উপত্যকার পরী [নিম্ফ অব দ্য ভ্যালি]

উপত্যকার পরী [নিম্ফ অব দ্য ভ্যালি] 

পাগল ইউহান্না 

গ্রীষ্মকালে প্রতি সকালে ইউহান্না তার বলদ ও বাছুরগুলোকে মাঠের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যেত, লাঙল বহন করত সে তার কাঁধের ওপর এবং মনোযোগ দিয়ে শুনত গায়কপাখিদের গান এবং গাছের পাতার খসখস আওয়াজ। দুপুরবেলায় সে বসত একটা নৃত্যরত স্রোতোস্বিনীর পাশে যার গতিপথ রুদ্ধ হয়েছে সবুজ চারণভূমির নিচু অংশে গিয়ে। ইউহান্না এই নদীর তীরে বসে দুপুরের খাবার খায় এবং পাখিদের জন্য ঘাসের ওপর ছড়িয়ে দেয় খাবারের টুকরো। সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে দিনের আলো কমে আসতে থাকলে সে তার বসতিতে ফিরে আসে। তাদের বসতি ছিল উত্তর লেবাননের ছোট্ট একটা গ্রামে। তারপর সে তার বয়স্ক পিতামাতার পাশে বসে তাদের আলোচনা শুনত। তারা কথা বলত সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘটছে সে সম্পর্কে এবং তাদের আলোচনা শুনতে শুনতে তার ঘুম পেত এবং ক্রমশ প্রশান্তি তাকে গ্রাস করে নিত। 

শীতের দিনগুলিতে সে আগুনের পাশে গুটিশুটি মেরে কাটাত উষ্ণতার জন্য এবং মনোযোগ দিয়ে শুনত বাতাসের চিৎকার। সে জানালার ভেতর দিয়ে উপত্যকার দিকে তাকিয়ে থাকত তাদের বরফের পোশাকের নিচে এবং কখনও তাকিয়ে থাকত পত্রহীন নিরাবরণ বৃক্ষের দিকে। দীর্ঘ রাত পর্যন্ত সে জেগে থাকত যতক্ষণ তার পিতামাতা ঘুমাতে না যায়। তারপর সে কাঠের আলমারি খুলে বের করে আনত বাইবেলের নতুন নিয়ম এবং গোপনে সে তা পড়ত বাতির অনুজ্জ্বল আলোয় এবং বারবার ভীতদৃষ্টিতে তাকাত সুখনিদ্রায় মগ্ন থাকা পিতামাতার ঘরের দিকে, যারা তাকে এই গ্রন্থ পড়তে নিষেধ করেছে। নিষেধ করার কারণ হচ্ছে সাধারণ মানুষের যিশুর শিক্ষার গোপনীয়তা সম্পর্কে জানার ব্যাপারে যাজকদের অনুমতি ছিল না। যদি কেউ তা করত তাহলে তাকে চার্চ থেকে বহিষ্কার করা হত। এ সময় ইউহান্নার যৌবনের দিনগুলি কেটে যায় বিস্ময়ের উন্মুক্ত প্রান্তর, সৌন্দর্য এবং যিশুখ্রিস্টের গ্রন্থের মাঝখানে। যখন তার পিতা কোনো কথা বলত তখন সে নিশ্চুপ হয়ে থাকত এবং মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনত কিন্তু সে একটি কথাও উচ্চারণ করত না। প্রায়ই সে তার সমবয়সীদের সঙ্গে বসত, কিন্তু সে কোনো কথা বলত না এবং তাকিয়ে থাকত তাদের ওপর দিয়ে সেইখানে, যেখানে গোধূলী মিলিত হয়েছে নীল আকাশের সঙ্গে। যখনই সে চার্চে যায় তখনই সে একটা দুঃখের অনুভূতি নিয়ে ফিরে আসে। কারণ চার্চের পুরোহিতরা যে বাণী প্রচার করেন তার সঙ্গে বাইবেলের নতুন নিয়মে সে যা পড়েছে তার কোনো মিল নেই এবং যারা বিশ্বস্ত এবং তাদের নেতারা যে জীবন যাপন করে তা নাজারেতের যিশু তাঁর গ্রন্থে যে সুন্দর জীবনের কথা উল্লেখ করেছেন, মোটেই তা নয়। 

শস্যক্ষেত ও চারণভূমিতে বসন্ত ফিরে এল এবং গলে যেতে থাকল বরফ। পাহাড়চূড়ায় অবশ্য এখনও কিছু বরফ জমে আছে। এই বরফ গলতে শুরু করলে তৈরি হবে একটা স্রোতোধারা এবং একাধিক স্রোতের সম্মিলনে পরিণত হবে একটা দ্রুতগতিসম্পন্ন নদী, তাদের গর্জন ঘোষণা করবে ঘুমিয়ে থাকা প্রকৃতির জাগরণ। আপেল ও আখরোট গাছগুলি পল্লবিত হয়ে উঠেছে এবং নতুন পাতা গজিয়েছে পপলার ও উইলো গাছে। আগুনের পাশে বসে ইউহান্না ক্রমে বিরক্ত হয়ে উঠে। তার পশুশাবকগুলি তাদের সংকীর্ণ বেড়ার ভেতরে ছটফট করতে শুরু করে। তারা এখন সবুজ তৃণভূমির জন্য ক্ষুধার্ত, কারণ তাদের জন্য মজুদ খড় ইতিমধ্যেই ফুরিয়ে গেছে। সুতরাং সে তাদেরকে মুক্ত করে মাঠের দিকে নেতৃত্ব দেয়। সে তার আলখাল্লার নিচে বহন করে বাইবেল যেন কেউ তা দেখতে না পায়। তারপর নেমে যায় পাহাড়গুচ্ছের মাঝখানে সুউচ্চ প্রাসাদের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মঠসংলগ্ন মাঠের ভেতরে। তার পশুশাবকগুলি তৃণভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং সে বসে একটা পাথরের মুখোমুখি। তাকিয়ে দেখে কিছুক্ষণ উপত্যকার যাবতীয় সৌন্দর্য এবং তারপর পড়তে শুরু করে বাইবেলে স্বর্গের সাম্রাজ্য সম্পর্কে যা বলা হয়েছে। 

এটা ছিল লেন্ট উৎসবের শেষদিকের একটা দিন। গ্রামবাসীদের ভেতরে যারা মাংস খাওয়া পরিহার করেছিল তারা অধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করেছে ইস্টারের। কিন্তু অন্যান্য গরিব কৃষকের মতো ইউহান্নাও জানত না উপবাস ও ভোজ-উৎসবের পার্থক্য, তার কাছে জীবন ছিল দ্রুততম একটি দীর্ঘদিন। কখনই তার খাবার একটা রুটির বেশি ছিল না যার সঙ্গে মিশে থাকত ভ্রূর ঘাম এবং সে ফল কিনত হৃদয়ের রক্ত দিয়ে। তার জন্য মাংস এবং দামি খাবার বর্জন করা ছিল একটা স্বাভাবিক বিষয়। উপবাসে তার শরীর ক্ষুধার্ত হয়ে উঠত না কিন্তু ক্ষুধার্ত হয়ে উঠত আত্মা, কারণ উপবাস তাকে বহন করে নিয়ে যেত যিশুর বেদনার কাছে এবং পৃথিবীতে যে জীবন তিনি যাপন করেছেন তার কাছাকাছি। 

ইউহান্নার চারপাশে পাখিরা পাখা ঝাপটাতে থাকে, ডাকতে থাকে একে অন্যকে এবং ঝাঁক বেঁধে ঘুঘুরা উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। ফুলগুলি মৃদুমন্দ বাতাসে সামনে ও পেছনে দুলছিল রৌদ্রালোকে স্নান করতে করতে। ইউহান্না বইয়ের ভেতরে ডুবে ছিল। হঠাৎ করে মাথা তুলল এবং দেখতে পেল শহরের চার্চগুলির গম্বুজ এবং গ্রামগুলি উপত্যকার ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এমনকি সে চার্চের সম্মিলিত ঘণ্টাধ্বনিও শুনতে পেল। সে তার চোখ বন্ধ করল এবং বিগত শতাব্দীগুলিকে অতিক্রম করে সে আত্মাকে পুরোনো জেরুজালেমের ওপরে ভেসে থাকার অনুমতি দিল রাস্তায় যিশুর পদচিহ্ন অনুসরণ করতে এবং তাঁর সম্পর্কে পথিকদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। পথিকেরা উত্তরে বলে : এখানে তিনি অন্ধদেরকে দৃষ্টি দান করতেন। ঐখানে তারা তাঁর জন্য একটা কাঁটার মুকুট তৈরি করেছিল এবং পরিয়ে দিয়েছিল তাঁর মাথায়। এই রাস্তায় তিনি থেমেছিলেন এবং নীতিগর্ভ রূপক কাহিনীর মাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছিলেন জনতার উদ্দেশে। ঐখানে তারা তাকে একটা থামের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল এবং থুতু দিয়েছিল তাঁর মুখে এবং চাবুক মেরেছিল তাকে। এই সংকীর্ণ পথের ওপর তিনি ক্ষমা করেছিলেন সেই বেশ্যাকে তার পাপের জন্য। আর ঐখানে তিনি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন তাঁর ক্রুশের নিচে।’ 

সময় অতিক্রান্ত হতে থাকল, আর ইউহান্না শরীরের ভেতরে একধরনের কষ্ট অনুভব করল এবং আত্মার ভেতরে প্রশংসিত হল যিশুর সঙ্গে। যখন সে উঠে দাঁড়াল মধ্যদিনের সূর্য তখন উপরে উঠে এসেছে। সে চারপাশে তাকাল কিন্তু তার পশুর পালকে দেখতে পেল না। সে তাদেরকে সব জায়গায় খুঁজল এবং হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল এই সমতলভূমিতে তাদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায়। খুঁজতে খুঁজতে সেই রাস্তায় গিয়ে থামল যা মাঠের ভেতরে হাতের রেখার মতো সরু হয়ে গেছে এবং সে সেখানে দেখতে পেল কালো পোশাক পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে বাগানের ঠিক মাঝখানে। সে দ্রুত তার কাছে গিয়ে দেখল মঠের একজন সন্ন্যাসী। ইউহান্না মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন জানাল এবং জিজ্ঞাসা করল সে তার পশুর পালকে দেখেছে কিনা। 

সন্ন্যাসী তার ক্রোধ গোপন করে ইউহান্নার দিকে তাকাল এবং রূঢ় কণ্ঠে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আমি দেখেছি তাদের। ওরা ঐখানে এসো, এসো, এখনই দেখতে পাবে।’ ইউহান্না সন্ন্যাসীকে অনুসরণ করে মঠে না পৌঁছানো পর্যন্ত। মঠে এসে সে দেখতে পায় তার পশুগুলিকে একটা প্রশস্ত খোঁয়াড়ের ভেতরে বেঁধে রাখা হয়েছে এবং তাদেরকে পাহারা দিচ্ছে অন্য এক সন্ন্যাসী। তার হাতে একটা মোটা লাঠি এবং পশুগুলি নড়াচড়া করলেই সে তাদেরকে পেটাচ্ছে। ইউহান্না যখন তাদেরকে মুক্ত করতে এগোয় তখনই সন্ন্যাসী তার আলখাল্লার প্রান্ত টেনে ধরে তাকে থামায় এবং তাকে মঠের দরজার দিকে ফেরায় এবং চিৎকার করে বলে, ‘এই হচ্ছে সেই অপরাধী রাখাল বালক। তাকে ধরেছি আমি।’ তার চিৎকারে চতুর্দিক থেকে যাজক ও সন্ন্যাসীরা ছুটে আসে। তারা ইউহান্নাকে ঘিরে ধরল সৈন্যরা যেভাবে মানুষকে ঘিরে ধরে। সে সবচেয়ে বয়স্ক সন্ন্যাসীর দিকে তাকায় এবং কোমল স্বরে বলে, ‘আমি কী করেছি যে আপনারা আমাকে অপরাধী বলছেন এবং কেন আপনারা আমাকে ঘিরে ধরেছেন?’ করাতের মতো ঘ্যাসঘ্যাস কণ্ঠস্বরে এক বয়স্ক ব্যক্তি জবাব দিলেন, ‘এই পশুগলি যেখানে চরে বেড়াচ্ছিল সেটা এই মঠের জমি এবং তারা আমাদের আঙুরবাগান নষ্ট করেছে। আমরা পশুগুলিকে আটক করেছি, কারণ এই ক্ষতির জন্য দায়ী হচ্ছে এর রাখাল।’ কথা বলার সময় তার ক্রুদ্ধ মুখ কঠিন হয়ে উঠল 1 তারপর ইউহান্না বলল, ‘ফাদার’ এরা হচ্ছে বোবা পশু, এদের কোনো বুদ্ধিবৃত্তি নেই এবং আমি একজন গরিব মানুষ এবং আমার বাহুতে কাজ করার শক্তি এবং এই পশুগুলি ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। আমার পশুগুলিকে নিয়ে যেতে দিন এবং আমি প্রতিজ্ঞা করছি এই চারণভূমিতে আমি আর কখনও আসব না।’ 

ফাদার সামনের দিকে এক পা বাড়াল, দুহাত তুলল স্বর্গের দিকে এবং বলতে লাগল, ‘ঈশ্বর আমাদেরকে এখানে স্থাপন করেছেন এবং এই ভূমির অভিভাবকত্বের ব্যাপারে বিশ্বাস করেছেন আমাদের। এই ভূমি খুবই পছন্দের ভূমি নবী এলিশার। আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমরা দিন-রাত্রি পাহারা দিচ্ছি এই ভূমি, কারণ এই ভূমি হচ্ছে পবিত্র ভূমি। যে এই ভূমির কাছাকাছি আসবে সে-ই পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। আর মঠের নির্দেশ অমান্য করলে তৃণভূমির প্রতিটি ঘাস পশুগুলির উদরে বিষে পরিণত হবে। সুতরাং পশুদেরকে তুমি নিয়ে যেতে পারবে না। আমরা ওদেরকে রেখে দেব যতক্ষণ তুমি এর ক্ষতিপূরণ না দিচ্ছ।’ 

ফাদার চলে যাচ্ছিল। ইউহান্না তাকে থামিয়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ করল, ‘আমি আপনাকে বিনয় করে বলছি ফাদার যে-দিনগুলিতে যিশু কষ্টভোগ করেছিলেন এবং মেরি কেঁদেছিলেন বেদনায়,এই উৎসবের সেই পবিত্র দিনগুলির কসম খেয়ে বলছি, আমি আমার প্রতিজ্ঞা রাখব, আমার পশুগুলিকে নিয়ে যেতে দিন। আমার প্রতি নির্দয় হবে না, আমি গরিব এবং এই আশ্রম হচ্ছে ধনী ও শক্তিশালী। নিশ্চয়ই আপনি আমার বোকামির জন্য ক্ষমা করবেন এবং আমার প্রতি দয়া দেখাবেন।’ বয়স্ক যাজক তার দিকে তাকিয়ে রসিকতা করে বলল, ‘এই আশ্রম তোমাকে ক্ষমা করবে না; শুধু তোমাকে নয়, কাউকেই নয়। হে নির্বোধ, এটা গরিব বা ধনীর বিষয় নয়। সৌন্দর্য প্রকাশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা যার তিনিই পবিত্র জিনিসগুলির গোপনীয়তা সম্পর্কে আমাদেরকেই শুধু জানিয়ে থাকেন। যদি তুমি তোমার পশুগুলিকে মুক্ত করতে চাও তাহলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তিন দিনার।’ ইউহান্না শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘ফাদার আমার কাছে কিছু নেই। করুণা করুন আমার এবং আমার দারিদ্র্যের প্রতি।’ 

যাজক তার হাতে ধরা মোটা রুটিতে আঙুল বুলিয়ে আদর করলেন এবং বললেন, ‘তাহলে এখন ফিরে যাও এবং তোমার জমির কিছুটা অংশ বিক্রি করে তিন দিনারসহ আবার ফিরে এসো। এলিশার তীব্র রোষে পতিত হওয়ার চেয়ে কোনকিছু ছাড়াই স্বর্গে প্রবেশ করা কি উত্তম নয়?’ 

ইউহান্না কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং তার শরীর উল্লসিত হয়। সে এমন এক স্বরে কথা বলতে শুরু করে যার ভেতরে ছিল প্রজ্ঞিতা এবং দৃঢ় প্রত্যয় : গরিবেরা অবশ্যই তাদের জমি বিক্রি করবে তাদের খাবার জোগাড় ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, আর আশ্রমের ধনভাণ্ডার ভরে উঠবে সোনা ও রুপায়। গরিবরা যদি আরও গরিব হয়ে পড়ে এবং হতভাগ্যরা ক্ষুধার মারা যায় তাহলে মহান এলিশা এই ক্ষুধার্ত পশুগুলিকেও ক্ষমা করতে পারেন?’ যাজক উদ্ধত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘যিশুখ্রীস্ট বলেছেন, প্রত্যেকের কাছে যা আছে তা তাকে দেওয়া হয়েছে এবং তার সবসময় প্রাচুর্য থাকবে কিন্তু তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হবে না যা তার আছে।’ 

এসব কথা শুনে ইউহান্নার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। সে তার আত্মার ভেতরে বেড়ে উঠল এবং বেড়ে উঠল তার মানসিক ও নৈতিক গুণাবলির ভেতরে। এটা ছিল এমন যেন তার পায়ের ওপর ভর করে মাটি বেড়ে উঠছে। সে তার পকেট থেকে এমনভাবে বাইবেল বের করল যেভাবে একজন যোদ্ধা নিজেকে রক্ষা করার জন্য তার তরবারি তুলে ধরে এবং সে প্রায় কেঁদে ফেলে, ‘আপনারা আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন এই পবিত্র গ্রন্থের বাণী নিয়ে। আপনারা ভণ্ড সন্ন্যাসী এবং সেইসব কথা আপনারা ব্যবহার করেন নিজের মতো করে, যা জীবনের জন্য সবচেয়ে পবিত্র এবং যা অনৈতিক কাজকে উৎসাহিত করে। দুঃখ হচ্ছে আপনাদের জন্য, যখন মানুষের পুত্র (যিশু) দ্বিতীয়বার আসবেন এবং ধ্বংস করবেন আপনাদের আশ্রম এবং তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেবেন উপত্যকার ভেতরে এবং আগুনে পোড়াবেন আপনাদের বেদি এবং প্রতিমূর্তিগুলি। যিশুির নিস্পাপ রক্ত এবং তাঁর মায়ের কান্নার কারণে আপনাদের জন্য দুঃখ হচ্ছে, কারণ তাঁরা আপনাদেরকে প্লাবনে ডুবিয়ে দেবে এবং বহন করে নিয়ে যাবে নরকের গভীরতায়। দুঃখ হচ্ছে আপনাদের জন্য যারা লোভের বেদির সম্মুখে নিজেদেরকে ধরাশায়ী করেন এবং আপনাদের কৃতকর্মের কদর্যতাকে গোপন করেন কালো পোশাকের নিচে। দুঃখ হচ্ছে আপনাদের জন্য, যারা প্রার্থনার সময় ঠোঁট নাড়ান যদিও আপনাদের হৃদয় পাথরের মতো কঠিন এবং যে বেদির সামনে নত হয় বিনয়ের সঙ্গে হৃদয়ের ভেতরে, তার আত্মা বিদ্রোহ করে তার ঈশ্বরের বিরুদ্ধে! আপনারা নিষ্ঠুর বলেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন এবং আটকে রেখেছেন একজন সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে এই ক্ষুদ্র তৃণভূমির দোহাই দিয়ে যা আমাদের জন্য সমানভাবে পরিচর্যা করে থাকে সূর্য। যখন আমি আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালাম যিশুর নামে এবং অনুরোধ জানালাম তাঁর দুঃখ ও বেদনার দিনগুলোর দোহাই দিয়ে তখন আপনি আমাকে অবজ্ঞা করেছেন। এই গ্রন্থখানা তুলে নিন, এটা খুলে দেখুন, এবং আমাকে দেখান কোথায় যিশু ক্ষমাশীল ছিলেন না। পড়ুন এই ঐশ্বরিক করুণ কাহিনী এবং আমাকে বলুন কোথায় যিশু ক্ষমা ও করুণার কথা বলেন নাই। নিচের দিকে তাকান, আপনাদের প্রত্যেকেই হৃদয়ের ভেতরে শুনতে পাবেন এইসব দরিদ্র শহর ও গ্রামগুলোতে বসবাস করে সেইসব অসুস্থ মানুষেরা, যারা যন্ত্রণার বিছানায় মর্মবেদনায় কাতরাচ্ছে; যাদের বন্দিত্বের ভেতরে দুর্ভাগ্য অতিক্রম করে দিনগুলি হতাশায় হতাশায়, যাদের দরজায় ভিক্ষুকেরা ভিক্ষা করে, যাদের উঁচু সড়কগুলিকে বিছানায় পরিণত করে আগন্তুকেরা এবং যাদের কবরস্থানগুলিতে কাঁদতে থাকে বিধবা ও এতিম।’ 

বয়স্ক যাজক চিৎকার করে বলল, ‘আটক করো এই পাপীকে। বইটা তার কাছ থেকে কেড়ে নাও এবং তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাও অন্ধকার কারাকক্ষে। সেখানে সে ঈশ্বরের অভিশাপ ভোগ করুক। সে এখানে ক্ষমা পাবে না, পরকালেও তার কোনো ক্ষমা নেই।’ সিংহ যেভাবে তার শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেভাবেই সন্ন্যাসীরা তার ওপর লাফিয়ে পড়ল। তার হাত বেঁধে ফেলল এবং নিয়ে গেল একটা সংকীর্ণ কক্ষে। তারপর দরজা বন্ধ করার আগে তাকে কিল, চড় ও লাথির পাশাপাশি বেদম প্রহার করে তারা। 

অন্ধকারে ইউহান্না বিজয়ীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে, যার সৌভাগ্য তার শত্রুকে দান করেছে তার বন্দিত্ব। দেয়ালের একটা খোলা জায়গা দিয়ে সে দেখতে পেল উপত্যকাগুলি সূর্যালোকে শুয়ে আছে। তার মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে উঠল এবং তার আত্মা আলিঙ্গন করল ঐশ্বরিক পরিতৃপ্তিকে। একটা মধুর অনুভূতি তাকে দখল করে নিল। কারাগারের এই সংকীর্ণ কক্ষে তার শরীর বন্দি থাকলেও তার আত্মা ছিল মুক্ত এবং সে মৃদুমন্দ বাতাসে তৃণভূমির ভেতরে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সন্ন্যাসীদের মারের কারণে কালসিটে দাগ পড়ে গিয়েছিল কিন্তু তারা তার অন্তর্মুখী অনুভূতিকে স্পর্শ করতে পারে নাই। সেইসব অনুভূতির ভেতরে সে নিরাপত্তায় ছিল নাজারেতবাসী যিশুর সঙ্গে। দুঃখ কষ্ট মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না, অথবা ধ্বংস করতে পারে না সেইসব মানুষকে যারা সত্যের পক্ষে থাকে। সক্রেটিস হাসতে হাসতে হেমলক পান করেছিলেন, পল উল্লসিত হয়েছিল যখন তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়। যখন আমরা আমাদের লুকিয়ে থাকা বিবেককে অস্বীকার করি, তখন তা আমাদের খুব ক্ষতি করে না। কিন্তু যখন আমরা তার সাথে প্রতারণা করি তখন সে আমাদের বিচার করে। 

ইউহান্নার পিতামাতা জানল তাদের একমাত্র সন্তানের ভাগ্যে কী ঘটেছে। তার মা আশ্রমে এল তার ছড়িতে ভর দিয়ে এবং নিজেকে নিক্ষেপ করল বয়স্ক যাজকের পায়ের ওপর। সে কেঁদে কেঁদে তার হাত চুম্বন করল এবং সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাল তার পুত্রের প্রতি দয়া করার জন্য। যাজক স্বর্গের দিকে তাকাল এবং ইউহান্নার মাকে বলল, ‘আমরা তোমার ছেলের কৌতুকপরায়ণতাকে ক্ষমা করতে পারি এবং ধৈর্য প্রদর্শন করতে পারি তার বোকামির জন্য, কিন্তু এই আশ্রমের কিছু ঐশ্বরিক অধিকার রয়েছ, যা তুলে ধরা দরকার। আমরা আমাদের বিনয়ের সাহায্যে সীমালঙ্ঘনকারী মানুষকে ক্ষমা করে থাকি, কিন্তু মহৎ এলিশা ক্ষমাও করেন না, দয়াও দেখান না যারা তার আঙুরক্ষেতে প্রবেশ করে এবং তার চারণভূমিতে পশু চরায়।’ 

ইউহান্নার মা তার দিকে তাকাল এবং তার বিবর্ণ বৃদ্ধ কপোল বেয়ে তখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তারপর সে একটা রুপার বোতাম বের করে যাজকের হাতে দিয়ে বলল, ‘এই বোতাম ছাড়া আমার কাছে আর কিছু নেই ফাদার। বিয়ের দিন আমার মা আমাকে এটা উপহার দিয়েছিলেন। সম্ভবত আশ্ৰম এটা আমার ছেলের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে গ্রহণ করবে।’ 

যাজক বোতামটা নিল এবং তার পকেটে রাখল এবং তার উদ্দেশে বলল, যখন সে তার হাত চুম্বন করছিল : দুঃখ হচ্ছে এই প্রজন্মের জন্য কারণ, যে বাণী এই গ্রন্থ থেকে সে উদ্ধৃত করেছে তা একেবারেই বিকৃত এবং ছেলেটা মূলত টক আঙুর খেয়েছে। হে নারী এখন বাড়ি ফিরে যাও এবং তার বোকামির জন্য প্রার্থনা করো যেন স্বর্গ তাকে সুস্থ করে তোলে।’ 

ইউহান্না তার বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হল এবং আস্তে আস্তে হেঁটে গেল পশুশাবকগুলির কাছে যেখানে তার মা লাঠিতে ভর দিয়ে আছে। ইউহান্না তারপর বাড়ি ফিরে গেল এবং পশুর পালকে খাবার দিয়ে সে জানালার পাশে বসল এবং তাকিয়ে থাকল দিনের বিবর্ণ আলোর দিকে। কিছুক্ষণ পর সে শুনতে পেল তার পিতা অনুচ্চকণ্ঠে তার মাকে বলছে : ‘বহু সময় আমি তোমাকে বলেছি সারা আমাদের ছেলেটা মনের দিক থেকে দুর্বল; কিন্তু তুমি তা স্বীকার করোনি কখনই। এখন আর তুমি আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবে না, কারণ তার কর্মকাণ্ড আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করেছে। যাজক তোমাকে যা বলেছে তা আমি তোমাকে কয়েক বছর আগেই বলেছিলাম।’ 

ইউহান্না একইভাবে পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকে যেখানে অসংখ্য মেঘের ওপর অস্ত যেতে থাকা সূর্যের রশ্মি বিভিন্ন রঙ ছড়াচ্ছে। 

.

এটা ছিল ইস্টার উৎসবের সময় এবং উপবাসের স্থান তখন দখল করেছে ভোজপর্ব। চার্চের নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে, বিসাররীর সমস্ত বাড়িগুলির উপর দিয়ে তা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এবং তা দেখে মনে হচ্ছিল যেন খুবই নিচু মানের বসতির মাঝখানে এক রাজকুমারের প্রাসাদ। জনগণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করত বিশপের আগমণ ও প্রস্থান এবং আরও লক্ষ্য করত বিশপের চার্চ ও বেদি পবিত্র করার কর্মকাণ্ড। এমনকি যখন জনগণ মনে করত তার আসার সময় হয়েছে তখন তারা মিছিল করে শহরের বাইরে চলে যেত এবং সে তাদের সঙ্গে চার্চে প্রবেশ করত। তখন প্রশংসাসংগীতে গাইত যুবকেরা এবং স্তবগান গাইত যাজকেরা এবং বাজতে থাকত মন্দিরা ও ঘণ্টা। তখন সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামত যার জিন ছিল অলংকৃত এবং লাগাম ছিল রুপার। ধর্ম মেনে চলে এরকম মানুষেরা সাধারণত তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সংবর্ধনা জানায় ধুমধাম করে এবং প্রশংসাসংগীত গেয়ে। বিশপ নতুন চার্চে যায় সোনালি সুতোর এমব্রয়ডারির কাজ-করা যাজকের পোশাক পরে। মাথায় পরিধান করে মূল্যবান রত্নখচিত মুকুট। এছাড়া সে মূল্যবান পাথরখচিত একটা ছড়ি ব্যবহার করে। সে পুরো চার্চ একবার প্রদক্ষিণ করত যাজকদের সঙ্গে স্তবগান গাইতে গাইতে। তখন ধূপদানি থেকে ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে এবং মোমবাতিগুলি মিটমিট করে জ্বলত। 

সে সময় ইউহান্না রাখাল ও কৃষকদের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকত একটা উঁচু প্লাটফর্মের ওপর এবং এসব জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখত বেদনার্ত চোখে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলত মর্মবেদনায় এবং তাকিয়ে থাকত ছোট্ট গ্রামগুলি থেকে উৎসবের উল্লাসে যোগ দিতে আসা গরিব মানুষের কোলাহলের দিকে, যাদের চারপাশে সোনার পাত্রে রাখা হয়েছে মদ, সোনার ধূপাধারে জ্বলছে ধূপ এবং সেইসঙ্গে জ্বলছে দামি মোমদানিতে মোম। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে চার্চকে পবিত্র করার জন্য। এখানে সম্পদ ও ক্ষমতা ধর্মের গুণাবলিকে মূর্ত করে তুলেছে প্রশংসাসংগীতের সঙ্গে সঙ্গে, আর সেখানে উপস্থিত হচ্ছে দুর্বল লোকেরা, যারা বিনয়ী এবং গরিব। নিরবতার ভেতরে প্রার্থনা করা এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলা, যার উত্থান ঘটে ভগ্নহৃদয়ের তলদেশ থেকে ইথারে ভেসে বেড়াতে এবং ফিসফিস করতে বাতাসের কানে কানে। এখানে ক্ষমতা নেতা ও প্রধান লোককে জীবন দান করেছিল চিরসবুজ সাইপ্রেস গাছের মতো। সেখানে কৃষকেরা আত্মসমর্পণ করে, যাদের অস্তিত্ব হচ্ছে মৃত্যুসহ একটা জাহাজ তার নাবিকের জন্য, ঢেউয়ের আঘাতে যার হাল ভেঙে গেছে এবং বাতাসে ছিঁড়েছে যার পাল, এখন তা বেড়ে উঠছে এবং এখন আবার ডুবে যাচ্ছে গভীরতার ক্রোধ এবং ঝড়ের সন্ত্রাসের মাঝখানে। এখানে দস্যুতাই হচ্ছে নিষ্ঠুরতা এবং অন্ধত্বই হচ্ছে বিনয়, যার একজন হচ্ছে অন্যের অভিভাবক। দস্যুতা কি শক্তিশালী একটি বৃক্ষ, নিচু ভূমি ছাড়া যা জন্মায় না? অথবা বশ্যতা কি একটা পরিত্যক্ত শস্যক্ষেত, যেখানে আর কিছুই জন্মায় না কাঁটাগাছ ছাড়া? 

এইসব বেদনা এবং নির্যাতন ইউহান্না অর্জন করে। সে দুহাতে তার গলা চেপে ধরে যেন তার নিশ্বাস আটকে গেছে। ভয়ের ভেতরে তার মনে হয় নিশ্বাস ফেলতে গেলে তার বক্ষ আলাদা হয়ে যাবে। এ অবস্থায়ই সে এই উৎসবের শেষ পর্যন্ত কাটাল যতক্ষণ লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে যার যার পথে চলে না যায়। 

খুব দ্রুত সে অনুভব করতে শুরু করল একটা আত্মা বাতাসের ভেতরে তাকে তাড়া দিচ্ছে বেড়ে উঠতে এবং তাঁর সম্পর্কে কথা বলতে এবং জনতার কোলাহলের ভেতরে একটা ক্ষমতা তাকে চালিত করে পৃথিবী ও স্বর্গের ধর্মপ্রচারকের মতো সামনে এগিয়ে আসতে। 

সে প্লাটফর্মের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং দুচোখ উপরে তুলে আঙুল নির্দেশ করে স্বর্গের দিকে। তারপর কঠিন কণ্ঠে সে চিৎকার করে বলে : ‘লক্ষ করুন হে নাজারেতবাসী যিশু, যিনি উচ্চতারও ওপরে আলোর বৃত্তের ভেতরে বসে আছেন। স্বর্গের নীল গম্বুজের ওপর থেকে নিচের দিকে এই পৃথিবীর প্রতি তাকান। হে বিশ্বস্ত কৃষক, দেখুন ঘন জঙ্গলের ভেতরে কাঁটাঝোপ গলা টিপে ধরেছে ফুলগুলির, যার বীজগুলি দ্রুত জীবনে পরিণত হবে আপনার ভ্রূর ঘামের সঙ্গে মিশে। হে শ্রেষ্ঠ মেষপালক, দেখুন যে দুর্বল মেষশাবককে আপনি পিঠে বহন করতেন, বন্য পশুরা তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। নিষ্পাপ পাতলা রক্ত শুষে নেয় মাটি এবং আপনার উষ্ণ অশ্রু লুকিয়ে যায় মানুষের হৃদয়ের ওপর। আপনার শ্বাসপ্রশ্বাসের উষ্ণতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় মরুভূমির বাতাসের সামনে। এই শস্যক্ষেত পবিত্র করেছিল আপনার পদযুগ যা এখন একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে শক্তিশালীদের পা গৃহহীনদের পাঁজর চূর্ণ করে দেয়, যেখানে নিপীড়কের হাত ধ্বংস করে দুর্বলের আত্মাকে। যন্ত্রণাভোগকারীদের কান্না উত্থিত হয় অন্ধকার থেকে এবং সিজারের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত যারা, তারা জোর করে কেড়ে নেয় দুর্বলদের সবকিছু যা তাদের এবং ঈশ্বরের। লক্ষ্য করুন সেইসব আঙুরলতাদের যা আপনার ডানহাত রোপণ করেছিল। শুঁয়োপোকা তার সমস্ত অঙ্কুর খেয়ে ফেলেছে এবং আঙুরগুলি পায়ে মাড়িয়ে যায় পথিকেরা। বিবেচনা করুন তাদের সম্পর্কে যারা আপনার শান্তির বাণী প্রচার করেছিল এবং দেখুন কীভাবে তারা বিভক্ত হয়েছে, তারা এখন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেয়।আমাদের সমস্যাক্রান্ত আত্মা এবং নিপীড়িত হৃদয়গুলি তৈরি হয়েছে তাদের যুদ্ধের শিকার হওয়ার জন্য। ভোজ উৎসব ও পবিত্র দিনগুলিতে তারা তাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করে তোলে স্বর্গে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে শান্তি এবং মানুষের উল্লাসের কথা বলতে গিয়ে। 

স্বর্গীয় ঈশ্বর কী মহিমান্বিত হন যখন দুৰ্নীতিগ্ৰস্ত ঠোঁট এবং মিথ্যাচারী জিভ তাঁর নাম উচ্চারণ করে? পৃথিবীতে কি শান্তি থাকে যখন শিশুদের বেদনা শস্যক্ষেতে কঠোর পরিশ্রম করে এবং লক্ষ্য করে শক্তিশালীদের খাবার যোগাতে ও অত্যাচারীর উদর পূর্ণ করতে সূর্যালোকে তাদের শক্তি ফুরিয়ে আসছে? মানুষেরা কি তখন উল্লসিত হয় যখন গৃহহীনেরা বেদনার্ত চোখে মৃত্যুর দিকে তাকায়? শান্তি কি হে দয়াৰ্দ্ৰ যিশু? এটা কি সেইসব শিশুদের চোখে থাকে, যারা ক্ষুধার্ত মায়ের বুকের ভেতরে অন্ধকার ঠাণ্ডায় বসতির ভেতরে বেঁচে আছে? অথবা গরিব মানুষের শরীরের ভেতরে, যারা তাদের পাথরের বিছানায় ঘুমায়, খাবারের প্রত্যাশা করে কিন্তু কোনো খাবারই তাদের কাছে আসে না কিন্তু তাদের যাজকেরা প্রতিদিন তাদের মোটাসোটা শূকরগুলিকে মাংস খেতে দেয়? হে যিশু আনন্দ কী? এটা কি সেখানে থাকে যখন একজন রাজকুমার মানুষের শারীরিক শক্তি ও নারীর সম্মান কয়েকটি রুপার টুকরোর বিনিময়ে কেনে? এটা কি থাকে সেইসব নীরবতার ভেতরে যা শরীর ও আত্মার দাসত্ব করে চোখ ধাঁধিয়ে দিতে? এটা কি উল্লসিত হয় নিপীড়িতদের কান্নার ভেতরে যখন অত্যাচারীরা তাদের ওপর পতিত হয় তরবারি নিয়ে এবং চূর্ণবিচূর্ণ করে তাদের নারী ও যুবকদের শরীর ঘোড়ার খুরের তলায় এবং তাদের রক্ত দিয়ে মাতাল করে তোলে মাটিকে? যিশু আপনার শক্তিশালী হাত প্রসারিত করুন এবং আমাদেরকে রক্ষা করুন নিপীড়কদের হাত থেকে অথবা আমাদেরকে পাঠিয়ে দিন মৃত্যুর কাছে যেন সে আমাদেরকে কবরের দিকে নেতৃত্ব দিতে পারে যেখানে আমরা শান্তিতে ঘুমাব, নিশ্চিন্ত থাকব আপনার ক্রুশের ছায়ায়। কারণ স্পষ্টতই আমাদের জীবন একটা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নয়, যার অধিবাসীরা হচ্ছে খারাপ আত্মা এবং একটা উপত্যকা যেখানে সাপ এবং ড্রাগনের খেলাধুলা করে। আমাদের দিনগুলি কি শাণিত তরবারি ছাড়া আর কিছুই নয়, রাত্রি যাকে লুকিয়ে রাখে আমাদের বিছানায় চাদরের তলায় এবং ভোরের আলোয় তা প্রকাশিত হয়ে ঝুলতে থাকে আমাদের মাথায় ওপর, যখন অস্তিত্বের ভালোবাসা আমাদেরকে নেতৃত্ব দেয় শস্যক্ষেতের দিকে? হে যিশু, করুণা করুন এই জনতাকে যারা এখানে একত্রিত হয়েছে পুনরুত্থান দিবসের নামে। করুণা করুন তাদের বিনয় ও দুর্বলতাকে।’ 

স্বর্গের প্রতি এ পর্যন্ত বলে ইউহান্না থামল। লোকজন তার চারপাশে দাঁড়িয়েছিল, কেউ কেউ খুশি হয় এবং প্রশংসা করে। অন্যেরা ক্রুদ্ধ হয় এবং তাকে অভিশাপ দেয়। একজন চিৎকার করে বলে, ‘স্বর্গের সামনে সে ঠিকমতোই আমাদের কথা বলেছে, কারণ আমরা নিপীড়িত।’ অন্য একজন বলল, ‘মনে হয় অশুভ আত্মার জিভে সে একথা বলল।’ অন্য একজন আর্তনাদ করে উঠল, ‘একজন বোকাই শুধু এরকম বলতে পারে। আমরা আমাদের পিতার কাছ থেকে আগে কখনও এধরনের কথা শুনি নাই, এমনকি এ-ধরনের কথা আমরা শুনতেও চাই না।’ একজন ফিসফিস করে তার প্রতিবেশীর কানে কানে বলে, ‘তাঁর কণ্ঠস্বর শুনে আমি আমার ভেতরে ভয়ংকর এক শিহরণ অনুভব করেছি যা আমার হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল, কারণ সে একটা অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে কথা বলছিল।’ তার বন্ধু উত্তর দিল, ‘তোমার কথা ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের নেতারা এ-ব্যাপারে আমাদের চেয়েও অধিক জানে। তাদের সন্দেহ করা মোটেই উচিত নয়।’ 

চারদিক থেকে কান্না ও আর্তনাদ উত্থিত হল এবং সমুদ্রের গর্জনের মতো তা ফুলে উঠে ছড়িয়ে পড়ল এবং তা হারিয়ে গেল ইথারে। একজন যাজক ইউহান্নাকে গ্রেফতার করল এবং তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করল। তারা তাকে গভর্নরের বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে তাকে প্রশ্ন করা হল কিন্তু সে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না, কারণ তার মনে পড়ে যায় যিশু তাঁর নির্যাতনকারীদের সামনে নীরব থাকতেন। সুতরাং তারা তাকে অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করল এবং সেখানে সে পাথুরে দেয়ালে মাথা রেখে শান্তভাবে ঘুমিয়ে গেল। 

পরদিন সকালবেলা ইউহান্নার পিতা এল গভর্নরের কাছে তার ছেলের পাগলামি প্রমাণ করতে। সে বলল, ‘ হে মহানুভব, প্রায়ই আমি শুনেছি আমার ছেলে একা একা বকবক করে এবং অদ্ভুত সব জিনিস সম্পর্কে বলে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। রাতের পর রাত সে নীরবতার ভেতরে বিভিন্ন অপরিচিত শব্দ উচ্চারণ করেছে, ভয়াবহ কণ্ঠস্বরে আহ্বান জানিয়েছে অন্ধকারের ছায়াগুলোকে যেন একজন জাদুকর তার মন্ত্র উচ্চারণ করছে। যেসব ছেলেদের সঙ্গে সে মেশে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, কারণ তারা জানে, তার মন কী পরিমাণ আকর্ষণ অনুভব করে পৃথিবীর ওপরের অন্য পৃথিবীর প্রতি। তার বন্ধুরা যখন তার সঙ্গে কথা বলে তখন কদাচিৎ সে উত্তর দিয়ে থাকে এবং যখন সে কথা বলে, তখন শব্দগুলিকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয় এবং অন্য কোনো বক্তব্যের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তার মাকে জিজ্ঞাসা করুন, প্রায় সময়ই সে তার ছেলেকে দেখেছে স্থিরদৃষ্টিতে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে এবং তখন তার চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। সে তখন তাকে কথা বলতে শুনেছে বৃক্ষ, বনভূমি, নদী, ফুল ও নক্ষত্রের তীব্র অনুভূতি নিয়ে যেভাবে শিশুরা আবোলতাবোল বকে তুচ্ছ বিষয় সম্পর্কে। আশ্রমের সন্ন্যাসীদের জিজ্ঞাসা করুন যাদের সঙ্গে সে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিল, রসিকতা করেছিল তাদের ভালোমানুষী নিয়ে, তাচ্ছিল্য করেছিল জীবনের পথ সম্পর্কে। সে হচ্ছে একজন অপ্রকৃতিস্থ, হে মহানুভব; কিন্তু সে তার মা ও আমার প্রতি খুবই দয়ালু। এই বৃদ্ধবয়সে সে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এবং পরিপূর্ণ করছে আমাদের যাবতীয় চাহিদা কঠোর পরিশ্রম করে। তাকে ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে আমাদের প্রতি করুণা করুন এবং ক্ষমা করুন তার নির্বুদ্ধিতাকে তার পিতামাতার খাতিরে।’ 

ইউহান্না মুক্তি পায় এবং তার পাগলামির খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তরুণেরা তাকে নিয়ে রসিকতা করত। কিন্তু যুবতীরা বেদনার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলত, ‘তার ভেতরে যে অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার জন্য দায়ী হচ্ছে স্বর্গ। সুতরাং তার সৌন্দর্যে মিলিত হয়েছে পাগলামি এবং তার সুন্দর চোখের আলো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তার অসুস্থ আত্মার অন্ধকারের সঙ্গে।’ 

পশুচারণভূমিগুলি ফুল ও বৃক্ষের পোশাকে সজ্জিত হয়েছিল। ইউহান্না বসেছিল তার পশুশাবকগুলির পাশে, যারা পালিয়ে গিয়েছিল আশ্রমের চারণভূমিতে, সৃষ্টি হয়েছিল বিবাদ। সে অশ্রুভেজা চোখে উপত্যকার কাঁধের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট গ্রামগুলির দিকে তাকাল, গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং পুনরাবৃত্তি করল এই কথাগুলি : 

‘তোমরা অনেক এবং আমি একা। বলো, তোমরা আমার কী করবে এবং তোমাদের যা ইচ্ছা হয় তাই করো। রাতের অন্ধকারে মাদী ঘোড়া নেকড়ের শিকারে পরিণত হতে পারে, কিন্তু তার রক্ত উপত্যকার পাথরগুলিকে রঞ্জিত করবে যতক্ষণ ভোর না হয় এবং সূর্য না ওঠে।’ 

.

মার্থা 

তার বাবা যখন মারা যার তখনও পর্যন্ত সে ছিল দোলনায় এবং তার মা মারা গিয়েছিল তার বয়স দশবছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। সে এতিম হিসেবে পরিত্যক্ত হয়েছিল এক গরিব প্রতিবেশীর বাড়িতে, যে বসবাস করত তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এবং লেবাননের চমৎকার উপত্যকার মাঝখানে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন ছোট্ট একটা গ্রামের ভূমিতে উৎপন্ন ফলের ওপর নির্ভর করে তারা অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। তার বাবা মারা গিয়েছিল এবং উইলের মাধ্যমে তাকে কিছুই দিয়ে যায়নি শুধুমাত্র নিজের নাম এবং বাদাম ও পপলার গাছের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জীর্ণ কুঁড়েঘর ছাড়া। মায়ের কাছ থেকে সে পেয়েছিল উত্তরাধিকারসূত্রে শুধুমাত্র মর্মবেদনার অশ্রুজল এবং তার এতিম জীবন। কিছুকালের জন্য সে তার মাতৃভূমিতে ছিল আগন্তুক, পরস্পরগ্রন্থিত বৃক্ষসমূহ এবং উঁচুউঁচু পাহাড়ের মাঝখানে। প্রতিদিন ভোরে ছেঁড়া কাপড় পরে খালি পায়ে একটা দুধেল গাভীর পেছনে পেছনে সে হেঁটে যেত উপত্যকার একদিকে, যেখানকার পশুচারণভূমি ছিল ঘাসে পরিপূর্ণ এবং সে একটা গাছের ছায়ায় বসত। সে গান গাইত পাখির সঙ্গে এবং নদীর কুলুকুলু ধ্বনির সঙ্গে মিলেমিশে যেত তার কান্না, যখন সে গাভীটাকে হিংসা করত তার খাবারের অতিপ্রাচুর্যের জন্য। সে তাকিয়ে থাকত ফুলের দিকে এবং লক্ষ্য করত প্রজাপতিদের পাখা ঝাপটানো। যখন দিগন্তে সূর্য ডুবে যেত এবং ক্ষুধা তীব্র হয়ে উঠত তখন সে কুঁড়েঘরে ফিরে আসত এবং তার অভিভাবকের কন্যার পাশে বসে লোভীর মতো ভুট্টার রুটি খেত বা শুকনো ফল এবং ভিনেগার ও অলিভ তেলে ভেজানো মটরশুঁটি দিয়ে। খাবার পর সে মাটিতে কিছু খড় বিছিয়ে শুয়ে পড়ত হাতের ওপর মাথা রেখে। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে ঘুমাত; তার মনে হত জীবন একসময় গভীর ঘুমের ভেতরে নিরুপদ্রব ছিল স্বপ্নের মাধ্যমে। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অভিভাবক তাকে রূঢ়ভাবে ঘুম থেকে জাগায় তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য এবং সে সুখনিদ্রা থেকে উঠে ভীত ও শিহরিত হত তার ক্রুদ্ধ ও কর্কশ আচরণে। এভাবেই বছরগুলি কেটে যাচ্ছিল, কারণ মার্থা ছিল দূরবর্তী পাহাড় ও উপত্যকার মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যবর্তী। 

অল্প কিছুদিনের ভেতরে সে অনুভব করে তার হৃদয়ে আবেগ জেগে উঠছে, যে অনুভূতি সম্পর্কে সে আগে কখনও জানত না। এটা ছিল একটা ফুলের হৃদয়ের সুরভি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠার মতো। স্বপ্ন এবং বিস্ময়ের চিন্তাগুলি তার ওপর কোলাহলমুখর হয়ে উঠল পাখির ঝাঁকের মতো যা অতিক্রম করে যায় ছোট্ট নদীটাকে। সে নারীতে পরিণত হল এবং কিছু অস্পষ্ট পদ্ধতি গ্রহণ করল কুমারী মৃত্তিকাকে শুদ্ধ করে তুলতে, যেখানে রোপিত হবে বিচক্ষণতার বীজ এবং তার ওপর অনুভূত হবে অভিজ্ঞতার ছাপ। একটা বালিকার আত্মা গভীর এবং নিষ্পাপ, ভাগ্যের নির্দেশে নির্বাসিত হয়েছিল সেই খামার সংলগ্ন বসতবাড়িতে যেখানে জীবন অতিক্রম করছিল বছরের ঋতুগুলির সঙ্গে তার নিয়োগকৃত পর্যায়। সে ছিল একজন অপরিচিত ঈশ্বরের ছায়া, যে বসবাস করছে পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে। 

আমাদের ভেতরে যারা অস্তিত্বের বৃহত্তর অংশ কোলাহলমুখর নগরীতে কাটিয়েছে তারা লেবাননের দূরবর্তী ছোট ছোট গ্রাম ও অন্যান্য গ্রামের অধিবাসীদের জীবন সম্পর্কে খুব অল্পই জানে। আমরা অব্যাহত রেখেছি আধুনিক সভ্যতার স্রোতপ্রবাহ। আমরা ভুলে গেছি অথবা আমরা আমাদেরকে বলেছি—শুদ্ধতা ও আধ্যাত্মিক পরিচ্ছন্নতার সুন্দর ও সাধারণ জীবনের দর্শন। যদি আমরা মুখ ঘুরিয়ে নিই এবং তাকাই তাহলে দেখতে পাব বসন্তে এটা হাসছে, গ্রীষ্মের সূর্যালোকে অলস হয়ে পড়ছে, ফসল তুলছে শরতে এবং অবসর নিচ্ছে শীতকালে, তার সমস্ত মানসিকতা আমাদের মায়ের প্রকৃতির মতো। ঐসব গ্রামবাসীর চেয়ে আমরা ধনী আমাদের বস্তুগত সম্পদের দিক থেকে, কিন্তু তাদের সাহসিকতা আমাদের চেয়ে অধিক সৎ। আমরা বীজ বুনি অনেক, কিন্তু ফসল আহরণ করি কম। আমরা আমাদের ক্ষুধার দাস, তাদের যা আছে তাই নিয়ে খুশি তাদের শিশুরা। আমরা পান করি জীবনের পাত্র থেকে তিক্ততার মেঘে ঢাকা একধরনের তরল- যার মধ্যে রয়েছে হতাশা, ভয় এবং ক্লান্তি। তারা পান করে এর সবটাই। 

মার্থা ষোলো বছর বয়সে পৌঁছাল। তার আত্মা ছিল একটা মার্জিত আয়না যেখানে প্রতিফলিত হত শস্যক্ষেতের সমস্ত চমৎকারিত্ব এবং তার হৃদয় ছিল প্রশস্ত উপত্যকার মতো, যা প্রতিধ্বনির ভেতরে কণ্ঠস্বরকে পেছনে ছুঁড়ে দিত। 

শরতের কোনো একদিন যখন প্রকৃতি বেদনায় পরিপূর্ণ তখন সে বসেছিল বসন্তের সঙ্গে পৃথিবীর শৃঙ্খল থেকে চিন্তার মতো মুক্ত, যেন কোনো কবির কল্পনা। সে তাকিয়ে ছিল গাছ থেকে ঝরে-পড়া হলুদ পত্রগুচ্ছের অস্থিরতার দিকে। সে পর্যবেক্ষণ করল বাতাস তাদের সঙ্গে খেলা করছে, মৃত্যু যেমন খেলা করে মানুষের আত্মার সঙ্গে। সে স্থিরদৃষ্টিতে ফুলের দিকে তাকাল এবং দেখতে পেল তারা বিবর্ণ হয়ে গেছে এবং শুকিয়ে তাদের হৃদয় ভেঙে গেছে টুকরো টুকরো হয়ে। তারা মৃত্তিকার ভেতরে সংরক্ষণ করছিল তাদের বীজ, যেমন নারীরা যুদ্ধ ও বিভিন্ন অস্থিরতার সময় তাদের অলংকার সংরক্ষণ করে থাকে। এইভাবে বসে সে যখন ফুল ও গাছের দিকে তাকিয়েছিল এবং তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করছিল তাদের বেদনা গ্রীষ্মকাল চলে যাবার সময়, তখন সে শুনতে পেয়েছিল উপত্যকার ভাঙা পাথরের ওপর খুরের শব্দ। সে ঘুরল এবং দেখতে পেল একজন ঘোড়সওয়ার আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার বহনকৃত দ্রব্যাদি এবং পোশাক বলছিল তার আরাম ও সম্পদ সম্পর্কে। সে ঘোড়া থেকে নামল এবং কোমলভাবে মার্থাকে অভিবাদন জানাল এমন এক রীতিতে যা সে আগে কখনও কাউকে ব্যবহার করতে দেখেনি। 

‘আমি পথভ্রষ্ট হয়ে সমুদ্রতীরের দিকে যাবার পথটা হারিয়ে ফেলেছি। তুমি কি আমাকে বলতে পারো তা কোন্ দিকে,’ সে জিজ্ঞাসা করল। 

সে বসন্তের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে থাকল সোজা হয়ে বৃক্ষের তরুণ শাখার মতো এবং বলল, ‘প্রভু, আমি জানি না, কিন্তু আমি গিয়ে আমার অভিভাবকের কাছ থেকে তা জেনে আসতে পারব কারণ সে জানে।’ সে এই কথা উচ্চারণ করল, একই সঙ্গে সে লজ্জা ও বিনয়মিশ্রিত ভীতি অনুভব করল, যা তার কোমলতা ও সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলল। সে যাবার উদ্যোগ নিতেই লোকটা তাকে থামাল। তার যৌবনের লাল মদ প্রবলভাবে চলাচল করতে লাগল তার শিরা-উপশিরার ভেতর দিয়ে। মার্থার এই পরিবর্তনের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘না যেওনা।’ সে দাঁড়িয়ে রইল এবং বিস্মিত হল কারণ তার কণ্ঠস্বরে এমন এক শক্তি ছিল যা তার গতিবিধিকে প্রতিরোধ করল। সে লুকিয়ে এক পলক তার দিকে তাকাল। লোকটা তাকে খুব যত্নসহকারে লক্ষ্য করছিল, তবে তা এমন একধরনের দৃষ্টি যার অর্থ সে উপলব্ধি করতে পারে না। তারপর লোকটা এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে হাসল যা তাকে মুগ্ধ করে এবং এই হাসির ভেতরে এমন একধরনের মিষ্টতা রয়েছে যার কারণে তার কাঁদতে ইচ্ছা হয়। সে স্নেহের সঙ্গে তার চোখদুটিকে বিশ্রাম দেয় মার্থার নগ্ন পা, তার সুন্দর বাহু, তার মসৃণ গ্রীবা এবং নরম ও ঘন কেশগুচ্ছের ওপর। উত্থিত আবেগের সঙ্গে সে লক্ষ্য করে সূর্যালোক তার চামড়া ও বাহুকে দান করেছে এই দীপ্তি, প্রকৃতি যাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। কিন্তু সে ছিল নীরব এবং লজ্জাবনত। সে চলে যেতেও চাইছিল না, আবার ঐশ্বরিক হওয়ার ক্ষেত্রেও সে ছিল অক্ষম। সে পারত কথা বলার শক্তি আবিষ্কার করতে। 

দুধেল গাভীটি সেই সন্ধ্যায় তার কর্ত্রী ছাড়াই নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে এল, কারণ মার্থা ফেরে নাই। তার অভিভাবক মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে এল এবং সমস্ত জায়গায় খোঁজাখুঁজি করল কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া গেল না। সে তার নাম ধরে ডাকল কিন্তু কোনো উত্তরই এল না গুহা ও বৃক্ষরাজির ভেতর থেকে বাতাসের শনশন শব্দের প্রতিধ্বনি ছাড়া। সে খুবই দুঃখ পেল এবং কুঁড়েঘরে ফিরে তার স্ত্রীকে তা জানাল। তার স্ত্রী নীরবে সারারাত ধরে কাঁদল এবং মনে মনে বলল, ‘আমি তাকে স্বপ্নের ভেতরে দেখেছি, একটা বন্যপশু নখ দিয়ে তার শরীর ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে এবং তখন সে হাসছিল এবং কাঁদছিল।’ 

সেই সুন্দর ছোট্ট গ্রামের মার্থার জীবন সম্পর্কে আমি এটুকুই সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। আমি জেনেছিলাম এক বৃদ্ধ গ্রামবাসীর কাছ থেকে যে তাকে শৈশবের দিনগুলি থেকেই চিনত। সে ঐ এলাকা থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পেছনে সে কিছুই ফেলে যায়নি, অভিভাবক মহিলার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ফেলে যাওয়া ছাড়া এবং একটি করুণ স্মৃতি যা ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসে চড়ে উপত্যকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় জানালার কাঁচের ওপর একটা শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো—বিবৰ্ণ। 

.

উত্তর লেবাননে কলেজের ছুটিটা কাটানোর পর ১৯০০ সালের শরতে আমি বৈরুতে ফিরে এলাম। লেখাপড়ায় ফিরে যাওয়ার আগে এক সপ্তাহ কাটালাম ছাত্র-বন্ধুদের সঙ্গে শহরের যত্রতত্র। তাদের সঙ্গে উপভোগ করলাম স্বাধীনতার স্বাদ, কারণ যৌবন যা চায় তাই অস্বীকার করা হয় বাড়িতে এবং শ্রেণীকক্ষের চারদেয়ালের মাঝখানে। এটা একটা পাখির মতো, যে খাঁচার খোলা দরজাটা খুঁজছে উড়তে এবং ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে। গান এবং মুক্তির আনন্দের সঙ্গে স্ফীত হয়ে উঠছে তার হৃদয়। 

যৌবন হচ্ছে একটা চমৎকার স্বপ্ন, কিন্তু এর মিষ্টতা গ্রন্থের নিরানন্দতায় দাসত্বে পরিণত হয় এবং এর উপলব্ধি হচ্ছে একটা নিষ্ঠুরতা। 

এমন দিন কি আসবে যখন জ্ঞানী মানুষেরা যৌবনের স্বপ্নগুলি জানার উল্লাসকে একত্রিত করতে সক্ষম হবে, যেমন কটুবাক্য একত্রে তা বহন করে আনবে দ্বন্দ্বের ভেতরে? তেমন দিন কি আসবে যখন মানুষের শিক্ষক হবে প্রকৃতি, মানবতা হবে তার গ্রন্থ এবং জীবন হবে পাঠদানের শ্রেণীকক্ষ? তেমনি দিন কি হবে? 

আমরা জানি না, কিন্তু আমরা অনুভব করি অত্যাবশ্যকীয়তা, যা আমাদেরকে চালিত করে, চিরকাল ঊর্ধ্বমুখী আধ্যাত্মিক অগ্রগতির দিকে যেতে। সেই অগ্রগতি হল, সব সৃষ্টির সৌন্দর্যের উপলব্ধি, আমাদের দয়া এবং সেই সৌন্দর্যের সুখ ছড়িয়ে দেওয়া ভালোবাসার মাধ্যমে। 

সেই সন্ধ্যায় আমি আমার বাড়ির বারান্দায় বসেছিলাম। লক্ষ্য করছিলাম কোলাহলমুখর মানুষের চলাচল এবং শুনছিলাম রাস্তায় হকারদের চিৎকার। প্রত্যেকেই তার পরিচ্ছদ ও খাবারের চমৎকারিত্ব সম্পর্কে উচ্চপ্রশংসা করছিল। এমন সময় একটা বালক আমার কাছে এল। তার বয়স বছর পাঁচকের মতো হবে। তার পরনে ছেঁড়া বস্ত্র এবং কাঁধে সে বহন করছে একটা ট্রে, যাতে রয়েছে একগোছা ফুল। ভাঙা ও দুর্বল কণ্ঠে সে আমাকে তার দীর্ঘ সংগ্রামের ঐতিহ্য সমর্পণ করল এবং তার কাছ থেকে একটা ফুল কিনতে অনুরোধ করল। 

আমি তার ছোট বিবর্ণ মুখের দিকে তাকালাম এবং লক্ষ্য করলাম তার চোখদুটো। তাতে ক্লান্তি ও দারিদ্র্যের ছায়া। মুখখানা অল্প খোলা যেন তার বক্ষস্থল ক্ষতচিহ্নে আহত, তার দুর্বল বাহু এবং তার ছোট্ট শরীরটা ট্রের ফুলের ওপর বাঁকা হয়ে আছে, অসংখ্য তরতাজা সবুজ চারাগাছের ভেতরে হলুদ ও বিবর্ণ হয়ে যাওয়া গোলাপচারার মতো। এক ঝলকে আমি সবকিছুই দেখলাম এবং করুণামিশ্রিত হাসি হাসলাম, এমন একধরনের হাসি যার ভেতরে অশ্রুজলের ছিটেফোঁটা ছিল। ওইসব হাসি যা হৃদয়ের গভীরতায় ভেঙে যায় এবং বেড়ে ওঠে ওষ্ঠের ওপর। আমাদের কি উচিত নয় তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া, যারা আমাদের চোখের মাধ্যমে নির্গমনের পথ খোঁজে। 

আমি তার কাছ থেকে কিছু ফুল কিনলাম কিন্তু এটা ছিল তার বাকশক্তি যা আমি কেনার ইচ্ছা করেছিলাম মনে মনে, কারণ আমি অনুভব করেছিলাম যে তার বিষণ্ন ও ব্যাকুল দৃষ্টির পেছনে ছিল পর্দা দিয়ে বিভক্ত করা একটা বিয়োগান্তক নাটকের দৃশ্য— গরিব মানুষের বিয়োগান্তক নাটক বিরতিহীনভাবে অভিনীত হচ্ছে দিনের মঞ্চের ওপর। একটা দৃশ্য কদাচিৎ দেখা যায়, কারণ এটা একটা বিয়োগান্তক নাটক। আমি তার সঙ্গে কথা বললাম খুব মিষ্টি করে, ফলে তার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব তৈরি হল, যেন সে এমন একটা শরীর খুঁজে পেয়েছে যার ভেতরে রয়েছে তার জন্য তত্ত্বাবধান ও নিরাপত্তা। বিস্ময়ে সে আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, কারণ সে অভ্যস্ত ছিল অন্যান্য ছেলেদের মতো কটুবাক্যে যারা সারাক্ষণ রাস্তায় নোংরামি করে বেড়ায় এবং ভাগ্যের তীরে তারা কখনও আহত হয় না। তারপর আমি তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। 

সে মাটির দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘যাওয়াদ।’ 

‘তুমি কার ছেলে এবং কোন এলাকার মানুষ?’

‘আমি মার্থার ছেলে, সে বান এর একজন নারী।’

‘এবং তোমার পিতা?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম। 

সে তার ছোট্ট মাথাটা এমনভাবে নাড়ল যেন সে জানে না পিতা কী 

‘তোমার মা কোথায় যাওয়াদ?’ 

‘বাড়িতে এবং সে অসুস্থ!’ 

ছেলেটির ওষ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসা এই কয়েকটি কথাই আমার কানে আঘাত করল এবং তার ভেতর থেকে আমার অভ্যন্তরস্থ অনুভূতিগুলি তৈরি করল অদ্ভুত ও বিষণ্ন প্রতিমূর্তি এবং আকৃতি, কারণ আমি জানতাম দুর্ভাগ্যবতী মার্থাকে, যার কাহিনী আমি গ্রামবাসীর কাছে শুনেছিলাম, সে এখন অসুস্থ এবং বৈরুতে। গতকাল যে বালিকা বনভূমি ও উপত্যাকার মাঝখানে যাবতীয় ক্ষতির হাত থেকে দূরে ছিল, সে-ই আজ শহরে ক্ষুধার নিষ্ঠুরতা এবং দারিদ্র্যের যাতনায় ভূগছে। প্রকৃতির সঙ্গে যে এতিম বালিকা তার শৈশবের দিনগুলি কাটিয়েছে গাভীর যত্ন নিয়ে চমৎকার পশুচারণভূমিতে, দুর্নীতিগ্রস্ত সভ্যতার স্রোতে সে-ই এসেছে দুর্দশা ও দুর্ভাগ্যের শিকারে পরিণত হতে। 

এসব বিষয় আমার মনের ভেতরে চলাচল করছিল আর ছেলেটি আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল একইভাবে, যদিও সে তার নিষ্পাপ আত্মার চোখ দিয়ে দেখছিল আমার ভাঙা হৃদয়। 

সে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই আমি তার হাত চোপ ধরলাম এবং বললাম, ‘আমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে চলো, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’ 

সে নীরবে এবং বিস্ময়করভাবে আমাকে পথ দেখিয়ে আগে আগে হাঁটতে লাগল। মাঝে মাঝে পেছনে তাকিয়ে দেখল, সত্যিই আমি তাকে অনুসরণ করছি কি না। ভয় ও সাহসের মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে আমি নোংরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। এসব রাস্তার বাতাস মৃত্যুর শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুলে ফুলে উঠছিল। এখানকার বাড়িগুলি পতনোন্মুখ এবং খারাপ লোকেরা তাদের মন্দকাজগুলি এসব জায়গায় সম্পন্ন করে রাত্রির পর্দা নেমে এলে। গলিপথগুলিতে পাক খেত বাতাস এবং মানসিক যন্ত্রণা ভাইপারের মতো। আমি ছেলেটার পেছনে পেছনে চললাম, যার হৃদয় নিষ্পাপ এবং উদ্দীপনা অনুচ্চারিত। আমরা বসতির শেষপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছালাম এবং ছেলেটা একটা নিচুঘরের ভেতরে ঢুকল। 

আমি তার পেছনে পেছনে ঢুকলাম। আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছিল যত আমি ঘরের কাছাকাছি আসছিলাম। আমি নিজেকে দেখতে পেলাম ঘরের মাঝখানে এবং ঘরের বাতাস স্যাঁতসেঁতে। একটা বাতি ছাড়া ঘরে কোনো ফার্নিচার ছিল না, যার দুর্বল আলো আধো অন্ধকারকে হলুদ রশ্মি দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেছিল এবং গদি আঁটা একটা চেয়ারের অবয়ব ভয়াবহ দারিদ্র্য, দুর্গতি ও প্রয়োজনের কথা বলছিল। সেই গদিআঁটা চেয়ারের ওপর দেয়ালের দিকে মুখ করে ঘুমাচ্ছে এক মহিলা, যেন সে পৃথিবীর যাবতীয় নিষ্ঠুরতাকে অস্বীকার করেছে অথবা ভাগ্য এটা দেখছে, একটি হৃদয় অধিক কোমল এবং করুণাময় মানুষের হৃদয়ের চেয়ে। ছেলেটা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ‘মা, মা’। সে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরল এবং ছেলেটাকে দেখল আর আঙুল নির্দেশ করল আমার দিকে। অর্থাৎ এর মধ্যেই চাদরের নিচে তার শরীর মোড় ফিরেছে এবং তার কণ্ঠস্বর তিক্ত হয়ে ওঠে আত্মার মর্মবেদনার সংগ্রামের মাধ্যমে এবং সে আর্তনাদ করে : ‘এই তুমি কি চাও? তুমি কি আমার জীবনের শেষ টুকরোগুলি কিনতে এসেছ যেন তুমি তোমার লালসা দিয়ে তাকে কলুষিত করতে পারো। আমার এখান থেকে চলে যাও, কারণ রাস্তাগুলি নারীতে পরিপূর্ণ এবং তারা সস্তায় তাদের শরীর ও আত্মা বিক্রি করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার কাছে রুদ্ধ হয়ে আসা শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া বিক্রি করার মতো কিছু নেই এবং সেগুলিও মারা যাবে খুব তাড়াতাড়ি। সুতরাং তাদেরকে কিনতে হবে কবরের শান্তি দিয়ে।’ 

আমি বিছানার কাছে এগিয়ে গেলাম। তার কণ্ঠস্বর আমার হৃদয়ের গভীরে গিয়ে পৌঁছাল, কারণ ওগুলিই ছিল তার গুণাবলির প্রতীক অথবা তার বেদনার কাহিনী। আমি তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম এবং আমার ইচ্ছা হয়েছিল যে আমার অনুভূতিগুলি আমার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে উড়ে যাক। 

‘আমাকে দেখে ভীত হয়ো না মার্থা। হিংস্র পশু হিসেবে আমি তোমার কাছে আসিনি, এসেছি বেদনার্ত মানুষ হিসেবে। আমি লেবাননের বাসিন্দা এবং দীর্ঘ সময় আমি সিডার বৃক্ষঘেরা গ্রাম ও উপত্যকার ভেতরে বসবাস করেছি। আমাকে ভয় পেয়ো না মার্থা।’ সে আমার প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল এবং অনুভব করল অস্তিত্বের ভেতরে যা বেড়ে ওঠে আত্মার গভীরতায়, যা তার সঙ্গে কেঁদেছিল, কারণ সে তার বিছানার ওপর শিহরিত হয়েছিল শীতের বাতাসে কেঁপে ওঠা একটা নগ্ন শাখার মতো। সে তার মুখের ওপর হাত রাখল যেন যে স্মৃতি থেকে নিজেকে লুকাবে যা তার মিষ্টতার মধ্যে ভীতিপ্রদ এবং সৌন্দর্যের ভেতরে তিক্ত। নীরবতার ভেতরে তার দীর্ঘশ্বাস শোনা যাচ্ছিল, তারপর আবার তার মুখমণ্ডল আবির্ভূত হল তার শিহরিত দুই কাঁধের মাঝখানে। আমি দেখতে পেলাম তার চোখ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অদৃশ্যের দিকে ঘরের শূন্যতার ভেতরে দাঁড়িয়ে থেকে এবং তার শুকনো ঠোঁট শিহরিত হচ্ছিল হতাশার শিহরণের সঙ্গে সঙ্গে। তার কণ্ঠনালির ভেতরে মৃত্যুর ঝনঝন শব্দ শোনা যাচ্ছিল এবং সেইসঙ্গে আরও শোনা যাচ্ছিল গভীর এবং চাপা আর্তনাদ। তারপর সে কথা বলল। তার উচ্চারণের ভেতরে ছিল সনির্বন্ধ প্রার্থনা এবং অনুনয় এবং তাতে আরও ফিরে এসেছিল দুর্বলতা ও যন্ত্রণা : ‘তুমি এখানে এসেছ তোমার দয়া ও করুণার কারণে এবং যদি করুণা পাপীদের জন্য হয় তাহলে ধার্মিকের চুক্তিতে পরিণত হও এবং করুণা প্রদর্শন করো তাদেরকে যারা বিপথে গেছে। তাহলে তা প্রশংসার যোগ্য কাজ হবে এবং তারপর আমার পক্ষ থেকে স্বৰ্গ তোমাকে পুরস্কৃত করবে। আমি প্রার্থনা করি তুমি এখান থেকে চলে যাও এবং প্রত্যাবর্তন করো যেখান থেকে তুমি এসেছ, কারণ এস্থানে তোমার উপস্থিতি তোমার জন্য অর্জন করবে লজ্জা এবং আমার জন্য তোমার করুণা বহন করে আনবে অপমান ও ঘৃণা। যাও, এখান থেকে চলে যাও, যে- কেউ তোমাকে এই নোংরা ঘরে দেখে ফেলতে পারে- শূকরের বিষ্ঠায় নোংরা এই ঘর। দ্রুত এখান থেকে বেরিয়ে যাও এবং তোমার আলখাল্লা দিয়ে তোমার মুখ ঢেকে ফ্যালো, তাহলে কোনো পথচারীই তোমাকে চিনতে পারবে না। যে করুণা তোমাকে পূর্ণ করে তুলেছে তা আমার শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনবে না, মুছে ফেলবেনা আমার পাপ এবং সারিয়ে নেবে না মৃত্যুর কঠিন হাত আমার ওপর থেকে। আমার দুর্গতি ও অপরাধ আমাকে নির্বাসন দিয়েছে এই গভীরতম অন্ধকারে। তোমার করুণাকে অনুমতি দিও না তোমাকে নির্বাসিতদের কাছে নিয়ে যেতে। আমি হলাম একজন কুষ্ঠরোগী, কবরের ভেতরে বসবাস করছি। আমার কাছাকাছি এসো না পাছে লোকজন তোমাকে অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় ধরে ফেলবে এবং তোমার কাছ থেকে তোমাকে সরিয়ে নেবে। সুতরাং ফিরে যাও, কিন্তু ঐসব ঐশ্বরিক উপত্যকাকে আমার নাম বোলো না, কারণ মেষপালক তার রোগাক্রান্ত মেষশাবককে অস্বীকার করবে তার পশমের জন্য আর যদি তুমি আমার সম্পর্কে বলো যে মার্থা, বান-এর সেই নারী এখন মৃত, তাহলে কেউ তোমাকে কিছু বলবে না।’ 

সে তার ছেলের ছোট্ট হাত দুখানা জড়িয়ে ধরল এবং চুম্বন করল বেদনার সঙ্গে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল : 

মানুষ আমার সন্তানের দিকে তাকাবে ঘৃণার সঙ্গে এবং পরিহাস করে বলবে, এটা হচ্ছে পাপের শাখাপ্রশাখা। এটা হচ্ছে মার্থার পুত্র, যে মার্থা বেশ্যা। এটা হচ্ছে একটা সুযোগের সন্তান এবং লজ্জার সন্তান। তারা তাকে এর চেয়ে আরও বেশি কিছু বলবে, কারণ তারা অন্ধ, তারা দেখবেও না এবং জানবেও না যে তার মা তাকে শৈশবেই পরিশুদ্ধ করেছে তার মর্মবেদনা ও অশ্রুজল দিয়ে এবং তার জীবনের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করেছে বেদনা এবং দুর্ভাগ্যের মাধ্যমে। আমি তাকে এতিম অবস্থায় রাস্তার শিশুদের মধ্যে পরিত্যাগ করে যাব না। একাকী করুণাহীন অস্তিত্ব এবং উইলের মাধ্যমে তাকে কিছুই দিয়ে যাব না শুধুমাত্র ভয়াবহ স্মৃতি ছাড়া। যদি সে ভীরু ও দুর্বল মানুষ হয়, তাহলে সে তার স্মৃতির জন্য লজ্জিত হবে, আর যদি সে সাহসী ও শক্তিশালী হয় তাহলে তার রক্ত জেগে উঠবে। যদি স্বর্গ তাকে সংরক্ষণের জন্য কেনে এবং তাকে শক্তির দিক দিয়ে মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার অনুমতি দেয়, তাহলে স্বর্গ তাকে সাহায্য করবে তাদের বিরুদ্ধে যারা তার মা ও তার প্রতি অন্যায় করেছিল। যদি সে মারা যায় এবং তাকে সরবরাহ করা হয় বছরগুলির প্রলোভন থেকে, তাহলে সে আমাকে খুঁজে পাবে সেই উচ্চতায় যেখানে সবকিছুই আলোকিত, বাকিরা তার আগমনের অপেক্ষা করছে। 

আমার হৃদয় আমাকে কথা বলার প্রেরণা যোগাল : 

‘মার্থা, তুমি কুষ্ঠরোগী নও যদিও তুমি কবরের ভেতর বসবাস করছিলে। তুমি অপরিচ্ছন্নও নও যদিও জীবন তোমাকে অপরিচ্ছন্নতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মাংসের আবর্জনার হাত পরিশুদ্ধ আত্মার কাছে পৌঁছাতে পারে না এবং বরফ পড়ার তথ্য হত্যা করতে পারে না জীবন্ত বীজকে। এ জীবন কী? দুঃখের একটা মাড়াইখানা ছাড়া, যার ওপর আত্মাগুচ্ছ মাড়াই করা হয় এবং তার আগে পরিত্যাগ করে প্রাকৃতিক রীতিতে উৎপন্ন হওয়া? কিন্তু সেইসব কালের কাছে শোক প্রকাশ করো, যারা মাড়াইখানা ছাড়াই তোমাকে পরিত্যাগ করে, কারণ মৃত্তিকার পিপীলিকা তাদেরকে বহন করবে এবং আকাশের পাখিরা তাদেরকে উঁচু করে তুলে ধরবে এবং তারা শস্যক্ষেতের প্রভুর সংরক্ষণাগারে প্রবেশ করবে না। 

তুমি অন্যায়ভাবে পীড়িত হয়েছ মার্থা এবং যে তোমাকে পীড়িত করেছে সে হচ্ছে রাজপ্রাসাদের শিশু, সম্পদে সে বিশাল কিন্তু তার আত্মা খুবই ছোট। তোমাকে কষ্ট দেওয়া এবং তাচ্ছিল্য করা হয়েছে, কিন্তু এটা ছিল অধিকতর ভালো ঘৃণাকারীর চেয়ে ঘৃণিত হওয়া। মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তির ভঙ্গুরতার শিকার হওয়া উচিত তার ক্ষমতাশালী হওয়ার চেয়ে, দুমড়েমুচড়ে ফেলে জীবনের পুষ্পগুচ্ছ এবং বিকৃত করে আকাঙ্ক্ষার অনুভূতির সৌন্দর্য। আত্মা হচ্ছে ঐশ্বরিক শৃঙ্খলের সঙ্গে সম্পর্কিত। আগুনের মতো তা উত্তাপ নিংড়াতে পারে এবং বিকৃত করতে পারে এই সম্পর্ককে এবং ধ্বংস করতে পারে সৌন্দর্য, কিন্তু তা পারে না এর সোনাকে অন্য ধাতুতে রূপান্তরিত করতে, বরং এটা পরিণত হবে অধিক উজ্জ্বলতায়। কিন্তু চামড়ায় কালশিরে পড়ার দুঃখ এবং দুর্বলতা যখন আগুন গ্রাস করে ফেলবে এবং তাকে ছাইয়ে পরিণত করবে বাতাসে উড়িয়ে নিতে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেবার জন্য মরুভূমির মুখের ওপর। হ্যাঁ মার্থা, তুমি একটা ফুল। পশুর পায়ের নিচে তুমি চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছ যা মানুষের ছদ্মবেশ পরে আছে। ভারী জুতো পরা পা তোমাকে মাড়িয়ে যায়, কিন্তু তারা সেই সুগন্ধকে ধ্বংস করতে পারে না যা বিধবার বিলাপ এবং এতিমের কান্না এবং তা দারিদ্র্যের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে উপরে উঠে যায় স্বর্গের দিকে—ন্যায়বিচার ও ক্ষমার ঝর্নাধারা। মার্থা একটু আয়েশ গ্রহণ করো, যার ভেতরে তুমি চূর্ণবিচূর্ণ ফুল এবং সেই পদযুগ নয়, যা এটাকে ধ্বংস করেছে।’ 

সে তন্ময় হয়ে আমার কথা শুনল এবং সান্ত্বনা পেয়ে তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেভাবে অস্তগামী সূর্যের কোমল রশ্মিতে মেঘ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সে আমাকে ইশারা করল তার পাশে বসতে। আমি তাই করলাম এবং অনুসন্ধান করছিলাম তার বেদনার্ত আত্মার গোপন বিষয়গুলি থেকে তার বাকপটুত্ব শিখতে। সে এমন একজনের দিকে তাকিয়েছিল যে জানে সে মরতে বসেছে। এটা ছিল একটা বালিকার দৃষ্টি, জীবনের বসন্তকালে যে অনুভব করছিল মৃত্যুর পদধ্বনি তার ভেঙে পড়া বিছানার মাধ্যমে। একজন নারীর দৃষ্টি পরিত্যক্ত হয়, যে দাঁড়িয়েছিল জীবন ও শক্তিতে পরিপূর্ণ লেবাননের সুন্দর উপত্যাকাগুলির মাঝখানে, কিন্তু এখন নিঃশেষিত এবং অপেক্ষা করছে অস্তিত্বের হাড় থেকে পরিত্রাণ পেতে। 

একটা গতিশীল নীরবতার পর সে তার সর্বশেষ শক্তিটুকু একত্রিত করল। শুরু করল সে কথাবলা, তার অশ্রুজলে তার কথার অর্থ প্রকাশিত হচ্ছিল এবং তার আত্মা ছিল তার শ্বাসপ্রশ্বাসের ভেতরে সক্রিয় : 

‘হ্যাঁ আমি পীড়িত হয়েছিলাম। মানুষের ভেতরে আমি পশুর শিকারে পরিণত হয়েছিলাম। আমি হচ্ছি একটা ফুল, আমি নিজের পায়ের নিচে আনন্দে ভেসেছি। আমি বসেছিলাম বসন্তের কিনারায়, যেভাবে সে আমার ওপর চড়ে বসেছিল। সে দয়া করে আমাকে বলেছিল, আমি সুন্দর। সে আমাকে ভালোবেসেছিল এবং সে কখনও আমাকে পরিত্যাগ করবে না। সে বলল, এই বিস্তৃত মহাশূন্য হল বিষণ্নতার স্থান এবং উপত্যকাগুলি হল পাখি এবং শেয়ালের বাসস্থান। সে আমাকে তার বুকে টেনে নিল এবং চুম্বন করল। তখন ও পর্যন্ত আমি চুম্বনের স্বাদ সম্পর্কে জানতাম না, কারণ আমি ছিলাম এতিম এবং গৃহহীন। সে আমাকে তার ঘোড়ার পেছনে বসিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা একটা সুন্দর বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে সে আমাকে সিল্কের পোশাক, সুগন্ধি, দামি খাবার এবং পানীয় দান করল 

এই সবকিছুই সে করল তার হাসি, মিষ্টিকথা এবং ভালোবাসার মাধ্যমে এবং সে লুকিয়ে রেখেছিল তার লালসা ও বাস্তব আকাঙ্ক্ষা। সে তৃপ্ত হওয়ার পর আমার আত্মার দীনতা নিয়ে সে চলে গিয়েছিল এবং আমার ভেতরে পরিত্যাগ করে গিয়েছিল জ্বলন্ত অগ্নিশিখা যা আমার যকৃৎ বিবর্ণ করে ফেলেছিল এবং তা বেড়ে উঠেছিল দ্রুততার ভেতরে। তারপর আমি এই যন্ত্রণার জ্বলন্ত উনুন এবং কান্নার তিক্ততার ভেতর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম এবং প্রবেশ করেছিলাম এই অন্ধকারে… সুতরাং জীবন দুইভাগে টুকরো হয়েছিল, একভাগ দুর্বল ও দুঃখপ্রবণ এবং অন্যভাগ ক্ষুদ্র ও রাত্রির নিরবতায় কাঁদছে, অনুসন্ধান করছে বিশাল শূন্যতায় প্রত্যাবর্তন। সেই নির্জন বাড়িতে আমার পীড়নকারী আমাকে এবং আমার স্তন্যপায়ী শিশুকে পরিত্যাগ করে। ভীতি ছাড়া আমাদের কোনো সঙ্গী ছিল না, ছিল না কান্না ও বিলাপ করা ছাড়া কোনো সাহায্যকারী। তার বন্ধুরা এসেছিল আমাদের জায়গাটা চিনতে এবং আমার প্রয়োজন ও দুর্বলতা সম্পর্কে জানতে। একজনের-পর-একজন তারা এসেছিল। তারা আমাকে সম্পদ দিয়ে কিনতে চেয়েছিল এবং আমার সম্মানে তারা প্রদান করেছিল রুটি হায়, বহু সময় আমার নিজের হাতই নিশ্চিত হয়েছিল আমার আত্মাকে মুক্ত করতে। কিন্তু আমি সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ালাম, কারণ আমার জীবন আমার কাছে একা নয়, আমার সন্তানও আমার জীবনের অংশ। আমার সন্তান, যাকে স্বর্গ ধাক্কা মেরে এই জীবনে প্রবেশ করিয়েছে, একারণে আমি জীবন থেকে নির্বাসিত হয়েছিলাম এবং একত্রিত হয়েছিলাম নরকের অতল গহ্বরে…’ একটা গভীর নীরবতার পর সেটা ছিল উড়ন্ত আত্মার উপস্থিতির মতো। সে তার চোখদুটি ওপরে তুলল, যা মৃত্যুর অবগুণ্ঠনে ঢাকা এবং একটা কোমল কণ্ঠস্বর উচ্চারিত হল : ‘হে ন্যায়বিচার, কে লুকিয়ে আছে? এই আতঙ্কিত প্রতিমূর্তির পেছনে লুক্কায়িত তুমি এবং একাকী তুমিই, আমার চলে যাওয়া আত্মার কান্না এবং অবহেলিত হৃদয়ের আহ্বান শোনো। তুমি একাকী প্রার্থনা করো, আর আমি প্রার্থনা ও সনির্বন্ধ অনুরোধ করি, নিজের জন্য প্রার্থনা করি ক্ষমা। তুমি তোমার ডানহাত দিয়ে পাহারা দাও আমার সন্তানকে এবং বাম হাত দিয়ে গ্রহণ করো আমার আত্মাকে।’ 

তার শক্তি কমে যায় এবং দীর্ঘশ্বাসও দুর্বল হয়ে আসে। সে তার ছেলের দিকে তাকাল তীব্র শোক ও কোমলতার সঙ্গে, তারপর ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি নামাল এবং এমন কণ্ঠস্বরে সে আবৃত্তি করল যাকে নীরবতা বলা যায় : 

‘আমাদের পিতা, স্বর্গে যার যথাযথ সৌন্দর্য প্রকাশিত, পবিত্র করো তার নাম… তার রাজ্য। স্বর্গে যা ঘটে পৃথিবীতেও তাই ঘটেছে… ক্ষমা করো আমাদের পাপ… ‘ মার্থার কণ্ঠস্বর থেমে গেল কিন্তু তার ঠোঁট মুহূর্তের জন্য সচল হল। যখন তারা সবাই স্থির হল, তখন তার শরীর পরিত্যাগ করল সমস্ত গতিশীলতা। তার শরীরজুড়ে প্রবাহিত হল একটা থরথরানি এবং তার দীর্ঘশ্বাস ও মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে গেল। আলাদা হল তার আত্মা এবং তার চোখ স্থির হয়ে থাকল অদৃশ্যের দিকে। 

ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্থার শরীর একটা কাঠের কফিনে শোয়ানো হল এবং দুজন গরিব লোক তা কাঁধে করে বহন করল। আমরা শহর থেকে দূরে একটা মরুভূমির ভেতরে তাকে সমাহিত করলাম, কারণ যাজক তার জন্য প্রার্থনা করবে না, এমনকি তার হাড়গুলিকেও কবরস্থানে বিশ্রাম নিতে দেবে না। ক্রুশচিহ্নটিই শুধু কবরটাকে পাহারা দিচ্ছিল। কোনো শোককারীই এই দূরবর্তী সমাধিক্ষেত্রে যায়নি, শুধু তার ছেলে এবং অন্য একটি ছেলে ছাড়া— অস্তিত্বের নিদারুণ দুর্দশা যাকে সমবেদনা শিক্ষা দিয়েছিল। 

.

কালের ধুলো ও অনন্ত আগুন 

[শরৎকাল, খ্রিস্টপূর্ব ১১৬ সাল]

রাত্রির শান্ত পরিবেশে সূর্যের শহরে* সবাই ঘুমিয়ে ছিল। শহরের বাড়িগুলি থেকে আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিল অলিভ ও লরেল গাছের মাঝখানে অবস্থিত মন্দিরের চারপাশে। উদিত চন্দ্রের আলোকরশ্মি ছলকে পড়েছিল মর্মরপাথরে তৈরি দীর্ঘ স্তম্ভের শুভ্রতার ওপর, যে স্তম্ভ সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দৈত্যের মতো এবং পাহারা দিচ্ছিল শান্ত রাত্রিতে ঈশ্বরের স্মৃতিসম্বলিত সমাধিগুচ্ছ। তারা বিস্ময় ও আতঙ্কে তাকিয়ে ছিল লেবাননের স্মৃতিস্তম্ভের দিকে, দূরবর্তী উচ্চতার অসমতল জায়গায় বসবাস করছে যারা। 

[* প্রাচীন বালবেক শহরকে বলা হত ‘বা’ল নগরী’ বা ‘সূর্যের শহর’। প্রাচীনকালের মানুষেরা এই শহরকে বলত হেলিওপোলিস। এটা ছিল সিরিয়ার সবচেয়ে সুন্দর শহর।]

সেই, মন্ত্রমুগ্ধ সময়ে ঘুমন্ত আত্মা ও অন্তের স্বপ্নের মাঝখানে ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে যাজকের পুত্র নাথান, এ্যাসতারতে-এর মন্দিরে প্রবেশ করল। সে তার শিহরিত হাতে একটা মশাল বহন করছিল এবং তা থেকে মন্দিরের বাতি ও ধূপদানিগুলিতে অগ্নিসংযোগ করল। রজন এবং গন্ধরসের ( সুগন্ধিদ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত রস) মিষ্টি গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠল এবং ঈশ্বরীর প্রতিমূর্তি অলংকৃত হয়েছিল সূক্ষ্ম অবগুণ্ঠনে—বাসনা ও আকুল আকাঙ্ক্ষার মতো অবগুণ্ঠন, যা মানুষের হৃদয়কে সংরক্ষণ করে। সে হাতির দাঁত ও সোনার প্রলেপ দেওয়া বেদির সম্মুখে মাটিতে প্রণত হয়, অনুনয়ের ভঙ্গিতে হাতদুটো ওপরে তোলে এবং অশ্রুপরিপূর্ণ চোখ তুলে স্বর্গের দিকে তাকায়। মর্মবেদনায় এবং রূঢ়তার কারণে ভেঙে যাওয়া কণ্ঠস্বরে সে প্রায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল : 

‘ক্ষমা করো, হে বিশাল এ্যাসতারতে। ক্ষমা করো, হে প্রেম ও সৌন্দর্যের ঈশ্বরী। আমাকে করুণা করো এবং আমার পছন্দের মানুষের ওপর থেকে তুলে নাও তোমার মৃত্যুর হাত, যাদেরকে আমার আত্মা পছন্দ করেছে তোমার ইচ্ছা পরিপূর্ণ করতে। চিকিৎসকের তরল এবং গুঁড়ো ওষুধ কোনো কাজেই আসেনি এবং যাজক ও জ্ঞানীলোকদের প্রীতিকর বৈশিষ্ট্য সবই ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে কেবলই রয়েছে তোমার ঐশ্বরিক নাম প্রয়োজনের সময় আমাকে সাহায্য করতে। উত্তর দাও আমার প্রার্থনার। তাকাও আমার পাপবোধ দ্বারা পীড়িত হৃদয় এবং আত্মার মর্মবেদনার দিকে এবং তাকে আমার জীবন্ত আত্মার অংশ হতে দাও যেন তোমার ভালোবাসার গোপনীয়তায় আনন্দিত হতে পারি এবং উল্লসিত হতে পারি যৌবনের সৌন্দর্যে, যা তোমার মহিমা ঘোষণা করবে… হৃদয়ের গভীরতা থেকে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে কাঁদি, হে ঐশ্বরিক এ্যাসতারতে। এই রাত্রির অন্ধকারের বাইরে আমি অনুসন্ধান করি তোমার ক্ষমার নিরাপত্তা… আমার কান্না শোনো! আমি তোমার দাস নাথান, যাজক হিরামের পুত্র, যে তার জীবন উৎসর্গ করেছে তোমার বেদির সেবায়। আমি এক তরুণীকে ভালোবাসি এবং আমার নিজের জন্যই তাকে গ্রহণ করেছি, কিন্তু জিনের পাখিরা তার শরীরের ওপর শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলছে যা কিনা বিস্ময়কর অসুখের শ্বাসপ্রশ্বাস। তারা মৃত্যুর বার্তাবাহক পাঠিয়েছে তার কাছে তাদের মন্ত্রপূত গুহার দিকে তাকে নেতৃত্ব দিতে। বর্তমানে মৃত্যু সেই তরুণীর কৌচে শুয়ে আছে আর্তচিৎকার করতে থাকা ক্ষুধার্ত পশুর মতো কালো পাখা তার ওপর ছড়িয়ে দিয়ে এবং আরও বিস্তৃত করছে তার নোংরা হাত জোরপূর্বক তাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে। একারণেই আমি তোমার কাছে প্রণত হয়েছি। আমাকে দয়া করো এবং তাকে কাঁদতে দাও। সে হচ্ছে একটা ফুল যে তার জীবনের গ্রীষ্মকাল উপভোগ করেনি এবং সে হচ্ছে একটা পাখি যার আনন্দসংগীত অভিবাদন জানাচ্ছে ভোরবেলাকে, যা প্রতিদিনই বিচ্ছিন্ন হয়। মৃত্যুর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা থেকে তাকে রক্ষা করো এবং আমরা গাইব প্রশংসাগীতি এবং তাকে পুড়িয়ে উৎসর্গ করব তোমার নামের মহিমার প্রতি। তুমি বহন করে আনবে আত্মাত্যাগ তোমার বেদির কাছে এবং পূর্ণ করবে তোমার পাত্র মদ এবং মিষ্টি সুগন্ধি তেলে এবং প্রসারিত করবে তোমার পূণ্যমণ্ডপ গোলাপ এবং জুঁইফুলের গন্ধে। আমরা প্রজ্জ্বলিত করব ক্রোধ এবং মিষ্টিগন্ধ ছড়ানো ঘৃতকুমারী বনভূমি তোমার প্রতিমূর্তির সামনে… রক্ষা করো ওই তরুণীকে হে অলৌকিকত্বের ঈশ্বরী এবং ভালোবাসতে দাও মৃতুঞ্জয়ীকে, কারণ তুমি হলে মৃত্যু এবং ভালোবাসার নিয়ন্ত্রণকারী।’ 

সে তার মর্মবেদনার ভেতরে কথা বলা, কান্না এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলা বন্ধ করল। তারপর সে আবার শুরু করল : ‘হায় ঐশ্বরিক এ্যাসতারতে, আমার স্বপ্নগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে এবং আমার জীবনের শেষ শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত কমে আসছে। আমার হৃদয় মারা যাচ্ছে আমার ভেতরেই এবং আমার চোখ অশ্রুজলে পুড়ে যায়। তোমার করুণা দিয়ে আমাকে টিকিয়ে রাখো এবং আমাকে তোমার পছন্দের পাত্রে পরিণত হতে দাও।’ 

এ সময় একজন দাস সেখানে প্রবেশ করল, ধীরগতিতে হেঁটে এল তার দিকে এবং তার কানে কানে বলল : ‘সে তার চোখ খুলেছে প্রভু এবং তার কৌচের চারদিকে চেয়ে দেখেছে কিন্তু আপনাকে সে দেখতে পায়নি। আমি আপনাকে ডাকতে এসেছি কারণ সে ক্রমাগত আপনার জন্য কাঁদছে।’ 

নাথান উঠে দাঁড়াল এবং দ্রুত হেঁটে চলে গেল। দাসটি তাকে অনুসরণ করল। যথাস্থানে পৌছে সে অসুস্থ মেয়েটির ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বিছানার পাশে দাঁড়াল। সে তার শীর্ণ হাতটা নিজের হাতে তুলে নিল এবং বারবার তার ওষ্ঠে চুমু খেল যেন সে তার হালকা পাতলা শরীর থেকে নতুন জীবনের শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করবে। তরুণী তার মুখখানা ঘোরাল, যা এতক্ষণ সিল্কের বালিশের ভেতরে লুকানো ছিল। সে তার চোখ সামান্য খুলে তার দিকে তাকাল। তার চোখের ওপর একটা হাসির ছায়া আবির্ভূত হল— জীবনের সবকিছুই অবশিষ্ট থাকল তার সুন্দর শরীরে, চলে যাওয়া আত্মার শেষ আলোকরশ্মি, একটি হৃদয়ের কান্নার প্রতিধ্বনি দ্রুত এর পরিসমাপ্তি ঘোষণা করছে। তরুণী কথা বলল এবং তার শ্বাসপ্রশ্বাস মনে হল রুদ্ধ হয়ে আসছে, খাদ্যাভাবে শিশুদের যেরকম হয়। ঈশ্বরেরা আমাকে আহ্বান জানায়, হে আমার আত্মার বাগদত্ত পুরুষ, মৃত্যু এসেছে আমাদেরকে আলাদা করতে…। দুঃখ কোরো না, কারণ ঈশ্বরের ইচ্ছা হচ্ছে ঐশ্বরিক এবং মৃত্যুর দাবিও যথাযথ… আমি এখন যাচ্ছি, কিন্তু প্রেম ও যৌবনের দ্বৈত পেয়ালা এখনও পরিপূর্ণ আমাদের হাতে এবং জীবনের মধুর পথ আমাদের সামনে শুয়ে আছে… আমি যাচ্ছি, হে আমার পছন্দের মানুষ আমি যাচ্ছি আত্মার চারণভূমিতে, কিন্তু আমি এই পৃথিবীতে ফিরে আসব। এ্যাসতারতে এই জীবনকে ফিরিয়ে আনে প্রেমাস্পদের আত্মায়, যারা অসীমের দিকে গেছে, যৌবনের আনন্দ ও ভালোবাসার উল্লাসের স্বাদ গ্রহণ করার আগেই… আমরা আবার মিলিত হব, নাথান এবং একত্রে পান করব ভোরের শিশির কন্দজ উদ্ভিদের পেয়ালা থেকে এবং রৌদ্রালোকে আনন্দিত হব শস্যক্ষেতের পাখিদের সঙ্গে। … আমার প্রিয় ও পছন্দের মানুষ, বিদায়। 

তার কণ্ঠস্বর আস্তে আস্তে কমে গেল এবং ঠোঁট ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসে শিহরিত হতে শুরু করল ফুলের পাপড়ির মতো। তার প্রেমিক তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করল এবং তার চোখের জলে ভিজে গেল তার চিবুক। যখন তার ওষ্ঠ তরুণীর মুখ স্পর্শ করল তখন সে দেখতে পেল এটা বরফের মতো ঠাণ্ডা। সে আর্তনাদ করে উঠল, ছিঁড়ে ফেলল তার পোশাক এবং ঝাঁপিয়ে পড়ল তার মৃত শরীরের ওপর, যখন তার আত্মা এর মর্মবেদনার ভেতরে বাতাসে স্থির হয়ে ভেসেছিল জীবনের গভীর সমুদ্র এবং মৃত্যুর অতল গহ্বরের মাঝখানে। 

সেই রাত্রির স্থিরতার ভেতরে অসংখ্য চোখের পাতা শিহরিত হতে হতে ঘুমিয়েছিল, নারীরা দুঃখ পেয়েছিল এবং শিশুদের আত্মা আতঙ্কিত হয়েছিল, কারণ উচ্চৈঃস্বরে বিলাপের কান্না ছিঁড়ে ফেলেছিল অন্ধকারকে এবং কান্না উত্থিত হয়েছিল এ্যাসতারতে- এর যাজকের প্রাসাদ থেকে। ভোর হওয়ার পর সবাই নাথানকে অনুসন্ধান করল তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এবং তার কষ্টকে প্রশমিত করতে, কিন্তু কেউ তাকে খুঁজে পেল না। 

বহুদিন পর, যখন পুব থেকে মরুযাত্রীদল এল, তখন তার নেতা জানাল, কীভাবে সে নাথানকে দেখেছিল পীড়িত আত্মার মতো মরুভূমির একদল গাজলা হরিণের সাথে বন্যতার ভেতরে দীর্ঘভ্রমণে যেতে। 

বহু শতাব্দী পার হয়ে গেছে এবং সময়ের পদযুগ বিভিন্ন যুগের কর্মকাণ্ডকে মুছে ফেলেছে। ঈশ্বরেরা পথিবী থেকে চলে গেছে এবং তার পরিবর্তে এসেছে অন্য ঈশ্বরেরা —ক্রোধের ঈশ্বর বিয়ে করেছে ধ্বংসের ঈশ্বরকে। তারা ধূলিসাৎ করেছে সূর্যের শহরের চমৎকার মন্দির, ধ্বংস করেছে সুন্দর সুন্দর প্রাসাদগুলি। এসব রাজ্যের সবুজ বাগানগুলি শুকিয়ে গেছে এবং উর্বর ভূমিগুলি এখন খরার দখলে। ওই উপত্যকায় কিছুই নেই ক্ষয় এবং ধ্বংস ছাড়া, যা গতকালের ভূতপ্রেতের সঙ্গে শিকার করে শুধু স্মৃতি এবং পুনরায় আহ্বান জানায় অতীত গৌরবের মন্ত্রমুগ্ধ স্তুতিগীতির মূর্ছিত প্রতিধ্বনিকে। যুগ পার হয়ে যায় এবং মানুষের কর্মকাণ্ডও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কিন্তু তার স্বপ্নকে ধ্বংস করতে পারে না, পারে না দুর্বল করে দিতে তার সবচেয়ে ভেতরের অনুভূতি ও আবেগগুলিকে, কারণ এই কষ্ট ভোগ করা অমর আত্মার মতোই দীর্ঘ। এখানে, সম্ভবত তারা লুক্কায়িত। সেখানে তারা সন্ধ্যার সূর্যের মতো লুকিয়ে যেতে পারে অথবা চাঁদ কাছাকাছি হতে পারে ভোরবেলায়। 

.

[বসন্তকাল ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ] 

দিনটা ছিল বিবর্ণ এবং আলোও অনুজ্জ্বল হয়ে আসছিল। সূর্যও একত্রিত করেছিল তার পোশাক-পরিচ্ছদ বালবেক -এর সমতল ভূমি থেকে। আলী আল-হুসাইনী* ঘুরে দাঁড়াল তার পশুর পালসহ ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের দিকে এবং ভেঙে পড়া স্তম্ভের পাশে বসে পড়ল। স্তম্ভগুলিকে দেখাচ্ছিল দীর্ঘকাল ধরে বিস্তৃত কোনো সৈনিকের পাঁজরের মতো যা কোনো এক যুদ্ধে ভেঙে গিয়েছিল এবং তা উপস্থাপিত হয়েছিল নগ্নভাবে। তার চারপাশে একত্রিত হওয়া ভেড়াগুলি চরে বেড়াচ্ছিল এবং নিরাপত্তার ভেতরে তারা ছিল শান্ত তার বাঁশির সুর শুনে। 

[* হুসাইনী হচ্ছে আরবের একটা গোত্র। বালবেক শহরে তারা তাঁবুতে বসবাস করত।]

মধ্যরাত এলে স্বর্গ জড়ো করল আগামীকলের বীজগুলি গভীর অন্ধকারে। চোখের পাতাগুলি ক্লান্ত হয়ে এল জাগরণের আতঙ্কে। মন ক্লান্ত হয়ে এল অতিক্রম করতে থাকা কল্পনার মিছিলের সঙ্গে যা কুচকাওয়াজ করছে ভয়ংকর নীরবতার মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেয়ালগুলির মাঝখানে। সে হাতের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল যখন ঘুম হামাগুড়ি দিয়ে নেমে এল তার ওপরে এবং ঢেকে ফেলল তার জাগরণ হালকাভাবে, অবগুণ্ঠনের ভাঁজের ভেতরে যেমন চমৎকার ধোঁয়াশা শান্ত লেকের উপরিভাগ স্পর্শ করে। 

বিস্মৃতি ছিল তার পৃথিবীর আত্মা যখন সে তার আধ্যাত্মিক আত্মার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। তার গোপন আত্মা ছিল স্বপ্নে পরিপূর্ণ, যে স্বপ্ন মানুষের শিক্ষা ও আইনের সীমা ছাড়িয়ে যায়। একটা দূরদৃষ্টি তার চোখের সামনে আবির্ভূত হয় এবং লুকিয়ে থাকা বিষয়গুলি নিজেদেরকে তার সামনে উন্মোচিত করে। তার আত্মা মিছিলের সময় দূরে দাঁড়িয়েছিল এবং সে চিরকাল ব্যস্ত অস্তিত্বহীনতার প্রতি। এই আত্মা একাকী দাঁড়িয়ে থাকত কাছাকাছি পর্যায়ের চিন্তা এবং পরস্পরবিরোধী আবেগের মুখোমুখি। সে জানত, কারণ তার জীবনে প্রথম এই আধ্যাত্মিক ক্ষুধার কারণগুলি অতিক্রম করে গিয়েছিল তার যৌবন। একটি ক্ষুধা অস্তিত্বের সমস্ত তিক্ততা ও মধুরতাকে ঐক্যবদ্ধ করে। একটি তৃষ্ণা একত্রে বহন করে আনছে আকুল আকাঙ্ক্ষার কান্না এবং প্রশান্তির পরিপূর্ণতা। একটি আকুল আকাঙ্ক্ষা, যা এই পৃথিবীর সমস্ত মহিমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না, পারে না গোপন করতে জীবনের গতি। 

আলী আল-হুসাইনী জীবনে এই প্রথম এক বিস্ময়কর চাঞ্চল্য অনুভব করল, যা তার ভেতরে জাগিয়ে রেখেছিল এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। ধূপদানি থেকে ধূপের স্মৃতির প্রতিমূর্তি ছাড়াই একটি অনুভূতি। একটা শিকারের অনুভূতি, যা তার ইন্দ্রিয়ের ওপর অবিশ্রান্তভাবে খেলা করে, যেমন একজন সংগীতজ্ঞের আঙুলের ছাপ খেলা করে তার বীণার তারের ওপর। অস্তিত্বহীনতা থেকে একটি নতুন অনুভূতি উত্থিত হয়— অথবা এই অনুভূতি এসেছিল কিছু একটা থেকে। এটা বেড়ে উঠেছিল এবং এর উন্নয়ন ঘটেছিল তার আধ্যাত্মিক সত্তাকে আলিঙ্গন না করা পর্যন্ত। এটা তার আত্মাকে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল একটা পরমানন্দে, এর দয়াপরায়ণতার ভেতরে মৃত্যুর কাছাকাছি যা রূঢ়তার ভেতরেও গ্রহণযোগ্য। একমুহূর্তের ভেতরে একটা অনুভূতির জন্ম হয় বিশাল শূন্যতায় যা নিদ্রায় পরিপূর্ণ। একমুহূর্তে তা জন্ম দিয়েছিল কালের একটা রীতি, যেমন একটি বীজ থেকে জন্ম একটি জাতির। 

আলী ধ্বংসপ্রাপ্ত পবিত্র স্মৃতিচিহ্নসম্বলিত সমাধির দিকে তাকাল এবং তার ক্লান্তি তার আত্মার জাগরণকে একটা জায়গা দিয়েছিল। ধ্বংসপ্রাপ্ত বেদির অবশিষ্টও তার চোখে পড়ল এবং ভেঙে পড়া পিলারের জায়গাগুলিও। সেইসঙ্গে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া দেয়ালের ভিত্তিভূমিও তার দৃষ্টি এড়াল না। তার চোখ চকচকে হয়ে উঠল, তার হৃদস্পন্দন প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেল এবং তারপর হঠাৎ করেই— যেমন একজন তখনও পর্যন্ত ছিল দৃষ্টিহীন, তারপর তার চোখে আলো ফিরে এল এবং সে দেখতে শুরু করল এবং সে চিন্তা করল এবং সেই চিন্তা প্রতিফলিত হল। চিন্তার বিশৃঙ্খলা এবং প্রতিফলনের দ্বিধার ভেতর থেকে জন্ম নিল স্মৃতির অলীক মূর্তি এবং সে স্মরণ করতে পারল সবকিছু। সে স্মরণ করল, সেইসব পিলারগুলি বিশালত্ব ও গর্বের ভেতরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে পুনরায় আহ্বান জানাল রুপার বাতি এবং ধূপদানিগুলিকে যা পরিবেষ্টন করে রেখেছে একটা ত্রাসোদ্দীপক ঈশ্বরীর প্রতিমূর্তিকে। সে আবার ফিরে আসতে বলল সেই অসহায় যাজককে যে হাতির দাঁত এবং সোনার প্রলেপ দেওয়া একটা বেদির সামনে নতজানু হয়ে তর্পণ করছে। সে আবার আহ্বান জানাল সেইসব তরুণীকে যারা তাদের খঞ্জনি বাজিয়ে চলেছে এবং তাদের যৌবন প্রেম ও সৌন্দর্যের ঈশ্বরীর গুণকীর্তন করছে- গাইছে প্রশাংসাগীতি। সে স্মরণ করতে পারল এবং দেখতে পেল এরা সব স্বচ্ছ হয়ে উঠছে স্থিরদৃষ্টিতে দেখার আগেই। সে অনুভব করল ঘুমন্ত জিনিসের প্রতিক্রিয়া যা তার নৈঃশব্দের গভীরতায় জেগে উঠছে। কিন্তু স্মৃতি কিছুই ফিরিয়ে আনেনা ছায়াময় প্রতিমূর্তি ছাড়া, যা আমরা পর্যবেক্ষণ করি আমাদের জীবনের অতীত থেকে, ফিরিয়ে আনে না আমাদের কানে কোনোকিছুই এক সময় যে কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল তার প্রতিধ্বনি ছাড়া। তাহলে কি যোগাযোগ ছিল যৌবনের অতীত জীবনের সঙ্গে এইসব শিকারকৃত স্মৃতিগুলির যা লালিত পালিত হয়েছে তাঁবুর ভেতরে এবং যে তার জীবনের বসন্তকাল কাটিয়েছিল বন্যতার ভেতরে ভেড়ার যত্ন নিয়ে? 

আলী জেগে উঠল এবং হেঁটে বেড়াল ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ভাঙা পাথরগুলির মাঝখানে। সেইসব দূরবর্তী স্মৃতিগুলি বেড়ে উঠল মনের চোখে দেখা বিস্মৃতিকে ঢাকতে যেভাবে একজন নারী উপেক্ষা করে একটি মাকড়সার জালকে তার আয়নার কাঁচ থেকে। সুতরাং এটা ছিল মন্দিরের কেন্দ্রে প্রবেশ না-করা পর্যন্ত এবং তারপর স্থির হয়ে দাঁড়াল যদিও পৃথিবীতে একটা চুম্বকীয় আকর্ষণ তার পদযুগকে উত্তোলন করল। তারপর সে হঠাৎ তার সামনে দেখল একটা ভাঙা মূর্তি মাটিতে পড়ে আছে। অনিচ্ছাকৃতভাবে সে ঐ মূর্তির সামনে প্রণত হয়। তার অনুভূতি তার ভেতরে সীমানা ছড়িয়ে প্রবাহিত হয় উন্মুক্ত ক্ষতস্থান থেকে রক্তপ্রবাহের মতো। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং কমে আসে সমুদ্রের ঢেউয়ের উত্থান ও পতনের মতো। এটা দেখার ক্ষেত্রে সে ছিল বিনয়ী এবং তার দীর্ঘশ্বাস ছিল তিক্ত যা তার মর্মবেদনার ভেতরে কেঁদেছিল, কারণ সে অনুভব করেছিল একাকিত্ব, যা আহত হয়েছিল এবং একটা দূরত্ব যা ধ্বংস হয়েছিল, আলাদা করেছিল তার আত্মাকে সুন্দর আত্মা থেকে, যা ছিল তার পাশে এবং এই জীবনকে সেখানে সে প্রবেশ করিয়েছিল। সে অনুভব করেছিল তার সুগন্ধ যেভাবে কোনোকিছু ছাড়া জ্বলন্ত অগ্নিশিখার একটি অংশ যা ঈশ্বর আলাদা করেছিলেন তার আত্মা থেকে সময় শুরুর সঙ্গে সঙ্গে। সে অনুভব করেছিল সেই আলো তার জ্বলন্ত হাড়ের ওপর পাখা ঝাপটাচ্ছিল এবং তার মস্তিষ্কের নিরুদ্বিগ্ন কোষের চারপাশে শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী ভালোবাসা হৃদয় ও আত্মাকে গ্রহণ করছিল। একটি ভালোবাসা যা আত্মার লুকানো জিনিসকে প্রকাশ করে আত্মার প্রতি এবং এর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মনকে আলাদা করে পরিমাপ ও ওজনের এলাকা থেকে। একটি ভালোবাসা যা আমরা শুনি কথা বলছে, যখন জীবনের জিহ্বা নীরব, যাকে আমরা লক্ষ্য করি আগুনের পিলার হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে যখন অন্ধকার সবকিছুকে গোপন করে। সেই ভালোবাসা, সেই ঈশ্বর, এই মুহূর্তে পতিত হয়েছিল আলী আল-হুসাইনীর আত্মার ওপর এবং তার ভেতরে জাগিয়ে রেখেছিল তিক্ত ও মধুর অনুভূতিগুলি যেভাবে সূর্য কাঁটাসহ সাজিয়ে রাখা ফুলগুলিকে সামনে নিয়ে আসে। 

এই ভালোবাসা কী জিনিস? কোথা থেকে এটা আসে? যৌবনের কাছে এটা কী বিশ্রামরত মানুষের দল ধ্বংসপ্রাপ্ত পবিত্র স্মৃতিচিহ্নসম্বলিত সমাধির মাঝখানে? এই মদকে কী বলা যায়, শিরা-উপশিরার ভেতর দিয়ে যার গতি একজন তরুণীকে নির্বিকারে করে তোলে? এইসব স্বর্গীয় গানকে কী বলব, যা একজন বেদুঈনের কানে আসে এবং দূরে চলে যায়, যদিও সে নারীর মিষ্টি সংগীত কখনও শোনেনি? 

এই ভালোবাসা কী এবং কোত্থেকে এটা আসে? আলীর কাছে তা কী চায়, যে ঘুমের জন্য ব্যস্ত এবং তার বীণা মানুষের থেকে দূরে রয়েছে? এটা কিছু একটা যা তার হৃদয়ে বপন করা হয়েছিল মানুষের দ্বারা উৎসাহিত সৌন্দর্যের মাধ্যমে নিজের ইন্দ্রিয় সম্পর্কে কোনো সচেতনতা ছাড়াই? অথবা এটা একটা উজ্জ্বল আলো ধোঁয়াশায় অবগুণ্ঠিত এবং এখন ভেঙে ফেলছে তার আত্মার শূন্যতাকে তার সম্মুখে আধ্যাত্মিকতাকে উদ্দীপিত করতে? এটা কি দৈবাৎ আবির্ভূত হওয়া একটি স্বপ্ন যা রাত্রির প্রশান্তির ভেতরে আসে তাকে উপহাস করতে অথবা একটি সত্য যা ছিল এবং থাকবে সময়ের শেষ পর্যন্ত? 

আলী তার অশ্রুপূর্ণ চোখ বন্ধ করল এবং প্রসারিত করল তার হাত একজন ভিক্ষুকের মতো যে দয়া প্রার্থনা করছে। তার আত্মা তার ভেতরে শিহরিত হল এবং এই শিহরণের ভেতরেই সে ভেঙে পড়ল এবং ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, যার ভেতরে ছিল চিরসবুজ গুল্মের অসুস্থতা এবং আকুল আকাঙ্ক্ষার অগ্নি। একটা কণ্ঠস্বরের ভেতরে, যা ছিল শুধুমাত্রই কথার মূর্ছিত ধ্বনি, যা তার আহ্বানে একটা দীর্ঘশ্বাসকে ওপরে তুলে নিল : ‘কে তুমি যে আমার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি, যদিও আমার চোখে তা দৃশ্যমান নয়, আত্মা থেকে আমাকে আলাদা করছে, তৈরি করছে সংযোগ দূরবর্তী এবং বিস্মৃত কালের সঙ্গে আমার বর্তমানের? তুমি কি একজন পরী, একজন বামনভূত, সেই অমর পৃথিবী থেকে এসেছ জীবনের অহংকার ও মাংসের নশ্বরতা সম্পর্কে বলতে? তুমি কি জিনের রানীর সেই আত্মা যা বেড়ে উঠেছে পৃথিবীর পাত্র থেকে, আমার গোত্রের যুবকদের ভেতরে আমার ইন্দ্রিয়কে দাসত্বে এবং আমাকে হাস্যকর ব্যক্তিতে পরিণত করতে? তুমি কে এবং এই প্রলোভন কি ত্বরান্বিত এবং ধ্বংস করছে, যা অধিকার করেছে আমার আত্মা? এসব অনভূতিগুলি কী যা আমাকে আগুন ও আলোয় পরিপূর্ণ করে তোলে? আমি কে এবং কী এই নতুন সত্তা, যাকে আমি আহ্বান জানাই ‘আমি’ বলে, যদিও তা আমার কাছে একজন আগন্তুক? এটা কি জীবনের বসন্তের জলধারা যা বাতাসের ক্ষুদ্র কণাসমূহ গিলে ফেলেছিল এবং আমি পরিণত হয়েছিলাম দেবদূতে যা আমাকে গোপন জিনিসগুলি দেখিয়েছে এবং শুনিয়েছে? আমি কি পান করেছিলাম শয়তানের মদ এবং প্রকৃত জিনিস দেখার ক্ষেত্রে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।’ 

কিছুক্ষণের জন্য সে নীরবতায় পতিত হয়েছিল। তার আবেগ বৃদ্ধি পেয়েছিল শক্তির ভেতরে এবং তার আত্মা বেড়ে উঠেছিল বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত গুণাবলির ভেতরে। সে আবার বলল : ‘হে একক, যে আত্মাকে উন্মোচিত করে এবং কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং যে লুকিয়ে রাখে রাত্রিকে এবং তৈরি করে দূরত্ব, হে সুন্দর আত্মা আমার স্বপ্নের শূন্যতার ওপরে তুমি বাতাসে স্থির হয়ে ভেসে আছ, তুমি জেগে আছ আমার হয়ে ওঠা আত্মার অনুভূতির ভেতরে, যা ছিল ফুলের বীজের মতো বরফের তলায় লুকানো এবং অতিক্রম করেছিল ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসের মতো এবং তা ছিল শস্যক্ষেতের শ্বাসপ্রশ্বাস বহনকারী। স্পর্শ করেছিল আমার ইন্দ্রিয়কে যেন তারা আন্দোলিত ও বিরক্ত হয় গাছের পাতার মতো। আমাকে তাকাতে দাও তোমার প্রতি, যদি তুমি হয়ে ওঠো শরীর এবং বস্তু। ঘুমকে আদেশ দাও আমার চোখের পাতা বন্ধ করে দিতে, যেন আমি তোমাকে স্বপ্নের ভেতরে দেখতে পারি, যদি তুমি পৃথিবী থেকে মুক্ত হও। আমাকে অনুমতি দাও তোমাকে স্পর্শ করতে, আমাকে শুনতে দাও তোমার কণ্ঠস্বর। অবগুণ্ঠনের একপাশে অশ্রুজল ফ্যালো, যা আমার পুরো অস্তিত্বকে ঢেকে রাখে এবং ধ্বংস করে সেই পোশাক যার ভেতরে লুকানো আমার দৈবত্ব। আমাকে পাখা দাও যেন আমি তোমার পেছনে উড়তে পারি উচ্চতায় অবস্থিত সভার এলাকায়, তুমি যদি তাদের কেউ হও, যারা সেখানে বাধাগ্রস্ত। জাদুমন্ত্রের সাহায্যে স্পর্শ করো আমার চোখের পাতা এবং আমি তোমাকে অনুসরণ করব জিনের গোপন জায়গা পর্যন্ত যদি তুমি তাদের পরী হও। তোমার অদৃশ্য হাত রাখো আমার হৃদয়ের ওপরে এবং আমাকে তোমার অধিকারে নাও, যদি তুমি মুক্ত হও তাহলে তাকে অনুসরণ করতে দাও যাকে তুমি অনুসরণ করবে।’ 

সুতরাং আলী অন্ধকারের কানে ফিসফিস করে বলল সেইসব শব্দাবলি যা চলাচল করছে সুরের প্রতিধ্বনি থেকে হৃদয়ের গভীরতায়। তার দূরদৃষ্টি এবং তার বেষ্টনের মাঝখানে প্রবাহিত হচ্ছিল রাত্রির অলীক মূর্তি, যদিও তারা তার উষ্ণ অশ্রুজলের ভেতর থেকে বেড়ে ওঠা ক্রোধ। মন্দিরের দেয়ালের ওপরে রঙধনুর রঙের মন্ত্রমুগ্ধ ছবি আবির্ভূত হল। সময় অতিক্রান্ত হতে থাকল। সে তার অশ্রুজলের ভেতরে আনন্দে উদ্বেলিত এবং মর্মবেদনার ভেতরে উল্লসিত হল। সে মনোযোগ দিয়ে শুনল হৃদস্পন্দন। সে তাকাল সবকিছুর ওপরে যদিও সে দেখছিল জীবনের ধরন, দ্রুত যা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং এর নিজস্ব স্থানে নিজস্ব সৌন্দর্যের ভেতরে রয়েছে একটি চমৎকার স্বপ্ন, চিন্তার প্রতিমূর্তির ভেতরে যা ভয়াবহ। নবীর মতো কে স্বর্গের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আধ্যাত্মিক প্রেরণাকে পর্যবেক্ষণ করে, সুতরাং সে অপেক্ষা করে একটি মুহূর্তের, যা আসছে। তার দ্রুত দীর্ঘশ্বাস তার প্রশান্ত শ্বাসপ্রশ্বাসকে থামিয়ে দেয় এবং তার আত্মা তাকে পরিত্যাগ করেছিল তার ওপরে বাতাসে স্থির হয়ে ভেসে থাকতে এবং তারপর প্রত্যাবর্তন করতে যদিও তা অনুসন্ধান করছিল সেইসব ধ্বংসপ্রাপ্তেেদর ভেতরে হারিয়ে যাওয়া একজনকে যে ভালোবাসা পেয়েছিল। 

ভোরের নৈঃশব্দ ভেঙে গেল এবং প্রবাহিত মৃদুমন্দ বাতাসের ভেতরে শিহরিত হল সেই নীরবতা। বিশাল শূন্যতা একজন ঘুমন্তের হাসি হাসল যে ঘুমের ভেতরে তার পছন্দের মানুষের প্রতিমূর্তি দেখেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত দেয়ালের ফাটল থেকে আবির্ভূত হল পাখিরা এবং বিভিন্ন পিলারের ভিতরে তারা চলাচল করতে লাগল, গান গাইতে লাগল এবং ডাকতে লাগল একজন আরেকজনকে এবং ঘোষণা করতে লাগল দিনের প্রস্তাবাবলি। আলী উঠে দাঁড়াল এবং তার হাত রাখল উষ্ণ ভ্রুর ওপর। সে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করল বিবর্ণ দৃষ্টিতে। তারপর আদমের মতো যখন তার চোখ খুলে গেল ঈশ্বরের শ্বাসপ্রশ্বাসে, সে তার সামনে সবকিছু দেখতে পেল এবং বিস্মিত হল। সে তার ভেড়াগুলিকে আহ্বান জানাল। তারা উঠে দাঁড়াল এবং মাথা নাড়ল এবং ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে শান্তভাবে তার পেছনে পেছনে চলল সবুজ চারণভূমির দিকে। 

আলী তার পশুর পালের আগে আগে হাঁটতে লাগল। তার বিশাল দৃষ্টি প্রশান্ত পরিবেশকে পর্যবেক্ষণ করছিল। তার অভ্যন্তরস্থ অনুভূতিগুলি বাস্তবতা থেকে উড়াল দিল তার কাছে গোপনীয়তাকে প্রকাশ করতে এবং রুদ্ধ করতে অস্তিত্বের যাবতীয় বিষয় এবং তাকে সেইসব দেখাতে যা যুগের সঙ্গে সঙ্গে অতিক্রান্ত হয়েছিল এবং সেইসব, যা এখনও অবশিষ্ট আছে যেমন এটা ছিল একটা চমকের ভেতরে তাকে সবকিছু ভুলিয়ে দিতে এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে তার ক্লান্ত ও আকুল আকাঙ্ক্ষার কাছে। সে লক্ষ্য করল তার আত্মার আত্মা এবং তার মাঝে একটা অবগুণ্ঠন, একটা অবগুণ্ঠনের মতো তার দৃষ্টি এবং আলোর মাঝখানে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং তার দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ছিল একটা অগ্নিশিখা যা তার জ্বলন্ত হৃদয় থেকে খসে পড়েছিল। 

সে ছোট্ট নদীটার কাছে এল যার কুলুকুলু ধ্বনি শস্যক্ষেতের গোপনীয়তা ঘোষণা করছিল এবং সে বসেছিল তার তীরে একটা উইলো গাছের নিচে যার শাখাগুলি ঝুলেছিল পানির ভেতরে যদিও তারা এর মধুরতাকে শুষে নেবে। ভেড়াগুলি মাথা নুইয়ে ঘাস খাচ্ছিল এবং তাদের লোমের শুভ্রতার ওপর জ্বলজ্বল করছিল ভোরের শিশির। 

একমুহূর্ত অতিক্রান্ত হওয়ার পর আলী অনুভব করতে শুরু করল তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে এবং সে তার আত্মার কাঁপুনিকে নবায়ন করল। একজন ঘুমন্তের মতো, যাকে দেখে সূর্যরশ্মি আধ্যাত্মিক বিস্ময়ে চমকে উঠেছে তার বিনিদ্রতার ভেতরে। সে লক্ষ্য করল তরুবীথিকার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে একটা মেয়ে কাঁধে একটা পাত্র বহন করে। ধীরে ধীরে সে পানির দিকে হেঁটে গেল। তার নগ্ন পা ছিল শিশিরে ভেজা। যখন সে স্রোতের কিনারায় এবং তার পাত্র পানিতে ভর্তির করার জন্য ফাঁকা হল তখন সে অন্য তীরের দিকে তাকাল এবং আলীর সঙ্গে তার চোখের মিলন ঘটল। সে চিৎকার করে উঠল এবং পাত্রটি মাটিতে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে এল কয়েক পা। এটা ছিল একজনের কৃতকর্ম যে খুঁজে পেল একটা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান যা হারিয়ে গিয়েছিল। একমুহূর্ত পার হয়ে গেল এবং মুহূর্তগুলো ছিল এরকম যেন দুটো হৃদয়ের মাঝখানে আলো জ্বলছে, নীরবতা থেকে তৈরি হচ্ছে বিস্ময়কর সুর এই দুজনকে বহন করে নিতে অস্পষ্ট স্মৃতির প্রতিধ্বনির ভেতরে এবং প্রত্যেককে অন্য জায়গা দেখাতে যা বিভিন্ন মূর্তি ও ছায়ায় পরিপূর্ণ এবং নদীর স্রোত ও বনভূমি থেকে অনেক দূরে যার অবস্থান। একজন অন্যজনের দিকে তাকাল এবং দুজনের চোখেই অনুনয়ের ভঙ্গি ফুটে উঠল এবং একজন অন্যজনের চোখে সন্ধান পেল আনুকূল্যের এবং প্রত্যেকেই মনোযোগ দিয়ে শুনল প্রত্যেকের দীর্ঘশ্বাস ভালোবাসার কান দিয়ে। 

তারা নিবিড়ভাবে ভাব বিনিময় করল একে অন্যের সঙ্গে আত্মার সবগুলি জিভের ভেতরে এবং যখন তাদের দুটি আত্মা উপলব্ধি ও জ্ঞানে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল তখন আলী এক অদৃশ্য শক্তির ওপর নির্ভর করে নদীর স্রোত অতিক্রম করল এবং ইতস্তত কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল। তারপর সে মেয়েটির কাছে গিয়ে তাকে আলিঙ্গন করল। চুম্বন করল তার ওষ্ঠ, চিবুক এবং চোখ। সে আলীর বাহুর ভেতরে মোটেও নড়াচড়া করল না, যদিও আলিঙ্গনের মধুরতা তার ইচ্ছাশক্তিকে হরণ করল এবং তার স্পর্শ মেয়েটির সমস্ত শক্তিকে কেড়ে নিল। মেয়েটি আত্মসমর্পণ করল যেভাবে জুঁইফুলের সুগন্ধ বাতাসে নিজেকে সমর্পণ করে। সে তার হাত রাখল আলীর বুকের ওপর এমনভাবে যেন সে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলেছে এবং এখন তার বিশ্রাম প্রয়োজন এবং সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল গভীরভাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস একটা অভ্যস্তরস্থ বস্তুর জন্মের কথা বলছে সংকীর্ণ হৃদয়ের ভেতরে এবং তার ভেতরে জীবনের জাগরণ যা ঘুমাচ্ছিল এবং এখন তা জাগ্রত। সে তার মাথা তুলল এবং আলীর চোখের দিকে তাকাল। একজনের এই দৃষ্টি, যে ঘৃণা করে প্রথা অনুযায়ী বক্তব্য মানুষের ভেতরে থেকে নৈঃশব্দের মাধ্যমে এবং সেটাই হল আত্মার ভাষা একজনের দৃষ্টি যে পরিতৃপ্ত নয় সেই ভালোবাসার উচিত একটা আত্মায় পরিণত হওয়া কথার শরীরের ভেতরে। 

দুজন প্রেমাস্পদ উইলোগাছের ভেতর দিয়ে হাঁটছিল এবং দু’জনের একজন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ছিল একটি ভাষা, যা দুজনের একজন হয়ে যাওয়ার কথা বলছিল এবং একটি কান শুনছিল নীরবতার ভেতরে ভালোবাসার প্রেরণা এবং দৃশমান একটি চোখ দেখছিল সুখের মহিমা। ভেড়াগুলি তাদেরকে অনুসরণ করছিল, খেয়ে ফেলছিল ফুল এবং তৃণলতার উপরিভাগ এবং পাখিরা মনোমুগ্ধকর গান গাইতে গাইতে তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল। 

যখন তারা উপত্যকার প্রান্তে পৌঁছাল তখন সূর্য ওপরে উঠেছে এবং উচ্চতায় জড়ো করেছে সোনালি ছদ্মবেশ। তারা একটা পাথরের পাশে বসল, যা তাদেরকে ছায়া দেয় এবং সূর্যের বেগুনিরশ্মি থেকে রক্ষা করে। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি আলীর কালো চোখের দিকে তাকাল এবং তখন ভোরের মৃদুমন্দ বাতাস খেলা করছিল মেয়েটির চুলের সঙ্গে যেন এই চুলগুলির অদৃশ্য ঠোঁট রয়েছে যারা তাকে চুম্বন করবে। আঙুলের ডগা যখন তার ওষ্ঠ ও কপোল আদর করছিল তখন সে মুগ্ধ হল এবং তার সমস্ত ইচ্ছা পরিণত হল একজন বন্দিতে। সে অভ্যস্ত সুমধুর স্বরে বলল : 

‘এ্যাসতারতে আমাদের আত্মাকে এই জীবনে ফিরিয়ে এনেছে। সুতরাং ভালোবাসার উল্লাস এবং যৌবনের মহিমা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ নাও হতে পারে, হে আমার পছন্দের মানুষ।’ 

আলী চোখ বন্ধ করে ফেলল, কারণ তার কথার সংগীত একটা স্বপ্নের ধরনকে স্বচ্ছ করে তুলছিল যা সে প্রায়ই দেখত তার স্বপ্নের ভেতরে। সে অনুভব করল সেই অদৃশ্য পাখাগুলি তাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে সেই জায়গা থেকে বিস্ময়কর আদলের একটি কক্ষে। সেই কক্ষের ভেতরে সে দাঁড়িয়ে ছিল একটা কৌচের পাশে যার ওপরে শুয়ে ছিল একজন সুন্দরী নারী এবং যার সৌন্দর্যের মৃত্যু ঘটেছিল তার ওষ্ঠের উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে। সে এই ভয়াবহ দৃশ্যে নিদারুন যন্ত্রণায় চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তারপর সে চোখ খুলে দেখল তার পাশে বসে আছে সেই মেয়েটি। তার ঠোঁটে ভালোবাসার হাসি এবং সেই হাসির ঝলকের ভেতরে রয়েছে জীবনের রশ্মিগুলি। আলীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং তার আত্মা ছিল সতেজ, অন্তর্দৃষ্টি ছিল ছড়ানো ছিটানো এবং সে ভুলে গিয়েছিল অতীত ও ভবিষ্যৎ… 

প্রেমাস্পদেরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করল এবং পান করল চুম্বনের মদ তৃপ্ত না-হওয়া পর্যন্ত। তারা ঘুমিয়ে পড়ল একে অন্যের বাহুর ভাঁজে যতক্ষণ-না তাদের ছায়া স্থান পরিবর্তন করল এবং সূর্যের তাপ তাদেরকে জাগিয়ে তুলল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *