পরিণাম কাহার না আছে? নিশার অবসান, দিনের সন্ধ্যা, পরমায়ুর শেষ, গর্ভের প্রসব, উপন্যাসের মিলন, নাটকের যবনিকা পতন, অবশ্যই আছে; পুণ্যের ফল, পাপের শাস্তি-ইহাও নিশ্চয়।
সীমার আজ বন্দি! যে সীমারের নামে হৃদয় কাঁপিয়াছে, যে সীমার জগৎ কাঁদাইয়াছে-সেই সীমার আজ বন্দি! সেই সীমারের আজ পরিণাম ফল-শেষ দশা। মোহাম্মদ হানিফা, মস্হাব কাক্কা, গাজী রহমান এবং প্রধান প্রধান সেনাপতিদিগের মত হইল যে, সীমারকে কিছুতেই ইহজগতে রাখা বিধেয় নহে। এমন নিষ্ঠুর, অর্থ-পিশাচ, পাপাত্মার মুখ আর চক্ষে দেখা উচিত নহে। তবে কী কর্তব্য?-যমালয়ে প্রেরণ! কী প্রকারে?-এখনো সাব্যস্ত হয় নাই।
অলীদকে ধৃত করিয়া মোহাম্মদ হানিফা কেন ছাড়িয়া দিলেন, তাহা তিনিই জানেন। মোহাম্মদ হানিফা মদিনার প্রবেশপথে নির্বিঘ্নে রহিয়াছেন, সীমারের শাস্তিবিধান করিয়া অদ্যই মদিনায় যাইবেন;-এই কথাই প্রকাশ।
অলীদের আর যুদ্ধের সাধ নাই-হানিফার মদিনাগমনে বাধা দিবারও আর শক্তি নাই,-মোহাম্মদ হানিফা যখন ধরিয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন তখন এক প্রকার প্রাণের ভয়ও নাই,-কিন্তু আশঙ্কা আছে! মস্হাব কাক্কার কথা প্রতিমুহূর্তে অন্তরে অন্তরে জাগিতেছে! কী লজ্জা! অধীনস্থ যে সৈন্যগণ জীবিত আছে, তাহারাই-বা মনে মনে কি বলিতেছে? আর এক কথা; সে কথা কাহাকেও বলে নাই,-মনে মনেই চিন্তা করিয়াছে,-মনে মনেই দুঃখভোগ করিতেছে-দামেস্কের বহুতর সৈন্য মস্হাব কাক্কার সঙ্গী হইয়াছে, ইহার কারণ কী? কেন তাহারা কাক্কার অধীনতা স্বীকার করিল-ইহার কী কোন কারণ আছে? এই সকল ভাবিয়া অলীদ দামেস্কে না যাইয়া ভগ্নহৃদয়ে ভগ্নশিবিরে হানিফার মদিনাপ্রবেশ পর্যন্ত ঐ স্থানে থাকাই স্থির করিয়াছে।
অসময়ে হানিফার শিবিরে আনন্দের বাজনা। আজ আবার বাজনা কেন? অলীদ ভাবিল, আবার কী যুদ্ধ? আবার কী মস্হাব কাক্কা রণক্ষেত্রে? মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিল, আবার সেই দূরদর্শনের সহায় গ্রহণ করিল, দেখিল-যুদ্ধসাজ নহে। মস্হাব কাক্কা, মোহাম্মদ হানিফা প্রভৃতি বীরগণ ধনুর্বাণহস্তে শিবিরের পশ্চাদ্ভাগ হইতে বহির্গত হইলেন এবং হস্ত পদ বন্ধন অবস্থায় একজন বন্দিকে কয়েকজন সৈন্য ধরাধরি করিয়া আনিয়া উভয় শিবিরের মধ্যবর্তী স্থানে এক লৌহদণ্ডের সহিত বক্ষ বাঁধিয়া, দুই দিকে অপর দুই দণ্ডের সহিত হস্তদ্বয় কঠিনরূপে বাঁধিয়া, বন্দির পদদ্বয় ঐ হস্তাবদ্ধ দণ্ডের নিন্মভাগে আঁটিয়া বাঁধিয়া দিল।
অলীদ মনে মনে ভাবিতেছে, এ আবার কী কাণ্ড উপস্থিত? এমন নিষ্ঠুরভাবে ইহাকে বাঁধিয়া তীরধনু হস্তে সকলে অর্ধ চন্দ্রাকৃতিভাবে কেন ঘিরিয়া দাঁড়াইল? এ লোকটি এমন কী গুরুতর অপরাধ করিয়াছে? ইহার প্রতি এরূপ নির্দয় ব্যবহার করিতেছে কেন? একটু অগ্রসর হইয়া দেখি-কার এ দুর্দশা? কোন্ হতভাগার পাপের ফল?
মস্হাব কাক্কা ধনুর্বাণ হস্তে ধরিয়া ঊচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “সীমার! আজ তোমার সৃষ্টিকর্তার নাম মনে কর, তোমার কৃতকার্যের পাপ-কথা মনে কর। দেখিলে, জগৎ কেমন ভয়ানক স্থান? দেখিলে? একটু বিবেচনা করিয়া দেখিলে, কার্যফল কথঞ্চিৎ পরিমাণে এখানেই কিছু কিছু পাওয়া যায়? লোকে অজ্ঞতা তিমিরাচ্ছন্ন হইয়া ভবিষ্যতের জ্ঞান হারাইয়া, অনেক কার্যে হস্তক্ষেপ করে; কিন্তু শেষে কোথায় রক্ষা পায়? কে রক্ষা করে? মাতা পিতা স্ত্রী পরিবার পরিজন কেহ কাহারো নহে। আজ কে তোমার নিকট আসিয়া দাঁড়াইল? কে তোমার পক্ষ হইয়া দুটা কথা বলিল? মোহতিমিরে কেমন আচ্ছন্ন করিয়াছিল,-তোমার হৃদয়-আকাশ কেমন ঘনঘটায় আবৃত করিয়া রাখিয়াছিল? তুমি একবার ভাব দেখি, নূরনবী মোহাম্মদের দৌহিত্র ইমাম হোসেনের মস্তক সামান্য অর্থলোভে স্বহস্তে ছেদন করিয়া তোমার কী লাভ হইল? আরো অনেকে তোমার সঙ্গে ছিল, তাহারাও যুদ্ধজয় করিয়াছিল? কিন্তু ইমাম-শির দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিতে, কই কেহই তো অগ্রসর হইল না! ধিক্ তোমাকে! সীমার! শত ধিক্ তোমাকে!-তুমি জগৎ কাঁদাইয়াছ,-পশুপক্ষীর চক্ষে জল ঝরাইয়াছ,-মানবহৃদয়ে বিষময় বিশাল শেলের আঘাত করিয়াছ। আকাশ, পাতাল, বন, উপবন, পর্বত, বায়ু তোমার কুকীর্তি কীর্তন করিতেছে-সে রবে প্রকৃতি বক্ষ পর্যন্ত ফাটিয়া যাইতেছে!-কিন্তু তোমার পরিণাম দশা, তুমি কিছুই ভাব নাই? দেখ দেখি! আজ তোমার কোন্ দিন উপস্থিত? সীমার! তুমি কি ভাবিয়াছিলে যে, এদিন চিরদিন তোমার সুখসেব্য সুদিনই যাইবে? একদিনও কী এ দিনের সন্ধ্যা হইবে না? দেখ দেখি, এখন কেমন কঠিন সময় উপস্থিত! যে পবিত্র মস্তক পবিত্র দেহ হইতে ছিন্ন করিতে খঞ্জর দ্বারা কত কষ্ট দিয়াছ, সে যাতনা সহ্য করিতে না পারিয়া প্রভু কী প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন-মনে হয়? ওরে পাপিষ্ঠ, নরাধম! ইমামের মুমূর্ষু অবস্থার কথা মনে হয়? তোকে নারকী বলিতে পারি না। পরকালের জন্য যে তোমার চিন্তা নাই, তাহা আমরা বিশেষ করিয়া জানি। তোমার পাপভার,-সে পাপভার, হায়! হায়! তুমি যাহার বুকের উপর উঠিয়া খঞ্জর দ্বারা গলা কাটিয়াছিলে, তিনিই লইয়াছেন! কিন্তু সীমার! জগতের দৈহিক যাতনার দায় হইতে উদ্ধার করিতে তোমার মুখপানে চায়, এমন লোক কে? ঈশ্বরের লীলা দেখ, তোমারই অনুগত সৈন্য তোমারই হস্ত পদ বন্ধন করিয়া আমার সম্মুখে আনিয়া দিল। ইহাতেও কী তুমি সেই অদ্বিতীয় ভগবানের প্রতি ভক্তিসহকারে বিশ্বাস করিবে না? এখনো কী তোমার পূর্বভাব অন্তর হইতে অন্তর হয় নাই? এই আসন্নকালে একবার ঈশ্বরের নাম কর। সীমার! আমরা তোমার সমুচিত শাস্তিবিধান করিব বলিয়াই আজ তীর হস্তে দণ্ডায়মান হইয়াছি। তরবারির আঘাত করিলাম না,-বর্শাদ্বারা ভেদ করিলাম না; এই বিষাক্ত তীরে তোমার শরীর জর্জরীভূত করিয়া তোমাকে ইহজগৎ হইতে দূর করিব। ঐ দেখ, তোমার প্রিয়বন্ধু ওত্বে অলীদ ছল্ছল্ নেত্রে তোমার দিকে চাহিয়া আছে মাত্র। কে আজ তোমার সাহায্য করিতে আসিল? তোমার নীরব রোদনে কে কর্ণপাত করিল? তুমি যাহার নিতান্ত অনুগত, তোমার আজিকার দশা তাহার নিকটে প্রকাশ করিতে-আজিকার এ অভিনয়ের অভাবনীয় দৃশ্য রাজগোচর করিতে অনেক চক্ষু তোমার দিকে রহিয়াছে, দেখিতেছি। কিন্তু কেহই তোমার কিছু করিল না। কী আশ্চর্য, তাহাদের অস্ত্রের অভাব হয় নাই, সাহসের অভাব ঘটিয়াছে কি-না জানি না;-কই, তাহারা কি করিল? জগতে কেহ কাহারো নহে। সকলেই স্বার্থের দাস, লোভের কিঙ্কর। তোমার সঞ্চিত অর্থ আজ কোথায় রহিল? সেই পুরস্কারের লক্ষ টাকায় কী উপকার হইল? ঈশ্বরকৃপায় তুমি আজ আমাদের ক্রীড়ার সামগ্রী। ধনুর্বাণ সহিত তোমাকে লইয়া আজ ক্রীড়া করিব। সীমার! তোমার কৃতকার্যের ফল সামান্যরূপে আজ আমাদের হস্তে ভোগ কর! এই আমার কথার শেষ-বাণের প্রথম। দেখ্ বাণের আঘাত কেমন মিষ্ট বোধ হয়! কেমন সুখসেব্য নিদ্রা আইসে!”
ধনুর টঙ্কার সীমারের কর্ণে বজ্রধ্বনির ন্যায় বোধ হইতে লাগিল! প্রাণের মায়া কাহার না আছে? আজ সীমারের চক্ষে জল পড়িল, আজ পাষাণ গলিল! পূর্বকৃত প্রতি মুহূর্তের পাপকার্যের ভীষণ ছবি মনে উদয় হইল। পাপময় জীবনের নিদারুণ পাপছায়া ভীষণ দর্শনে সীমারের চক্ষের উপর ঘুরিতে লাগিল। জলবিন্দুর সহিত শরীরের রক্তবিন্দু ঝরিতে লাগিল। সীমার ঊর্ধ্বদৃষ্টিতে আকাশ পানে চাহিয়া হোসেনের প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়া জীবন শেষের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। শরীরের মাংস সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে দেহ স্খলিত হইয়া মৃত্তিকায় পড়িতেছে-তত্রাচ সীমারের প্রাণ দেহপিঞ্জরেই ঘুরিতেছে। মস্হাব কাক্কা প্রভৃতি দ্বিগুণ জোরে শর-নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন! শরীরের গ্রন্থি সকল ছিন্ন হইয়া পড়িতে আরম্ভ হইল, তবু প্রাণ বাহির হইল না! কী কঠিন প্রাণ! তখন সীমার ঊর্ধ্বদৃষ্টে চাহিয়া বলিতে লাগিল, “হে ঈশ্বর! আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত নাই? আমার শরীরের মাংসখণ্ড প্রায় স্খলিত হইয়া পড়িল, অস্থি-সকল র্জর্জ হইয়া ভগ্ন হইয়া গেল, তবু প্রাণ বাহির হইল না। হে দয়াময়! আমিও তোমার সৃষ্ট জীব, আমার প্রতি কটাক্ষপাত কর, আমার প্রাণবায়ু শীঘ্রই হোসেনের পদপ্রান্তে নীত কর।”
মোহাম্মদ হানিফা এবং মস্হাব কাক্কা এই কাতরপূর্ণ প্রার্থনা শুনিয়া শরাসন-জ্যা শিথিল করিলেন, আর তূণীরে হস্তক্ষেপ করিলেন না। সকলেই দয়াময়ের নাম করিয়া শত সহস্র প্রকারে তাঁহার গুণানুবাদ করিলেন। ক্রমে সীমারের প্রাণবায়ু ইহজগৎ হইতে অনন্ত আকাশে মিশিয়া হোসেনের পদপ্রান্তে আশ্রয় গ্রহণ করিল।
বীরকেশরিগণ আর সীমারের প্রতি ভ্রূক্ষেপও করিলেন না, শিবিরে আসিয়া মদিনা যাইতে প্রস্তুত হইলেন। ওত্বে অলীদ বিষন্ন বদনে দামেস্কাভিমুখে যাত্রা করিল। যে আশা তাহার অন্তরে জাগিতেছিল, সে আশা আশা-মরীচিকাবৎ ঐ প্রান্তরের বালুকাকণা মধ্যে মিশিয়া গেল। মনে মনেই বুঝিল, সীমারের সৈন্যগণ মস্হাব কাক্কার অধীনতা স্বীকার করিয়াছে! আর আশা কী?-এ প্রান্তরে আর আশা কী?