আজ ওমর আলীর প্রাণবধ। এ সংবাদে কেহ দুঃখী, কেহ সুখী। নগরবাসীরা কেহ ম্লান মুখে বধ্যভূমিতে যাইতেছে-কেহ মনের আনন্দে হাসি রহস্যে নানা কথার প্রসঙ্গে বধ্যভূমিতে উপস্থিত হইতেছে। শূলদণ্ড দণ্ডায়মান হইয়াছে। স্বপক্ষ বিপক্ষ সৈন্যদল ওমর আলীর বধক্রিয়া স্পষ্টভাবে দেখিতে পায়, মন্ত্রী মারওয়ান সে উপায় বিশেষ বিবেচনা করিয়া করিয়াছে। দিনমণির আগমনসহ নাগরিকদল দলে দলে দামেস্ক-প্রান্তরে আসিয়া একত্রিত হইতে লাগিল। প্রায় সকল লোকের মুখেই এই কথা-“আজ শূল-দণ্ডের অগ্রভাগ রক্তমাখা হইয়া ওমর আলীর মজ্জা ভেদ করিবে। কাল মস্হাব কাক্কার খণ্ডিত শির ধরায় লুণ্ঠিত হইবে; তাহার পর হানিফার দশা যাহা ঘটিবে, তাহা বুঝিতেই পারা যায়।”
কথা গোপন থাকিবার নহে। বিশেষ মন্দ কথা বায়ুর অগ্রে অগ্রে অতি গুপ্তস্থানেও প্রবেশ করে। বন্দিগৃহেও ঐ কথা শেষে প্রাণবধের কথা শুনিয়া সাহরেবানু ও হাসনেবানুর কথা বন্ধ হইয়াছে, অন্তরে ব্যথা লাগিয়াছে। ক্রন্দন ভিন্ন তাঁহাদের আর উপায় কি? হোসেন-পরিজনের দুঃখের অন্ত নাই। রক্ত, মাংস, অস্থি ও চর্মসংযুক্ত শরীর বলিয়াই এত সহ্য হইতেছে,-পাষাণে গঠিত হইলে এতদিন বিদীর্ণ হইত,-লৌহ-নির্মিত হইলে কোন্ দিন গলিয়া যাইত!
সাহরেবানু দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া করুণস্বরে বলিতে লাগিলেন, “হায়! সর্বস্ব গেল, প্রাণ গেল, রাজ্য গেল,-স্বাধীনতা গেল! আশা ছিল জয়নাল আবেদীন বন্দি গৃহ হইতে উদ্ধার হইবে। কিন্তু যিনি উদ্ধার হেতু কত কষ্ট, কত বিপদ কত যন্ত্রণা সহ্য করিয়া দামেস্কপ্রান্তর পর্যন্ত আসিলেন, আসিয়াও তিনি কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। আর ভরসা কি! আজ ওমর আলী-কাল শুনিব যে মোহাম্মদ হানিফার জীবন শেষ! আর আশা কি! জগদীশ! তোমার মনে ইহাই ছিল! তোমার মনে ইহাই ছিল!”
সালেমা বিবি বলিলেন, “সাহরেবানু, এ কি? ঈশ্বরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। সেই নির্বিকার নিরাকার দয়াময়কে কোন প্রকারে দোষী করিও না,-মহাপাপ! মহাপাপ! তিনি জীবের ভাল’র জন্যই আছেন, অজ্ঞ লোকের শিক্ষার জন্য অনেক সময়ে অনেক লীলা দেখাইয়া থাকেন। সেই করুণাময় ভগবান কৌশলে দেখাইয়া দেন যে ক্ষুদ্রবুদ্ধি মানব ক্ষমতাশালী হইলেও তাঁহার ক্ষমতার নিকট অতি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ। আমাদের স্বভাবই এই যে, কোন মানুষের অলৌকিক ক্ষমতা দেখিলেই আমরা সেই সর্বশক্তিমান ভগবানের কথা একেবারে ভুলিয়া যাই। কিন্তু সেই মহাশক্তির প্রভাবে, মানবের অন্তরের মূঢ়তা ও মূর্খতা দূর করিতে সেই অলৌকিক ক্ষমতাশালী মানবের প্রতি এমন কোন বিপদজাল বিস্তার হয় যে, তাহার সে অলৌকিক ক্ষমতা ও শক্তি যে কোথায়, কোন্ পথে, কিসে মিশিয়া যায়, তাহার আর সন্ধান পাওয়া যায় না। সেই অনন্তশক্তিসম্পন্ন মহাপ্রভুর ক্ষমতা অসীম। তিনিই সর্বমূল, তিনিই বিপদের কাণ্ডারী, বিপদ-সাগর হইতে উদ্ধার হইবার একমাত্র তরী। মানুষের ক্ষমতা কি? ওমর আলীর সাধ্য কি? হানিফার শক্তি কি? সেই বিপদতারণ ভগবানের কৃপা না হইলে, দয়াময়ের দয়া না হইলে, কোন্ প্রাণী কাহাকে বিপদ-সাগর হইতে উদ্ধার করিতে পারে? তিনিই রক্ষাকর্তা, তিনিই সর্ববিজয়, সর্বরক্ষক, বিধাতা! সাহরেবানু স্থির হও। হৃদয়ে বল কর। সেই অদ্বিতীয় ভগবানের প্রতি একমনে নির্ভর কর। দুঃখে পড়িয়া সামান্য লোকের ন্যায় বিহ্বল হইও না। বলহীন হৃদয়ের ন্যায় ব্যাকুল হইও না। তাঁহার নামে কলঙ্ক রটাইও না। তিনি তাঁহার সৃষ্ট জীবনের মন্দ-চিন্তা কখনোই করেন না। সাবধান-সাহরেবানু সাবধান, মনের মলিনতা দূর কর। তিনি অবশ্যই মঙ্গল করিবেন। তিনি সর্বমঙ্গলময় অদ্বিতীয় ঈশ্বর।”
“এত বিপদ মানুষের অদৃষ্টেও ঘটে! সকলই তো ঈশ্বরের কার্য! আমরা কি অপরাধে অপরাধী। কি পাপ করিয়াছি যে তাহারই এই প্রতিফল?”
“একথা মুখে আনিও না, বিপদ, ব্যাধি, জ্বরা, জগতে নূতন নহে। নূরনবী হজরত মোহাম্মদ মস্তফার পরিজন হইলেই যে ইহজগতে বিপদগ্রস্ত হইতে হইবে না, একথা কখনোই অন্তরে স্থান দিও না। ঈশ্বর মহান্, তাঁহার শক্তি মহান্। কত নবী, কত অলি, কত দরবেশ, তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন। কত শত সহস্র মহাপুরুষ, যোগী, ঋষি, এই ভবে জন্মিয়া গিয়াছেন। কত ভক্তের মন পরীক্ষার জন্য তিনি কত কি করিয়াছেন। তুমি জানিয়া শুনিয়া আজ ভুলিয়া যাইতেছ। ছি! ছি! ঈশ্বরে নির্ভর কর! তুমি কি সকলই ভুলিয়া গিয়াছ? হজরত আদমকেও বেহেস্তের চিরসুখ শান্তি পরিত্যাগে চির-সন্তাপহারিণী নয়নের মণি পরম প্রিয়তমা প্রাণের প্রাণ অর্ধাঙ্গিনী সহধর্মিণী বিবি হাওয়ার সহিত বিচ্ছেদ ঘটিয়া এক নয় দুই নয় ৪০ বৎসর সজল নয়নে দেশ দেশান্তরে, পর্বতে বিজনে, প্রান্তরে, মহাকষ্টে ভ্রমণ করিতে হইয়াছিল। হজরত এব্রাহিমকেও গগনস্পর্শী অগ্নিশিখা মধ্যে প্রবেশ করিতে হইয়াছিল। হজরত নুহ পয়গম্বরকে জলে ভাসিতে হইয়াছিল। হজরত এহিয়াকে মহাব্যাধিগ্রস্থ হইয়া মহাকষ্ট পাইতে হইয়াছিল। হজরত ইউসুফকে অন্ধকূপে ডুবিতে হইয়াছিল। হজরত ইউনোস্কে মৎস্যের উদরে প্রবেশ করিতে হইয়াছিল। হজরত জাক্রিয়াকে করাতে দ্বিখণ্ডিত হইতে হইয়াছিল। হজরত মুশাকে প্রাণভয়ে দেশত্যাগী হইতে হইয়াছিল। ঈসাইদিগের মতে হজরত ঈসাকেও শূলে আরোহণ করিয়া প্রাণবিসর্জ্জন করিতে হইয়াছিল। আমাদের হজরত মোহাম্মদ কি কম বিপদে পড়িয়াছিলেন? প্রাণভয়ে জন্মভূমি মক্কা নগর পরিত্যাগ করিয়া গুপ্তভাবে মদিনা যাইতে হইয়াছিল। ইঁহারা কি বিপদকালে ঈশ্বরের নাম ভুলিয়াছিলেন? নূরনবী মোহাম্মদের কথা একবার মনে কর। ঈশ্বরের আদেশে তিনি কি না করিয়াছেন। রাজাধিরাজ সাদ্দাদ, নমরূদ, ফেরাউন, কারূণ, ইহাদের অবস্থাও একবার ভাবিয়া দেখ। ধন-বল, রাজ্য-বল, বাহুবল প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে থাকা সত্ত্বেও তাঁহারা কত বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলেন। সে সকল প্রাচীন কাহিনী, প্রাচীন কথা, কেবল সেই অদ্বিতীয় ভগবানের মহাশক্তির প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখাইয়া দিতেছে। তিনি কি না করিতে পারেন? আজ ওমর আলীর প্রাণবধ হইবে, কাল এজিদের প্রাণ যাইতে পারে। ঈশ্বর যাহা ঘটাইবেন, তাহা নিবারণের কাহারো ক্ষমতা নাই। তিনি সর্বপ্রকারে দয়াময়-সকল অবস্থাতেই করুণাময়। ভাবিলে কি হইবে? আর কাঁদিলেই বা কি হইবে?”
“আপনার হিতোপদেশে আমার মন অনেক সুস্থ হইল। কিন্তু একটি কথা এই যে, প্রধান বীর ওমর আলী এজিদ্ হস্তে মারা পড়িল, ইহাতে হানিফার সাহস, বল, উৎসাহ, অনেক লাঘব হইল।”
“সে কি কথা? সে অদ্বিতীয় ভগবান হানিফাকেও এজিদ্ হস্তে বিনাশ করাইয়া আমাদিগকে উদ্ধার করিতে পারেন। তাঁহার নিকটে এ কার্য কিছুই নহে। তিনি কি না করিতে পারেন? পর্বতকে সমুদ্রে পরিণত করিতে, মহানগরকে বনে পরিণত করিতে, মহাসমুদ্রে মহানগর বসাইতে তাঁহার কতক্ষণের কাজ? তাঁহার ক্ষমতার-দয়ার পার নাই। তবে জগৎচক্ষে সাধারণ বিবেচনায় দেখিতে হইবে যে, এ সকল ঘটনার মূল কি? আমার মনের কথা আমি বলিতেছি-ইহা আর কিছুই নহে, ঈশ্বরের লীলা-প্রকাশ-ক্ষমতা বিকাশ। কিন্তু ঈশ্বর সেই ক্ষমতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার সৃষ্ট জীবকে উপদেশ দিতেছেন, ‘জীব। সাবধান! এই কার্যে এই ফল, এই পথে চলিলে এই দুর্গতি, এই আমার নির্ধারিত নিয়মের অতিক্রম করিলে এই শাস্তি।’ তিনি সকলকেই সমান ক্ষমতা দিয়াছেন। কাহাকে কোন কার্যই করিতে তিনি নিষেধ করেন না। আপন ভালমন্দ আপনিই বুঝিয়া লইতে হইবে। সংসার বড় ভয়ানক কঠিন স্থান। আজ আমরা দামেস্কের বন্দিখানায় বন্দিভাবে বসিয়া এত কথা বলিতেছি। -ভাব দেখি, ইহার মূল কি?”
এইরূপ কথা হইতেছে, এমন সময় জয়নাব আসিয়া বলিলেন, “আমি গবাক্ষদ্বারে দণ্ডায়মান হইয়া দেখিলাম, নগরের বহুসংখ্যক লোক দামেস্ক প্রান্তরে যাইতেছে। সকলের মুখে এই কথা যে, আজ ওমর আলীর প্রাণবধ দেখিব, কাল মোহাম্মদ হানিফার খণ্ডিত শির দামেস্ক প্রান্তরে লুটাইতে দেখিব। জয়নাল আবেদীন কারাগার সম্মুখে দণ্ডায়মান ছিল; প্রহরিগণ কে কোথায় আছে দেখিতে পাইলাম না। জয়নাল ঐ জনতার মধ্যে মিশিয়া তাহাদের সঙ্গে চলিয়া গেল। আমি সঙ্কেতে অনেক নিষেধ করিলাম-শুনিল না। একবার ফিরিয়া তাকাইয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে বেগে চলিয়া গেল! কেবলমাত্র একটি কথা শুনিলাম-“হায় রে অদৃষ্ট! কার্বালার ঘটনা এখানেও ঘটিতে আরম্ভ হইল। এক একটি করিয়া এজিদ্ হস্তে-‘ এই কথার পর আর কিছুই শুনিতে পাইলাম না দেখিতে দেখিতে চক্ষুর অন্তরাল হইয়া পড়িল-এ আবার কি ঘটনা ঘটিল!”
সাহরেবানু জয়নাবের মুখপানে একদৃষ্টে চাহিয়া কথাগুলি শুনিলেন। তাঁহার মুখের ভাব সে সময় যে প্রকার হইয়াছিল, তাহা কবির কল্পনার অতীত,-চিন্তার বহির্ভূত। জয়নাল আবেদীনই তাঁহাদের একমাত্র ভরসা। সাহরেবানুর প্রাণপাখী সে সময় দেহপি রে ছিল কিনা, তাহা কে বলিতে পারে? চক্ষু স্থির! কণ্ঠ রোধ! সে একপ্রকার ভাব-স্পন্দনহীন।
সালেমা বিবি বুদ্ধিমতী, সহ্যগুণও তাঁহার বিস্তর। কিন্তু সাহরেবানুর অবস্থা দেখিয়া তিনিও বিহ্বল হইলেন। নাম ধরিয়া অনেকবার ডাকিলেন। চৈতন্য নাই। বুকে মুখে হস্ত দিয়া সান্ত্বনার অনেক চেষ্টা করিলেন কিন্তু সাহরেবানুর মোহভঙ্গ হইল না, তিনি মৃত্তিকায় পড়িয়া গেলেন। অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “জয়নাল! বাবা জয়নাল। নিরাশ্রয়া দুঃখিনীর সন্তান! কোথা গেলি বাপ? তোর পায় পায় শত্রু, পায় পাপ বিপদ, আমরা চিরবন্দি। দুঃখের ভার বহন করিতে জগতে আমাদের সৃষ্টি হইয়াছিল। তুই দুঃখিনীর সন্তান, কি কথা মনে করিয়া কোথা গেলি? তুই কি তোর পিতৃব্য ওমর আলীর প্রাণবধ দেখিতে গিয়াছিস্? তুই সেই বধ্যভূমিতে গিয়া কি করিবি? তোকে যে চিনিবে, সেই এজিদের নিকট লইয়া গিয়া তোকেও ওমর আলীর সঙ্গী করিবে। এজিদ্ এখন হানিফার প্রাণ লইতেই অগ্রসর হইয়াছে। তোকে কয়েকবার মারিতে গিয়াও কৃতকার্য হয় নাই; আজ তোকে দেখিলে তা’র ক্রোদের কি সীমা থাকিবে? বন্দি পলাইলে কা’র না রোষের ভাব দ্বিগুণ হয়? জয়নাল, তোর এ বুদ্ধি কেন হইল?”
সাহরেবানু বিস্তর দুঃখ প্রকাশ করিলেন। সালেমা বিবিও অনেক প্রকারে বুঝাইলেন। শেষে সালেমা বিবি বলিলেন, “সাহরেবানু, স্থির হও। জয়নাল অবোধ নহে। তাহার পিতার সমস্ত গুণই তাহাতে রহিয়াছে। ঈশ্বর তাহাকে বীরপুরুষ করিয়াছেন। এজিদের অত্যাচার তাহার হৃদয়ে আঁকা রহিয়াছে। সে একা কিছুই করিতে পারিবে না। আবার আমাদিগকে বন্দিখানায় রাখিয়া এমন কোনও কার্যে হঠাৎ হস্তক্ষেপ করিবে না যে তাহাতে মারা পড়ে কি ধরা পড়ে। তাহার আশা অনেক। ঈশ্বরে নির্ভর কর, এ সকল তাঁহারই লীলা। তুমি স্থির হও, ঈশ্বরের নাম করিয়া জয়নালকে আশীর্বাদ কর,-তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হউক। তুমি নিশ্চয় জানিও এজিদ্ হস্তে তাহার মৃত্যু নাই। সেই মদিনার রাজা, সেই দামেস্কের রাজা। আমি মাননীয় নূরনবীমুখে শুনিয়াছি, জয়নাল আবেদীন দ্বারা মদিনার সিংহাসন রক্ষা হইবে, ইমাম বংশ জীবিত থাকিবে, রোজকেয়ামত পর্যন্ত জয়নাল আবেদীনের বংশধরগণ জগতে সকলের নিকট পূজনীয় হইয়া থাকিবে। নূরনবীর বাণী কি কখন মিথ্যা হয়? ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা কর, জয়নালের মনোবাঞ্ছা নির্বিঘ্নে পরিপূর্ণ হউক।”