উদ্বাস্তু
উদ্বাস্তু
শ্রমিক দিবসের পর থেকেই হঠাৎ ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করল। সামার কটেজের লোকজন ফিরে যেতে লাগল যে যার বাড়ি। লস্ট লেকে জমতে শুরু করল বরফ। ওখানে সলি ভিনসেন্ট ছাড়া কেউ থাকে না। ভিনসেন্ট মোটাসোটা মানুষ। বছরখানেক আগে, বসন্তে লেকের পাড়ের বাড়িটি কিনেছে। সারাটা গ্রীষ্ম তার কেটেছে স্পাের্টস শার্ট পরে। কেউ কখনও তাকে শিকারে যেতে বা মাছ ধরতে দেখেনি। যদিও প্রতি হায়, ছুটির দিনে শহর থেকে বন্ধুবান্ধব এনে বাড়িতে বসে ফুর্তিফার্তি করে ভিনসেন্ট। বাড়ি কিনেই সে দরজার সামনে বিরাট এক সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে-সনোতা বীচ।
শহরে খুব কম আসত ভিনসেন্ট। একদিন দেখা গেল সে ডকস বার-এ ঢুকেছে। তারপর মাঝে মাঝে সে আসতে শুরু করল, ব্যাক রুমে নিয়মিত জুয়াড়ীদের সাথে কার্ড খেলল।
পোকারটা ভালই খেলে ভিনসেন্ট, সুগন্ধী, দামী সিগার খায়। কিন্তু নিজের সম্পর্কে বলে না কিছুই। একদিন স্পেকস হেনেসি তাকে সরাসরি একটা প্রশ্ন করে বসলে জানায়, সে এসেছে শিকাগো থেকে। আগে ব্যবসা করত। এখন কিছুই করে না। তবে কিসের ব্যবসা করত জানায়নি ভিনসেন্ট।
ভিনসেন্ট হয়তো মুখে সব সময় তালা দিয়েই রাখত যদি না সেদিন স্পেস হেনেসি তাকে সোনার মোহরগুলো দেখাত।
এ জিনিস দেখেছে কেউ কখনও আগে? জিজ্ঞেস করে হেনেসি তার বন্ধুবান্ধবদের। কেউ কিছু বলে না। তবে ভিনসেন্ট একটা মোহর তুলে নেয় টেবিলের ওপর থেকে।
জন্মদিন, তাই না? বিড়বিড় করে ভিনসেন্ট। দাড়িঅলা লোকটা কে-বিসমার্ক?
খিকখিক হাসে স্পেকস হেনেসি। এবার ধরা খেয়ে গেছ, বন্ধু। ওটা বুড়ো ফ্রাঙ্ক জোসেফের ছবি। অস্ট্রোহাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের নেতা ছিল, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে। ব্যাঙ্কে এই তথ্যটাই দিয়েছে ওরা আমাকে ?
কোত্থেকে পেয়েছ এ জিনিস? স্লট মেশিনে? জানতে চায় ভিনসেন্ট। এদিক ওদিক মাথা নাড়ে হেনেসি। একটা ব্যাগে। বোঝাই ছিল সোনার মোহরে।
এই প্রথম ভিনসেন্টকে কোন ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠতে দেখে সবাই। মোহরটা আবার হাতে নিয়ে মোটা আঙুলের মধ্যে ঘোরাতে ঘোরাতে জিজ্ঞেস করে, ঘটনাটা বলবে আমাকে?
গল্পবাজ হেনেসির উৎসাহের অভাব নেই। খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার। বলতে শুরু করল সে। গত বুধবার অফিসে বসে আছি। এমন সময় এক মহিলা এসে জানতে চাইল আমি রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করি কিনা এবং বিক্রি করার মত কোন লেক প্রপাটির সন্ধান জানা আছে কিনা আমার। বললাম, অবশ্যই জানা আছে। লস্ট লেকের ধারে শূলজ কটেজটি বিক্রি হবে। আসবারপত্রসহ।
মহিলা দেখতে চাইল বাড়িটি। বললাম, কোন অসুবিধা নেই। কাল দেখাতে পারব। কিন্তু মহিলা বলল, সে ওই রাতেই বাড়ি দেখতে চায়।
আমি নিয়ে গেলাম তাকে বাড়ি দেখাতে। বাড়ি দেখে পছন্দ হয়ে গেল তার। বলল, কিনবে। নির্দেশ দিল কাগজপত্র ঠিক করতে। সে সোমবার রাতে এল এক ব্যাগ বোঝাই মোহর নিয়ে। ত ব্যাঙ্কের হ্যাঙ্ক ফেলচকে ডেকে এনেছিলাম দেখাতে। মোহরগুলো নকল কিনা। সে বলল সব ঠিক আছে। খিকখিক হাসল হেনেসি। তখন আমি ফ্রানজ জোসেফের নামটা জানতে পারি। ভিনসেন্টের কাছ থেকে মোহরটি নিয়ে নিজের পকেটে রেখে দিল সে। যা হোক, মনে হচ্ছে তুমি নতুন এক প্রতিবেশী পেয়ে যাচ্ছ। শূলজের বাড়ি থেকে তোমার কটেজের দূরত্ব আধা মাইলও না। ভাল কথা, মহিলার নাম হেলেন এস্টারহেজি। সম্ভবত হাঙ্গেরিয়াম রিফুজি ? কাউন্টেস জাতীয় কিছু একটা হবে। হয়তো দেশ থেকে পালিয়ে এসেছে। এমন কোথাও লুকিয়ে থাকতে চায়, যেখানে কমুনিস্টরা তার খোঁজ পাবে না। তবে আমার অনুমান ভুলও হতে পারে। কারণ মহিলা নিজের সম্পর্কে কিছুই বলেনি।
কি পোশাক পরনে ছিল মহিলার? জিজ্ঞেস করে ভিনসেন্ট।
লাখ টাকা দামের পোশাক। হাসে হেনেসি তার দিকে তাকিয়ে। কেন ওকে বিয়ে করার চিন্তা করছ নাকি? ওর টাকার জন্য? তবে মহিলাকে দেখলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। কথা বলার ঢং অনেকটা অভিনেত্রী শা শা গেবর-এর মত। চেহারাতেও খানিকটা মিল রয়েছে। তবে মহিলার চুলের রঙ লাল। আমি যদি বিয়ে না করতাম, তাহলে
বাড়িতে কবে উঠছে সে? বাধা দেয় ভিনসেন্ট।
বলেনি। তবে দুএকদিনের মধ্যেই হয়তো উঠে যাবে।
হাই তুলে উঠে দাঁড়ায় ভিনসেন্ট।
আরে, চললে কোথায়? খেলা মাত্র শুরু হয়েছে—
ক্লান্ত লাগছে, বলল ভিনসেন্ট। বাড়ি যাব।
বাড়ি ফিরে এল ভিনসেন্ট। তবে সে রাতে ঘুম এল না। সারাক্ষণ নতুন প্রতিবেশীর কথা ভাবল।
নতুন একজন প্রতিবেশী পেয়ে খুশি হয়নি ভিনসেন্ট। সে যতই সুন্দরী হোক না কেন ? ভিনসেন্ট নিজেও এক ধরনের রিফুজি। উত্তর থেকে পালিয়ে এসেছে। শুধু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু ছাড়া কারও সাথে যোগাযোগ নেই তার। এদেরকে বিশ্বাস করে সে। এরা ছিল তার ব্যবসার সহকারী। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীদের চেহারা আর দেখতে চায় না ভিনসেন্ট। কখনও নয়। এদের কেউ কেউ প্রতিহিংসা পরায়ণ আর ভিনসেন্টের প্রাক্তন ব্যবসায় প্রতিহিংসা ঝামেলার সৃষ্টি করতে পারে।
এসব ভেবে রাতে ভালভাবে ঘুমাতে পারল না ভিনসেন্ট। তবে বালিশের নিচে তার পূরানো ব্যবসার ছোট একটি স্যুভেনির কেম রেখে দিল সে তা কেউ ঝুলতে পারবে না।
পরদিন ভিসেন্ট সিদ্ধান্ত নিল নতুন প্রতিবেশীর ওপর নজর রাখবে। কারণ তার সন্দেহ হচ্ছে মহিলার প্রতি। মহিলা হাঙ্গেরিয়ান উদ্বাস্তু হলেও কে বলতে পারবে তাকে প্ল্যান করে এখানে পাঠানো হয়নি?
সকাল সকাল শহরে গেল ভিনসেন্ট। দামী একজোড়া বিলকিউলার কিনে আনল। তারপর নজর রাখতে শুরু করল শূলজের বাড়ির দিকে।
রান্নাঘরের জানালা দিয়ে শূলজের বাড়ি পরিষ্কার দেখা যায়। একটা ছোট ভ্যান নতুন প্রতিবেশীর জিনিসপত্র নিয়ে এল। জিনিস বলতে কতগুলো বাক্স এবং ক্রেট। ভ্যানের লোকজন ধরাধরি করে নামাল বাক্সপেটরা। মনে হলো বেশ ভারী। বাক্সের মধ্যে কি সোনার মোহর আছে? ভাবল ভিনসেন্ট। অপেক্ষা করতে লাগল বাড়ির নতুন মনিবণী কখন আসে দেখার জন্য। ভ্যান চলে গেল কিন্তু মহিলার দেখা মিলল না। সমস্ত বিকেল বিনকিউলার চোখে ঠেকিয়ে রাখতে রাখতে হাত এবং চোখ দুইই ব্যথা হয়ে গেল। ভিনসেন্ট বিনকিউলার রেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রান্নায়। খিদে লেগেছে। একটা স্টিক ভাজল সে। খেল। তারপর লেকের পাড়ে তাকাল। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শূলজের বাড়ির জানালায় জ্বলে উঠেছে আলো। তার মানে মহিলা এসেছে। কখন এল? ভিনসেন্ট যখন রান্নায় ব্যস্ত নিশ্চয়ই তখন।
আবার বিনকিউলার চোখে তুলল ভিনসেন্ট। যে দৃশ্য দেখল তাতে বিনকিউলারটি তার হাত থেকে প্রায় খসে পড়ে যাচ্ছিল।
মহিলার বেডরুমের পর্দা ওঠানো। মহিলা শুয়ে আছে বিছানায়। গায়ে কিছু নেই। সোনার মোহরে সমস্ত শরীর ঢাকা।
চোখ কচলে আবার বিনকিউলার অ্যাডজাস্ট করল ভিনসেন্ট। না, ভুল দেখেনি সে। সত্যি মহিলার গা ভরা সোনার মোহর, বাতির আলোতে ঝলকাচ্ছে। লাল টকটকে চুল তার, ডিম্বাকৃতি, মুখখানা বিষণ্ণ, বড় বড় চোখ, উঁচু চোয়াল। ঠোঁটজোড়া দেখে মনে হলো হাসছে। সোনার মোহর ভরা গায়ে হাত বোলাচ্ছে।
ভিনসেন্ট টের পেল তার গলা শুকিয়ে এসেছে, দপদপ লাফাচ্ছে কপালের একটা শিরা। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকল লম্বা, ফর্সা মোহরে ঢাকা শরীরটার দিকে। অনেকক্ষণ পরে বিনকিউলার নামাল ভিনসেন্ট। জানালার পাল্লা বন্ধ করল। তারপর থম মেরে বসে রইল! সে রাতেও ঘুম হলো না তার।
পরদিন সকালে ইলেকট্রিক রেজর দিয়ে দাড়ি কামাল ভিনসেন্ট। লোশন মাখল গায়ে। নতুন টাই পরল। তারপর মুখে চওড়া হাসি ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোল শূলজের কটেজের দিকে।
কটেজের দরজায় নক করল ভিনসেন্ট।
কোন সাড়া নেই।
আবার কড়া নাড়ল ভিনসেন্ট।
কেউ সাড়া দিল না।
ডজনখানেক বার ঘন ঘন কড়া নেড়েও লাভ হলো না কোন। কটেজের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ। ভেতর থেকে কারও সাড়া শব্দ মিলল না।
দরজা ভেঙে ঢুকতে পারে ভিনসেন্ট। মহিলাকে সত্যি কেউ পাঠিয়েছে কিনা জানে না সে। অবশ্য পকেটে ছোট্ট স্যুভেনিরটা আছে তার। যে কোন ঘটনার জন্য প্রস্তুত। মহিলার সোনার মোহর মেরে দেয়ার ইচ্ছে তার নেই। মহিলাকে খুব পছন্দ হয়েছে তার। সত্যিকারের কাউন্টেস হবে হয়তো। এমন একটি মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে মন্দ হয় না। তবে জোর করে ঢোকা ঠিক হবে না ভেবে ফিরে গেল ভিনাসেন্ট। সারাদিন জানালার ধারে বসে রইল সে। অপেক্ষা করল। মহিলার দেখা মিলল না। সম্ভবত কেনাকাটা করতে শহরে গেছে। তবে ফিরে আসবে। আর ফিরে আসলেই
এবারও হেলেন কখন বাড়ি ফিরল দেখা হলো না তিনসেন্টের। ওই সময় সে বাথরুমে ছিল। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। বাথরুম থেকে ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসতেই ভিনসেন্ট দেখতে পেল হেলেনের বাড়িতে আলো জ্বলছে। এবার আর দ্বিধা করল না ভিনসেন্ট। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল হেলেনের বাড়িতে। সদর দরজায় কড়া নাড়ার মুহূর্তে একটু ইতস্তত করল। শেষে টোকা দিল দরজায়। দরজা খুলে দিল হেলেন।
দোরগোড়ায় দাড়িয়ে হেলেন, চেয়ে আছে অন্ধকারে। বাতির আলো পড়েছে তার লাল চুলে। জ্বলজ্বল করছে। পরনে লম্বা গাউন।
বলুন? বিড়বিড় করল হেলেন।
ঢোক গিলল ভিনসেন্ট। মেয়েটা এত সুন্দরী বুঝতে পারেনি। এই মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে বুঝে শুনে।
আমার নাম সলি ভিনসেন্ট, অবশেষে বলল সে। আমি আপনার প্রতিবেশী। লেকের ওধারে থাকি। শুনলাম আপনি নতুন এসেছেন এখানে। তাই পরিচয় করতে এলাম।
তো?
হেলেন তাকিয়ে আছে ভিনসেন্টের দিকে। হাসছে না। নড়ছে না। অস্বস্তি লাগল ভিনসেন্টের।
আপনি হেলেন, তাই না? শুনেছি আপনি হাঙ্গেরিয়ান। এদিকে বোধ হয় এই প্রথম এসেছেন! এখনও থিতু হতে পারেননি। আর–
আমি এখানে ভালই আছি। বলল হেলেন। এবারও হাসল না সে, নড়াচড়াও করল না। স্রেফ মূর্তির মত তাকিয়ে আছে। ঠাণ্ডা, কঠিন, সুন্দরী একটি পাষাণ মূর্তি।
শুনে খুশি হলাম। আপনি আমার বাড়িতে একবার পা দিলে ধন্য হব। আমার বাড়িতে টোকে ওয়াইন আছে, আছে বড় একটি রেকর্ড প্লেয়ার, বেশ কিছু ক্লাসিক মিউজিকসহ। এমনকি সেই বিখ্যাত সঙ্গীত হাঙ্গেরিয়ান ব্যাপসডির দুর্লভ কালেকশনও রয়েছে আমার কাছে। এ ছাড়া।
হঠাৎ হেসে উঠল মেয়েটা। হাসির দমকে গোটা শরীর কাঁপছে, কিন্তু বরফ-সবুজ চোখজোড়া হাসছে না তার। অবশেষে হাসি থামাল হেলেন। বরফ ঠাণ্ডা গলায় বলল, নো। খ্যাঙ্কিউ। আমি এখানে ভাল আছি। আমাকে কেউ বিরক্ত না করলেই বরং খুশি হব।
তাহলে অন্য কোনদিন—
আবারও বলছি আমি চাই না কেউ আমাকে বিরক্ত করুক। এখন বা অন্য কোন সময়। গুড ইভনিং মি,- বলে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল হেলেন।
বেকুব বনে গেল ভিনসেন্ট। তারপর রাগ হলো খুব। তার মুখের ওপর এভাবে। দরজা বন্ধ করে দেয়া? কেউ সলি ভিনসেন্টকে অপমান করে পার পায়নি। অতীতে পায়নি, এখনও পাবে না। মেয়েটাকে একটা শিক্ষা দিতেই হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে ভিনসেন্ট কি জিনিস। রাগে ফুলতে ফুলতে বাড়ি ফিরে এল ভিনসেন্ট। ওরকম মেয়ে হলেও তার চলবে। পুরুষ মানুষের টাকা থাকলে বিয়ে করা আবার সমস্যা নাকি?
টাকা! হ্যাঁ, মেয়েটার অনেক টাকা আছে। নিজের চোখে দেখেছে ভিনসেন্ট। নিশ্চয়ই ওই ক্রেটগুলো বোঝাই সোনার মোহরে। হেলেন ক্রেটের ভেতরে মোহর লুকিয়ে রেখেছে কম্যুনিস্টদের ভয়ে। কম্যুনিস্টরা জানতে পারলেই মোহরগুলো কেড়ে নেবে। কিন্তু ভিনসেন্ট নিচ্ছে না কেন? কে তাকে সাধু সেজে বসে থাকতে বলেছে? বিশেষ করে এত বড় অপমানের পরেও।
প্ল্যানটা সাথে সাথে মাথায় এল। শহরে গিয়ে কার্নি আর ফ্রমকিনকে খবর দিলেই হলো। ওরা সকল কাজের কাজী। মেয়েটা বাড়িতে একা! তিন মাইলের মধ্যে আর কেউ নেই। ঘটনা ঘটার পরে কেউ কোন সন্দেহও করবে না। ভাববে কম্যুনিস্টরা এসে মেরে রেখে গেছে মেয়েটাকে। যাবার সময় লুঠ করে নিয়ে গেছে সোনার মোহর।
পরদিন কার্নি আর ফ্রমকিনকে খবর দিল ভিনসেন্ট। বলল, রাত নটার মধ্যে বাসায় চলে আসতে। কাজ আছে। সাক্ষাতে বাকি কথা হবে।
কার্নি আর ফ্রমকিন যথাসময়ে হাজির হয়ে গেল ভিনসেন্টের বাড়িতে। ভিনসেন্ট তখনও বিষয়টি নিয়ে ভাবনায় মশগুল। তার চেহারা দেখেই কার্নি বুঝতে পারল কিছু একটা ভজকট আছে।
কি ব্যাপার? জানতে চাইল কার্নি।
হাসল ভিনসেন্ট। তোমাদের গাড়ি ঠিক আছে তো? কিছু মাল নিয়ে যেতে হবে। শহরে।
কি মাল? বলল ফ্রমকিন।
তা এখন বলা যাবে না। আমি মাল নিয়ে আসব।
কোথায় ওটা?।
মাল আনতেই বেরুচ্ছি।
ও ফিরে না আসা পর্যন্ত বাড়িতে ওদেরকে বসে থাকতে বলে গেল ভিনসেন্ট। বলল, আধাঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবে। তারপর বেরিয়ে পড়ল।
ওদেরকে বলেনি ভিনসেন্ট কোথায় যাচ্ছে। ওরা অনুসরণ করে কিনা বোঝার জন্য বাড়িটাতে বার দুয়েক চক্কর দিল ভিনসেন্ট। কার্নিরা পিছু নেয়নি বোঝার পরে হনহন করে এগোল হেলেনের কটেজের দিকে। বেডরুমের জানালায় আলো। জুলছে। এবার হেলেনকে মজা দেখিয়ে ছাড়বে ভিনসেন্ট! সে কি জিনিস বুঝবে মেয়েটা।
হেলেনের কি দশা করবে ভেবে মুচকি হাসছিল ভিনসেন্ট। হঠাৎ খেয়াল করল নিভে গেছে বেডরুমের আলো। তার মানে ঘুমাবে হেলেন। ঘুমাবে মোহরের বিছানায়। ভালই হলো। ভিনসেন্টকে কড়া নাড়তে হবে না। দরজা ভেঙে ভেতরে টুকবে। আঁতকে উঠবে হেলেন।
সদর দরজা ভাঙতে হলো না। খোলাই ছিল! পা টিপে টিপে এগোল ভিনসেন্ট। চাঁদের আলো গলে পড়ছে জানালা দিয়ে। প্রায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সব কিছু। হঠাৎ গলার কাছটা ভারভার ঠেকল ভিনসেন্টের। খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়লে এমন হয় তার।
বেডরুমের দরজা খুলে ফেলল ভিনসেন্ট। জানালার পর্দা তোলা বলে চাদের আলোয় উদ্ভাসিত ঘর। আলো পড়েছে বিছানায় শুয়ে থাকা হেলেনের ওপর। তার গা ভর্তি সোনার মোহর। চাদের আলোয় ঝিলমিল করছে। এমন সময় হেলেনের বরফসবুজ চোখজোড়া খুলে গেল। ভিনসেন্টের সাথে চোখাচোখি হলো। সেই ফাঁকা দৃষ্টি চোখে। হঠাৎ অদ্ভুত একটা পরিবর্তন শুরু হয়ে গেল। সবুজ আগুনের মত জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল চোখজোড়া। হাত বাড়িয়ে দিল হেলেন। ডাকছে ওকে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ভিনসেন্ট। হঠাৎ পচা কাদামাটির গন্ধ ভক্ করে লাগল নাকে। মুহূর্তে চোখের সামনে থেকে নেই হয়ে গেল হেলেন। পরক্ষণে পেছন থেকে একটা ধাক্কা খেল। ভিনসেন্ট। হুমড়ি খেয়ে পড়ল বিছানায়। বিছানা কোথায়? এ তো পচা কাদা! উঠে বসতে গেল ভিনসেন্ট, হেলেন চট করে ওর হাত ধরে ফেলল, মুচড়ে গিয়ে গেল পিঠের ওপর। যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল ভিনসেন্ট। ধস্তাধস্তি করতে লাগল। মেয়েটার গায়ে কি শক্তি! ওর সাথে কিছুতেই পেরে উঠছে না ভিনসেন্ট। মেয়েটা ঠাণ্ডা, শক্ত কি একটা জিনিস দিয়ে যেন বাড়ি মারল ওকে। আমার পিস্তল, ভাবল ভিনসেন্ট নিয়ে গেছে পকেট থেকে।
একটু পরে গরম একটা তরল ধারা, গড়িয়ে পড়তে শুরু করল ভিনসেন্টের মুখ বেয়ে। রক্ত! গা গুলিয়ে উঠল মেয়েটা ওর রক্ত চেটে খাচ্ছে দেখে।
হেলেন খাটের সাথে খুব শক্তভাবে বেঁধে ফেলেছে ভিনসেন্টকে। নড়তে পারছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বাতাসে পচা মাটির গা গোলানো গন্ধ। শুধু বিছানা নয়, মেয়েটার গা থেকেও আসছে। মেয়েটা হাসছে।
শেষ পর্যন্ত তুমি এলে, অ্যাঁ? ফিসফিস করে বলল মেয়েটা। তোমাকে আসতেই হলো, না? বেশ করেছ এসেছ। এখন থেকে তুমি এখানে থাকবে। আমি তোমাকে আমার পোষ্য করে রেখে দেব। তুমি বেশ মোটাতাজা আছ। গায়ে অনেক রক্ত। তোমাকে দিয়ে অনেক দিন চলে যাবে আমার।
মেয়েটার মুখ থেকে কথা বলার সময় তীব্র দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসছে। মুখ সরিয়ে নিল ভিনসেন্ট। আবার হেসে উঠল মেয়েটা।
এরকম প্ল্যানই করেছিলে তুমি, তাই না? আমি জানি তুমি কেন এসেছ। মোহরের জন্য। সোনার মোহর আর কাদা মাটি নিয়ে এসেছি আমি আমার দেশ থেকে। ওর ওপর সারাদিন ঘুমাই আমি জেগে উঠি রাতের বেলা। আর রাতে যখন জেগে উঠব তখন তুমি থাকবে এখানে। কেউ আমাদের খোঁজ পাবে না। বিরক্ত করতেও আসবে না। তাগড়া শরীর তোমার। আমার খিদে মিটবে ভাল ভাবেই।
ভিনসেন্ট কর্কশ গলায় বলল, না! তুমি নিশ্চয়ই আমার সাথে ঠাট্টা করছ। তুমি একটা উদ্বাস্তু–
আবার হাসল মেয়েটা। হ্যাঁ। আমি উদ্বাস্তু। তবে রাজনৈতিক উদ্বাস্তু নই। জিভ বের করল সে। ক্রিসেন্ট তার দাঁত দেখতে পেল। লম্বা, সাদা দাঁত, ঠোঁটের কোণা দিয়ে বেরিয়ে আছে। এগিয়ে এল ভিনসেন্টের ঘাড় লক্ষ্য করে…
ওদিকে ভিনসেন্টের বাড়িতে তার জন্য অপেক্ষায় থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে নিজেদের গাড়িতে উঠে বসেছে কার্নি এবং ফ্রমকিন।
ও আজ আর আসছে না, বলল কার্নি। মনে হচ্ছে কোন ঝামেলা হবে। ওর চেহারায় ঝামেলার আভাস দেখতে পেয়েছি আমি। অদ্ভুত লাগছিল ওকে।
ঠিক, সায় দিল ফ্রমকিন। কিছু একটা হয়েছে ভিনসেন্টের। তবে কোন ঝামেলা বাধার আগেই কেটে পড়ি চলো।
[মূল: রবার্ট ব্লচের ‘দ্য রিফুজী’]