উপত্যকায় যেভাবে সভ্যতার বিকাশ
কিভাবে সৃষ্টি হলো রূপময় এই উপত্যকা? এখানে মানুষ বসতি গাড়ল কখন? কিভাবে? এই প্রশ্ন একেবারেই মৌলিক। এর উত্তরে অনেকেই আশ্রয় নেন রূপকথা আর মিথের। হিন্দু মিথোলজি অনুসারে কাশ্বাপ’ নামের এক সাধু দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তরমুখী তীর্থযাত্রা করছিলেন। পথিমধ্যে তিনি জানতে পারলেন ‘স্বতিস্বর’ নামে বিশালাকার এক জলাশয়ের কথা। ওই জলাশয় ছিল ভূতের (Demon) দখলে।
তখন সাধুর ইচ্ছায় দেবী সারিকা’ মস্তবড় এক পক্ষীর আকারে সেখানে আবির্ভূত হন। পক্ষীদেবী তার চঞ্চুতে এক স্বর্গীয় বিরাট পাথর খণ্ড আনেন। এরপর তা ভূতগুলোর দিকে নিক্ষেপ করেন। ফলে ধ্বংস হয়ে যায় ভূতসকল। ওই পাথরটি নিজেই একটি পাহাড়ে পরিণত হয়ে যায়। ওই পাহাড়ের নাম হয় ‘হরি পর্বত। কাশ্মীরি ভাষায় হর’ মানে পাখি। এ থেকে হরি’ শব্দের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। পরে, কাশ্বাপ ঋষি ওই জলাশয়ের পশ্চিম দিকে একটি নালা কেটে পানি অপসারণ করেন বলে কথিত আছে।
কিন্তু, এ কি সম্ভব? ভ্যালি সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কী? এটা জানার জন্য চেষ্টা করেছি ভূ-তত্ত্ব ও ভূগোল নিয়ে খানিকটা অধ্যয়নের। আলাপ করেছি বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে। অধ্যাপক এম শফি ভাটের মতে, একজন মানুষের পক্ষে এত বড় একটা লেকের পানি নালা কেটে সরিয়ে বাসোপযোগী করা অসম্ভব। মূলত কাশ্মীর উপত্যকা সৃষ্টির ভূ-তাত্ত্বিক গল্প হিমালয় পর্বতমালার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। বৈজ্ঞানিক ধারণা মতে, পৃথিবীর বয়স ৪.৬ বিলিয়ন বছর। আর ৩০ মিলিয়ন বছর আগে হিমালয় পর্বতমালা সৃষ্টি হয়েছে। ভূ-পৃষ্ঠের বিকাশের অনেক অধ্যায় রয়েছে।
যেমন, বরফ যুগ (আইস এইজ), প্রস্তর যুগ (স্টোন এইজ)। অধ্যাপক শফি বলেন, শেষ আইস এইজ সমাপ্ত হয়েছে এখন থেকে ১০ হাজার বছর আগে। সেই সময় একটি আবদ্ধ, পর্বত বেষ্টিত উপত্যকা বরফ গলা পানির মাধ্যমে জলাশয়ে পরিণত হয়। রাশিয়ান প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের মধ্যে কোনো সংঘর্ষের ফলে এই উপত্যকা সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। পরে আবদ্ধ পানির হাইড্রোলিক প্রেসার, ভূ-তাত্ত্বিক কোনো বিবর্তন (আপহিলস) অথবা বড় কোনো ভূমিকম্পের ফলে ওই আবদ্ধ উপত্যকার পশ্চিম দিকটা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে আবদ্ধ পানি সরে গিয়ে বসবাস উপযোগী ভ্যালি সৃষ্টি হয়। ইতিহাসবিদদের ধারণা, এখানে মানববসতি শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব
৩০০০ বছর আগে। অর্থাৎ, এখন থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। সম্ভবত, নূহের আলাইহিস সালাম মহাপ্লাবনের কাছাকাছি সময়ে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, প্যালিওলিথিক, নিওলিথিক ও মেগালিথিক সকল যুগের প্রত্ননিদর্শনেরই সন্ধান মিলেছে কাশ্মীর ভূখণ্ডে। অর্থাৎ, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সাল থেকে জনবসতির ধারণা ভুল নয়।
কাশ্মীরের আদি বাসিন্দাদের তিনটি গ্রুপের পরিচয় ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন। যথা: নাগ (Naga), পিশাচ (Pisacha) ও ইয়াক্ষা (Yaksha)। এসব গোষ্ঠী লেক বা নালার পাশে বাস করত। কাশ্মীরের ভাষায় পানির পাহাড়ি নালাকে (Spring) বলা হয় নাগ’। আদি ওই গোষ্ঠীগুলো বন্যপশু ও সাপের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকত।
বন্য জীবজন্তুকে তারা ভয়ও পেত, পূজাও করত। এরপর আর্যরা আসে সেখানে। আদি বাসিন্দাদের এই নামকরণের পেছনেও রয়েছে। দারুণ গল্প। আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার পর স্থানীয় ওই বাসিন্দাদের মধ্যে একটি পক্ষ তাদের মেনে নেয়। তাদের নাম হয় হনুমান’ এবং বানরজাতি’। আর আরেক পক্ষ কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ওই সব হিংস্র প্রতিরোধের কারণে তাদের নাম হয় নাগ (সাপ) এবং পিশাচ (শয়তান)। যাইহোক, সমগ্র উত্তর পশ্চিম ভারতে আসন গাড়তে ওই নাগ ও পিশাচদের মোকাবিলা করে আর্যরা। তাতে সফল হওয়ার পরই আদি বাসিন্দারা হয়ে পড়ে নিচু আর আর্যরা প্রতিষ্ঠা পায় উঁচু ব্রাহ্মণ) হিসেবে। এভাবেই হিন্দু সমাজে জাত-ব্যবস্থার শুরু হয় বলে অনেক ইতিহাসবিদ লিখেছেন।
নচিকেতা গেয়েছেন, বিজয়ীরা বরাবর ভগবান এখানেতে/পরাজিতরাই পাপী এখানে; রাম যদি হেরে যেত রামায়ণ লেখা হতো/রাবণ দেবতা হতো সেখানে।’ এ শুধু রামায়ণের গল্পের ক্ষেত্রেই সত্য নয়। কাশ্মীরের ইতিহাসেও বিজয়ীরা বরাবর ভগবান বনে গেছেন। ইতিহাসের রচনাও ভগবানসমদের হাতেই হয়েছে। পরবর্তীতে আর্যদের বর্ণনামতে, কিছু কালের মধ্যেই আদি বাসিন্দাদের কেউ আর বেঁচে ছিল না। তাদের দাবি, যেসব নিম্নবর্ণের লোক সমাজে ছিল তারাও মূলত আর্যদেরই বিভিন্ন বর্ণ। আমার নেপালি বন্ধু বিষ্ণু পোখরেল এ বিষয়ে তার মতামত দিয়েছিল এভাবে, “আর্য সমাজের রীতি অনুসারে কেউ নিজের বোনের সঙ্গে মিলনের মতো গুরুতর অপরাধ করে বসলে তাদের করা হতো একঘরে।
তারাই পরে হয়ে পড়ত অচ্ছুত, নিম্নবর্ণ। এভাবে আর্যদের মধ্যেও অনেকে নিম্নবর্ণ হয়ে পড়ে।’ ওইসব বর্ণনায় যদিও বলা হয়েছে নাগ ও পিশাচেরা ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু, অনেক ঐতিহাসিক বলেছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীতে ফের হয়েছে শাসক। অনেকেই ধারণা করেন, কাশ্মীরের ব্রাহ্মণরা (পণ্ডিত) ছাড়া অন্য মানুষেরা আসলে ওই আদি বাসিন্দাদেরই বংশধর।
এবার ফিরে আসি নামকরণের গল্পে। জায়গাটির নাম কেন হলো কাশ্মীর? এ নিয়েও নানাবিধ বর্ণনা পাওয়া গেছে। স্থানীয় ভাষায় কাশ্মীরকে বলা হয় কাশীর’। এর
মানে হলো, যেখানে ‘কশুর লোকেরা বাস করে। আর ‘কশুর অর্থ ‘যারা মাংস খায়’। নামটির প্রথম অংশ কাশ’। ইতিহাসবিদ ফিদা এম হাসনাঈন আরও লিখেছেন, নূহের আলাইহিস সালাম আমলে মহাপ্লাবনের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২০০০-এর মধ্যে কোনো এক সময়) পর তার তিন সন্তান ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় বসতি বিস্তার করে। তাদের একজনের নাম ছিল হাম। হাম’-এর সন্তানের নাম ছিল কাশ’, যার নামে একটি বিরাট উপজাতির বিস্তার হয়। এই কাশ’ উপজাতির অবস্থান মেলে বিভিন্ন স্থানে। তারা বিভিন্ন নদী, পাহাড়, গ্রাম ও শহরের নামকরণ করে।
বাগদাদ শহরের পাশের একটি গ্রামের নাম কাশ’। ইরাকের একটি নদীর নাম কাশানা’। ইরানের নিশাপুরের একটা গ্রাম ‘কাশ-মার’; শহরের নাম কাশান’, কাশাফ’ ও কাশাই’। মধ্য এশিয়ায় মেরভ শহরের গ্রামের নাম কাশ-মোহরা’। বুখারার একটি গ্রামের নাম ‘কাশ’। সমরখন্দে দুটি গ্রামের নাম ‘কাশ-বান্দ’ ও কাশ-আনিয়া। চায়নিজ তুর্কিস্থানের (জিংজ্যাং) একটি জায়গা কাসগার’। আফগানিস্তানে এই উপজাতির লোকেরা গড়ে তোলে কাশকার, কাশহিল, কাশেক ও কণ্ড গ্রাম। তারা আরও দক্ষিণে হিন্দু কুশ পর্বত পেরিয়ে এক এলাকায় বসতি গড়ে, যার নাম দেয় ‘কাশ-মর’। ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর তার স্মৃতি থেকে এটি চিহ্নিত করেন যে, ‘কাশ’ উপজাতি থেকেই কাশীরের বাসিন্দাদের নামকরণ হয়েছে। এই লোকেরা প্রথমে কাশতাওয়ার (কিশতোয়ার: জম্মু অঞ্চলের একটি জেলা) এলাকায় বসতি গড়ে। পরে পীরপাঞ্জাল পর্বতমালা পেরিয়ে কাশ্মীরে বিস্তৃত হয়। এছাড়াও কাশ্মীর ভ্যালির পুলওয়ামা জেলার কুশতওয়ার’ গ্রাম, অনন্তনাগ জেলার ‘কাশনাগ’ ঝরনা এবং আরও কিছু গ্রামের নাম ওই উপজাতির চিহ্ন বহন করে।
মোদ্দাকথা, একটি বর্ণনা অনুসারে নূহ আলাইহিস সালাম নবীর বংশধর কাশ’ উপজাতি থেকে নামকরণ করা হয়েছে কাশ্মীরের। এই হিসেবে, কাশ্মীরের বাসিন্দারা বনী-ঈসরাইলের (ঈহুদি) বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কোনো উপজাতি বলেও ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন। অনেক নৃবিজ্ঞাণী ও ঐতিহাসিক কাশ্মীরের মানুষের আচরণ, চেহারা, গায়ের রং এবং মুখের দাড়ি ইত্যাদি বিশ্লেষণ করেও দাবি করেন, কাশ্মীরিরা ইহুদিদের বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন উপজাতি। বনী ইসরাইলের ১২টি গোত্রের মধ্যে নানা সংঘাতের বর্ণনা মুসলিম ও হিব্রু ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়। ওই সংঘাতের ফল হিসেবে তারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ওইসব ইহুদি সিরিয়া ও ব্যাবিলনের দিকে যায়। কিন্তু, সেখানেও তারা হয় নিহত অথবা বন্দি হয়। পরে, ইন্দো-গ্রীক (আলেকজাণ্ডারের বিজয়ের পর) রাজাদের সময় বন্দি ইহুদিদের মধ্যে যারা শিল্পকর্মে দক্ষ ছিল তাদের স্থানান্তর করা হয় আফগানিস্তান, ব্যাকট্রিয়া, গিলগিত, চিত্রালসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায়। এভাবে কোনো এক সময় তারা কাশ্মীরের আশেপাশে চলে আসে। সে হিসেবে ওইসব বিচ্ছিন্ন উপজাতির কাশ্মীরে আসার সময় হলো খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতক। কিন্তু, এটিই একমাত্র বর্ণনা নয়। হিন্দু রূপকথা অনুসারে কাশ্বাফ-ঋষি নিজ হাতে
জলাবদ্ধ জায়গার পানি সেঁচ করে একে বাসযোগ্য করেছেন। তাই এ উপত্যকার নাম কাশ্মীর। এর আগে ওই লেকের নাম ছিল ‘স্বতিস্বর’ বা ‘স্বতিস্বরাস। অপর এক মতে, আদি প্রাকৃত ভাষায় ‘কাশ’ মানে হলো নালা আর মীর’ মানে হলো পর্বত। সেখান থেকেও নামকরণ হয়ে থাকতে পারে কাশ্মীর।
বোঝা গেল, আর্য সমাজ আর আদি বাসিন্দাদের মধ্যে নানা সংঘাতের মাধ্যমেই কাশ্মীরি সভ্যতার বিকাশ হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষের আনাগোনা ছিল অব্যাহত। এছাড়াও এশিয়ার পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত হাজার মাইল দীর্ঘ বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক ‘সিল্করুটেও সংযুক্ত ছিল কাশ্মীর। ওই রুট ধরে চায়নিজ সিল্ক, রাশিয়ান গ্লাসওয়ার, ভারতীয় মসলা আর মধ্য এশিয়ার ঘোড়াচামড়ার আমদানি-রপ্তানি হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে স্থানান্তরিত হয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন। অর্থাৎ, কাশ্মীর ছিল অনেক সভ্যতার মিলনস্থল। স্পষ্টতই, পারস্য, মধ্য এশিয়া, চীন ও ভারতীয় সভ্যতার মিলন হয়েছে সেখানে। এসবের মধ্যে ইরান আর মধ্য এশীয় সভ্যতার প্রতিফলন দেখা যায় সবচেয়ে বেশি।
ঐতিহাসিকরা বলেন, প্রতিটি সভ্যতাই পর্বতবেষ্টিত কাশ্মীর উপত্যকার সীমানায় এসে থমকে গেছে। কেউ এসে এককভাবে একে দখল করতে পারেনি। শীতল ও নিরিবিলি হওয়ায় ধ্যান-জ্ঞান সাধনায় এলাকাটি ছিল উপযোগী। ফলে কাশ্মীর ছিল জ্ঞানের কেন্দ্র। ভারতীয় সভ্যতার অগণিত তথ্য ও উপাখ্যান লিখিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে কাশ্মীর থেকে। যুগান্তকারী সব জ্ঞানের বিকাশ হয়েছে। বৈদিক যুগের পাঞ্জাবের তক্ষশীলা বিদ্যাকেন্দ্র ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল কাশ্মীরের জ্ঞান দ্বারা। বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ পানিনির ব্যাকরণের ব্যাখ্যা মহাভাষ্য’ লিখেছিলেন যিনি তার নাম পাতাঞ্জলি। তিনি ছিলেন কাশ্মীরি। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকেই এমন অসংখ্য জ্ঞান সাধকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ আয়ুরবেদের চরকসংহিতার রচনায় কাশ্মীরি পণ্ডিত দৃধাবালার ভূমিকা আছে বলে জানা যায়।
সেটাও হয়েছিল বৈদিক যুগে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের সেই সময় পাঞ্জাবের তক্ষশীলা ছিল জ্ঞানের কেন্দ্র। আর কাশ্মীরও ছিল বৃহত্তর উত্তর-পশ্চিম ভারতের অন্যান্য এলাকার মতো ওই কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। ধারণা করা হয় নাট্যশাস্ত্রের রচয়িতা ভারতমুণীও ছিলেন কাশ্মীরি পণ্ডিত। দক্ষিণ ভারতে অদ্যাবধি জনপ্রিয় শেভিক, তান্ত্রিক ধর্মচর্চারও মূল উৎসস্থল হলো কাশ্মীর। সম্ভবত এসব কারণেই কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে এখনও পণ্ডিত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। প্রাগৈতিহাসিক এই ভিত্তি পেরিয়ে ঐতিহাসিকরা একমত হয়েছেন, লিখিত ইতিহাস সংরক্ষণেও কাশ্মীর অনবদ্য। খ্রিষ্টপূর্ব ১১৮৪ সাল থেকে পরবর্তী সময়ের কাশ্মীরের প্রায় সকল শাসকের বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ পাওয়া যায়। সেই হিসেবে কাশ্মীরের লিপিবদ্ধ ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দিয়েছেন পারভেজ দেওয়ান। তিনি উল্লেখ করেছেন, মহাভারতের যুদ্ধের আগে রাজা
প্রথম গোনাডা ২০ বছর শাসন করেছেন। এর পর অজ্ঞাত সময় থেকে পাও রাজবংশ শাসন করে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক পর্যন্ত। সেখান থেকে খ্রিষ্টযুগের শুরু পর্যন্ত শাসন করে মৌর্য বা মৌরিয়ান (Mauryans) রাজবংশ। কুশান রাজবংশ ছিল ১৭৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। তারপর শুরু হয় গোনানডা (দ্বিতীয়) রাজবংশের শাসন। পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী ছিল তা। হোয়াইট হুন শাসকরা ছিলেন ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। পরের ৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিলেন কারকোটা রাজবংশের শাসকরা।
বিচ্ছিন্ন কয়েকজন রাজা শাসন করেন কিছুকাল কাশ্মীরকে। তারা কোনো রাজবংশের প্রতিনিধি ছিলেন না। ১১০১ সাল থেকে শুরু হয় লোহারা রাজবংশের শাসন। দ্বিতীয় লোহারা রাজবংশের শাসন শেষ হয় ১৩৩৯ সালে। সেখান থেকে শুরু হয় সুলতান শাসনামল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া শাহ মীর রাজবংশই মূলত সুলতান আমল। এরপর ধারাবাহিকভাবে মীর্জা হায়দার দৌলত কাসগরী (১৫৪১ – ১৫৫১), চাক রাজবংশ (১৫৬১ – ১৫৮৯), মোগল (১৫৮৯ – ১৭৫২), আফগান (১৭৫২ – ১৮১৯), শিখ (১৮১৯ – ১৮৪৬, পাঞ্জাব) ও ডোগরা (১৮৪৬ – ১৯৪৭) শাসনের অধীনে ছিল কাশ্মীর উপত্যকা। ১৯৪৭ এর পর থেকে শুরু হয় বর্তমানের জটিল এক জাতীয়তাবাদী আলো-আঁধারি খেলা।
প্রচলিতভাবে রাষ্ট্র বা শাসকদের দৃষ্টিকোণ থেকেই রচিত হয়ে আসছে ইতিহাস। উপরের তালিকাও তার ব্যতিক্রম নয়। বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে, ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে সামাজিক জীবনের গতিধারা এবং জনগণের মতামত ইতিহাসে তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের গবেষণা এখন বেশ জনপ্রিয়। কাশ্মীরিদের ধর্মীয় ও আঞ্চলিক পরিচিতি নিরূপণের লক্ষ্যে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রলেখা জুৎসি (Chitralekha Zutshi) রচিত Language of Belongings গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য। তিনি তুলে ধরেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর জনগণের সঙ্গে কাশ্মীরিদের ধর্মীয়’ ও ‘আঞ্চলিক পরিচিতির স্বাতন্ত্র ও সামাঞ্জস্য।
আর্থিক শ্রেণিভেদ গড়ার পেছনে শতবর্ষের ঔপনিবেশিক শাসনের ভূমিকা বর্ণনা করেছেন তিনি। আর, কাশ্মীরিদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনে ইসলামের ভূমিকা কতখানি তাও আলোচনা করেছেন। পরবর্তী বিভিন্ন অধ্যায়ে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ অধ্যায়ে সংক্ষেপে এটুকুই বলা প্রয়োজন যে, কাশ্মীরি জনগণের কাছে পর্বতবেষ্টিত হিমালয়ান ওই উপত্যকা আপন ভূমি। কারও কাছে মায়ের সমান। কাশ্মীরি ভাষায় ‘মা’জ কাশীর’। কেউ বলে কাশ্মীর হামারা হ্যায়’। ভূ-প্রাকৃতিক আলোড়ন, মহাপ্লাবন কিংবা কাশ্বাপ ঋষির আধ্যাত্মিকতা বা ক্যারিশমার যেটাই হোক না কেন, ইতিহাসের কোনো এক সময় থেকে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছিল সেখানে। কালক্রমে ওই বসতি হয়ে ওঠে সভ্যতার সংযোগস্থল। মানুষের আনাগোনা বাড়ে। চিন্তা, বিশ্বাস ও পণ্যের লেনদেন হয়। শাসন-শোষণের প্রশ্ন আসে। আপন-পরের বিভেদ সৃষ্টি হয়। গড়ে ওঠে জাতিসত্ত্বা, জাতীয়তাবাদ।
নোট/সূত্র
১. শ্রীনগর শহরের মধ্যে হরিপর্বত এখন একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। মুসলমান
বাসিন্দারা একে বলে ‘কোহ-এ-মারান’। ওই পর্বতে একটি আদি দুর্গ রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে মকদুম শাহ (র.) নামে এক বুজুর্গের মাজার। অসংখ্য মানুষ সেখানে যায় কল্যাণের আশায়।
২. Parvez Dawan; A History of Kashmir (2008); New Delhi: Manas Publication. P11.
৩. নূহ ছিলেন প্রথম মানব আদমের দশম বংশধর। তিনি ছিলেন নবী আলাইহিস সালাম। তার আহ্বানে খুব কম সংখ্যক মানুষ খোদার পথের অনুসারি হয়েছিল। বিপথগামী মানুষদের ধ্বংসের জন্য আল্লাহ এক মহাপ্লাবন নাজিল করেন। তার আগে আল্লাহর নির্দেশে নূহ আলাইহিস সালাম নির্মাণ করেন এক বিশাল নৌকা। একটানা বৃষ্টি হয় চল্লিশ দিন। প্রায় দেড়শ দিন পানিতে ডুবে ছিল পৃথিবী। সকল প্রজাতির জীবজন্তু, পশু-পাখি এবং খোদাভীরু মানুষদের নিয়ে নৌকা ভিড়ে এক পর্বতের গায়ে (আরবি/কুরআন ও হিব্রু ধর্মগ্রন্থে প্রায় একই রকম বর্ণনা পাওয়া যায়)। হিন্দু পুরাণ ও মহাভারতেও তেমন এক বন্যার কথা পাওয়া যায়। তবে একটু ভিন্ন বর্ণনায়। তাতে বলা হয়েছে, তিন জগতের সবকিছু একটি মৃত্যুর মহাসমুদ্রে পরিণত হয়। ভয়ঙ্কর সেই তুফানের মধ্য থেকে একটি পাত্র ভেসে ওঠে ভগবানের কৃপায়। তাতে আশ্রয় নেয় সকল বীজ ও জোড়া প্রাণি। সাতজন পবিত্র মানুষও। অবতার বিষ্ণু সেখানে হাজির হন একটি মাছ হিসেবে। তিনিই ওই পাত্রকে নিরাপদে ভাসিয়ে নিয়ে যান।
৪. Parvez Dawan; A History of Kashmir (2008); New Delhi: Manas Publication. Pp: 13-14.
৫. Fida M Hassnain; Buddhist Heritage of Kashmir, Journal of Kashmir Studies (2011), Pp: 144-159.
৬. Sheikh Showkat Hossain; Facts of Resurgent Kashmir (2008); Kashmir Institute; Srinagar; Pp: 2-3.
৭. Fida M Hassnain; Kashmiris With Jewish Roots; Journal of Kashmir Studies (2007); Pp: 17-30.
৮. প্রাক্ত
৯. Parvez Dawan; A History of Kashmir (2008); New Delhi: Manas Publication. P13.
১০. Subhash Kak; The Wonder That Was Kashmir, www.ece.Isu.edu/kak/wonder.pdf
১১. প্রাগুক্ত
১২. ধারণা করা হয় তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার বছর অতীতে মহাভারতের যুদ্ধ হয়।