বিশ্রামদায়িনী নিশার দ্বিযাম অতীত! অনেকেই নিদ্রার ক্রোড়ে অচেতন। এ সময় কিন্তু আশা, নিরাশা, প্রেম, হিংসা, শোক, বিয়োগ, দুঃখ, বিরহ, বিচ্ছেদ, বিকার এবং অভিমানসংযুক্ত হৃদয়ের বড়ই কঠিন সময়। সে হৃদয়ে শান্তি নাই-সে চক্ষে নিদ্রা নাই। ঐ এজিদের মন্ত্রণাগৃহে দীপ জ্বলিতেছে, প্রাঙ্গণে, দ্বারে, শাণিত কৃপাণহস্তে প্রহরী দণ্ডায়মান রহিয়াছে। গৃহাভ্যন্তরে, মন্ত্রণাদাতা মারওয়ানসহ এজিদ জাগরিত, সন্ধানী গুপ্তচর সম্মুখে উপস্থিত।
মারওয়ান আগন্তুক গুপ্তচরকে জিজ্ঞাসা করিল, “কোন্ দিকে যাইতে দেখিলে? আর সন্ধানেই-বা কি কি জানিতে পারিলে?”
“আমি বিশেষ সন্ধানে জানিয়াছি, তাহারা হানিফার সাহায্যে মদিনায় যাইতেছে।”
“মোহাম্মদ হানিফা যে মদিনায় গিয়াছে-এ কথা তোমাকে কে বলিল?”
“তাঁহাদের মুখেই শুনিলাম! মোহাম্মদ হানিফা প্রথমতঃ কারবালাভিমুখে যাত্রা করেন; পরে কি কারণে কারবালায় না যাইয়া মদিনায় গিয়াছেন, সে কথা অপ্রকাশ।”
“তবে কী যুদ্ধ বাঁধিয়াছে?”
“যুদ্ধ না বাঁধিলে সাহায্য কিসের?”
“আচ্ছা, কত পরিমাণ সৈন্য?”
“অনুমানে নিশ্চয় করিতে পারি নাই; তবে তুরস্ক ও তোগান প্রদেশেরই বিস্তর সৈন্য। এই দুই রাজ্যের ভূপতিদ্বয়ও আছেন।”
এজিদ্ বলিল, “কী আশ্চর্য! ওত্বে অলীদ কী করিতেছেন? ভিন্ন দেশ হইতে হানিফার সাহায্যার্থ সৈন্য যাইতেছে, সৈন্য-সামন্তের আহারীয় পর্যন্ত সঙ্গে যাইতেছে, ইহার কী কোন সংবাদ অলীদ প্রাপ্ত হয় নাই? মোহাম্মদ হানিফা স্বয়ং মহাবীর, তাহার উপরেও এত সাহায্য, শেষ যাহাই হউক, ঐ সকল সৈন্যগণ যাহাতে মদিনায় যাইতে না পারে, তাহার উপায় করিতে হইবে। ঐ সকল সৈন্য ও আহারীয় সামগ্রী যদি মদিনায় না যায়, তাহা হইলেও অনেক লাভ। এমন কোন বীরপুরুষই কী দামেস্ক রাজধানীতে নাই যে, উপযুক্ত সৈন্য লইয়া এই রাত্রেই উহাদিগকে আক্রমণ করে, আরো না হয় গমনে বাধা দেয়?”
সীমার করজোড়ে বলিলেন, “বাদশাহ নামদার! চির-আজ্ঞাবহ দাস উপস্থিত, কেবল আজ্ঞার অপেক্ষা। যে হস্তে হোসেন-শির কারবালা-প্রান্তর হইতে দামেস্কে আনিয়াছি, সেই হস্তে তোগানের ভূপতি ও তুরস্কের সম্রাট্কে পরাস্ত করা কতক্ষণের কার্য?”
এজিদের চিন্তিত হৃদয়ে আশার সঞ্চায় হইল। মলিনমুখে ঈষৎ হাসির আভা প্রকাশ পাইল। তখনই সৈন্য-শ্রেণীর অধিনায়ককে সীমারের আজ্ঞাধীন করিয়া দিলেন।
সীমার হানিফার সাহায্যকারীদিগের বিরুদ্ধে উপযুক্ত সৈন্য লইয়া গুপ্তচরসহ ঐ নিশীথ সময়ে যাত্রা করিলেন।
এজিদ্ বলিলেন, “মারওয়ান! মোহাম্মদ হানিফা একাদিক্রমে শত বর্ষ যুদ্ধ করিলেও আমার সৈন্যবল, অর্থবল ক্ষয় করিতে পারিবে না। যে পরিমাণ সৈন্য নগর হইতে বাহির হইবে, তাহার দ্বিগুণ সৈন্য সংগ্রহ করিতে পূর্বেই আদেশ করিয়াছি! ওদিকে যুদ্ধ হউক, এদিকে আমরা জয়নাল আবেদীনকে শেষ করিয়া ফেলি। জয়নাল আবেদীনের মৃত্যু ঘোষণা হইলে হানিফা কখনোই দামেস্কে আসিবে না। কারণ জয়নাল উদ্ধারই হানিফার কর্তব্য কার্য, সেই জয়নালই যদি জীবিত না থাকিল তবে হানিফার যুদ্ধ বৃথা। দ্বিতীয় কথা, হানিফার বন্দি অথবা মৃত্যু আমাদের পক্ষে উভয়ই মঙ্গল। কিন্তু যদি জয়নাল জীবিত থাকে, আর হানিফাও জয়লাভ করে, তাহা হইলে মহা সঙ্কট ও বিপদ! এ অবস্থায় আর জয়নালকে রাখা উচিত নহে। আজ রাত্রেই হউক, কি কাল প্রত্যূষেই হউক, জয়নালের শিরচ্ছেদ করিতেই হইবে।”
“আমি ইহাতে অসম্মত নহি, কিন্তু ওত্বে অলীদের কোন সংবাদ না পাইয়া জয়নালবধে অগ্রসর হওয়া ভাল কি মন্দ, তাহা আজ আমি স্থির বলিতে পারিলাম না। জয়নাল মদিনার সিংহাসনে বসিয়া দামেস্ক সিংহাসনের অধীনতা স্বীকারপূর্বক কিছু কিছু কর যোগাইলে দামেস্ক রাজ্যের যত গৌরব, হোসেন-বংশ একেবারে শেষ করিয়া একচ্ছত্র রূপে মক্কা-মদিনায় রাজত্ব করিলে কখনো তত গৌরব হইবে না।”
“সে কথা যথার্থ, কিন্তু তাহাতে সন্দেহ অনেক। কারণ জয়নাল প্রাণরক্ষার জন্য আপাতত আমার অধীনতা স্বীকার করিলেও করিতে পারে, কিন্তু সে যে বংশের সন্তান, তাহাতে কালে তাহার পিতা, পিতৃব্য এবং ভ্রাতাগণের দাদ উদ্ধার করিতে বদ্ধপরিকর হইয়া আমার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করিবে না, ইহা আমি কখনোই বিশ্বাস করিতে পারি না।”
“যাহা হউক মহারাজ! জয়নাল-বধ বিশেষ বিবেচনাসাপেক্ষ; আগামীকল্য প্রাতে যাহা হয়, করিব।”