উপসংহার

উপসংহার 

একটা গোল টেবিলের চারদিকে মুখোমুখি বসে চারটে ছেলে। চোখ বোজা। হাতে হাতে ধরা। অন্ধকার ঘরের কোথাও কোনও দরজা জানলা খোলা নেই, তবু টেবিলের উপরে পেতলের মোমদানিতে জ্বলতে-থাকা মোমটার শিখা মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক নড়েচড়ে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। হয়তো বা তাকে ঘিরে বসে থাকা মানুষগুলোর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের দমকেই হবে। ঘরের মধ্যে জমাট বাঁধা নীরবতা। ছেলেগুলোর বয়স খুব বেশি হলে চোদ্দ পনেরো। 

জুন মাসের গুমোটে সবার কপালেই বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দু-এক ফোঁটা কপাল বেয়ে নেমে জুলপির কাছে জমে আছে। কিন্তু ঘাম মোছার তাগিদেও হাতের বন্ধন ছাড়ার উপায় নেই তাদের। মোমের আলো ঘরের দেওয়ালে লম্বা লম্বা অপার্থিব ছায়া তৈরি করেছে। আচমকাই ওদের মধ্যে একজনের মাথা ঝুলে পড়ল বুকের উপর। একটা অস্পষ্ট গোঁ গোঁ শব্দ বেরিয়ে এল তার গলা থেকে। প্রায় একই সঙ্গে চোখ খুলে গেল বাকি তিনজনের। মুহূর্তের জন্য একে অন্যের দিকে চাইল তারা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে শীর্ণকায় ছেলেটি মৃদু হাঁফাচ্ছে। তার কপাল বেয়ে দর দর করে নেমে আসছে ঘামের স্রোত। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে প্রচণ্ড ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। ঠিক উলটোদিকে বসা বড় চেহারার ফর্সা ছেলেটি কপাল কুঁচকে ইশারা করে বার বার তাকে শান্ত হতে বলছে। নিজেকে সামলানোর প্রবল চেষ্টায় দাঁতে দাঁত চেপে রয়েছে শীর্ণকায় ছেলেটি। চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে উঠেছে তার। ইতিমধ্যে তৃতীয় ছেলেটি মিডিয়ামকে লক্ষ্য করে কিছু প্রশ্ন করছে। কিন্তু স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না তাদের কথোপকথন। হঠাৎ মিডিয়ামের ঝুলে পড়া মাথা সোজা হয়ে গেল। বড় বড় বিস্ফারিত চোখ মেলে তাকাল সে সরাসরি শীর্ণকায় ছেলেটির দিকে। সে চোখে দৃষ্টি নেই। সম্পূর্ণ সাদা। মুখ খুলে হাসছে সে। কালো কালো ক্ষয়-পড়া দাঁতের ফাঁক দিয়ে সরীসৃপের মতো জিভটা লকলক করে বেরিয়ে আসছে বারবার। একটা তীব্র চিৎকার, অলৌকিক হাসির শব্দ আর তার মধ্যেই আর একটা অসহায় কণ্ঠ, “সার্কেল ভাঙবি না, যাই হয়ে যাক সার্কেল ভাঙবি না।” 

তীব্র স্বরে টেলিফোন বেজে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল ডঃ অজয় ঘোষের ঘরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের আরামদায়ক শীতলতা সত্ত্বেও ঘামে শরীর ভিজে গেছে তাঁর। হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলতে গিয়ে দেহটা সামান্য বাঁকাতে হল। আর ঠিক তখনই ঘাড়ের ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে উঠে বসলেন তিনি। এসবের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল ফোনের রিং। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠলেন ডঃ ঘোষ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মৃদু শব্দ যেন ঘুমপাড়ানি গান। পাশে অঘোরে ঘুমোচ্ছে অনিন্দিতা। আজকাল ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুম আসে না ওর। তাই টেলিফোনের শব্দও ওকে জাগাতে পারেনি। জলের বোতলটা হাতে নিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ডঃ ঘোষ। পনেরো তলা ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে বাইরের পৃথিবীটা বড় মায়াময় লাগে। বিশেষ করে রাতে। অনেক নীচে রাতের কলকাতার রাস্তা দিয়ে তিরবেগে চলে যাচ্ছে এক একটা গাড়ি। তাদের হেডলাইটের আলোটুকুই কেবল দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। ঢক ঢক করে বেশ খানিকটা জল গলায় ঢেলে আবার বিছানায় এসে উঠলেন ডঃ ঘোষ। পায়ের কাছ থেকে চাদরটা টেনে গায়ে দিয়ে শুতে যাবেন, এমন সময় আবার সশব্দে বেজে উঠল ফোনটা। রাতের ফোন অবাক করে না ডাক্তারদের। এবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভার তুললেন তিনি। 

“হ্যালো, ডঃ অজয় ঘোষ স্পিকিং।” ওপাশে একটা পরিচিত গলার স্বর। ডঃ ঘোষের অ্যাসিস্ট্যান্ট পলাশ। 

“স্যার, একবার আসতে হবে।” ফোনটা কেটে আর একটা নম্বর ডায়াল করলেন ডাক্তারবাবু। ড্রাইভার রাজেশ ডাক্তারবাবুর ফ্ল্যাটের একতলায় সারভেন্ট কোয়ার্টারে থাকে। রাজেশকে দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে চলে আসতে বলে নিজেও উঠে পড়লেন তিনি। খুব প্রয়োজন না হলে পলাশ কখনও রাতের দিকে ফোন করবে না। হসপিটালের রুগীদের সাধারণ অভাব অভিযোগ ডঃ ঘোষের জুনিয়ররাই সামলে নিতে পারে। তার জন্য তাঁকে সবসময় দরকার পড়ে না। কখনও রাতবিরেতে ফোন আসা মানেই কোনও নতুন ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট এসে হাজির হয়েছে, নয়ত ভর্তি থাকা পেশেন্টদের মধ্যেই কেউ প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজ অবশ্য দ্বিতীয়টার সম্ভাবনা কম। কারণ তেমন গুরুতর অসুস্থ হওয়ার মতো রুগী এখন হসপিটালে নেই। একজন দু-জন ছাড়া সবাই প্রায় অনেকদিন ধরে আছে। মেডিকেশনে আছে। এক যদি না কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে। যদিও প্রত্যেক রুগীকে ডঃ ঘোষের হসপিটালে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়। প্রতি ঘরে, বারান্দায় সিসিটিভির প্রহরা। ওয়ার্ড বয়রাও খুব সতর্ক। তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে এরকম ঘটনা দু-একটা ঘটে যায় না, তা নয়। 

হসপিটালের সামনে ওয়ার্ড বয়দের একটা ছোটখাটো জটলা। ডঃ ঘোষের গাড়িটা থামতেই প্রায় সবাই একসঙ্গে ঘুরে তাকাল। গাড়ি থেকে নামতে নামতে অবাক হলেন ডাক্তারবাবু। এরা সবাই খুব কর্মনিষ্ঠ। রাতের দিকে রুগীরা ঘুমিয়ে পড়ার পর একটু আধটু আড্ডা যে মারে না তা নয়, কিন্তু ডঃ ঘোষকে আসতে দেখেও আড্ডা ভেঙে যে যার ওয়ার্ডের দিকে দৌড়বে না, এমন কলজের জোর এদের কারো নেই। কিন্তু আজ ব্যাপারটা অন্যরকম। ওদের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তিনি লক্ষ্য করলেন প্রত্যেকের মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। কিছু বলতে গিয়েও যেন সাহস সঞ্চয় করতে পারছে না তারা। ডাক্তারবাবু ওদের মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য সময় নষ্ট করলেন না। সোজা গিয়ে ঢুকলেন নিজের কেবিনে। কাচের দরজা ঠেলতেই ভেতরে চেয়ারে বসা পলাশ উঠে দাঁড়াল। ডঃ ঘোষ হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে পাশে দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো ছোট্ট বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বললেন, “কী ব্যাপার পলাশ! ইমারজেন্সি কিছু মনে হচ্ছে।” 

পলাশের মুখের দিকে তাকালেন ডাক্তারবাবু। হাত মুছে গ্লাভস পড়তে গিয়েও থমকে গেলেন। পলাশের বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে গেল তাঁর। ঠোঁট কাঁপছে পলাশের। দুটো হাতের পাতা মুঠো করে সামনের কাচের টেবিলের উপর রাখা। তবে স্থির নয়। থরথর করে কাঁপছে। এগিয়ে এলেন ডাক্তার। 

“পলাশ, তুমি বোসো। জল খাও। তারপর শান্ত হয়ে বল কী হয়েছে।” নিজের চেয়ারে বসতে বসতে পলাশের দিকে জলের গ্লাস এগিয়ে দিলেন। এক ঢোঁকে পুরো জল শেষ করে দু’হাত দিয়ে কিছুক্ষণ নিজের মাথাটা টিপে ধরে থাকল সে। তারপরে টেবিলের উপরে ঝুঁকে পড়ে বলল, “১০৪, ১০৪ নম্বরের পেশেন্ট স্যার।” 

ভুরু কুঁচকে গেল ডাক্তারের, “পরিষ্কার করে বলো কী হয়েছে!” স্যারের এই গম্ভীর গলার সঙ্গে পারিচিত পলাশ। সে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, “আপনি নিজে একবার গিয়ে দেখুন স্যার।” 

১০১ থেকে ১০৫ নম্বর কনফাইনমেন্ট সেল। এই হসপিটালে এই পাঁচটিই এমন সেল আছে। অত্যন্ত ভায়োলেন্ট পেশেন্টদের রাখা হয় এগুলোতে। আপাতত ১০৪ ছাড়া বাকিগুলো খালি। তাই তিনতলার এই করিডরটা বেশ নিঃশব্দ। টিমটিমে আলোতে করিডরে একটা ভৌতিক পরিবেশ। এমনিতে এখানে জনা দুয়েক ওয়ার্ড বয় আর একজন সিকিউরিটি গার্ডের ডিউটি থাকে সবসময়। কিন্তু আজ একজন ওয়ার্ড বয়েরও দেখা নেই। তারা যে সবাই ভিড় জমিয়েছে হসপিটালের গেটের কাছে, তা একটু আগেই দেখে এসেছেন ডঃ ঘোষ। শুধু সিকিউরিটি গার্ডটি বোধকরি চাকরি বাঁচানোর তাগিদেই গলদঘর্ম হয়েও সিঁড়ির মুখে দাঁড়ানো। করিডরের শেষে তার নির্ধারিত বসার চেয়ারটি তাই ফাঁকা। ডঃ ঘোষের পদশব্দ কানে আসতেই সোজা হয়ে দাঁড়াল গার্ড ছেলেটি। পলাশ দু-জন ওয়ার্ড বয়কে ডেকে এনেছে। সবার আগে ডঃ ঘোষ, তার অন্তত তিন হাত পিছনে পলাশ, আর তার পেছনে ভয়কাতর মুখে দুই ওয়ার্ড বয়। ভায়োলেন্ট পেশেন্টদের সামলানোর অভিজ্ঞতা তাদের অনেকদিনের। তবু তাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সামনে না আসতে হলেই বেঁচে যায়। পলাশ চাপা গলায় একবার ধমক দিল তাদের। তাতে একটু জোর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল ঠিকই, কিন্তু ইচ্ছে যে বিন্দুমাত্র নেই, তা বলে দিতে হয় না। ডঃ ঘোষ এ সবকিছুই দেখেও দেখলেন না। হনহন করে এগিয়ে গেলেন ১০৪ রুমের দিকে। পিছন থেকে পলাশের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “স্যার, আগে ওদের যেতে দিন।” দু-জন ওয়ার্ড বয় এগিয়ে যাচ্ছিল। হাতের ইশারায় তাদের থামতে বললেন ডাক্তার! 

“কাউকে যেতে হবে না। বাইরে থাকো। আমি ডাকলে ভেতরে আসবে।” পিছনের মানুষগুলো হয়তো নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাঁচল। 

১০৪-এর বাইরে অন্য কনফাইনমেন্ট সেলগুলোর মতোই লোহার তারজালির গেট লাগানো। তাতে ইয়াব্বড় তালা ঝুলছে। সেখানে দাঁড়িয়ে ডঃ ঘোষ পলাশের দিকে তাকালেন। পলাশ তড়িঘড়ি এগিয়ে এসে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে এগিয়ে দিল ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার সেটা হাতে নিতেই আবার ফিরে গেল নিজের আগের অবস্থানে। সেলের ভেতরটা অন্ধকার। কোনও জানলা নেই বলে বিন্দুমাত্র আলো কোনও উৎস থেকে এসে প্রবেশ করছে না। বিরক্তমুখে ডাক্তার তাকালেন পলাশের দিকে। 

“আলো জ্বলছে না কেন?” 

“জ্বলছিল স্যার। আমরা শেষবার যখন দেখে গেছি, তখনও জ্বলছিল। জানি না এখন…” পলাশের কণ্ঠস্বর আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেল। ডঃ ঘোষ লোহার গেটের তালা খুলে ভেতরের দরজাটা খুলতেই একটা বোঁটকা গন্ধ এসে ধাক্কা মারল নাকে। হসপিটালের প্রত্যেক ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে অত্যন্ত পার্টিকুলার ডঃ ঘোষ। যথেষ্ট বিত্তবান পরিবারের রুগীরাই ভর্তি হয় এই হসপিটালে। কাজেই এটুকু নজর রাখতেই হয়। সেলের ভেতরে পা দিয়ে বাঁদিকের দেওয়াল হাতড়ে সুইচ খুঁজছিলেন ডাক্তার। হাতে আসার পর বুঝলেন সবকটি সুইচ জ্বালানোই আছে। অর্থাৎ বাল্ব কেটে গেছে নিশ্চয়ই। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে তার টর্চ জ্বালালেন ডঃ ঘোষ। ঘরে ঢুকতে যাবেন, পেছন থেকে পলাশের ফিসফিসে গলার স্বর ভেসে এল, “খুব সাবধান স্যার।” 

মাথাটা গরম হয়ে গেল ডাক্তারের। মুখে কিছুই বললেন না। মোবাইলের টর্চ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের এদিক ওদিক দেখতে থাকলেন। ঘরে আসবাব বলতে একটা সিঙ্গল বেড, আর তার পাশে একটা ছোট টেবিল। ওপাশে ছোট্ট ঘেরা জায়গায় একটা কমোড। আপাতত খাটটা ফাঁকা। ঘরের চারিপাশে টর্চ ঘুরিয়েও কাউকে দেখা গেল না। ডঃ ঘোষ একটু অধৈর্য হয়ে উঠলেন। কিছুটা চিন্তিতও। চোখে প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে তাকালেন পিছনের দিকে। নাহ, কেউ নেই। কোথায় গেল পেশেন্ট? এ ঘর থেকে বেরোনোর একটাই দরজা। আর সেটা তিনি নিজের হাতে এইমাত্র তালা খুলে ঢুকেছেন। দরজার বাইরে থেকে তিন জোড়া বিস্ফারিত চোখ উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখ সরিয়ে নিলেন ডাক্তার। একটা স্তিমিত থপ থপ শব্দ যেন কার্নে আসছে! কান খাড়া করে শব্দের উৎস বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি। কয়েক সেকেন্ড লাগল বুঝতে যে, তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর ঠিক উলটোদিকের দেওয়ালের মাঝামাঝি অংশ থেকে শব্দটার উৎপত্তি। মোবাইলের টর্চটা স্তিমিত হয়ে নিভে যেতেই ভ্রূ কুঁচকে উঠল তাঁর। এই তো দিব্যি জ্বলছিল, কী হল আবার! মোবাইলের সুইচ টিপে আবার চেষ্টা করলেন অন্তত স্ক্রিনের আলো জ্বালাতে। নাঃ, কোনও লাভ নেই। সম্ভবত চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে মোবাইল। চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে পেছনে ফিরে পলাশের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় ধমকে উঠলেন, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ! যাও একটা টর্চ নিয়ে এসো।” 

“চলে আসুন স্যার। সব আলো এমনি এমনি নিভে যায়নি। এ অলৌকিক। এ কোনও ভূতপ্রেতের ব্যাপার।” 

“বাজে কথা না-বলে যা বলছি সেটা করো।” ডাক্তারের ধমক খেয়ে পলাশ আর দাঁড়াল না। ছুট দিল হুকুম তামিল করতে। ডাক্তার অবাক হয়ে দেখলেন পলাশের পিছন পিছন দু-জন ওয়ার্ড বয়ও দৌড়ে উধাও হয়ে গেল। একা অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটু কী স্নায়ু শিথিল হতে শুরু করল ডঃ ঘোষের? ঘটনাটা খুবই অদ্ভুত তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ভূতপ্রেত অলৌকিকে বিশ্বাস করবেন তা বলে? 

দিন দুয়েক আগে ১০৪-এর পেশেন্টকে ভর্তি করা হয় এখানে। শুরুতে জেনারেল বেডে রাখা হলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বোঝা যায় লোকটি যে কোনো সময় অন্য রোগীদের ক্ষতি করতে পারে। তাই ১০৪-এ নিয়ে আসা হয় তাকে। স্কিজোঅ্যাফেক্টিভ বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলেই মনে হয়েছিল ডঃ ঘোষের। সঠিকভাবে ডায়াগনোস করার জন্য কিছু টেস্টের প্রয়োজন ছিল। গতকাল সেই টেস্টগুলো করার জন্য একজন জুনিয়র ডাক্তার এসেছিলেনও। কিন্তু লোকটি আচমকাই চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়। ডঃ ঘোষ যখন রাতে বাড়ি যান, তখনও সে ঘোরের মধ্যে ছিল। কিন্তু শারীরিক কন্ডিশন নরম্যাল দেখে ডাক্তার নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু রাতেই আবার পলাশের ফোন। এখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোরের আলো ফুটবে। ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালেন ডাক্তার। ওয়ার্থলেস সব! টর্চ আনতে এত সময় লাগে? 

…থপ…থপ…থপ… 

চমকে সামনের দেওয়ালের দিকে তাকালেন ডাক্তার। শব্দটা থেমে গিয়েছিল। আবার শুরু হয়েছে। ঠিক যেন কেউ ভারী পা ফেলে নেমে আসছে দেওয়াল বেয়ে। কী? দেওয়াল বেয়ে? বহুবছর আগের একটা দৃশ্য আচমকা স্পষ্ট হয়ে উঠল চোখের সামনে। তিন জোড়া অবিশ্বাসী চোখের সামনে দেওয়ালে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে একটা ছেলে। ছেলে? হ্যাঁ, বলতে গেলে তাই বলতে হবে। কিন্তু কালচে পিচ্ছিল শ্যাওলার মতো গায়ের রং, ক্ষয়-পড়া কালো দাঁতের ফাঁক দিয়ে সরীসৃপের মতো লিকলিকে জিভ সত্যিই কোনও মানুষের হয়? 

মাথাটা প্রবলবেগে একবার ঝাঁকিয়ে নিলেন ডঃ ঘোষ। নাঃ এসব ভাবার সময় নয় এখন। সে কবেকার ঘটনা! আজও বিশ্বাস করতে মন চায় না। তিনি ডাক্তার। বিজ্ঞানের সাধক। এসব ভুলভাল চিন্তা তাঁকে দুর্বল করতে পারবে না আজ আর। শব্দটা লক্ষ্য করে দু-পা এগোলেন ডাক্তার। হঠাৎ ঘরের সিলিঙ থেকে লম্বা তারের মাধ্যমে ঝুলিয়ে রাখা এতক্ষণ না-জ্বলা বাল্বটা দপ দপ করে উঠল। সঙ্গে চির চির করে শব্দ। বাল্বটা অবিচ্ছিন্ন কানেকশন পাচ্ছে না সম্ভবত। তাই ক্রমাগত জ্বলছে নিবছে। সেই আলোতেই দেওয়ালের দিকে তাকালেন ডঃ ঘোষ। 

*****

একদৃষ্টিতে ডঃ ঘোষের অ্যাসিস্ট্যান্টের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সাব ইন্সপেক্টর সৌম্য রায়। লোকটা তখন থেকে একটা চেয়ারে বসে থরথর করে কাঁপছে। চোখের দৃষ্টি উদভ্রান্তের মতো। অনেকক্ষণ ওঁকে সামলে নেওয়ার সময় দেওয়া হয়েছে। আর নয়। এবার কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না-করলেই নয়। গলা খাঁকারি দিলেন সৌম্য। সেই শব্দে এক সেকেন্ডের জন্য চোখ তুলে তাকাল পলাশ। 

“একবার এদিকে আসুন মিঃ পলাশ গুহ। আমার কিছু জানার আছে।” পলাশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর এগিয়ে এল সৌম্যর দিকে। 

“আপনি চেয়ারটা এখানে নিয়ে আসুন। দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?” পলাশ বাধ্য ছাত্রের মতো নিজের চেয়ার টেনে এনে বসল সাব ইন্সপেক্টরের মুখোমুখি। 

“দেখুন মিঃ গুহ, আমি জানি আপনি খুবই আঘাত পেয়েছেন। ডঃ ঘোষের এমন দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু সত্যিই অকল্পনীয়। কিন্তু আমার হাত-পা বাঁধা। কিছু প্রশ্ন যে আমাকে করতেই হবে।” পলাশ আস্তে আস্তে মুখ তুলল। কাঁপা গলায় বলল, “বুঝতে পারছি স্যার। বলুন কী জানতে চান।” 

“ডঃ ঘোষ যখন বারান্দা থেকে পড়ে যান, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?” “১০৪ নম্বর সেলের লাইটটা জ্বলছিল না। তাই উনি আমাকে টর্চ আনতে পাঠিয়েছিলেন। আমি সেটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাতে একটু সময় লেগে গিয়েছিল। তারপর যখন খুঁজে পেলাম, ওটা নিয়ে ছুটে আসছিলাম। করিডরের মুখে এসে পৌঁছতেই যে দৃশ্য দেখি, তাতে আমার সারা শরীর অবশ হয়ে যায়।” 

“বলে যান, শুনছি।” 

“করিডরের মুখে আসতেই একটা গোঙানির শব্দ কানে এল। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাই হাতের টর্চটা জ্বেলে শব্দ লক্ষ্য করে আলো ফেলতেই দেখলাম, ডঃ ঘোষ বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তাঁর মুখ এদিকে, কিন্তু দেহের সমস্ত ভর রেলিঙের উপর। বড় বড় চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। দৃষ্টি তাঁর সিলিঙের দিকে। মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে গোঙানির শব্দ। আমি সিলিঙের দিকে টর্চের আলো ফেললাম। আর তখনই…” 

“তখনই?…” 

“বারান্দার রেলিং টপকে নীচে পড়ে গেলেন স্যার।” 

“আর আপনি তখন ছুটে গিয়ে নিশ্চয়ই রেলিং দিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করলেন? কী দেখলেন? ডঃ ঘোষ কী তখনও বেঁচে ছিলেন, ছটফট করছিলেন? নাকি পড়েই স্থির হয়ে গিয়েছিলেন?” 

“না মানে, আমি দেখিনি।” 

“মানে? আপনি চোখের সামনে ওঁকে পড়ে যেতে দেখেও ছুটে গেলেন না? এ আবার হয় নাকি? এটা তো এরকম দৃশ্য দেখার পর যে কোনও মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন?” 

“আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না স্যার। মানে, আমি সিলিঙে যা দেখেছিলাম… তারপর আর সাহস করে উঠতে পারিনি…” 

“কী এমন দেখেছিলেন মিঃ গুহ? বিশ্বাস-অবিশ্বাস আপনি আমার উপর ছেড়ে দিন। আপনি বলুন।” 

“আমি আপনাকে আর একটু আগে থেকে সব কথা বলতে চাই। শুনবেন?“

“শুনব বলেই এখানে বসে আছি মিঃ গুহ। ভণিতা না করে সরাসরি বিষয়ে এলে খুশি হব।” 

পলাশ একটু ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করে- 

“১০৪ নম্বরের পেশেন্ট ভর্তি হয় দু’দিন আগে। যখন আনা হয়, তখন পেশেন্টের জ্ঞান ছিল না। কিন্তু জ্ঞান আসার পর বোঝা যায় তাঁকে অন্যদের সঙ্গে রাখা যাবে না। সময়ে সময়ে প্রচণ্ড হিংস্র হয়ে উঠছিল। তাই তাঁকে ১০৪ নম্বরে রাখা হয়। বেশিরভাগ সময়েই পেশেন্টকে সিডেটিভ দিয়ে রাখা হচ্ছিল। কাল রাতেও স্যার যখন বাড়ি গেলেন তখন পেশেন্ট অচেতন। কিন্তু তাঁর দু-এক ঘণ্টা পর থেকেই শুরু হয় এক অদ্ভুত কাণ্ড। ওয়ার্ড বয় পেশেন্টকে খাওয়াতে এসে দেখে পেশেন্ট সেলে নেই। সিকিউরিটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করে। সে করিডরের মুখেই বসা ছিল। কাউকে বেরোতে হলে সেখান দিয়েই বেরোতে হবে। তখন ওরা আমাকে ডাকে। আমি এসে দেখি পেশেন্ট বেডে শোয়া। শুধু শুধু আমাকে ডেকে আনার জন্য ধমকাচ্ছিলাম ওদের। কিন্তু ঠিক তখনই লোকটা সটান উঠে দাঁড়াল বেডের উপর। আপনি না দেখলে বিশ্বাস করবেন না, কোনও মানুষের পক্ষে এভাবে না বসে শোয়া অবস্থায় দাঁড়ানো সম্ভব বলে! আরও দেখলাম, ওর চোখ খোলা থাকলেও সম্পূর্ণ সাদা, কালচে দাঁত বের করে উৎকট হাসছে, আর মাঝে মাঝে দাঁতের ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়ছে কালো সরু জিভ। বহুদিন ধরে মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করছি। আমি হলফ করে বলতে পারি এ কোনও মানসিক সমস্যার লক্ষণ না। আমাদের তিনজনের চোখের সামনে লোকটা দেওয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করল। আমরা আর ওখানে দাঁড়ানোর সাহস জোগাড় করতে পারিনি। কোনওরকমে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে নীচে এসে খবর দিই ডঃ ঘোষকে। স্যার না আসা পর্যন্ত আর এদিকে আসিনি।” 

“আপনার কি মনে হয়, এসব আষাঢ়ে গল্প পুলিশ বিশ্বাস করবে?” 

“আমি তো আগেই বলেছিলাম স্যার। আপনি কেন, কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি নিজের চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতাম না। আপনি চাইলে ওই ওয়ার্ড বয় আর সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।” 

“সেটা তো আমি করবই। কিন্তু যদি তর্কের খাতিরেও ধরে নিই আপনার কথা সত্যি, তাহলে ওই পেশেন্টের মৃত্যুর কারণও বলতে চান অলৌকিক কিছু?” 

“আমার তাই মনে হয়। স্যার যখন ব্যালকনি থেকে পড়ে যাচ্ছেন, তার আগে আমি টর্চের আলো ফেলতেই দেখেছিলাম সিলিঙে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো বসে আছে একটা মূর্তি। তাঁর চার হাত পা আটকে আছে উপরে আর মাথা উলটো হয়ে ঝুলছে নীচের দিকে। চোখে সেই শূন্যতা, মুখে হাসি। স্যার হুড়মুড় করে পড়ে যেতেই ঐ মূর্তিটাও সিলিঙ থেকে সোজা ঝাঁপ দিল বাইরে। আর আমার কিছু দেখার সাহস হয়নি স্যার। আমি নীচে ছুটে যাই। ততক্ষণে বাইরে ওয়ার্ড বয় সিকিউরিটি গার্ডদের ভিড় জমে গেছে। দু-দুটো জোরালো আওয়াজ পেয়ে তারা হসপিটালের বাইরে জড়ো হয়েছে। আমি গিয়ে দেখি দুটো লাশ। একটা ডঃ ঘোষের, আর অন্যটা সেই ১০৪ নম্বরের পেশেন্টের।”

*****

বডি দুটো পোস্ট মর্টেমে পাঠিয়ে দিয়ে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালেন সৌম্য। তাঁর ভ্রূতে গভীর ভাঁজ। কয়েক মাস হল এই থানায় এসেছেন তিনি। এর মধ্যেই এমন একটা কেস তাঁর দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া আরও একটা বিষয় তাঁর কৌতূহল বাড়িয়ে তুলেছে। ডঃ অজয় ঘোষ। নামটা শুনেই চেনা মনে হয়েছিল বটে, কিন্তু খুবই কমন নাম বলে বেশি ভাবেননি তা নিয়ে। কিন্তু মৃতদেহের মুখ দেখে তাঁর বহুবছরের ভুলে যাওয়া কোনও সুর যেন স্মৃতির তন্ত্রীতে আঘাত করে ঝঙ্কার দিয়ে উঠল। অজয়। তখন নামের আগে গালভরা ডক্টর উপাধি বসেনি। তখন কত আর বয়স তাঁদের! পনেরো বড়জোর। পড়াশোনা, ফুটবল, আড্ডা এই ছিল তাঁদের জীবন। 

অজয়, সৌম্য, রঞ্জন আর বিপ্লব। চারজন হরিহর আত্মা। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল সৌম্যর। এতদিন পরে যদি বা অজয়ের সঙ্গে দেখা হল, তা এমন পরিস্থিতিতে। জোর করে বাস্তবে ফিরে এলেন সৌম্য। সাময়িক আবেগটা কেটে যেতে উপলব্ধি করলেন, একদিকে বোধহয় ভালোই হয়েছে। এতদিন পর অজয়ের মুখোমুখি হলে কালের অতলে চাপা পড়ে-যাওয়া তিক্ত স্মৃতি আবার মাটি খুঁড়ে উঠে আসতই। কি জানি তাঁরা দু’জনেই সেই চরম সত্যিটা মেনে নিতে পারতেন কিনা! বিশেষত অজয় এখন নামকরা ডাক্তার। সে হয়তো পরিচয় স্বীকার করতেই চাইত না সৌম্যর সঙ্গে। 

যাই হোক, পলাশের কাছ থেকে ১০৪ নম্বরের রোগীর বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। পলাশ একটা চিরকুটে লিখে দিয়ে দিয়েছে সৌম্যকে। তবে হসপিটাল থেকে বার বার ফোন করেও কানেকশন পাওয়া যায়নি। বার বার বলছে ফোন সুইচড অফ। কাজেই তাঁর বাড়িতে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। 

আঠাশ নম্বর রামনাথ বৈদ্য লেন। নাম যেমনই হোক না কেন, আসলে এঁদো গলি। তারই মুখে বড় রাস্তার পাশে ড্রাইভারকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে নামলেন সৌম্য। গলির একপাশে ড্রেন থেকে তুলে স্তূপ করে রাখা কাদা ময়লা বাঁচিয়ে সাবধানে এগোচ্ছিলেন তিনি। একটা আঁশটে গন্ধে ভরে আছে পুরো রাস্তাটা। একদম শেষের দুটো বাড়ি আগেই সৌম্যর উদ্দিষ্ট ঠিকানা। গলির ভেতরে আলো নেই। বড় রাস্তার মুখে যেখানে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেখানেই একটা ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলছে। তারই ছিটেফোঁটা এসে যেটুকু উদ্ভাসিত করছে গলির ভেতরটা তাতেই দেখতে পেলেন একটা একতলা বাড়ি। খুবই সামান্য জমির উপর গড়ে তোলা হয়েছে বাড়িটা। রাস্তার ড্রেনের উপর একটা কালভার্ট বসিয়ে তার উপরেই বাড়িতে প্রবেশ করার ছোট লোহার গেট। আশেপাশের বাড়ি থেকে বাংলা সিরিয়ালের শব্দ, দু চারটে গলার আওয়াজ, গৃহস্থালির বাসনকোসনের টুকরো টাকরা ঢং ঢং ঝন্ ঝন্ কানে আসছে। অথচ এই বাড়িটা নিশ্চুপ। যদিও সৌম্য বুঝতে পারছেন বিষয়টা। সদ্য অপঘাত-মৃত্যু হয়েছে যে বাড়ির মানুষের, সেই শোকের বাড়িতে এটাই স্বাভাবিক পরিবেশ। কিন্তু আলো জ্বলছে না কেন? জানলা দরজার ফাঁক ফোঁকর দিয়েও সামান্যতম আলো ছিটকে বেরোচ্ছে না বাইরে। লোহার গেটের দুপাশে নিচু পাঁচিল। পাঁচিলের ওপাশ থেকে কিছু ঝোপঝাড় হুমড়ি খেয়ে রাস্তার দিকে এসে পড়েছে আর সেখান থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার জোরালো আওয়াজ। সৌম্য একবার থমকে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে বাড়ির আশপাশটা দেখে নিলেন। তারপর লোহার ছোট গেটের কুলুপ খুলে ভেতরে পা দিলেন। ভেতরে পা ফেলতেই দুটো সিঁড়ি। জায়গা এতই কম যে গেট খুলে পা ফেললেই ঘরে ঢোকার দরজার নীচের সিঁড়ির উপরেই পা পড়ে। সেখানে দাঁড়িয়েই কাঠের দরজার গায়ে লাগানো কড়া নাড়লেন সৌম্য। কড়া নাড়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলে গেল বিনা ভূমিকায়। একজন মহিলা। ঘরে খুব মৃদু আলোর আভাস। সেই আলো পিছনে থাকায় ভদ্রমহিলার মুখ দেখা যাচ্ছে না বটে, তবে অনুমান করা যায় তিনি বয়স্ক। ভদ্রমহিলা অপেক্ষা করছেন সৌম্যর কিছু বলার। 

“নমস্কার। আমি শ্যামপুর থানার সাব ইন্সপেক্টর সৌম্য রায়। আপনার বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে জানি। সেই সূত্রেই আমার এখানে আসা। খুব বেশি সময় নেব না।” 

“আসুন।” সৌম্যর কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন মহিলা। ভেতরের ঘরটাকে অনায়াসে বসার ঘর বলাই যায়, যদিও আয়তন খুবই কম। দুটো বেতের চেয়ার পাশাপাশি রাখা আর তাদের মাঝখানে একটা ছোট্ট গোল টেবিল। ঠিক উলটোদিকের দেওয়ালে একটা বুক শেলফ রাখা। তার উপরে পাশাপাশি তিনটে ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। তিনটি ছবিতেই ফুলের মালা পরানো। সম্ভবত ভদ্রমহিলা এক জীবনে বেশ কয়েকটি শোকের সম্মুখীন হয়েছেন। ছবির ফ্রেমগুলি বেশ ছোট হওয়ায় মালায় প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। ওখানেই দু’পাশে দুটি মোমবাতি জ্বলছে, তার আলোতেই যেটুকু আলোকিত ঘর। এই কারণেই বাইরে থেকে আলোর কোনও আভা দেখা যাচ্ছিল না। সৌম্য বেতের চেয়ারে বসে পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন। তারপর একটা নোটবুক আর পেন বের করলেন। মহিলা পাথরের মূর্তির মতো একটু দূরে দাঁড়িয়ে। 

“আপনি মৃত ব্যক্তির কে হন?” 

“মা।” 

“ওঃ আমি খুব দুঃখিত। আসলে বুঝতেই পারছেন কিছু অফিসিয়াল বিষয় কিছুতেই এড়ানো যায় না। তাই এই শোকের মুহূর্তে আপনাকে বিরক্ত করছি।” “বলুন।”, ভদ্রমহিলার গলার স্বর বেশ অস্বস্তিকর। শীতল, অবিচলিত, যেন পৃথিবীর কোনও কিছুতেই তাঁর কিছু এসে যায় না। 

“আপনার ছেলের মানসিক রোগ কতদিনের পুরোনো? প্রথম থেকেই কি ডঃ ঘোষকে দেখান, নাকি এর আগেও অন্য কোনও ডাক্তারকে দেখিয়েছেন?” 

ভদ্রমহিলা কোনও উত্তর দিলেন না। বরং ঘরের ভেতরে যাওয়ার দরজার পাশে রাখা একটা ছোট টুল থেকে তুলে নিলেন আর একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। খুব মন দিয়ে একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে মুছতে লাগলেন ছবিটা। একটু অপেক্ষা করে সৌম্য গলা খাঁকারি দিলেন। তাঁর প্রশ্ন দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তির জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন তিনি, এমন সময় ভেসে এল ভদ্রমহিলার গলার স্বর, “আমার ছেলের কোনও মানসিক রোগ ছিল না।” 

সৌম্য একটু ভড়কে গেলেন। মানসিক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন বৃদ্ধার ছেলে। তবু বলছেন মানসিক রোগ ছিল না? শোকে তাপে ওঁর মাথাতেও কি গণ্ডগোল দেখা দিল নাকি? যাক গে, আত্মহত্যার কেস। রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ, যেভাবে হোক সাজিয়ে দিলেই হবে। ঘড়ি দেখলেন সৌম্য। ঘরের আধো আলোতে ঘড়ি দেখতেও সমস্যা হচ্ছে। চোখের কাছে এনে দেখছিলেন। মাথা তুলেই সামান্য চমকে উঠলেন। বৃদ্ধা কখন যেন তাঁর একদম কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। একটা পাঁক পাঁক গন্ধ উঠে আসছে তাঁর দেহ থেকে। গা গুলিয়ে উঠল সৌম্যর। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। নোটবুকটা পকেটে রাখতে রাখতে প্রশ্ন করলেন, “আপনার ছেলের বয়স কত হয়েছিল?” 

“পনেরো বছর তিন মাস বাইশ দিন।” 

এবার মজা লাগল সৌম্যর। পোস্ট মর্টেমে পাঠানোর সময় এক ঝলক দেখা মুখটা মনে পড়ল। যদিও থেঁতলে যাওয়া শরীরটাতে হাড়গোড় কিছু আস্ত ছিল না বলেই মনে হয়, তবু মুখটুকু যা বোঝা গেছে তাতে গোঁফওলা আধবুড়ো একটা লোকের বয়স পনেরো? মহিলার মাথা পুরোই গেছে। 

হাসি চেপে সৌম্য আবার জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার ছেলের নাম?” 

“রঞ্জন। রঞ্জন মজুমদার।” 

এত চমকে উঠলেন সৌম্য যে হাত থেকে পেন পড়ে গেল। প্রথমে অজয়, এবার রঞ্জন? কিন্তু রঞ্জন কীভাবে হতে পারে? রঞ্জন তো… আচমকা বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা তাঁর মাথায় এল। পনেরো বছর তিন মাস বাইশ দিন। হ্যাঁ তাই তো। রঞ্জন মারা যাওয়ার সময় তার বয়স তো সেরকমই হওয়ার কথা। তার ঠিক মাস চারেক আগেই ধুমধাম করে জন্মদিন পালন করা হয়েছিল রঞ্জনের। তার কয়েকদিন পরেই নদীর ধারে আড্ডা মারতে মারতে কথাটা বলেছিল রঞ্জন। 

***** 

“জানিস, আমার দাদুর পোষা জ্বিন ছিল।” 

“এই আবার আষাঢ়ে গল্প শুরু করলি তো!” 

“দাঁড়া না, শুনতে দে।” অজয়কে থামিয়ে দিল সৌম্য। 

“বল তো রঞ্জন, জ্বিন মানে? সত্যি জ্বিন?”

“সত্যি না তো কি, মিথ্যা? আমার দাদু গৃহত্যাগী হয়েছিলেন তন্ত্রসাধনা করার জন্য। শেষ বয়সে আবার ঘরে ফেরেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন সেই জ্বিনকে।” 

অজয় আর বিপ্লব গা টেপাটেপি করে হাসছিল। হাসি থামিয়ে বিপ্লব বলল, “তা সেই জ্বিনবাবু এখন কোথায়? তোদের বাড়িতে তোদের সঙ্গেই থাকে নাকি? “ একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে চুপ করে গেল রঞ্জন। সৌম্য বাকি দু’জনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। 

“আঃ তোরা একটু থামবি? হ্যাঁ রে রঞ্জন, কী বলছিলি একটু খুলে বল তো!”

“দাদু মারা যাওয়ার আগে সেই জ্বিনকে মন্ত্র পড়ে একটা পেতলের ঘটিতে পুরে মুখ বন্ধ করে মাটির নীচে পুঁতে দিয়েছিলেন। দাদু ছাড়া আর কেউ জানত না কোথায় পোঁতা আছে সেই ঘটি। কয়েকদিন আগে…”

“কয়েকদিন আগে? কী হয়েছে?” বিপ্লব বলে উঠল অধৈর্য স্বরে। যতই হাসাহাসি করুক না কেন, এসব গল্পের আকর্ষণ ত্যাগ করা বড় কঠিন। রঞ্জন গম্ভীর মুখে একবার তাকাল বিপ্লবের দিকে। তারপর চোখ সরিয়ে বলল, “বাগানের তুলসি মঞ্চ আমার বাবার ঠাকুমার আমলের। সিমেন্টের বেদিটা বেশ অনেকদিন ধরেই ভেঙেচুরে গিয়েছিল। কয়েকদিন আগে মা মিস্ত্রি লাগিয়েছিল সেই পুরনো তুলসি মঞ্চ ভেঙে আবার নতুন করে তৈরি করার জন্য। আর তা করতে গিয়েই তুলসি মঞ্চের ভেতর থেকে পাওয়া গেছে লাল শালু দিয়ে মুখ বাঁধা একটা পেতলের ঘটি। মা সেটা নিয়ে কী করবে বুঝতে না-পেরে রেখে দিয়েছে ঠাকুরের আসনে। আমাদের কুলপুরোহিত গেছেন বৃন্দাবন তীর্থ করতে। সামনের সপ্তাহে ফিরলেই মা তাঁকে ডেকে এনে যা করার করবে।” 

রঞ্জনের কথা শেষ। বাকিদের মুখেও কথা নেই। কিন্তু অজয় অন্য কিছু ভাবছিল, “আমাদের দেখাবি রঞ্জন জিনিসটা? একটিবার দেখব। তারপর ফেরত দিয়ে দেব। প্লিজ একবার আন।“ 

রঞ্জন রাজি হয়নি প্রথমটা। কিন্তু কৈশোরের প্রবণতায় বন্ধুদের সামনে হিরো সাজার লোভ সংবরণ করা বড় কঠিন। তাছাড়া বিষয়টার সত্যতা নিয়ে হয়তো সন্দিহান ছিল সে-ও। ঠিক হল পরদিন সন্ধ্যাবেলায় অজয়ের বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে ওদের বাড়িতেই ঘটিটা নিয়ে রঞ্জন আসবে। বাকিরাও সেইসময় সেখানেই থাকবে। মাত্র পনেরো মিনিটের জন্যই আসবে রঞ্জন। তার মা সেই সময় সিরিয়াল দেখতে তার জ্যেঠির ঘরে যায়। মা ফেরার আগেই ঘটি আবার স্বস্থানে ফিরিয়ে দিতে হবে। তাতেই রাজি হল বন্ধুরা। 

কথামতো পরদিন ঠিক সন্ধে ছ’টায় সব বন্ধুরা এসে হাজির হল অজয়ের বাড়িতে। অজয়ের বাবা-মা দু’জনেই ডাক্তার। কাজেই তাঁদের বাড়ি ফিরতে রাত হয়। এর থেকে নিরাপদ স্থান আর হয় না। রঞ্জন ঘরে ঢুকেই কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে বের করল ঘটিটা। একটা খুব সাধারণ দেখতে পেতলের ঘটি। মুখে লাল শালু জড়ানো। ঘটির রং এখন আর পেতলের মতো নেই, বরং খানিকটা লোহার উপরে শ্যাওলা পড়লে যেমন হয় তেমনি দেখতে লাগছে। লাল শালুটা কিন্তু দেখে বেশ নতুন বলেই মনে হচ্ছে। রঞ্জন জানাল, “পুরোনো শালুটা ছিঁড়ে গিয়েছিল বলে ঘটির ঢাকনার উপর দিয়ে মা একটা নতুন শালু জড়িয়ে দিয়েছে।” 

“তা না হয় হল। কিন্তু এর মধ্যে যে জ্বিন আছে, তা প্রমাণ হবে কী করে?” ঘটিটা দেখামাত্রই হাসাহাসি শুরু করল অজয় আর বিপ্লব। 

“হ্যাঁ রে রঞ্জন, জ্বিনটা ছেলে না মেয়ে? মেয়ে হলে তুই বিয়ে করে ফেল। ব্যাস ঝামেলা খতম।” 

সৌম্যরও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না রঞ্জনের গল্পটা। কেমন মনে হচ্ছিল রঞ্জন তাদের বোকা বানাচ্ছে। তাই প্রস্তাবটা সেই দিল, “এক কাজ করা যাক। ঘটিটা খুলে দেখা যাক ওতে কী আছে।” 

কথাটা শুনেই রঞ্জনের মুখ শুকিয়ে গেল, “না না এ কি বলছিস! তুই জানিস, জ্বিন বশ করার মন্ত্র না জেনে জ্বিনকে মুক্তি দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি খুব ভুল করেছি তোদের এটার কথা বলে। আমি যাই এখন।” 

“কিন্তু যাই বললেই যেতে দিচ্ছে কে?” বাকি তিনজন তখন দরজা আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। 

“আমাদের বোকা বানিয়ে পালাবি ভাবছিস? তোর এসব গালগল্পে আমরা বিশ্বাস করি না। দে বলছি ওটা।” রঞ্জন দু-হাতে আঁকড়ে ধরল ঘটিটা। কিন্তু যতই হোক, তিনজনের সঙ্গে ও একা পারবে কেন? টানাটানিতে হাত থেকে ছিটকে পড়ল ঘটিটা। লাল শালু সমেত ঘটির ঢাকনা খুলে ঠিকরে গেল একদিকে, মুখখোলা ঘটিটা মেঝের উপর কয়েক রাউন্ড চক্কর খেয়ে স্থির হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল দরজার কাছে দাঁড়ানো চার বন্ধু। ঘটির মুখ থেকে সাদা সাদা ছাইয়ের মতো সামান্য গুঁড়ো বেরিয়ে মেঝেতে পড়েছে। কিছু সময় চুপ করে থাকার পর নীরবতা ভঙ্গ করে হেসে উঠল অজয়। 

“সে কি রে রঞ্জন, তোর জ্বিন যে পাউডার ফর্মে বেরোবে সে কথা তো বলিসনি।” 

রঞ্জন হাসল না। তার হাত-পা কাঁপছে। 

“এখন… এখন কী হবে? আমি কী করব?” 

“কিস্যু হবে না। যদি তোর দাদুর আমলে এসব সত্যি হয়েও থাকে, এতদিন পর আর…” কথা শেষ হল না সৌম্যর। চিৎকার করে উঠল রঞ্জন 

“চুপ কর। একদম চুপ। এবার টের পাবো আমরা সবাই। সব শেষ হয়ে যাবে। একে একে সবাই মরব আমরা। দেখে নিস।” অবস্থা সুবিধের নয় বুঝে সৌম্য চুপ করে গেলেও বিপ্লব আর অজয় থামার ছেলে নয়। রোগা সোগা শীর্ণ চেহারা হলেও অজয়ের জেদ প্রচণ্ড। সে বলল, “এসব দু’নম্বরী কথায় চিঁড়ে ভিজবে না চাঁদ, কোথায় তোর জ্বিন? যদি তোর কথা সত্যি হয়ে থাকে তবে এক্ষুনি প্ৰমাণ দে।” 

রঞ্জন চোখ তুলে তাকাল অজয়ের দিকে। ওর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, মুখ লাল। 

“প্রমাণ চাই তোর? বেশ। জ্বিন সদ্য মুক্তি পেয়েছে। এই ঘরেই আছে। আয় আমরা প্ল্যানচেট করি। জ্বিন থাকলে অবশ্যই আসবে। করবি? আছে সাহস?” রঞ্জন যে এভাবে চ্যালেঞ্জ করবে তা আশা করেনি অজয়। কিন্তু সে ভাঙবে তবু মচকাবে না। 

“বেশ। এখনই হোক প্ল্যানচেট। শুনেছি এতে চারজন লাগে। আমরাও চারজন আছি।” 

এরপর প্ল্যানচেট সম্পর্কে যে যার গল্পের বই পড়া, লোকের কাছে শোনা জ্ঞান প্রয়োগ করে তেপায়া টেবিল, মোমবাতি ইত্যাদি সারা বাড়ি থেকে জোগাড় করে আনল। সৌম্য শুনেছিল, যাই হয়ে যাক না কেন, সার্কেল ভাঙলে বিপদ। সার্কেল অর্থাৎ চারজনের হাতে হাতে ধরা বন্ধন। পরবর্তী দশ মিনিট চার বন্ধুর জীবন ওলট পালট করে দিয়েছিল। প্ল্যানচেট শুরু করার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই রঞ্জনের মাথা ঝুলে পড়ল বুকের উপর। প্রথমে অন্য তিনজন ভেবেছিল রঞ্জন ইচ্ছে করে এমন করছে। কারণ প্ল্যানচেটের সাফল্য সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল তাদের মনে। তারপরই সেই ভয়ংকর দৃশ্য। এতদিন পরেও চোখ বুজলেই মনে করতে পারেন সৌম্য। গিরগিটির মতো দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছে রঞ্জন। ভয়ে কাঁপছে অজয়। ঘাম গড়াচ্ছে ওদের সবার কপাল বেয়ে। সৌম্য চিৎকার করছে, সার্কেল ভাঙবি না, সার্কেল ভাঙবি না। আর তার মধ্যেই হঠাৎ বিপ্লব চিৎকার করে হাত ছেড়ে দৌড়াল দরজার দিকে। আর সার্কেল ভাঙা মাত্র প্রায় সিলিঙের কাছ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ল রঞ্জন। পড়েই স্থির হয়ে গেল। মুখের সব বিকৃতি তখন উধাও। তারপর তিনজন বছর পনেরো ষোলোর কিশোরের বোধকরি জীবনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। রঞ্জনের দেহটা একটা বিছানার চাদরে মুড়ে অজয়দের বাড়ির পিছনের ঝোপে লুকিয়ে ফেলল তারা। তারপর মেল ট্রেনের গতিতে ছুটতে থাকা হৃদপিণ্ডের আন্দোলন মুখে ফুটতে না দিয়ে যে যার বাড়িতে ফিরে গেল। আবার তিনজনে মিলিত হল রাত একটার সময় অজয়ের বাড়ির পিছনে। নদীর জলে রঞ্জনের লাশটা বিসর্জন দিয়ে ফেরার পথে ঘটিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল নদীর জলে। তারা ঠিক করেছিল এ ঘটনা সারাজীবন তাঁদের মধ্যেই গোপন থাকবে। 

রঞ্জনের খোঁজ শুরু হয়েছিল রাত আটটা থেকে। তার মা ভেবেছিলেন হয়তো কোনও বন্ধুর বাড়িতে গেছে। অজয়ের বাড়িতে উনি যখন এসেছিলেন, তিন বন্ধু ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে বসেছিল। খানিকক্ষণ ডাকাডাকি করে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। অজয়ের বাবা-মা সেদিন ফিরেছিলেন রাত ন-টার পর। রঞ্জনের হয়ে খোঁজ করার বিশেষ কেউ ছিল না। তার বাবা এবং জ্যেঠা কেউই বেঁচে ছিলেন না। বয়স্কা জ্যেঠি আর মায়ের পক্ষে যতটা সম্ভব খোঁজাখুঁজি করেছিলেন। তারপর পুলিশের উপর ভরসা করে বসেছিলেন। পুলিশ নড়েচড়ে বসায় বিপ্লব, সৌম্য আর অজয়কে ঘটনাটা জানাতে হয়েছিল নিজেদের বাবা মায়েদের। কপালে তিরস্কার জুটলেও পুলিশের হাত থেকে ছেলেদের রক্ষা করতে বাবা-মায়েরা তাদের অকাট্য অ্যালিবাই হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বিপ্লব আর সৌম্যর বাবা-মা পুলিশকে জানিয়েছিলেন তারা যে যার বাড়িতে পড়াশোনা করছিল আর অজয় ছিল সৌম্যর বাড়িতে। সন্দেহ ঘোরতর হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ মেলেনি। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিন পরিবারই পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গিয়েছিল সেখান থেকে। তার পর থেকে এতদিনের মধ্যে তিন বন্ধুর আর কখনো দেখা হয়নি। কে কোথায় ছিল সেই খবরটুকুও রাখেনি তারা। আর আজ এতদিন পর সৌম্যর চোখের সামনে তাজা হয়ে উঠছে সেই স্মৃতি! 

***** 

“আমার ছেলেকে নদীতে ফেলে দিয়েছিলি তোরা। আমি সব জানতাম। অজয়ের বাড়িতে শুধু না, তোর আর বিপ্লবের বাড়িতেও রঞ্জনকে খুঁজতে গিয়েছিলাম আমি। তখন তোদের মায়েরা বলেছিল তোরা বাড়িতে নেই। অথচ পুলিশের কাছে বেমালুম মিথ্যে বলল তোদের মা-বাবা। আমিও প্রমাণ করতে পারলাম না। কীভাবে পারব? আমার কথায় কে বিশ্বাস করবে? কিন্তু কয়েকদিন পর রঞ্জুর ফুলে ফেঁপে ওঠা পচাগলা দেহটা নদী থেকে উদ্ধার হওয়ার পর থেকে প্রায়ই গিয়ে বসে থাকতাম নদীর ধারে। অনেক প্রশ্ন জাগত মনে। কিন্তু উত্তর ছিল না। এর মধ্যে একদিন নদীর ধারে জমে থাকা পলিতে গেঁথে থাকা ঘটিটা দেখতে পেলাম। সেটা বাড়িতে নিয়ে এলাম। তারপর থেকেই প্রায়ই একটা বীভৎস মূর্তি দেখতে পেতাম আমার আশেপাশে। প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতাম। শ্বশুর মশাইয়ের মুখে শুনেছিলাম জ্বিনকে সবসময় কাজে লাগাতে হয়। নইলে সে তার মালিককেই হত্যা করে। কিন্তু আমি মন্ত্র তন্ত্র জানি না। শরণাপন্ন হলাম আমাদের কুলপুরোহিত বিপিনবাবুর। উনি সবই জানতেন। আমার শ্বশুরমশাইয়ের আমল থেকে উনি আমাদের কুলপুরোহিত। প্রথমটা অরাজি হলেও সন্তানহারা মায়ের অশ্রু তাঁর মন গলিয়েছিল। উনিই আমাকে নিয়ে যান একজন পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিকের কাছে। সেই থেকে এই এতদিন… আমার এতগুলো বছর কেটে গেছে জ্বিন বশীভূত করার বিদ্যা শিখতে। একমাত্র সন্তানের মৃত্যু মাকে দিয়ে কী কী করিয়ে নিতে পারে, আমি তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। শুধু প্রার্থনা করতাম, আমার প্রতিশোধ পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত যেন বেঁচে থাকতে পারি। 

প্রথমে খোঁজ পেলাম বিপ্লবের। এই বাড়িতে একা থাকত। কাজকর্ম তেমন কিছু করত না। একটু পাগলাটে ছিল। একদিন এসে আলাপ করলাম ওর সঙ্গে। আমার পরিচয় পেয়ে কেঁদে ফেলল। ক্ষমা চাইছিল বারবার। খারাপ লাগছিল, কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। আমার ছেলের অকালমৃত্যু শুধু নয়, শেষ দেখাটাও আমাকে দেখতে না দেওয়ার মতো নিষ্ঠুরতা যারা করেছে, আমাকে তো তাদের শাস্তি দিতেই হত। বিপ্লবই খোঁজ দিল অজয়ের। নিজের মানসিক সমস্যার জন্য ডাক্তারের খোঁজ করতে গিয়ে অজয়ের সন্ধান পেয়েছিল বিপ্লব। কিন্তু যায়নি ওর কাছে। এক রাতে বিপ্লবের নামে সংকল্প করে জ্বিন ছাড়লাম। এর পরদিন বিপ্লবের মা সেজে ওকে ভর্তি করালাম অজয়ের হসপিটালে। জ্বিন তার নিজের কাজ সেরে ফিরে এসেছে। বাকি ছিলি তুই। ভাবছিলাম তোকে কোথায় পাব! অথচ দেখ, একেই বোধহয় বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। নিজে থেকে এসে উঠলি আমার দোরে।” 

মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে রঞ্জনের মায়ের। হাতে ধরা ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা মোছা শেষ হয়েছে। শেলফের উপরে রাখা বাকি তিনটে ফ্রেমকে ঠেলে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছেন সম্ভবত চতুর্থ ছবিটির জায়গা করার জন্য। 

সৌম্য ঘামছিলেন। ভদ্রমহিলা যে রঞ্জনের মা, সে ব্যাপারে তাঁর কোনও সন্দেহ নেই। একসময়ে প্রায় রোজ দেখা মুখটা এতক্ষণে তাঁর স্মৃতিতে স্পষ্ট। কিন্তু তাঁর বলা কথাগুলো কি বিশ্বাসযোগ্য, নাকি কেবলই শোকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা এক মায়ের প্রলাপ, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। হ্যাঁ, অল্পবয়সের নির্বুদ্ধিতায় তাঁরা অন্যায় করেছিলেন, কিন্তু রঞ্জন যে প্ল্যানচেট করতে গিয়ে প্রেতের কবলে পড়ে নিহত হয়েছে, এ কথা কি কেউ বিশ্বাস করত? তিনটে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনা অপরাধে শেষ হয়ে যেত না? আরে, ওগুলো কাদের ছবি? ফ্রেমগুলোকে সরাতে গিয়ে খসে পড়েছে ফুলের মালা। আর তাতেই মোমের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ছবিগুলো। একটাই ছবি ছিল, চারজনের। রঞ্জনের শেষ জন্মদিনে ওদের বাড়িতেই তোলা। ছবির চারটি চরিত্রকে আলাদা করে চারটি আলাদা ছবি বাঁধানো হয়েছে। পরপর দেখা যাচ্ছে হাসি মুখে রঞ্জন, বিপ্লব আর অজয়কে। আর শেষতম ছবি, যেটা এইমাত্র রঞ্জনের মা রাখলেন বইয়ের শেলফের উপর, সেটা সৌম্যর। খসে পড়া ফুলের মালাগুলো আবার পরিয়ে দিচ্ছেন তিনি ছবিগুলোতে। তিনটে ছবিতে মালা পরিয়ে সামনে রাখা চতুর্থ মালা যেটাকে এতক্ষণ ফুলের স্তূপ বলে মনে করেছিলেন সৌম্য, সেটা তুলে চতুর্থ ছবির সামনে রাখলেন রঞ্জনের মা। মৃদু হাসি নিয়ে তাকালেন সৌম্যর দিকে। 

“আ, আমি এখন উঠব। আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

ঠোঁটে আঙুল দিয়ে সৌম্যকে চুপ করতে ইশারা করলেন ভদ্রমহিলা।

“চুপ। একদম চুপ। শোন, শুনতে পাচ্ছিস? ও এখানেই আছে। ওই যে, আসছে। ওর শেষ কাজ। এরপর ওকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেব ঘটির মধ্যে। আর পুঁতে দেব মাটির নীচে। ওর কাজও শেষ, আমার কাজও শেষ। এবার নিশ্চিন্তে মরতে পারব আমি। ওই শুনতে পাচ্ছিস?” 

মোমের আলোয় রঞ্জনের মায়ের বিস্ফারিত চোখদুটো ভয়ংকর দেখাচ্ছে। না, এখানে আর এক মুহূর্তও না। এক্ষুনি বেরোতে হবে এখান থেকে। দরজার দিকে এগোনোর জন্য পা বাড়াতেই সৌম্যর কানে এল ভারী পায়ের শব্দ। থপ থপ থপ… কেউ বা কিছু নেমে আসছে দেওয়াল বেয়ে। অজয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট পলাশের বর্ণনার কথা মনে পড়ে গেল সৌম্যর। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। আচমকা দপ করে নিভে গেল একসঙ্গে দুটো মোমবাতিই। একটা উৎকট গন্ধ ঘিরে ধরেছে সৌম্যকে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে শুধু কানে আসছে একজোড়া ভারী পদক্ষেপ এগিয়ে আসছে… দরজাটা কোনদিকে? দরজাটা? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *