উন্নত সমাজের মূলমন্ত্র
সুইডিশ কেমিক্যাল সোসাইটি থেকে পোস্টডক্টরাল গবেষণার (Postdoctoral Research) জন্য স্কলারশিপ দেওয়া হবে। বৃত্তির সংখ্যা তিনটি। অর্থমূল্য সাড়ে তিন লাখ সুইডিশ ক্রোনার। যেনতেন কথা নয়! স্টকহোম ইউনিভার্সিটি থেকে মাত্র পিএইচডি শেষ করেছি। আমারও ইচ্ছা আবেদন করার। তবে শুরুতে একটু ইতস্তত বোধ করছিলাম। কারণ, আমি সুইডিশ নই। আমার নামের আগে মোহাম্মদ। মুখের ভাষা বাংলা। দুই অক্ষর সুইডিশ জ্ঞান নেই। দেখতেও সুইডিশদের মতো নই। বৃত্তিতে কোনো কোটা নেই। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের গবেষণা এগিয়ে নেওয়ার জন্যও এই স্কলারশিপ নয়। না ধর্মে, না সংস্কৃতিতে তাদের সঙ্গে আছে আমার মিল। যা-ই হোক, এসব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে, আখেরে আবেদন করলাম। ২০১৬ সালে সে বৃত্তি পেলাম। সুইডিশ কেমিক্যাল সোসাইটির ওয়েবপেজে সে খবর প্রকাশ করা হলো। আমার নামধাম, বাড়ি, ধর্ম, চেহারা, রাজনৈতিক পরিচয়, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা এগুলো ওদের দেখার বিষয় না। ওরা দেখেও না। এসব সমাজ যা দেখার শুধু তা-ই দেখে। আর তা হলো যোগ্যতা। ওদের মূলমন্ত্রই সেটা।
যে দেশটির সঙ্গে আমার বস্তুত কোনো দিক দিয়েই সম্পর্ক নেই, তারা আমাকে বৃত্তি দিল। যা দেখল তা হলো আমার কাজ। কার অধীনে ডক্টরাল গবেষণা করেছি। সে প্রফেসরের রেপটে কেমন। যে ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেছি সেটির মান। গবেষণায় কত ভালো পাবলিকেশন ছিল। যে ইউনিভার্সিটি পোস্টডক করতে চাই সেটার র্যাঙ্কিং কেমন। যে প্রফেস অধীন পোস্টডক করব, তার খ্যাতি ইত্যাদি বিষয়ই ওদের। বিবেচনার বিষয়।
একটা দেশে যখন মানুষের যোগ্যতাকেই মুখ্য বিবেচনা করা। হয় না, তখন সেখানে যোগ্যতার একটা তীব্র প্রতিযোগিতা দাঁড় করানো যায় না। ফলে সেখানে অযোগ্যরা ঢুকে পড়ে। সেখানের ব্যবস্থাপনা দুর্বল হতে থাকে। উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। আমি যখন খবরে দেখি, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা প্রশাসনিক একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় দলীয় বিবেচনায়, তখন খুব কষ্ট হয়। একজন। মেধাহীন অযোগ্য শিক্ষক যদি রাজনৈতিক বিবেচনায় কর্মজীবন শুরু করেন, তাহলে তিনি মেধাবী তৈরি করবেন কী করে–এটা কি আমরা ভাবি!
পশ্চিম ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও রাজনীতি আছে। সেসব দেশে কি কেউ ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সনদ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পারবেন? কেউ কি বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়িয়ে, গবেষণা না করে শুধু রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারবেন? এটা অসম্ভব! সেসব দেশে একজন। মানুষকে তার কাজের সঙ্গে পূর্ণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে টিকে থাকতে হয়। সেসব সমাজে একজন মানুষের জাত, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির উর্ধ্বে কাজকে বড় করে দেখা হয়। যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। পশ্চিমের দেশগুলো এজন্যই উন্নত। পৃথিবীকে তারা নেতৃত্ব। দিচ্ছে এ কারণেই।
ইউরোপ-আমেরিকায় আমি কতগুলো মেধাবী বাঙালিকে চিনি। কথা বললেই তাদের গোপন ব্যথার কথা উঠে আসে। আর। সে বেদনার নাম হলো প্রবঞ্চনা। যোগ্য হওয়ার পরও নিজের দেশে বঞ্চিত হওয়া প্রবঞ্চিত ছেলেমেয়ে প্রবঞ্চিত হওয়ার দুঃখ তাদের কাদায়। উন্নত সমাজ এসব। এত ছেলেমেয়েদের আলিঙ্গন করে। সারা দুনিয়ার ধনী। লোতে বাংলাদেশের মেধাবী ছেলেমেয়েরা বিকশিত হতে। অথচ নিজের দেশে পারেন না। কী আফসোস!
মাপকাঠি যেখানে নড়বড়ে, সেখানে শৃঙ্খলা হলো দুরাশা। ভবত্তিক চর্চা সেখানে স্বপ্নমাত্র। যোগ্যতার সঠিক যাচাই না। হলে সমাজ গোড়া থেকে পচতে শুরু করে। দেশটাকে যদি দাঁড় করাতে হয় তাহলে মাপকাঠির মাপে ছাড় দেওয়া যায় না। আমরা কি সেটা এখনো বুঝতে পারছি না?