হুতাশনের দাহন আশা, ধরণীর জলশোষণ আশা, ভিখারীর অর্থলোভে আশা, চক্ষুর দর্শন আশা, গাভীর তৃণভক্ষণ আশা, ধনীর ধনবৃদ্ধির আশা, প্রেমিকের প্রেমের আশা, সম্রাটের রাজ্যবিস্তার আশার যেমন নিবৃত্তি নাই, হিংসাপূর্ণ পাপহৃদয়ে দুরাশারও তেমনি নিবৃত্তি নাই-ইতি নাই। যতই কার্যসিদ্ধি, ততই দুরাশার শ্রীবৃদ্ধি। জয়নাবের রূপমাধুরী হঠাৎ এজিদ্-চক্ষে পড়িল, অন্তরে দুরাশার সঞ্চার হইল। স্বামী জীবিত,-জয়নাবের স্বামী আবদুল জাব্বার জীবিত; অত্যাচার, বলপ্রকাশ মাবিয়ার নিতান্ত অমত, অথচ জয়নাব-রত্ন লাভের আশা। কি দুরাশা! সে কার্যও সিদ্ধ হইল, কিন্তু আশার ইতি হইল না। সে রত্নখচিত সজীব পুষ্পহার দৈবনির্বন্ধে যে কণ্ঠে শোভা করিল-হৃদয় শীতল করিল-সেই কণ্টক। এজিদ্-চক্ষে হাসান বিষম কণ্টক; তাঁহার জীবন অন্ত করিতে পারিলেই আশা পূর্ণ হয়। তাহাও ঘটিল; কিন্তু আশার ইতি হইল না। যাহার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে, তাহার জীবন-প্রদীপ নির্বাণ না করিলে মনের আশা কখনোই পূর্ণ হইবে না। ঘটনাক্রমে কার্বালা-প্রান্তরে প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত রক্তের স্রোত বহিয়া তাহাও ঘটিয়া গেল। সৈন্যসামন্ত প্রহরী পরিবেষ্টিত হইয়া সে মহামূল্য জয়নাবরত্ন দামেস্ক নগরে আসিল, কিন্তু আশার ইতি হইল না।
বৃদ্ধ মন্ত্রী হামান কথার ছলে বলিয়াছিলেন, “যে আমার নয়; আমি তাহার কেন হইব।” এ নিদারুণ বচন কি আঘাতিত হৃদয়মাত্রেরই মহৌষধ? না-রূপজ মোহ যে হৃদয়কে সম্পূর্ণরূপে অধিকার করিয়া বসিয়াছে, সে হৃদয় যথার্থ মানব হৃদয় হইলেও সময়ে সময়ে পশুস্বভাবে পরিণত হয়। প্রথম কথাতেই জয়নাবের মনের ভাব এজিদ্ অনেক জানিতে পারিয়াছেন, সুতীক্ষ্ণ ছুরিকাও দেখিয়াছেন। সে অস্ত্র তাঁহার বক্ষে বসিবে না, যাহার অস্ত্র, তাঁহারই বক্ষ, তাঁহারই শোণিত,-কিন্তু বিনা আঘাতে, বিনা রক্তপাতে, তাঁহার হৃদয়ের রক্ত আজীবন শরীরের প্রতি লোমকূপ হইতে যে অদৃশ্যভাবে ঝরিতে থাকিবে, তাহাও তিনি বুঝিয়াছিলেন। তবে আশা?-আছে। দুরাশা কুহকিনী, এজিদের কানে কয়েকটি কথার আভাস দিয়াছে,-তাহাতেই এজিদের অন্তরে এই কথা-এ কি কথা? কমলে গঠিত কোমলাঙ্গীর হৃদয় কি পাষাণ? কোমল হস্তে লৌহ অস্ত্র! কমল-অক্ষিতে বজ্র দৃষ্টি? কোমল-বদনে কর্কশ ভাষা? কোমল-প্রাণে কঠিন ভাব? অসম্ভব! অসম্ভব! সম্পূর্ণ অসম্ভব এবং বিপরীত! অবশ্যই কারণ আছে। জয়নাল, হানিফা প্রভৃতি জীবিত। সেই কি মূল কারণ? নিশ্চয় তাহারা ভব-ধাম হইতে চিরকালের জন্য সরিলে নিশ্চয় এ বিপরীত ভাব কখনোই থাকিবে না। নিশ্চয়! নিশ্চয়!! নিশ্চয়!!! চিরকালের জন্য সে সময় সে পদ্ম-চক্ষুতে এজিদের ছায়া ভিন্ন আর কোন ছায়া আসিবে না। সে হৃদয়ে সদা সর্বদা এজিদ্-রূপ ব্যতীত আর কোনরূপ জাগিবে না। নিশ্চয়ই কমলে কমল মিশিয়া-কোমল ভাব ধারণ করিবে। আপাদ মস্তকে অন্তরে, হৃদয়ে, প্রাণে, শরীরে উত্তাপবিহীন সুকোমল বিজলীছটা সবেগে খেলিতে থাকিবে।”
দুরাশা! দুরাশা!!
কুহকিনী আশার এই ছলনায় এজিদ্ কাহারো কথায় কর্ণপাত করিলেন না। দুন্দুভি বাজাইয়া লোহিত নিশান উড়াইয়া, যাত্রা করিলেন। ওমর হাসেম, আবদুল্লাহ্ জেয়াদ প্রভৃতি পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্যসহ মহারাজের পশ্চাদ্বর্ত্তী হইলেন। গুপ্তচর সন্ধানীরা কেহ প্রকাশ্যে, কেহ অপ্রকাশ্যে, কেহ ছদ্মবেশে, সকলের অগ্রে নানা সন্ধানে নানা পথে ছুটিল। যেখানে যাহা শুনিতেছে দেখিতেছে, মুহূর্তে মুহূর্তে আসিয়া জানাইয়া যাইতেছে।
একজন আসিয়া বলিল, “বাদশা নামদারের জয় হউক। কতকগুলি সৈন্য নগরাভিমুখে আসিতেছে।” এজিদের মুখভাব কিঞ্চিৎ মলিন হইল।
কিছুক্ষণ পরে আর একজন আসিয়া বলিল, “আমি বিশেষ লক্ষ্য করিয়া আসিয়াছি, যাহারা আসিতেছে তাহারা দামেস্কের সৈন্য।”
এজিদ্ মহা সন্তুষ্ট হইয়া সংবাদ-বাহককে বিশেষ পুরস্কৃত করিতে আদেশ দিয়া বিজয় বাজনা বাজাইতে আজ্ঞা করিলেন।
কিছুক্ষণ পরে সংবাদ আসিল; “বাদশা নামদার! প্রধান মন্ত্রী মারওয়ান এবং প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ অলীদ মহামতি আসিতেছেন।”
এজিদ্ মহাহর্ষে বলিতে লাগিল, “ওমর! জেয়াদ! শীঘ্র আইস, বিজয়ী বীরদ্বয়কে আদরে সম্ভাষণ করিয়া গ্রহণ করি। কি সুযাত্রায় আজ অশ্বে আরোহণ করিয়াছিলাম। যে হানিফার নামে জগৎ কম্পিত, সেই হানিফা বন্দিভাবে, কি জীবন-শূন্য দেহে, কি খণ্ডিত শিরে, দামেস্কে আনীত হইতেছে। ধন্য বীর মারওয়ান! কিছু না করিয়া সে আর দামেস্কে ফিরিয়া আসিতেছে না। ধন্য মারওয়ান। খণ্ডিত হউক আর অখণ্ডিত হউক, হানিফার মস্তক বন্দিগৃহের সম্মুখে লট্কাইয়া দিব। জয়নাল-শিরও আগামী কল্য ঐ স্থানে বর্শার অগ্রে স্থাপিত করিব। দেখিবে আকাশ, দেখিবে সূর্য, দেখিবে জগৎ, দেখিবে দামেস্কের নরনারী-দেখিবে জয়নাব-এজিদের ক্ষমতা!”
যতই অগ্রসর হইতেছেন ততই আশার ছলনায় মোহিত হইতেছেন। “এখন মদিনার রাজা কে? মারওয়ানকে উভয় রাজ্যের মন্ত্রীত্ব-পদে অভিষিক্ত করিব, আর আজ আমার নিকট যাহা চাহিবে, তাহাই দান করিব। বিজয়ী সেনাগণকে বিশেষরূপে পুরস্কৃত করিব। এ সকল সৈন্যগণকেও পুরস্কৃত করিব। কাহাকেও বঞ্চিত করিব না।”
এজিদ্ আশার প্রবঞ্চে পড়িয়া যাহা কিছু বলিতেছেন, তাহাতে হাসিবার কথা নাই। আশা আর ভ্রম, এই দুয়েই মানুষের পরিচয়। আমরা ভবিষ্যতে অন্ধ না হইলে কখনোই ভ্রমকূপে ডুবিতাম না, আশার কুহকে ভুলিতাম না এবং সুখ দুঃখের বিভিন্নতাও বুঝিতাম না। তাহা হইলে যে কি ঘটিত, কি হইত ঈশ্বরই জানেন।
মারওয়ান ওত্বে অলীদ সহ দামেস্কাভিমুখে আসিতেছে, এজিদ্ও মহাহর্ষে সৈন্যগণসহ বিজয়ী বীরদ্বয়ের অভ্যর্থনা হেতু অগ্রসর হইতেছেন, মারওয়ান কখনোই পরাস্ত হইবে না, মারওয়ান পৃষ্ঠ দেখাইয়া কখনোই পলাইবে না, কার্য উদ্ধার না করিয়া দামেস্কে আসিবে না,-এই দৃঢ় বিশ্বাস-এই এজিদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাহাতেই এত আশা। অল্প সময় মধ্যেই পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ হইল। এজিদ্ বিজয়-বাজনা বাজাইয়া বিজয় নিশান উড়াইয়া উপস্থিত হইল। মারওয়ানের অন্তরে আঘাত লাগিতে লাগিল, ম্লানমুখ আরো মলিন হইল।
এজিদ্ অনুমানেই বুঝিল-অমঙ্গলের লক্ষণ! কি বলিয়া কি জিজ্ঞাসা করিবে? কুকথা কুসংবাদ যতক্ষণ চাপা থাকে ততক্ষণই মঙ্গল! মন্ত্রীবরের গলায় রত্নহার পরাইবার কথা বিপরীত চিন্তায় চাপা পড়িয়া গেল! বিজয়-বাজনা স্বভাবতঃই বন্ধ হইল। মারওয়ানের মুখে কি কথা অগ্রে বাহির হইবে শুনিয়া এজিদের মহা আগ্রহ জন্মিল।
মারওয়ান নতশিরে অভিবাদন করিয়া বিনম্রভাবে বলিল, “মহারাজ! আর অগ্রসর হইবেন না। শত্রুদল আগত!”
“তোমাদের আকারে প্রকারে অনেক বুঝিয়াছি। কিন্তু বার বার পশ্চাদ্দিকে সভয়ে দেখিতেছ কি? পশ্চাতে কি আছে?”
মারওয়ান মনে মনে বলিল,-“যাহা আপনার দেখিবার বাকী আছে।” (প্রকাশ্যে) “মহারাজ আর কিছু নহে-সেই চাঁদ-তারা-সংযুক্ত নিশানের অগ্রভাগ দেখিতেছি! বেশি বিলম্ব নাই। তাহারা যেভাবে আসিতেছে, তাহাতে কোনরূপ সাজসজ্জা করিয়া আত্মরক্ষার অন্য কোন নূতন উপায়, কি নগর রক্ষার কোনরূপ সুবন্দোবস্ত করিতে আর সময় নাই। যাহা সংগ্রহ আছে, তাহাই সম্বল, ইহার প্রতিই নির্ভর।”
“হানিফা কি এত নিকটবর্তী?”
“সে কথা আর মুখে কি বলিব? কান পাতিয়া শুনুন, কিসের শব্দ শুনা যায়।”
“হাঁ, কিছু কিছু শুনিতেছি। কোন কোন সময়ে আকাশে যে মেঘ গর্জন শুনিতে পাওয়া যায়, বোধ হয় সেই ঘনঘটাবলী বিজলী সহিত বহু দূর খেলা করিতেছে।”
“মহারাজ ও ঘনঘটার শব্দ নহে, বিদ্যুতের আভাও নহে, দামামার নাকাড়ার গুড়গুড়ি, ডঙ্কার কর্ণভেদী ধ্বনি, আর অস্ত্রের চাক্চিক্য।”
এজিদ্ আরো মনোনিবেশ করিলেন, স্থিরভাবে অশ্ববল্গা ধরিয়া কান পাতিয়া শুনিতে লাগিলেন, স্পষ্টতঃ ভেরীর ভীষণ নাদ, নাকাড়ার খরতর আওয়াজ, শিঙ্গার ঘোর রোল ক্রমেই নিকটবর্তী। বাজনা শুনিতে শুনিতে দেখিতে পাইলেন, মোহাম্মদী নিশান-দণ্ডের অগ্রভাগ, সজ্জিত পতাকার জাতীয় চিহ্ন, আরোহী এবং পদাতিক সৈন্যগণের হস্তস্থিত বর্শা ফলকের চাক্চিক্য, স্ফূর্তিবিশিষ্ট তেজীয়ান্ অশ্বের পদচালন।
এজিদ্ সদর্পে বলিল, “যাঁহার জন্য আমাকে বহুদূর যাইতে হইত, ঘটনাক্রমে নিকটেই পাইলাম। চিন্তা কি? মারওয়ান এত আশঙ্কা কি? চালাও অশ্ব-এখনি আক্রমণ করিব।”
“মহারাজ! আমরা সর্ববলে বলীয়ান না হইয়া এসময়ে আর আক্রমণ করিব না। আমাদের বহু সৈন্য মোহাম্মদ হানিফার হস্তে মারা গিয়াছে! সৈন্যবল বৃদ্ধি না করিয়া আর আক্রমণের নামও মুখে আনিবেন না। আত্ম-রক্ষা নগর-রক্ষা এই দুইটির প্রতিই বিশেষ লক্ষ্য করিয়া কার্য করিতে হইবে। বিশেষ ইহাতে আমার আর একটি উদ্দেশ্য সফল হইবে।”
“কি উদ্দেশ্য সফল হইবে।”
“মহারাজ! কার্বালা প্রান্তরে হোসেন যেমন জল বিহনে শুষ্ককণ্ঠ হইয়া সারা হইয়াছিল, সেইরূপ দামেস্ক-নগরে হানিফা অন্ন বিহনে সর্বস্বান্ত হইবে। এ রাজ্যে কে তাহাদের আহার যোগাইবে? কে তাহাদের সাহায্য করিবে? আমরা আক্রমণের নামও করিব না, উহারাই আক্রমণ করুক; আক্রমণ ইচ্ছা না হয়, শিবির নির্মাণ করিয়া বসিয়া থাকুক; অগ্রে কিছুই বলিব না। যত দিন বসিয়া থাকিবে, ততই আমাদের মঙ্গল। অন্নের অনটন পড়ুক, ক্রমে স্বাস্থ্য ভঙ্গ হউক, সময় পাইলে আমরা মনোমত প্রস্তুত হইতে পারিব। সে সময় বিষম বিক্রমে আক্রমণ করিব।”
এজিদ্ অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া সম্মত হইলেন, আক্রমণ জন্য আর অগ্রসর হইলেন না, অন্য চিন্তায় মন দিলেন।
ওদিকে গাজী রহমান আপন সুবিধামত স্থানে শিবির নির্মাণের আদেশ দিয়া গমনে ক্ষান্ত হইলেন। মোহাম্মদ হানিফা, মস্হাব কাক্কা প্রভৃতি গাজী রহমানের নির্দিষ্ট স্থান মনোনীত করিয়া অশ্ব হইতে অবতরণ করিলেন। সৈন্য সামন্ত, অশ্ব উষ্ট্র ইত্যাদি ক্রমে আসিয়া জুটিতে লাগিল। বাসোপযোগী বস্ত্রাবাস নির্মাণ হইতে আরম্ভ হইল। গাজী রহমানের আদেশে দক্ষিণে, বামে, সম্মুখে, সীমা নির্দিষ্ট করিয়া তখনি সামরিক নিশান উড়িতে লাগিল। মারওয়ানের চিন্তা বিফল হইল। সমর-ক্ষেত্র,-উভয় দলের সম্মুখ ক্ষেত্র! এজিদ্ পক্ষেও যুদ্ধ নিশান উড়িল, শিবির নির্মাণের ত্রুটি হইল না-প্রভাতে যুদ্ধ।