মন্ত্রণাগৃহে এজিদ্ একা। দেখিলেই বোধ হয় যেন কোন বৃহৎ চিন্তায় এখন তাহার মস্তিষ্ক-সিন্ধু উথলিয়া উঠিয়াছে। দুঃখের সহিত চিন্তা,-এ চিন্তার কারণ কী? কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া গৃহের চতুষ্পার্শে দৃষ্টি করিল;-দেখিল কেহ নাই! পূর্ব নির্দিষ্ট সময়ে মারওয়ান মন্ত্রণাগৃহে উপস্থিত থাকিবে; সময় উত্তীর্ণ হইয়াছে, তথাচ মন্ত্রীবর আসিতেছে না। এজিদের চিন্তাকুল অন্তর ক্রমেই অস্থির হইতেছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া মৃদুমৃদু স্বরে বলিল, “সীমার বন্দি! এতদিন পরে সীমার শত্রুহস্তে বন্দি! অলীদেরও প্রাণের আশঙ্কা! আমারই সৈন্য, আমারই চির-অনুগত সৈন্য যখন বিপক্ষ দলে মিশিয়াছে, তখন আর কল্যাণ নাই! হা! কী কুক্ষণেই জয়নাব রূপ নয়নে পড়িয়াছিল! সে বিশালাক্ষির দোলায়মান কর্ণাভরণের দোলায় কি মহা অনর্থই ঘটিল। অকালে কত প্রাণীর প্রাণপাখি দেহপিঞ্জর হইতে একেবারে উড়িয়া চলিয়া গেল। শত শত নারী পতিহারা হইয়া মনের দুঃখে আত্মবিসর্জন করিল! কত মাতা সন্তান বিয়োগে অধীরা হইয়া অস্ত্রের সহায়ে দৈহিক মায়া হইতে-শোক-তাপের যন্ত্রণা হইতে-আত্মাকে রক্ষা করিল। কত দুগ্ধপোষ্য শিশু সন্তান এক বিন্দু জলের জন্য শুষ্ককণ্ঠ হইয়া মাতার ক্রোড়ে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হইল! ছি ছি! সামান্য প্রেমের দায়ে, দুরাশার কুহকে, মহাপাপী হইতে হইল! হায়! হায়! রূপজ মোহে মোহিত হইয়া, আত্মহারা, বন্ধুহারা শেষে সর্বস্বহারা হইতে হইল? বিনা দোষে, বিনা কারণে, কত পুণ্যাত্মার জীবন প্রদীপ নিবিয়া গেল! এত হইল, এত ঘটিল, তবু আগুন নিবিল না,-সে রত্ন হস্তগত হইয়াও আশা পূর্ণ হইল না, স্ববশে আসিল না।-হোসেনকে বধ করিয়াও সে চিন্তার ইতি হইল না। ক্রমেই আগুন দ্বিগুণ ত্রিগুণরূপে জ্বলিয়া উঠিল। সৈন্যহারা, মিত্রহারা, রাজ্যহারা, ক্রমে সর্বস্বহারা হইবার উপক্রম হইয়া উঠিল! ধিক্ প্রণয়ে! ধিক্ রমণীর রূপে! শত ধিক্ কুপ্রেমাভিলাষী পুরুষে! সহস্র ধিক্ পরস্ত্রী-অপহারক রাজায়!”
এই পর্যন্ত বলিতেই মারওয়ান উপস্থিত হইয়া যথাবিধি সম্ভাষণ করিল। এজিদ্ অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “সীমারের কি হইল!”
“মহারাজ! সীমার যখন বিপক্ষদলের হস্তগত হইলেন, তখন তাঁহার আশা একপ্রকার পরিত্যাগ করিতে হইবে। এখন ওত্বে অলীদের রক্ষা, রাজ্যরক্ষা, প্রাণরক্ষা, এই সকল রক্ষার উপায় চিন্তা করাই অগ্রে কর্তব্য। সীমার-উদ্ধার, সীমারের আশা আর করিবেন না। কারণ, সীমার মোহাম্মদ হানিফার হস্তগত হইলে তাঁহার রক্ষা কিছুতেই নাই।”
“তবে কি সীমার নাই?”
“সীমার নাই, এ-কথা বলিতে পারি না। তবে অনুমানে বোধ হয় যে, সীমার মোহাম্মদ হানিফার হস্তে ধরা পড়িয়াছেন। সুতরাং সীমার-উদ্ধারের চিন্তা না করিয়া অলীদ-উদ্ধারের চিন্তাই এইক্ষণে আবশ্যক হইয়াছে। তার পর ও কয়েক দিনে যদি অলীদ বন্দি হইয়া থাকেন, কি যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া যদি আত্মসমর্পণ করিয়া থাকেন, তবে প্রথম চিন্তা দামেস্করাজ্য রক্ষা, আপনার প্রাণরক্ষা। আপন সৈন্য যখন বিপক্ষদলে মিশিয়াছে, তখন দুঃসময়ের পূর্ব চিহ্ন, দুরবস্থার পূর্বলক্ষণ, সম্পূর্ণ বিপদের সূচনা দৃশ্য দেখাইয়া, অমঙ্গলকে আহ্বান করিতেছে। আমাদের সৌভাগ্য শশী চির-রাহুগ্রস্ত হইবে বলিয়াই জগতের অন্ধকার ছায়ার দিকে ক্রমশঃই সরিতেছে।”
এজিদের কর্ণে কথা কয়টি বিষসংযুক্ত সূচিকার ন্যায় বিদ্ধ হইল; তাহার মনের পূর্বভাব কে যেন হরণ করিয়া অন্তরময় মহাবিষ ঢালিয়া দিল। সিংহগর্জনে গর্জিয়া উঠিল, “কি আমি বাঁচিয়া থাকিতে দামেস্কের সৌভাগ্য-শশী চির-রাহুগ্রস্ত হইবে? এ কথা তুমি আজ কোথায় পাইলে? কে তোমার কর্ণে এ মূলমন্ত্র টিপিয়া দিয়াছে? মারওয়ান বুঝিলাম, হানিফার তরবারির তেজের কথা শুনিয়া তোমারও হৃৎপিণ্ডের শোণিতসার শুকাইয়া গিয়াছে। তুমি নিশ্চয় জানিয়ো, এজিদ্ বর্তমান থাকিতে এ রাজ্যে সৌভাগ্য-শশীর অল্প পরিমাণ অংশ রাহুর গ্রাসে পতিত হইবে না। আমি তোমাকে এইক্ষণে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিব, তুমি তাহারই উত্তর দাও। জয়নাল আবেদীন, হাসান পরিবার-ইহারা কী এখন জীবিত থাকিবে? মোহাম্মদ হানিফা যদি সীমারের প্রাণবিনাশ করিয়া থাকে, তবে নিশ্চয়ই আমি জয়নালের শিরচ্ছেদ স্বহস্তে করিব।”
“মহারাজ! এ সময় জয়নাল আবেদীনের প্রাণবিনাশ করিলে আর নিস্তার নাই। এ জ্বলন্ত আগুন এখন নির্বাণের উপায় আছে-এখনো রক্ষার উপায় আছে-এখনো সন্ধির আশা আছে। কিন্তু জয়নালের কোন অনিষ্ট ঘটাইলে ধন, জন, রাজ্য, প্রাণ সমূলে বিনাশের সুপ্রশস্ত পথ পরিষ্কার করিয়া দেওয়া হইবে। দামেস্করাজ্যের আশা, প্রাণের আশা পরিত্যাগ করিয়া জয়নাল আবেদীনকে যাহা ইচ্ছা হয় করিতে পারেন। এখন পরাজয় স্বীকারপূর্বক জয়নালকে ছাড়িয়া দিলে দামেস্কনগর রক্ষার আশা করিলেও করা যাইতে পারে। দেখুন হাসানের বধসাধন হইলে, বৃদ্ধ মন্ত্রী হামান প্রকাশ্য সভায় যে সারগর্ভ রাজনৈতিক উপদেশচ্ছলে নিজমত প্রকাশ করিয়াছিলেন, সে সময় আমি তাঁহার মতের পোষকতা করি নাই। যদি জানিতাম যে, হোসেন ব্যতীত মোহাম্মদ হানিফা নামে প্রবল পরাক্রান্ত আরো একজন বীর আছে, তাহা হইলে বৃদ্ধ সচিবের কথা কখনো অবহেলা করিতাম না; আপনার মত প্রবল করিয়া কোনকালেই অগ্রসর হইতাম না; যদি হইতাম তবে অগ্রে হানিফার বধসাধন না করিয়া হোসেনের বিরুদ্ধে কিছুতেই অস্ত্র ধরিতাম না। ভ্রমই লোকের সর্বনাশের মূল। ভ্রমই মনুষ্যের অমঙ্গলের কারণ।”
“মারওয়ান! তোমার এ দুর্বুদ্ধি আজি কেন হইল! আমি পরাজয় স্বীকারে সন্ধি করিব? প্রাণের ভয়ে হানিফার সহিত সন্ধি করিব? জয়নালকে, হোসেন-পরিজনকে ছাড়িয়া দিব? জয়নালকে ছাড়িয়া দিব? ধিক্ তোমার কথায়! আর শত ধিক এজিদের প্রাণে! মারওয়ান! বল তো, এ মহাসংগ্রামের কারণ কি? এ ঘটনার মূল কি? তুমি কি সকলই বিস্মৃত হইয়াছ? মনে হয় তুমিই না বলিয়াছিলে, স্ত্রী-জাতি বাহ্যিক সুখপ্রিয়; কই, এতদিনেও তো তোমার কথার সত্যতা প্রমাণ বা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাইলাম না। জগতে সুখী হইতে কে না ইচ্ছা করে?-এও তোমারই কথা। কই, বন্দিগৃহে মহাকেশে থাকিয়াও তো সুখী হইতে ইচ্ছা করে না, পাটরাণী হইতেও চাহে না? মারওয়ান! তোমার পদে পদে ভ্রম! আমি তো উন্মাদ। গত বিষয় আলোচনা বৃথা! আমার আজ্ঞা এই যে, তোমাকে এখনই অলীদ-সাহায্যে এবং সীমার-উদ্ধারে যাইতে হইবে।”
“আমি যাইতে প্রস্তুত আছি, অলীদের সাহায্য ব্যতীত এ সময়ে হানিফাকে আক্রমণ করিতে আমি পারিব না।”
“সুযোগ পাইলেও আক্রমণ করিবে না?”
“সুযোগ পাইলে মারওয়ান ছাড়িয়া দিবে তাহা মনে করিবেন না। তবে অগ্রেই বলিতেছি যে, অলীদকে রক্ষা করাই আমার প্রধান কার্য। সীমারের দেখা পাইলে, কি জীবিত থাকিলে, অবশ্য উদ্ধারের চেষ্টা করিব।”
“চেষ্টা করিবে,-কী কথা! উদ্ধার করিতেই হইবে।”
“মহারাজ! যে কঠিন সময় উপস্থিত হইয়াছে, নিশ্চিতরূপে আর কিছুই বলিতে পারি না। সময় মন্দ হইলে চতুর্দিক হইতে বিপদ চাপিয়া পড়ে! এখন ভবিষ্যৎ ভাবিয়া কার্য না করিলে, পরিণাম রক্ষা হইবে না। একা মোহাম্মদ হানিফা আপনার শত্রু নহে! নানা দেশের, নানা রাজ্যের ভূপতি ও বীরপুরুষগণ আপনার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়াছে; বলিতে গেলে, মোহাম্মদভক্ত মাত্রেই আপনার প্রাণ লইতে দুই হস্ত বিস্তার করিয়া রহিয়াছে।”
“আমি কী এতই হীনবল হইয়া পড়িয়াছি যে, তোমার বর্ণিত রাজগণ সহিত যুদ্ধ করিয়া পরাস্ত হইব?”
“মহারাজ! জয়-পরাজয় ভবিষ্যতের গর্ভে!”
“তবে কী হানিফার খণ্ডিত মস্তক আমি দেখিব না?”
“অবশ্যই দেখিতে পারেন-বিলম্বে।”
“কথা অনেক শুনিলাম, তুমি অদ্যই পঞ্চদশ সহস্র সৈন্য লইয়া অলীদের সাহায্যে এবং সীমারের উদ্ধারে গমন কর, এই আমার আজ্ঞা।”
এই আজ্ঞা করিয়া এজিদ্ রোষভরে মন্ত্রণাগৃহ হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল।
মারওয়ান বলিতে লাগিল, “দুর্মতির লক্ষণই এই, যেখানে উচিত সেইখানেই রোষ। যাহা হউক আমি এখনই যাত্রা করিব, সীমারের উদ্ধার যাহা হইবার বোধ হয় এতদিনে হইয়া গিয়াছে, অলীদের উদ্ধার হয় কি-না, তাহাই সন্দেহ।”