উপনিবেশবাদ প্রসঙ্গে মার্কস

উপনিবেশবাদ প্রসঙ্গে মার্কস
রণবীর সমাদ্দার

বিশ্ববাজার, বিশ্ববাণিজ্য

উপনিবেশবাদ নিয়ে মার্কস কোনও প্রামাণ্য গ্রন্থ লিখে যাননি। সম্ভবত কোনও সম্পূর্ণ তত্ত্ব তাঁর লেখায় পাওয়া যাবে না। এ নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। কেউ বলেছেন মার্কস প্রাচ্যবাদী; মার্কস ছিলেন পশ্চিমি এবং পশ্চিম সভ্যতা কেন্দ্রিক। এডওয়ার্ড সইদের মতো সাংস্কৃতিক তত্ত্ববিদ এ নিয়ে মার্কসের সমালোচনা করেছেন। আবার এ কথাও কেউ কেউ বলেছেন, মার্কস শিল্প, শিল্পায়ন, শিল্পসভ্যতা— এর বাইরে কিছু বোঝেননি, বা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করেননি। ফলে, উপনিবেশবাদ নিয়ে মার্কসের আগ্রহ ছিল সীমিত।

এই লেখা উপরোক্ত অভিযোগসমূহের জবাব নয়। যদিও এই অভিযোগসমূহ খেয়ালে রাখলে মার্কসের উপনিবেশবাদ সংক্রান্ত লেখাপত্র বোঝার ক্ষেত্রে সুবিধে হবে। মার্কসের লেখাপত্র নানা জায়গায় পাওয়া যায়। এসব লেখা অভিযোগকারীরা জানেন না তা নয়; কিন্তু সাংস্কৃতিক আলোচনার একটা কাঠামো আছে যা অভিযোগকারীদের বক্তব্যের ধরনকে নির্ধারিত করে। একইসঙ্গে বোঝা যায়, এইসব অভিযোগকারীরা উপনিবেশবাদ প্রসঙ্গে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ উপলব্ধি করতে কেন ব্যর্থ হয়েছেন। অন্য দিকে আমাদের বোঝা দরকার উপনিবেশবাদ নিয়ে মার্কসের জীবনব্যাপী চর্চা, বিশেষত ভারত অধ্যয়ন, কীভাবে শুরু হয়েছিল, এবং তার বিকাশই-বা তাঁর চিন্তাধারায় কীভাবে ঘটল।

উপনিবেশ নিয়ে মার্কসের চিন্তা তাঁকে প্রাক্-ঔপনিবেশিক সমাজ-কাঠামো নিয়ে ভাবনাচিন্তার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রাক্-ঔপনিবেশিক উৎপাদন ব্যবস্থা বলতে তিনি কি কোনও স্বতন্ত্র ‘এশীয়’ উৎপাদন ব্যবস্থা অথবা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা বুঝতেন? এ নিয়ে কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত তাঁর লেখায় পাওয়া যায় না, যদিও নানা ভাবনার ছাপ তাঁর জীবনব্যাপী লেখায় রয়েছে। হয়তো এই দুই বিষয় নিয়ে তাঁর ভাবনা— ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা এবং প্রাক্-ঔপনিবেশিক সমাজ গঠন নিয়ে তাঁর নানা বক্তব্যকে গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না। অথচ এই দুই বিষয়ে তাঁর ভাবনার মাঝে গভীর সম্পর্ক আছে। ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রসঙ্গে মার্কসের বিশ্লেষণ, রচনা, মন্তব্যাবলি এবং চিঠিপত্র পড়ার সময় উপরের কথাগুলো খেয়ালে থাকা দরকার।

অন্য দিকে বিশ্ববাজার এবং বিশ্ববাণিজ্যের কথা মার্কসের লেখায় নানাভাবে ঘুরে-ফিরে এসেছে। উপনিবেশবাদ নিয়ে তাঁর লেখার প্রেক্ষিত রূপে কাজ করেছে পুঁজিবাদী যুগে বিশ্ববাজার এবং বিশ্ববাণিজ্যের প্রসঙ্গ। ধনতন্ত্র বিশ্ববাজার সৃষ্টি করে, বিশ্ববাণিজ্যকে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যায়, বিভিন্ন আঞ্চলিক বাজার ধ্বংস করে, পুরনো বাণিজ্য প্রাচীর ভেঙে দেয়, নতুন প্রাচীর সৃষ্টি করে। বিশ্ব-ইতিহাসের প্রতিমূর্তি বিশ্ববাণিজ্য, মার্কস এ কথা কখনও বলেননি। কিন্তু হেগেলের ছাত্র হিসেবে মার্কস প্রথম থেকে ‘বিশ্ব’ নামক এক ধারণার কাছে বার বার ঘুরে-ফিরে এসেছেন। বলা চলে, মার্কসের লেখায় বিশ্ববাণিজ্য আধুনিক ইতিহাসের চালিকাশক্তি রূপে আবির্ভূত হয়েছে। জার্মান ইডিওলজি, তাঁর খসড়া রচনা গ্রুনড্রিশে অথবা বিখ্যাত কমিউনিস্ট ইস্তাহার— এইসব লেখায় বিশ্ববাজার এবং বিশ্ববাণিজ্যের শক্তির কথা বার বার উঠে এসেছে।

বিশ্ববাণিজ্য কী? এই সংক্রান্ত তাঁর আলোচনায় ভূগোল যেমন এসেছে, তেমনই উঠে এসেছে পুঁজির আদিম সঞ্চয়ের কথা, এবং উপনিবেশবাদের প্রসঙ্গ। বিশ্ববাণিজ্য এক ধরনের শক্তি যা পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং রাজনীতির সম্মিলিত রূপকে প্রাবল্য দিয়েছে। বিশ্ববাণিজ্য বিশ্বঅর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা আনে; ধ্বংস ও বাজারনির্মাণকে এক নিরন্তর যৌথ প্রক্রিয়ায় পরিণত করে। বিশ্ববাণিজ্য ধনতন্ত্রের প্রাণভোমরা হয়ে দাঁড়ায়।

এইভাবে বাণিজ্যের পূর্বতন তত্ত্ব এবং পূর্বতন ইতিহাসকে পুঁজিবাদী ইতিহাসের অবয়বে ফিরে দেখার সম্ভাবনা মার্কস আমাদের সামনে হাজির করলেন। পুঁজিবাদের রথাশ্বের সঙ্গে বিশ্ববাণিজ্যকে জুড়ে তিনি আমাদের দেখালেন পুঁজিবাদকে বিশ্বশক্তি হিসাবে কীভাবে এবং কেন দেখতে হবে, এবং উপনিবেশবাদকে বুঝতে গেলে এবং ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে কেন ধনতন্ত্র নামক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সম্ভাবনার এক অংশ হিসেবে দেখতে হবে, কেন ধনতন্ত্র এবং উপনিবেশবাদ বিষয়টিকে পারস্পরিক সম্পর্কের নিরিখে বিচার করতে হবে।

এই একই কারণে উপনিবেশবাদ এবং ভারতবর্ষ সংক্রান্ত তাঁর নানা লেখা মার্কসবাদী মহলে এবং সাধারণভাবে উপনিবেশবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের মাঝে আলাপ আলোচনা ও বিতর্কের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সামাজিক উত্তরণের প্রশ্নকে ঘিরে নানা আলাপ আলোচনা শুরু হল, মার্কসের লেখাপত্র নিয়ে। উপনিবেশবাদ কি এক অন্তর্বর্তী অধ্যায় যার মধ্য দিয়ে ধনতন্ত্র বিশ্বজুড়ে ছড়াল? উপনিবেশ শাসনের মধ্য দিয়ে কৃষক সংগ্রাম কি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অঙ্গীভূত হল? ঔপনিবেশিক বাণিজ্য কি বিশ্ববাণিজ্যের প্রকৃত রূপ উদ্ঘাটন করল? এরকম বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক হল মার্কসের উপনিবেশবাদ সংক্রান্ত লেখাপত্র থেকে। একইভাবে মার্কসের বিভিন্ন লেখা থেকে পুঁজিবাদী উত্তরণের যে ছবি বেরুল, তা বিভিন্ন ধরনের, এবং বিভিন্ন সম্ভাবনার ইঙ্গিতবাহী। গভীর সম্ভাবনাময় এইসব লেখাকে তাই নানা দেশের কমিউনিস্টরা বার বার পড়েছেন; পুঁজিবাদী উত্তরণ নিয়ে তাঁর লেখার যেসব দিক ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে, সেসব লেখাও পড়া হয়েছে গভীর আগ্রহের সঙ্গে, বারংবার। বিশ্ববাজার নিয়ে মার্কসের নানা লেখা এইভাবে উপনিবেশবাদ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পরিপ্রেক্ষিত রূপে কাজ করেছে। আন্তঃ-উপনিবেশ বাণিজ্য, যেমন ভারত ও চিনের মধ্যে আফিম বাণিজ্য, চিন থেকে সোনা রপ্তানি, এই ধরনের নানা প্রসঙ্গ মার্কসের লেখায় এসেছে বিশ্ববাণিজ্য এবং উপনিবেশবাদের গভীর সম্পর্কের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে।

বিশ্ববাণিজ্যের ধারণা মার্কসের লেখায় ধনতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণের এক স্তম্ভ। উৎপাদন এবং পণ্য সঞ্চালন— একই অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার দুই মুহূর্ত। উৎপাদনের বাস্তবায়ন ঘটে সঞ্চালনের প্রক্রিয়ায়। পণ্যসঞ্চালন, বিশেষত পুঁজিরূপী পণ্যসঞ্চালন বাস্তবায়িত হয় উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। বিশ্ববাজার এবং বিশ্ববাণিজ্য এইভাবে ধনতন্ত্রকে এক বাস্তব শক্তিরূপে গড়ে তোলে। ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ— সব কিছুকে আঘাত করে; ইতিহাসের মানচিত্রের প্রভূত পরিবর্তন সাধন করেই পুঁজিবাদের আবির্ভাব এবং তাঁর জীবন। উপনিবেশবাদ এই বিশ্ববাণিজ্যের এক মূর্তরূপ। স্লোগানের ভাষায় বলা যায়, উপনিবেশবাদ নেই, অর্থাৎ ধনতন্ত্র নেই।

সতর্ক হওয়া দরকার, মার্কস এখানে কোনও বিশ্বব্যবস্থার কথা বলছেন না। অথবা এও বলছেন না যে, পুঁজিবাদ একটি নির্ধারিত কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সীমান্তে প্রসারিত হচ্ছে। মার্কসের বক্তব্যের তাৎপর্য রয়েছে উপনিবেশবাদকে বোঝার ক্ষেত্রে; আরও গভীরে গিয়ে বলা যায়, সামাজিক উত্তরণের জটিলতা উপলব্ধির ক্ষেত্রে। বিশ্ববাণিজ্য এবং পুঁজির আদিম সঞ্চয়ের এই যুগ্ম আলোচনা আমাদের সামনে নিয়ে আসে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের প্রসঙ্গকে। বৈপ্লবিক রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা উঠে আসে বিশ্ববাণিজ্যের ঝোড়ো যুগে।

ঔপনিবেশিক সম্পর্ক, শ্রেণিসম্পর্ক এবং কৃষক

প্রাক্-ঔপনিবেশিক সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এল? শ্রেণিসম্পর্কের বিন্যাসের ওপর কী প্রভাব পড়ল? নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন পত্রিকায় মার্কস দীর্ঘকাল ধরে (এক দশকেরও বেশি) যেসব লেখালেখি করেছেন, তার এক বড় অংশ জুড়ে আছে ঔপনিবেশিক সমাজে শ্রেণিসম্পর্কের পরিবর্তনের প্রশ্নটি। তাঁর বক্তব্য কিছু ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হয়েছে, বা বলা চলে যে, সমাজ পরিবর্তনের গতিপথের যে-সম্ভাবনার কথা মার্কস ভেবেছিলেন, সমাজ পরিবর্তন ঠিক সেভাবে হয়নি। বিশেষত দু’টি লেখা, ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ (২৫ জুন, ১৮৫৩) এবং ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফল’ (২২ জুলাই, ১৮৫৩), যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক। এবং তার বেশিরভাগই সমালোচনামূলক। এইসব সমালোচনার আবার বেশিরভাগই মার্কসের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সরিয়ে রেখে করা।

ভারতবর্ষ সম্পর্কে মার্কসের এইসব লেখাপত্র বা প্রতিবেদনসমূহের মূল প্রশ্ন ছিল, উপনিবেশে সামাজিক রূপান্তরের কী চেহারা দাঁড়াবে এবং উপনিবেশে রাজনৈতিক বিপ্লব সাধিত হবে কোন পথে? আজ আমরা এই প্রশ্নের নাম দিয়েছি ‘জাতি এবং শ্রেণি’ অথবা ‘জাতি এবং শ্রেণির আন্তঃসম্পর্কের সমস্যা’। ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ নামক প্রতিবেদনে মার্কস লিখলেন প্রাচ্যে সরকার চলে কীভাবে, খাজনা আসে কীভাবে, লুণ্ঠনের গুরুত্ব, সাম্রাজ্য চালানোর ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরনের প্রশাসনের উপস্থিতি; এবং তার পাশাপাশি ব্যবসায়-বাণিজ্যের চেহারা, এবং কৃষকদের অবস্থা। বর্ণে বিভক্ত গ্রামসমাজ বারংবার জনশূন্য হয়ে গেছে আগ্রাসন, যুদ্ধ এবং মহামারিতে। ভারতবর্ষে, মার্কস বললেন, গ্রামসমাজ অক্ষয়, অব্যয়; কিন্তু এও বললেন, গ্রামসমাজের ভবিষ্যৎই হল পদদলিত, লুণ্ঠিত হওয়া। এই সমাজে পরিবর্তন আসবে কীভাবে? কিন্তু পরিবর্তনের মূল্য দিতে হবে অনেক। গ্যোয়েটের উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কস বললেন, ব্যক্তিগতভাবে আমরা সবাই এই পরিবর্তনের নির্মম প্রক্রিয়ায় দুঃখ পেতে পারি। কিন্তু নিদারুণ কষ্টের পথে পরিবর্তনের এই কি বাস্তবতা নয়?

এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তি, শিল্পায়ন, এবং পুঁজি বিনিয়োগের বিধ্বংসী প্রক্রিয়ার দিকে মার্কস পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ব্রিটিশ তরবারি, বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ, রেলপথ, এবং ব্রিটিশ ‘ড্রিল সার্জেন্ট’ দ্বারা শিক্ষিত সৈন্যবাহিনী উপনিবেশের মুক্তির আবশ্যিক শর্ত হয়ে দাঁড়াবে। এবং যদিও জমিদারি এবং রায়তওয়ারি ব্যবস্থা ব্যক্তিগত সম্পত্তির রূপ নিয়ে নানা কুফল আনছে, উপরোক্ত যন্ত্র, প্রযুক্তি এবং এক নব্যশিক্ষিত সামাজিক স্তর— এই তিন উপাদানের সমন্বয়ে ব্রিটিশ শাসনের অধীনেই এক আধুনিক শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা নিজেরা দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করবে।

এখানে মনে রাখা দরকার ‘এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা’ নামক এক ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কিত কোনো অতি সরল ধারণা মার্কস পোষণ করেননি। ঔপনিবেশিক সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের বিশ্লেষণ করতে গেলে ‘প্রাক্-ঔপনিবেশিক’ অতীত সম্পর্কে এক সম্যক ধারণা গড়ে তোলা মার্কসের কাছে প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল নিম্নলিখিত অনুসন্ধানে ব্রতী হওয়া— প্রাক্-ঔপনিবেশিক সমাজে উদ্বৃত্ত আহরণ করা হত এবং ভোগ হত কীভাবে। এই উদ্বৃত্ত আহরণ এবং ভোগের প্রক্রিয়ায় ধর্মের এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির কী ভূমিকা ছিল। কীভাবে ধর্ম এবং উপাসনা ব্যবস্থা এক দিকে সৃষ্টি করল এক দলিত সমাজ, অন্য দিকে লালিত করল এক উদ্বৃত্তভোগী, প্রতিপত্তিশালী সম্প্রদায় এবং রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থাকে। মহাজনি পুঁজি, গ্রামীণ সম্পত্তি ব্যবস্থা, এবং শাসনব্যবস্থা— এর আন্তঃসম্পর্ক নির্ধারিত হত কীভাবে।

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, মার্কসের বিশ্লেষণ, মন্তব্য, এবং প্রতিবেদনের কিছু কিছু অংশ পড়লে মনে হয় যে, ভারতবর্ষে কোনও সামাজিক পরিবর্তন কখনও এসেছে— সে ধারণা তিনি অস্বীকার করেছেন। জড় ভারতবর্ষে ইতিহাস আবির্ভূত হচ্ছে পুঁজিবাদ উপনিবেশ স্থাপনের হাত ধরে— হয়তো এমন এক হেগেলীয় ধারণার বশবর্তী হয়েছেন। অন্য দিকে এও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মার্কসের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শ্রেণিসম্পর্কের বাস্তবতার দিকে নজর ঘোরানো। উদীয়মান জাতির সামনে হাজির করা শ্রেণি নামক বাস্তবতাকে। এই অনুসন্ধানও সহজ ছিল না। অনুসন্ধানের এই পথেও নতুন সমস্যা ও নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল মার্কসকে।

জাতির স্বাধীনতা এবং ঔপনিবেশিক অধীনতা থেকে যদি দেশকে মুক্ত হতে হয়, তবে কোন সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি জাতির এই সংগ্রামকে সম্ভব করে তুলবে? স্বাধীনতাকামী সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি কোন শ্রেণির অবয়বে মূর্ত হবে এবং কেন এই ভূস্বামীবর্গ, নব্যশিক্ষিত সামাজিক স্তর? না কি ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে অপস্রিয়মাণ সর্বভারতীয় রাজশক্তি যা মুঘল সাম্রাজ্য নামে খ্যাত ছিল? না কি কৃষকরা? না কি এইসব মিলিয়ে এক শক্তি, যাকে আখ্যা দেওয়া চলে জাতীয় শক্তি রূপে?

মার্কসের অনুসন্ধান এবং উত্তর একাধিক পথে গেছে। নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন-এ ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালীন মহাবিদ্রোহকে মার্কস আখ্যা দিয়েছিলেন জাতীয় বিদ্রোহ রূপে। বিভিন্ন শ্রেণি এবং স্তরের সমন্বয়ে এই মহাবিদ্রোহ। কিন্তু বাস্তববাদী মার্কস-এঙ্গেলসের চোখ এড়ায়নি ঔপনিবেশিক ভারতে শ্রেণিসম্পর্কের জটিলতা, সম্পত্তিবান ভূস্বামীদের দুর্বলতা, সামরিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা, এবং দেশের সামগ্রিক জনসাধারণের দুর্বিষহ অবস্থা। তাই জাতীয় অভ্যুত্থান ঘটলেই যে তা সফল হবে এ আশা মার্কস-এঙ্গেলসের ছিল না। কিন্তু অন্য এক পথেও তাঁদের চিন্তাভাবনা গিয়েছিল। মার্কস গভীর আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করেছিলেন চিনে ঔপনিবেশিক শক্তিবিরোধী অভ্যুত্থান, ঠিক যেমন লক্ষ করেছিলেন রাশিয়ায় জার-বিরোধী সংগ্রামের সম্ভাবনা। ঔপনিবেশিকতাবাদ-বিরোধী সংগ্রাম এবং অভ্যুত্থান কীভাবে জাতীয় চেতনার রূপ পেতে পারে, মার্কসের লেখায় তার ইঙ্গিত আছে।

এই ধরনের সামাজিক প্রেক্ষাপটে কৃষকদের ভূমিকা নিয়ে মার্কস চিন্তাভাবনা করেছিলেন। ঔপনিবেশিক শাসন নিয়ে মার্কসের বিভিন্ন বক্তব্যে কৃষকের কথা বারংবার ফিরে এসেছে। আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ শাসনের পরিণাম আইরিশ কৃষককে কী চরম মাত্রায় ভোগ করতে হয়েছিল, আইরিশ ভূস্বামীবর্গের অবস্থান, অথবা চিনে কৃষকদের অবস্থা— এইসব নিয়ে তাঁর নানা মন্তব্য আছে। এইসব মন্তব্য এবং আলোচনায় মার্কসের এক দ্বিধাও ধরা পড়ে। কৃষকরা কি একটা শ্রেণি যা সামাজিক এবং জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেবে, সমগ্র জাতিকে সমাবিষ্ট করবে, এবং নেতৃত্ব দেবে? আয়ারল্যান্ড প্রসঙ্গে মার্কস এবং জার্মানি প্রসঙ্গে এঙ্গেলস ‘গ্রামীণ সর্বহারা’, ‘আধা সর্বহারা’, এই ধরনের শব্দ বেশি ব্যবহার করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে কৃষক বলতে বুঝিয়েছেন গ্রামীণ ভূমিহীন কৃষক এবং গ্রামীণ সর্বহারাকে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে, বিশেষত ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময় ভূস্বামীদের প্রতিরোধকে মার্কস কৃষক প্রতিরোধ বলতে চাননি; অথচ অন্য দিকে এই বাস্তবতাকেও অস্বীকার করার উপায় ছিল না যে, ব্যাপক জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গ্রামে ভূস্বামীবর্গ থেকে কৃষক সবাই সমাবিষ্ট হচ্ছে। মার্কস একে সামন্ততান্ত্রিক প্রতিরোধও বলেননি। তাহলে জাতীয় জাগরণে কৃষকদের ভূমিকাকে দেখা হবে কীভাবে? কী পদ্ধতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সর্বহারা শ্রেণি জাতীয় জাগরণে অংশ নেবে, নেতৃত্ব দেবে, এবং অন্যান্য শ্রেণির সমাবেশ ঘটাবে? এর উত্তরের জন্য কমিউনিস্ট আন্দোলনকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় আরও চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর— ঠিক বলতে গেলে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত, যখন মাও জে-দং লিখলেন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘চিনা সমাজের শ্রেণিবিশ্লেষণের কথা’ এবং গ্রামীণ সমাজের শ্রেণিবিশ্লেষণের রূপরেখার নিরিখে চিন বিপ্লবের পথ নির্ধারণ করলেন।

জাতি, উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি, এবং শ্রেণির— বিশেষত কৃষকসমাজের— নিবিড় অথচ দ্বন্দ্বসংকুল সম্পর্ককে বোঝার চেষ্টা মার্কস থেকে মাও পর্যন্ত চলেছে। এবং, জাতি এবং কৃষকের সম্পর্ক আজও দ্বান্দ্বিক এবং রহস্যময়। তিনটি বিষয় এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য।

প্রথমত, কৃষকের সংজ্ঞা এবং ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি— মার্কস এই প্রসঙ্গকে এক কেতাবি সমস্যা রূপে দেখেননি। প্রশ্ন এটাও ছিল না যে, কৃষকরা জড়তা কাটাবে কি না। মার্কসের সামনে প্রশ্ন ছিল: ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি কীভাবে সামাজিক পরিবর্তন বা রূপান্তরের অংশ হয়ে দাঁড়াবে? তাই পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, অথবা ভারতের স্বাধীনতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘নিগ্রো দাসত্ব’ বা যাকে বলা হয় অতলান্তিক দাসত্ব— এই সব ক্ষেত্রেই স্বাধীনতার কথা মার্কসের লেখায় যুক্ত হয়েছে সামাজিক রূপান্তর বা সামাজিক বিপ্লবের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে। তাই কৃষকদের ভূমিকার কথা মার্কসকে বার বার ভাবতে হয়েছে। শ্রেণিবিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দিয়েছেন আবার জাতীয় স্বাধীনতার আশু প্রয়োজনের পক্ষেও দাঁড়িয়েছেন।পুঁজি–র প্রথম খণ্ডে মার্কস উল্লসিত অতলান্তিকের ওপারে আইরিশ বিপ্লবীদের নবজাগরণ লক্ষ করে, যা ‘ফেনিয়ান আপরাইজিং’ নামে খ্যাত। একইভাবে চিনের বিদ্রোহ লক্ষ করে তাঁর সাংবাদিক প্রতিবেদনে মার্কস লিখেছেন, ‘স্বর্গীয় শাসনের’ (চিনা শাসন) ভবিষ্যৎ কী হবে জানি না, কিন্তু নিশ্চিতভাবে জাতীয় জাগরণ ঘটবে। সামাজিক রূপান্তর ও বিপ্লবের লক্ষ্য তাঁর দৃষ্টি থেকে সরে যায়নি। মার্কস কৃষকবাদী ছিলেন না, ছিলেন বিপ্লবী। তাই প্রাচ্যবাদীরা এবং সাংস্কৃতিক সমালোচকরা মার্কসের যতই সমালোচনা করুন না কেন, তাঁরা মার্কসের মূল অনুসন্ধানের বিষয়টিই বুঝতে পারেননি।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক রূপান্তরের প্রসঙ্গ মার্কস-এঙ্গেলসকে নিয়ে গিয়েছিল গ্রামীণ সম্পত্তিব্যবস্থা বিশ্লেষণের দিকে। বস্তুত, মার্কস জীবনের শেষ বছরগুলি অতিবাহিত করেন গ্রামীণ সম্পত্তির ইতিহাস অনুসন্ধানে— যার মূল প্রশ্ন, বিভিন্ন সমাজে পুরনো যুগে উদ্বৃত্ত উৎপাদিত হত কীভাবে এবং কীভাবেই-বা তা আহৃত হত, বণ্টিত হত? এই অনুসন্ধান ছিল বহুমুখী। কেউ কেউ তাই সংগতভাবে মনে করেন, মার্কস ভাবতে শুরু করেছিলেন বহুমাত্রিক এবং বহুত্ববিশিষ্ট সামাজিক রূপান্তরের কথা। সে যাই হোক, উপনিবেশবাদের প্রেক্ষাপটে তাঁর এবং এঙ্গেলসের গ্রামীণ শ্রেণিবিশ্লেষণের প্রয়াস তাৎপর্যপূর্ণ। স্মরণ করুন এঙ্গেলসের বিখ্যাত জার্মানির গৃহযুদ্ধ নামক গ্রন্থের কথা। ষোড়শ শতাব্দীর কৃষক যুদ্ধের ব্যর্থতার কথা মার্কস-এঙ্গেলসের স্মরণে এসেছিল ১৮৪৮-এর বিপ্লবের ব্যর্থতার পর। ষোড়শ শতাব্দী এবং ১৮৪৮-৪৯-এর সময়ের অত্যাশ্চর্য মিল এঙ্গেলস হয়তো খেয়াল করেছিলেন। বুর্জোয়াশ্রেণি কৃষক বিদ্রোহের যুগে জনগণের আশার সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। ১৮৪৮-৪৯-এ তারা ব্যর্থ হল। ষোড়শ শতাব্দীর কৃষক বিদ্রোহ নিছক ধর্মীয় বিদ্রোহ ছিল না। শ্রেণিসংঘর্ষের উপাদানও সেখানে ছিল। এরই রেশ ধরে ১৮৭০-এ জার্মানির গৃহযুদ্ধ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস সরাসরি টেনে আনলেন গ্রামীণ কৃষক সমাজের শ্রেণিসম্পর্কের কথা। এবং এও বললেন যে, কৃষক সমাজের অভ্যন্তরীণ পার্থক্য এবং গ্রামীণ সম্পত্তি প্রথা সামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এই প্রক্রিয়ার শেষ কোথায়? সংক্ষেপে বলা চলে এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য মার্কসের পুঁজি গ্রন্থের শেষের দিকের প্রসিদ্ধ আলোচনার দিকে যেতে হবে যেখানে মার্কস আলোচনা করেছেন পুঁজির আদিম সঞ্চয় নিয়ে। ধনতন্ত্র কৃষক এবং কৃষকসমাজকে জমি এবং উৎপাদন যন্ত্রসমূহ থেকে উচ্ছেদ করবে। পুরনো কৃষকসমাজ হয়ে দাঁড়াবে আদিম সঞ্চয়ের উপকরণ। কৃষক রূপান্তরিত হবে ‘আদিম’ সর্বহারায়। তাই পুঁজি শেষ হচ্ছে ওই বিখ্যাত গ্রন্থের সর্বাপেক্ষা কম আলোচিত অধ্যায় দিয়ে, যার প্রসঙ্গ ছিল, উপনিবেশবাদ। এই আলোচনা অত্যন্ত জটিল ও বিশদ পরিসর সাপেক্ষ। এখানে তা সম্ভব নয়। তবু মার্কসের বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণতা ও গভীরতার দিকে একটা ইঙ্গিত হয়তো দেওয়া যেতে পারে।

তৃতীয়ত, মার্কস শুরু করেছিলেন এ কথা বলে, ‘দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনতার জন্য অন্য দেশকে পরাধীন করা দরকার এবং জন বুল তাই করেছে’। ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ প্রসঙ্গেও মার্কস একই কথা বলেছিলেন। আয়ারল্যান্ডের সমকালীন ইতিহাস পর্যালোচনা করে মার্কস প্রথম আন্তর্জাতিকের সভায় এবার একটু অন্য কথা বললেন, ‘আমি এখন দৃঢ় নিশ্চিত যে, আয়ারল্যান্ডেই বিপ্লবের দিকে প্রথমে মনোযোগ দিতে হবে যদি আমরা ইংল্যান্ডে বিপ্লব চাই’। উপনিবেশবিরোধী বিপ্লব না হলে পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লব সম্পন্ন হবে না। এই ছিল উপনিবেশবাদ প্রসঙ্গে মার্কসের বিপ্লবী শিক্ষা।

উপনিবেশ কবলিত জনগণ এক সামগ্রিক রাজনৈতিক সত্তা

উপনিবেশবাদ সংক্রান্ত মার্কসের লেখাপত্রে উপনিবেশের অবসান যুক্ত হয়েছে সামাজিক রূপান্তরের কর্মসূচির সঙ্গে। তার অর্থ হল উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রামের রাজনৈতিক চরিত্রের দিকে মনোনিবেশ করা এবং উপনিবেশবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক সত্তার তাৎপর্য অনুধাবন করা।

মার্কসের লেখায় এইভাবে আমরা দুটো বিষয়ের সন্ধান পাই। এক, উপনিবেশবাদ অবসানের এক রাজনৈতিক তত্ত্বের প্রথম আভাস এইসব লেখায়। বিস্ময় লাগে কীভাবে দেড়শো বছর আগে মার্কস উপনিবেশবাদ অবসানের এক রূপরেখা রচনায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। দুই, উপনিবেশবাদ-বিরোধী জাতীয় অভ্যুত্থানের মূল হল সর্বহারা-কৃষক মোর্চা,— এই রাজনীতির প্রতি মার্কসের ইঙ্গিত। উপনিবেশবাদ-কবলিত জনগণ এক রাজনৈতিক সত্তা; এবং সে সত্তা শুধু সর্বহারা শ্রমিক দিয়ে গঠিত নয়, বা শুধু কৃষক সাধারণকে নিয়েও তৈরি হয় না। এই রাজনৈতিক সত্তা নির্মাণের প্রক্রিয়ায় অন্যান্য সামাজিক অংশকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি হয় জাতি, যে-জাতি এক স্বতন্ত্র সত্তা রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই উপলব্ধির আভাস মার্কসের লেখায়। কোথাও স্পষ্টাকারে, কোথাও ইঙ্গিতের রূপে।

এই প্রসঙ্গে বলা যায়, মার্কস এইভাবে পশ্চিমের কৃষক ও প্রাচ্যের কৃষকের মাঝে কোনও গভীর ও মৌলিক পার্থক্য টানতে অস্বীকার করলেন। শুধু তাই নয় বর্ণদাসত্ব প্রথা কীভাবে পুঁজিবাদ এবং উপনিবেশবাদকে এক কাঠামোয় বেঁধেছে তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। পুঁজিবাদের বিকাশের নানা রূপের এক বড় কারণ হল উপনিবেশবাদের ইতিহাস— এই কথারও উল্লেখ করলেন সাবেকি অর্থশাস্ত্রের সমালোচনার অঙ্গরূপে গ্রুনড্রিশে নামক খসড়ায়। এইভাবে বিপ্লব, সামাজিক রূপান্তর, শ্রেণিবিন্যাস, জাতীয় অভ্যুত্থান এবং ঐতিহাসিক বিকাশের নানামুখী পথ মার্কসের উপনিবেশ সংক্রান্ত লেখায় একই মানচিত্রে ধরা পড়ল। ‘সাম্যবাদ, বিপ্লব এবং স্বাধীন পোল্যান্ড’ শীর্ষক আলোচনায় মার্কস যত স্পষ্ট করে বলা সম্ভব বললেন স্বাধীনতার সামাজিক চরিত্রের কথা। বললেন, ‘১৭৯৩-এর জ্যাকোবাঁ হল আমাদের আজকের যুগের কমিউনিস্টরা’, যারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে দাঁড় করিয়েছে সর্বহারার মুক্তির প্রশ্নের উপরে। ক্রাকাউ-এর বিপ্লব সমগ্র ইউরোপের কাছে এক আদর্শ দৃষ্টান্ত, কারণ ক্রাকাউ-এর এই বিপ্লব জাতীয়তাবাদকে চিহ্নিত করেছে গণতন্ত্রের সঙ্গে, সমগ্র শ্রেণিসমূহের মুক্তির সঙ্গে।’১০এইভাবে মার্কসের লেখায় এক দিকে বিপ্লব মানব ইতিহাসকে আমাদের সামনে পরিষ্কার রূপে হাজির করেছে; অন্য দিকে উপনিবেশবাদ-বিরোধী যুদ্ধ আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলেছে বিপ্লবের ইতিহাসকে।

আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি, মার্কস ঔপনিবেশিক ইতিহাসকে বিশ্ববাণিজ্যের ইতিহাসের অঙ্গরূপে দেখেছিলেন। কিন্তু এও লক্ষ করেছিলেন যে, বিশ্ববাণিজ্যের পরিণামে ঔপনিবেশিক অর্থনীতি অধীন জাতিগুলিকে ধ্বংস করেছে। তাই উপনিবেশবাদ-বিরোধী যুদ্ধ এবং ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পুঁজিবাদ বিরোধী অভ্যুত্থানের শর্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর অন্য এক অর্থ অথবা তাৎপর্য হল, সামাজিক রূপান্তরের সমস্যাকে আর পিছনে ফেলে রাখা যাচ্ছে না, কারণ উপনিবেশবাদ ধনতন্ত্রের এক আকস্মিক বা ব্যতিক্রমী রূপ নয়,— এ হলো ধনতন্ত্রের এক নিয়মিত এবং আবশ্যিক রূপ।

মার্কসের পুঁজি গ্রন্থের শেষ অধ্যায়গুলি তার উপনিবেশবাদ সংক্রান্ত নানা বক্তব্যকে সংহত করেছে। এইসব বিভিন্ন দিকগুলিকে এক জায়গায় বেঁধে মার্কস দেখিয়েছেন, উপনিবেশবাদ, কৃষক উচ্ছেদ, এবং অর্থশাস্ত্র নামক এক নবীন জ্ঞান একযোগে ভূগোল এবং ইতিহাসের এমন পরিবর্তন ঘটিয়েছে যে বিপ্লব হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বহারাশ্রেণি এবং জনসাধারণের অমোঘ কর্তব্য। আমরা বলতে পারি, উপনিবেশবাদ সংক্রান্ত মার্কসের লেখাপত্র হল তার পুঁজি সংক্রান্ত বিখ্যাত রচনাসমূহের এক সমান্তরাল খসড়া, এক সমান্তরাল কণ্ঠস্বর, এক সমান্তরাল ইতিহাস।

আমরা জানি না, মার্কস কেন এই দুই দিক— পুঁজির ইতিহাস এবং উপনিবেশের ইতিহাসকে এক সমন্বিত ইতিহাস রূপে রচনা করেননি। মার্কস এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিয়ে যাননি। আমাদের ভুললে চলবে না, মার্কস ছিলেন প্রথম মার্কসবাদী। মার্কসবাদ এগিয়েছে এইরকমই পথ হাতড়ে। এরকম পথ হাতড়ানোর মধ্য দিয়ে এগোনোই মার্কস ও মার্কসবাদের পথ। অথবা হয়তো, এও বলা যায়, পুঁজিবাদই এগোয় এইরকম দ্বিপথে।

যেটা লক্ষ করার মতো: মার্কস যেভাবে উপনিবেশ সংক্রান্ত চর্চা করেছিলেন, তাঁর মূল তাৎপর্য ছিল উপনিবেশের বিষয়টিকে পুঁজির বিশ্ব ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করা। তাই তার আলোচনা উপনিবেশবাদ/জাতীয়তাবাদ অথবা উপনিবেশ/জাতির দ্বৈততায় আবদ্ধ থাকেনি, অন্যান্য সম্পর্কিত বিষয়সমূহকে তিনি আলোচনায় টেনে এনেছিলেন, যেমন: পুঁজির আদিম সঞ্চয়, সীমারেখা, সর্বজনীনতা, নির্দিষ্ট ঘটনার নির্দিষ্ট চরিত্র, ইত্যাদি। জাতিরা উপনিবেশ সৃষ্টি করেছে, কিন্তু জাতির আবির্ভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটেছে সাম্রাজ্যের গর্ভে। মার্কস বার বার পুঁজিবাদী প্রসারের কথা তুলেছিলেন উপনিবেশবাদের আলোচনা প্রসঙ্গে, এবং সেই প্রেক্ষিতে ঔপনিবেশিক প্রশাসন ব্যবস্থা এবং সাধারণভাবে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় এনেছিলেন। এইভাবে মার্কসের লেখায় পাওয়া যায় আধুনিক প্রশাসনের আদিপর্বের আভাস। বিশ্বায়নের সত্য হিসাবে শুধু বিশ্ববাজার ও বিশ্ববাণিজ্য নয়, মার্কসের লেখায় আভাস পাওয়া যায় শ্রমের গতিশীলতা, পরিবর্তনশীল সীমারেখা, এবং পুঁজির আদিম সঞ্চয়ের নানা আলোচনার। ভারতবর্ষ, চিন, আয়ারল্যান্ড নিয়ে তাঁর আলোচনার তাৎপর্য এখানে।

তাই এটা লক্ষ করার মতো যে, ভারতবর্ষ অথবা চিন নিয়ে আলোচনা করার সময় মার্কস পুঁজিবাদকে কোনও এক কেন্দ্র থেকে পৃথিবীর নানা অংশে প্রসারিত হচ্ছে, এরকম এক ব্যবস্থা রূপে প্রসারিত করেননি। উপনিবেশ সংক্রান্ত তাঁর লেখায় এক পরিবর্তনশীল, জটিল, বিশ্বব্যাপী সম্পর্কাবলির চেহারা উঠে এসেছে, যা পুঁজিবাদকে এক আধিপত্যকামী বিশ্বব্যবস্থায় পরিণত করেছে। তাই পরিবর্তনের আলোচনায় মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক সম্পর্কাবলির প্রসঙ্গকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। অন্তত এটুকু আমরা বলতে পারি যে, মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজ-পরিবর্তন প্রসঙ্গে দ্বান্দ্বিক। উৎপাদন পদ্ধতি রূপে পুঁজিবাদ এক ধরনের সঞ্চয় পদ্ধতি বনাম পুঁজিবাদ এক ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থা— এই ধরনের কোনও চরম দ্বৈততা মার্কসের লেখায় পাওয়া যায় না। মার্কসের উপনিবেশ সংক্রান্ত লেখাপত্রে আমরা বরং পাই দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির এক শিক্ষণীয় নিদর্শন।

তবে এটুকু বলা যায়, উপনিবেশ সংক্রান্ত নানা লেখা মার্কস সারাজীবন জুড়ে রচনা করেছিলেন। তার অন্যতম প্রধান অংশ হল নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন-এ সাংবাদিক প্রতিবেদনগুলো। এই বিভিন্ন রচনাকে সরিয়ে রেখে মার্কসের পুঁজি অধ্যয়ন করা অনর্থক। পুঁজির অন্তরালের ইতিহাস হল উপনিবেশবাদের ইতিহাস। পুঁজির আদিম সঞ্চালনের নেপথ্যের কাহিনি ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়া এবং দীর্ঘ ঔপনিবেশিক যুদ্ধের ইতিহাসে পাওয়া যাবে।

এই অনুসন্ধান মার্কসকে দাঁড় করিয়েছিল জাতি এবং শ্রেণির দ্বন্দ্বের মুখোমুখি এবং সারাজীবন মার্কস জুঝেছেন এই দ্বন্দ্বের সঙ্গে। আজও মার্কসের জন্মের দু’শো বছর পরে, আমরা জুঝে চলেছি জাতি এবং শ্রেণির দ্বৈততার সঙ্গে। সম্ভবত বিপ্লবী চিন্তাধারার জীবনে এ এক নির্মম বাস্তব এবং এর ভবিতব্য।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

১. এডওয়ার্ড সইদ অ-পশ্চিমি সমাজ সম্পর্কে মার্কসের বক্তব্য জাতিবিদ্বেষমূলক এমন অভিযোগও করেছিলেন। Edward Said, Orientalism (Vintage : New York, 1978), p. 155.

২. ভারতবর্ষ সংক্রান্ত তাঁর অনেকগুলি লেখার জন্য Iqbal Husain (ed.), Karl Marx on India: From the New York Daily Tribune (including Articles by Frederick Engels) and Extracts from Marx-Engels Correspondence 1853-1862 (Aligarh Historians Society and Tulika Books : New Delhi, 2006) দ্রষ্টব্য।

৩. ‘The British Rule in India’, New York Daily Tribune, 25 June 1853. https://www.marxists.org/archive/marx/works/1853/06/25.htm (accessed on 10 September 2018); ‘The Future Results of British Rule in India’, New York Daily Tribune, 22 July 1853. https://marxists.catbull.com/archive/marx/ works/1853/07/22.htm (accessed on 10 September 2018).

৪. ‘The British Rule in India’, New York Daily Tribune, 25 June 1853. https://www.marxists.org/archive/marx/works/1853/06/25.htm (accessed on 10 September 2018).

৫. ‘Lord Canning’s Proclamation and Land Tenure in India’, New York Daily Tribune, 7 June 1858. https://www.marxists.org/ archive/marx/works/1858/06/07.htm (accessed on 14 April 2018).

৬. ‘Analysis of Classes in Chinese Society’ (March 1926), Selected Works of Mao Tse-Tung, Volume 1 (Foreign Language Press: Beijing). https://www.marxists.org/reference/archive/mao/selected-works/volume-1/mswv1_1.htm (accessed on 1 October 2018).

৭. Frederick Engels, ‘Introduction’, The Peasant War in Germany (International Publishers: New York, 1948), pp. 8-9. https://www.marxists.org/archive/marx/works/download/pdf/peasant-war-germany.pdf (accessed on 12 August 2018).

৮. Karl Marx, ‘The Modern Theory of Colonisation’, Capital, Volume 1, chapter 33 (Penguin Classics: London, 1990), pp. 931-942.

৯. Marx to Engels (11 December 1869), ‘As to the Irish question… the way I shall put forward the matter next Tuesday is this: that quite apart from all phrases about “international” and “humane” justice for Ireland—which are to be taken for granted in the International Council—it is in the direct and absolute interest of the English working class to get rid of their present connection with Ireland. And this is my most complete conviction, and for reasons which in part I cannot tell the English workers themselves. For a long time I believed that it would be possible to overthrow the Irish regime by English working class ascendancy. I always expressed this point of view in the New York Tribune. Deeper study has now convinced me of the opposite. The English working class will never accomplish anything before it has got rid of Ireland. The lever must be applied in Ireland. That is why the Irish question is so important for the social movement in general.’ (Italics in original). https://www.marxists.org/archive/marx/works/1869/letters/69_12_10-abs.htm (accessed on 12 September 2018).

১০. Karl Marx, ‘Communism, Revolution and a Free Poland’, public lecture in Brussels on the occasion of the second anniversary of the Krakow Uprising, 22 February 1848. https://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/02/22a.htm (accessed on 11 October, 2018).

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *