উদ্ভাবনে আমরা কেন পিছিয়ে?
আমি যখন কোনো বিদেশির সঙ্গে গল্প করি, তখন আমার দেশটাকে বড় করার জন্য অনেক মিথ্যা কথা বলি। আমার জীবনে যদি মিথ্যা কথার সমষ্টি করা হয়, তার ৯০ ভাগই আমার দেশকে জড়িয়ে মিথ্যা কথা। আর সবই হলো দেশটাকে অন্যের কাছে বড় করার জন্য। মিথ্যা বলা মহাপাপ হলেও, আমি এই পাপ করেছি। ক্রমাগত করে যাচ্ছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মিথ্যা। বলে আজকের দুনিয়ায় পার পাওয়া কঠিন। বিদেশিদের কাছে আমার দেশটিকে নিয়ে যতই মিছেমিছি গৌরব করি না কেন, তারা ঠিকই সবকিছু জেনে যায়। কিছুদিন পর পর যখন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিভিন্ন বিষয়ে জরিপ বা গবেষণা করে, তখন আমার দেশটির নাম খুঁজে পাওয়া যায় সেসব তালিকায়। সেসব তালিকা দেখলেই বুকটা হাহাকার করে ওঠে। আফসোস লাগে। প্রচণ্ড কষ্ট হয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে (২০১৮) বাংলাদেশের অবস্থান এশিয়ার সবচেয়ে নিচে। অর্থাৎ আমার দেশটি হলো উদ্ভাবনে সবচেয়ে পিছিয়ে। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এমনকি নেপালও আমাদের চেয়ে এগিয়ে। এই খবরটা যে কতটা উদ্বেগের, সেটা সম্ভবত আমাদের সরকার কখনোই উপলব্ধি করে না। গবেষণা করেই যেহেতু আমার জীবিকা চলে, তাই দেশের গবেষণা ও উদ্ভাবনের খোঁজখবর আমি রাখি। আর সে জন্যই, এই রিপোর্টটা আমাকে বিস্মিত করেনি। আমার পরিচিত বিদেশি সহকর্মী বা বন্ধুরা যখন এই আন্তর্জাতিক রিপোর্টটি দেখবে, তখন তাদের কাছে আর বড় করে কিছু বলার থাকবে না।
গবেষণা ও উদ্ভাবনে আমরা পিছিয়ে কেন? আমাদের কি মেধাবী ছেলেমেয়ে নেই? আমাদের কি টাকা নেই? আমাদের মস্তিষ্ক কি উর্বর নয়? না, এর কোনোটাই না। আমাদের দেশটা অসংখ্য মেধাবীতে ভরা। পরিশ্রমী, স্বপ্নবান, উদ্যমী তরুণে ভরা। আমাদের শুধু নেই ব্যবস্থাপনা। আমরা পাঁচটা পদ্মা সেতু করতে পারব, কিন্তু যদি গবেষণা ও উদ্ভাবনে এগিয়ে না যাই, তবে দেশটাকে দাঁড় করতে অনেক সময় লাগবে। টেকসই উন্নয়নের (Sustainable Development) জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবন হলো। অন্যতম শর্ত। আর উন্নত গবেষণার জন্য প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সময় উপযোগী নিয়ম-নীতি।
আমি যখন দেখি, আমাদের বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রগুলোর চেয়ারম্যান-মেম্বার হলেন সচিবালয়ের লোক, তখন খুব কষ্ট হয়। সচিবালয়ের লোক দিয়ে কেন আমরা গবেষণা কেন্দ্র বা গবেষণা। সংগঠন চালাব? তাদের তো কোনো গবেষণার অভিজ্ঞতা নেই। তারা হয়তো জীবনে ১০টি গবেষণাপত্রও (Research Article) প্রকাশ করেননি। তারা কোনো দিন গবেষণার সঠিক মূল্যায়ন ও গুরুত্বই বুঝবেন না। সেই জায়গাগুলোতে থাকার কথা ছিল। দেশের প্রথিতযশা গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে শিক্ষক ও গবেষক। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গবেষক। দুনিয়ার কোনো উন্নত সমাজের বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান বা বিজ্ঞান সংগঠনে কি সচিবালয়ের লোক বসিয়ে রাখা হয়?
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়াই হচ্ছে নিয়োগ ও পদোন্নতি। গবেষণাপত্র প্রকাশে কুম্ভিলতার (Plagiarism) আশ্রয় এখন মামুলি বিষয়। বেনামি অনলাইন জার্নালে টাকা দিয়ে হচ্ছে গবেষণাপত্রের প্রকাশ। সেসব গবেষণাপত্র দেখিয়ে হরহামেশা চলছে পদোন্নতি। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নামধারী শত শত পদে বসে আছেন গবেষণাহীন মানুষ। দেশের হাজার হাজার মেধাবী এক্সপার্টরা দেশে ফিরতে চাইলেও তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার নেই কোনো সঠিক উদ্যোগ। কী করে হবে তাহলে উদ্ভাবন? দেশের বিজ্ঞানমন্ত্রী কি এগুলো দেখেন না? সরকারের নজরে কি এগুলো পড়ে না? গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য প্রধানত শর্ত হলো যোগ্য ও মেধাবী লোক নিয়োগ। দ্বিতীয় শর্ত হলো মেধাবীর হাতে পর্যাপ্ত অর্থ জোগান দেওয়া। তিয়াত্তরের নিয়ম-নীতি দিয়েই ইউনিভার্সিটি ও গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে এখনো নিয়োগ-পদোন্নতি হচ্ছে। ৫০ বছরের পুরোনো এসব নীতি বদলের সময় হয়েছে বহু আগেই। অথচ আমাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
আমি খুব লক্ষ করে দেখেছি, গবেষণা বিষয়টাকে আমাদের দেশে কত হালকা করে দেখা হয়। কত হেলায়-ফেলায় দেখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের কাছেও গবেষণা বিষয়টা পরিষ্কার না। গবেষণা ও গবেষক সম্মেলনের নামে আমরা এখনো খাবারদাবার আয়োজন নিয়েই ব্যস্ত থাকি। গবেষণার নামে প্রতারণায় ভরপুর প্রকাশনা নিয়েই তুষ্ট আছি। বিদেশের নামকরা গবেষক বলতে সাদা চামড়ার কাউকে ধরে এনে ঢালাওভাবে প্রচার করছি। গবেষণার ফলাফল কোনো জার্নালে প্রকাশ না করে, কিংবা পেটেন্ট না করে দলবল-নেতা নিয়ে হাজির হই পত্রিকা অফিসে! বিজ্ঞান ও গবেষণাবিষয়ক কোনো অনুষ্ঠানেও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের দাওয়াত করে প্রধান অতিথির আসনে বসিয়ে রাখি। দুনিয়ার কোথাও গবেষণার এমন সংস্কৃতি আছে বলে আমার জানা নেই।