উপহার

উপহার

সুপুরি গাছদুটোর পজিশনে কোনও ভুল হচ্ছে না তো?

সুবিমল চেয়ারে হেলান দিল। চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলের ওপর রাখল। প্যাকেট টেনে একটা সিগারেট বের করল। টেবিলের ওপর দু’বার ঠুকে আবার ঢুকিয়ে রাখল প্যাকেটে। গাছদুটো সমস্যা করছে। সমস্যাটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত অস্বস্তি কাটবে না। গাছদুটো ঠিক কোথায় ছিল? কোনদিকে?

সুবিমল ইন্টারকম তুলল।

‘প্রীতি, আজ আমার কতগুলো অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?’

খুব বাজে ধরনের সেক্রেটারিরাও বসের সারাদিনের কাজের তালিকা একেবারে ঠোঁটের ডগায় রাখে। শুধু সেদিনেরটা নয়, আগামী দু’-তিনদিনেরটাও কণ্ঠস্থ রাখা তাদের পক্ষে কোনও ব্যাপার না। কার সঙ্গে এবং কখন বসের মিটিং, লাঞ্চ, ডিনার তো বলতে পারবেই, এমনকী ম্যাডামের মার্কেটিং, ছেলের ক্রিকেট কোচিং, মেয়ের কলেজের ফাংশনের সময়ও তাদের কাছে জলভাত।

প্রীতি মোটেই বাজে ধরনের সেক্রেটারি নয়। গত পাঁচ বছর ধরে সে যথেষ্ট যোগ্যতার সঙ্গে এই অফিসে তার কাজ করে চলেছে। কিন্তু মুশকিল হল, কিছুতেই বসের কাজের তালিকা তার মুখস্থ হতে চায় না। বারবার গুলিয়ে যায়। আজ নতুন নয়, টানা পাঁচ বছর ধরেই এই গোলমাল চলছে। নানা কায়দায় সে এই গোলমাল কাটানোর চেষ্টা করেছে। আগের দিন লুকিয়ে কাগজে নাম, সময়, টুকে বাড়িতে নিয়ে গেছে। রাত জেগে পায়চারি করে পড়েছে। সকালে রিভাইজ দিয়েছে। বরকে দিয়ে পড়া ধরিয়েছে। তারপর অফিসে আসার পথে মেট্রোতে বিড়বিড় করতে করতে এসেছে— সাড়ে দশটায় ফিনান্স ম্যানেজার খাস্তগির, দশটা সাতান্নতে ওয়ার্কশপ সুপারভাইজার কৌশিক ভদ্র, এগারোটা কুড়িতে অ্যাক্রো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জি. এম ভডুকা…। পাশে বসা মহিলা এই বিড়বিড়ানি শুনে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে এবং সরে বসেছে। কিন্তু আসল কাজের কাজ কিছু হয়নি। বাধ্য হয়ে প্রীতি মন থেকে আর বসকে কিছু বলতে সাহস পায় না। জিজ্ঞেস করলে দেখে দেখে বলে। ঘরে ডাকলে হাতের নোটবুক খুলে, আর নিজের টেবিলে থাকলে কম্পিউটার টিপে দেখে নেয়। এই কারণেই রোজ অফিসে পৌঁছেই প্রীতি সবার আগে কম্পিউটার চালিয়ে নেয় এবং ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করে খুলে ফেলে।

প্রীতি আজ এখনও কম্পিউটার চালাতে পারেনি। তার আসতে দেরি হয়েছে। ইদানীং তার প্রায়ই দেরি হচ্ছে। মেয়ে সদ্য পক্স থেকে সেরে উঠেছে। শরীর দুর্বল। তাকে খাইয়ে আসতে হচ্ছে। আজ অবশ্য উলটোটা ঘটেছে। মেয়ে বিদ্রোহ করেছে, রোজ রোজ মায়ের হাতে সে খাবে না। সেই ঝামেলা সামলাতে গিয়ে আজ দেরি। প্রীতি রোজই একটা ভয়ের মধ্যে থাকে। আজ অফিসে ঢুকলে নির্ঘাত বসের বকুনি জুটবে।

ভাল করে টেবিলে বসতে-না-বসতেই ফোন— অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক’টা? নার্ভাস হয়ে মুখে যে সংখ্যাটা এল সেটাই বলে ফেলল প্রীতি।

‘স্যার, সাতটা।’

‘মোটে সাতটা? গুড, এমন কিছু নয়। প্রীতি, সাতটাই ক্যানসেল করে দাও। আজ আমার কোনও সময় নেই।’

এই শুরু হল। সাতই হোক আর সতেরোই হোক অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করা যে কতবড় হ্যাপার ব্যাপার প্রীতি তা ভাল করেই জানে। তালিকা ধরে ধরে ফোন করতে হবে। কখনও গম্ভীর গলায়, কখনও ন্যাকান্যাকা ভাবে বলতে হবে, ‘দুঃখিত, স্যার আজ খুব ব্যস্ত। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল।’ এইটুকু বললেই কি হয়ে গেল? মোটেই হল না। এরপরেও থাকবে হাজার প্রশ্ন। সেসব প্রশ্ন যদি বা সামলানো গেল, প্রত্যেকে তখন বলবে, ‘ঠিক আছে, তা হলে আর একটা তারিখ দিন। কাল দিন। কাল না হলে পরশু দিন। পরশু সকালে না পরশু বিকেলে করুন। ওনার ডায়েরিটা দেখুন। শিডিউল বলুন। মিসেস প্রীতি, আপনি চাইলেই পারেন। আপনি চাইছেন না, তাই পারছেন না। তা হলে এক কাজ করুন, লাইনটা ওঁর ঘরে দিন, আমি নিজেই কথা বলে নিচ্ছি।’

কিছুতেই ছাড়বে না। বসের অ্যাপয়েন্টমেন্টের অরিখ যেন খইয়ের মোয়া। কৌটো করে সেই মোয়া প্রীতি অফিসে নিয়ে এসেছে। চাইলেই একটা করে বের করে দেবে।

কাঁধ দিয়ে কানে ফোন চেপে ধরে প্রীতি দ্রুত কম্পিউটারের কী বোর্ড টিপছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফাইলটা বের করা গেছে, কিন্তু আজকের তারিখের পাতাটা পাওয়া যাচ্ছে না। মাউস হাতড়েও কিছু হচ্ছে না। এই রে, পাতাটা উড়ে গেল নাকি?

এই অবস্থাতেই প্রীতি ম্যানেজের চেষ্টা করে। তার আবছা মনে পড়ছে, মার্কেটিং আর প্রোডাকশনের জন্য কখন যেন সময় দেওয়া ছিল। সেটা কখন?

‘স্যার, মিটিংগুলো খুব আর্জেন্ট ছিল। বিশেষ করে মার্কেটিং আর প্রোডাকশন…।’

‘না না, কোনও সময় নেই। বলছি তো করব না। কিছু একটা বলে দাও। শরীর খারাপ, বিজি— যা খুশি।’

‘স্যার, ভিজিটর মিট করবেন তো?’

‘না, করব না! নেকস্ট উইকে ডেট দাও! না না, নেক্সট উইকে নয়, উনিশের পর আসতে বলো। আফটার নাইনটিন।’

প্রীতি হতাশ গলায় বলল, ‘স্যার, ফিনান্স থেকে কতকগুলো ইমর্পটান্ট ফাইল এসেছে। আমি কি আপনার কাছে নিয়ে যাব?’

‘না, নিয়ে আসবে না। আজ আমি কোনও ফাইল দেখতে পারব না। ফিনান্সে জানিয়ে দাও, আমার জন্য অপেক্ষা না করে পেমেন্টগুলো যেন ছেড়ে দেয়। আর কী আছে? কুইক, তাড়াতাড়ি বলে প্রীতি। আই অ্যাম ইন হারি। প্রীতি, তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না, আমি ভীষণ জরুরি একটা কাজের মধ্যে রয়েছি।’

প্রীতি ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়ার কারণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল নয়, ভেঙে পড়ার কারণ কম্পিউটারের পরদায় আজকের পাতাটা এই মুহূর্তে খুঁজে পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সাতটা নয়, আজ বসের সতেরোটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট। একথা এখন আর বলা যায় না। প্রীতির কপালে ঘাম জমে উঠল। খানিক আগে আজকের গোটা সিস্টেমে যে বিপর্যয় শুরু হয়েছিল, এখন তা মারাত্মক চেহারায় দেখা দিল। সাতের ধাক্কার থেকে সতেরোর ধাক্কা অনেক কঠিন।

ব্যাগ থেকে কোনওরকমে রুমাল বের করেছে প্রীতি। ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ‘স্যার, ডিনারটা কিন্তু যেতে হবে। কনস্যুলেটের ইনভিটেশন। না যাওয়াটা কি ঠিক হবে?’

সুবিমল ঠান্ডা গলায় বলল, না, ঠিক হবে না। তবু আমি যাব না। মিস্টার দত্তকে বলো ডিনারটায় তিনি যেন যান। এখনই বলে দাও। কনস্যুলেটের ডিনার জি. এম এক্সটারনাল গেলেও চলবে। শোনো প্রীতি, এখন কোনও টেলিফোন ঘরে দেবে না। আর হ্যাঁ, দু’কাপ কফি পাঠিয়ে দিতে বলবে, প্লিজ?’

ফোন নামিয়ে প্রীতি থম মেরে বসে রইল। তার ভাল লাগছে না। সতেরোটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করতে হবে বলে নয়। ভাল লাগছে না অন্য কারণে। আজ নয়, গত তিনমাস ধরে এই কাণ্ড চলছে। হুটহাট অফিসের কাজকর্ম সব বাদ দিয়ে মানুষটা কী করছে? প্রায় রোজই এমন সব লোকদের ডেকে পাঠিয়ে ঘরে গুজগুজ ফুসফুস করছে, যাদের সঙ্গে এই অফিসের কোনও সম্পর্ক নেই। ব্যাপারটা কী? কী এমন কাজ? খরাপ কিছু নয় তো? বড়লোকদের হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়ার ঘটনা কম শোনা যায় না। বস ভাল না মন্দ বোঝা খুব শক্ত। কিন্তু এই মানুষটার ক্ষেত্রে সহজেই বোঝা গেছে। মানুষটা ভাল। বেশ ভাল।

প্রীতি বুঝতে পারছে না, কী করা উচিত। তবে একটা কিছু যে করা উচিত সেটা বুঝতে পারছে। সতেরোটা মিটিং বাতিল করে তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। চিন্তা হচ্ছে। ম্যাডামের সঙ্গে একবার কথা বললে কেমন হয়? বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে? বস জানতে পারলে রেগে যাবে? রেগে তো যাবেই। তিন পয়সার সেক্রেটারির বাড়াবাড়িতে রেগে যাবে না তো খুশিতে ডগমগ হয়ে অফিসের সবাইকে সন্দেশ খাওয়াবে?

কান্টিনে কফির অর্ডার দিয়ে প্রীতি নোটবইটা টেনে নিল।

ম্যাডামের নম্বরটা যেন কত? ছিঃ, সামান্য একটা টেলিফোন নম্বরও কি সে কখনও মনে রাখতে পারবে না?

‘ম্যাডাম, আমি প্রীতি বলছি।’

‘আরে প্রীতি, কী খবর? কেমন আছ?’

‘ভাল আছি ম্যাডাম। আপনি কেমন আছেন?’

‘ভাল আছি। তোমার মেয়ের খবর বলো। পক্সের পর ক’টা মাস কিন্তু খুব কেয়ারফুল থাকবে।’

‘কেয়ারফুল আছি ম্যাডাম।’

‘দাগগুলো সব গেছে?’

‘না, এখনও কপালে কয়েকটা আছে।’

‘তুমি একটা কাজ করো। রোজ ডাবের জলের সঙ্গে অল্প একটু গোলাপ জল দিয়ে মুখ ধোয়াও।’

‘ধোয়াব ম্যাডাম। ম্যাডাম, একটা কথা ছিল। বলব?’

‘সেকী, বলবে না কেন? তুমি হেজিটেট করছ কেন? এনিথিং সিরিয়াস প্রীতি?’

‘ঠিক বুঝতে পারছি না ম্যাডাম। কখনও মনে হচ্ছে সিরিয়াস, কখনও মনে হচ্ছে, সিরিয়াস নয়।’

‘ইন্টারেস্টিং।’

‘ম্যাডাম, আপনি কিন্তু স্যারকে বলবেন না।’

‘ঠিক আছে, বলব না। তুমি বলো।’

‘ম্যাডাম, স্যার আজ সতেরোটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করেছেন। যদিও উনি জানেন সাতটা…।’

সুবিমল সোজা হয়ে বসল। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল। তারপর টেবিলে পাতা নকশার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘নরেনবাবু, আপনাকে কি ব্যাপারটা বোঝাতে পারছি? এই পরিকল্পনায় সুপুরি গাছ দুটো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলতে পারেন মোস্ট ইমপর্ট্যান্ট। মানুষের স্মৃতি অনেক কিছু ভুলে যায়, কিন্তু গাছের পজিশন কখনও ভোলে না। ধরুন, ছেলেবেলায় আপনার বাড়ির পেছনে একটা আমগাছ ছিল। এখন আর গাছটা নেই। আপনি কিন্তু চিরকাল বলে যাবেন, আমাদের বাড়ির পেছনে একটা আমগাছ ছিল। কখনও বলবেন না, বাড়ির সামনে আমগাছ ছিল। এই ভুল আপনার হবে না। অ্যাম আই কারেক্ট মিস্টার মিত্র?’

নরেন মিত্রর ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। এসিটা বড় জোরে চলছে। বড় কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরদের ঘরগুলো এরকমই হয়। ঘর বাড়াবাড়ি রকমের ঠান্ডা করে রাখা হয়। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এসব ঘরে শুধু সুট-টাই অচল। একটা কম্বল থাকলে ভাল হত। বেশ কম্বল জড়িয়ে মিটিং করা যেত। তবে এখন ঠান্ডা গরমের দিকে মন দেওয়াটা ঠিক নয়। অর্ডারটা খুবই বড়। বড় এবং অভিনব। গত সতেরো বছরে তার কোম্পানি অনেক বড় বড় কাজ করেছে। বাড়ি, মার্কেট কমপ্লেক্স, জলাধার। কিন্তু এ ধরনের কাজ কখনও করেনি। একটা অন্য রকম মজা আছে। তিনমাস হল কাজটা চলছে। এখন একেবারে শেষ পর্যায়ে। এই অবস্থায় এসে সামান্য ঘরের ঠান্ডা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও অর্থই হয় না। উলটে মাথা ঠান্ডা করে সাবধানে চলতে হবে। ছোটখাটো ভুলও যেন না হয়। মনকেও সাবধান রাখতে হবে। সফল হওয়ার সব থেকে আসল উপায় হল, মনকে সাবধান রাখা।

নরেন সামান্য হেসে বলল, ‘ঠিকই স্যার। গাছের পজিশন নিয়ে কেউ কখনও ভুল করবে না।’

মিস্টার মিত্র, নকশায় আপনি বলছেন, গাছদুটো থাকছে ইস্টে। ঠিক ইস্টে নয়, খানিকটা নর্থ-ইস্ট, উত্তর-পূর্বে বলাই ভাল। তাই তো?’

‘হ্যাঁ স্যার, গাছদুটো পুবদিকেই থাকছে, একটু উত্তর ঘেঁষা। সুপুরি গাছ স্যার পুবদিকেই পোঁতা হয়।’

সুবিমল চোখ কুঁচকে বলল, ‘আপনি শিয়োর? পুবদিকেই পোঁতা হয়?’

‘টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়োর স্যার। আমি স্যার মধু মল্লিকের সঙ্গে কালও কথা বলেছি। উনি বললেন, পাড়াগাঁয়ে এই জিনিসটা ফলো করা হয়। ফার্স্ট আওয়ারের সান লাইটটা নাকি সুপুরি গাছের পক্ষে প্রয়োজনীয়।’

‘মধু মলিক কে?’

নরেন বলল, ‘মধু মল্লিকের কথা স্যার আমি আপনাকে আগেই বলেছি। আপনার হয়তো খেয়াল নেই। ভদ্রলোক একসময় বোটানিক্যাল গার্ডেনের চিফ গার্ডেনার ছিলেন। অবসর নিয়ে নিজে কাজ করছেন। আপনার এই প্রজেক্টের গোটা গাছপালা ব্যাপারটা উনিই দেখছেন স্যার। এ বিষয়ে ওনার অনেক পড়াশোনা।’

সুবিমল নরেনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটাই তো মুশকিল। অনেক পড়াশোনাতে ছোটখাটো জিনিস গোলমাল হয়ে যায়। আপনি একটা কাজ করুন, মিস্টার মল্লিককে খবর দিন! আই ওয়ান্ট টু মিট হিম। শুধু সুপুরি নয়, সবটাই এর কাছ থেকে শুনব। জবা, কামিনী, গোলাপ, গাঁদা, পুঁইশাক, কাঁচা লঙ্কা— যা যা প্ল্যানে আছে সবটাই শুনব। এভরিথিং।’

‘অবশ্যই স্যার। অবশ্যই শুনবেন। আমি তা হলে কালই আসতে বলি? একটা কাজ করলে ভাল হত। কাল সকালে আপনি যদি একবার স্পটে যান। বাড়ি আর পুকুর ঘাটটাও আপনার একবার দেখে নেওয়া দরকার।’

সুবিমল চিন্তিত গলায় বলল, ‘কেন, সেগুলোতে আবার কোনও গোলমাল হল নাকি?’

‘না না, কোনও গোলমাল নয়। সবটাই প্ল্যান অনুযায়ী হয়েছে। তবে খুঁটিনাটি ব্যাপার গুলো নিয়ে তো সবসময়ই সন্দেহ থেকে যায়।’

‘এই কাজে তো খুটিনাটিগুলোই আসল মিস্টার মিত্র।’

ক্যান্টিনের ছেলেটা এসে কফি দিয়ে গেল। নরেনের দিকে কাপ এগিয়ে সুবিমল নিজের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিল। বলল, ‘হাতে তো আর একদম সময় নেই। এর মধ্যে খুঁটিনাটি সব ঠিক করে ফেলতে হবে। নরেনবাবু, আপনাকে আগেও বলেছি, আবার বলছি, মনে রাখবেন, জিনিসটা কিন্তু সিনেমার সেট বা পুজোর প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে না। তাই যদি হত, তা হলে আমি মুম্বাই বা সাউথের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে কাউকে নিয়ে আসতাম। সত্যি কথা বলতে কী, আমার মেজভাই বিমল বাঙ্গালোর থেকে আমাকে বলেছিল, সে ওখান থেকে সবটা অ্যারেঞ্জ করতে পারবে। প্রথমদিকে বিমলের কথায় আমি খানিকটা কনফিউজড হই। ভাবলাম, ঠিক আছে। আমরা ভাই-বোনেরা যা চাইছি সেটা যদি ওরা করে দিতে পারে তা হলে ক্ষতি কী? কিন্তু তারপর আমি বোস্টনে আমার বোন সুনন্দার সঙ্গে কথা বলি, জামসেদপুরে কথা বলি ছোটভাই অমলের সঙ্গে। ওরা দু’জনেই বলল, নো, সেট ডিজাইনারের কাজ এটা নয়। সিনেমার সেটের মধ্যে একটা লোক ঠকানো ব্যাপার রয়েছে। মনে হয়, কিন্তু আসলে সত্যি নয়। আমরা সেটা চাই না।’

নরেন ঢোঁক গিলে বলল, ‘নিশ্চয় স্যার, অবশ্যই স্যার। তবে পুরোটা তো সত্যি করা যাবে না। ধরুন, এইসব বড় বড় গাছ। এগুলো তো স্যার অন্য জায়গা থেকে নিয়ে গিয়ে লাগাতে হয়েছে।’

সুবিমল কাপ সরিয়ে রেখে বলল, “ইয়েস, সবটা সত্যি হবে না। আমরা সেটা জানি। কিন্তু ভেরি ক্লোজড টু দ্য ট্রুথ। সত্যির যতটা কাছে যাওয়া যায় আমাদের যেতে হবে। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। টাকাটা এখানে ম্যাটার করছে না।’

‘অবশ্যই স্যার। মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, দালান, পুকুর, কঞ্চির বেড়া, গোয়াল, তুলসী মঞ্চ, লাউয়ের মাচা, এগুলো আমরা নিখুঁতভাবেই করেছি। স্যার, একটা ছোট ধানের গোলা করে দেব? এই যে এইখানে।’

নরেন টেবিলে পাতা ছবির একদিকে আঙুল দেখায়।

‘ধানের গোলা? ধানের গোলা কি ছিল? দিদিমার কাছে ধান ভাঙার একটা ঢেঁকির কথা শুনেছিলাম। আপনি ঢেঁকি জোগাড় করতে পেরেছেন?’

নরেন অল্প হেসে বলল, ‘প্রথম দিকে সমস্যা হচ্ছিল। এখন মিটে গেছে। কাটোয়াতে লোক গেছে। কালকের মধ্যে চলে আসবে। দুটো ঢেঁকি আনাচ্ছি স্যার। এক্সট্রা থাকা ভাল। একটা গোলমাল করলে আর একটা বসিয়ে দেব।’

‘গুড। ভেরি গুড।’ সুবিমল সামান্য হেসে বলল, ‘ধন্যবাদ মিস্টার মিত্র। আপনার কথা শুনে, আমার অনেক নিশ্চিন্ত লাগছে। বুঝতে পারছি, আপনি আমাদের সেন্টিমেন্টটা বুঝতে পারছেন। আমি গোড়াতেই বুঝেছিলাম বাইরের কারও পক্ষে এই সেন্টিমেন্টটাকে ফিল করা সম্ভব নয়।’

‘স্যার, একটা কথা বলব?’

সুবিমল কফির কাপ সরিয়ে রেখে বলল, ‘নিশ্চয় বলবেন।’

‘উনি কি কিছুই বলতে পারবেন না? যদি একটু-আধটুও বলতেন। তা হলে আমি মন-প্রাণ দিয়ে সেই, ডিটেলটা প্রজেক্টে আনবার চেষ্টা করতে পারতাম।’

‘সরি মিস্টার মিত্র, আপনাকে তো বলেছি, এটা সম্ভব নয়। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই বাবা চুপচাপ হয়ে যান। লাস্ট সেভেন ইয়ার্স বাবা কোনও কথাই বলতে পারেননি। খানিকটা স্মৃতিভ্রংশের মতো। প্রথমে আমরা ভাবলাম, আলঝাইমার ধরনের কোনও অসুখ। সঙ্গে প্যারালাইসিস। আমার বোন সুনন্দা আর তার স্বামী দু’জনেই ডাক্তার। ওরা বোস্টনে থাকে। চিকিৎসার জন্য বাবাকে নিয়ে গেল। কোনও লাভ হয়নি। এখানকার ভাক্তাররা বললেন, বাবা শুধু কথা বলতে পারেন না তা নয়, উনি আর কথা বলতে চান না। জীবনের প্রতি একটা অনীহা একটা রিফিউজাল তৈরি হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, অসুখটা ঠিক কী কেউ বলতে পারল না। আপনার কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে মিস্টার মিত্র।’

‘তারপর?’ কফির কাপ হাতে নিয়ে নরেন জিজ্ঞেস করল।

তারপর আর কী, কিছুই নয়। নাউ হি হিজ ওয়েটিং ফর হিজ ডেথ। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন। প্র্যাকটিক্যালি নো সেন্স। সুখ-দুঃখ কোনও কিছুই আর মানুষটাকে স্পর্শ করতে পারে না। সবেতেই নির্বিকার। নির্লিপ্ত। হাসি-কান্না কিছুই নেই। টোটাল একটা ভেজিটেবল। জড় পদার্থের মতো বিছানায় পড়ে আছেন। বাবার দিকে তাকালে আমাদের খুব খারাপ লাগে। এত কষ্ট করে চার চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন, বাট হি কান্ট এনজয় হিজ সাকসেস।’

সুবিমল আরও একটা সিগারেট ধরাল। তারপর খানিকটা আপনমনেই বলল, ‘সামনের মাসের উনিশ তারিখ বাবার জন্মদিন। নব্বই বছরে পা দিচ্ছেন। আমরা। ছেলেমেয়েরা ঠিক করেছি, এই নব্বুই বছরের জন্মদিনে বাবাকে তার চাইল্ডহুডের একটা পার্ট উপহার দেব। তাঁর শৈশবের খুব সামান্য একটা টুকরো। সেই টুকরোটাই আপনি তৈরি করছেন। আমার বাবার দেশের বাড়ি। আমরা জানি, জিনিসটা দেখে তিনি কোনওরকম রিঅ্যাক্ট করবেন না। সেটার প্রোবাবিলিটি সব থেকে বেশি। কিন্তু আমাদের ভাল লাগবে। নব্বই বছরের এক বৃদ্ধের জন্মদিনে তাঁর ছেলেমেয়েরা এর থেকে বেশি কী বা দিতে পারে মিস্টার মিত্র?’

নরেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে আছে। তার হাতে কফির কাপ। ঠান্ডা হয়ে গেছে। এ তার কী হচ্ছে ? কলকাতার একজন দুঁদে কনট্রাক্টর সে। যার জীবন মাত্র দু’রকমের। লাভের আর লোকসানের। তার কেন এমন হবে? ক্লায়েন্টের কথা শুনে মন দুর্বল হবে কেন? নিজেকে সামলে সে বলল, ‘সরি স্যার। আমি ঠিক এতটা জানতাম না।’

‘ইটস ওকে মিস্টার মিত্র। আমি বুঝতে পারছি, আপনাকে একটা খুব কঠিন কাজ হাতে নিতে হয়েছে। আমার বারাসতের তিনবিঘা জমির ওপর বাবার হারিয়ে যাওয়া দেশের বাড়িটা আপনাকে বানাতে হচ্ছে স্রেফ গল্পের ওপর দাঁড়িয়ে। আমরা তো কেউ ওই বাড়ি দেখিনি। স্কুল শেষ করেই বাবাকে সেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়। প্রচণ্ড অর্থাভাবে আমার ঠাকুরদা সেই বাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ছোটবেলায় বাবার মুখে আমরা যেরকম গল্প শুনেছি, আপনাকে আমরা বলবার চেষ্টা করেছি। যখন যেরকম মনে পড়েছে। ছেঁড়া ছেঁড়া গল্প, ঘটনা। সব মিলিয়ে একটা অস্পষ্ট ছবি। ইটস গ্রেট যে আপনার এঞ্জিনিয়াররা তার ওপর দাঁড়িয়ে প্ল্যান তৈরি করেছেন। সেটা ঠিক না ভুল, আদ্দেক না পুরো কিছুই আমরা জানি না। কিন্তু আমরা এটা জানি যে আমরা চেষ্টা করছি। আমাদের কোনও ফাঁকি ছিল না।’

নরেন গাঢ় গলায় বলল, ‘স্যার, আমিও চেষ্টা করব। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমি মন দিয়েই চেষ্টা করব।’

রাতে খাওয়ার শেষে সুবিমল পুডিং খায়। খুবই সামান্য। মাত্র এক টুকরো। রাঁধুনি সব রান্না করলেও মায়া এটা নিজের হাতে বানায়।

সোফায় বসে সুবিমল অনেকটা সময় ধরে পুডিংয়ের এই টুকরোটুকু খায় এবং স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করে।

বাড়ির কাজের লোকেরা আড়ালে এই পুডিংকে বলে ‘গল্প পুডিং’।

আজ ‘গল্প পুডিং’ হাতে নিয়েও সুবিমল চুপচাপ।

মায়া হেসে বলল, ‘অত চিন্তা করছ কেন? দেখবে সব ঠিকঠাক হবে।’

সুবিমল অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘সেটাই তো চিন্তার। তোমার মতো সবাই আমার ওপর নির্ভর করে আছে। তা ছাড়া জিনিসটা প্রথমে আমার মাথা থেকেই আসে। এখন যদি কিছু ভুল হয়ে যায়।’

‘একটু-আধটু ভুল ঠিকে কিছু যাবে আসবে না। টাকা তো অনেকেরই থাকে, কিন্তু এমন চমৎকার একটা জিনিস কতজনে ভাবতে পারে? তুমি বেশি চিন্তা করছে। আর তো মাত্র ক’টা দিন। তুমি কি নিজে একবার ওখানে গিয়েছিলে? আমার তো খুব যেতে ইচ্ছে করছে। বাবাই বলছিল, মা, বাবাকে বলো। আমি ক্যামেরা নিয়ে যাব। এমন একটা দুর্দান্ত জিনিস কেমনভাবে তৈরি হচ্ছে তার ফোটো তুলে রাখা উচিত।’

এতক্ষণ বাদে সুবিমল অল্প হাসল। বলল, ‘এটা একটা সারপ্রাইজের মতোই থাকুক না। আমি তো নিজেও যাচ্ছি না। বাবা আগে দেখবেন, তারপর আমরা। সেটাই ভাল হবে না?’

মায়া খুব ভাল করেই বুঝতে পারছে, তার শ্বশুরের কিছু দেখা এবং না-দেখা দুটোই এই মুহূর্তে সমান। তবু সে সুবিমলকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলল, সেটাই ভাল। আমি বাবাইকে বুঝিয়ে বলল। ঠাকুরদার জন্য এই স্যাকরিফাইসটুকু সে নিশ্চয় করতে রাজি হবে।’

সুবিমল খানিকটা নিজের মনেই বলল, নরেন মিত্রর ওপর ভরসা করে ভুল হয়নি মনে হচ্ছে। তবে দু’-একটা ছোটখাটো সমস্যা হচ্ছে।’

মায়া আগ্রহ দেখিয়ে বলল, ‘কী সমস্যা।’

‘এই ধরো, দুটো সুপুরি গাছের পজিশন। গাছদুটো ঠিক কোথায় ছিল বুঝতে পারছি না। তারপর ধরো ধানের গোলা। ধানের গোলা কি ছিল? বাবা আমাদের এ সম্পর্কে কখনও কিছু বলেছেন কিনা মনে করতে পারছি না। যাই হোক, আর একটু চেষ্টা করে দেখি। মায়া, তোমাকে কিন্তু একটা কাজ করতে হবে। উনিশ তারিখ এখানে কারা কারা যাচ্ছে, তার একটা লিস্ট তৈরি করবে। ছোট লিস্ট। এটা একেবারেই পারিবারিক অনুষ্ঠান। পরিবারের বাইরের ভিড় না হওয়াই ভাল।’

মায়া হেসে বলল, ‘আমি কিন্তু লিস্টে একজনকে রাখব। তুমি না বলতে পারবে না। সে হবে আমার বিশেষ নিমন্ত্রিত।’

সুবিমল স্ত্রীর দিকে চেয়ে হেসে বলল, ‘আচ্ছা, না বলব না।’

শুতে যাওয়ার আগে সুবিমল দুটো টেলিফোন করল। জামসেদপুরে ছোট ভাই অমলকে এবং বোস্টনে বোন সুনন্দাকে। জামসেদপুরে লাইন পেতে একটু অসুবিধে হল। অমল উত্তেজিত গলায় বলল, ‘ধানের গোলা? কই, ধানের গোলা ছিল বলে তো কখনও শুনিনি। তবে হ্যালো, হ্যালো, দাদা, একটা খুব ইমপর্ট্যান্ট কথা মনে পড়ে গেছে। আমি কাল সকালেই তোকে ফোন করতাম। একসময় বাবা আমাকে একটা ছাগলের গল্প করেছিল।’

‘ছাগল!’

‘ইয়েস, ছাগল ছাগলছানা। কমপ্লিট ব্ল্যাক। কুচকুচে কালো, শুধু দ্য টেল ওয়াজ হোয়াইট। ল্যাজটুকু সাদা। ক্লাস টু না থ্রি-তে বাবার মুখে শোনা সেই ছাগলের গল্পটা আজ সাইটে কাজ করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল। ছাগলছানাটা নাকি খুব ছটফটে ছিল, খালি লাফাত। নাউ আই ক্লিয়ারলি রিমেম্বার যে বাবা আমাকে বলেছিল, ছাগলটার নাম ছিল ‘লাফানি’। ইয়েস ‘লাফানি’। শুনতে পাচ্ছিস দাদা, লাফাত বলে লাফানি। বাবা ‘লাফানি’র সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছে। ইভেন আমার মনে পড়ছে, একটা জ্বরের সময় দুপুরে বাবা আমাকে লাফানির গল্পটা বলছে, আর আমি গা ভরতি জ্বর নিয়েও হাসছি। বাবা বলল, ভাল করে হাস। ভাল করে হাসলে জ্বর কমে যায়। তুই বিশ্বাস করবি না দাদা, আমার মনে আছে, বিকেলে তোরা যখন স্কুল থেকে ফিরলি, দেখি আমার জ্বর সত্যি সত্যি ছেড়ে গেছে! দাদা, চুপ করে আছিস কেন? শুনতে পাচ্ছিস?’

সুবিমল গাঢ় গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি। তুই বল।’

‘দাদা, তুই মিস্টার মিত্রকে বল, ওখানে ছাগলটাকে চাই। হোয়াটএভার মে বি দ্য প্রাইস। বাকি সবকিছু ঠিক আছে তো? আমি দু’দিন আগেই পৌঁছোচ্ছি।’

বোস্টনে জামসেদপুরের থেকে তাড়াতাড়ি ফোনের লাইন ঢুকে গেল। সুনন্দা হাসপাতালে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ফোন ধরেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দাদা, টিকিট হয়ে গেছে। সতেরোই রাতে এয়ারপোর্টে গাড়ি রাখবি।’

প্লেনের সময় জানার পর সুবিমল বোনের কাছে ধানের গোলা সম্পর্কে প্রশ্ন করল।

‘গোলা?’ তুই এক কাজ কর দাদা, কাল সকালেই একবার সন্তোষপুরে পিসিমার কাছে যা। যদিও পিসিমার অনেক বয়স হয়েছে। কতটা মনে করতে পারবে বলতে পারছি না। তাও তুই নিজে গিয়ে একবার জিজ্ঞেস কর। বাড়িতে ধানের গোলা থেকে থাকলে নিশ্চয় বলতে পারবে। ও তো আর ছোটখাটো ব্যাপার নয় যে চোখ এড়িয়ে থাকবে।’

‘আমি আজই অফিস ফেরত সন্তোষপুর গিয়েছিলাম। দুটো সুপুরি গাছের পজিশন নিয়ে কনফিউশন হচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও পিসিমা বলতে পারল না। তবে একটা অন্য জিনিস বলেছে। জিনিসটা মনে হচ্ছে ঝামেলার।’

‘ঝামেলার জিনিস!’

‘পিসিমা বলল, বাড়ির পুকুরটা থেকে নাকি মাঝে মাঝে মাছের ঘাই মারবার আওয়াজ শোনা যেত। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে ভাই-বোনে সেই ঘাইয়ের আওয়াজ শুনত।’

খানিকটা চুপ। তারপর সুদুর বোস্টন থেকে সুনন্দার ফোঁপানির শব্দ ভেসে এল, ‘দাদা, উই নিড দিস সাউন্ড। এই আওয়াজটা আমাদের চাই। প্লিজ অ্যারেঞ্জ। প্লিজ।’

গভীর স্নেহে সুবিমল বলল, ‘কাঁদিস না সুনন্দা। আমি চেষ্টা করব। অবশ্যই চেষ্টা করব।’

আজও ঠিক সময়ে আসতে পারেনি প্রীতি। অনেক চেষ্টা করেছিল, হয়নি। মাঝখান থেকে ট্যাক্সির পেছনে গাদাখানেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। খুবই বিরক্ত লাগছে। এমন একটা সময় মাঝবয়সি একটা লোক টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। প্রীতি মুখ তুলে দেখল, লোকটার হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, গায়ে ময়লা ফতুয়া, এবং কাঁধে গামছা। লোকটার থেকে বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে।

প্রীতি আঁতকে উঠল। এরকম একটা লোক তার টেবিল পর্যন্ত এল কী করে?

‘একী, কে আপনি?’

লোকটা দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘দিদি, আমার নাম বট্টব্যাল। ঘনশ্যাম বট্টব্যাল। এখানকার বড়সাহেব নরেনবাবু মারফত আমাকে খবর পাঠিয়েছেন। তাই এলুম। আমি দিদি, পশু পক্ষী সাপ্লাই করি। ক্যানিংয়ে আপিস আছে।’

প্রীতি অবাক হয়ে বলল, ‘কী করেন?’

‘পশু পক্ষী সাপ্লাই করি। ইদানীং মাছও করছি। তবে ছোট মাছ নয়, বড় মাছ। জলে পড়লে ঘাই মারে। ঝপাং ঝপাং আওয়াজ হয়।’

প্রীতি প্রায় উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘আপনার এখানে কী চাই? এটা তো চিড়িয়াখানা নয়।’

ঘনশ্যাম বট্টব্যাল দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘হে হে, কী যে বলেন দিদি। আমার কিছু চাই না। এখানকার বড়সাহেবের চাই। একটা ছাগলছানা চাই। পুরোটা বেলাক, শুধু নেজটুক সাদা।’

লোকটা প্রীতির দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘বড়সাহেবকে খবর দেন। বলেন, বট্টব্যাল দুটো ছাগলছান এনেছে। ভ্যানে বাঁধা আছে। সাহেব কি বাইরে গিয়ে দেখে আসবেন, নাকি আমি ওদের ভেতরে নিয়ে আসব? আমার মনে হয় ভেতরে আনাই ভাল। সাহেবকে আবার কষ্ট করে বাইরে যেতে হবে। আপনি কী বলেন দিদি?’

বসের ঘরের দিকে যেতে যেতে প্রীতির মানটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। আহা রে, একটা ভালমানুষ একদম বদ্ধ পাগল হয়ে গেল? আশ্চর্য, ম্যাডামও কিছু করতে পারল না।

উনিশ তারিখ বেলা দশটার কিছু পরে চারটে বড় গাড়ি এবং একটা শীততাপ অ্যাম্বুলেন্সের বিশাল কনভয় এসে দাঁড়াল গাছের ছায়ায়।

সামনেই একটা নিচু বাঁশের বেড়া। বেড়ার গায়ে ছোট্ট দরজা। কঞ্চি দিয়ে বানানো সেই দরজা নারকোল দড়ি দিয়ে বেড়ার সঙ্গে বাঁধা। কঞ্চির সেই দরজা ঢেকে আছে নব্বইটা লাল গোলাপ।

অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে বিশ্বনাথবাবুকে বসানো হল হুইল চেয়ারে। দাড়ি কামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধবধবে সাদা চুল, আঁচড়ানো। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, একটা সাদা মানুষ।

উনি কিছু কি বুঝতে পারছেন? মনে হচ্ছে না পারছেন। তবে চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরেছেন। এই হুইল চেয়ার খুবই আরামদায়ক। দু’দিন আগে সুদূর বোস্টন শহর থেকে তার মেয়েজামাই নিয়ে এসেছে।

নরেন মিত্র আজ তার ব্যাবসার নিয়ম ভেঙেছে। সুট-টাইয়ের বদলে পরেছে পাজামা, পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিতে ফুলকাটা নকশা। শুধু তাই নয়, নিমন্ত্রিত না হওয়া সত্ত্বেও নরেন তার স্ত্রী এবং দুই ছেলেকে নিয়ে এসেছে। এই কারণে তার মুখে একটা লজ্জা লজ্জা হাসি।

একটু পরেই ফুল-গাঁথা কঞ্চির দরজা খুলে বিশ্বনাথবাবুর চার ছেলেমেয়ে, জামাই, পুত্রবধূ আর এক ঝাঁক নাতি-নাতনি হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

ম্যাডামের ‘বিশেষ নিমন্ত্রিত’ হলে কী হবে, প্রীতি এখানেও আসতে দেরি করেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সবার পরে এসে পৌঁছেছে। পৌঁছে এত আনন্দ হচ্ছে যে, ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে বসকে একটা প্রণাম করে। সবার সামনে বসকে প্রণাম করাটা কি ঠিক হবে?

‘দেশের বাড়ির’র দালানে খাওয়ার আয়োজন হয়েছে।

এই দালান মাটি লেপা। সোঁদা গন্ধ উঠছে। পরিবেশনের দায়িত্বে রয়েছে বিমল। খাবার দেওয়া হয়েছে কলাপাতায়। সুবিমল নিজের হাতে বাগানের কলাগাছ থেকে সেই পাতা কেটে এনেছে। অমলের তত্ত্বাবধানে পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হয়েছে। শুরুতেই সেই মাছ ভেজে দেওয়া হয়েছে সকলকে।

সুনন্দার আট বছরের ছেলে বিদেশে থাকায় ভাল করে বাংলা বলতে পারে না। মাছভাজা দেখে সে চিৎকার করে উঠল, “পুখুরের মাস, পুখুরের মাস”।

সবাই হেসে উঠল। হাসির আওয়াজে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছোট্ট ছাগলছানা লাফ দিয়ে ছুট লাগাল ধানের গোলার দিকে। ছানাটা কুচকুচে কালো। ল্যাজটুকু শুধু সাদা।

বিশ্বনাথবাবুও আজ কলাপাতায় খাচ্ছেন। নার্স বেচারির অসুবিধে হচ্ছে। সে আগে কখনও কোনও রোগীকে কলাপাতায় খাওয়ায়নি। কলাপাতার ওপর চামচ ঠিকমতো চলছে না।

সুনন্দা এগিয়ে এসে বলে, ‘সিস্টার, আমাকে দিন। আমি বাবাকে খাইয়ে দিচ্ছি’।

তবে সুনন্দাও তেমন সুবিধে করতে পারছে না। করবে কী করে?

সে একই সঙ্গে বুড়োমানুষটাকে খাওয়াচ্ছে এবং তার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে। নব্বুই বছরের বিশ্বনাথবাবু আজ অনেকদিন পর মনভরে কাঁদছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *