কী মর্মভেদী দৃশ্য! কী হৃদয়বিদারক বিষাদ ভাব! কাহারো মুখে কথা নাই, হর্ষের চিহ্ন নাই, যুদ্ধজয়ের নাম নাই, সীমারবধের প্রসঙ্গ নাই, অলীদ পরাজয়ের আলোচনা নাই। রাজা রাজবেশশূন্য, শির শিরস্ত্রাণশূন্য, পদ পাদুকাশূন্য, পরিধেয় নীলবাস,-বিষাদ-চিহ্ন নীলবাস। সৈন্যদলে বাজনা বাজিতেছে না, তুরি-ডঙ্কার আর শব্দ হইতেছে না। “নকীব” উষ্ট্রপৃষ্ঠে বসিয়া ভেরীরবে ভূপতিগণের শুভাগমনবার্তা আর ঘোষণা করিতেছে না। সকলেই পদব্রজে-সকলেই ম্লানমুখে-নীরবে। তীর তূণীরে, তরবারি কোষে, খ র পিধানে, সকল চক্ষুই জলে পরিপূর্ণ। কারুকার্যখচিত সুন্দর নিশান-স্থান আজ নীল নিশান। হানিফা সসৈন্যে রাজপথে-পুণ্যভূমি মদিনা নগরের রাজপথে। নগরের উচ্চ উচ্চ প্রাসাদে, অত্যুচ্চ মঞ্চে, সিংহদ্বারে, নানা স্থানে, অনন্ত শোক-প্রকাশক নীল পতাকা-সকল অনিল সহকারে অনন্ত নীলাকাশে মিশিয়া হোসেনের অনন্ত শোক কাঁপিয়া কাঁপিয়া প্রকাশ করিতেছে। যে দিকে দৃষ্টিপাত কর, সেই দিকেই শোকের চিহ্ন-বিষাদের রেখা। হোসেন-শোকে মদিনার এই দশা। এ দশা কে করিল? এ অন্তর্ভেদী দুর্দশা কে ঘটাইল? মর্ত্যে, শূন্যে, আকাশে, নীলিমা-রেখা কে অঙ্কিত করিল? হায়! হায়! হোসেন-শোকের অন্ত নাই। এ বিষাদ-সিন্ধুর শেষ নাই। বিমানে সূর্যদেবের অধিকার, রজনীদেবী, তারকামালার অধিকার থাকা পর্যন্ত মোহাম্মদীয়গণের অন্তরাকাশ হইতে এ মহাবিষাদ-নীলিমারেখা কখনোই বিলীন হইবে না-কখনোই সরিবে না।
মোহাম্মদ হানিফা নিদারুণ শোকে, মর্মভেদী বেশে, নগরে প্রবেশ করিলেন। নগরবাসিগণ হোসেনের নাম করিয়া কাঁদিয়া কাঁদিতে মোহাম্মদ হানিফার পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত হইতে লাগিল। হায়! পুণ্যভূমি মদিনা আজ অন্ধকার! মোহাম্মদ হানিফার অন্তরে শোকসিন্ধুর তরঙ্গ উঠিয়াছে-প্রবাহ ছুটিয়াছে। নূরনবী হজরত মোহাম্মদের রওজার চতুষ্পার্শ্বে যাইয়া সকলে একত্রে হাসান, হোসেন, কাসেম প্রভৃতির শোকে অধীর হইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। ক্রমেই ক্রন্দনের আবেগ বুদ্ধি-আরো বৃদ্ধি। কিন্তু বৃদ্ধি হইতে হইতেই হ্রাস, ক্রমেই মন্দীভূত, ক্রমেই নীরব, ক্রমেই চক্ষু জলহীন, ক্রমেই পরিবর্তন, ক্রমেই হা-হুতাশ, ক্রমেই দুই একটি কথা শুনা যাইতে লাগিল। মোহাম্মদ হানিফা সকলের কথাই শুনিতে লাগিলেন। কাহাকেও আশ্বস্ত করিলেন, কাহাকেও সাহস দিলেন, কাহাকেও বা সস্নেহ মিষ্ট সম্ভাষণে আদর করিলেন। ক্রমে নাগরিকদলকে বিদায় করিয়া সঙ্গী রাজগণ, সৈন্যগণ, আত্মীয় বন্ধুবান্ধবগণ, কে কোথায় আছেন, কি করিতেছেন, তাহার তত্ত্বাবধান এবং আহার-বিহার ও বিশ্রামের শৃঙ্খলায় মনোনিবেশ করিলেন।
মদিনার প্রধান প্রধান ও মাননীয় সম্ভ্রান্ত মহোদয়গণ আসিয়া বলিতে লাগিলেন, “যাহা হইবার হইয়াছে, এক্ষণে কি করা যায়?”
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “মদিনার সিংহাসনে জয়নাল আবেদীনকে না বসাইতে পারিলে, আমার মনে শান্তি হইবে না। দুঃখ করিবার সময় অনেক রহিয়াছে। মদিনার যেরূপ শ্রীহীন অবস্থা দেখিতেছি, ইহাতে আমার মন অত্যন্ত চঞ্চল ও ব্যথিত হইয়া মহাকষ্ট ভোগ করিতেছে। জয়নাল আবেদীন নিশ্চয়ই জীবিত আছে। জয়নাল মদিনা ও দামেস্ক উভয় রাজ্যই করতলস্থ করিয়া একচ্ছত্ররূপে রাজত্ব করিবে, ইহা নিশ্চয়, অব্যর্থ। যাঁহার ভবিষ্যদ্বাণী এতদূর সফল হইল, তাঁহার বাক্যের শেষ অংশ কি আর সফল হইবে না? আপনারা সকলে অনুমতি করিলেই আমি দামেস্ক আক্রমণে যাত্রা করিতে পারি।”
নাগরিকদলের মধ্য হইতে একজন বলিলেন, “জয়নাল আবেদীন ঈশ্বরানুগ্রহে অবশ্যই মক্কা, মদিনা ও দামেস্কের সিংহাসন অধিকার করিবেন, সে বিষয়ে আমাদের জ্বলন্ত বিশ্বাস ও অটল আশা আছে; তবে কয়েক দিন বিলম্ব মাত্র। আপনি পথশ্রমে ক্লান্ত, সৈন্যগণও অলীদসহ যুদ্ধে ক্লান্ত হইয়াছে; এ অবস্থায় কয়েক দিন এই পবিত্র ধামে বিশ্রাম করিয়া দামেস্কে যাত্রা করেন, এই আমাদের প্রার্থনা। জয়নাল-উদ্ধারে মদিনার আবাল-বৃদ্ধ আপনার পশ্চাদ্বর্তী হইবে, কেহই ঘরে বসিয়া থাকিবে না। এতদিন আমরা নায়কবিহীন হইয়া পথে পথে ঘুরিয়াছি, যাহার যাহা ইচ্ছা তাহাই বলিয়াছি; কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। হজরতের চরণপ্রান্তে আশ্রয় লইব বলিয়াই কাসেদ্ পাঠাইয়াছিলাম। আপনি এত অল্প সৈন্য লইয়া কখনো দামেস্কে যাইবেন না। এজিদের চক্র, মারওয়ানের মন্ত্রণা ভেদ করা বড়ই কঠিন;-আমরা আপনার সঙ্গে যাইব। এখনো মদিনা বীরশূন্য হয় নাই, এখনো মদিনা পরাধীন বা পরপদভরে দলিত হয় নাই,-এখনো মদিনার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয় নাই। (কখনো হইবে না)। এখনো মদিনা একেবারে নিঃসহায়, কি কোন বিষয়ে নিরাশ হয় নাই। এজিদের অত্যাচার-নূরনবী মোহাম্মদের বংশধরগণের প্রতি অত্যাচারের কথা মদিনা ভুলে নাই। যাঁহার জন্য এই পবিত্র সিংহাসন শূন্য আছে, তাঁহার কথা সকলের অন্তরে গাঁথা রহিয়াছে-তাঁহার উদ্ধারের চেষ্টা দিবানিশি অন্তরে জাগিতেছে। আপনি যেদিন মদিনা হইতে যাত্রা করিবেন, সেই দিন মদিনার লোকের প্রভুভক্তি, রাজভক্তি, একতার আদর্শ, হোসেনের বিয়োগজনিত দুঃখের চিহ্ন, সকলই দেখিতে পাইবেন। আমি আর অধিক বলিতে পারি না। এইমাত্র নিবেদন যে সপ্তাহ কাল এই নগরে বিশ্রাম করুন, সপ্তাহ অন্তর আমরা সকলে আপনার সঙ্গী হইব।”
মোহাম্মদ হানিফা নগরবাসীদিগের অনুরোধে সপ্তাহকাল সসৈন্যে মদিনায় থাকিতে সম্মত হইলেন।
ওদিকে মারওয়ান মদিনাভিমুখে আগমন এবং অলীদের দামেস্কে গমন, পথিমধ্যে উভয় সেনাপতির সাক্ষাৎ-উভয় দলের মিলন। অলীদের সঙ্গে অতি অল্পমাত্র সৈন্য; তাহার অধিকাংশই আহত, কতক জরা, কতক অর্ধমরা, কতক অসুস্থ। মুখ মলিন, বসন মলিন! পৃষ্ঠে তূণীর ঝুলিতেছে, তীর নাই। কোষ রহিয়াছে, তরবারি নাই। বর্শার ফলক কোথায় উড়িয়া গিয়াছে, কেবল দণ্ড বর্তমান। ছিন্নপতাকা ভগ্নদণ্ড। সাহস উৎসাহের নামমাত্র নাই। যেন তাড়িত-ভয়ে চকিত সর্বদাই পশ্চাদ্দৃষ্টি। মনঃসংযোগে অশ্বপদশব্দ শুনিতে কর্ণ স্থির। সৈন্যগণের অবস্থা দেখিলেই অনুমান হয় যে, প্রবল ঝঞ্ঝাবাতেই ইহাদের সর্বস্ব উড়িয়া গিয়াছে; আহারাভাবেও মহাক্লান্ত।
মন্ত্রীপ্রবর মারওয়ান, অলীদের অবস্থা দেখিয়া আর অগ্রসর হইতে সাহসী হইল না; ঐ সংযোগস্থলেই উভয় দল একত্রিত হইয়া গমনে ক্ষান্ত হইল। পরস্পর কথাবার্তা হইলে মারওযান বলিল, “এইক্ষণ মদিনা আক্রমণ, কি হানিফার সহিত যুদ্ধ করা উচিত নহে। আমাদের বলবিক্রমের সহিত তুলনা করিলে হানিফার সৈন্যবল সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ; এ অবস্থায় আত্মরক্ষাই সর্বতোভাবে শ্রেয়ঃ।”
অলীদ বলিল, “আত্মরক্ষা ভিন্ন আর উপায় কি? সীমারের দুর্দশা দেখিয়া আমার প্রাণ কাঁপিয়া গিয়াছে।”
“সীমারের দুর্দশা কি?”
অলীদ সীমারের শাস্তির বৃত্তান্ত আদি-অন্ত বিবৃত করিল।
মারওয়ান বলিল, “সীমারের যে দুর্দশা ঘটিবে তাহা আমি অগ্রেই ভাবিয়া স্থির করিয়াছিলাম।”
অলীদ বলিল, “ভ্রাতঃ! হানিফার বলবিক্রম দেখিয়া স্বদেশের আশা, জীবনের আশা, ধন-জন পরিজন আশা হইতে একেবারে নিরাশ হই নাই বটে, কিন্তু সন্দেহ অনেক ঘটিয়াছে?”
“আরে ভাই! আমিই তো সীমার-উদ্ধার ও তোমার সাহায্য, এই দুই কার্যের ভার গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি। সীমারের উদ্ধার তো এ জীবনে এক প্রকার শেষ হইল। এখন তোমার সাহায্য বাকী। যাহা হউক, এই সকল অবস্থা লিখিয়া মহারাজ সমীপে কাসেদ্ প্রেরণ করি। উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমরা এই স্থানেই অবস্থিতি করিব। এ স্থানটি অতি মনোহর ও মনোরম।”