পরিশিষ্ট

উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদী ভাবনা

উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদী ভাবনা

ভবানীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

সুউচ্চ হিমালয় পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমতো বিস্ময় জাগে! বিশালকায় ওই হিমালয়ের কাছে বেশিরভাগ সময় নিজেকে অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক জীব বলে বোধ হয়। কোটি কোটি বছর ধরে শিলার স্তরগুলোকে বুকে আঁকড়ে রেখেছে! প্রকৃতি নিজেই সৃষ্টি করেছে সেই সংগ্রহশালা, যেখানে সুরক্ষিত রয়েছে তার যুগ-যুগান্তের কর্মকাণ্ডের চিহ্ন। প্রকৃতি যা করে তার চিহ্ন রেখে যায় কোনও-না-কোনওভাবে, আমরা শুধু তা খুঁজে নিই মাত্র। এটাই বোধহয় প্রাকৃতিক নিয়ম। কিছুই হারিয়ে যায় না। সময় তো আর জাগতিক নিয়মের বেড়াজাল ছিঁড়তে পারে না, নানা কর্মকাণ্ডের চিহ্নগুলোকে সযত্নে সাজিয়ে রাখে তার ওই সংগ্রহশালায় । তাই কালই ইতিহাসের সাক্ষী, সেই উপাদানগুলো সাজিয়ে আমরা ইতিহাস রচনা করি। হিমালয়ের শরীরে থরে থরে সাজানো অসংখ্য শিলাস্তরগুলোকে যেমন একটার সঙ্গে আরেকটাকে মেলানো যায় না, প্রত্যেকটাই একক বা অনন্য। সময়ের ক্ষেত্রেও এর কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। ইতিহাসের কোনও বিশেষ সময়ের বা যুগের সঙ্গে আরেক সময়কে বা যুগকে মেলানো যায় না। তাদের উপাদানগত তফাত পরিলক্ষিত হয়। এই উপাদান হল অর্থনৈতিক এবং সামাজিক। এই দুই মূল উপাদানই প্রভাবিত করে মানুষের বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক, অন্যান্য ভাবনাচিন্তার জগৎকে। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে সমাজ এবং অর্থনৈতিক বিকাশের যে ইতিহাস আমরা জানি, তা রচিত হয়েছে মূলত অর্থনৈতিক উপাদানের গুণগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। এই পরিবর্তনই সামাজিক বিকাশকে প্রভাবিত করেছে, তাতে কাঠামোগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক পরিবর্তন ব্যতিরেকে সমাজের পরিকাঠামোগত পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। যদি সময়কে একটা তন্ত্র হিসেবে কল্পনা করি তবে এই উপাদানগুলো তার উপকরণ, একটার সঙ্গে আরেকটার সম্পর্ক এতটাই নিবিড় যে একটার ইতরবিশেষ রদবদল অন্য আরেকটাকে পালটাতে বাধ্য করে। সেই কারণেই প্রতিটি সময়কাল বা যুগ স্বতন্ত্র।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম উনিশ শতকে। তাঁর উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছিল ওই সময়কালেই। ঈশ্বরচন্দ্রের কর্মধারাকে যুক্তিবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং বাস্তববাদিতার নিরিখে মূল্যায়ন করতে হলে সমকালীন সামাজিক বিকাশের ধারার সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। তা না হয়ে একুশ শতকের প্রেক্ষাপটে তাঁর কর্মবৈচিত্র্যকে বুঝতে গেলে ভুল হবে। বস্তুবাদী সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, কোনও নির্দিষ্ট সময়কালে কোনও ব্যক্তিবিশেষের আবির্ভাব নেহাতই কাকতালীয়। কিন্তু সমাজবিকাশের ধারা তাঁর উন্মেষ ও বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তিবিশেষ কোনও কোনও ক্ষেত্রে নতুন কিছু পরিমার্জন বা পরিবর্ধন ঘটাতে পারেন, তাতে বিকাশের ধারার সাধারণভাবে খুব পরিবর্তন ঘটে না। ‘ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা’ আলোচনা প্রসঙ্গে মার্কসীয় তাত্ত্বিক প্লেখানভ বলছেন, ‘তাঁরা নিজেরাই হলেন এই ধারার মূর্ত প্রকাশ; এই ধারাটি না থাকলে ওঁরা নিজেরাই সম্ভাবনা থেকে বাস্তবের আঙিনায় উপনীত হতে পারতেন না।’ অর্থাৎ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে ব্যক্তিবিশেষ হোক বা সময়কালই হোক, তার ব্যাখ্যায় বা বিশ্লেষণে বিস্ময়করভাবে এক প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তা হল সমাজ এবং কালের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা বা ভাবা। এই প্রবণতা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিমূলক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম, চিন্তাজগতের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছিল যে-সময়কালে, সে-সময় সামাজিক ভাবনাচিন্তার জগৎকে ঘিরে রেখেছিল ধর্মীয় অন্ধত্ব, গোঁড়ামি ও কুসংস্কার। বহু বহু দিন ধরে বাঙালির চিন্তার জগতে তা লালিত হয়েছিল। ব্রিটিশরা আসার কারণে সেই চিন্তার জগতে ইউরোপীয় সংস্কৃতির নতুন উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের তাগিদেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন ভাবধারা প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন। সামাজিক কাঠামোগত উপাদান এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে এই দুই সংস্কৃতির ভিন্নতা ছিল এবং তা থাকাই স্বাভাবিক।

এরকম এক যুগসন্ধিক্ষণে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিদের আবির্ভাব। তাঁদের মতো চিন্তাশীল ব্যক্তিরা ইউরোপের আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের গতিবিধির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাঙালি সমাজের রদবদল ঘটাতে চেয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য ভাবধারার যে-সংঘাত তার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সংঘাতের অনিবার্যতা জেনেই সে কাজ তাঁরা করতে চেয়েছিলেন, সেই শিক্ষা তাঁরা পেয়েছিলেন ইউরোপের নবজাগরণের ইতিহাস থেকে। অনেকাংশে সফলও হয়েছিলেন। এতে যে বাঙালি সমাজের ভাবনার জগৎ নতুনভাবে আলোকিত হবে, সে-বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন। ‘তিনি (বিদ্যাসাগর) পাশ্চাত্ত্য ও প্রাচ্য বিদ্যার মধ্যে সম্মিলনের সেতুস্বরূপ হয়েছিলেন…। তিনি যা-কিছু পাশ্চাত্ত্য তাকে অশুচি বলে অপমান করেননি। তিনি জানতেন, বিদ্যার মধ্যে পূর্ব্ব-পশ্চিমের দিগ্‌বিরোধ নেই। তিনি নিজে সংস্কৃতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন অথচ তিনিই বর্ত্তমান য়ুরোপীয় বিদ্যার অভিমুখে ছাত্রদের অগ্রসর করবার প্রধান উদ্যোগী হয়েছিলেন…। এই উদ্যোগের প্রেক্ষাপট ও যথার্থতা উপলব্ধি করতে হলে সেই সময়কার বাঙালি সমাজের অবস্থান এবং তার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা থাকার প্রয়োজন।

বাঙালি সমাজের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় মধ্যযুগীয় প্রভাব

ইউরোপের নবজাগরণের ঢেউ ভৌগোলিক সীমানায় আটকে ছিল না। বিজ্ঞানে ও দর্শনে উন্মোচিত নতুন ভাবনাগুলোর প্রভাব অন্যান্য দেশের চিন্তাশীল মানুষদের আলোড়িত করেছিল। বাঙালি সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিরাও যে তাতে আকৃষ্ট হবেন সেটাই স্বাভাবিক। ইউরোপের সমাজের মতো বাঙালি সমাজও সুদীর্ঘ সময় ধর্মীয় অনুশাসনের জালে আবদ্ধ ছিল। ধর্মীয় অন্ধত্ব, নানা কুপ্রথা সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। ‘দেশের সর্বত্র কুসংস্কারের রাজত্ব চলিতেছিল। নৈতিক ব্যভিচার করিয়াও কোন শাস্তিভোগ করিতে হইত না, পরন্তু তাহারা সমাজে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিত।… কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের মধ্যেই প্রায় দু’হাজার শাখা-উপশাখা আছে, তাহারা কেহ কাহারও সঙ্গে খায় না, পরস্পরের মধ্যে ছেলেমেয়েদের বিবাহও দেয় না। বাংলার ব্রাহ্মণেতর জাতিসমূহের মধ্যে নানা সামাজিক উচ্চনীচ স্তরভেদ আছে; উহাদের মধ্যে কেহ জল-আচরণীয় অথবা উচ্চবর্ণের জল যোগাইবার অধিকারে অধিকারী। হিন্দুর মনে পাশ্চাত্য বীজ বপন করিয়া অন্ততপক্ষে দুই পুরুষ অপেক্ষা করিতে হইয়াছিল এবং তাহার পরে মৌলিক বিজ্ঞান চর্চার যুগ আসিয়াছিল। ক্ষেত্র বহুদিন পতিত থাকিয়া উচ্চচিন্তার জন্ম দিবার অযোগ্য হইয়া উঠিয়াছিল এবং সেই জন্য প্রথমে নূতন ফসলের আবাদ করিবার পূর্বে তাহাতে ভাল করিয়া “সার” দিতে হইয়াছিল।’

তেরো-চোদ্দো শতকে ইউরোপের সমাজ যে ক্ষয়িষ্ণু দশায় পৌঁছেছিল, বাঙালির জনজীবন তার তুলনায় কম বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল ভাবলে ভুল হবে। ফলে সামাজিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে বিচার করলে প্রাক্‌-নবজাগরণ পর্বের ইউরোপীয় সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে আঠারো বা তার আগের কয়েক শতকের বাঙালি সমাজের অবস্থানগত বিশেষ তফাত ছিল না। তাই ইউরোপের নবজাগরণের পরবর্তী পর্যায়ের শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবে প্রভাবিত ইউরোপের আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন বাঙালি সংস্কারবাদীদের উৎসাহিত করেছিল। তাঁরা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মধ্যে দিয়েই ইউরোপের নবজাগরণের গতিপ্রকৃতি ও অন্যান্য দিকগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুধাবন করেছিলেন। এমন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর সংস্কার কাজে সক্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়। এটা ঠিক যে, সেই চিন্তাভাবনার প্রয়োগক্ষেত্র হিসেবে ভারতীয় সমাজ ইউরোপের তুলনায় কম উর্বর ছিল। কারণ আমাদের দেশ ছিল পরাধীন, ফলে ইউরোপের সমাজের সঙ্গে তখনকার ভারতীয় সমাজের এটা হল একটা গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক উপাদানগত ফারাক।

ভারতে বিজ্ঞান চর্চার বহু প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্রর ক্ষেত্রে যে-চর্চার কথা জানা যায়, তা নিঃসন্দেহে সমকালের প্রেক্ষাপটে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। বৈদিক যুগের শুরুতে প্রকৃতি সম্পর্কে কৌতূহল, প্রকৃতিকে জানার বা বোঝার ইচ্ছা থেকেই বিজ্ঞান চর্চার শুরু হয়েছিল। পরে সেই বিজ্ঞান চর্চা এক অন্য মাত্রা পেয়েছিল। কিন্তু বৈদিক যুগের শেষের দিকে বিজ্ঞান চর্চার ধারায় ভাটা পড়ে। বৈদিক যুগের শুরুতে যে চিকিৎসাশাস্ত্র বিশেষ মর্যাদার জায়গায় ছিল, ধীরে ধীরে তাও মর্যাদাশূন্য হয়ে পড়ে এবং সে কাজকে নিচু মানের কাজ বলে ভাবা শুরু হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা মৃতপ্রায় অবস্থায় পৌঁছয়। ফলে যাগ-যজ্ঞ, পূজা-অর্চনা বিশেষ গুরুত্ব পায়। স্বাভাবিকভাবেই ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় সমাজশ্রেষ্ঠ বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে, জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রকট হয়। এর পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ আটশো থেকে এক হাজার বছর বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চার কোনও প্রমাণ মেলে না। চার শতক কি পাঁচ শতক থেকে আবার গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। এই চর্চা চলেছিল তেরো শতকের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত। ওই সময়কালে ভারতীয় গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদরা বিজ্ঞান চর্চায় যে দক্ষতা এবং নিপুণতার পরিচয় দিয়েছিলেন, আজও পৃথিবীর বিজ্ঞানের ইতিহাসে সুবিদিত। এই সময়েই আমাদের দেশের গণিতবিদরা আবিষ্কার করেন দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন (ইংরেজিতে বলা হয় Decimal place value notation) এবং শূন্যের ব্যবহার। পদ্মনাভ, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্কর, মুঞ্জাল, শ্রীধর— এঁরা সেই সময়কার গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ। কিন্তু সেই সময় এই আবিষ্কারগুলো যথেষ্ট মর্যাদা পেলেও পরে নথিপত্র সব নষ্ট করে দেওয়া হয়। একশো থেকে পাঁচশো শতকের মধ্যে লেখা হয়েছিল সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ। সেই সময়কার পাণ্ডুলিপিতে দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতনের ব্যবহার লক্ষ করা গিয়েছিল। ফলে প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান চর্চা যে সমৃদ্ধ ছিল, তা বোঝাই যায়।

নয় শতকের দ্বিতীয় ভাগে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা আবার গতি হারাতে শুরু করে। আট শতকের কাছাকাছি সময়ে হিন্দু ধর্মে নতুনভাবে সংযোজিত হয় শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ। এ মত অদ্বৈত-বেদান্ত বা শঙ্কর মত বা মায়াবাদ নামেও পরিচিত। উপনিষদ বা বেদান্তের ভাবনার অবলম্বী এই দর্শনকে বলা হয় বেদান্ত বা উত্তর-মীমাংসা। এদের নানা শাখা-উপশাখার মধ্যে মায়াবাদ সুপরিচিত। তখন দেখা দিয়েছিল এক নতুন চরিত্রের ধর্মসংকট। বৈষ্ণব ধারার দ্বৈতবাদের সঙ্গে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদের বিরোধ। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার গতিহীনতা আরওই বাড়তে থাকে। তেরো কি চোদ্দো শতকের পরে ভারতের বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিশেষ কোনও ভাবনাচিন্তার কথা জানা যায় না। ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়েছিল ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক অন্ধকারময় যুগ।

… ১৯০২ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় A History of Hindu Chemistry-তে হুবহু এই কথাই বলেছেন যে, আমাদের দেশে বিজ্ঞানের অভাব নয়, বৈজ্ঞানিক প্রতিভার অভাব নয়, এমন একটা সমাজ গড়ে উঠল যে সমাজে হাতের কাজ অত্যন্ত নিন্দিত হয়ে দাঁড়াল। সে সময়ে যারা কায়িক শ্রমের অধিকারী তারা নিম্নবর্ণের মানুষ বলে বিবেচিত হল। এবং তা যখন হয় তখন বিজ্ঞান, তার প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে। কেননা এই হাতের কাজ, এই কায়িক শ্রম, এর সঙ্গে প্রকৃতির জ্ঞান সবচেয়ে ভালো করে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে যে বর্ণাশ্রম সমাজ গড়ে উঠল সেখানে এই কায়িক শ্রম, এই হাতের কাজ, যে কাজের প্রশংসায় সুশ্রুত উচ্ছ্বসিত, সেটা বড়ো নিন্দিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে লাগল। উনি বলেছেন এ জাতীয় সমাজে একটা দেকার্ত বা একটা বয়েল বা এ ধরনের কোনও বিজ্ঞানীকে আশা করা যায় না। আমার আরো অবাক লাগে জেনে ফুটনোটে একটা দীর্ঘ ফুটনোট দিয়েছেন প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং সেখানেও দাসপ্রথা-ক্রীতদাস প্রথা যত পোক্ত হতে লাগল ততই বারোটা বাজতে লাগল বিজ্ঞানের। সেই কথাটা আজকের দিনে প্রমাণ করবার জন্যে বেঞ্জামিন ফ্যারিংটন-এর মতো বিদ্বান Greek Science বলে বই লিখেছেন। একই কথা। কিন্তু ১৯০২ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় এই কথাটা ধরেছিলেন এবং সেখানে তিনি সুশ্রুতের কথা উল্লেখ করেছেন। বলছেন যে দেশে সুশ্রুতের মতো বিজ্ঞানী জন্মেছিল, যে বলেছিল নিজের হাতে মড়া না কাটলে তুমি শল্যবিদ্যা শিখতে পারবে না, সে দেশে বর্ণাশ্রম ধর্ম আমাদের কী সর্বনাশ করে দিয়ে গেল। সে দেশ থেকে বিজ্ঞান ক্রমশ মুছে যেতে লাগল। সঙ্গে উনি আরও একটা কথা বলেছিলেন, সেটা অনেকের কাছেই খুব অপ্রীতিকর হয়েছিল। উনি বলেছিলেন দ্বিতীয় কারণ হল, যে দেশে এই মায়াবাদ বলে দর্শনটির এমন প্রবল প্রতাপ— যে দর্শন অনুসারে বিশ্ব প্রকৃতিটাই মায়া, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা ইত্যাদি, সে দেশে বিজ্ঞানের বারোটা বেজে যায়। কেননা বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যই হল এই প্রকৃতির রহস্য সন্ধান করা।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চার ইতিহাস এবং সভ্যতা ও সমাজবিকাশের ইতিহাসের মধ্যে সম্পর্ক সুগভীর। প্রকৃতিকে ব্যবহার করে যেমন সভ্যতা এগিয়েছে, তেমনই প্রকৃতির কাজকর্মকে জানতে এবং বুঝতে গিয়ে বিজ্ঞান চর্চার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। প্রকৃতি এবং সমাজ-সভ্যতার মধ্যে সেতু তৈরি করেছে প্রযুক্তি। তাই পৃথিবীর ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে যখনই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা বাধা পেয়েছে কিংবা তার গতি শ্লথ হয়েছে, সভ্যতা থমকে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপে খ্রিস্টান ধর্মের বাড়বাড়ন্ত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ করার কারণে ইউরোপের সমাজবিকাশ থমকে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের দেশের সামাজিক বিবর্তনের ধারায় তার নানা সময় পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। কখনও তা মায়াবাদের কারণে, কখনও-বা ব্রাহ্মণ্যবাদের বাড়বাড়ন্তে।

বাঙালি সমাজে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের ভাবনা ও বিদ্যাসাগর

যখন ইউরোপে নবজাগরণের ঢেউ আছড়ে পড়েছে, তার পরেও বহুকাল আমাদের দেশ ছিল নিস্তরঙ্গ। ব্রিটিশরা এদেশে আসার পরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে কিছু কিছু রদবদল ঘটেছিল। আঠারো শতকের প্রায় শেষ দিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল বিজ্ঞানের নানা শাখার, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলোর বাস্তব প্রয়োজনও ছিল। ১৭৮৪ সালে জন্ম হয় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-র। প্রথমদিকে এই সংস্থা বিজ্ঞান চর্চায় সেভাবে যুক্ত না হলেও পরে তা হয়ে উঠেছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম কেন্দ্র। ১৭৮৬ সালে হাওড়ার শিবপুরে ‘বোটানিক্যাল গার্ডেন’ তৈরি করা হয়। নানা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হলেও উদ্ভিদবিজ্ঞানের গবেষণায় এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আঠারো শতকের স্কটল্যান্ডের উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড. উইলিয়াম রক্সবার্গ (Dr. William Roxburgh, 1751-1815) আমাদের দেশের গাছপালার প্রথম শ্রেণিবিন্যাস করেন। এক সময় কয়লা ও লোহার অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের। ১৮০৮ সালে ‘ফিজিক্যাল কমিটি’ নামে একটি কমিটি মূলত ভূ-তত্ত্ব গবেষণার কাজ শুরু করে। ব্রিটেনেও রেলপথ, ‘ক্যানাল’ তৈরির প্রয়োজনে একইভাবে ভূবিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়েছিল। কিন্তু পথঘাট তৈরির কাজে জরিপ ও অবস্থানগত নানা তথ্যের প্রয়োজন। সে কথা মাথায় রেখে ১৭৯৯ সালে উইলিয়াম লাম্বটন (William Lambton, 1753–1823) ‘ম্যাথেম্যাটিক্যাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল সার্ভে’-র প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ১৮০০ সালে তার অনুমোদন পেলেও ১৮০২ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে কাজ শুরু হয়েছিল। পরে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’। ব্রিটিশদের উদ্যোগেই ১৮১৭ সালে তৈরি হয়েছিল ‘স্কুল বুক সোসাইটি’। এই সোসাইটি থেকে বিদ্যালয়ে পাঠযোগ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই প্রকাশ করা হত। তখনও ভারতের সঠিক, সম্পূর্ণ মানচিত্র ছিল না। ১৮২০ সালে ‘অ্যাটলাস অব ইন্ডিয়া’ নামে এক প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল মানচিত্র তৈরির তাগিদে। আবার ১৮২০ সালে উইলিয়াম কেরি (William Carey, 1761–1834) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘কৃষি সোসাইটি’ (Agri Horticultural Society of India)। এর উদ্দেশ্য ছিল চাষবাসের যন্ত্রপাতি, বীজ, গাছপালার নানা ব্যাবহারিক দিক নিয়ে মানুষকে সচেতন করা। এই প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলো ব্রিটিশদের উদ্যোগেই তৈরি হয়েছিল। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রাত্যহিক জনজীবনের সমস্যাগুলো মেটানোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নই সংস্থাগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, ব্রিটিশ শাসকদের এই কাজগুলোর মাধ্যমে রথ দেখা ও কলা বেচা দুটো উদ্দেশ্যই সফল হয়েছিল। এক দিকে নিজেদের শাসনকাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তুলেছিল, অন্যদিকে এর ফলে এদেশের সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্নে আপাতভাবে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা হিসেবে তা মান্যতা পেয়েছিল। ১৮২৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল মেডিক্যাল ও ফিজিক্যাল সোসাইটি। নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, খোঁজখবর নেওয়া এবং চিকিৎসার কাজে সমন্বয় গড়ে তোলাই ছিল এই সংস্থার উদ্দেশ্য। ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ’।

‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’-তে চাকরি পেয়েছিলেন রাধানাথ শিকদার (১৮১৩-১৮৭০)। পরে এই সংস্থার একজন যোগ্য প্রতিভাবান ব্যক্তি হিসেবে তিনি দেশে-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। এভারেস্টের মতো পর্বতচূড়ার উচ্চতা মাপার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের কথা সুবিদিত। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ’-এ চিকিৎসাশাস্ত্রের পড়াশুনোর প্রয়োজনে একদা সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগের ছাত্র পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত (১৮০০-১৮৫৬) প্রথম মানুষের দেহ ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন। তিনি ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ’-এর ব্যাবহারিক পাঠের প্রদর্শক ছিলেন। ব্রিটিশ শাসকেরা যে প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান চর্চা শুরু করেছিলেন, তার প্রভাবে উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে বাঙালি সমাজের কিছু কিছু বাঙালি পরিবারে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে কৌতূহল দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে রাজা রামমোহন রায়ের কথা চলেই আসে। রামমোহন রায় ১৮১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘আত্মীয় সভা’। মূলত ধর্ম নিয়ে আলোচনাই ছিল এই সভার উদ্দেশ্য। পরে এই ‘আত্মীয় সভা’ এবং ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ হয়ে উঠেছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র।

হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি ও অন্ধত্বের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন রাজা রামমোহন। সেই উপলব্ধি থেকেই ধর্ম-সংস্কারের পথে হেঁটেছিলেন। পরিণতিতে ১৮৪৭ সালে হিন্দু ধর্মের নতুন ধারার জন্ম দিলেন, ব্রাহ্ম ধর্ম নামে যার পরিচিতি। হয়তো এই কারণে অনেকে তাঁকে ধর্ম-সংস্কারক হিসেবেই ভেবেছেন। কিন্তু এ ধারণা সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। নিঃসন্দেহে সংস্কারের একটা দিক হিসেবে মাত্র একে উল্লেখ করা যেতে পারে। ব্রাহ্মণ্যবাদের গোঁড়ামি ও অন্ধত্বের বিরুদ্ধতার ফসল হল ব্রাহ্ম ধর্মের জন্ম। ১৮১৫ সালে তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় বেদান্ত প্রকাশ করেন। তখন থেকে বেদান্ত নিয়ে বিতর্কের শুরু হয়। উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে বিজ্ঞান চর্চা এবং যুক্তিবাদী ভাবনার বিকাশ ঘটানোর ভিত্তি যে তিনিই রচনা করেছিলেন, তা অনস্বীকার্য। বাঙালিদের মধ্যে রামমোহন প্রথম ভূগোল বই লিখেছিলেন ইংরেজি ও বাংলায়। জ্যোতির্বিদ্যার বই হিসেবে ভূগোল ও জ্যামিতি লিখেছিলেন। এদেশে আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার জন্যে ১৮২৩ সালে লর্ড আমহার্স্টকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘ব্রিটিশ আইনসভা দেশকে যদি অন্ধকারে রাখতে চায়, তা হলে সংস্কৃত শিক্ষাপদ্ধতি হল সবথেকে ভাল। কিন্তু এদেশীয় মানুষদের উন্নতিই যদি সরকারের লক্ষ্য হয়, তবে আরও উদার এবং গোঁড়ামিমুক্ত কোনও শিক্ষামাধ্যমের প্রসার ঘটাবেন। এতে গণিত, প্রকৃতিবিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন। ইউরোপের শিক্ষিত, প্রতিভাবান মানুষদের দরকারমতো নিযুক্ত করে প্রয়োজনীয় বইপত্তর, বিজ্ঞানশিক্ষার যন্ত্রপাতিসহ কলেজ গড়ে তোলার দরকার।’

এই প্রসঙ্গে আর এক ব্যক্তির কথা স্বভাবতই চলে আসে, তিনি বিদ্যাসাগরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু অক্ষয়কুমার দত্ত। ছাত্রজীবন থেকে যিনি বিজ্ঞান চর্চায় প্রভূত উৎসাহী ছিলেন। উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারের কোনও আলোচনা অক্ষয়কুমার দত্তকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। তিনি অবশ্য কখনও রামমোহন রায়ের মতো সামনের সারিতে থেকে সরাসরি যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানভাবনা প্রসারের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি। তাঁর জগৎ ছিল একটু ভিন্ন প্রকৃতির। মূলত পত্র-পত্রিকা ও বই প্রকাশনার মধ্যে দিয়েই বিজ্ঞানের আলোকে সমাজ সচেতনতা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি কখনওই বেদকে অভ্রান্ত বলে মেনে নেননি। তাঁর মতে, ঈশ্বরের প্রত্যাদিষ্ট বেদ হতে পারে না। বেদ কোনও ধর্মের ভিত রচনা করতে পারে বলে তিনি বিশ্বাসও করতেন না। ১৮৪২ সালে প্রসন্নকুমার ঘোষকে নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন বিদ্যাদর্শন পত্রিকা। বেশিদিন এই পত্রিকাটি চালিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু যতদিন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে প্রধানত অক্ষয়কুমারই লিখতেন। বেশিরভাগ লেখার উদ্দেশ্যই ছিল সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় অন্ধত্বের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান চেতনার প্রসার ঘটানো। পরবর্তীকালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মধ্যে দিয়ে বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানের নতুন জায়গা তৈরি করেছিলেন। একসময় দেবেন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তাকেও তিনি অনেকটাই প্রভাবিত করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তের জন্ম একই বছরে, তাঁরা শুধুমাত্র সমবয়সি নন, সমমনোভাবাপন্ন ও অন্তরঙ্গ ছিলেন। বলা যেতে পারে অক্ষয়কুমার ঈশ্বরচন্দ্রের সংস্কারচিন্তার অনুগামী ও সহযোগী হিসেবে থেকেছেন।

উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই সংস্কার আন্দোলন খুব সংগঠিতভাবে না হলেও শুরু হয়। উনিশ শতকে সংস্কারবাদী আন্দোলনের দুটো ধারা সুস্পষ্ট, ধর্মীয় সংস্কার ও সমাজ সংস্কার। যদিও ইউরোপের মতো এই দুটো ধারা স্বতন্ত্র ছিল না, তাদের মধ্যে সমন্বয়ও ছিল। ইউরোপে নবজাগরণের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁদের সঙ্গে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক ছিল না। লুথার, ক্যালভাঁ ছিলেন ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পথপ্রদর্শক। তাঁদের কিন্তু নবজাগরণের পক্ষে না থেকে উপায় ছিল না। এদেশে বিশেষত বাঙালি সমাজে সংস্কারকদের ধর্মসংস্কারক ও সমাজসংস্কারক হিসেবে আলাদা করা সম্ভব ছিল না। তবে ঈশ্বরচন্দ্রের সংস্কারচিন্তা বিশ্লেষণ করলে সুস্পষ্ট হয় যে তিনি সমাজের নানা দিককে নিয়ে ভেবেছেন এবং ধর্মকে বাদ দিয়েই। তাঁর বহুমাত্রিক কর্মধারার মধ্যে যে দু’টি দিক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হল যুক্তিবোধ এবং বিজ্ঞানমনস্কতা। আগে থেকে এর যে-ভিত রচনা করে গিয়েছিলেন রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত তার ওপরেই যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানচেতনা প্রসারের ইমারত গড়েছিলেন বিদ্যাসাগর। নিজের জীবনাচরণেও তার কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি।

চিকিৎসাশাস্ত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। ডাক্তারি শেখার জন্যে মানুষের কঙ্কাল কিনেছিলেন। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শেখার জন্যে বই-পত্তর, সঙ্গে হোমিওপ্যাথিক ওষুধও কিনেছিলেন অনেক। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে রীতিমতো পড়াশুনো করতেন। মহেন্দ্রলাল সরকারকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় উৎসাহিত করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রই। চিকিৎসার বিষয়ে কতটা আন্তরিক ছিলেন, তা বোঝা যায় রাজনারায়ণ বসুকে লেখা এক চিঠিতে: ‘আমি কল্য অথবা পরশ্ব আপনাকে দেখিতে যাইব স্থির করিয়াছিলাম, কিন্তু এরূপ দুইটি রোগীর চিকিৎসা করিতেছি যে, তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া যাওয়া কোন মতে উচিত নহে।’ ঈশ্বরচন্দ্রের চিকিৎসার অনেক কাহিনিই রয়েছে। তাঁর চিকিৎসা করার ঘটনাবলির তুলনায় উল্লেখযোগ্য দিক হল বিজ্ঞানের প্রণালীবদ্ধ শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে তিনি যে কতটা অবহিত ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে নরকঙ্কাল নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের অনুশীলন পদ্ধতি থেকে। তখন নরকঙ্কাল নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের অনুশীলন ছিল কল্পনার অতীত। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৮৩৬ সালের ১০ জানুয়ারি পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত শব ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন এবং সেই কাজ যে কত দুঃসাহসিক ছিল, তা বোঝাতে গিয়ে দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন: ‘… যাঁরা আমাদের দেশে আইনগ্রন্থ রচনা করেছেন, যে আইনগ্রন্থের নাম ধর্মশাস্ত্র— আপস্তম্ভ থেকে মনু পর্যন্ত সকলেই একবাক্যে এই আইন ঘোষণা করেছেন মড়া কাটা তো দূরের কথা, মড়া ছুঁলে আপনি অপবিত্র হয়ে যাবেন। সংস্কার করতে হবে। যে গ্রামের মধ্যে দিয়ে মড়া যাবে সে গ্রামকে সংস্কার করতে হবে। যাঁরা মড়া বইবেন তাঁদের সবাইকে সংস্কার করতে হবে। এতই অপবিত্র কাজ। ও শুধু চণ্ডাল ফণ্ডাল ধরনের ঘৃণিত নীচ মানুষের কাজ। কিন্তু উচ্চবর্ণের মানুষের পক্ষে এটা অকল্পনীয়। ধর্মশাস্ত্রকারদের এই নির্দেশ দু’হাজার বছরের ওপর আমাদের দেশকে শাসন করে এসেছে।’

ওষুধ নিয়েও বিদ্যাসাগর পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন। নিজে হাঁপানি রোগে প্রায়ই কষ্ট পেতেন। একদিন চা খাওয়ার পরে কষ্ট কিছুটা কমেছিল। কিন্তু চায়ের স্বাদ ও গন্ধ স্বাভাবিক ছিল না। সন্দেহ হওয়াতে ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিলেন, তাতে আরশোলা পড়েছিল। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তৈরি করেছিলেন, উপায়ও পরে জানিয়েছিলেন। পদ্ধতিটা ছিল এরকম: বেশ কয়েকটা আরশোলাকে জলে সিদ্ধ করে, পরে তাতে ‘অ্যালকোহল’ মিশিয়ে, ছেঁকে ওষুধ তৈরি হল। ওষুধ তৈরির উপায় না বলে অনেকের ওপর ব্যবহার করে হাঁপানি কমাতে পেরেছিলেন। নিজের ওপর পরীক্ষা করেও ভাল ফল পেয়েছিলেন।

আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়েও তাঁর কম আগ্রহ ছিল না। ১৭৭২ শকের মাঘ মাসের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তিনি ‘শূল রোগের ঔষধ’ শিরোনামের বিজ্ঞাপনে নানারকম ভেষজ উপাদান ব্যবহার করে এক ওষুধের উল্লেখ করেছিলেন। এর সঙ্গে ওষুধ খাওয়ার নিয়ম ও পথ্যাপথ্যের বিবরণ দিয়ে নীচে নিজে স্বাক্ষর করেছিলেন।

এ কথাগুলো শুধুই তাঁর চিকিৎসাবিজ্ঞানে আগ্রহ বোঝানোর জন্যে বলা নয়। সেই সময় ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র, অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হত। তিনি সেই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গরিব মানুষদের নিজে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতেন।

ঈশ্বরচন্দ্র মনে করতেন যে মানুষকে যদি প্রকৃত শিক্ষিত করে তোলা যায়, তবেই কুসংস্কারের থেকে মুক্তি সম্ভব। সে-কারণে তিনি সেসময়কার শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে পালটাতে চেয়েছিলেন। শিক্ষার বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে শিক্ষাপদ্ধতি, সব বিষয়েই ভেবেছিলেন। তখন হাতে-লেখা পাণ্ডুলিপির সাহায্যেই পড়াশুনোর প্রচলন ছিল। তিনি সেসব নকল করিয়ে সংগ্রহ করেছিলেন নিজের পাঠাগারের জন্যে। কিন্তু উপলব্ধি করেছিলেন, এই উপায়ে লেখাপড়া করা এবং করানো— দুটোই ভীষণ কঠিন কাজ। এই কারণে বইয়ের সংখ্যা তখন নিতান্তই কম ছিল। বই সহজলভ্য না হলে শিক্ষার প্রসার ঘটানো সম্ভব নয়। তাই হাতে-লেখা পাণ্ডুলিপির পরিবর্তে মুদ্রিত বইয়ের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তার কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে নিজেই ছাপাখানা খুলেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘যৎকাল আমি ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার সংস্কৃত কলেজে নিযুক্ত ছিলাম; তর্কালঙ্কারের উদ্যোগে, সংস্কৃত যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা সংস্থাপিত হয়। ঐ ছাপাখানায়, তিনি ও আমি, উভয়ে সমাংশভাগী ছিলাম।’১০ ওই ছাপাখানায় ছাপা বইগুলো বিক্রির জন্যে পরে সংস্কৃত প্রেস ও ডিপজিটারি নামে বইয়ের দোকানও খুলেছিলেন। এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে শিক্ষার মাধ্যমকে উন্নত করার জন্যে আধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহারের অন্যতম সাক্ষ্য বহন করে। প্রথম এই প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল। পরে ঈশ্বরচন্দ্র এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কার নিজেরাই বই লিখতে শুরু করেন। বইগুলো ছিল মূলত শিক্ষা প্রসারের জন্যে এবং সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। বিদ্যাসাগরের এই কাজকে ইউরোপের ধনতান্ত্রিক নবজাগরণ যুগের উদ্যোগী প্রিন্টার-প্রকাশকদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।১১

শুধুমাত্র আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারই নয়, আধুনিক বিজ্ঞানের প্রসারের জন্যেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। ১৮৪৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল জীবনচরিত। এই জীবনচরিত গ্রন্থে তিনি কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, হার্শেল, গ্রোশ্যস, লিনিয়াস, ডুবাল, জেকিন্স ও জোন্স-এর জীবনী অনুবাদ করেছিলেন। যেসব বিজ্ঞান-সাধকের জীবনী তিনি অনুবাদ করেছিলেন, তা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইউরোপের আধুনিক বিজ্ঞানের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে যথেষ্টভাবে অবহিত ছিলেন। এই বইয়ে ‘প্রথম বারের বিজ্ঞাপন’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘রবর্ট ও উইলিয়ম চেম্বর্স, বহুসংখ্যক সুপ্রসিদ্ধ মহানুভবদিগের বৃত্তান্ত সঙ্কলন করিয়া, ইঙ্গরেজী ভাষায় যে জীবনচরিতপুস্তক প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা বাঙ্গালা ভাষায় অনুবাদিত হইলে, এতদ্দেশীয় বিদ্যার্থিগণের পক্ষে বিশিষ্টরূপ উপকার দর্শিতে পারে, এই আশয়ে আমি ঐ পুস্তকের অনুবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম।’১২ ওই সময়ে ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা খুবই কঠিন কাজ ছিল, বিশেষ করে বিজ্ঞানের বিষয়। কারণ তখন বিজ্ঞানের শব্দগুলোর বাংলা পরিভাষা ছিল না। ফলে নতুন করে বৈজ্ঞানিক পরিভাষার কাজও তাঁকে করতে হয়েছিল, বইয়ের শেষে তিনি সেগুলোর উল্লেখ করেছিলেন। ‘ইয়ুরোপীয় পদার্থবিদ্যা ও অন্যান্য বিদ্যা সংক্রান্ত অনেক কথার বাঙ্গালা ভাষায় অসঙ্গতি আছে; ঐ অসঙ্গতি পূরণার্থে কোনও কোনও স্থলে দুরূহ সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ ও স্থলবিশেষে তত্তৎ কথার অর্থ ও তাৎপর্য পর্য্যালোচনা করিয়া তৎপ্রতিরূপ নূতন শব্দ সঙ্কলন করিতে হইয়াছে।’১৩ যেখানে প্রতিশব্দ পাননি, সেখানে অর্থ ও তাৎপর্য বুঝে নতুন শব্দ চয়ন করেছেন। বিষয়কে না বুঝে এ কাজ করা সম্ভব নয়। ফলে জীবনচরিত লেখার সময় তাঁকে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো সম্পর্কে যে চর্চা করতে হয়েছে, তা বোঝাই যায়। যাঁরা অনুবাদক তাঁরা জানেন, বিষয়বস্তুর গভীরে না পৌঁছালে অনুবাদ করা এবং যথাযথ শব্দ চয়ন করা যায় না। বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ না থাকলে এই কাজ তিনি করতে পারতেন না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, সেই সময় স্কুল বুক সোসাইটি-র উদ্যোগে বিজ্ঞানের বাংলা পরিভাষা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো যথেষ্ট জড়তাযুক্ত এবং বেশিরভাগই ছিল দুষ্পাঠ্য। সেসব শব্দ ব্যবহার না করে ঈশ্বরচন্দ্র নিজে পরিভাষা তৈরি করেছিলেন। একই সময়ে বিজ্ঞানের বাংলা পরিভাষা সৃষ্টিতে অক্ষয়কুমার দত্তের অসামান্য অবদানের কথা বলতেই হবে। তাঁদের সৃষ্ট পরিভাষার বেশ কিছু পরে ব্যবহার করা না হলেও অনেক শব্দ আজও বাংলায় বিজ্ঞান নিয়ে লেখায় প্রয়োজন হয়।

ঈশ্বরচন্দ্র সমসাময়িক বিজ্ঞান শেখানো নিয়ে কতটা উৎসুক ছিলেন, তা বোঝা যায় আরেকটা ঘটনায়। ১৮৫৫ সালের কথা। ঈশ্বরচন্দ্রকে দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যালয়গুলোর জন্যে সহকারী ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনও গ্রামের একটি স্কুলে গিয়েছেন তিনি। উঁচু শ্রেণির ছাত্রদের পৃথিবীর গতি নিয়ে প্রশ্ন করলেন। প্রশ্ন ছিল দুটো— পৃথিবীর কত রকমের গতি আছে এবং কোন গতির জন্যে পৃথিবীর কত সময়ের প্রয়োজন হয়। ছাত্ররা উত্তর দিয়েছিল পৃথিবীর কোনও গতি নেই। পৃথিবী স্থির থাকে এবং সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরপাক খায়। বিদ্যাসাগর শুনে অবাক হয়েছিলেন। মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেস করাতে তিনিও ঈশ্বরচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘পৃথিবী সত্যি সত্যি ঘোরে নাকি? আমি ভাবতাম, পৃথিবী এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে।’ উত্তর শুনে ঈশ্বরচন্দ্র আরও অবাক হয়ে বলেছিলেন— ‘ না,… দু’রকম গতি আছে পৃথিবীর— আহ্নিক গতি আর বার্ষিক গতি। আহ্নিক গতির জন্য পৃথিবীতে দিনরাত্রি হয়। আপন মেরুরেখার চারিদিকে পৃথিবী চব্বিশ ঘণ্টায় একবার ঘোরে; তার নাম আহ্নিক গতি। আর বার্ষিক গতির জন্যে পৃথিবীতে দিনরাত্রি ছোট-বড় হয়, পৃথিবীতে ঋতুবদল হয়। আপন মেরুরেখার চারদিকে ঘুরতে-ঘুরতে পৃথিবী একটি নির্দিষ্ট পথে প্রায় তিনশো পঁয়ষট্টি দিনে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে; তার নাম বার্ষিক গতি। পৃথিবী সত্যি-সত্যি ঘোরে।’১৪

সেই সময় গণিত পড়ানো হত সংস্কৃত ভাষায়। ১৮৫৩ সালে প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী বাংলা ভাষায় প্রথম পাটীগণিত লিখেছিলেন। গণিতে বাংলা পরিভাষা তৈরির ক্ষেত্রে প্রসন্নকুমার পথপ্রদর্শক। কিন্তু এই পরিভাষা নিয়ে প্রসন্নকুমার লিখছেন, ‘এই সকল শব্দ সঙ্কলন বিষয়ে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অনেক সাহায্য করিয়াছেন।’ প্রসন্নকুমার বাংলায় বীজগণিতও লিখেছিলেন। বীজগণিত (প্রথম ভাগ)-এর ‘বিজ্ঞাপন’-এ তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘বাঙ্গালা ভাষায় বীজগণিত গ্রন্থের অসদ্ভাব দেখিয়া, প্রায় দশ বৎসর পূর্বে, আমার পরমাত্মীয় অশেষ গুণসম্পন্ন শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরামর্শে, আমি এই পুস্তক সঙ্কলন করিতে প্রবৃত্ত হই।’১৫ এ থেকে খুব সহজেই অনুমান করা যায় শুধু বিজ্ঞান চর্চা নয়, বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান প্রসারে বিদ্যাসাগর ছিলেন অনুপ্রেরণা।

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের সব বিষয়ের শিক্ষা প্রদানের পরিকল্পনাও করেছিলেন। ১৮৫৪ সালে ছোটলাট পদে আসীন হবার আগে ফ্রেডারিক জে. হ্যালিডে শিক্ষা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি বাংলা শিক্ষা ও বাংলাকে পঠনপাঠনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের কথা ভেবেছিলেন। হ্যালিডে-র উৎসাহেই বিদ্যাসাগর সেই পরিকল্পনা করতে পেরেছিলেন। তাঁর পরিকল্পনা থেকে কয়েকটি প্রস্তাব উল্লেখ করা যেতে পারে:

১. বাংলা শিক্ষার বিস্তার ও সুব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজনীয়। তা না হলে দেশের জনসাধারণের কল্যাণ হবে না।

২. কেবল লিখন-পঠন ও গণনা বা সরল অঙ্ক কষার মধ্যে বাংলাশিক্ষা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। যতদূর সম্ভব বাংলা ভাষাতেই সম্পূর্ণ শিক্ষা দিতে হবে, এবং তার জন্যে ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত, পাটীগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, নীতিবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও শারীরবিজ্ঞানও শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।

৩. প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে এই বইগুলি পাঠ্যপুস্তকরূপে গ্রহণযোগ্য: (ক) শিশুশিক্ষা (পাঁচ ভাগ),… (খ) পশ্বাবলী অর্থাৎ জীবজন্তুর প্রাকৃতিক বিবরণ, (গ) বাংলার ইতিহাস— মার্শম্যানের বইয়ের ভাবানুবাদ, (ঘ) চারুপাঠ, অথবা প্রয়োজনীয় বিষয় সম্বন্ধে পাঠমালা। (ঙ) জীবনচরিত— চেম্বার্স বায়োগ্রাফির অন্তর্গত কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, হার্শেল, লিনিয়াস, ডুবাল, উইলিয়াম জোন্স, টমাস জেঙ্কিন্স প্রমুখ বিজ্ঞানীদের সংক্ষিপ্ত জীবনীর ভাবানুবাদ।

৪. পাটীগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা ও নীতিবিজ্ঞানের বই লেখা হয়েছে। ভূগোল, রাজনীতি, শারীরবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং কতকগুলি ধারাবাহিক জীবনচরিত এখনও রচনা করতে হবে। বর্তমানে ভারতবর্ষ, গ্রীস, রোম ও ইংলন্ডের ইতিহাস হলেই চলবে।…১৬

এর সঙ্গে আরও বেশ কিছু প্রস্তাব ছিল। আধুনিক বিজ্ঞান বলতে শুধুমাত্র পাটীগণিত বা বীজগণিত নয়, পদার্থবিদ্যা, শারীরবিজ্ঞান, এমনকী পশ্বাবলী অর্থাৎ জীববিজ্ঞানের প্রাথমিক ধাপের শিক্ষার কথাও তিনি ভেবেছিলেন। এর সঙ্গে বিজ্ঞানীদের জীবনী এবং পাশ্চাত্য ইতিহাসের উল্লেখ তো রয়েইছে।

বিজ্ঞান শিক্ষার ভাষা নিয়ে ১৮৫৩ সালের অক্টোবর মাসের পাঁচ তারিখে ‘কাউন্সিল অব এডুকেশন’-এর ‘সেক্রেটারি’ ড. এফ. আই. মৌআট-কে লিখেছিলেন: ‘আমার বক্তব্য হল, আমাদের সংস্কৃতশিক্ষা দিতে দিন, প্রধানত বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য। তার সঙ্গে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান আয়ত্ত করার সুযোগ দিন। এই সুযোগ পেলে আমি নিশ্চিত হয়ে আপনাকে বলতে পারি যে সংসদের উৎসাহ ও সমর্থন থাকলে, আমি কয়েক বছরের মধ্যে এমন একদল শিক্ষিত যুবক তৈরি করে দিতে পারব, যারা নিজেদের রচনা ও শিক্ষার দ্বারা দেশের জনসাধারণের মধ্যে জ্ঞান-বিদ্যার প্রসারে, আপনাদের প্রাচ্য-বিদ্যার অথবা শুধু ইংরেজিবিদ্যার পণ্ডিতদের চেয়ে, অনেক বেশি সাহায্য করতে পারবে।’১৭ বাংলা ভাষাকে ঈশ্বরচন্দ্র জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখার মাধ্যম হিসেবে গণ্য করলেও ইংরেজি মাধ্যমের ওপর তাঁর গুরুত্ব দেওয়ার পিছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সব কিছুকে বাংলায় অনুবাদ করা অসম্ভব। প্রাথমিক বিজ্ঞান শিক্ষার জন্যে বাংলা প্রয়োজন কিন্তু পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশমান পর্যায়গুলোকে আয়ত্ত করতে গেলে ইংরেজি শিক্ষা ছাড়া সম্ভব নয়, এদিকটাও তিনি ভেবেছিলেন। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’-তে যন্ত্রপাতি সারানোর কাজ করতেন সৈয়দ মীর মহসিন হুসেন। যন্ত্রপাতি সারানোর কাজে ওই সংস্থায় তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতা ছিল সর্বজনবিদিত। জানা যায় তিনি নিজে একটা ‘থিওডোলাইট’ তৈরি করেছিলেন। এত কিছু সত্ত্বেও প্রাপ্য মর্যাদা পাননি, শুধুমাত্র ইংরেজি পড়তে না পারার জন্য।১৮ খুব দুঃখজনক হলেও এটাই ছিল বাস্তব পরিস্থিতি।

এই তো গেল বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের ভাবনার দিক। কিন্তু শিক্ষার বিষয়বস্তুর মধ্যে চিরাচরিত হিন্দুধর্মনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির আদলটাই পালটে তিনি আধুনিক ও বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসের ২২ তারিখে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই দায়িত্ব পাওয়ার পরে সংস্কৃত কলেজে তাঁর বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষাচিন্তাকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। ১৮৫২ সালের ১২ এপ্রিল ‘Notes on the Sanscrit College’ শিরোনামে তাঁর চিন্তাভাবনা ছাব্বিশটি অনুচ্ছেদে লিপিবদ্ধ করেন বিদ্যাসাগর, যার কিছু কিছু এখানে উদ্ধৃত হল এ বিষয়ে তাঁর মৌলিক চিন্তার দিকটি বোঝার জন্যে।

… … …

১১) বর্তমানে গণিতশাস্ত্রের পাঠ্য হল লীলাবতী ও বীজগণিত। গণিতবিজ্ঞানের পক্ষে এই দু’খানি বই যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া এমন এক পদ্ধতিতে বই দু’খানি রচিত, প্রচলিত ছড়া আর্যা ইত্যাদির সাহায্যে, আসল বিষয়বস্তু এক-একটি প্রহেলিকা হয়ে উঠেছে। সহজ বিষয় সরল করে না বলার জন্য ছাত্রদের অনেক বেশি সময় লাগে এই বিদ্যা আয়ত্ত করতে।… আসল কথা হল, সংস্কৃত-গণিত ছাত্রদের পড়ানোর কোনও সার্থকতা নেই, কারণ এতে ছাত্রদের প্রচুর সময় ও শ্রম অপব্যয় হয়। সেই সময়টুকু তারা অন্য প্রয়োজনীয় বিষয় পড়তে পারে।

১২) সেইজন্য সংস্কৃতে গণিতশিক্ষা না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।

১৩) এ থেকে এ কথা বুঝলে ভুল হবে যে আমি শিক্ষার ব্যাপারে গণিতবিদ্যার যথাযথ গুরুত্ব দিই না। তা আদৌ ঠিক নয়। আমি শুধু বলতে চাই যে সংস্কৃতের বদলে ইংরেজির মাধ্যমে গণিতবিদ্যার শিক্ষা দেওয়া উচিত, কারণ তাতে ছাত্ররা অর্ধেক সময়ে দ্বিগুণ শিখতে পারবে।

১৪) হিন্দু-দর্শনের ছয়টি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায় আছে— ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, পতঞ্জল, বেদান্ত ও মীমাংসা। ন্যায়দর্শনে প্রধানত তর্কবিদ্যা, অধ্যাত্মবিদ্যা, এবং মধ্যে মধ্যে কিঞ্চিৎ রসায়ন, আলোকবিদ্যা ও বলবিদ্যা সম্বন্ধে আলোচনা আছে। পতঞ্জল ও মীমাংসা সম্বন্ধেও প্রায় ঐ একই কথা বলা যায়। মীমাংসায় উৎসবপার্বণ এবং পতঞ্জলে ঈশ্বরচিন্তা হল বিষয়বস্তু।…

১৬) এ কথা ঠিক যে, হিন্দু-দর্শনের অনেক মতামত আধুনিক যুগের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে খাপ খায় না, কিন্তু তা হলেও প্রত্যেক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের এই দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা উচিত। ছাত্ররা যখন দর্শনশ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে, তার আগে ইংরেজি ভাষায় তারা যে জ্ঞান অর্জন করবে তাতে ইয়োরোপের আধুনিক দর্শনবিদ্যা পাঠ করারও সুবিধা হবে তাদের। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দুই দর্শনেই সম্যক জ্ঞান থাকলে, এ দেশের পণ্ডিতদের পক্ষে আমাদের দর্শনের ভ্রান্তি ও অসারতা কোথায় তা বোঝা সহজ হবে।… সুতরাং আমার ধারণা, সর্বমতের দর্শন পাঠ করবার সুযোগ দিলে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত গড়ে উঠবে। তার সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞান থাকলে, দুই দর্শনের মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্য কোথায় তাও তারা বুঝতে পারবে।

১৭) এই শিক্ষার আর-একটি সুবিধা হল এই যে, পাশ্চাত্য দর্শনের ভাবধারা আমাদের বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে হলে যে বৈজ্ঞানিক পরিভাষা (Technical word) জানা দরকার, তা পণ্ডিতদের আয়ত্তে থাকবে।…

২০) বর্তমানে সংস্কৃত কলেজের সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সাহিত্য, অলংকার, গণিত, স্মৃতি, দর্শন ও সংস্কৃত গদ্যরচনা— এই বিষয়গুলি আছে। এগুলি এইভাবে পরিবর্তন করা যেতে পারে; সাহিত্য ও অলংকার যেমন আছে তেমনি থাকবে। সংস্কৃত-গণিত ও সংস্কৃত গদ্যরচনা বাদ দিতে হবে এবং তার বদলে ইতিহাস, গণিত ও প্রাকৃতিক দর্শন ইংরেজিতে পড়াতে হবে এবং সেটাই হবে সিনিয়র বৃত্তিপরীক্ষার বিষয়।…১৯

১৮৫৩ সালের জুলাই কি অগস্ট মাস নাগাদ শিক্ষাসংসদ বারাণসীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ জে.আর. ব্যালান্টাইন (James Robert Ballantyne, 1813–1864) কলকাতায় এসেছিলেন এবং তাঁকে সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি পরিদর্শন করে এক সুদীর্ঘ রিপোর্ট শিক্ষাসংসদকে দিয়েছিলেন। শিক্ষাসংসদ সেই রিপোর্ট ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সাত তারিখে নিজে লেখা আরেকটা রিপোর্ট জমা দেন। তার কয়েকটা দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:

… সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন, সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই। তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। সংস্কৃতে যখন এইগুলি পড়তেই হবে তখন তার প্রতিষেধক হিসেবে ভাল ভাল ইংরেজি দর্শনশাস্ত্রের বই পড়ানো দরকার। বার্কলের বই পড়ালে সেই উদ্দেশ্য সাধিত হবে বলে মনে হয় না, কারণ সাংখ্য ও বেদান্তের মতোই বার্কলে একই শ্রেণীর ভ্রান্তদর্শন রচনা করেছেন। ইয়োরোপেও এখন আর বার্কলের দর্শন খাঁটি দর্শন বলে বিবেচিত হয় না, কাজেই তা পড়িয়ে কোনও লাভ হবে না।…

একথা অবশ্য ঠিক যে হিন্দুদর্শনে এমন অনেক অংশ আছে যা ইংরেজিতে সহজবোধ্য করে প্রকাশ করা যায় না। তার কারণ, সেই সব… অংশের মধ্যে পদার্থ বিশেষ কিছু নেই।…২০

সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শনের ভ্রান্ততা নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের বক্তব্য খুব স্পষ্ট। এখানে যে বার্কলে-র কথা বলেছেন, তিনি আয়ারল্যান্ড-এর আঠারো শতকের দার্শনিক ছিলেন। বার্কলে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে মনের ধারণা বলে ভাবতেন। এই ধারণা আবার ঈশ্বরের। অর্থাৎ জগতের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হল। স্বাভাবিকভাবেই যুক্তিবাদে এই দর্শন অর্থহীন। বোঝাই যায়, ঈশ্বরচন্দ্র পাশ্চাত্য দর্শনের দিকগুলোও ভালভাবে রপ্ত করেছিলেন। সে-কারণে সাংখ্য, বেদান্তের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শন পড়ানোর কথা বললেও বার্কলে-র দর্শন একেবারেই যে উপযোগী নয়, তাও তিনি লিখেছিলেন। ব্যালান্টাইন তাঁর রিপোর্টে হিন্দু দর্শন ও পাশ্চাত্য দর্শনের সমন্বয়ের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র এর বিপদ সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়েই রিপোর্টে লিখেছিলেন:

পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও হিন্দু শাস্ত্রের মধ্যে সব জায়গায় মিল দেখানো সম্ভব নয়। যদিও তা সম্ভব ধরে নেওয়া যায়, তবু আমার মনে হয়, প্রগতিশীল ইয়োরোপীয় বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্য ভারতীয় পণ্ডিতদের কাছে সমাদরযোগ্য করা রীতিমতো কঠিন। তাঁদের কুসংস্কারগুলি বহুকালের সঞ্চিত ও দৃঢ়মূল। সেগুলি নির্মূল করা সহজ ব্যাপার নয়।… পুরোনো কুসংস্কার তাঁরা অন্ধের মতো আঁকড়ে ধরে থাকবেন।… তাঁদের বিশ্বাস, যে ঋষিদের মস্তিষ্ক থেকে শাস্ত্রগুলি বেরিয়েছে তাঁরা সর্বজ্ঞ, অতএব তাঁদের রচিত শাস্ত্র অভ্রান্ত। কোনো বিষয় আলাপ-আলোচনার সময় যদি পাশ্চাত্যবিজ্ঞানের কোনো সত্যের অবতারণা করা যায়, তাহলে সেটা হাসি-ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেন। সম্প্রতি আমাদের দেশে, বিশেষ করে কলকাতায় ও তার আশেপাশে, পণ্ডিতদের মধ্যে একটা অদ্ভুত মনোভাব পরিস্ফুট হয়ে উঠছে। শাস্ত্রে যার বীজ আছে, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনলে সেই সত্য সম্বন্ধে তাঁদের শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা জাগা দূরে থাক, তার ফল হয় বিপরীত। অর্থাৎ সেই শাস্ত্রের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস আরও গভীর হয় এবং শাস্ত্রীয় কুসংস্কার আরও বাড়তে থাকে। তাঁরা মনে করেন, যেন শেষ পর্যন্ত তাঁদের শাস্ত্রের জয় হয়েছে, বিজ্ঞানের জয় হয়নি।…২১

এইসব ভাবনা নিঃসন্দেহে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও যুক্তিবাদের রসে সিঞ্চিত। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি ব্যালান্টাইন সাহেবের সব মতকে মেনে নিতে চাননি। সে-কারণে ১৮৫০ সালের ১৬ ডিসেম্বর কাউন্সিল অব এডুকেশনের সেক্রেটারি মৌআট সাহেবকে লেখা চিঠিতে দর্শনের কী কী পড়ানো দরকার এ নিয়ে তাঁর মত জানিয়েছিলেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘মীমাংসা বা ধর্মীয় আচারাদির বিধি বাদ দিয়ে (১) সাংখ্যপ্রবচন, (২) পতঞ্জলসূত্র, (৩) পঞ্চদশী, (৪) সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ।’২২ সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ বইটির সম্পাদনা করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র নিজেই। এর পাণ্ডুলিপি অনেক কষ্ট করে উদ্ধার করেছিলেন। বেনারস থেকে তিনটে পাণ্ডুলিপি কিনে এনেছিলেন। পরে কলকাতায় বসে সম্পাদনার কাজ করেছিলেন। এই কথাগুলো গ্রন্থটির ‘ভূমিকা’-য় তিনি লিখেছিলেন।২৩ প্রথম অধ্যায়ে সারসংকলন করেছিলেন চার্বাক দর্শনের। এ কথা এখন সকলেরই জানা, ভারতে বস্তুবাদী দর্শনচর্চায় ‘চার্বাক দর্শন’-এর বিশেষ জায়গা রয়েছে। কিন্তু সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ-র গুরুত্ব হল চার্বাক দর্শনের পুনরুদ্ধার। ‘তার থেকেই লোকে— এদেশে ও বিদেশে— প্রাচীন ভারতের আপসহীন নিরীশ্বরবাদী বেদবিরোধী বস্তুবাদী এই দর্শনের কথা জানতে পারেন।’২৪ এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান অসামান্য; তা দুটো কারণে বলা যেতে পারে। প্রথমত, তিনি ভারতের বস্তুবাদী দর্শনকে পুনরুদ্ধার করে বিশ্বসমাজে ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদী চর্চার ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছিলেন। দ্বিতীয়ত, বেদান্ত দর্শনে আচ্ছন্ন সমাজে সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শনকে ভুল ও সারহীন ঘোষণা করে সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ-কে পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব, যেখানে প্রথম অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে বস্তুবাদী দর্শন বা ‘চার্বাক দর্শন’। এ থেকে ঈশ্বরচন্দ্রের শুধু সাহসিকতাই নয়, সুগভীর যুক্তিবাদী ভাবনা ও বিজ্ঞানমনস্কতার দিকটি সহজেই উপলব্ধ হয়।

এ তো গেল তাঁর শিক্ষার বিষয়বস্তু নিয়ে বিজ্ঞাননির্ভর ধ্যানধারণার আলোচনা। দেশের ও বিদেশের সমাজ প্রগতির নানা দিক অনুশীলন করলে একটা বিশেষ লক্ষণ ধরা পড়ে। তা হল, বিজ্ঞান চর্চা অনেকেই করেন, বিজ্ঞানকে ভালবাসেন কিন্তু ব্যাবহারিক জীবনে বৈজ্ঞানিক চিন্তার কোনও প্রতিফলন ঘটে না। পৃথিবীর অনেক বিজ্ঞানীর জীবনধারা থেকে তা জানা যায়। নিঃসন্দেহে তাঁরা বিজ্ঞানপ্রেমী মানুষ। কিন্তু বিজ্ঞানপ্রেম আর বিজ্ঞানমনস্কতাকে একভাবে ভাবা যায় না। বিজ্ঞান নিয়ে দিনরাত্তির গবেষণায় নিমগ্ন থেকেও কেউ বিজ্ঞানমনস্ক নাও হতে পারেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিজ্ঞানী ছিলেন না, বিজ্ঞানের গবেষণাও করেননি। বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে নানা সমস্যার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁর চরিত্রে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞাননির্ভরতা দানা বেঁধেছে। তার সঙ্গে রসদ জুগিয়েছে আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শনের অনুশীলন। তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতাকে নিজের ব্যাবহারিক জীবনেও কাজে লাগিয়েছেন। তিনি সচেতন ছিলেন যে বর্ণবৈষম্য, জাতিভেদের মতো বিষয়গুলো বাঙালি সমাজের কুসংস্কার, গোঁড়ামিকে আরও বেশি বাড়িয়ে তুলছে। এই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে তিনি নিজের যুক্তিবোধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সংস্কৃত কলেজে একসময় ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া কেউ পড়ার সুযোগ পেত না। ঈশ্বরচন্দ্র তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসের সাত তারিখে ‘কাউন্সিল অব এডুকেশন’-এর ‘সেক্রেটারি’ ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্য ছাত্রদের ভরতি সম্পর্কে ‘রিপোর্ট’ তলব করেন। বিদ্যাসাগর সেই ‘রিপোর্ট’-এ লিখেছিলেন, ‘… ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্য জাতের ভরতিতে কোনো আপত্তি নেই কিংবা অন্যভাবে বললে শূদ্রদের বিভিন্ন শ্রেণির সংস্কৃত কলেজে ভরতিতে আপত্তি নেই। কিন্তু সুবিধার কথা ভেবে আমার প্রস্তাব হল আপাতত কায়স্থরাই শুধু ভরতি হোক।’২৫ ওই বছরের জুলাই মাস থেকে কায়স্থ ছাত্ররা সংস্কৃত কলেজে পড়ার সুযোগ পেল। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই জাতিভেদের বিরুদ্ধে কাজ করেননি। প্রতিদিনের জীবনে নিজেও তা মেনে চলতেন। এখানে এমন এক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তখন ছেলেমানুষ। হরপ্রসাদের বাড়ি নৈহাটীতে। সকালবেলা বাড়ির মেয়েমহলে একদিন মস্ত সোরগোল উঠল—ওমা, এমন তো কখনো শুনিনি, বামুনের ছেলে অমৃতলাল মিত্তিরের পাত থেকে রুইমাছের মুড়োটা কেড়ে খেয়েছে!

পাঁচজনে পাঁচরকম কথা কইতে লাগলেন; ঘোর কলি! সব একাকার হয়ে যাবে! জাতজন্ম আর থাকবে না!

একজন মিত্তিরের পাত থেকে রুইমাছের মুড়ো কেড়ে খেয়েছে—কে সেই বামুনের ছেলে? হরপ্রসাদের জানতে ইচ্ছা হল।

—কে কেড়ে খেয়েছে?

হরপ্রসাদের মা বললেন—জানিস নি? বিদ্যাসাগর।

—তিনি কি এখানে এসেছেন?

হরপ্রসাদের মা বললেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ—কাল থেকে এসেছেন।২৬

১৮৯১ সালের অগস্ট মাসের এক তারিখের সঞ্জীবনী-তে উল্লিখিত আছে:

বর্দ্ধমানে যখন বড় ম্যালেরিয়া জ্বরের ধুম, তখন আমরা কলিকাতাতে বসিয়া শুনিলাম যে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজ ব্যয়ে ডাক্তার ও ওষুধ লইয়া সেখানে গিয়াছেন; এবং ডাক্তার ও ঔষধ সঙ্গে হাড়ি, শুড়ি, জেলে, মালা, জাতি বর্ণ নির্ব্বিশেষে সকলের দ্বারে দ্বারে ফিরিয়া চিকিৎসা করাইতেছেন। তিনি গাড়িতে বসিয়াছেন, একটী মুসলমানের বালক হয়ত তাঁহার ক্রোড়ে রহিয়াছে।…২৭

এসব আচরণ থেকে ঈশ্বরচন্দ্রের মধ্যে জাতপাতবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ এক মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়। যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানভাবনার আঙ্গিকে কারও চিন্তার জগৎকে বুঝে নিতে হলে অবশ্যই ধর্ম এবং ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর মনোভাবের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। হিন্দুদের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল সংস্কৃত কলেজের ছুটির দিনের পরিবর্তন। একসময় সংস্কৃত কলেজ ছুটি থাকত অষ্টমী আর প্রতিপদ তিথিতে। বোঝাই যায় যে, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিধি মেনেই এই ছুটি নির্ধারিত হয়েছিল। ১৮৫১ সালের ২৩ নভেম্বর ‘কাউন্সিল অব এডুকেশন’-এর ‘সেক্রেটারি’কে বিদ্যাসাগর চিঠি লিখেছিলেন, ‘সম্মান জ্ঞাপনপূর্বক আমি ‘‘কাউন্সিল অব এডুকেশন’’-এর জ্ঞাতার্থে জানাই যে বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী সংস্কৃত কলেজ প্রতি অষ্টমী এবং প্রতিপদে ছুটি থাকে। এর পরিবর্তে প্রতি রবিবার ছুটির দিন হিসাবে গণ্য করার জন্য প্রস্তাব করছি…।’২৮ তিনি সফল হয়েছিলেন এবং তারপর থেকে সংস্কৃত কলেজ ছুটি থাকত প্রতি রবিবার।

আবার ‘রামায়ণ মহাভারত-কে তিনি সাধারণ কাব্য বলেই মনে করেছেন, ধর্মগ্রন্থ বলে নয়। দুটি কাব্যর দোষও তিনি উল্লেখ করেন বিনা দ্বিধায়।’২৯ শুধু সেই সময়েই বলব না, এমনকী এই একুশ শতকেও এই দু’টি মহাকাব্যকে ধর্মগ্রন্থ বলে অনেক ভারতীয় মনে করেন। অথচ উনিশ শতকে বিদ্যাসাগর যথার্থ মূল্যায়ন করেছিলেন।

হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামির সঙ্গে তিনি কখনও আপস করেননি। সেইসঙ্গে প্রগতিশীল ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নারীমুক্তির কথা ভেবেছিলেন এবং সরবও হয়েছিলেন তা নিয়ে। তিনি বুঝেছিলেন, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, স্ত্রীশিক্ষার বিরোধিতা এবং বিধবাবিবাহে আপত্তি— এইসবই ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের ফসল। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তিনি যেভাবে ভেবেছিলেন তাতে বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়, ‘অপ্রমত্ত শারীরতত্ত্বাভিজ্ঞ বিজ্ঞ ভিষগ্বর্গেরা কহিয়াছেন, অনতীতশৈশব জায়া-পতিসম্পর্কে যে সন্তানের উৎপত্তি হয়, তাহার গর্ভবাসেই প্রায় বিপত্তি ঘটে, যদি প্রাণবিশিষ্ট হইয়া ভূমিষ্ঠ হয়, তাহাকে আর ধাত্রীর অঙ্কশয্যাশায়ী হইতে না হইয়া অনতিবিলম্বে ভূতধাত্রীর গর্ভশায়ী হইতে হয়। কথঞ্চিৎ যদি জনক-জননীর ভাগ্যবলে সেই বালক লোকসংখ্যার অঙ্ক বৃদ্ধি করিতে সমর্থ হয়, কিন্তু স্বভাবতঃ শরীরের দৌর্বল্য ও সর্বদা পীড়ার প্রাবল্যপ্রযুক্ত সংসারযাত্রার অকিঞ্চিৎকর পাত্র হইয়া অল্পকালমধ্যেই পরত্র প্রস্থিত হয়।’৩০ আধুনিক ভারতে যে শারীরবৃত্তীয় কারণে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ হয়েছে, উনিশ শতকে সেই যুক্তিতেই ঈশ্বরচন্দ্র বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন।

আবার স্ত্রীশিক্ষার উপযোগিতা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যে আধুনিকতার ছাপ অতি স্পষ্ট: ‘এতদ্দেশে যদ্যপি স্ত্রীজাতির বিদ্যাশিক্ষার প্রথা প্রচলিত থাকিত, তবে অস্মদ্দেশীয় বালক-বালিকারা মাতৃসন্নিধান হইতে সদুপদেশ পাইয়া অল্প বয়সেই কৃতবিদ্যা হইতে পারিত।… স্তন্যপান পরিত্যাগ করিয়াই যদি বালকেরা মাতৃ-মুখ-চন্দ্রমণ্ডল হইতে সরস উপদেশ-সুধা স্বাদ করিতে পায়, তবে বাল্যকালেই বিদ্যার প্রতি দৃঢ়তর অনুরাগী হইয়া অনায়াসে কৃতবিদ্য হইতে পারে। কারণ, সন্তানের হৃদয়ে জননীর উপদেশ যেমন দৃঢ়রূপে সংসক্ত হয় ও তদ্দ্বারা যত শীঘ্র উপকার দর্শে, অন্য শিক্ষকের দ্বারা তাহার শতাংশেরও সম্ভাবনা নাই, জননীর উপদেশকতাশক্তি থাকাতেই ইউরোপীয়েরা অল্প বয়সেই বিচক্ষণ ও সভ্যলক্ষণসম্পন্ন হয়।’৩১ তিনি মনে করতেন স্ত্রীশিক্ষার মাধ্যমে বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক সমস্যা দূর করা সম্ভব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুশিক্ষিত করে তোলার জন্যে নারীশিক্ষার প্রয়োজন। এই যুক্তিনিষ্ঠ ধারণা থেকেই তিনি স্ত্রীশিক্ষার জন্যে প্রাণপাত করেছিলেন। এখনকার সমাজেও সেই যুক্তি সমানভাবে প্রযোজ্য।

বিধবাবিবাহ নিয়ে যাঁরা শাস্ত্রের নানা কথা বলে বিরোধিতা করত, তাদের তিনি শাস্ত্রজ্ঞানেই নিরস্ত করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, বিধবাবিবাহ সমাজের অনেক বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাও তিনি আলোচনা করেছেন: ‘তোমরা প্রাণতুল্য কন্যা প্রভৃতিকে অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণানলে দগ্ধ করিতে সম্মত আছ, তাহারা, দুর্নিবাররিপুবশীভূত হইয়া ব্যভিচারদোষে দূষিত হইলে, তাহার পোষকতা করিতে সম্মত আছ, ধর্মলোপভয়ে জলাঞ্জলি দিয়া, কেবল লোকলজ্জাভয়ে, তাহাদের ভ্রূণহত্যার সহায়তা করিয়া, স্বয়ং সপরিবারে পাপপঙ্কে কলঙ্কিত হইতে সম্মত আছ; কিন্তু, কি আশ্চর্য! শাস্ত্রের বিধি অবলম্বনপূর্বক, তাহাদের পুনরায় বিবাহ দিয়া, তাহাদিগকেও সকল বিপদ হইতে মুক্ত করিতে সম্মত নহে।’৩২ বিধবাবিবাহের বিরোধিতা করার অর্থ ব্যভিচার ও ভ্রূণহত্যার মতো সামাজিক অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া। এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের মধ্যে আধুনিক মানসিকতা ও বাস্তবজ্ঞানের লক্ষণ সুস্পষ্ট। অথচ শাস্ত্রের উপদেশের কাছে তাঁর এই যুক্তিবোধ যে কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, সে-ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন: ‘… যুক্তিমাত্র অবলম্বন করিয়া, ইহাকে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন কর, তাহা হইলে, এতদ্দেশীয় লোকে কখনই ইহা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্রতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাঁহারা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদনুসারে চলিতে পারেন।’৩৩

বিদ্যাসাগর নিজে যুক্তিবাদী ছিলেন বলে শ্রাদ্ধ সম্বন্ধীয় আচার ছাড়া আর কোনও শাস্ত্র নির্দেশিত আচার-অনুষ্ঠান মানতেন না। ব্রাহ্মণ্য আচার-অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে তাঁর মনোভাব কী ছিল, তা জানা যায় বিহারীলাল সরকারের লেখা থেকে— ‘… তিনি তো পিতামহীর নিকট মন্ত্রগ্রহণ করেন নাই; পরন্তু সন্ধ্যাহ্নিক পূজাদিতেও তাঁহার প্রবৃত্তি ছিল না। তবে অপর কাহারও সন্ধ্যাহ্নিক ক্রিয়া দেখিয়া, তিনি নাসিকা সংকুচিত করিতেন না। আপন পরিবারের মধ্যে কাহারও প্রতি তৎসম্বন্ধে তাঁহার নিষেধও ছিল না।…’৩৪ শুধু পিতামহী নয়, তিনি কারুর কাছেই কখনও দীক্ষা গ্রহণ করেননি।

বিদ্যাসাগর কাশী গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে। বিদ্যাসাগর একজন দয়াবান দাতা পুরুষ, এ প্রচার ছিলই। অতএব সেখানে কয়েকজন ব্রাহ্মণ তাঁর কাছে টাকা চাইতে এলেন। তিনি তাঁদের যা যা বলেছিলেন, তা একবার স্মরণ করা যাক:

আমি যদি আপনাদের মতো বামুনদের কাশীতে দান করে যাই, তাহলে আমি কলকাতায় ভদ্রলোকের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। আপনারা যতরকম দুষ্কর্ম করতে হয় তা করে দেশ ছেড়ে এসে কাশীতে উঠেছেন। এখানে আছেন বলে আপনাদের যদি আমি ভক্তি-শ্রদ্ধা করে বিশ্বেশ্বর বলে মান্য করি, তা হলে আমার মতো নরাধম আর নেই।

… আপনাদের বিশ্বেশ্বর মানি না।

… মাকে মানি, বাবাকে মানি। আমার বাবা আমার বিশ্বেশ্বর, আমার মা আমার অন্নপূর্ণা।৩৫

ঈশ্বরচন্দ্র ঈশ্বর নিয়ে বিশেষ আলোচনা করতেন না, কোনও ধর্মসভাতেও তাঁর যাওয়ার কথা জানা যায় না। তিনি বলতেন, ‘আমি নিজে ঈশ্বরের বিষয় কিছু বুঝি না, আবার পরকে কি লেকচার দেব?’৩৬ তাঁর জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে কিছু কিছু আলোকপাত করেছেন। বিদ্যাসাগর ঈশ্বর সম্পর্কে যথার্থই উদাসীন ছিলেন। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দর মনে হয়েছিল যে, বিদ্যাসাগরের নিশ্চয় ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণা আছে এবং তিনি ঈশ্বরের বিষয়ে বোঝেন। এ কথা জানার পরে বিদ্যাসাগর রেগে গিয়েছিলেন, দুঃখও পেয়েছিলেন। কেননা এ সম্পর্কে তাঁর ধারণাটি হল, ‘এই দুনিয়ার একজন মালিক আছেন তা বেশ বুঝি। নিজে যেমন বুঝি, তেমনি চলি। কেউ পীড়াপীড়ি করলে বলব, “এর বেশি বুঝতে পারিনি।” কিন্তু এ পথে না গিয়ে ও পথে গেলেই স্বর্গে যেতে পারব, তাঁর প্রিয় হব, এ সব বুঝিও না, কাউকে বোঝানোরও চেষ্টা করি না। লোককে বুঝিয়ে শেষকালে কি ফ্যাসাদে পড়ে যাব? পরের জন্য বেত খেয়ে মরব?’৩৭ ইহকাল, পরকালের মতো কাল্পনিক ধারণাও ছিল তাঁর কাছে অর্থহীন। ধর্মাচার নিয়ে তিনি যে যুক্তিনিষ্ঠ ছিলেন, তা বলাই যায়। কিন্তু ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে তাঁর সম্পর্কে ‘নাস্তিক’ বা ‘ঈশ্বরবিশ্বাসী’ কোনওটাই বলা যায় না। তিনি কখনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, আবার তাঁর লেখায় ঈশ্বরের কথাও পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর বলতেন, ‘ঈশ্বর যদি থাকেন তো তিনি তো আর কামড়াবেন না।’৩৮

‘স্যার জন লরেন্স’ স্টিমারডুবির কারণে প্রায় সাত থেকে আটশো মানুষ মারা গিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর এ ঘটনা শুনে বলেছিলেন, ‘দুনিয়ার মালিক কি আমাদের চেয়ে নিষ্ঠুর? আমি যা পারি না, কেমন করে পরম করুণাময় হয়ে তিনি তা পারলেন, কেমন করে তিনি একসঙ্গে ডুবিয়ে মারতে পারলেন সাত-আটশো মানুষ? এই কি দুনিয়ার মালিকের কাজ? এসব দেখলে এই দুনিয়ার কেউ মালিক আছেন বলে সহসা মনে হয় না।’৩৯

আবার শিশুপাঠ্য বোধোদয়-এ বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘ঈশ্বর, কি চেতন, কি অচেতন, কি উদ্ভিদ, সমস্ত পদার্থের সৃষ্টি করিয়াছেন। এ নিমিত্ত ঈশ্বরকে সৃষ্টিকর্তা বলে। ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ। তাঁহাকে কেহ দেখিতে পায় না; কিন্তু তিনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান আছেন। আমরা যাহা করি, তিনি তাহা দেখিতে পান; আমরা যাহা মনে ভাবি, তিনি তাহা জানিতে পারেন। ঈশ্বর পরম দয়ালু; তিনি সমস্ত জীবের আহারদাতা ও রক্ষাকর্তা।’৪০ এখানে তিনি ঈশ্বরের কথা বলেছেন, যেভাবে সাধারণত ঈশ্বরকে বোঝানো হয়ে থাকে, সেভাবেই। তফাত শুধু তাঁর ভাবনায়, ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন যে প্রথম যখন তিনি বোধোদয় লিখেছিলেন, তখন তাতে ঈশ্বরভাবনার কথা ছিল না, কয়েক সংস্করণ সেভাবেই ছাপা হয়েছিল। কিন্তু পরে এই অংশ যুক্ত করেছিলেন।৪১

বোধোদয়-এ প্রথম দিকে ঈশ্বরের কথা উল্লেখ না করলেও পরে সরাসরি ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা বলেছেন, আলাদা অনুচ্ছেদে। স্বাভাবিকভাবেই পাঠক সংশয়ান্বিত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে তাঁর ঈশ্বরভাবনা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে কতকগুলো প্রশ্ন জাগে। এটা ঠিক যে, বোধোদয়-এর ভাবনার প্রেক্ষিত আর অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁর মতামতের প্রেক্ষাপট কিন্তু ভিন্ন। বোধোদয় রচনার উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক লেখা। ফলে তার গ্রহণযোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্র ‘ঈশ্বর’ অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে বাকি বিষয়বস্তু হল পদার্থবিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান, ধাতুবিজ্ঞান, গণিত, জীববিজ্ঞান, শারীরবিদ্যার নানা বিষয়। ‘ঈশ্বর’ অনুচ্ছেদটিকে বেশ অপ্রাসঙ্গিক এবং বিচ্ছিন্ন বলেই মনে হয় কারণ অন্য কোনও অনুচ্ছেদের বিষয়বস্তুর সঙ্গে তাকে মেলানো কঠিন। বিদ্যালয় স্তর থেকে বিজ্ঞানকে পাঠ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করার কথা তিনি ভেবেছিলেন। সেই চিন্তা নিয়েই যে বোধোদয় লিখেছিলেন, এ কথা বুঝতেও কোনও অসুবিধা হয় না। কারণ, সেই সময় বাংলায় বিজ্ঞানের বইয়ের যথেষ্ট অভাব ছিল। মনে করা যেতেই পারে বিজ্ঞানের সঙ্গে ‘ঈশ্বর’ ভাবনার মতো বিষয়কে যুক্ত করতে চাননি বলেই প্রথম কয়েকটা সংস্করণে তার কোনও উল্লেখ ছিল না। কিন্তু পরে বইটিকে তুলনায় বেশি গ্রহণীয় করার জন্যে সমসাময়িক সামাজিক ধ্যানধারণার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই কি সংযুক্ত করেছিলেন তা? তাতে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে অন্তত সহজভাবে গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব হবে। কিংবা বিজ্ঞান ও ঈশ্বরভাবনা পাশাপাশি তুলে ধরতে পারলে ঈশ্বরভাবনার অসারতা এবং জড়তার দিকটা পাঠকরা সহজে অনুধাবন করতে পারবেন! যা করেছিলেন পাঠ্যসূচিতে দর্শনের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে। সাংখ্য ও বেদান্তের অসারতা জেনেও পাশ্চাত্য দর্শনের সঙ্গে সাংখ্য ও বেদান্ত পড়াবার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেছিলেন যে তাতে সাংখ্য ও বেদান্তের অসারতা পাঠক সহজেই বুঝবেন। ফলে বোধোদয়-এ ঈশ্বর আলোচনা নিছকই বিজ্ঞানের আঙিনায় বিদ্যালয় ছাত্রদের নিয়ে আসার কৌশল হিসেবে কি ভাবা যেতে পারে না?

অন্যান্য ক্ষেত্রে আলাপচারিতায় ঈশ্বর সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো আলাদাভাবে বিচার করলে কার্য-কারণ অনুসন্ধানের প্রতিচ্ছবি মেলে। যে-কোনও যুক্তিনিষ্ঠ, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটতেই পারে। তাঁর উপবীত ধারণ, শ্রাদ্ধাদির মতো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বা চিঠিপত্র লেখার সময় শিরোনামে ‘শ্রীশ্রীদুর্গাশরণং’, ‘শ্রীশ্রীহরিশরণং’ উল্লেখ— এসব নিয়ে অনেকেই তাঁকে ঈশ্বরবিশ্বাসী বলে মনে করেছেন। এ কথাও বলা হয় যে তিনি ধর্মীয় বেড়াজালের বাইরে বেরতে পারেননি। কিন্তু সবমিলিয়ে কোনওভাবেই তাঁকে যেমন ‘নাস্তিক’ বলা সম্ভব নয়, আবার পুরোপুরিভাবে তথাকথিত ‘ঈশ্বরবিশ্বাসী’ হিসেবে ভাবাও যায় না। সে-কারণে ঈশ্বরভাবনা বা ধর্মভাবনা তাঁর একান্তই নিজস্ব বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে। যা নিয়ে তিনি যেমন মাতামাতি করেননি, আবার সরাসরি বিরোধিতাতেও যাননি। ‘তবু স্পষ্টই বোঝা যায়— এদেশে ধর্ম বলতে যা বোঝায়, এবং ধার্মিক লোকেরা ঈশ্বর বলতে যা বোঝেন,— বিদ্যাসাগর তাতে আস্থা রাখতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিল মানবিক ধর্মে— রিলিজিয়ান অব ম্যান-এ, এ বরং বলা যায়; যদিও প্রমাণ অজস্র যে, তাঁর সারাজীবনের নিদারুণ অভিজ্ঞতায় মানুষের প্রতি তাঁর বিশ্বাস বিষমরূপেই চিড় খেয়ে গিয়েছিল,— সে বিশ্বাস ভেঙে যাওয়া তাঁর কালে, তাঁর মতো মানুষের পক্ষে, অনিবার্য ছিল। তথাপি ঈশ্বর সেই শূন্যস্থান— যতখানিই হোক তা— জুড়ে বসতে পারেনি, তিনিও ঈশ্বরের আশ্রয় খোঁজেন নি।’৪২

বরং ধর্মীয় গোঁড়ামি, জাতপাত, ধর্মীয় বিভেদ কিংবা কুসংস্কারের বিরুদ্ধেই তিনি কাজ করে গেছেন আজীবন, সে-আলোচনা আগেই করা হয়েছে। ইয়ং বেঙ্গল দলের কর্মকাণ্ড থেকে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। সমসাময়িক সামাজিক রীতিনীতিকে পুরোপুরিভাবে অগ্রাহ্য করে পাশ্চাত্য ধ্যানধারণাকে প্রতিষ্ঠা করার যে প্রয়াস, তা পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। ফলে সংস্কারের প্রয়োজনে কিছু কিছু রীতিনীতিকে সাময়িকভাবে মেনে নিতে হয়, এটা তিনি জানতেন, তা না হলে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয়। শেষপর্যন্ত সংস্কার আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিধবাবিবাহ নিয়ে লেখাতে সে-কৌশল অবলম্বন করেছেন— শাস্ত্র দিয়েই তথাকথিত শাস্ত্রসম্মত যুক্তি খণ্ডন করেছেন। সংস্কারের কাজে দরকারমতো তিনি শান্তভাবে সুকৌশলী হয়েছেন। হয়তো সেই কারণে সচেতনভাবে ধর্ম ও ঈশ্বরচিন্তা নিয়ে গভীর আলোচনা বাদ দিয়ে অন্যান্য অনেক সামাজিক সমস্যা নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। কারণ তিনি বুঝতেন ধর্ম ও ঈশ্বরভাবনা এই দু’টি ছিল তখনকার সমাজে অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। এ বিষয় নিয়ে বিতর্কিত হয়ে উঠলে অন্যান্য সংস্কারগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। অনেকটা অনুরূপ মত পাওয়া যায় গোপাল হালদারের লেখাতেও।৪৩

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কর্মবৈচিত্র্যের বিশেষ দিক হল, তিনি এদেশের প্রাচীন ভাবধারা ও সংস্কৃতির সুগভীর বিশ্লেষণ এবং উপলব্ধির ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে পাশ্চাত্যের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বীজ বপন করেছিলেন। ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে অনেকটাই সাফল্য লাভ করেছিলেন। একদিকে যেমন প্রাচীন ভারতের শাস্ত্র পুনরুদ্ধার করে তাদের নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যে শাস্ত্রাদি তখন চর্চিত হত, সেগুলোর অসার ও যুক্তিহীন দিকগুলোও চিহ্নিত করে তাদের অপ্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছেন। একইসঙ্গে পাশ্চাত্যের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিতি ঘটিয়ে বাঙালি সমাজকে যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান-নির্ভর জীবনবোধে আলোকিত করেছেন। সেই নিরিখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যথার্থই যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক, তা বলাই বাহুল্য। একইসঙ্গে ইতিহাসের বিচারে যথার্থ অর্থেই ‘আধুনিক এক মানবতাবাদী’ হয়ে উঠেছিলেন।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

. জি. ভি. প্লেখানভ, ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা (মস্কো: প্রগতি প্রকাশন, ১৯৭৪) পৃ. ৫।

. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগরচরিত (কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৩ শ্রাবণ, ১৩৬৫ ব.), পৃ. ৭৩।

. প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আত্মচরিত (শৈব্যা সংস্করণ) (কলকাতা: শৈব্যা প্রকাশন বিভাগ), পৃ. ১১৬-১১৭।

. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ‘প্রাচীন ভারতে শল্য চিকিৎসা’, মৌলবাদ ও বিজ্ঞান (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, ১৯৯৫), পৃ. ৮-৯।

. Sophia Dobson Collet, ‘Rammohun’s Letter to Lord Amherst on Western Education’, The Life and Letters of Raja Rammohun Roy Edited by Dilip Kr. Biswas and Probhat Chandra Ganguly, (Third Edition, 1962), p. 460. (মূল ইংরাজি থেকে অনুবাদ লেখকের)

. বদরুদ্দীন উমর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ (কলকাতা: চিরায়ত প্রকাশন, প্রথম ভারতীয় সংস্করণ), পৃ. ১৯।

. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর (এলাহাবাদ: ইণ্ডিয়ান প্রেস, ষষ্ঠ সংস্করণ), পৃ. ৫০২।

. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ‘প্রাচীন ভারতে শল্য চিকিৎসা’, মৌলবাদ ও বিজ্ঞান (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, ১৯৯৫), পৃ. ২।

. ভুবনকৃষ্ণ মিত্র, ‘জীবতত্ত্ব’, জন্মভূমি, ফাল্গুন ১৩০৮ ব., পৃ. ২৫০-২৫১।

১০. ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা, ‘নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস’, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ (১৯৭২), তৃতীয় খণ্ড, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, কলকাতা, পৃ. ৪৩৯।

১১. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ (কলকাতা: ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৭৩), পৃ. ১৬৬।

১২. ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা, ‘জীবনচরিত’, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ (১৯৭২), প্রথম খণ্ড, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, প্রথমবারের বিজ্ঞাপন দ্রষ্টব্য।

১৩. তদেব।

১৪. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০১৬), পৃ. ১৭৫।

১৫. তদেব, পৃ. ৪৮।

১৬. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ১৯৯।

১৭. তদেব, পৃ. ১৮২।

১৮. Ashish Lahiri, Caught Between Two Cultures: Science in Nineteenth Century Bengal (Calcutta: Thema, 2013) p. 30.

১৯. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ১৭৪-১৭৫।

২০. তদেব, পৃ. ১৭৮-১৭৯।

২১. তদেব, পৃ. ১৭৯ ।

২২. ইন্দ্রমিত্র,করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ৬৪৭। (মূল ইংরাজি থেকে অনুবাদ লেখকের)

২৩. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ৩৯৮।

২৪. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘চার্বাকচর্চার ধারা: রচনা-সমীক্ষা’, চার্বাকচর্চা (কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি), পৃ. ১।

২৫. ইন্দ্রমিত্র,করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ১৪২। (মূল ইংরাজি থেকে অনুবাদ লেখকের)

২৬. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘ভূমিকা’, বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ (কলকাতা: গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, ১৩৩৮ ব.), পৃ. ১৯।

২৭. ইন্দ্রমিত্র,করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ১১।

২৮. তদেব, পৃ. ১৪২। (মূল ইংরাজি থেকে অনুবাদ লেখকের)

২৯. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘বিদ্যাসাগর-রচনাবলি: না-পড়া অংশ’, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ (কলকাতা: চিরায়ত প্রকাশন, ২০১১), পৃ. ১৭৬।

৩০. ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা, ‘বাল্যবিবাহের দোষ’, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ (১৯৭২), দ্বিতীয় খণ্ড, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, পৃ. ৫।

৩১. তদেব, পৃ. ৭।

৩২. ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা, ‘বিধবাবিবাহ— দ্বিতীয় পুস্তক’, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ (১৯৭২), দ্বিতীয় খণ্ড, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, পৃ. ১৬৪-১৬৫।

৩৩. ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা, ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ (১৯৭২), দ্বিতীয় খণ্ড, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, পৃ. ২১।

৩৪. বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর (কলকাতা: শাস্ত্র-প্রকাশ কার্য্যালয়, তৃতীয় সংস্করণ), পৃ. ৩১০-৩১১।

৩৫. ইন্দ্র মিত্র,করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ৫৮৮-৫৮৯।

৩৬. শ্রীম, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণকথামৃত (কলকাতা: উদ্বোধন কার্যালয়, ১৩৬০ ব.) দ্বিতীয় ভাগ, পৃ. ৩৮৫-৩৮৬।

৩৭. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর (ষষ্ঠ সংস্করণ), পৃ. ৫৩৯।

৩৮. বিপিনবিহারী গুপ্ত, ‘পুরাতন প্রসঙ্গ’, আর্য্যাবর্ত্ত, মাঘ ১৩২০ ব., পৃ. ৯০৭।

৩৯. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর (ষষ্ঠ সংস্করণ), পৃ. ৫৪০-৫৪১।

৪০. ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা, ‘বোধোদয়’, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ (১৯৭২), প্রথম খণ্ড, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, পৃ. ১৭৭।

৪১. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ৩৮১।

৪২. গোপাল হালদার, ‘ভূমিকা’, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ (১৯৭২), তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৩৬।

৪৩. তদেব, পৃ. ৩৩-৩৭।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *