উপদেবতায় বিশ্বাস
(১) ডান
‘ডান’ সাঁওতালদিগের এক বিশেষ জ্বালা। “ডান” থেকে গ্রামের লোক শত্রু হয়; আত্মীয়কুটুম্বের দরজা বন্ধ হয়; বাপ-ছেলে কলহ করে. ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই হয়; বুড়োবুড়ী ঝগড়া করে, আর দেশে মরক লাগে। ডান না থাকলে এদের বেশ শান্তি ছিল। সাহেবেরা এতলোকের বিচার করে, কিন্তু কি জানি কেন ডানদের লাগাল পায় না। ডান এদের খেয়ে ফেলে, আর এরা যদি ‘ডান’ ধরে মারপিট করে তবে হাকিম উল্টা তাদের জেল দেয়। হাকিমদের বুঝালেও বুঝে না; এরা ডানকে বলে থাকে “আচ্ছা বেশ, আমার আঙ্গুল খেয়ে ফেল দেখি, নতুবা বিশ্বাস করবো না”—এই বলে ডানদের জেল দেয়।
এখন আর পুরুষের কথা কেহ শুনে না। মেয়েদেরই রাজ্য হয়েছে। পুরুষেরা কিছু বললে কেহ শুনে না সেজন্য তারা চুপ করে থাকে। ডানেরা রাত্রে গ্রামের রাস্তায়, বনে ও প্রান্তরে বসে থাকে। কথায় বলে এরা মাটিতে চলে না; মন্ত্রের গুণে ডালে ডালে বসে বাতাসের মত ঘুরে বেড়ায়; ঠাকুরদের আখরায় নেমে ঠাকুরদের সঙ্গে নাচে, এবং বাঘ ডেকে আনে এবং চিরুণী দিয়ে তাদের আঁচরিয়ে চুমা খায়; তারপর ঠাকুরদের কাবু করে শপথ করায় তাঁরা যেন খড়িমাটিতে না উঠে পড়ে। এরূপ করে মোরগের ডাক শুনলেই ভোরে ঘরে ফিরে যায়।
ডানেরা অনেক চেলা করে; ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভুলিয়ে নিয়ে যায়। নিজেরা মরলে যেন বীজ থাকে সেজন্য সন্ধ্যায় বাতি জ্বললে রাতে বের হয়। চেলার জন্য লোকের ঘরে ঢুকে, ছোটমেয়েদের বের করে আনে, এবং তারা স্বীকার না পেলে বলে, “যদি না শিখিস তবে মরে যাবি অথবা বাঘে খাবে।” এজন্য ভয়ে এরা কষ্টে সৃষ্টে শিখে থাকে।
অনেকে বলে থাকে যে ডান, ওঝা, ও জান এর! সকলেই কামরু গুরু থেকে শিক্ষ। পেয়েছে। কথায় বলে, আদিযুগে এদের পূর্বপুরুষেরা উহারই চেলা হয়েছিল। ওঝা হয়ত উনির শিষ্য ছিলেন, কিন্তু ‘ডান’। কিংবা জানদের কথা ঠিক বলা যায় না।
(২) “ওঝা”
একথা ঠিক যে ওঝারা কামরু গুরুর কাছ থিকে তাদের বিদ্যা শিখেছে। অতি প্রাতনকালে এঁর দেশ এবং সাঁওতালদের দেশ “লাগালাগি” ছিল, সেজন্য প্রাচীনেরা এরূপ বলে। ওঝাদের কাজ ছয় রকম—
(১) খাঁড়ি করে পাতা পেতে তেলসিন্দুর দিয়ে গণে,
(২) চাল ছিটায়,—এও একরকম গণনা,
(৩) দাঁতে কামড়িয়ে চালের গুড়ি দিয়ে ঝাড়ান,
(৪) উপদেবতাদের বের করা,
(৫) উপদেবত ছাড়ান—ভূতছাড়ান,
(৬) লোকের ঔষধপত্র দেওয়া।
ব্যারাম হ’লে ঔষধ খেয়ে না সারলে ওঝাকে দিয়ে খঁড়ি পাতা হয়। তেল ও ‘সরিজম’ গাছের পাতা আনে; ওঝা বসে পাতায় তেল মাখিয়ে মন্ত্র পড়ে, এবং বোঙ্গা, ভূত, কি ডান বের করে। এতে সারে ত ভাল না হয়, অন্য ব্যবস্থা করা হয়।
কোন জায়গায় “দুঃখ” (বেদনা) উঠলে ঔষধ খাওয়ান হয় এবং জায়গায় বেদনার স্থানে ময়দার “পোলটিস্” দেওয়া হয়। প্রথমে একবার মন্ত্র পড়ে ঝাড়ে, তারপর মুখে দাঁতে চিবিয়ে ময়দার গুড়ি গুলি করে ক্ষতস্থানে মন্ত্র পড়তে পড়তে লাগিয়ে দেয়। এরা একপ্রকার কবিরাজবিশেষ।
(৩) জান (জ্যোতিষ)
“জান” “ডান”-বিষয়ক ব্যারামের “হাইকোর্ট”। যাকে ‘ডানে’ পায় সে জানের সাহায্য নেয়। কোন ব্যারামে ঔষধে কোন ফল না হ’লে প্রথমে খঁড়ি পেতে ওঝাকে দিয়া ঝাড়াপুছি হয়; তারপর গাছের ডাল হাতে করে সকলে “জানের” নিকট চলে আসে। গ্রাম শুদ্ধ লোকের ব্যামে। হলে সকলে মিলে মাঁঝির বাড়ীতে সমবেত হয়; আর কোন একজনের ব্যামো হ’লে সে এসে মাঁঝির নিকট কাঁদাকাটি করে। পরে রোগীর আত্মীয় দুএকজন এবং গ্রামের পাঁচছয়জন সাক্ষী জানের কাছে চলে যায়। সেখানে নানাপ্রকার প্রক্রিয়া হয়। জান বাারামের কারণ বের করে বলে দেয়, এবং রোগীকে দেবতার পূজা করতে উপদেশ দেয়।