রাত্রির পর দিন, দিনের পর রাত্রি আসিয়া, দেখিতে দেখিতে সপ্তাহ কাল অতীত হইয়া গেল। মদিনাবাসীরা মোহাম্মদ হানিফাকে সসৈন্যে আর এক সপ্তাহ মদিনায় থাকিতে বিশেষ অনুরোধ করিলেন। হানিফা অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া হাঁ-না, কিছুই কহিলেন না।
গাজী রহমান বলিলেন, “আপনাদের অনুরোধ অবশ্যই প্রতিপাল্য; কিন্তু জয়নাল উদ্ধারে যতই বিলম্ব, ততই আশঙ্কা, ততই বিপদ মনে করিতে হইবে। এ সময় বিশ্রামের সময় নহে। এক এক মুহূর্ত এক এক যুগ বলিয়া মনে হইতেছে! বিশেষ মারওয়ানের মন্ত্রণার অন্ত নাই-কোন্ সময় এজিদ্কে কোন্ পথে চালাইয়া কি অনর্থ ঘটাইবে, তাহা কে বলিতে পারে? হয় তো সে সময় এজিদের প্রাণান্ত সহিত দামেস্ক, নগর সমভূমি করিলেও সে দুঃখের উপশম হইবে না,-সে অনন্ত দুঃখের ইতি হইবে না। আপনারা প্রবীণ এবং প্রাচীন, যাহা ভাল হয় করুন।”
নাগরিকদল হইতে একজন বলিলেন, “মন্ত্রিবর! আপনার সারগর্ভ বচন অবশ্যই আদরণীয়, সন্দেহ নাই। কিন্তু আমরা যে কারণে প্রভুকে আর এক সপ্তাহ কাল থাকিতে অনুরোধ করিতেছি, সে কথা এখন বলিব না। তবে সময়ে তাহা অপ্রকাশ থাকিবে না। জয়নাল আবেদীন, এজিদ্ পাপাত্মার বন্দিগৃহে বন্দি; প্রভু হাসান হোসেনের স্ত্রী পরিবার নূরনবী মোহাম্মদের সহধর্মিণী বিবি সালেমাও ইঁহারাও বন্দি; দিবারাত্র, প্রহরে দণ্ডে, পলে অনুপলে আমাদের অন্তরে এ সকল কথা জাগিতেছে-প্রাণ কাঁদিতেছে,-তাঁহাদের দুঃখের কথা শুনিয়া হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে! মনে হইতেছে যদি পাখা থাকিত, যদি মুহূর্ত মধ্যে যাইবার কোন উপায় থাকিত, তবে এখনি যাইয়া দামেস্ক নগর আক্রমণ এবং নরাধম এজিদের প্রাণবধ করিয়া জয়নাল উদ্ধারের উপায় করিতাম। আমরা ভুক্তভোগী, আমাদের পদে পদে আশঙ্কা, পদে পদে নৈরাশ্য। অধিক আর কি বলিব, এজিদের আজ্ঞায়, মারওয়ানের মন্ত্রণায়, অলীদের চক্রে, জায়েদার সাহায্যে, মায়মুনার কৌশলে, মহর্ষি হাসানকে হারাইয়াছি। জেয়াদের ছলনায়, সেই মহাপাপী চির-নারকী জেয়াদের প্রবঞ্চনায় প্রভু হোসেন, মহাবীর কাসেম এবং আলি আকবর প্রভৃতিকে মদিনা হইতে চিরবিদায় দিয়াছি। মন্ত্রিবর! কি বলিব! মদিনার শত শত সমুজ্জ্বল রত্ন, কারবালা-প্রান্তরে রক্তস্রোতে ভাসিয়া গিয়াছে-সে সকল কথা কি আমরা ভুলিয়াছি? তবে যে কেন বিলম্ব করিতেছি-বলিব। যদি ঈশ্বর সে সময়ের মুখ দেখান, তবে বলিব। আমাদের শত অনুরোধ,-মদিনাবাসী আবালবৃদ্ধ নরনারী সকলেরই অনুরোধ, আর এক সপ্তাহ আপনারা সসৈন্যে মদিনায় অবস্থিতি করুন। সময় হইলে আমরা কখনোই দামেস্কগমনে বাধা দিব না, বরং মনের আনন্দে জয় জয় রবে, জয়নাল উদ্ধারে আপনাদের সঙ্গে যাত্রা করিব।”
মদিনাবাসীদিগের মত না লইয়া দামেস্ক আক্রমণ করা হইবে না একথা পূর্ব হইতেই সুস্থির আছে। সুতরাং গাজী রহমান আর দ্বিরুক্তি করিলেন না, অন্য অন্য আলাপে নগরবাসীদিগকে সন্তুষ্ট করিলেন। সে দিন কাটিয়া গেল। নিশানগমনে ঈশ্বরাধনা করিয়া সকলেই স্ব স্ব স্থানে নিদ্রাদেবীর নিয়মিত অর্চনায় শয্যার আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।
মোহাম্মদ হানিফা শয়ন করিয়া আছেন-ঘোর নিদ্রায় অভিভূত! স্বপ্ন দেখিতেছেন-যেন হজরত নূরনবী মোহাম্মদ তাঁহার শিয়রে দণ্ডায়মান হইয়া বলিতেছেন, “মোহাম্মদ হানিফ! জাগ্রত হও, আলস্য পরিহার কর, এ সময় তোমার বিশ্রামের সময় নহে। তোমার পরিজন দামেস্কে বন্দি, তুমি মদিনায় বিশ্রামসুখে বিহ্বল! যাও দামেস্কে ঈশ্বরের নাম করিয়া এখনই যাত্রা কর, জয়নাল উদ্ধার হইবে, কোন চিন্তা নাই। ঈশ্বর তোমার সহায়!” মোহাম্মদ হানিফা যেন স্বপ্নযোগেই প্রভুর পদধূলি মস্তকে গ্রহণ করিলেন। নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল-অঙ্গ শিহরিয়া উঠিল। ভয়ে ভীত হইয়া গাজী রহমানকে ডাকিয়া, মস্হাব কাক্কা, ওমর আলী এবং আর আর আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুগণকে জাগাইয়া, স্বপ্ন-বিবরণ বলিলেন।
গাজী রহমান বলিলেন, “প্রভুর আদেশ হইয়াছে, আর বিলম্ব নাই, এখনই যাত্রা,-এই শুভ সময়। হাঁ, এখন বুঝিলাম-সময়ের অর্থ এখন বুঝিলাম। আমরা কেবল রাজনীতি, সমরনীতি, বিধি ব্যবস্থা যুক্তি ও কারণের উপর নির্ভর করিয়াই কার্য করি। ভ্রম হইলে ঈশ্বরের দোহাই দিয়া রক্ষা পাই। কিন্তু মদিনাবাসীরা আমাদের অপেক্ষা সহস্রাংশে শ্রেষ্ঠ। আমি সে সময়ের অর্থই বুঝিতে পারি নাই। ধন্য মদিনা! ধন্য তোমার পবিত্রতা! ধন্য তোমার একাগ্রতা!”
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “গাজী রহমান! আমরা বাহ্যিক ব্যবহার, বাহ্যিক কারণ দেখিয়াই কার্যানুষ্ঠান করি; কিন্তু মদিনাবাসীদিগের প্রতি কার্য ঈশ্বরে নির্ভর করে এবং নূরনবী মোহাম্মদের প্রতি তাঁহাদের অটল ভক্তি,-তাহার প্রমাণ প্রাচীন কাহিনী। প্রভুর জন্মস্থান মক্কা নগরের অধিবাসীরা প্রভুর কথায় বিশ্বাস ও আস্থা প্রকাশ করা দূরে থাকুক বরং তাঁহার জীবনের বৈরী হইয়াছিল। এই মদিনাবাসীরাই তাঁহাকে সম্মানের সহিত গ্রহণ করে এবং ঈশ্বরের সত্যধর্ম এই মদিনাবাসীরাই প্রকাশ্যভাবে অকপটে গ্রহণ করে। আর অধিক কি বলিব, মদিনাবাসীর অন্তর সরল ও প্রেমপূর্ণ। আমি এখনই যাত্রা করিব, প্রভাতের প্রতীক্ষায় আর থাকিব না।”
আজ্ঞামাত্র ঘোর রবে ভেরী বাজিতে লাগিল। সৈন্যগণ নিদ্রাসুখ পরিহার করিয়া আতঙ্কে জাগিয়া উঠিল। সাজ সাজ রবে চতুর্দিকে মহা কোলাহল পড়িয়া গেল। সজ্জিত হইলে প্রভাতীয় উপাসনা সময়ের আহ্বান-স্বরে সকলের কর্ণকে আনন্দিত করিল। মদিনাবাসীরা প্রথমে ভেরীর শব্দ এবং পরে উপাসনার সুমধুর আহ্বান-স্বরে জাগরিত হইয়া নিয়মিত উপাসনায় যোগ দিলেন। মোহাম্মদ হানিফা, গাজী রহমান প্রভৃতি সৈন্যাধ্যক্ষগণ এবং সৈন্যগণ, সজ্জিত-বেশে উপাসনায় দণ্ডায়মান হইয়া একাগ্রচিত্তে উপাসনা সমাধান করিয়া, জয়নালের উদ্ধারের জন্য পরমেশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিলেন।
নগরবাসীরা মহাব্যস্ত হইয়া হানিফার চতুর্দিক বেষ্টন করতঃ যোড়করে বলিতে লাগিলেন, “হজরত! গতকল্য আমরা যে প্রার্থনা করিয়াছিলাম, তাহা বোধ হয় গ্রাহ্য হইল না।”
মোহাম্মদ হানিফা বিনয়বচনে বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! বিগত নিশায় স্বপ্নযোগে প্রভু মোহাম্মদ আমাকে দামেস্ক গমনে আদেশ করিয়াছেন। আর আমার সাধ্য নাই যে, এখানে ক্ষণকাল বিলম্ব করি!”
“হজরত! আমরা অজ্ঞ, অপরাধ মার্জনা হউক। ঐ আদেশের জন্যই সপ্তাহকাল মদিনায় অবস্থিতির নিমিত্ত পূর্বেও প্রার্থনা করিয়াছিলাম। গতকল্যের প্রার্থনাও ঐ কারণে। আমরা চির-আজ্ঞাবহ দাস, মার্জনা করিবেন। এখন আমাদের আর কোন কথা নাই-আপনিও প্রস্তুত হইয়াছেন, আমরাও প্রস্তুত আছি। আপনি অশ্বে কশাঘাত করিলেই দেখিবেন, কত লোক জয়নাল উদ্ধারে আপনার অনুগামী হয়।”
মোহাম্মদ হানিফা, মস্হাব কাক্কা, গাজী রহমান ও হানিফার আর আত্মীয়-স্বজন এবং ভিন্ন ভিন্ন দেশীয় রাজগণ, বীরদর্পে অশ্বপৃষ্ঠে ঈশ্বরের নাম করিয়া চাপিয়া বসিলেন। রণবাদ্য বাজিতে লাগিল। সৈন্যগণ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া হানিফার বিজয় ঘোষণা করিতে করিতে যাত্রা করিল। ধানুকী, পদাতিক ও পতাকিগণ আনন্দ-রবে অগ্রে চলিল।
সপ্তবার হজরতের পবিত্র রওজা পরিক্রম করিয়া সমস্বরে ঈশ্বরের নাম ডাকিয়া সকলে জয়নাল-উদ্ধারে যাত্রা করিলেন। মদিনাবাসীরাও অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া মহানন্দে হানিফার জয়ঘোষণা করিতে করিতে সৈন্যদলে মিশিলেন। মারণ ভিন্ন মরণ কথা কাহারো মনে নাই। সিংহদ্বার পার হইয়া সকলে পুনরায় একস্বরে ঈশ্বরের নাম সপ্তবার উচ্চারণ করিয়া যাইতে লাগিলেন। পথপ্রদর্শক উষ্ট্রারোহী মধুরস্বরে বংশীবাদন করিতে করিতে সকলের অগ্রে অগ্রে চলিল।
দিবাভাগে গমন-রাত্রে বিশ্রাম। এই ভাবে কয়েক দিন যাইতে যাইতে একদিন পথপ্রদর্শকদল সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার জন্য ভেরী বাজাইতে লাগিলেন। সকলেই সমুৎসুক হইয়া সম্মুখে স্থিরনেত্রে দৃষ্টি করিতেই দেখিলেন যে, বহুদূরে শিবিরের উচ্চ চূড়ায় লোহিত নিশান উড়িতেছে। গাজী রহমান সাঙ্কেতিক নিশান উড়াইয়া সকলকে গমনে ক্ষান্ত করিলেন। সকলেই মহাব্যস্ত। তত্ত্বানুসন্ধানে জানিলেন যে, সম্মুখে সমরনিশান উড়িতেছে, সবিশেষ না জানিয়া আর অগ্রসর হওয়া উচিত নহে।
মারওয়ান-শিবিরেও মারওয়ান ভেরীবাদনধ্বনি শুনিয়াছে।
শিবিরের বাহিরে আসিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে তাহার মুখে অন্য কোন কথা সরিল না। অস্থির ও আতঙ্কিত ভাবে অলীদকে জিজ্ঞাসা করিল, “ভ্রাতঃ! আবার যে পূর্বগগনে কি দেখা যায়। ঐ কি আগমন?”
“কার আগমন?”
“আর কার? যার ভয়ে অলীদ কম্পমান-মারওয়ান অস্থির।”
অলীদ বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিয়া বলিল, “আর সন্দেহ নাই-এক্ষণে কি করা যায়?”
“আর কি করা! কিছু দিন বিশ্রাম করিব আশা ছিল-ঘটিল না।-আর ক্ষণকাল তিষ্ঠিলেই তোমার আমার দশা মিলিয়া মিশিয়া বোধ হয়, একই হইবে। হয়ত কিছু বেশিও হইতে পারে। পূর্ব সঙ্কল্প ঠিক রাখিয়া, যত শীঘ্র হইতে পারে, যাইয়া নগর-রক্ষার উপায় করা কর্তব্য। নিতান্ত পক্ষে চাপিয়া পড়ে, দামেস্ক নগর-নিকটস্থ প্রান্তরে আবার ডঙ্কা বাজাইয়া নিশান উড়াইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইব। এখানে আর কিছুই নহে; প্রস্থান-ত্রস্তে প্রস্থান।”
“উহারা যে বিক্রমে আসিতেছে, আমরা যে উহাদের অগ্রে দামেস্কে যাইতে পারিব, তাহাতেও অনেক সন্দেহ! আপন রাজ্যে দ্বিগুণ বল; যেখানেই ধর ধর, সেই খানেই মার মার। ঐ দেখ, উহারাও গমনে ক্ষান্ত হইয়াছে। না জানিয়া, বিশেষ তত্ত্ব না লইয়া কেন অগ্রসর হইবে? আমাদের সন্ধান না লইতে লইতে আমরা এ স্থান হইতে চলিয়া যাই। আর কথা নাই ভাই। প্রস্থান,-শীঘ্র প্রস্থান।”
তখনই শিবির-ভঙ্গের আদেশ হইল, লোহিত পতাকা নীচে নামিল। মুহূর্তমধ্যে শিবির ভঙ্গ করিয়া, মারওয়ান ও অলীদ সৈন্যগণসহ দামেস্কাভিমুখে বেগে চলিল।
ওদিকে গাজী রহমান মহা চিন্তায় পড়িয়াছেন! এই নিশান উড়িতে উড়িতে কোথায় উড়িয়া গেল? দেখিতে দেখিতে শিবিরও ভগ্ন হইল। লোকজনও সরিতে লাগিল। ক্রমেই ঈষৎ দৃষ্টি,-ক্রমেই দৃষ্টির অগোচর।
মোহাম্মদ হানিফা গাজী রহমানকে বলিলেন, “আর চিন্তা কেন? পৃষ্ঠ দেখাইয়া যখন পলাইয়া গেল, তখন আর সন্দেহ কি? পলায়িত ব্যক্তির পরিচয় নিষ্প্রয়োজন,-আজ এই স্থানেই বিশ্রাম।”
“তাহাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু বিশেষ সতর্কভাবে থাকিতে হইবে। উহারা পলাইয়া বলিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি না। গুপ্তচরদিগকে কয়েক জন চতুর সৈন্যসহ সন্ধানে পাঠাইতেছি। সন্ধান করিয়া জানিয়া আসুক-উহারা কে? কেন শিবির স্থাপন করিয়াছিল? কেনই বা চলিয়া গেল?”
“ও’ত ওত্বে অলীদের শিবির নহে!”
“না-না; অলীদের শিবিরের অত জাঁকজমক কোথা?”
“তবে কে?”
“সেই তো সন্দেহ, এখনই জানিতে পারিবে।”