উদ্ভট শখ
অফিসে আসার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একটা টেলিফোন কল পেল তপন দত্ত। টেলিফোনটা বড়োবাবুর টেবিলে। ডাক পেয়ে তপন উঠে গেল ফোন ধরতে। টেলিফোনে অন্যপ্রান্তের কথাগুলি শুনতে শুনতে তপনের হৃৎপিণ্ডটা ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। সেকেন্ড দশেক বাদে রিসিভার নামিয়ে রেখে সে উত্তেজিত সুরে বড়োবাবুকে বলল, ‘মুখুজ্যেদা, আমায় একবার বেরতে হবে। আমার পিসিমা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ফোনে বলল ওঁর পাশের বাড়ি থেকে।’
তপনের উৎকণ্ঠিত ভাব দেখে বড়োবাবু বলেন, ‘হ্যাঁ যান। কী হয়েছে?’
তপন বলল, ‘খুব শ্বাসকষ্ট। বুকে ব্যথা। পিসিমার হার্ট তো ভালো নয়।’
বড়োবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডাক্তার এসেছে?’
তপন জানায়, ‘বলল তো এনেছে। পাড়ার ডাক্তার।’
বড়োবাবু বললেন, ‘না না। ওঁকে স্পেশালিস্ট দিয়ে দেখান।’
তপন বিমর্ষ ভাবে বলে, ‘অনেকবার তো বলেছি। পিসি রাজি হয় না। পুরনো কালের লোক। পাড়ার ডাক্তারেই বিশ্বাস। সাহেবি ডাক্তারে ভয় পায়। কী করি? বেশি জোর করা যায় না। বড্ড জেদী মানুষ। আমি তাহলে যাই?’
বড়োবাবু তৎক্ষণাৎ সম্মতি দিলেন, ‘হ্যাঁ যান। আপনার হাতে কোনো জরুরি কাজ থাকলে ওই নিতাইকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন। বলবেন, আমি বলেছি।’
পিসিমার বাড়ি যাবার পথে বাসের সিটে বসে তপন ছটফট করে। মনে মনে ডাকে- হে ভগবান!
পিসিমার বাড়ি ভবানীপুরে। হাজরা পার্কের কাছে নেমে বড়ো রাস্তা থেকে পাশে ঢুকে যাওয়া একটা সরু রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক হেঁটে পিসির বাড়ি পৌঁছয় তপন।
বাড়িটা পিসির নিজের। মাঝারি আকার। দোতলা। নীচতলাটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। দোতলায় থাকেন নিস্তারিণীদেবী অর্থাৎ তপনের পিসিমা।
নিঝুম বাড়ি। থমথম করছে। কারো গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। কী ব্যাপার?
তপন সোজা দোতলায় উঠে গেল।
সিঁড়ির পাশের ঘরটায় বসে ছিলেন আশুবাবু এবং বাগচীমশাই। পাশাপাশি গম্ভীর মুখে। আশুবাবু পাশের বাড়িতে থাকেন। ওঁর ছেলেই টেলিফোন করেছিল তপনকে। বাগচীমশাই পিসির ভাড়াটে।
তপনকে দরজায় দেখে আশুবাবু তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। তপন কাছে গিয়ে উদবিগ্ন চাপা সুরে জিজ্ঞেস করল— ‘পিসি?’
আশুবাবু নীচু স্বরে জবাব দিলেন : ‘ঘুমুচ্ছেন। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।’
—‘কেমন অবস্থা?’ প্রশ্ন করে তপন।
আশুবাবু ডান হাতটা বরাভয়ের ভঙ্গিতে তুলে বললেন, ‘মনে হচ্ছে এ যাত্রা ফাঁড়া কাটল। তবে ডাক্তার বলেছে, আরও চব্বিশ ঘণ্টা না গেলে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না।’
কথাগুলো কানে যাওয়া মাত্র তপনের সব উদবেগ উত্তেজনায় যেন ঠান্ডা জল ঢেলে দেওয়া হল। গ্রীষ্মের দুপুরে ঘেমে নেয়ে ধড়ফড় করে ছুটে আসার ক্লান্তিটা টের পেল এতক্ষণে। পা দুটো থেকে যেন শুষে নিচ্ছে শক্তি। সে ওই ঘরেই একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল।
তপনের অবস্থা দেখে আশুবাবু ভরসা দিলেন ‘আহা অত নার্ভাস হচ্ছ কেন? ডাক্তার চাটুজ্যে যখন বলেছেন মনে হচ্ছে এ যাত্রা টিকে যাবেন তখন নির্ঘাত টিকেই যাবেন। ওই ‘মনে হচ্ছে টুকু কথার কথা। ওটা বাদ দিতে পার। অনেক দিন তো দেখছি আমাদের ডাক্তারবাবুকে। আশ্চর্য ক্ষমতা। তবে হ্যাঁ, দিন পনেরো কমপ্লিট রেস্ট নিতে বলেছেন। আর ঠিকঠাক খাওয়া চাই সময়মতো। তোমার পিসিমা কিছুদিন বড্ড অনিয়ম করেছেন। মোতির মা বলছিল।
তপনের মাথায় আশুবাবুর শেষ কথাগুলো আর ঢোকে না। কেমন ফাঁকা লাগছে মগজটা। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক থেকে। সে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়।
এবার বাগচীমশাই কথা বললেন, ‘যাও-না, পিসিকে একবার দেখে এসো।’
বাগচীমশায়ের কথায় তপনের চটক ভাঙে। সে সামলে নেয় নিজেকে। বলে— ‘ও হ্যাঁ যাই।’ সে পা টিপেটিপে যায় পিসির শোবার ঘরের দরজায়।
খাটে চিত হয়ে শুয়ে আছেন নিস্তারিণী দেবী। বুক অবধি চাদরে ঢাকা। চোখ বোজা। লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে ধীর লয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস বইছে। খাটের পাশে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার। টেবিলে কিছু ওষুধপত্র। ফ্যানটা ঘুরছে জোরে। পায়ের কাছে চেয়ারে বসে প্রৌঢ়া মোতির মা। একাগ্রদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পিসিমার দিকে। সাদা থান পরা বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি যেন। বাড়িতে যে ঝড় বয়ে গেছে তার ছাপ মোতির মায়ের চোখেমুখে।
তপন দরজায় আসতে মোতির মা এক ঝলক ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তপনকে। ফের তার চোখ ফিরে গেল পিসিমার ওপর।
তপন জানে, যতদিন না পিসিমা সুস্থ হয়ে খাট ছেড়ে নামবেন, মোতির মা কদাচিৎ তাঁকে চোখের আড়াল করবে। দিনে রাতে এই ঘরেই কাটাবে। পিসির সব কাজ করে দেবে। বাইরে থেকে নার্স ভাড়া করে আনা সত্ত্বেও মোতির মা থাকে। এর আগেও এই ব্যাপার ঘটেছে।
একটা বিপুল হতাশা আচ্ছন্ন করে তপনকে। ইস এবারেও হল না। গেল সুযোগটা।
তপন পিসির কাছে যায় না। মস্ত ঘরখানার এক কোণে অবসন্ন ভাবে একটা চেয়ারে বসে। মাথায় চিন্তার ঝড়।
ওঃ আর কতদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে ছোটেলালকে? বেচুকে? শুধু হতাশা নয়। প্রচণ্ড রাগ ও মরিয়া ভাব গুমরে ওঠে তার বুকের ভিতর। উঃ এভাবে আর কতদিন যে চলবে?
খানিকক্ষণ চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে থেকে তপন পিসির ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ফের গিয়ে বসে আশুবাবু ও বাগচীমশায়ের কাছে। পিসির ঘর তার তখন অসহ্য ঠেকছিল।
—‘কে ডাক্তার ডাকল?’ জানতে চায় তপন।
আশুবাবু বললেন, ‘মোতির মা। নিস্তারদির বুকে ব্যথা উঠতেই প্রথমে ছুটে যায় ডাক্তারবাবুর কাছে। তারপর আমাদের খবর দেয়। খুব বুদ্ধি ওর।’
—‘হুঁ। কিছু আনতে হবে?’ জিজ্ঞেস করে তপন।
আশুবাবু বললেন, ‘আপাতত দরকার নেই। আমার ছেলে মিন্টু, ওষুধ ইনজেকশন অক্সিজেন সব এনে দিয়েছে। তোমায় টেলিফোন করল তারপর জানে, তুমি আসতে আসতে দেরি হয়ে যাবে। মিন্টু দুজন নার্স ঠিক করতে গেছে। দিনে রাতে ডিউটি দেবে দিন পনেরো।’
—‘সত্যি মিন্টু খুব কাজের,’ জানায় তপন, ‘তবে আমি দেরি করতাম না। তেমন দরকারে ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসতাম। বড়ো জোর মিনিট পনেরো লাগত।’ আশুবাবু বললেন, ‘কিছু বলা যায় না হে। যা পথঘাট, ট্রাফিক জ্যাম। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই।’
—‘তা বটে।’ সায় দেন বাগচীমশাই।
আশুবাবু এবং বাগচীমশাই এবার বিদায় নিলেন। মোতির মাকে বলে গেলেন, কিছু দরকার হলেই যেন খবর দেয় তাঁদের। তপন সেখানে আরও ঘণ্টাখানেক বসে রইল গুম মেরে। মধ্যে এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট সামনে রেখে গেল পিসির ছোকরা কাজের লোক রাজু। অন্যদিন মোতির মা নিজে হাতে চা দেয়। আজ অবশ্য সে মা ঠাকরুনকে ছেড়ে নড়বে না। যতক্ষণ না নার্স আসে।
ঘণ্টাখানেক বাদে উঠে পড়ল তপন। মোতির মাকে বলে এল— ‘দরকার হলেই আমায় খবর দিয়ো। অবশ্য আমি রোজই আসব কিছুদিন।’
তপন বেরিয়ে পড়ে। অত্যন্ত ক্ষুব্ধ চিত্তে।
তপন কেন ক্ষুব্ধ? কী চায় সে? কারণগুলো জানানো যাক।
তপন দত্ত তিরিশে পা দিয়েছে। কলকাতায় কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে থাকে ছোটো একখানা ঘর ভাড়া নিয়ে। একাই থাকে। এখনও বিয়ে করেনি। বজবজে থাকেন তপনের বাবা মা। ছোটোখাটো সরকারি চাকরি করে তপন। ডালহৌসি পাড়ায় অফিস। নিস্তারিণী দেবী তার নিজের পিসিমা। বাবার একমাত্র ছোটো বোন।
তপনের বাবা স্কুলমাস্টার ছিলেন। কায়ক্লেশে সংসার চালিয়েছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন যতটা সম্ভব। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তপন তাঁর একমাত্র ছেলে।
বি. এ. পাস করে তপন আর পড়েনি। পড়াশুনা তার বেশি ভালো লাগত না। খেলাধুলো আর আড্ডায় মনোযোগ ছিল বেশি। বছর তিনেক বেকার ছিল। তখন ট্যুইশনি সম্বল করে বাপের হোটেলে থেকে চুটিয়ে আড্ডা দিত। তারপর এই চাকরিটা জোটে।
তপনের বাবা ছেলের কাছে হাত পাতেন না।
এই পিসির সঙ্গে তপনের ঘনিষ্ঠতা হয় কলকাতায় চাকরি নিয়ে আসার পর। বাবা তপনকে বলে দিয়েছিলেন, মাঝে মাঝে বিধবা নিঃসঙ্গ পিসির খোঁজখবর নিতে। সেই সূত্রেই পরিচয় ঘন হয়।
তপনের এই পিসির বয়স প্রায় সত্তর। তাঁর একটি মাত্র মেয়ে বিয়ের পর বিদেশে বাস করছে বহুকাল। মেয়ে দু-এক বছর অন্তর দেশে আসে মাকে দেখতে।
পিসি রীতিমতো ধনী। কলকাতা শহরে তাঁর দুটো বাড়ি। এ ছাড়া সোনাদানা, জমা টাকাও প্রচুর। পিসির মেয়ে বলে দিয়েছে যে মায়ের সম্পত্তি চাই না। কারণ সে বা তার স্বামী আর এদেশে ফিরবে না। তাদের কোনো অভাব নেই। সুতরাং মা তাঁর সম্পত্তি যাকে খুশি দান করতে পারেন।
তপন প্রথম প্রথম পিসির কাছে যেত দুটো ভালোমন্দ খাবার লোভে। এরপর পিসির টাকাকড়ির গন্ধ পেয়ে পিসিকে রীতিমতো তোয়াজ শুরু করে। নিঃসঙ্গ পিসিরও ক্রমে বেশ স্নেহ জন্মায় ভাইপোটির ওপর। তিনি কয়েক বছর আগে একদিন স্পষ্টই জানিয়েছিলেন যে তাঁর উইলে তপনের জন্য মোটা অর্থ বরাদ্দ করে রেখেছেন। মোতির মাও কিছু পাবে। আর বাকি সম্পত্তি পাবে এক অনাথ আশ্রম। যে-কোনো কারণেই হোক পিসির সঙ্গে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকদের কোনো সম্পর্ক নেই।
মোতির মায়ের বয়স প্রায় পঞ্চাশ। বিধবা। তার আপনজন কেউ নেই। নিস্তারিণী দেবীর আশ্রয়ে এসেছে বছর দশেক। সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে মনিব ঠাকরুনটিকে।
প্রচুর পয়সা থাকলেও পিসির জীবনযাত্রা খুবই সাদাসিধে। তিনি তপনকে বলেছেন, ‘তোর পিসেমশাই অনেক কষ্টে ব্যাবসা করে অবস্থা ফিরিয়েছিলেন। কিন্তু কখনো অযথা বড়োমানুষি করেননি। তাঁর রেখে যাওয়া বিষয়সম্পত্তি আমি সৎ কাজে দান করব। নষ্ট হতে দেব না। অবশ্য আমায় যারা ভালোবাসে, যত্ন করে, লোক ভালো, তাদেরও আমি বঞ্চিত করব না।’
পিসি অত্যন্ত একগুঁয়ে এবং নীতিবাগীশ। তপনের বেজায় ভয়, পিসি তার আসল হালচাল টের পেলে হয়তো একটি পয়সাও জুটবে না তার বরাতে। তাই সে প্রাণপণে পিসির সামনে ভড়ং বজায় রেখে চলে।
ছোটো থেকে তপনের মনে প্রচুর সাধ। ভালো ভালো খাওয়া, পরা, জিনিস কেনা। কিন্তু টানাটানির সংসারে এবং কড়া বাপের শাসনে সেসব সাধ আহ্লাদ মেটেনি। চাকরি পেয়ে শহরে এসে তার সুপ্ত বাসনাগুলো ডানা মেলে। কিছু খারাপ সঙ্গীও জুটেছে কলকাতায়। তাদের পাল্লায় পড়ে নানান বদখেয়াল কাঁধে ভর করেছে। রোজগার কম। এদিকে খরচের বহরটা বেশি। তাই বাজারে ধার জমেছে ঢের। সেসব ধারশোধের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না তপন। অফিসের ফান্ড থেকেও কিছু ধার নিয়েছে মিথ্যে বলে— বাবার অসুখে চিকিৎসার নামে ছোটেলাল এবং বেচু তার দুই প্রধান পাওনাদার।
কিছুটা ধার শোধ করা যায় শখের দামি জিনিসগুলো বিক্রি করে। এছাড়া অফিসের ফান্ড থেকে আরও ধার নিতে হবে। অবশ্য ধার শোধ করতে মাইনে আরও কম পাবে। খুব টেনে চালাতে হবে কয়েকবছর। সেটাও তার ইচ্ছে নয় মোটে। তবে এই আর্থিক সমস্যার সুরাহা হবে এবং আরও কয়েকদিন কাপ্তেনি চালিয়ে যাওয়া যাবে এমন একটি সহজ উপায় আছে— পিসিমা। অর্থাৎ পিসিমা যদি এখনই গত হন, তপনের হাতে তাহলে মোটা টাকা আসে এবং সে দুশ্চিন্তা-মুক্ত হয়।
কিন্তু সে আশাও যে কেবলই ফস্কে যাচ্ছে। মোতির মায়ের সেবাযত্ন এবং পাড়ার ডাক্তারবাবুর চিকিৎসার গুণ তার বাড়া ভাতে ছাই ঢালছে বারবার।
পিসিমা কিপ্টে নয়। পাড়ার লোককে দরকারে অনেক সাহায্য করেন কিন্তু পিসির থেকে আর ধার পাবার উপায় নেই। কারণ বছর পাঁচেক আগে তপন পিসির থেকে দশ হাজার টাকা ধার করেছিল কাপড়ের ব্যাবসা করবে বলে। সে টাকা শোধ হয়নি। সত্যি সত্যি ব্যাবসা দাঁড় করানোর মতো ধৈর্য বা খাটাখাটুনি করা তপনের ধাতে নেই। সহজে বড়োলোক হবার আশায় সেই টাকায় রেস খেলেছে। টাকা উড়ে গেছে কয়েক মাসে। টাকা শোধ দিতে না পারায় পিসি একটু চটেছিলেন। বলেছিলেন— ‘তোর দ্বারা ব্যাবসা হবে না। তোকে আর টাকা দেব না ব্যাবসায় লাগাতে।’ ভাগ্গিস পিসি জানতে পারেননি যে কীভাবে নষ্ট হয়েছে তাঁর টাকাগুলো।
মাসখানেকের মধ্যে তপনের পিসি আবার সুস্থ হয়ে উঠলেন।
আটটার ভিতর পিসির বাড়ি হাজির হলে খাসা জলখাবার জোটে। কখনো লুচি বেগুন ভাজা। কখনো-বা মোহনভোগ। পিসি অবিশ্যি নিজে খান মুড়ি-চিঁড়ে। তবে লোক খাওয়াতে ভালোবাসেন। যাকে-তাকে নয়। পছন্দের লোক হওয়া চাই।
তপন যখন লুচি খায় পিসি তখন খাবার টেবিলের অপর প্রান্তে চেয়ারে বসে একটা বড়ো পাথরের গেলাসে লেবু চিনির শরবত খান। একটু একটু করে। কথাবার্তা বলেন আর মাঝে মাঝে চুমুক মারেন। কখনো-বা সংসারের কাজে উঠে যান গেলাস টেবিলে রেখে। ফের এসে চুমুক দেন।
একদিন সকালে এমনি খেতে খেতে তপনের মনে হঠাৎ খেলে যায়— পিসি এখন উঠে গেছে। অর্ধেক খালি গেলাসটা পড়ে আছে টেবিলে। কেউ নেই কাছে। এসময়টা মোতির মা রান্নাঘরে থাকে। ওই গেলাসের শরবতে যদি টুক করে ফেলে দেওয়া যায় কোনো তীব্র বিষ। ব্যস কাজ হাসিল।
তারপরেই মনে জাগে— এরপর কিন্তু লোকে ঠিক সন্দেহ করবে। পুলিশে খবর দেবে। মৃতদেহ পোস্টমর্টেম হবে। জানা যাবে বিষের অস্তিত্ব। তখন? সে ধরা পড়ে যাবে। ফলে ফাঁসি। কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
ভিতরে ভিতরে তপনের অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে উঠেছে যে পিসিকে খুন করার চিন্তাও আটকাচ্ছে না তার বিবেকে।
কাল ছোটেলাল হুমকি দিয়েছে তপনকে। এই মাসে তপন ছোটেলালের ধারের সুদ গুনতে পারেনি। আসছে মাসে একসঙ্গে দুমাসের সুদ চাই। নইলে কীভাবে পাওনা আদায় করতে হয় ছোটেলাল জানে।
শুধু ছোটেলাল নয়, অন্য পাওনাদারদের তাগাদাও ক্রমে বাড়ছে। সমস্তটা নাহোক অন্তত কিছুটা ধার শোধ করা চাই।
মরিয়া তপনের মাথায় অনেক উদ্ভট চিন্তা খেলে। হয় পিসি নয় ছোটেলাল— দুজনের একজন অন্তত এখনই পটল তুললে সে আপাতত খানিক নিশ্চিন্ত হয়। ছোটেলালের কাছে কর্জের পরিমাণটা সবচেয়ে বেশি। লোকটা সাক্ষাৎ গুণ্ডা। ওকে একটি পয়সাও ফাঁকি দেবার উপায় নেই।
কিন্তু ছোটেলালকে বাগে পাওয়া কঠিন। সুতরাং পিসিই ভরসা। পিসিকে এখুনি দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার কত প্ল্যান যে তার মাথায় ঘোরে। কিন্তু তার ওপর বিন্দুমাত্র সন্দেহ পড়বে না এমন একটাও পথ দেখতে পায় না। অফিসে অনেকেই জানে যে বড়োলোক পিসির দৌলতে তপন বিলাসিতা করে। এত ধারের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে তার খুব প্রেস্টিজ যাবে।
তপন হঠাৎ একটা দিশে পেল। আচমকা!
টিফিনের সময় অফিসের ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছিল অনেকে। তপনের মন মেজাজ ভালো নেই। সে চুপচাপ বসে চা খাচ্ছিল। শুনে যাচ্ছিল অন্যদের কথা।
সেদিনকার দৈনিক সংবাদপত্রে একটা খবর বেরিয়েছিল। তাই নিয়ে জোর আলোচনা বেধেছে। খবরটা এই—
বড়োবাজারে এক ধনী ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে তার শোবার ঘরে। মনে হচ্ছে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। তবে খুন বা আত্মহত্যা বোঝা যায়নি। তিনতলায় একা থাকতেন বৃদ্ধ। সকালে তাঁকে মৃত দেখা যায়। বৃদ্ধ ইদানীং খুব ভুগছিলেন। পুলিশ বাড়ির লোকদের জেরা করছে। লাশ ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে।
সবজান্তা সাধন মণ্ডল ওই সূত্র ধরে লম্বা এক লেকচার জুড়ে দেয়। কোন বিষের কী লক্ষণ তাই নিয়ে। কী কী লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে কী বিষ খেয়েছে। তার বক্তৃতা শেষ হতেই মদন বলল, ‘ইস এমন বিষ কি নেই যা খাওয়ালে কেউ ধরতে পারবে না? পোস্টমর্টেমেও ধরা যাবে না?’
—‘উহুঁ।’ মাথা নাড়ে সাধন।
—‘আমি শুনেছি, আছে।’ মন্তব্যটা করে ইউনিয়ন লিডার জীবন হালদার। সে এই দলে বসেনি। ব্যস্ত হয়ে এসে টোস্ট আর চা খাচ্ছিল পাশের টেবিলে।
—‘কোথায় শুনেছেন?’ সাধন ভুরু কুঁচকে জীবনকে প্রশ্ন করে।
—‘একজনের কাছে শুনেছিলাম।’ নির্বিকার ভাবে জবাব দেয় জীবন।
—‘ইমপসিবল। আমি কোথাও এমন বিষের কথা পড়িনি।’ জোরালো কণ্ঠে জানায় সাধন।
জীবন হালদার একটুও দমে না। দৃঢ় স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘সায়ান্সের কোথায় কী এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে সব কি ছাপা হয়? একদিন হঠাৎ জানা যায়।’
যুক্তিটা অকাট্য। সাধনরা চুপ করে যায়। তবে সাধনের মুখ দেখে ঠাহর হয় যে সে মোটেই কথাটা মেনে নেয়নি। কিন্তু জীবনের সঙ্গে তর্ক করতে চায় না। জীবন প্রচণ্ড তার্কিক তো বটেই। তাছাড়া ইউনিয়ন লিডার। আপদে বিপদে ভরসা। তর্ক করে ওকে চটিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। লোকটা অতি ধূর্ত। ওকে ভয় পায় সকলে। চটে গেলে কী প্যাঁচে ফেলবে কে জানে?
জীবন পাশের টেবিলের হাবভাব ভ্রূক্ষেপই করল না। চা শেষ করে দ্রুত পায়ে উঠে গেল।
জীবন চলে যেতেই সাধন ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল— ‘কে কী গুলতাপ্পি মেরেছে, ব্যাস, বিশ্বাস করতে হবে। আবদার?’
বাপি বলল, ‘লিডার যে। যা খুশি গেলাতে ওস্তাদ।’
জীবনের মাতব্বরি একদম পছন্দ করে না তপন। একবার খটাখটিও লেগেছিল। তবু নিজের স্বার্থে সেদিনই অফিস ছুটির কিছু আগে তপন জীবনকে পাকড়াও করল— ‘আচ্ছা ওই যে ভাই ক্যান্টিনে একটা কথা বলছিলেন, কিছুতেই ধরা যাবে না। সত্যি?’
—‘তাই শুনেছি।’ গম্ভীর ভাবে জানায় জীবন।
—‘আশ্চর্য আবিষ্কার। কার কাছে শুনেছেন? একটু কথা বলে জানতাম আরও।’
—‘কেন, আপনার কি ওই বিষ দরকার?’ জীবন বাঁকা সুরে বলে।
‘না না। আমি কী করব? একটু জানবার ইচ্ছে হল ডিটেলস-এ।’ জীবন ঝপ করে বলল, ‘বেশ, যদি এই নিয়ে আরও জানতে চান, নাম ঠিকানা দিচ্ছি। এর কাছে চলে যান। দেখি একটা কাগজ?’
তপন একটা পুরোনো রসিদ বের করে জীবনের হাতে দেয়। জীবন তাতে খসখস করে লিখে সেটা ফেরত দিল তপনকে।
তপন পড়ল— কবিরাজ নন্দ সেন। নিবাস পানিহাটি। একটা রাস্তার নাম দেওয়া হয়েছে।
—‘কবিরাজ!’ অবাক হয় তপন।
—‘হুঁ। কেন অসম্ভব কি? এসব প্রাচীন শাস্ত্রে নাকি অনেক গোপন বিদ্যা আছে। পানিহাটি চেনেন?’
—‘চিনি। শ্যামবাজার থেকে বি. টি. রোড ধরে ঘণ্টাখানেক বাসে।’
—‘তবে চলে যান। শুনেছি ওই রাস্তায় গিয়ে এঁর নাম বললেই লোকে বাড়ি দেখিয়ে দেবে। তবে হ্যাঁ, ইনি চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ে কথা বলতে গেলে নাকি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া দেখা করেন না। নিজের নাম ঠিকানা দিয়ে চিঠি লিখবেন। উনি জানাবেন, কবে কখন যাবেন। চিঠিতে প্রয়োজন লিখবেন— কবিরাজি শাস্ত্র বিষয়ে ব্যক্তিগত আলোচনা।’ কথা থামিয়ে জীবন হালদার হনহন করে চলে যায়।
.
পরদিনই কবিরাজ নন্দ সেনের নামে একটি পোস্টকার্ড ছাড়ল তপন।
দিন দশেক পরে কবিরাজ নন্দ সেনের উত্তর এল পোস্টকার্ডে। লাল কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। আগামী রবিবার দুপুর তিনটে থেকে চারটের মধ্যে যেতে লিখেছেন। অর্থাৎ তিন দিন বাদে।
.
পানিহাটিতে নন্দ কবিরাজের বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না তপনের। ওই রাস্তায় একজন দেখিয়ে দিল— ‘আরও এগিয়ে যান। একটা বাঁক পাবেন। ঘুরেই পথের পাশে একটা বকুল গাছ। বাঁদিকে। তার সামনের বাড়ি। দোতলা। সামনে সাইনবোর্ড আছে।’
অঞ্চলটা প্রাচীন। রাস্তার ধারে বেশির ভাগ বাড়ি পুরোনো। আবার কয়েকটা হাল আমলের নতুন বাড়িও রয়েছে। দুপুরে তখন পথে লোক খুব কম।
সাইনবোর্ডটা দেখতে পেল তপন। ময়লা রঙচটা। লেখা— কবিরাজ নন্দ সেন। তারপর কতগুলি উপাধি বা ডিগ্রি ছোটো ছোটো অক্ষরে।
কবিরাজের বাড়িটা প্রকাণ্ড। বহু পুরোনো। মেরামতের অভাবে জীর্ণ। পলেস্তরা খসা ইট বের হওয়া দেওয়াল। বিবর্ণ জানলাগুলো বেশির ভাগ বন্ধ মানুষ সমান উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। পাঁচিল ভেঙে গেছে অনেক জায়গায়। গেটের জায়গাটা হাঁ হয়ে আছে। গেট নেই। বাড়ির পিছনে জমি রয়েছে খানিক। সেখানে কয়েকটা বড়ো বড়ো গাছ বাড়ির ছাদ ছাড়িয়ে উঠেছে। নিস্তব্ধ বাড়িটায় কেউ বাস করে কিনা বোঝা দায়।
গেটের ফাঁক দিয়ে হাত কুড়ি সোজা পেরিয়ে মোটা মোটা দুই থামের পিছনে এক ফালি বারান্দা। সাইনবোর্ডটা ঝুলছে বারান্দার মাথায়। বারান্দার পিছনে একটা ঘর দেখা যাচ্ছে। তার দরজাটা খোলা।
তপন হাতঘড়িতে দেখল— তিনটে বেজে কুড়ি মিনিট। রাস্তার দুধারে তাকাল। কেউ নেই। সে গেট পেরিয়ে বারান্দায় উঠে খোলা দরজায় উঁকি মারল।
ঘরের পেছনের দেয়াল ঘেঁষে একটা তক্তপোশ, তাতে সতরঞ্চি পাতা। তার ওপর একজন বসে, দরজার দিকে মুখ করে। কিছু পড়ছেন। সামনে কাঠের ডেস্কে বই রেখে। তপনের পায়ের শব্দে মুখ তুলে ভারী গলায় বললেন- ‘কে?’
তপন ঘরে ঢোকে। জিজ্ঞেস করে, ‘কবিরাজ নন্দ সেন আছেন?
—‘আমি। কী চাই?’ ভদ্রলোক উত্তর দেন।
তপন নীরবে কবিরাজের জবাব লেখা পোস্টকার্ডখানা বাড়িয়ে দেয়। এক নজরে সেটিকে দেখে নিয়ে কবিরাজ বললেন, ‘বসুন।’
তক্তপোশের সামনে কয়েকটা পুরোনো কাঠের চেয়ার, তারই একটায় বসল তপন।
ঘরের একধারে দুটো খোলা জানলা। তাই দিয়ে রোদ ঢুকছে ঘরে। ঘরখানায় চোখ বুলিয়ে নেয় তপন
বেশ বড়ো ঘরখানা। একধারে কাচের পাল্লা দেওয়া বড়ো একটা আলমারি। তাতে অনেক শিশি বোতল। কবিরাজের পাশে তক্তপোশে রাখা এক গাদা বইখাতা। দেয়ালে একটা ছবি ঝুলছে এক বৃদ্ধের। ঘরের আর কিছুর দিকে নজর দেবার সময় পায় না তপন। সামনের লোকটি তার যাবতীয় মনোযোগ আকর্ষণ করে।
কবিরাজ নন্দ সেনের চেহারাখানা চোখে পড়ার মতো। বাবু হয়ে খাড়া বসে আছেন। মাঝারি লম্বা। রোগা পাকানো শরীর। ফর্সা রং। পরনে ঢোলা গেরুয়া পাঞ্জাবি এবং ধুতি। মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। মাথায় ঘাড় অবধি ঢাকা ঘন চুল। লম্বাটে মুখ। চুল দাড়িতে কিছু পাকা চুলের রেখা। বয়স চল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে যা খুশি হতে পারে। চাপা ঠোঁট। টিয়াপাখির মতো বাঁকা লম্বা নাক চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। চশমার কাচের পেছনে দুটি জ্বলজ্বলে চোখের চাউনি স্থিরভাবে লক্ষ্য করছে তপনকে।
—‘বলুন?’ ধীর গম্ভীর কণ্ঠে যেন আদেশ হয়।
তপনের বেশ নার্ভাস লাগে। কোনোরকমে সাহস সঞ্চয় করে। কারো গলা শোনা যাচ্ছে না। মনে হয় আর কেউ নেই কাছাকাছি। সে ইতস্তত করে নীচু স্বরে বলে ফেলে, ‘শুনলাম, আপনি এমন একটা বিষ জানেন যা কোনোমতেই ধরা যায় না?’
কবিরাজ কথা বলেন না। শুধু একবার মাথা নাড়েন সায় দিয়ে।
—‘আমি এইজন্যেই’— তপন থতমত ভাবে বাকি কথা শেষ করে না। –’আপনার চাই?’ চাঁচাছোলা স্পষ্ট প্রশ্নটা যেন ধাক্কা মারে তপনকে। সে ঢোক গিলে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল— ‘হ্যাঁ।’
—‘হুম। কবিরাজ তক্তপোশ ছেড়ে মাটিতে নামলেন। ধীরপায়ে গিয়ে বাইরের দরজাটা বন্ধ করলেন। তারপর ঘরের অন্য দরজা, যেটা অন্দরের দিকে সেটার কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি এই সময় এক কাপ চা খাই। আসুন ভিতরে। এক কাপ চা পান করবেন আমার সাথে।’
—‘না না, চা কেন?’ তপন আপত্তি জানায়।
—‘কেন, চা খান না?’
—‘তা খাই।’
—‘তাহলে আসুন। চা একা খেলে জমে না।’ লোকটির কণ্ঠে এমন কর্তৃত্ব যে ওঁর অনুরোধ এড়ানো কঠিন। তপন উঠে কবিরাজের পিছু নেয়। বাড়ির ভিতরে ঢোকে।
চৌকো ছোটো বাঁধানো নীচু চাতাল। তার চারপাশ ঘিরে উঁচু বারান্দা। মোটা মোটা গোল থাম। এক-একধারে দু-তিনটে ঘর। ঘরগুলোর দরজা বন্ধ। একতলা বা দোতলায় জনপ্রাণীর দেখা পাওয়া গেল না। মনে হল যে বাড়ির এই অংশে থাকে না কেউ। উঠোনে ময়লা। বারান্দা ঝুলে ভর্তি। এক গাদা পায়রা ঘুরছে কার্নিসে কড়িকাঠে। যেন পোড়োবাড়ি। একটা ঘরের ছিটখানি খুলে কবিরাজ তপনকে ডাকলেন— ‘আসুন ভিতরে।’
মাঝারি ঘরখানা। একটি মাত্র খড়খড়ি-দেওয়া জানলা খোলা। যথেষ্ট আলো ঢুকছে না ঘরে। দুদিকের দেওয়ালে পাঁচ-ছয় হাত উঁচু অবধি কাঠের খোলা তাক। দুটো মস্ত মস্ত কাচের পাল্লা দেওয়া কাঠের আলমারি একধারে। তাকে ও আলমারিতে অজস্র নানা আকারের শিশি বোতল। নানারকম বাটি প্লেট ছুরি চামচ গোল কাগজের ঠোঙা ইত্যাদি। শিশি বোতলগুলো যে খালি নয় বোঝা যায়। দেয়াল ঘেঁষে একধারে একটা সরু কাঠের বেঞ্চি। বেঞ্চির ওপর দু-তিনটে শিশি এবং কিছু টুকরো গাছের শিকড় ডাল ও পাতা। কেমন অদ্ভুত গন্ধ ভাসছে ঘরে। তপনের মনে হল এই ঘরেই বোধহয় কবিরাজের ওষুধের স্টক থাকে। ওষুধ তৈরি হয়।
—‘বসুন।’ আঙুল দেখাল কবিরাজ।
ঘরের মাঝখানে ছোটো একটা টেবিল। তার দুপাশে দুটো চেয়ার। একটা চেয়ারে বসল তপন।
ঘরের কোণে একটা স্টোভ ছিল। সেটা জ্বাললেন কবিরাজ। তারপর কেটলিতে কুঁজো থেকে জল ভরে বসিয়ে দিলেন স্টোভে। তাক থেকে দুটো কাপ নামিয়ে ধুয়ে রাখলেন বেঞ্চিতে। দড়িতে ঝোলানো ঝাড়নে হাত মুছে এবার তিনি এসে বসলেন তপনের মুখোমুখি।
স্থির চোখে তাকিয়ে কবিরাজ তপনকে প্রশ্ন করলেন— ‘এবার বলুন, ওই বিষ দিয়ে আপনি কাকে হত্যা করতে চান এবং কেন?’
এই আচমকা প্রশ্নে তপন একেবারে থ হয়ে গেল। তার মুখে খানিকক্ষণ কথা বেরোয় না। তারপর প্রবল প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বলে, ‘না না, আমি সেজন্যে চাইনি।’
তপনের কথা হাত তুলে থামিয়ে দিলেন কবিরাজ। অবিচলিত ভাবে বললেন, ‘অযথা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। যা জানতে চাইছি উত্তর দিন।’
মানুষটির প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বে আচ্ছন্ন হয়ে তপন বুঝল যে এঁকে ধোঁকা দেওয়া বৃথা। সে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘তার কি দরকার আছে? আমি কিন্তু এরজন্য উপযুক্ত মূল্য দিতে প্রস্তুত।’
—‘আছে।’ কবিরাজ মশাই দৃঢ় স্বরে জানালেন— ‘কারণ আগে আমি বুঝে নিই, এই বিষ যাকে দেব, তাকে এটা দেওয়া উচিত হবে কিনা? উচিত মনে করলে তবেই দিই। নইলে দিই না। যদি আপত্তি থাকে, বলবেন না। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি নিরুপায়। আপনাকে এ বস্তু দেবার কথা তাহলে কোনোমতেই বিবেচনা করতে পারব না। ভেবে দেখুন, কী করবেন?’ নিস্তব্ধ ঘর। শুধু শোঁ শোঁ স্টোভের আওয়াজ।
মরিয়া তপন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ঠিক আছে বলছি। যাকে আমি মারতে চাই, তিনি হচ্ছেন আমার পিসিমা। আর মারতে চাইছি কারণ’, তপন একটা লম্বা গল্প ফেঁদে বসে-
.
বৃদ্ধা পিসিমা দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী। তাঁকে চিকিৎসা করাতে করাতে তপন নিঃস্ব হতে বসেছে। ধারে ডুবে যাচ্ছে। চিকিৎসা না করলে বাবা মনে কষ্ট পাবেন তাই বাধ্য হয়ে… পঙ্গু পিসিমার কোনো দিন আর ভালো হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। শুধু শুধু এই বিরাট খরচ তাকে টানতে হচ্ছে। আরও কত দিন যে টানতে হবে কে জানে? রোগে ভুগে ভুগে পিসিমার মেজাজ ভীষণ খিটখিটে হয়ে গেছে। সর্বদা চিৎকার চেঁচামেচি করেন শুয়ে শুয়ে। এর জন্যে তপনের স্ত্রী নিতান্ত বিরক্ত। সে আর পিসিমার সেবা করতে চাইছে না। সংসারে ঘোর অশান্তি লেগে গেছে পিসিমাকে নিয়ে। পিসিমা গত হলে তপনের সংসারে অনেক সমস্যার সমাধান হয়। শান্তি ফিরে আসে। পিসিও রোগযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান। পিসিকে কোথাও যে পাঠিয়ে দেবে তারও উপায় নেই— ইত্যাদি ইত্যাদি।
কবিরাজমশাই তাকে থামিয়ে দিলেন— ‘দাঁড়ান, চা-টা বানিয়ে নিই। জল ফুটে গেছে।’
কবিরাজ মেঝেতে উবু হয়ে বসে চা বানাতে থাকেন। এই ফুরসতে তপন ভেবে নেয়, অসুস্থ পঙ্গু পিসির কারণে তার জীবন যে কত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাই নিয়ে আরও কী কী বলবে। যাতে নন্দ কবিরাজের সহানুভূতি জাগে। যাতে সে বোঝাতে পারে পিসিকে হত্যা করলে কোনো অপরাধ করা হবে না। পিসির জীবনের বিনিময়ে অনেকের অশেষ উপকার হয়।
কবিরাজমশাই দু কাপ চা বানিয়ে টেবিলে রাখলেন। সঙ্গে একটি প্লেটে দুটি বিস্কুট। একখানা বিস্কুট নিজে তুলে নিয়ে এবং এক কাপ চা নিজে নিয়ে চুমুক দিয়ে ইশারা করলেন তপনকে— খান।
দুজনে চা বিস্কুট শেষ করে। কবিরাজ চা খেতে খেতে চুপচাপ শোনেন তপনের বাকি কাঁদুনি।
তপন কথা শেষ করে উৎসুক ভাবে তাকিয়ে রইল কবিরাজের দিকে।
কবিরাজমশাই এবার একবার মাথা ঝাঁকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, ‘এই বিষ আমি মাঝে মাঝে লোককে দিয়েছি বটে। আগেই যা বলেছি আপনাকে, সেই পরিস্থিতিতে। যখন মনে করেছি যে সে এই বিষ পাবার যোগ্য, অর্থাৎ খুনটা অন্যায় নয়। এ বিষে মৃত্যু ঘটলে এটা যে বিষ প্রয়োগে মৃত্যু তা ধরা অসম্ভব। মনে হবে স্বাভাবিক মৃত্যু। সন্ন্যাস রোগে। বিষের কোনো অস্তিত্ব টের পাওয়া যাবে না ময়না তদন্তে। এই বিষ আমি কাউকে দেব মনস্থ করলে এমনিই দিই। এর জন্য মূল্য নিই না।’
—‘বাঃ’, তপন উৎফুল্ল হয়ে বলে, ‘অনুগ্রহ করে আমায় ওই বিষ দিন। বুঝছেন তো আমার অবস্থা?’
কবিরাজের দাড়ি গোঁফের ফাঁকে ঠোঁটে বিচিত্র হাসি ফোটে। গালে কপালে ভাঁজ দেখা যায়। চোখ দুটি ছোটো হয়ে ঝিকমিক করে। চাপা গম্ভীর গলায় তিনি কেটে কেটে উচ্চারণ করলেন— ‘এই বিষ আপনাকে আমি ইতিমধ্যেই দিয়েছি। আপনি তা গ্রহণ করেছেন ওই চায়ের মাধ্যমে। চা বানাতে বানাতেই আমি স্থির করে ফেলি যে এই বিষ আপনার প্রাপ্য। সুতরাং বিনি পয়সাতেই দিয়েছি। তবে এর প্রতিষেধকের জন্য আমি মূল্য নিই।’
তপন ব্যাপারটা বুঝে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে কিছু ঝুঁকি আন্দাজ করেই এসেছিল। হয়তো বাগে পেয়ে বিষের জন্য প্রচুর দর হাঁকবে। অথবা ভবিষ্যতে ব্ল্যাকমেল করতে পারে। কিংবা অন্য কোনো ফাঁদে ফেলতে পারে। কিন্তু এই সম্ভাবনা সে ভাবতেই পারেনি।
তপন পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা ছুরি বের করে স্প্রিং টিপল। আট ইঞ্চি লম্বা ধারালো ফলাটা ঝড়াং করে বেরিয়ে এল।
নন্দ কবিরাজ বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে খিকখিক করে হেসে বললেন, ‘ওটা ব্যবহার না করাই ভালো। প্রতিষেধকটা তাহলে কিন্তু আর মিলবে না। দুনিয়ায় আমি ছাড়া আর কেউ এই বিষ এবং প্রতিষেধক জানে বলে তো শুনিনি।’ ক্ষিপ্ত তপন ছুরিটা মুঠোয় বাগিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নন্দ কবিরাজের দিকে। কী করবে ভেবে পায় না।
কবিরাজ নির্বিকার ভাবে বললেন, ‘ঝাল মেটাতে আমায় খুন করতে পারেন কিন্তু আপনিও বাঁচবেন না। আড়াই থেকে তিনঘণ্টার মধ্যে অব্যর্থ বিষের ক্রিয়া শুরু হবে। মিনিট দশেকের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যু।
—‘প্রতিষেধকটা বের করুন। নইলে’– ঘড়ঘড়ে গলায় গর্জন করে ওঠে তপন, ছুরি তাক করে।
কবিরাজ নির্বিকার ভাবে বললেন, ‘প্রাণের মায়া তুচ্ছ করেই এ কাজ করি। জীবনে আমার কোনো আসক্তি নেই। কোনো বন্ধন নেই।
—‘প্রতিষেধকের জন্যে কত চান?’ গরগর করে ওঠে তপন
—‘মাত্র এক হাজার টাকা,’ বিনীত ভাবে জানালেন কবিরাজ, ‘কী করি? বেঁচে থাকলে কিছু টাকার প্রয়োজন। কারো যদি শখ থাকে খুন করা আটকানো, তা সেই উদ্ভট শখ থেকে কিছু উপার্জন করা কি অপরাধ? কী বলেন?’
ছুরিটা নিজের চেয়ারে রেখে তপন বিনা বাক্যব্যয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে হাজার টাকা গুনে টেবিলের ওপর রাখল।
কবিরাজমশাই কিন্তু টাকাটা নেবার কোনো চেষ্টাই করলেন না। তিনি এবার কঠিন গলায় বললেন— ‘আর একটা কাজ বাকি। আপনার পিসিমা এবং আমার নিজের নিরাপত্তার কারণে। আপনাকে একটি বিবৃতি লিখতে হবে। এখুনি। আপনার পিসিমাকে খুন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে এবং উদ্দেশ্যটা যে আমি দৈবাৎ জেনে ফেলেছি তাও লিখতে হবে। এই নিন কাগজ কলম। বয়ানটা বলে যাচ্ছি, লিখুন।’
কবিরাজমশাই বলে যান। বাধ্য হয়ে লেখে তপন। তপন মতলবটা ঠিক ধরতে পারে না। লেখার নীচে নাম সই করে তারিখ দিয়ে।
কবিরাজ বললেন, ‘এবার আমি আপনার এই স্বীকৃতি খামে ভরে ডাকে দিয়ে আসব। ওটা যাবে আমার এক বন্ধুর কাছে। সে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে বড়ো কাজ করে। তাকে এখুনি আমি জানিয়ে দিচ্ছি আলাদা একটা চিঠিতে— আমি বা আপনার পিসিমা নিস্তারিণী দেবীর হঠাৎ অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটলে সে যেন এই খামটা খুলে আপনার বিবৃতিটা পড়ে এবং অনুসন্ধান করে এ ব্যাপারে আপনার হাত আছে কি না। যদি আপনি আমাদের কাউকে সত্যি খুন করে বসেন, মনে রাখবেন যে আপনার ফাঁসির ব্যবস্থা তৈরি রইল। আপাতত আপনার বিবৃতিটা খামে বন্ধ হয়ে গচ্ছিত থাকবে আমার পুলিশ বন্ধুর কাছে। হ্যাঁ, চিঠি দুটো ডাকে ফেলে দিয়ে এসে, আমি নিশ্চিন্তে আপনাকে প্রতিষেধকটা দেব।’
কবিরাজমশাই এবার উঠে, তাকে রাখা একটা খাতার ভিতর থেকে একটা খাম এবং একটা ইনল্যান্ড বের করলেন। খামে তপনের স্বীকৃতিটা ভরলেন। খামের মুখ আঠা দিয়ে বন্ধ করলেন। কোণের বেঞ্চিতে রেখে খামে ঠিকানা লিখলেন। ওইখানেই চটপট লিখলেন ইনল্যান্ডে। সেটাও আটকালেন। অতঃপর ধীরেসুস্থে এসে টেবিল থেকে হাজার টাকা তুলে নিজের পাঞ্জাবির পকেটে ভরে তপনকে বললেন— ‘এইখানেই অপেক্ষা করুন। আমি আধঘণ্টার মধ্যে ফিরব।’
নন্দ কবিরাজ বেরিয়ে গেলেন। কাঠ হয়ে বসে থাকে তপন। ঘামতে থাকে। হাতঘড়িতে দেখল যে চা খাবার পর প্রায় এক ঘণ্টা দশমিনিট কেটেছে। ঠিক আধঘণ্টা বাদে ফিরে এলেন কবিরাজ। তপনকে ডাক দিলেন— ‘আসুন।’
বাইরের দিকে যে ঘরে কবিরাজ প্রথমে বসেছিলেন সেখানে হাজির হয় দুজনে।
তপন লক্ষ করে যে বাইরের দরজাটা খোলা এবং তক্তপোশের ওপরে রাখা একটা কাচের গেলাস ভর্তি বুঝি কোনো শরবত।
কবিরাজ গেলাসটা দেখিয়ে তপনকে বললেন, ‘ওই আপনার প্রতিষেধক। খেয়ে ফেলুন।’
তপন ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে সমস্ত শরবতটুকু খেয়ে নিল। কেমন মিষ্টি ঝাঁঝালো স্বাদ। ঠক করে নামিয়ে রাখল গেলাসটা।
তপনের চোখমুখের ভাব লক্ষ্য করে কবিরাজ মশাই কড়া গলায় বললেন— ‘উঁহু কোনো মারধর বা গুণ্ডামির চেষ্টা করবেন না। মনে রাখবেন, পুলিশের এক বড়ো কর্তা আমার বন্ধু। আর এ পাড়ার লোক আমায় খুব মানে।’
দাঁত কিড়মিড় করে তপন বলল, ‘আপনার এই চালাকি আমি রটিয়ে দেব। দেখি আপনার এই ব্যাবসা কেমন চলে।’
কবিরাজ মুচকি হেসে বললেন, ‘তাহলে কিন্তু আমার কাছে আপনার আসার উদ্দেশ্যটাও ধরে ফেলবে লোকে।’
সঙ্গে সঙ্গে কুঁকড়ে গেল তপন। সে চলে যাবার জন্য পিছু ফেরে।
—‘শুনুন।’ ডাকলেন কবিরাজ।
তপন ঘুরে দাঁড়ায়।
বাঁকা হেসে কবিরাজ মশাই বললেন, ‘একটি অনুরোধ। ইচ্ছে হলে আমার এই বিষের খবর অন্যদেরও জানাতে পারেন, কারণটা বুঝে। তবে একটু কৌশলে। যোগাযোগ করার কায়দাটাও বলে দেবেন। আমার কাছে এই বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যারা আসে তাদের প্রত্যেককেই আমি এই অনুরোধ করে থাকি।’
একটু থেমে স্থির চোখে তপনের দিকে চেয়ে কবিরাজ বললেন— ‘বলা তো যায় না, মনে মনে কে কার শত্রু! হয়তো বা আপনার থেকে খবর পেয়ে কেউ আমার কাছে আসতে পারে আপনাকেই সরাবার মতলবে। তখন আমার এই বেয়াড়া শখটাই আপনাকে রক্ষা করবে। আচ্ছা নমস্কার।’
কবিরাজ নন্দ সেনের বাড়ি থেকে তপন বেরিয়ে পড়ে। পিছনে দরজা বন্ধ হবার শব্দ হয়।