উদ্ভব সমস্যাবর্তে একটি পুরাতন ধারণার উত্থান

উদ্ভব

সমস্যাবর্তে একটি পুরাতন ধারণার উত্থান

মিশরের সিংহাসনে নতুন ফারাও চিওপস আরোহন করার কয়েক মাস পর শেষ শরতের এক সকালে তিনি ঘোষণা দিলেন যে, সম্ভবত তার জন্য কোনো পিরামিড নির্মাণের ইচ্ছে তার নেই। সভাসদের যারা এই সংবাদটা শুনলো, রাজপ্রাসাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ঊর্ধ্বতন মন্ত্রিপরিষদ, ফারাও চিওপসের পুরাতন উপদেষ্টা উছারকেফ এবং সর্বোচ্চ ধর্মযাজক হেমিউনি যিনি একই সাথে প্রধান প্রকৌশলির দায়িত্বে আছেন তাদের সবার ভ্রু কুচকে গেলো। মনে হলো তারা যেনো বড় কোনো দুর্ঘটনার সংবাদ এই মাত্ৰ শুনলেন।

সভাসদ কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। তারা সম্রাটের অপ্রসন্ন মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে এর সত্যতা উপলব্ধি করার চেষ্টা করলো। তারা অন্তর দিয়ে সম্রাট যে ‘সম্ভবত’ শব্দটা উচ্চারণ করেছে সেটাকে গ্রহণ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু সম্রাট চিওপসের মুখমণ্ডল দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছিলো না। সেটা ছিলো দুর্ভেদ্য। সভাসদ আশা করছিলো তার এই কথাটাও ঠাট্টাচ্ছলে তুচ্ছ একটা কথা হবে যেভাবে তরুণ রাজ রাজরা তাদের দুপুরের ভোজে বসে আনন্দ করার জন্য বলে থাকেন। তিনি কি এই কিছুদিন আগে মিশরের সবচেয়ে পুরাতন দুটি গির্জা বন্ধ করে দিলেন না? তারপর আবার তিনিই ঘোষণা করলেন যেখানে ধর্মীয় উৎসর্গীকৃত অনুষ্ঠান বন্ধ ছিলো সেখান থেকেই সবাই যেনো তাদের অনুষ্ঠান পালন করে।

সম্রাট চিওপসও সভাসদের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তার চোখে মুখে এক ধরনের ব্যাঙ্গাত্মক জিজ্ঞাসা : ‘এই সংবাদ কি তোমাদেরকে নিদারুণ যন্ত্রণায় ফেলে দিয়েছে নাকি? যদি আমার পিরামিড না হয় তাহলে তোমাদেরটা হবে। আহ! কী ধরনের দাসত্ব ভাব তাদের চেহারাগুলোতে এখন ফুটে উঠেছে। আমি যখন আরো বয়স্ক হবো আরো কঠিন হবো তখন কতোদিন এই ভাব থাকবে?’

কোনো কথা না বলেই এমনকি সভাসদের চেহারার দিকে না তাকিয়েই তিনি উঠে দাঁড়ালেন আর সভা ত্যাগ করলেন।

সম্রাট চলে যাওয়ার পর তারা একা হয়ে পড়লেন। একে অপরের মুখের দিকে তাকালেন।

‘কী হতে যাচ্ছে আমাদের সাথে?’

তারা ফিসফিস করে বললো।

‘এটা কী ধরনের দুর্ভাগ্য?’

মন্ত্রিপরিষদের একজন সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আরেকজন বারান্দায় দেয়ালের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সর্বোচ্চ ধর্মযাজকের চোখে পানি।

বাইরে মরুভূমির বাতাসে একটা বালির চক্র ঘুরতে লাগলো। তারা চোখে মুখে হতবুদ্ধিতা নিয়ে বালির সেই ঘূর্ণির দিকে তাকালো, যেটা ঘুরতে ঘুরতে উপরে স্বর্গের দিকে চলে যাচ্ছে।

তারা সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। তাদের সকলের চোখে-মুখে একটাই কথা ভেসে বেড়াচ্ছে, ‘ও আমাদের সম্রাট, তুমি কোনো উপায়ে সর্বোচ্চ আসনে যাবে। যখন সেই অন্তিম ক্ষণটা আসবে তখন কীভাবে তুমি আকাশের চূড়ায় আরোহণ করবে আর নক্ষত্র হয়ে থাকবে অন্যান্য সব ফারাওদের মতো। তুমি কীভাবে আমাদেরকে প্রজ্বলিত করবে।

তারা পরস্পরে খুব মোলায়েমভাবে কথা বলছিলো। তারপর তারা ভিন্ন ভিন্ন পথে চলে গেলো। দু জন চলে গেলো সম্রাটের মা খেন্তকাসের সাথে একটা বৈঠকের আয়োজনের জন্য, একজন চলে গেলো সুরা পান করতে, প্রধান কারিগর আর প্রকৌশলী চলে গেলো ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষে যেখানে অনেক পুরাতন একটা আর্কাইভ আছে সেখানে অনেক বয়স্ক একজন এক চক্ষু শাস্ত্রপণ্ডিতের সাথে দেখা করতে।

শরতের বাকি সময়টায় কেউ আর পিরামিড নিয়ে কোনো কথা বললো না।

এমন কি রাষ্ট্রদূতদের অভ্যর্থনা কক্ষেও যেখানে চিওপস সুরা পান করে মাতাল হয়ে থাকেন। যেনো মনে হলো একজন রাজপতির জন্য বিদেশীদের সামনে এ বিষয়টা আলোচনা করা উপযুক্ত না।

সম্রাট বাকি যাদের তার এই পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন তারা ভাবছিলো এটা হয়তো সম্রাটের একটা পরিহাস। এমন কি কখনো কখনো ভাবা হচ্ছিলো যে বিষয়টা নিয়ে আর সম্রাটের সাথে আলোচনা না করাটাই ভালো হবে। তাহলে হয়তো দীর্ঘ সময় প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা না বলাতে এক সময় এটা আস্তে আস্তে বালির চরে ডুবে যাবে।

কিন্তু আরেক পক্ষের চিন্তা-ভাবনা ছিলো আরো ভয়ঙ্কর! তারা দিন রাত শুধু এটা নিয়েই ভাবছিলো। আলোচনা করছিলো।

কেউ কেউ রাজমাতার কক্ষ থেকে তেমন উৎসাহব্যাঞ্জক কোনো সাড়া না পেয়েও তার সাথে আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।

একদল চলে গেলো আর্কাইভ ঘরে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করার জন্য। আর্কাইভ ঘরে তারা যতোই গবেষণা করছিলো কাজ তাদের জন্য ততোই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো। বেশ ভালো কিছু প্যাপিরাস (এক ধরনের বিশেষ পাতায় লেখা পাণ্ডুলিপি) হারিয়ে গেছে। বাকিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এমন কি তখনো বিদ্যমান কিছু স্ক্রোল (বিশেষ পাতায় লেখা মোড়ানো লিপি) যার আশে পাশে কিছু নোট লেখা ছিলো সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে।

তবে একই সময় অগ্রভাগ ছেঁড়া কিছু প্যাপিরাস থেকে তারা প্রায় সব রকমের তথ্য জোগাড় করতে পারলো যেগুলো তাদের গবেষণার সাথে সম্পর্কিত ছিলো। সে সব তথ্যের মধ্যে পিরামিডের বিষয়ে যাবতীয় খোঁজ খবর ছিলো : পিরামিডের পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী এর গঠনশৈলী, প্ৰথম পিরামিডের ইতিহাস, দ্বিতীয় পিরামিড, পঞ্চম; এভাবে উত্তরাধিকারীভাবে একের পর এক, পিরামিডের ভিত্তি প্রস্তরের বৃদ্ধি, এগুলোর উচ্চতা, মৃতদেহকে মমি করে সব সময় সতেজ রাখার গোপন সূত্র, পিরামিডের ভেতর প্রথম লুটতরাজের কাহিনী, বিভিন্ন আকারের পাথর টেনে টেনে স্থাপন, ভেতরে প্রবেশ বন্ধ করার জন্য পাথর দিয়ে দরজা তৈরি, মৃত্যুর রায়, দেয়ালে নানা ধরনের চিত্রাঙ্কন যেগুলো আঁকা হয়েছিলো বিশেষ রহস্যময়ভাবে যার অর্থ উদঘাটন দুঃসাধ্য, ইত্যাদি নানা বিষয়ে তারা অনেক তথ্য সংগ্রহ করলো।

এ সব তথ্য সবগুলোই ছিলো খুব সুস্পষ্ট।

কিন্তু তাদের গবেষণার মূল লক্ষ্যটাই এগুচ্ছিলো না। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্যাপিরাসের জঙ্গল। আর সেগুলো তাদের দিকে গর্তের ভেতর কাঁকড়া বিছের বিষাক্ত হুলের মতো করে পিট পিট করে তাকাচ্ছিলো। যেনো ধারণার উপর পিরামিড হয়েছিলো তারা সেটা খুঁজছে, এগুলোর আসলে মূল অস্তিত্বের কারণ কী? কেন এগুলো তৈরি হয়েছিলো, এর যুক্তিসঙ্গত একটা ঐতিহাসিক শক্ত ব্যাখ্যা তারা খুঁজছিলো। কিন্তু এখানেই এসে তারা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। আসলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া প্যাপিরাসের মাঝেই এ তথ্যগুলো অত্যন্ত গোপনে লুকিয়ে আছে।

তারা আগে কখনোই এ ধরনের মানসিক শ্রমের মুখোমুখি হয় নি। এটা তাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা হোক, তাদের গবেষণার লক্ষ্য বার বার ব্যর্থ হওয়ার পরেও শেষ পর্যন্ত তারা একটা ধারণা দাঁড় করতে পেরেছে।

মূল বিষয়টা যদি এমন নাও হয় তাহলে এটা হবে তার প্রতিকৃতি বা ছায়া জাতীয় কিছু।

তারা দীর্ঘ সময় এটা নিয়ে অনেক আলোচনা পর্যালোচনা করলো। একটা সময় তারা বুঝতে পারলো যে, তারা আসলে যে বিষয়টা খুঁজছে সে ব্যাপারে পুরোপুরিই সচেতন আছে।

‘আসলে সব কিছুই তো পরিষ্কার।’ ফারাও এর সাথে আলোচনায় বসার আগে তাদের গোপন রাজনৈতিক বৈঠকে সর্বোচ্চ ধর্মীয় পুরোহিত বললো।

‘সমস্যাটার মূলে কী আছে সেটা আমরা এর মধ্যেই জেনে গেছি। নয়তো কেন সম্রাট সেই কথাটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে আমি এখন আর সেটা উচ্চারণ করতে চাই না। আমরা ভীত হয়ে পড়েছিলাম।’

দু দিন পর অতিমাত্রায় রাত জাগার বিমর্ষতা নিয়ে তারা সম্রাট চিওপসের সাথে দেখা করলো। ফারাওকেও তাদের মতো মলিন লাগছিলো। ফারাও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আর তাতে সভাসদের সবাই অবাক হয়ে ভাবলো হয়তো সম্রাট পুরো বিষয়টা ভুলে গেছে। তাদের মনে হলো কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই তারা একটা জ্বলন্ত অঙ্গারের দিকে উড়ে যাচ্ছে।

এর মধ্যেই সর্বোচ্চ পুরোহিত কথা বললো।

‘আপনার পিরামিড তৈরির বিষয়ে আপনি যে উদ্বেগ দেখিয়েছিলেন আমরা সে বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলতে চাই মাননীয়।’

চিওপস কোনো রকম বিস্মিত বা অবাক হওয়ার মতো কিছুই দেখালেন না। কথা বলার মাঝখানে বাধা দিয়ে এটাও বললেন না, ‘আপনি কী বলতে চান?’

তিনি শুধু তার ঘাড়টা একটু নাড়লেন। যার অর্থ হলো, ‘আমি শুনছি!” প্রথমে সর্বোচ্চ পুরোহিত কথা বলা শুরু করলেন। তারপর একে একে বাকি সবাই তাকে অনুসরণ করলো।

তারা প্যাপিরাসগুলো পড়ে যে সমস্ত পরিশ্রম সাধ্য তথ্য পেয়েছে তার একটা বর্ণনা দিলো। তারা ফারাও যোসের দ্বারা নির্মিত প্রথম পিরামিডের কথা বললো যেটা মাত্র পঁচিশ হাত উঁচু ছিলো। এরপর ফারাও সেখেমখাটের ক্রোধের কথা বর্ণনা করলেন। তার প্রকৌশলী যখন পিরামিড নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলো আর সে পিরামিডটা ছিলো আগের পিরামিডের চেয়ে উচ্চতায় ছোট তখন ফারাও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে প্রকৌশলীকে চাবুক পেটা করেছিলো। এরপর সভাসদ পরবর্তীতে পিরামিড নিয়ে আর কী কী পরিকল্পনা হয়েছিলো তার একটা বিসদ বর্ণনা দিলো। বিশেষ করে যেটা প্রকৌশলী ইমহোটেপ দিয়ে পরিকল্পিত হয়েছিলো। তারা পরিবর্তিত সেই পিরামিডের নানা রকম গ্যালারি, শবদেহ রাখার ঘর, গোপন কুঠুরিসমূহ, পাথরের দরোজা যা দিয়ে ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। সেনফিরোকে দিয়ে তৈরি তিনটা পিরামিডের মধ্যে একটা ছিলো যার দৈর্ঘ্য পাঁচশো হাত আর উচ্চতা ছিলো তিনশো হাত। যেটাকে আপনি শ্বাসরুদ্ধকর বলতে পারেন।

তারা যখনই প্রত্যেকটা বিষয়ের বর্ণনা দিচ্ছিলো তখনই আশা করছিলো এই বুঝি সম্রাট বাধা দিয়ে বসেন।

‘আমার কাছে কেন এ বিস্তারিত বিষয় নিয়ে এসেছো!”

এটা ভাবতে ভাবতে তারা দেখলো কথার মাঝখানে কোনো রকম বাধা সম্রাটের কাছ থেকে এলো না।

তখন প্রধান পুরোহিত বেশ দরাজ গলায় বললেন, ‘আপনি বেশ অবাক হবেন যে এ সবগুলো বিষয়ের সাথে আমার কী না ঘটেছে? আপনিই সঠিক জাহাপনা..

সম্রাটের নীরবতায় সভাসদ আরো উৎসাহিত হয়ে সব কিছুই আরো বিস্তারিত আলোচনা করলো। তারা আগে থেকেই মূল কোনো বিষয়ে প্রশ্ন আসতে পারে সেটা জানতো।

তারা কোনো রকম পিছু না হটেই ব্যাখ্যা করলো যে, যদিও পিরামিড একটা চমৎকার সমাধি ক্ষেত্র। কিন্তু তারা তাদের গবেষণায় দেখেছে প্ৰথম থেকেই পিরামিড তৈরির সময়ে এর সাথে মৃত্যু কিংবা সমাধি কবরের কোনো সম্পর্ক বা উদ্দেশ্য ছিলো না। এটা নিজে নিজেই স্বাধীনভাবে গড়ে উঠেছিলো। আর এর সাথে ছিলো বিশুদ্ধ চিন্তা।

এই প্রথমবারের মতো চিওপসের মুখে প্রাণবন্তের ছাপ দেখা গেলো। তাদের সবাইকে আনন্দিত করে চিওপস বললেন, ‘আশ্চর্য!’

আসলে প্রধান পুরোহিত তার কথাকে আরো গুরুত্ব দিয়ে বললো, ‘আমরা আপনাকে আরো অনেক কিছুই বলবো যেটা আপনার কাছে আরো আশ্চর্য মনে হবে।’

পুরোহিত তার রক্ত শুন্য পুরাতন হৃৎপিণ্ডের ভেতর থেকে একটা লম্বা শ্বাস নিলো।

‘মহামান্য পিরামিডের পরিকল্পনাটা জন্ম নিয়েছিলো একটা ক্রান্তিলগ্ন সময়ে।’

কথার মাঝে মাঝে সঠিক সময়ে একটু থামাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুরোহিত এ বিষয়ে খুব সচেতন ছিলো। কারণ, কথার মাঝে সঠিক সময়ের বিরতি বক্তব্যের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। যেভাবে মেয়েদের চোখের পাপড়িতে আইলিসের ছোঁয়া তাদের চোখের রহস্যময়তাকে আরো বহুগুণ বৃদ্ধি করে।

‘হ্যাঁ এটা ছিলো খুবই সঙ্কটময় মুহূর্ত।’ কিছুক্ষণ থেমে পুরোহিত আবার বললেন।

‘ধারাবাহিক ইতিহাসে তখন ফারাওনিক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। এটা সম্ভবত নতুন কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার ছিলো না। কারণ পুরাতন প্যাপিরাসগুলোতে ভাগ্যের এমন অনেক বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ আছে। তবে সে সময় নতুন যে বিষয়টা ঘটেছিলো সেটা একেবারেই ব্যতিক্রম আর স্বতন্ত্র ছিলো। সেই সঙ্কটটা ছিলো এক রকমের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে তৈরি। সেটা কোনো ধরনের দারিদ্রতা কিংবা অসময়ে নীলনদের পানি প্লাবিত হওয়া অথবা মহামারি প্রকট আকারে দেখা দেওয়া থেকে তৈরি হয় নি। ইতোপূর্বে যেভাবে হয়েছিলো। বরং সেটা হয়েছিলো অতি প্রাচুর্যতার কারণে।’

‘জ্বি অতি প্রাচুর্যতার জন্য।’ তার সাথে সাথে হেমিউনি প্রতিউত্তর করলো। ‘অন্য কথায় বলা যায় এটা ছিলো অতি স্বচ্ছলতার কারণ।’

চিওপস বারো ডিগ্রি কোণাকুণি করে তার চোখের ভ্রুকে উঠিয়ে প্ৰধান প্রকৌশলীর দিকে তাকালো।

‘শুরুতেই এই অবস্থা থেকে একটা পরিষ্কার সম্যক ধারণা নেওয়া ছিলো কঠিন। সে বলতে লাগলো।

“অনেক বুদ্ধিমান পণ্ডিত যারা ফারাও এর খুবই বিশ্বস্ত ছিলো তারা যখন প্রথম বিষয়টা ফারাও এর কাছে বর্ণনা করলো তখন তাদের কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পুরস্কৃত করা হলো আবার কাউকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো নির্বাসনে। কিন্তু তারা যেনো ব্যাখ্যাটা দিয়েছিলো এই সঙ্কটকালীন সময়ের সেটা হলো, এই অতি উৎকর্ষতা, স্বচ্ছলতার কারণে জনগণ অনেক বেশি স্বনির্ভর আর স্বাধীনচেতা হয়ে পড়েছিলো। তারা রাজকর্মচারীদের বিরোধিতা শুরু করলো, সাথে সাথে ফারাওকেও। আস্তে আস্তে এটা বাড়তে থাকলো। দিন যেতে যেতে সবাই বুঝতে পারলো এটা এমন একটা সমস্যা যেটার মুখোমুখি তারা ইতোপূর্বে কখনো হয় নি। তখন শুধু একটা প্রশ্নই ছিলো যার উত্তর সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। সেটা হলো কীভাবে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এর সমাধানটা আসলে কোথায়।

ফারাও তার রাজকীয় জ্যোতির্বিদ আর যাদুকরদের পাঠিয়ে দিলেন সাহারা মরুভূমিতে যাতে তারা সেখানে নীরবে ধ্যান করে চিন্তা-ভাবনা করে এর একটা সমাধান বের করতে পারে। চল্লিশ দিন পর যে সমস্ত লোকজন তাদের সাথে যোগাযোগ করতো তাদের মাধ্যমে ফারাও আরো ভয়াবহ একটা খবর পেলেন যেটা তিনি কখনো আশা করেন নি।

তাকে জানানো হলো এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে রাষ্ট্রের এই উন্নতি, সমৃদ্ধিকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।

ফারাও আর তার রাজপ্রাসাদের সবাই গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন।

এ সমৃদ্ধি সব কিছু ধ্বংস করে ফেলতে হবে?

কিন্তু কীভাবে?

বন্যা! ভূমিকম্প, সাময়িকভাবে নীলনদকে শুকিয়ে ফেলা।

অনেক ধরনের পরিকল্পনাই করা হলো। কিন্তু কোনোটাই তার মনোপুত হলো না।

তাহলে কি যুদ্ধ!

যুদ্ধ করেই এ সব ধ্বংস করতে হবে। যুদ্ধতো একটা দু ধারি তলোয়ার। এতে তো হিতে বিপরীত হতে পারে। বিশেষ করে উদ্ভুত এই পরিস্থিতিতে।

তাহলে কী করা যায়?

অথচ এ পরিস্থিতিতে কিছু না করে বসে থাকাও সম্ভব না। একটা রাস্তাই তো আছে। আর সেটা হলো মরুভুমির এই প্রত্যাদেশ অনুসরণ করা। নয়তো আশু এই বিপদে ধ্বংস অনিবার্য।

একটা গুজব ছিলো যে হারেমের একজন বিজ্ঞ মুরব্বি রেনেফার সে বেশ অদ্ভুত একটা কৌশলের কথা বলেছিলো যা দিয়ে মিশরের এই ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধি আর উন্নতিকে ঠেকিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যা মিশরের জন্য ধ্বংস ডেকে এনেছিলো।

বাইরের রাষ্ট্রদূতরা মেসোপটেমিয়ায় অর্থনৈতিক উৎপাদনের জন্য সমানুপাতে বিশাল এক পানির উৎস তৈরির কাজ করছিলো। ব্যাপারটা যদি তাই হয় সম্ভবত সে রকমই তাহলে মিশরেরও উচিৎ তার জনসংখ্যার অতিরিক্ত শক্তিটুকু ধ্বংস করে ফেলা।

তার উচিৎ কল্পনাতীত এমন বিশাল এক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যেখানে অধিকাংশ লোক অংশগ্রহণ করবে আর তাতে অবাধ্য জনগণের অতিরিক্ত শক্তিটুকু ব্যয় করা হবে। এক কথায় এমন এক প্রকল্প গ্রহণ করা যার উদ্দেশ্য মুখ্য নয় কিন্তু তাতে শরীর এবং আত্মার ধ্বংস সাধন হবে। আর এটা নতুন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য একটা সমাধান।

ফারাও-এর মন্ত্রিরা নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এলো সে সময়।

মিশরকে ঘিরে চারদিক দিয়ে একটা অকল্পনীয় গভীর সুড়ঙ্গ করতে হবে যেটা পানি দিয়ে কানায় কানায় ভর্তি থাকবে।

তবে মন্ত্রিপরিষদের সকলের পরিকল্পনায় যদিও দেশপ্রেম, আধ্যাত্মিকতা ও দৃঢ়তাপূর্ণ ছিলো, কিন্তু এর পরেও তাদের সকল পরিকল্পনা ফারাও প্রত্যাখ্যান করলেন।

নতুন আর কী পরিকল্পনা করা যায় যেটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম যেটা শেষ হবে কিন্তু তারপরেও চলতে থাকবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে যেনো প্রকল্পটা যুগে যুগে নিজে নিজেই আবার নতুনত্বে সজ্জিত হবে।

এভাবেই স্বয়ং সম্রাট, রাজন্যবর্গ নথি লেখক সবাই মিলে ধীরে ধীরে একটা শবদেহের স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। একটি প্রধান মিনার যেখানে রাজাধিরাজকে সমাহিত করা হবে।

ফারাও এ পরিকল্পনাটা শুনে খুব মুগ্ধ হলেন।

মিশরের মূল আধ্যাত্মিক কেন্দ্র কোনো ধর্মীয় দুর্গ বা রাজপ্রাসাদ হবে না, সেটা হবে একটা মিনার, শবদেহের স্মৃতিস্তম্ভ।

ধীরে ধীরে মিশর এটা দিয়ে সারা পৃথিবীতে পরিচিতি পাবে।

এটা তৈরি হয়েছিলো মহান এক পরিকল্পনা দিয়ে, আর তা হলো মহান ফারাও এবং মৃত্যু, অথবা আরো সুন্দর এবং নির্ভুলভাবে বলতে গেলে মৃত্যুর পর মহান ফারাও-এর স্বর্গে উত্থান।

এটা এমন দৃশ্যমান হবে যে অনেক দূর থেকেও একে দেখা যাবে। সকল ফারাও এর নিজ নিজ একটা করে পিরামিড থাকবে।’

ফারাও চিওপসের সামনে এতোটুকু বর্ণনা শেষ করে রাজপ্রাসাদের মূল পুরোহিত হেমিউনি বেশ দীর্ঘক্ষণ নীরবতা পালন করলেন। তারপর আবার কথা বলা শুরু করলেন।

‘সুতরাং মহামান্য ফারাও মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের আগেই এ জগতে পিরামিডের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। অন্য কথায়, আত্মাকে রক্ষার পূর্বেই এটা শরীরকে রক্ষা করবে।

হেমিউনি আবার চুপ হলেন। তারপর আস্তে আস্তে কথা বলার আগে একটু শ্বাস টেনে নিলেন।

‘মহামান্য প্রভু প্রথমত পিরামিড হলো একটা ক্ষমতা, একটা ঐশ্বর্য। মহামান্য প্রভু ফারাও এটা আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত অভিভাবক। আপনার গোপন রক্ষা কর্তা, আপনার সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী। এটা যতো উঁচু হবে ততো আপনার উদ্দেশ্য, মান-মর্যাদা পরিলক্ষিত হবে।

হেমিউনি খুব আস্তে আর নরমভাবে কথা বলছিলো। কিন্তু তার ভেতরের উত্তেজনা আর ভীতি ঠিক টের পাওয়া যাচ্ছিলো।

‘পিরামিড হলো এমন একটা স্তম্ভ যা সকল ক্ষমতাকে ধারণ করে। এটা যদি নড়বড়ে হয়ে পড়ে তাহলে সবকিছু ভেঙে যাবে।’

হেমিউনি খুব রহস্যপূর্ণভাবে তার হাত নাড়িয়ে এমন একটা ইশারা করলো আর তার চোখ জোড়া ধক করে এমনভাবে জ্বলে উঠলো যে মনে হলো সবাই একটা ধ্বংস প্রাপ্ত বিস্তীর্ণ প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘সুতরাং আমার প্রভু ঐতিহ্যকে রোধ করবেন না। নয়তো আপনার সাথে সাথে আমরাও নরকের অনন্ত তলে পতিত হবো।’

হেমিউনি বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে তার চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। যা দিয়ে বোঝা যায় যে, সে তার কথা-বার্তা শেষ করেছে। অন্যরাও হেমিউনির মতো মৃত বিষণ্ণ স্বরে কথা বললো।

কেউ কেউ মেসেপটোমিয়ার সেই খালের কথা আবার বললো।

কেউ আবার যোগ করলো যে, পিরামিড হলো দেশের জন্য সার্বজনীন স্মৃতি বাহক। একদিন সময়ের সাথে সাথে সব কিছু বিবর্ণ হয়ে যাবে। এই নথিপত্র, যুদ্ধ, বন্যা হৈ হুল্লোড়, রাজপ্রাসাদ সবকিছুই বিস্মৃতি হয়ে পড়বে। কিন্তু এই পিরামিড সে একাই দাঁড়িয়ে থাকবে। সব কিছুই ক্ষয় প্রাপ্ত হবে কিন্তু এ পিরামিড একাই মরুভূমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। পুরাতন জ্যামিতিকদের দিয়ে তৈরি এটা একটা স্বর্গীয় প্রতিকৃতি। আপনি এর প্রতিটি অংশের সাথে মিশে থাকবেন। এর সুউচ্চ চূড়া এর বাঁধানো পিঠ এর নিম্ন ভাগ সব কিছুর সাথে। পিরামিডের প্রত্যেকটি নাম না জানা পাথর তাদের কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে আপনাকে রক্ষা করবে মহান প্ৰভু।’

তারা যখনই কোনো কাজের স্পষ্ট রূপ রেখা দাঁড় করায় তখনই এর সাথে তারা স্বাভাবিক প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলোও উল্লেখ করে।

ফারাও চিওপস বুঝতে পারলেন এ পিরামিড ব্যবসার সাথে তার সভাসদের অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারটাও জড়িত। পিরামিড নিয়ে সভাসদের অতি গুরুত্ব মনোভাবের মাঝে কোনো ছলনা নেই। তিনি আরো বুঝতে পারলেন এটা তার পিরামিডই নয় তার সভাসদ সকলের।

চিওপস তার ডান হাতটা উঁচু করে মেলে ধরে সভাসদকে বুঝিয়ে দিলেন

যে আলোচনা আজকের মতো শেষ। সভাসদের সকলের সদস্য তাদের হৃদয়ের ধুকধুকানি দিয়ে শুনতে পেলো সম্রাট চিওপসের শুষ্ক ঠাণ্ডা নীরব সিদ্ধান্ত বাণী।

‘একটা পিরামিড তাহলে নির্মাণ করো। এটা যেনো হয় আগের সবগুলোর চেয়ে উঁচু আর সুমহান।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *