উদুদা পাহাড়ের অশরীরী দানব – সঙ্কর্ষণ রায়

উদুদা পাহাড়ের অশরীরী দানব – সঙ্কর্ষণ রায়

যাবেন না হুজুর। আমার জিপের ড্রাইভার জোহান ও গাইড সুখলাল প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, এই উদুদা পাহাড় অদৃশ্য দানবের আস্তানা, এখানে কোনো মানুষের পা পড়েনি….

কয়লা খুঁজতে খুঁজতে মধ্যপ্রদেশেরে ‘সুরগুজা’ জেলার উত্তর প্রান্তে উদুদা পাহাড়ের নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। আমার ধারণা, পাহাড়ের ভেতরে কয়লার বিপুল ভান্ডার আছে। পাহাড়ে চড়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করব ভাবছি, কিন্তু স্থানীয় লোকেরা সকলেই আমাকে বাধা দেয়। তারা বলে, পাহাড়ে মাটির নীচে একজন অশরীরী দানব ঘুমিয়ে আছে। বৃষ্টি পড়লেই তার ঘুম ভাঙে, সেতর্জনগর্জন শুরু করে দেয়।

একশো বছর আগে ইংরেজ ভূ-বিজ্ঞানী ভ্যালেন্টাইন বল-ও এই পাহাড়ে উঠতে গিয়ে এ অঞ্চলের মানুষদের কাছ থেকে বাধা পেয়েছিলেন। বাধা না মেনে তিনি পাহাড়ে উঠেছিলেন। তিনি পাহাড়ে উঠতেই হঠাৎ বৃষ্টি নামল এবং ভাঙল দানবের ঘুম। তার তর্জনগর্জন শুনে ভয় পেয়ে তিনি পাহাড় থেকে নেমে এসেছিলেন। তাঁর কথা আজও এখানকার মানুষদের মুখে মুখে ফেরে।

গাইড সুখলাল বললে, বল সাহেবও তো আপনারই মতো কয়লা খুঁজতে এসেছিলেন, কয়লার খোঁজেই পাহাড়ে উঠতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই দানোর হাঁকডাক শুনে নেমে আসার পর আর ওঠার চেষ্টা করেননি।

অমি বললাম, বল সাহেব ভয় পেয়েছিলেন বলে আমি ভয় পাব! তা ছাড়া এখন তো আকাশ পরিষ্কার, মেঘের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি না পড়লে তো দানবটার ঘুমই ভাঙবে না, অনায়াসে আমি পাহাড়ে উঠে কাজ সেরে দিনের আলো থাকতে থাকতে নীচে নেমে আসতে পারব…

না হুজুর না, পাহাড়ের মাথায় গিয়ে পৌঁছতেই আপনার সারাটা দিন লেগে যাবে। তা ছাড়া আকাশ পরিষ্কার দেখে মনে করবেন না যে মেঘ জমবে না। এই পাহাড়ের আনাচেকানাচে সবসময়ই মেঘ লুকিয়ে থাকে, যে-কোনো সময়ে তারা আকাশকে ছেয়ে ফেলে বৃষ্টি ঝরাতে পারে…

তুমি আমাকে যতই ভয় দেখাও না কেন, পাহাড়ে আমি চড়বই। গাইড হিসেবে তোমার কর্তব্য আমার সঙ্গে যাওয়া…

আমাকে মাপ করবেন হুজুর, আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারব না। উদুদা পাহাড়ে দানবের আস্তানা, ওখানে যাওয়া মানে দানবের এলাকায় অনধিকার প্রবেশ…

ঠিক আছে—একলাই যাব আমি।

একলাই চলি। ঘন ঘাসের তলায় চাপা আছে বন্য প্রাণীদের পায়ে পায়ে তৈরি পথ। এই পথটাকে পা দিয়ে অনুভব করতে করতে এগিয়ে যাই। মানুষের আনাগোনা না থাকলেও বনের পশুদের উপস্থিতি চলতে চলতে অনুভব করি। চোখে না দেখলেও বুঝতে পারি যে নিকটেই আছে তারা।

প্রায় চার ঘণ্টা চলার পর পাহাড়ের ওপরকার মালভূমির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছাই। এখানে ঘুরে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে গভীর উৎরাই দেখতে পাই। গাছপালা দিয়ে চাপা পড়ে যাওয়ায় মনে হয় যেন একটানা সবুজ রঙের ঢল নেমেছে নীচের সমতলভূমির দিকে। তাকে বিশ্লিষ্ট করে একটি পাহাড়ি নদী বেগে নীচে নেমে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে সার্ভে অব ইন্ডিয়ার যে ম্যাপ আছে, তার সঙ্গে স্থানীয় ভূচিত্রকে মিলিয়ে বুঝতে পারি যে এটা দুধী নদী।

উদুদা পাহাড়ের ওপরকার এই মালভূমির মধ্যে কোথাও প্রচ্ছন্ন রয়েছে দুধী নদীর উৎস। নদীস্রোত মালভূমিকে ঢেকে রাখা গাছপালা লতাগুল্মের মধ্যে চাপা পড়ে যাওয়াতে তার উৎসটি কোথায় বুঝতে পারি না। ওপরে মালভূমির ওপরে গিয়ে দাঁড়ালে হয়তো তা বুঝতে পারব।

দুধী নদীর উৎস খোঁজা আমার কাজ নয়, আমি খুঁজছি কয়লা। মালভূমির ওপরকার বন যতই ঘন হোক, গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে কিছু পাথর দেখা যাচ্ছে। এই পাথরগুলোর মধ্যে কয়লাও থাকতে পারে ভেবে আমি আস্তে আস্তে চড়াই বেয়ে উঠতে থাকি।

চড়াই না বলে খাড়াই বলাই উচিত, কারণ পাথরের স্তূপ খাড়া হয়ে উঠে গিয়েছে ওপরের দিকে। বন্য প্রাণীদের পায়ে-চলা পথ এখান দিয়েও উঠে গিয়েছে বলে তাকে অনুসরণ করে ওপরের দিকে যেতে পারি।

শেষ পর্যন্ত মালভূমির ওপরে এসে দাঁড়িয়ে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে বেলেপাথরের স্তর দেখতে পাই। ঝুঁকে পড়ে বেলেপাথর পরীক্ষা করি, কারণ বেলেপাথরের তলায় কয়লা থাকার সম্ভাবনা।

পাথর পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ মনে হল অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি যে আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। এতক্ষণ আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘও ছিল না, হঠাৎ এই মেঘের আবির্ভাব আমাকে অবাক করে।

মেঘ জমার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ বৃষ্টিও নামে। এমন প্রচন্ড বৃষ্টি আগে কখনো দেখিনি। আকাশের মেঘ যেন জলপ্রপাত হয়ে নেমে আসছে, মেঘের স্তূপগুলো যেন একসঙ্গে তরলায়িত হয়ে সমস্ত বনকে ডুবিয়ে ফেলতে চলেছে। আমিও যেন ডুবে যাচ্ছি, বৃষ্টি যেন বন্যার আকার নিয়ে আমাকে ডুবিয়ে ফেলতে চলেছে।

আত্মরক্ষার তাগিদে ছুটতে শুরু করি। গাছপালা, ঘাস ও লতাঝোপের দুর্ভেদ্য বাধা পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে একটা বেলেপাথরের ঢিবির নীচে এসে দাঁড়াই। তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটা গহ্বরের মুখোমুখি হই। ঢুকে পড়ি তার ভেতরে।

গুহার মধ্যে ঢুকতেই বুঝতে পারি যে এখানে আমি একা নই, কয়েকটা ভাল্লুক গা-জড়াজড়ি করে বসে আছে। হয়তো এই গুহাটা ওদের আস্তানা, কিংবা হয়তো প্রচন্ড বৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার জন্য ওরা এখানে আশ্রয় নিয়েছে। ওরা আমার দিকে ভ্রূক্ষেপও করে না।

বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলে। আকাশ থেকে একসঙ্গে লক্ষ লক্ষ জলপ্রপাত যেন নেমে আসছে। একেই বোধহয় বলে ‘cloudbursts’—বইয়ে পড়েছি, এ হেন মেঘ-ভাঙা দুর্যোগ সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে ঘটে থাকে।

বৃষ্টির বেগের সঙ্গে তাল রেখে গাছপালাগুলো প্রবল বেগে কাঁপতে থাকে, মনে হয় তারা যেন মূলসুদ্ধ উপড়ে বেরিয়ে আসবে।

বাইরের এই প্রমত্ততা ভাল্লুকদের ভয়ে একেবারে নিস্পন্দ করে দেয়, গুহার দেয়াল ঘেঁষে পাথরের মতোই নিথর হয়ে বসে থাকে তারা। তাদের একটির মধ্যেও হিংস্রতার কোনো আভাস পাই না। সঙ্গে ক্যামেরা ছিল না, থাকলে ভয়ে জড়োসড়ো ভাল্লুকদের ছবি তুলে রাখতে পারতাম।

ভাল্লুকদের ভয় দেখে আমার ব্যক্তিগত ভয় যখন ভোঁতা হয়ে আসছে, তখন গুহার মধ্যে ঢুকল একটা বাঘিনী তার দুটি শাবককে নিয়ে। আমার গা ঘেঁষেই তারা গুহার ভেতরের দিকে গেল, আমার বা ভাল্লুকদের দিকে ভ্রূক্ষেপও করল না।

তারপর একটানা প্রায় চার ঘণ্টা ধরে ভাল্লুক, বাঘ ও মানুষের মধ্যে একটা বিস্ময়কর সহাবস্থান চলল। প্রাকৃতিক দুর্যোগই সম্ভব করল এই অসম্ভবকে।

বৃষ্টি যখন থামল তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গুহা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না, কারণ, গুহার সামনে জল জমতে জমতে মালভূমিটাকে জলাভূমিতে পরিণত করেছে। আমার বন্যপশু সঙ্গীরাও অনড়, গুহা থেকে বেরিয়ে যেতে তারাও সাহস পাচ্ছে না।

আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই যেখানে যতটুকু আলোর চিহ্ন ছিল সবকিছুকেই আচ্ছন্ন করে ফেলে গভীর অন্ধকার। গুহার ভেতরকার শূন্যতা এবং বাইরের বন একাকার হয়ে যায় নিবিড় অন্ধকারের ঐক্যবন্ধনে। বাঘ বা ভাল্লুকদের কাছে এই অন্ধকার অবশ্য অন্ধকার নয়, কারণ অন্ধকারের যবনিকা ভেদ করতে পারে তাদের চোখের দৃষ্টি। অন্ধকারে তাদের চোখ সক্রিয় বলেই তাদের চোখ অন্ধকারের মধ্যে জ্বলন্ত অঙ্গারখন্ডের মতো জ্বল জ্বল করতে থাকে। আরো অনেক জ্বলন্ত অঙ্গারখন্ড গুহার বাইরে বনময় ছড়িয়ে থাকে। হয়তো বন্যপ্রাণীদের অনেকেই বন্দি হয়ে পড়েছে জলার মধ্যে।

এই অন্ধকার বনে আমি একা নই, গুহার মধ্যে বাঘ ও ভাল্লুক ছাড়া আরো অনেক বনের পশু ও সরীসৃপ বনময় ছড়িয়ে আছে। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগের মধ্যে তারা ও আমি একই সঙ্কটের সূত্রে বঁাধা পড়ে গিয়েছি। এই জনহীন বনের মধ্যে তারাই আমার বন্ধু। তাই আর ভয় পাই না বনজোড়া এই অন্ধকারকে।

অন্ধকার গুহার মধ্যে মন যখন ভয়শূন্য হয়ে উঠেছে, তখন ভয়ংকর একটা গর্জনে আমার বুক কেঁপে ওঠে। বনের সব বন্যপ্রাণী একযোগে গর্জে উঠলে যে শব্দ সৃষ্টি হত তাকেও ছাপিয়ে যায় এই আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে এই গুহার পাথরের দেয়াল, বনের গাছপালা, লতাঝোপ সব কিছুই যেন একসঙ্গে শিউরে ওঠে।

এই গর্জনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে রকমারি শব্দ। কীসের শব্দ, কোথা থেকে আসছে তার কিছুই পারি নে বুঝতে। জলের স্রোতের মতো এই শব্দের স্রোত বন-পাহাড়কে কাঁপিয়ে তুলে একটানা বয়ে যেতে থাকে। পায়ের নীচেও তার স্পন্দন অনুভব করি।

হঠাৎ মনে হল, এই বোধহয় সেই অশরীরী দানব। বৃষ্টির জল তার ঘুম ভাঙিয়েছে। তার গর্জন শোনামাত্র এই গুহার মধ্যে আশ্রয় নেওয়া প্রাণীরা ভয়ে অস্থির হয়ে ওঠে, তারা বেরিয়ে যায় গুহা থেকে। আমার দিকে ভ্রূক্ষেপও না করে আমার গা ঘেঁষেই যায়। তারপর যায় আর একজন, যাকে এ পর্যন্ত চোখেও দেখিনি। অন্ধকারের মধ্যে গাঢ়তর অন্ধকারের স্রোতের মতো বেরিয়ে যায় একটি মস্তবড়ো অজগর সাপ। লম্বায় দশ মিটারের কম হবে না। বুঝতে পারি যে ভয়ে অজগরও জর্জর হয়ে উঠেছে।

অজগরকে অনুসরণ করে আমিও বেরিয়ে যাই গুহা থেকে। গুহার বাইরে অন্ধকারের মধ্যে প্রচন্ড তোলপাড় টের পাই। চোখে দেখা না গেলেও বুঝতে পারি যে বনের পশুরা প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করছে। প্রাণভয়ে আমিও চাই তাড়াতাড়ি এই পাহাড় থেকে নেমে যেতে।

ঠিক এমন সময় একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার আমার নজরে এল। পাহাড়ের ওপরে যে জল জমে জলা সৃষ্টি হয়েছিল, তা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে এতখানি জল কোথায় গেল?

বুদ্ধি দিয়ে এর ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে একটা কথা আমার মনে আসে। পাহাড়ে মালভূমির মাথায় পাথর পরীক্ষা করতে গিয়ে অনেকগুলি ফাটল আমার নজরে এসেছিল। ফাটলগুলো পাথরের স্তরকে বিশ্লিষ্ট করেছে। এইসব ফাটলের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের মালভূমির ওপরে জমে থাকা সব জল ঢুকে পড়েছে পাহাড়ের মধ্যে। এই বিপুল জলরাশির ভূগর্ভে প্রবেশের শব্দকে অদৃশ্য দানবের তর্জনগর্জন বলে আমার এবং আরো অনেকের মনে হয়েছে।

অদৃশ্য দানবের গর্জন যে আসলে জলের পাতাল প্রবেশের শব্দ তার প্রমাণ একটু বাদেই দেখতে পাই। ততক্ষণে মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে দেখা দিয়েছে আধখানা বঁাকা চাঁদ। তার আলোয় দেখতে পাই, পাথরের ঢিবির তলা থেকে মেঠো ইঁদুর বেরিয়ে আসছে। পাঁচ-দশটা নয়, শয়ে শয়ে ইঁদুর বেরিয়ে এসে শোভাযাত্রা করে এগিয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে তারা মাটির তলার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসেছে। জল ঢোকাতে মাটির তলায় আর থাকতে পারেনি। মাটির মধ্যে ঢুকে যাওয়া জলস্রোত তাদের টেনে বের করে এনেছে।

এর পর অশরীরী দানবকে আর ভয় পাই নে। পাহাড় থেকে নেমে গাইড সুখলালকে ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করি। কিন্তু বুঝেও সেবোঝে না, অশরীরী দানব সম্বন্ধে তার ভয়কে আমি অনেক চেষ্টা করেও ঘোচাতে পারি না। অগত্যা পাহাড়ে উঠে একাই আমাকে চালিয়ে যেতে হয় কয়লা খোঁজার কাজ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *