কথা চাপিয়া রাখা বড়ই কঠিন। কবিকল্পনার সীমা পর্যন্ত যাইতে হঠাৎ কোন কারণে বাধা পড়িলে মনে ভয়ানক ক্ষোভের কারণ হয়। সমাজের এমনই কঠিন বন্ধন, এমনই দৃঢ় শাসন যে কল্পনাকুসুমে আজ মনোমত হার গাঁথিয়া পাঠক-পাঠিকাগণের পবিত্র গলায় দোলাইতে পারিলাম না। শাস্ত্রের খাতিরে নানা দিক লক্ষ্য রাখিতে হইতেছে! হে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ভগবান্! সমাজের মূর্খতা দূর কর। কুসংস্কার তিমির সদ্জ্ঞান-জ্যোতিঃ প্রতিভায় বিনাশ কর। আর সহ্য হয় না। যে পথে যাই, সেই পথেই বাধা। সে পথের সীমা পর্যন্ত যাইতে মনের গতি রোধ তাহাতে জাতীয় কবিগণেরও বিভীষিকাময় বর্ণনায় বাধা জন্মায়, চক্ষে ধাঁধা লাগাইয়া দেয়; কিন্তু তাঁহারাও যে কবি, তাঁহাদের যে কল্পনাশক্তির বিশেষ শক্তি ছিল, তাহা সমাজ মনে করেন না। এই সামান্য আভাসেই যথেষ্ট, আর বেশি দূর যাইব না। বিষাদ-সিন্ধুর প্রথম ভাগেই স্বজাতীয় মূর্খদল হাড়ে চটিয়া রহিয়াছেন। অপরাধ আর কিছুই নহে, পয়গম্বর এবং ইমামদিগের নামের পূর্বে, বাঙলা ভাষায় ব্যবহার্য শব্দে সম্বোধন করা হইযাছে; মহাপাপের কার্যই করিয়াছি! আজ আমার অদৃষ্টে কী আছে, ঈশ্বরই জানেন। কারণ মর্ত্যলোকে থাকিয়া স্বর্গের সংবাদ প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণকে দিতে হইতেছে।
স্বর্গীয় প্রধান দূত জিবরাইল অতি ব্যস্ততাসহকারে ঘোষণা করিতেছেন,-‘দ্বার খুলিয়া দাও। প্রহরিগণ! আজ স্বর্গের দ্বার, সপ্ততল আকাশের দ্বার খুলিয়া দাও। পুণ্যাত্মা, তপস্বী, সিদ্ধপুরুষ, ঈশ্বরভক্ত, ঈশ্বরপ্রণয়ী প্রাণিগণের অমরাত্মার বন্দিগৃহের দ্বার খুলিয়া দাও। স্বর্গীয় দূতগণ! অমরপুরবাসী নরনারীগণ! প্রস্তুত হও। হোসেনের এবং অন্য অন্য মহারথিগণের দৈনিক সৎক্রিয়া সম্পাদন জন্য মর্ত্যলোকে যাইবার আদেশ হইয়াছে। দ্বার খুলিয়া দাও, প্রস্তুত হও।”
মহাহুলস্থূল পড়িয়া গেল। “অল্পক্ষণের জন্য আবার মর্ত্যলোকে?” অমরাত্মা এই বলিয়া স্ব স্ব রূপ ধারণ করিলেন। এদিকে হজরত জিবরাইল আপন দলবল সহ সকলের পূর্বেই কার্বালা প্রান্তরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ক্রমে সকলের আবির্ভাব হইতে আরম্ভ হইল। দেখিতে দেখিতে জনমানবশূন্য প্রান্তরে, পুণ্যাত্মাদিগের আগমনে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। বালুকাময় প্রান্তরে সুস্নিগ্ধ বায়ু বহিয়া স্বর্গীয় সৌরভে চতুর্দিক মোহিত ও আমোদিত করিয়া তুলিল।
স্বর্গীয় দূতগণ স্বর্গসংস্রবী দেবগণ, সকলেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হজরত আদম,-যিনি আমি পুরুষ যাঁহাকে অবজ্ঞা করিয়া প্রধান ফেরেশতা আজাজীল শয়তানে পরিণত হইয়াছিল, সেই স্বর্গীয় দূতগণ পূজিত হজরত আদম,-হোসেন-শোকে কাতর-ও স্নেহপরবশে প্রথমেই তাঁহার সমাগম হইল। পরে মহাপুরুষ মুসা-স্বয়ং ঈশ্বর তূর পর্বতে যাঁহার সহিত কথা কহিয়াছিলেন, মুসা সেই সচ্চিদানন্দের তেজোময় কান্তি দেখিবার জন্য নিতান্ত উৎসুক হইলে, কিঞ্চিৎ আভা মাত্র যাহা মুসার নয়নগোচর হইয়াছিল, তাহাতেই মুসা স্বীয় শিষ্যসহ সে তেজ ধারণে অক্ষম হইয়া অমনই অজ্ঞান অবস্থায় ধরাশায়ী হইয়াছিলেন, শিষ্যগণ পঞ্চত্ব পাইয়াছিল, আবার করুণাময় জগদীশ্বর, মুসার প্রার্থনায় শিষ্যগণকে পুনর্জীবিত করিয়া মুসার অন্তরে অটল ভক্তির নব-ভাব আবির্ভাব করিয়াছিলেন-সে মহামতি সত্য তার্কিক মুসাও আজি হোসেন-শোকে কাতর,-কারবালায় সমাসীন। প্রভু সোলেমান-যাঁর হিতোপদেশ আজ পর্যন্ত সর্বধর্মাবলম্বীর নিকট সমভাবে আদৃত,-সেই নরকিন্নরী দানবদলী ভূপতি মহামতিও আজ কারবালা প্রান্তরে উপস্থিত। যে দাউদের গীতে জগৎ মোহিত, পশু পক্ষী উন্মত্ত, স্রোতস্বতীর স্রোত স্থির-ভাবাপন্ন, সে দাউদও আজ কারবালায়।
ঈশ্বর-প্রণয়ী ইব্রাহিম,-যাঁহাকে ঈশ্বরদ্রোহী রাজা নমরূদ প্রচণ্ড অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করিয়া সত্য প্রেমিকের প্রাণসংহার করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, যে অগ্নিশিখা গগনম্পর্শী হইয়া জগজ্জনের চক্ষে ধাঁধা দিয়াছিল,-দয়াময়ের কৃপায় সে প্রজ্বলিত গগনস্পর্শী অগ্নি ইব্রাহিম চক্ষে বিকশিত কমলদলে সজ্জিত উপবন, অগ্নিশিখা সুগন্ধযুক্ত স্নিগ্ধকর গোলাপমালা বলিয়া বোধ হইয়াছিল,-সে সত্যবিশ্বাসী মহাঋষি আজ কারবালা ক্ষেত্রে সমাগত। ইসমাইল-যিনি নিজ প্রাণ ঈশ্বরোদ্দেশ্যে উৎসর্গ করিয়া ‘দোম্বার’ পরিবর্তে নিজে বলি হইয়াছেন-সে ঈশ্বরভক্ত ইসমাইলও আজ কারবালা প্রান্তরে। ঈশা-যিনি প্রকৃত সন্ন্যাসী জগৎপরিত্রাতা মহাঋষি তাপস, ঈশ্বরের মহিমা দেখাইতে যে মহাত্মা চিরকুমারী মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন,-তিনিও আজ মর্ত্যধাম কারবালার মহাক্ষেত্রে। ইউনুস-যিনি মৎস্যগর্ভে থাকিয়া ভগবানের অপরিসীম ক্ষমতা দেখাইয়াছিলেন-তিনিও কারবালায়। মহামতি হজরত ইউসুফ বৈমায়েত্র ভ্রাতাকর্তৃক অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হইয়া ঈশ্বরের কৃপায় জীবিত ছিলেন এবং দাস পরিচয়ে বিক্রীত হইয়া মিসর রাজ্যে রাজসিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন, সে মহা সুশ্রীর অগ্রগণ্য পূর্ণজ্যোতির আকর হজরত ইউসুফও আজ কারবালার মহাপ্রান্তরে। হজরত জার্জিসকে বিধর্মিগণ শতবার শতপ্রকারে বধ করিয়াছে, তিনিও পুনঃ পুনঃ জীবন প্রাপ্ত হইয়া দয়াময়ের মহিমার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখাইয়াছেন। সে ভুক্তভোগী হজরত জার্জিসও আজ কারবালাক্ষেত্রে।-এই প্রকার হজরত ইয়াকুব, আসহাব, ইসহাক, ইদ্রীস, আয়ুব, ইলিয়াস, হরকেল, শামাউন, লূত, এহিয়া, জাকারিয়া প্রভৃতি মহা মহা মহাত্মাগণের আত্মা অদৃশ্য শরীরে কারবালায় হোসেনের দৈহিক শেষ ক্রিয়ার জন্য উপস্থিত হইলেন।
সকলেই যেন কাহার আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন। ক্ষণকাল পরে সকলেই একেবারে দণ্ডায়মান হইয়া ঊর্ধ্বনেত্রে বিমান দিকে বারবার লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। আর সকলেই আরব্য ভাষায় “ইয়া নবী সালাম আলায়কা, ইয়া হাবিব সালাম আলায়কা, ইয়া রসুল সালাম আলায়কা, সালওয়াতোল্লাহ আলায়কা” সমস্বরে গাহিয়া উঠিলেন। সহস্র সহস্র লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মুখে মহাঋষি প্রভু হজরত মোহাম্মদের গুণানুবাদ হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে মৃদুমন্দভাবে শূন্য হইতে “হায় হোসেন! হায় হোসেন!” রব করিতে করিতে হজরত মোহাম্মদ উপস্থিত হইলেন! তাঁহার পবিত্র পদ ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ করিল। এতদিন প্রকৃতি শরীরী জীবের মুখে “হায় হোসেন, হায় হোসেন!” রব শুনিয়াছিল; আজ দেবগণ, স্বর্গের হুর-গ্লামানগণ, মহাঋষি, যোগী, তপস্বী, অমরাত্মার মুখে শুনিতে লাগিল, “হায় হোসেন! হায় হোসেন!! হায় হোসেন!!”
এই গোলযোগ না যাইতে-যাইতেই সকলে যেন মহাদুঃখে নির্বাকভাবে দণ্ডায়মান হইলেন। হায় হায়! পুত্রের কী স্নেহ! রক্ত, মাংস, ধমনী, অস্থি, শরীরবিহীন আত্মাও অপত্য-স্নেহে ফাটিয়া যাইতেছে, যেন মেঘ-গর্জনের সহিত শব্দ হইতেছে-হোসেন! হায় হোসেন! মরতজা আলী “শেরে খোদা” (ঈশ্বরের শার্দূল) স্বীয় পত্নী বিবি ফাতেমাসহ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দৈহিকের জন্য শোক অমূলক খেদ বৃথা। দৈহিক জীবের সহিত তাঁহাদের কোন সংস্রব নাই,-তথাপি পুত্রের এমনই মায়া যে, সে সকল মূলতত্ত্ব জ্ঞাত থাকিয়াও মহাত্মা আলী মহা খেদ করিতে লাগিলেন। জগতীয় বায়ু প্রকৃত আত্মায় বহমান হইয়া ভ্রমময় মহাশোকের উদ্রেক করিয়া দিল। কুহকিনী দুনিয়ার কুহকজালের ছায়া দেখিয়া হজরত আলী অনেক ভ্রমাত্মক কথা বলিতে লাগিলেন। “আন অশ্ব, আন তরবারি, এজিদের মস্তক এখনই সহস্র খণ্ডে খণ্ডিত করিব।” হায়! অপত্য স্নেহের নিকট তত্ত্বজ্ঞান, আত্মজ্ঞান, সকলই পরাস্ত।
সকল আত্মাই হজরত আলীকে প্রবোধ দিলেন। হজরত জিবরাইল আসিয়া বলিলেন, “ঈশ্বরের আদেশ প্রতিপালিত হউক। শহীদগণের দৈহিক সৎকারে প্রবৃত্ত হওয়া যাউক। অগ্রে শহীদগণের মৃতদেহ অন্বেষণ করিয়া সংগ্রহ করিতে হইবে; বিধর্মী, ধর্মী, স্বর্গীয়, নারকী, একত্র মিশ্রিত সমরাঙ্গণে অঙ্গে অঙ্গ মিশাইয়া রহিয়াছে; সেইগুলি বাছিয়া লইতে হইবে।” সকলেই শহীদগণের দেহ অন্বেষণে ছুটিলেন!
ঐ যে শিরশূন্য মহারথ-দেহ ধুলায় পড়িয়া আছে, খরতর তীরাঘাতে অঙ্গে সহস্র সহস্র ছিদ্র দৃষ্ট হইতেছে, পৃষ্ঠে একটি মাত্র আঘাত নাই,-সমুদয় আঘাতই বক্ষ পাতিয়া সহ্য করিয়াছে, এ কোন্ বীর? কবচ, কটিবন্ধ, বর্ম, চর্ম, অসি, বীর সাজের সমুদয় সাজ, সাজওয়া অঙ্গেই শোভা পাইতেছে, বয়সে কেবল নবীন যুবা। কী চমৎকার গঠন! হায়! হায়! তুমি কী আবদুল ওহাব? হে বীরবর! তোমার মস্তক কি হইল? তুমি কি সেই আবদুল ওহাব? যিনি চিরপ্রণয়িনী প্রিয়তমা ভার্যার মুখখানি একবার দেখিতে বৃদ্ধা মায়ের নিকট অনুনয়-বিনয় করিয়াছিলেন, মাতৃ আজ্ঞা প্রতিপালনে, অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়াই যিনি বীররমণী বীরবালার বঙ্কিম আঁখির ভাব দেখিয়া ও রণোত্তেজক কথা শুনিয়া অসংখ্য বিধর্মীর প্রাণ বিনাশ করিয়াছিলেন,-তুমি কি সেই আবদুল ওহাব?
বীরবরের পদপ্রান্তে এ আবার কে? এ বিশাল অক্ষি দুটি ঊর্ধ্বে উঠিয়াও বীরশ্রেষ্ঠ আবদুল ওহাবের সজ্জিত শরীর-শোভা দেখিতেছে। এক বিন্দু জল!!-ওহে এক বিন্দু জলের জন্য আবদুল ওহাব-পত্নী হত-পতির পদপ্রান্তে শুষ্ককণ্ঠা হইয়া আত্মবিসর্জন করিয়াছেন!
এ রমণীহৃদয়ে কে আঘাত করিল? এ কোমল শরীরে কোন পাষাণহস্ত অস্ত্রাঘাত করিয়া বৃদ্ধ বয়সে জীবলীলা শেষ করিল? রে কাফেরগণ! হোসেনের সহিত শত্রুতা করিয়া রমণী-বধেও পাপ মনে কর নাই? বীরধর্ম, বীর-নীতি, বীর-শাস্ত্রে কি বলে? যে হস্ত রমণী দেহে আঘাত করিতে উত্তোলিত হয়, সে হস্ত বীর অঙ্গের শোভনীয় নহে, সে বাহু বীর-বাহু বলিয়া গণনীয় নহে। নরাকার পিশাচের বাহু!
সে বীর-কেশরী, সে বীরকুল-গৌরব, সে মদিনার ভাবি রাজা কোথায়? মহা মহা রথী যাঁহার অশ্ব-চালনায়, তীরের লক্ষ্যে, তরবারির তেজে, বর্শার ভাজে মুগ্ধ সে বীরবর কই? সে অমিত-তেজা রণকৌশলী কই? সে নব-পরিণয়ের নূতন পাত্র কই? এই তো শাহানা বেশ। এই তো বিবাহ সময়ের জাতিগত পরিচ্ছদ। এই কী সেই সখিনার প্রণয়ানুরাগ নব পুষ্পহার পরিণয়সূত্রে গলায় পরিয়াছিল! এই কী সেই কাসেম! হায়! হায়!! রুধিরের কী অন্ত নাই!
সখিনা সমুদয় অঙ্গে, পরিধেয় বসনে রুধির মাখিয়া বীর-জায়ার পরিচয়-বিবাহের পরিচয় দিয়াছেন, তবু রুধিরের ধারা বহিতেছে-মণিময় বসনভূষণ, তরবারি, অঙ্গে শোভা পাইতেছে। তূণীর, তীর, বর্শা দেহপার্শ্বে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বাম পার্শ্বে এ মহাদেবী কে? এ নবকমলদলগঠনা নবযুবতী সতী কে? চক্ষু দু’টি কাসেমের মুখ দেখিতে দেখিতে যেন বন্ধ হইয়াছে, জানিত কি অজানিতভাবে বাম হস্তখানি কাসেমের বক্ষের উপর রহিয়াছে। সত্যি! তুমি কে? তোমার দক্ষিণ হস্তে এ কী? এ কী ব্যাপার-কমলকরে লৌহ অস্ত্র! সে অস্ত্রের অগ্রভাগ কই? উহু! কি মর্মঘাতী দৃশ্য! বদ্ধমুষ্টিতে অস্ত্র ধরিয়া হৃদয়-কন্দরে প্রবেশ করাইয়াছ! তুমি কী সখিনা? তাহা না হইলে এত দুঃখ কার? স্বামীর বিরহ-বেদনায় কাতর হইয়া আত্মবিসর্জন করিয়াছ? না-না-বীর-জায়া, বীর-দুহিতা কী কখনো স্বামী-বিরহে কী বিয়োগে আত্মবিসর্জন করে? কী ভ্রম! কী ভ্রম! তাহা হইলে এ বদনে হাসির আভা কেন থাকিবে? জ্যোতির্ময় কমলাননে জ্বলন্ত প্রদীপ প্রভা কেন রহিবে? বুঝিলাম-বিরহ কি বিয়োগ দুঃখে এ তীক্ষ্ণ খঞ্জরে হৃদয়-শোণিত, স্বামী দেহ বিনির্গত শোণিতে মিশ্রিত হয় নাই। স্বামী বিয়োগে অধীরা হইয়া দুঃখভার হ্রাস করিতেও খ রের আশ্রয় গ্রহণ করা হয় নাই। ধন্য সতী! ধন্য সতী সখিনা! তুমি জগতে ধন্য, তোমার সুকীর্তি জগতে অদ্বিতীয় কীর্তি! কী মধুময় কথা বলিয়া খঞ্জরহস্তে কহিয়াছিলে? জগৎ দেখুক। জগতের নরনারীকুল তোমায় দেখুক। এত প্রণয়, এত ভালবাসা, এত মমতা, এত স্নেহ, এক শোণিতে গঠিত যে কাসেম সেই আমার পরিণয়ে আবদ্ধ, নব প্রেমে দীক্ষিত-যে ঘটনায় নিতান্ত অপরিচিত হইলেও মুহূর্তমধ্যে প্রণয়ের ও প্রেমের সঞ্চার হয়,-সতীত্ব ধন রক্ষা করিতে সেই কাসেমকে মুক্তকণ্ঠে বলিলে, “ভুলিলাম কাসেম, এখন তোমায় ভুলিলাম।” এই চিরস্মরণীয় মহামূল্য কথা বলিয়া যাহা করিলে, তাহাতে অপরের কথা দূরে থাকুক,-নির্দয়হৃদয় মারওয়ানের অন্তরেও দয়ার সঞ্চার হইয়াছিল। ধন্য, ধন্য সখিনা! সহস্র ধন্যবাদ তোমারে!
এ প্রান্তরে এ রূপরাশি কাহার? এ অমূল্য রত্ন ধরাসনে কেন? ঈশ্বর তুমি কি না করিতে পার? একাধারে এত রূপ প্রদান করিয়া কি শেষে ভ্রম হইয়াছিল? সেই আজানুলম্বিত বাহু, সেই বিস্তারিত বক্ষ, সেই আকর্ণ বিস্তারিত অক্ষিদ্বয়, কি চমৎকার ভ্রূযুগল, ঈষৎ গোঁফের রেখা! হায়! হায়! ভগবান্ এত রূপবান্ করিয়া কি শেষে তোমার ঈর্ষা হইয়াছিল? তাহাতেই কি এই কিশোর বয়সে আলী আকবর আজ চির-ধরাশায়ী।
এ যুগল মূর্তি এক স্থানে পড়িয়া কেন? এ ননীর পুতুল রক্তমাখা অঙ্গে মহাপ্রান্তরে পড়িয়া কেন? বুঝিলাম, ইহাও এজিদের কার্য। রে পাষণ্ড পিশাচ! হোসেনের ক্রীড়ার পুত্তলি দুটিও ভগ্ন করিয়াছিস্; হায়! হায়! এই তো সেই ফোরাতনদী, ইহার ভয়ানক প্রবাহ মৃত শরীর সকল স্রোতে ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে। নদীগর্ভে স্থানে স্থানে লৌহিত, স্থানে স্থানে কিঞ্চিৎ লোহিত, কোন স্থানে ঘোর পীত, কোন স্থানে নীলবর্ণের আভাসংযুক্ত স্রোত বহিয়া নিদারুণ শোক প্রকাশ করিতেছে। -হোসেন-শোকে ফোরাতের প্রতি তরঙ্গ মস্তক নত করিয়া রঞ্জিত জলে মিশিয়া যাইতেছে।
শব্দ হইল, “এ আমার কোমরবন্ধ, এ যে আমার শিরস্ত্রাণ, এ যে আমারই তরবারি, এ সকল এখানে পড়িয়া কেন?” আবার শব্দ হইল, “এ সকলই তো হোসেনের আয়ত্তাধীনে ছিল!”
এই তো সেই মহাপুরুষ-মদিনার রাজা! এ প্রান্তরে বৃক্ষতলে পড়িয়া কেন? রক্তমাখা খ র কাহার? এ তো হোসেনের অস্ত্র নহে। অঙ্গের বসন, শিরাস্তরণ, কবচ, স্থানে স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে, কারণ কি? তাহাতেই কী এই দশা? এ কি আত্ম-বিকারের চিহ্ন, না ইচ্ছামৃত্যুর লক্ষণ? বাম হস্তের অর্ধ পরিমাণ খণ্ডিত হইয়াও দুই হস্ত দুই দিকে পড়িয়া যে উপদেশ দিতেছে, তাহার অর্থ কি জগতে কেহ বুঝিয়াছে? বাম হস্তে আবার কে আঘাত করিল? মস্তক খণ্ডিত হইয়াও জন্মভূমি মদিনার দিকে ফিরিয়া রহিয়াছে! হায় রে জন্মভূমি!!
সীমার মস্তক লইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে গিয়াছিল, আজরও সেই মস্তক এই দেহে সংযুক্ত করিবার আশয়ে পুত্রগণের মস্তক কাটিয়া দিয়াও কৃতকার্য হইতে পারে নাই। এজিদ্, কত খেলা খেলিবে, কত অপমান করিবে, আশা করিয়া মস্তক দামেস্কে লইয়া গিয়াছিল। ধন্য হে কারিগরি! ধন্য রে ক্ষমতা! জগদীশ! তোমার মহিমা অপার। তুমি যাহা সংঘটন করিয়া একত্র করিতে ইচ্ছা কর, তাহা অত্যুচ্চ পর্বতশিখরে থাক্, ঘোর অরণ্যে থাক্, অতল জলধিতলে থাক্ অনন্ত আকাশে থাক্ বায়ু অভ্যন্তরে থাক্ তাহা সংগ্রহ করিয়া একত্র করিবেই করিবে। এ লীলা বোঝা মানবের সাধ্য নহে, এ কীর্তির কণামাত্র বুঝাও ক্ষুদ্র নর মস্তকের কার্য নহে। জগদীশ! প্রাণ খুলিয়া বলিতেছি, “তুমি সর্বশক্তিমান্ অদ্বিতীয় প্রভু! তোমার মহিমা অপার!!”
স্বর্গীয় দূতগণ, পবিত্র আত্মাগণ, শহীদগণের দৈহিক ক্রিয়ার যোগ দিলেন, স্বর্গীয় সুগন্ধে সমাধিস্থান আমোদিত হইতে লাগিল।
শহীদগণের শেষক্রিয়া “জানাজা” করিতে অন্য অন্য মৃত শরীরের ন্যায় জলে স্নান করাইতে হয় না, অন্য বসন দ্বারা শরীর আবৃত করিতে হয় না, ঐ রক্তমাখা শরীর সজ্জিত বেশে, ঐ বীর-সাজে মন্ত্র পাঠ করিয়া মৃত্তিকায় প্রোথিত করিতে হয়। ধর্মযুদ্ধের কী অসীম বল, কী অসীম পরিণাম ফল!
দৈহিক কার্য শেষ হইলে শহিদগণ দিব্যজ্ঞান লাভ করিয়া ঈশ্বরের আদেশে স্বর্গে নীত হইলেন।