৮
এদিকে রাজকুমার দৃঢ় এখন আর রাজকুমার নেই। বছরের পর বছর সে যখন কারাগারে ছিল, তখনও সে নিজেকে রাজকুমার বলেই জানত। এখন তার কিছুই মনে পড়ে না। নিজের মায়ের কথা, নিজের রাজ্যের কথাও মনে পড়ে না।
লিচ্ছবি রাজ্যের এক দ্বীপে, মোড়লের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে দৃঢ়। মোড়লের মস্ত বড় সংসার, প্রায় তিরিশ-চল্লিশজন লোক থাকে। অনেকখানি জায়গা জুড়ে পরপর দশ-বারোটা মাটির ঘর, আর প্রচুর গাছপালা।
দৃঢ়র শরীর এখনও অসুস্থ, সারাদিন একটা মাটির ঘরে সে শুয়ে থাকে। দুটো হাত ঢাকা দিয়ে রাখে চোখের ওপর। এখনও সে আলো সহ্য করতে পারে না। দুটো হাতেও তেমন জোর নেই। মোড়লের এক মেয়ে তাকে দু’বেলা খাবার দিয়ে যায়। দৃঢ় শুধু খায় আর ঘুমোয়। এ-বাড়ির মানুষ যখন তাকে জিজ্ঞেস করে, ওগো, তুমি কে? তোমার বাড়ি কোথায়? কোন্ দেশ থেকে এসেছ? দৃঢ় চুপ করে থাকে।
দিনের পর দিন যায়। আস্তে-আস্তে দৃঢ় সুস্থ হয়ে উঠল। হাত দুটোতে জোর ফিরে এল, চোখেও রোদ পড়লে কষ্ট হয় না। এখন আর সে সারাদিন ঘরে থাকে না, ঘুম থেকে উঠে একটা গাছতলায় গিয়ে বসে। বাচ্চা ছেলেরা দূরে দাঁড়িয়ে কৌতূহলের সঙ্গে তাকে দেখে। এই রহস্যময় মানুষটি কোনও কথা বলে না।
শরীর সুস্থ হয়ে ওঠার সময় রাজকুমার দৃঢ় নিজেকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে লোকে তার নাম-ধাম জিজ্ঞেস করে, সে উত্তর দিতে পারে না কেন? নিশ্চয়ই তার একটা নাম ছিল, কোথাও একটা বাড়ি ছিল। কী করে সে সব ভুলে গেল? তার দুই বাহুতে দুটো সোনার বালা আছে, কিন্তু তাতে কিছু লেখা নেই।
বেশি চিন্তা করতে গেলে তার মাথা ঝিমঝিম করে।
মোড়লের যে-মেয়েটি তাকে খাবার দিতে আসে, তার বয়েস দশ-এগারো বছর। তার নাম লোপা। তার মাথা ভর্তি কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল, গায়ের রং কালো, মুখখানাতে দুষ্টু-দুষ্টু ভাব। খাবার দেবার সময় রোজই সে বলে, “এই যে বোবা মানুষ, খাও!”
একদিন রাজকুমার দৃঢ় তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
“অমনি লোপা হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কথা বলেছে! কথা বলেছে! কথা বলেছে।” সেইরকম চ্যাঁচাতে-চ্যাঁচাতে সে চলে গেল বাড়ির মধ্যে। ডেকে আনল তার বাবাকে।
মোড়লের গায়ের রং কালো কুচকুচে, লম্বা-চওড়া চেহারা, মাথার চুল সাদা। সে এসে বলল, “ওগো বিদেশী, তুমি কথা বলছ বলে আমরা বড় খুশি হয়েছি! তুমি কোন্ দেশের মানুষ? আমাদের এদেশে কি তোমার চেনা কেউ আছে?”
দৃঢ় লজ্জার সঙ্গে বলল, “আমি কিছুই মনে করতে পারছি না। আমি এখানে এলাম কী করে?”
মোড়ল বলল, “তুমি নদীতে ভাসতে ভাসতে এসেছ। তোমার মাথায় চোট লেগেছিল। কতদূর থেকে তুমি এসেছ, তাও আমরা জানি না।”
দৃঢ় বলল, “আমিও জানি না। এটা তোমাদের বাড়ি? আমাকে এখানে থাকতে দিয়েছ কেন?”
মোড়ল জিভ কেটে বলল, “তুমি আমাদের অতিথি! তুমি এখানে যতদিন খুশি থাকতে পারো। অতিথির সেবা করলে পুণ্য হয়।”
দৃঢ় বলল, “কিন্তু আমি কেন থাকব? কিংবা কোথায়ই বা যাব?” মোড়ল বলল, “যদি অন্য কোথাও না যেতে চাও, তা হলে আমাদের বাড়িতেই থাকো।”
দৃঢ় বলল, “আমি দেখি যে এ-বাড়ির সকলেই কিছু-না-কিছু কাজ করে। আমারও তো কোনও কাজ করা উচিত। কিন্তু আমি কী কাজ জানি? কিছুই তো জানি না।”
মোড়ল বলল, “যদি কাজ করতে ইচ্ছে হয়, আস্তে-আস্তে শিখে নেবে। আমরা শিখিয়ে দেব।”
দৃঢ় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বুকের মধ্যে একটা কষ্ট হচ্ছে। কিছুই না-জানার কষ্ট বড় মর্মান্তিক।
আরও কেটে গেল কয়েকটা দিন। লোপা নামে মেয়েটির সঙ্গে তার ভাব হয়েছে। দৃঢ় নিজের নামও জানে না শুনে লোপার কী হাসি! এমন মানুষ সে কখনও দেখেনি। তারপর সে নিজেই দৃঢ়র একটা নাম দিয়েছে। দৃঢ়কে সে ‘কুমার’ বলে ডাকে।
মোড়লের এক ভাই মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ে। দৃঢ় তার পাশে বসে-বসে দেখে। নিজেও মূর্তি গড়ার চেষ্টা করে। আস্তে-আস্তে সে শিখে গেল অনেকটা। একদিন হঠাৎ ডাকাতেরা আক্রমণ করল সেই মোড়লের বাড়ি। নৌকো করে এল ডাকাতের দল, তাদের হাতে তলোয়ার, বর্শা আর জ্বলন্ত মশাল। হইহই করে ধেয়ে এল এই বাড়ির দিকে।
ডাকাতদের দেখে মোড়লের বাড়ির লোকজন ভয়ে পালাতে লাগল। কয়েকজন বাধা দিতে গেলেও প্রচণ্ড মার খেল ডাকাতদের হাতে।
দৃঢ় ঘুমিয়ে ছিল, তাকে ডাকবার কথা কারুর মনে আসেনি। ঘুম ভেঙে সে দেখল, তার দরজার কাছে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।
দৃঢ় জিজ্ঞেস করল, “কে? কী চাই?”
ডাকাতটা বলল, “তুই কে রে ব্যাটা? বাড়ির জামাই নাকি? তোর হাতে দেখছি সোনার বালা। দে, খুলে দে!”
দৃঢ় বলল, “তুমি আমার বালা চাও? কেন, বালা নিয়ে কী করবে?”
ডাকাতটা বলল, “ভাল চাস তো শিগগির দে! নইলে তোর মুণ্ডু কাটব!”
দৃঢ় বলল, “তোমাকে আমার ভাল লাগছে না! তুমি যাও এখান থেকে। আমি এখন ঘুমোব।”
ডাকাতটা অট্টহাস্য করে ঢুকে এল ঘরের মধ্যে। তারপর খপ্ করে দৃঢ়র মাথার চুল চেপে ধরে টেনে তুলতে গেল।
যন্ত্রণার চোটে আ-আ শব্দ করে উঠল। তারপর তার রাগ হল। রাগের চোটে ডাকাতটাকে একটা ধাক্কা দিল সে। ডাকাতটা ছিটকে পড়ে গেল।
পরের মুহূর্তেই ডাকাতটা তাকে হত্যা করার জন্য তলোয়ার তুলল।
দৃঢ় সেদিকে চেয়ে বলল, “তুমি আমাকে মারতে চাও?”
দৃঢ় যে চৌকিটায় শোয়, তার একটা পায়া ঢকঢক করে। একদিন ভেঙে পড়েছিল, আবার জোড়া লাগানো হয়েছে কোনওরকমে। চোখের নিমেষে দৃঢ় সেই খাটের পায়াটা তুলে নিয়ে বাধা দিল ডাকাতটাকে।
নিজের নাম ভুলে গেলেও দৃঢ় যুদ্ধবিদ্যা ভোলেনি। রাজকুমাররা খুব ভাল ভাল গুরুর কাছে অস্ত্রশিক্ষা করে, সাধারণ একটা ডাকাত তার সঙ্গে পারবে কেন? একটুক্ষণের মধ্যেই ডাকাতটা কাবু হয়ে গেল, মাথায় একটা চোট লাগার ফলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সে।
দৃঢ় তার হাত থেকে তলোয়ারটা খুলে নিল।
বাড়ির মধ্যে দারুণ চ্যাঁচামেচি হচ্ছে, মেয়েরা ভয় পেয়ে কাঁদছে। দৃঢ় তলোয়ারটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
ডাকাতদের যে সর্দার, তার ভয়ঙ্কর চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া চুল, কপালে মস্ত একটা সিঁদুরের টিপ, দু’ কানের ফুটোয় দুটো ফুল গোঁজা। সেই সদার লোপার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আর লোপা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
দৃঢ় বলল, “এই, ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ছেড়ে দাও!”
ডাকাতের সর্দার বলল, “এটা আবার কে? আয়, তোকে আগে সাবাড় করি।”
দৃঢ় কখনও কারও বাড়ির ডাকাতি দেখেইনি। ডাকাতদের ব্যাপারটাই সে জানে না। সে মনে করল, এই লোকগুলো খারাপ।
ডাকাত সর্দারের সঙ্গে আরম্ভ হয়ে গেল দৃঢ়র দ্বন্দ্বযুদ্ধ!
এই লোকটির সাহস আর শক্তি দুটোই প্রচণ্ড। দৃঢ় তাকে সহজে হারাতে পারল না। চলতে লাগল লড়াই। অন্য ডাকাতরা সেখানে ছুটে এলেও সর্দারকে সাহায্য করতে পারল না। লড়াইটা হচ্ছে একটা দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে।
এক সময় দৃঢ়র তলোয়ারের আঘাতে ডাকাতের সর্দারের হাত থেকে তলোয়ারটা ছিটকে পড়ে গেল। দৃঢ় তার অস্ত্রটা সর্দারের গলায় ঠেকিয়ে বলল, “তোমার সঙ্গীদের থামতে বলো। নইলে কিন্তু তুমি বাঁচবে না।”
সর্দারের ওই অবস্থা দেখে বাকি ডাকাতরা ছুটে পালাল। তাড়াহুড়ো করে নৌকোয় উঠতে গিয়ে কয়েকজন পড়ে গেল জলে। এর মধ্যে গ্রামের অন্য লোকরাও তেড়ে এল। ডাকাতদের সর্দার আর তার দু’জন সঙ্গী বন্দী হল গ্রামের লোকদের কাছে।
মোড়ল ও তার বাড়ির লোকেরা ফিরে এসে ধন্য ধন্য করতে লাগল দৃঢ়কে। তার জন্যই বেঁচে গেল সব কিছু। এর আগে ডাকাতদের বিরুদ্ধে এমন সাহসের সঙ্গে লড়াই করতে আর কাউকে দেখা যায়নি। এই বিদেশী মস্ত বড় বীর।
দৃঢ় এইসব প্রশংসার কথা গায়েই মাখল না। তার অসময়ে ঘুম ভেঙেছিল, সে আবার ঘুমোতে চলে গেল।
পরদিন থেকে দৃঢ়র খুব খাতির বেড়ে গেল সেই গ্রামে। সবাই তাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে চায়। মোড়ল তাকে অন্য কোনও বাড়িতে যেতে দিতে চায় না। তার ভয়, দৃঢ় তাদের বাড়ি ছেড়ে যদি চলে যায়! তার খুব ইচ্ছে, তার মেয়ের সঙ্গে দৃঢ়র বিয়ে দেওয়ার।
কয়েকদিন পর দেশের রাজার কাছ থেকে দূত এল সেই মোড়লের কাছে। দূত তার সঙ্গে কয়েকজন সৈন্য ও একটা রথ নিয়ে এসেছে। একদল সাঙ্ঘাতিক ডাকাতকে একজন অচেনা বিদেশী লড়াই করে হারিয়ে দিয়েছে, এই খবর পৌঁছেছে রাজার কানে। তিনি এই লোকটিকে দেখতে চান।
রাজার আদেশ অমান্য করার উপায় নেই। দৃঢ় যেতে চায় না। মোড়লদের বাড়িটা আর এখানকার লোকদের সঙ্গে তার চেনা হয়ে গেছে, এ-জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার ইচ্ছে নেই তার। কিন্তু মোড়ল বুঝল যে, দৃঢ় না গেলে রাজা তার ওপরেই রাগবেন। সে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দৃঢ়কে রাজি করাল। দৃঢ় উঠে বসল রথে।
এ-দেশের রাজা খুব বৃদ্ধ। তাঁর চার ছেলে। এদের মধ্যে কে যে পরে সিংহাসনে বসবে তা এখনও ঠিক হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী বড় ছেলেরই যুবরাজ হওয়ার কথা, কিন্তু রাজা বেশি ভালবাসেন তাঁর ছোট ছেলেকে। রাজকুমারদের মধ্যেও ভাব নেই, তারা সব সময় ঝগড়া করে।
দৃঢ়কে দেখে বৃদ্ধ রাজা চমকে উঠলেন।
দৃঢ়র পোশাক-পরিচ্ছদ এখন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মুখভর্তি জঙ্গলের মতন দাড়ি-গোঁফ, খালি পা। তাকে দেখে রাজকুমার বলে চেনার কোনও উপায় নেই। শুধু দুই বাহুতে দুটি সোনার বালা। দুই কানে দুই কুণ্ডল। তার চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, সে সাধারণ ঘরের ছেলে নয়।
সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রাজার চোখের দিকে চেয়ে রইল, সেই দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখলেই মনে হয়, ছোটবেলা থেকে সে কারও সামনে মাথা নিচু করেনি। রাজকুমাররাই এমনভাবে দাঁড়ায়।
রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি বিদেশী? তোমার নাম কী?”
লোপা তাকে যে নামে ডাকে, দৃঢ় সেই নামটাই বলল। সে বলল, “আমার নাম কুমার। আমি এসেছি অনেক দূর দেশ থেকে।”
রাজা বললেন, “আমি তোমার বীরত্বের কথা শুনেছি। গ্রামের লোক ডাকাত দেখলেই পালায়। তুমি একা রুখে দাঁড়িয়েছ। তোমাকে আমি একটা কাজ দিতে চাই। কিছুদিন আগে এ-রাজ্যের কোটাল মারা গেছে। তুমি নগর-কোটাল হবে?”
দৃঢ় কিছু উত্তর দেবার আগেই বড় রাজকুমার বলল, “বাবা, আপনি আগেই একে কাজ দিচ্ছেন? এ-লোকটা সত্যি-সত্যি বীর কি না, তা আগে পরীক্ষা করে দেখা হবে না? ও আমাদের সামনে লড়াই করে দেখাক।”
রাজা বললেন, “ঠিক। একবার ওর বীরত্বটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। কার সঙ্গে ও লড়াই করবে?”
বড় রাজকুমার বলল, “আমাদের ছোটকুমার ভাল লড়াই শিখেছে। তার সঙ্গেই যুদ্ধ করুক। তাকে যদি হারাতে পারে, তখন না হয় আমরা দেখব!”
ছোট রাজকুমার সঙ্গে-সঙ্গে তলোয়ার নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই দৃঢ় শান্তভাবে বলল, “আমি কোটাল হতে চাই না। আমি সেই গ্রামে মোড়লের বাড়িতে ফিরে যেতে চাই। ওঁর সঙ্গে আমি লড়াইও করব না!”
বড় রাজকুমার ধমক দিয়ে বলল, “চুপ করো। রাজার মুখের ওপর কথা বলতে নেই। রাজা তোমাকে লড়াই করতে বলেছেন, এখন লড়ো!”
দৃঢ় বলল, “কেন এর সঙ্গে লড়াই করব? ইনি তো আমার কোনও ক্ষতি করেননি!”
বড় রাজকুমারের ইচ্ছে, এই অচেনা লোকটা যদি ছোট রাজকুমারের সঙ্গে লড়াই করে তাকে মেরে ফেলে, তা হলে খুব ভাল হয়। তার পথের কাঁটা দূর হয়ে যায়!
বড় রাজকুমার বলল, “রাজার আদেশ অগ্রাহ্য করলে কী শাস্তি হয় জানো? তার শাস্তি মৃত্যু। তুমি লড়াই না করলে তোমায় শূলে চড়ানো হবে। সেই ভাবে মরতে চাও, না লড়াই করতে চাও?”
ছোট রাজকুমার বলল, “এ-লোকটাকে তো মনে হচ্ছে ভীতু। এ কী করে কোটালের কাজ করবে?”
বৃদ্ধ রাজা বললেন, “ওহে বিদেশী, তলোয়ার তোলো।”
দৃঢ় এবার তার তলোয়ারটা হাতে নিল। ছোট রাজকুমার ধেয়ে এল তার দিকে। দুই তলোয়ারে ঠোকাঠুকি হল।
লড়াইয়ে মন দিতে পারছে না দৃঢ়। সে পিছিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। একসময় রাজা হাত তুলে বললেন, “থাক, থাক, যথেষ্ট হয়েছে। লড়াইয়ের ফলাফল দেখার দরকার নেই। কে কীরকম ভাবে অস্ত্র চালায়, তা দেখলেই বোঝা যায়, তার দক্ষতা কতখানি। এই বিদেশী যুবক ইচ্ছে করলেই যে ছোট কুমারকে হারিয়ে দিতে পারে, তা আমি বুঝেছি। আমি আজ থেকে একে কোটালের কাজে নিযুক্ত করলাম।”
তলোয়ার নামিয়ে দৃঢ় বলল, “মহারাজ, আমাকে মাফ করুন। আমি কোটালের কাজ নিতে চাই না।”
বড় রাজকুমার বলল, “আরে, এ-লোকটা যে দেখি মহা মূর্খ! রাজ্যের কোটালের কাজ কত সম্মানের কাজ। কত টাকাপয়সা পাবে। সে কাজ নিতে চাইছে না?”
রাজা মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “বিদেশী কুমার, তুমি এ-কাজ নিতে চাও না কেন?”
দৃঢ় বলল, “আমি গ্রামে ফিরে যেতে চাই। নদীর ধারের গ্রামটি আমার বড় ভাল লেগেছে।”
রাজা বললেন, “কোটালের কাজ নিয়েও তুমি মাঝে-মাঝে সেখানে ফিরে যেতে পারবে। তুমি ডাকাতদের দমন করেছ, এই পুরস্কার তোমার প্রাপ্য। আপাতত তুমি অতিথি ভবনে থাকো। নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ পরে কাল তুমি রাজসভায় এসো, তোমার কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে।”
রাজকুমার দৃঢ়র ভাগ্যের চাকা এখানেই থামল না। পরের দিনই তার নিয়তি তাকে নিয়ে গেল অন্যদিকে।
পরদিন স্নান করে, নতুন মূল্যবান বস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে দৃঢ় এল রাজসভায়। অতিথিশালার পরিচারকরা তাকে যত্ন করে সাজিয়ে দিয়েছে, আজ তাকে আবার দেখাচ্ছে রাজকুমারের মতন। তার নতুন নাম হয়েছে কুমার সিংহ!
রাজার সভায় এসেছে ভোজ রাজ্যের দূত। দুই রাজবংশের মধ্যে আত্মীয়তা আছে। সেই দূত বৃদ্ধ রাজাকে এক দীর্ঘ কাহিনী শোনাল। কাহিনী যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন দৃঢ় এসে ঢুকল রাজসভায়।
রাজা দূতকে বললেন, “সবই তো শুনলাম। বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার। তুমি ভোজরাজকে বলবে, আমি তাঁকে সবরকম সাহায্য করব। তুমি যাকে খুঁজতে এসেছ, তাকে খোঁজার ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করবে আমার কোটাল। এতদিন এই রাজ্যে কোনও কোটাল ছিল না। আজই নতুন কোটাল নিযুক্ত হয়েছে।”
রাজা দৃঢ়র দিকে তাকিয়ে বললেন, “কুমার সিংহ, এটাই হবে তোমার প্রথম কাজ!”
ভোজরাজের দূত রাজকুমার দৃঢ়র দিকে ফিরে যেন ভূত দেখার মতন চমকে উঠল! বেশ কয়েক মুহূর্ত অপলকভাবে চেয়ে থেকে সে বলল, “কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! এই তো সেই মানুষ!”
রাজাও সবিস্ময়ে বললেন, “এই সেই মানুষ?”
ভোজরাজের দূত বলল, “সেই মানুষ! কোনও ভুল নেই! মহারাজ, এই যুবক আমাদের সেনাপতি বাহুককে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাজিত করেছে। তারপর রাজার নিজস্ব কালো ঘোড়ায় চেপে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জলপ্রপাতের মধ্যে। আমাদের রাজা আগেই ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি কেউ ওই ঘোড়ায় চেপে জলপ্রপাত পার হতে পারে, তবে তার সঙ্গেই তাঁর দুই রাজকন্যার বিবাহ দেবেন। এর আগে সেরকম অসম্ভব কাজ আর কেউ পারেনি! শুধুমাত্র এই রাজকুমার পেরেছেন!”
রাজা হেসে বললেন, “রাজকুমার! আমি ঠিক ধরেছিলাম। প্রথম দেখেই বুঝেছি! এই কুমার যে দারুণ বীর, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। কুমার, তুমি এতবড় একটা কাণ্ড করে এসেছ, তা আমাদের বলোনি কেন?”
রাজকুমার দৃঢ় বলল, “না, না, মহারাজ, আমি সেরকম তো কিছু করিনি! নিশ্চয়ই এই দূত ভুল করেছেন। অন্য কারও কথা ভেবেছেন।”
দূত বলল, “আমার ভুল হতেই পারে না। অবিকল এই মুখ। দু’ বাহুতে ঠিক এইরকম সোনার বালা। আমাদের দুই রাজকন্যাই ঠিক করেছেন, এই বীর পুরুষকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়েই করবেন না।”
রাজা বললেন, “আমার নিজের কোনও কন্যা নেই। যদি থাকত, তবে তার সঙ্গেই আমি এই বীর যুবকের বিবাহ দিতাম।”
রাজকুমার দৃঢ়র সঙ্গে তার ছোট ভাইয়ের মুখের অনেক মিল। দুজনেরই বাহুতে একইরকম তাদের বংশের বালা। দৃঢ় বারবার বলতে লাগল, সে বাহুক নামে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে লড়াই করেনি, কালো ঘোড়ায় চেপে কোনও খরস্রোতা নদীতেও ঝাঁপ দেয়নি। দূত সে কথা মানতেই চাইল না কিছুতে। এই লোককে খোঁজার জন্য সে অনেক রাজ্য ঘুরেছে। এখন আর সে একে ছাড়বে না!
রাজকুমার দৃঢ় তখন ভাবল যে, আগেকার কোনও কথাই তো তার মনে নেই। তা হলে হয়তো হতেও পারে। সে চুপ করে গেল।
বৃদ্ধ রাজা তখনই মহা সমারোহে রাজকুমার দৃঢ়কে পাঠিয়ে দিল ভোজ রাজ্যে। সেখানে একসঙ্গে দুই রাজকন্যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। নিজের পিতার রাজ্যে সে কারাবন্দী হয়ে ছিল, এখন সে হয়ে গেল অন্য একটি রাজ্যের যুবরাজ।