তোমার এ দুর্দশা কেন? কোন কুক্রিয়ার ফলে তোমার এ দশা ঘটিয়াছে? যখন পাপ করিয়াছিলে, তখন কি তোমার মনে কোন কথা উদয় হয় নাই? এখন লোকালয়ে মুখ দেখাইতে এত লজ্জা কেন? খোল, খোল, মুখের আবরণ খোল; দেখি কি হইয়াছে। চিরপাপী পাপপথে দণ্ডায়মান হইলে হিতাহিত জ্ঞান অণুমাত্রও তাহার অন্তরে উদয় হয় না। যেন-তেন প্রকারেণ পাপকূপে ডুবিতে পারিলেই এক প্রকারে রক্ষা পায়,-কিন্তু পরক্ষণে অবশ্যই আত্মগ্লানি উপস্থিত হয়।
পাঠক! লেখনীর গতি বড় চমৎকার। ষষ্ঠ প্রবাহে কোথায় লইয়া গিয়াছি, আবার সপ্তম প্রবাহে কোথায় আনিয়াছি। সম্মুখে পবিত্র রওজা, পুণ্যভূমি মদিনার সেই রওজা। পবিত্র রওজার মধ্যে অন্য লোকের গমন নিষেধ, এ-কথা আপনারা পূর্ব হইতেই অবগত আছেন। আর যাহার জন্য উপরে কয়েকটি কথা বলা হইল সে আগন্তুক কী করিতেছে, দেখিতেছেন? সে পাপী পাপমোচন জন্য এখন কি কি করিতেছে, দেখিতেছেন? রওজার বহির্ভাগস্থ মৃত্তিকার ধূলি অনবরত মুখে-মস্তকে মর্দন করিতেছে, আর বলিতেছে, “প্রভু রক্ষা কর। হে হাবিবে খোদা, আমায় রক্ষা কর। হে নূরনবী হজরত মোহাম্মদ, আমায় রক্ষা কর। তুমি ঈশ্বরের প্রিয় বন্ধু। তোমার নামের গুণে নরকাগ্নি নরদেহ নিকটে আসিতে পারে না। তোমার রওজার পবিত্র ধূলিতে শত শত জরাগ্রস্ত মহাব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি নীরোগ হইয়া সুকান্তি লাভ করিতেছে, তাহাদের সাংঘাতিক বিষের বিষাক্ত গুণ হ্রাস হইতেছে। সেই বিশ্বাসে এই নরাধম পাপী বহু কষ্টে পবিত্র ভূমি মদিনায় আসিয়াছে। যদিও আমি প্রভু হোসেনের সহিত অমানুষিক ব্যবহার করিয়াছি-দয়াময়! হে দয়াময় জগদীশ! তোমার করুণা-বারি পাত্রভেদে নিপতিত হয় না। দয়াময়! তোমার নিকট সকলই সমান। জগদীশ! এই পবিত্র রওজার ধূলির মাহাত্ম্যে আমায় রক্ষা কর।”
ক্রমে এক-দুই করিয়া জনতা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। আগন্তুকের আত্মগ্লানি ও মুক্তিকামনার প্রার্থনা শুনিয়া সকলেই সমুৎসুক হইয়া, কোথায় নিবাস, কোথা হইতে আগমন, এই সকল প্রশ্ন করিতে লাগিল। আগন্তুক বলিল, “আমার দুর্দশার কথা বলি। ভাই রে! আমি ইমাম হোসেনের দাস। প্রভু যখন সপরিবারে কুফায় গমনের জন্য মদিনা হইতে যাত্রা করেন, আমি তাঁহার সঙ্গে ছিলাম। দৈব নির্বান্ধে কুফার পথ ভুলিয়া আমরা কারবালায় যাই।”
সকলে মহাব্যস্তে-“তারপর? তারপর?”
“তারপর কারবালায় যাইয়া দেখি যে, এজিদ্ সৈন্য পূর্বেই আসিয়া ফোরাতনদীকূল ঘিরিয়া রাখিয়াছে। একবিন্দু জললাভের আর আশা নাই। আমার দেহমধ্যে কে যেন আগুন জ্বালিয়া দিয়াছে। সমুদয় বৃক্তান্ত, আমি একটু সুস্থ না হইলে বলিতে পারিব না। আমি জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরিলাম।”
মদিনাবাসীরা আরো ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তারপর কী হইল, বল; জল না পাইয়া কী হইল?”
“আর কী বলিব-রক্তারক্তি, মার মার, কাট কাট,-আরম্ভ হইল, প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেবল তরবারি চলিল; কারবালার মাঠে রক্তের স্রোত বহিতে লাগিল, মদিনার কেহ বাঁচিল না!”
“ইমাম হোসেন, ইমাম হোসেন?”
“ইমাম হোসেন সীমার হস্তে শহীদ্ হইলেন।”
সমস্বরে আর্তনাদ ও সজোরে বক্ষে করাঘাত হইতে লাগিল। মুখে “হায় হোসেন! হায় হোসেন!!”
কেহ কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, “আমরা তখনই বারণ করিয়াছিলাম যে, হজরত মদিনা পরিত্যাগ করিবেন না। নূরনবী হজরত মোহাম্মদের পবিত্র রওজা পরিত্যাগ করিয়া কোন স্থানে যাইবেন না।”
কেহ কেহ আর কোন কথা না শুনিয়া ইমাম শোকে কাঁদিতে কাঁদিতে পথ বাহিয়া যাইতে আরম্ভ করিলেন। কেহ কেহ ঐ স্থানে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। কেহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তারপর, যুদ্ধ অবসানের পর কী হইল?”
“যুদ্ধ অবসানের পর কে কোথায় গেল, কে খুঁজিয়া দেখে। স্ত্রীলোকমধ্যে যাহারা বাঁচিয়া ছিল, ধরিয়া ধরিয়া উটে চড়াইয়া দামেস্কে লইয়া গেল। জয়নাল আবেদীন যুদ্ধে যায় নাই, মারাও পড়ে নাই। আমি জঙ্গলে পলাইয়া ছিলাম। যুদ্ধ শেষে ইমামের সন্ধান করিতে রণক্ষেত্রে শেষে ফোরাত নদীতীরে গিয়া দেখি যে, এক বৃক্ষ-মূল হোসেনের দেহ পড়িয়া আছে, কিন্তু মস্তক নাই, রক্তমাখা খঞ্জরখানিও ইমামের দেহের নিকট পড়িয়া আছে। আমি পূর্ব হইতে জানিতাম যে, ইমামের পায়জামার বন্ধমধ্যে বহুমূল্য একটি মুক্তা থাকিত। সেই মুক্তা লোভে দেহের নিকটে গিয়া যেমন খুলিতেছি, অমনই ইমামের বাম হস্ত আসিয়া সজোরে আমার দক্ষিণ হস্ত চাপিয়া ধরিল। আমি মহা ভীত হইলাম, সে হাত কিছুতেই ছাড়ে না। মুক্তাহরণ করা দূরে থাকুক, আমার প্রাণ লইয়া টানাটানি। সাত-পাঁচ ভাবিয়া নিকটস্থ খঞ্জর বাম হস্তে উঠাইয়া সেই পবিত্র হস্তে আঘাত করিতেই, হাত ছাড়িয়া গেল। কিন্তু কর্ণে শুনিলাম-“তুই অনুগত দাস হইয়া আপন প্রভুর সহিত এই ব্যবহার করিলি? সামান্য মুক্তালোভে ইমামের হস্তে আঘাত করিলি? তোর শাস্তি-তোর মুখ কৃষ্ণবর্ণ কুকুরের মুখে পরিণত হউক, জগতেই নরকাগ্নির তাপে তোর অন্তর, মর্ম, দেহ সর্বদা জ্বলিতে থাকুক।”
“এই আমার দুর্দশা, এই আমার মুখের আকৃতি দেখুন। আমি আর বাঁচিব না, সমুদয় অঙ্গে যেন আগুন জ্বলিতেছে। আমি পূর্ব হইতেই জানি যে, হজরতের রওজার ধূলি গায়ে মাখিলে মহারোগও আরোগ্য হয়, জ্বালা-যন্ত্রণা সকলই কমিয়া জল হইয়া যায়। সেই ভরসাতেই মহা কষ্টে কারবালা হইতে এই পবিত্র রওজায় আসিয়াছি।”
মদিনাবাসিগণ এ পর্যন্ত শুনিয়াই আর কেহ তাহার দিকে ফিরিয়া চাহিলেন না। সকলেই ইমাম-শোকে কাতর হইলেন। নগরের প্রধান প্রধান এবং রাজসিংহাসন-সংস্রবী মহোদয়গণ, সেই সময়ে নগরমধ্যে ঘোষণা করিয়া কি কর্তব্য স্থির করিবার জন্য, রওজার নিকটস্থ উপাসনা -মন্দির সম্মুখে মহাসভা আহ্বান করিয়া একত্রিত হইলেন।
কেহ বলিলেন, “এজিদকে বাঁধিয়া আনি।”
কেহ বলিলেন, “দামেস্ক নগর ছারখার করিয়া দেই।”
বহু তর্ক-বিতর্কের পর শেষে সুস্থির হইল যে, “নায়ক বিহনে স্ব-স্ব প্রাধান্যে ইহার কোন প্রতিকারই হইবে না। আমরা মদিনার সিংহাসনে একজন উপযুক্ত লোককে বসাইয়া তাহার অধীনতা স্বীকার করি। প্রবল তরঙ্গমধ্যে শিক্ষিত কর্ণধার বিহনে যেমন তরী রক্ষা কঠিন, রাজবিপ্লব বিপদে একজন ক্ষমতাশালী অধিনায়ক না হইলে, রাজ্য রক্ষা করাও সেইরূপ মহা কঠিন। স্ব-স্ব প্রাধান্যে কোন কার্যেরই প্রতুল নাই।”
সমাগত দলমধ্য হইতে একজন বলিয়া উঠিলেন, “কাহার অধীনতা স্বীকার করিব? পথের লোক ধরিয়া কী মদিনার সিংহাসনে বসাইতে ইচ্ছা করেন? মদিনাবাসীরা কোন্ অপরিচিত নীচ বংশীয়ের নিকট নতশিরে দণ্ডায়মান হইবে। প্রভু মোহাম্মদের বংশে তো এমন কেহ নাই যে, তাঁহাকে সিংহাসনে বসাইয়া জন্মভূমির গৌরব রক্ষা করিব।”
প্রথম বক্তা বলিলেন, “কোন চিন্তা নাই, মোহাম্মদ হানিফা এখনো বর্তমান আছেন। হোসেনের পর তিনি আমাদের পূজ্য, তিনিই রাজা। ইহার পর হোসেনের আরো বৈমাত্রেয় ভ্রাতা অনেক আছেন। কারবালার এই লোমহর্ষক ঘটনা শুনিয়া, তাঁহারা কি স্ব-স্ব সিংহাসনে বসিয়াই থাকিবেন? ইহার পর নূরনবী মোহাম্মদের ভক্ত অনেক রাজা আছেন; এই সকল ঘটনা তাঁহাদের কর্ণগোচর হইলে তাঁহারাই কি নিশ্চিন্তভাবে থাকিবেন? এজিদ্ ভাবিয়াছে কী? মনে করিয়াছে যে, হোসেনবংশ নির্বংশ করিয়াছি-নিশ্চিন্তে থাকিবে; তাহা কখনোই ঘটিবে না, চতুর্দিক হইতে সমরানল জ্বলিয়া উঠিবে। আমরা এখনই উপযুক্ত একজন কাসেদ হনুফানগরে প্রেরণ করি। আপাততঃ মোহাম্মদ হানিফাকে সিংহাসনে বসাইয়া যদি জয়নাল আবেদীন প্রাণে বাঁচিয়া থাকেন, তবে তাঁহার উদ্ধারের উপায় করি। সঙ্গে সঙ্গে এজিদের দর্প চূর্ণ করিতেও সকলে আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।”
সকলে এই প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, তখন হনুফানগরে কাসেদ প্রেরিত হইল।
প্রথম বক্তা পুনরায় বলিলেন, “মোহাম্মদ হানিফা মদিনায় না-আসা পর্যন্ত আমরা কিছুই করিব না। শোকবস্ত্র যা যে অঙ্গে ধারণ করিয়াছি রহিল। জয়নাল আবেদীনের উদ্ধার, এজিদের সমুচিত শাস্তি বিধান না করিয়া আর এ শোক-সিন্ধুর প্রবল তরঙ্গের প্রতি কখনোই দৃষ্টি করিব না। আঘাত লাগুক, প্রতিঘাতে অন্তর ফাটিয়া যাউক, মুখে কিছুই বলিব না। কিন্তু সকলেই ঘরে ঘরে যুদ্ধ-সাজের আয়োজনে প্রস্তুত হও।”
এই প্রস্তাবে সকলে সম্মত হইয়া সভাভঙ্গ করিলেন। হোসেন-শোকে সকলেই অন্তরে কাতর; কিন্তু নিতান্ত উৎসাহে যুদ্ধ সজ্জার আয়োজনে ব্যাপৃত হইলেন। নগরবাসিগণের অঙ্গে, দ্বিতল ত্রিতল গৃহ-দ্বারে এবং গবাক্ষে শোকচিহ্ন। নগরের প্রান্তসীমায় শোকসূচক ঘোর নীলবর্ণ নিশান উড্ডীন হইয়া জগৎ কাঁদাইতে লাগিল।
এদিকে দামেস্কনগরে আবার রণভেরী বাজিয়া উঠিল। এজিদের লক্ষাধিক সৈন্য সমর সাজে সজ্জিত হইয়া মদিনাভিমুখে যাত্রা করিল। হানিফার মদিনা আগমনের পূর্বেই সৈন্যগণ মদিনা-প্রবেশপথে অবস্থিতি করিয়া, হানিফার গমনে বাধা দিবে, ইহাই মারওয়ানের মন্ত্রণা। মোহাম্মদ হানিফা প্রথমে কারবালায় গমন করিবেন, তৎপরে মদিনায় না যাইয়া মদিনাবাসীদের অভিমত না লইয়া হজরতের রওজা পরিদর্শন না করিয়া, কখনোই দামেস্ক আক্রমণ করিবেন না-ইহাই মারওয়ানের অনুমান। সুতরাং মদিনা-প্রবেশপথে সৈন্য সমবেত করিয়া রাখাই আবশ্যক এবং সেই প্রবেশপথে হানিফার দর্প চূর্ণ করিয়া, জীবন শেষ করাই যুক্তি। সেই সিদ্ধান্তই নির্ভুল মনে করিয়া এজিদ্ মারওয়ানের অভিমতে মত দিল;-তাই আবার রণভেরী বাজিয়া উঠিল। ওত্বে অলীদ দামেস্ক হইতে আবার মদিনাভিমুখে সৈন্যসহ চলিল। হানিফার প্রাণ বিনাশ, কি বন্দি করিয়া দামেস্কে প্রেরণ না-করা পর্যন্ত মদিনা আক্রমণ করিবে না। কারণ মোহাম্মদ হানিফাকে পরাস্ত না করিয়া মদিনার সিংহাসন লাভ করিলে কোন লাভ নাই। বরং নানা বিঘ্ন, নানা আশঙ্কা; এই যুক্তির উপর নির্ভর করিয়াই ওত্বে অলীদ মদিনাভিমুখে যাইতে লাগিল। ওত্বে অলীদ নির্বিঘ্নে যাইতে থাকুক, আমরা একবার হানিফার গম্য-পথ দেখিয়া আসি।