যে নগরে সুখসাগরে তরঙ্গের উপর তরঙ্গ খেলা করিতেছিল, মহানন্দের স্রোত বহিতেছিল; রাজপ্রাসাদ, রাজপথ, প্রধান প্রধান সৌধ আলোকমালায় পরিশোভিত হইয়াছিল; ঘরে ঘরে নৃত্য, গীত, বাজনার ধুম পড়িয়াছিল, রঙ্গিন পতাকা সকল হেলিয়া-দুলিয়া জয়সূচক চিহ্ন দেখাইতেছিল;-হঠাৎ সমুদয় বন্ধ হইয়া গেল! মুহূর্তমধ্যে মহানন্দবায়ু থামিয়া বিষাদ-ঝটিকা-বেগ রহিয়া রহিয়া বহিতে লাগিল। মাঙ্গলিক পতাকারাজি নতশিরে হেলিতে-দুলিতে পড়িয়া গেল। রাজপ্রাসাদের বাদ্যধ্বনি, নূপুরের ঝন্ঝনি, সুমধুর কণ্ঠস্বর, আর কাহারো কর্ণে প্রবেশ করিল না। সুহাস্য আস্য সকল বিষাদ-কালিমা রেখায় মলিন হইয়া গেল। কেহ কাহারো সঙ্গে কথা কহিতেছে না, জিজ্ঞাসা করিলেও উত্তর পাইতেছে না। রাজভবনের অবস্থার হঠাৎ পরিবর্তন দেখিয়া কতজনে কত কথার আলোচনায় বসিয়া গেল। শেষে সাব্যস্ত হইল, গুরুতর মনঃপীড়া হঠাৎ পরিবর্তন, নিশ্চয়ই হঠাৎ শ্রবণ। দুঃখের কথা বটে! কারবালার সংবাদ-বিবি সালেমার প্রেরিত কাসেদের আগমন।
এ প্রদেশের নাম আম্বাজ। রাজধানী হনুফানগরে! এই সমৃদ্ধিশালী মহানগরীর দণ্ডধর মোহাম্মদ হানিফা। সম্রাট্ স্বীয় কন্যার বিবাহ উপলক্ষে আমোদ-আহ্লাদে মাতিয়াছিলেন, শুভ সময়ে শুভ কার্য সুসম্পন্ন করিবেন আশা ছিল, এমন সময়ে কাসেদ আসিয়া হরিষে সম্পূর্ণ বিষাদ ঘটাইয়া মোহাম্মদ হানিফাকে নিতান্তই দুঃখিত করিয়াছে!
হাসানের সাংঘাতিক মৃত্যু, জেয়াদের সখ্যতা, মারওয়ানের আচরণ, কুফার পথ ভুলিয়া হোসেনের কারবালায় গমন ও ফোরাত নদীর তীরে শত্রুপক্ষ হইতে বেষ্টন, এই সকল কথা শুনিয়া ক্রোধে, বিষাদে নরপাল মহা অস্থির। কাসেদ সম্মুখে অবনতশিরে দণ্ডায়মান।
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “হা! জীবিত থাকিতেই ভ্রাতা হাসানের মৃত্যুসংবাদ শুনিতে হইল। ভ্রাতা হোসেনও কারবালা প্রান্তরে সপরিবারে কষ্টে পড়িয়া আছেন! হায়! এতদিন না জানি কী ঘটনাই ঘটিয়া থাকিবে! জগদীশ! আমার এই প্রার্থনা, দাসের এই প্রার্থনা, কারবালা প্রান্তরে যাইয়া যেন ভ্রাতার পবিত্র চরণ দেখিতে পাই, পিতৃহীন কাসেমের মুখখানি যেন দেখিতে পাই। দয়াময়! আমার পরিজনকে রক্ষা করিয়ো, দুরন্ত কারবালাপ্রান্তরে তুমি ভিন্ন তাহাদের সহায় আর কেহ নাই। দয়াময়! দয়াময়!! আমার মনে শান্তি দান কর। আমি স্থির মনে অটলভাবে যেন কারবালায় গমন করিতে পারি। পূজ্যপাদ ভ্রাতার সাহায্য করিয়া কৃতার্থ হইতে পারি। দয়াময়! আমার শেষ ভিক্ষা এই যে, তোমার এ চিরকিঙ্করের চক্ষু কারবালার প্রান্তসীমা না দেখা পর্যন্ত হোসেন-শিবির শত্রুর আক্রমণ হইতে রক্ষা করিয়ো।”
এই প্রকার উপাসনা করিয়া মোহাম্মদ হানিফা সৈন্যগণকে প্রস্তুত হইতে আদেশ করিলেন। আরো বলিলেন, “আমার সঙ্গে কারবালায় যাইতে হইবে। আমি এ নগরে আর ক্ষণকালের জন্যও থাকিব না। রাজকার্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তে ন্যস্ত থাকিল।”
মোহাম্মদ হানিফা ঈশ্বরের নাম করিয়া বীর-সাজে সজ্জিত হইলেন। যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ গাজী রহমানকে প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ পদে বরণ করিয়া কারবালাভিমুখে যাত্রা করিলেন। কাসেদ সঙ্গে সঙ্গে চলিল।