৭
পাহাড়ের আড়ালে সূর্য উঠেছে একটু আগে। এখনও রোদ চড়া হয়নি, রাজপুরীর সামনের চত্বরটিতে ছড়িয়ে আছে পাতলা ছায়া। এখানে অনেকগুলি গাছে পাখিরা জেগে উঠে ডাকাডাকি করে অন্যদের জাগাচ্ছে। দূরে শোনা যাচ্ছে জলপ্রপাতের শব্দ।
রাজকুমার তীক্ষ্ণ এসে দাঁড়িয়েছে একটি গাছের নীচে। সেই গাছের অনেক ডালপালা ছড়ানো। মল্লপাল এবং দলের অন্য লোকজনরা দাঁড়িয়ে আছে দূরে। নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল, বাহুক এখনও আসেনি। অনেক দর্শক অবশ্য এসে গেছে এরই মধ্যে।
হঠাৎ সানাই আর কাড়া-নাকাড়া বেজে উঠল। রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল একটি দল, তার মাঝখানে কালো ঘোড়ার পিঠে বসে আছেন বৃদ্ধ রাজা। প্রজারা রাজার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল।
একটি গাছের নীচে ঘোড়া থেকে নামলেন রাজা। তারপর তিনি হাতছানি দিয়ে তীক্ষ্ণকে কাছে ডাকলেন।
রাজকুমার তীক্ষ্ণ কাছে এগিয়ে এসে হাত জোড় করে রাজাকে প্রণাম জানাল।
রাজা মৃদু স্বরে বললেন, “জয় হোক। দীর্ঘজীবী হও, কুমার। আমি শুনলাম, তুমি আমার সেনাপতি বাহুককে কাপুরুষ বলে অপমান করেছো। কেন এমন দুঃসাহস দেখালে তুমি? বাহুক তোমার চেয়ে বয়েসে অনেক বড়, তোমার তুলনায় অনেক শক্তিমান। এই রাজ্যের হয়ে সে তিনটি যুদ্ধ জয় করেছে। তোমাকে জয় করতে তার এক মুহূর্তও লাগবে না।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “বেশ তো! আমার সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি যদি জয়ী হতে পারেন, তা হলে তাঁর গৌরব আরও বাড়বে। আপনার রাজ্যের সুনাম হবে!”
রাজা বললেন, “তোমাকে হারিয়েই তো সে থামবে না। তুমি তাকে কাপুরুষ বলেছ, তোমাকে সে হত্যাও করবে! তোমার এত কম বয়েস, তবু তুমি মরতে চাও কেন? কী তোমার দুঃখ? কেন তুমি নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে রাজ্যে ঘুরছ?”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ হেসে বলল, “আমার কোনও দুঃখ নেই। আমার খুব তাড়াতাড়ি মরে যাবারও ইচ্ছে নেই। আমি দিগ্বিজয়ী হবার জন্য রাজ্য ছেড়ে বেরিয়েছি।”
রাজা বললেন, “তোমার অভিজ্ঞতা কম, তাই তুমি বুঝতে পারছ না। তোমার যতই দক্ষতা থাকুক, বড়-বড় বীরদের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে তোমার যে-কোনও সময় মৃত্যু হতে পারে। একজনকে তুমি যুদ্ধে হারালেও তার সঙ্গী-সাথীরা তোমাকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করবে। আমি তাই এই যুদ্ধ বন্ধ করতে এসেছি। সেনাপতি বাহুক এখনি এসে পড়বে। তুমি তার সামনে ক্ষমা চাও! বয়েসে বড় একজন যোদ্ধার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। তুমি ক্ষমা চাইলেই মিটমাট হয়ে যাবে। তারপর তুমি আমাদের অতিথি হয়ে কিছুদিন থাকো।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ উদ্ধতভাবে বলল, “ক্ষমা চাওয়া তো দূরে থাক, সেনাপতি বাহুক যদি এখানে আসতে আর দেরি করেন, তা হলে আমি সবার সামনে তাঁকে আবার কাপুরুষ বলব। এই রাজ্যের সকলকেই কাপুরুষ বলব!”
রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হায় বালক! তবে তোমাকে মরতেই হবে দেখছি!”
সঙ্গে-সঙ্গে শোনা গেল অনেকগুলি ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ। একদল অশ্বারোহীর সঙ্গে এসে উপস্থিত হল সেনাপতি বাহুক। তার সঙ্গে স্বর্ণখচিত পোশাক। মাথায় কার্তিক ঠাকুরের মতন মুকুট। তার সঙ্গীদেরও বেশ বলবান যোদ্ধা বলে মনে হয়।
বাহুক ঘোড়া থেকে নেমে রাজাকে প্রণাম জানাবার পর গম্ভীরভাবে বলল, “মহারাজ, আজ একটু পরেই আমাকে পাহাড়পুরে যেতে হবে। তার আগে আপনার সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসতে হবে। এই বালকটির যুদ্ধসাধ আমি খুব তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দিচ্ছি। তারপর সব কাজ সারব।”
এর পর সে জনতার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “এই অসভ্য ছোকরাটি আমাকে অপমান করেছে, আমাদের রাজ্যের অপমান করেছে। আমি একে শাস্তি দেব। এর বয়েস কম বলে অনেকের দয়া হতে পারে। কিন্তু একে ক্ষমা করার জন্য অনুরোধ করবেন না আমাকে। এই হতভাগা প্রাণ নিয়ে এ রাজ্য ছেড়ে যেতে পারবে না।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ মৃদু-মৃদু হাসতে লাগল।
এর পর শুরু হল যুদ্ধ। রাজকুমার তীক্ষ্ণর চেহারাটা ছোটখাটো বলে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা প্রথম থেকেই তাকে অবহেলার চক্ষে দেখে। তাকে পরাজিত করা যেন অতি সহজ কাজ। কিন্তু রাজকুমার তীক্ষ্ণর হালকা শরীরটি এত দ্রুত ঘুরতে পারে যে, তাকে ধরাছোঁওয়াই যায় না। তা ছাড়া সে অনেক উঁচুতে লাফাতে পারে। হঠাৎ-হঠাৎ যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। লাফিয়ে গাছের ডাল ধরে ঝোলে।
সেইরকমই একবার গাছের ডাল থেকে রাজকুমার তীক্ষ্ণ একটা লাথি মারল বাহুকের মুখে। বাহুক সেই আঘাতে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল। রাজকুমার তীক্ষ্ণ ঝুপ করে তার সামনে এসে পড়ে বলল, “তুমি নিজেই জানিয়েছ, কেউ কারুকে ক্ষমা করবে না। উঠে দাঁড়াও! শুয়ে থাকা অবস্থায় আমি কারুকে হত্যা করি না। ওঠো!”
সেনাপতি বাহুক অতিকষ্টে উঠে দাঁড়াল। তার মাথা ঘুরছে। তবু সে খুব জোরে একটা কোপ মারতে গেল। ঝট করে সরে গিয়ে রাজকুমার তীক্ষ্ণ তার তলোয়ারের অর্ধেকটা বিধিয়ে দিল বাহুকের বক্ষে। বাহুক আর একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না, ঢলে পড়ল মৃত্যুর মুখে।
রক্তমাখা তলোয়ারটা টেনে বার করে উঁচুতে উঠিয়ে রাজকুমার তীক্ষ্ণ চেঁচিয়ে বলল, “আমার সঙ্গে লড়াই করতে আর কেউ চায়? আর কেউ আমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে রাজি আছে?”
সবাই বিস্ময়ে হতবাক্। কেউ কোনও সাড়া দিল না।
তারপর হঠাৎ বাহুকের অশ্বারোহী দল হুঙ্কার দিয়ে উঠল এক সঙ্গে। অস্ত্র তুলে প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন যোদ্ধা আসতে লাগল রাজকুমার তীক্ষ্ণর দিকে। দ্বন্দ্বযুদ্ধের এরকম নিয়ম নয়। একসঙ্গে এতজন মিলে একজন মাত্র যোদ্ধাকে আক্রমণ করে না। রাজকুমার তীক্ষ্ণ একবার তাকাল বৃদ্ধ রাজার দিকে। রাজা কটমট করে তাকিয়ে আছেন। তিনিও আগে থেকেই জানতেন, বাহুক পরাজিত হলে তার দেহরক্ষীরা সবাই একসঙ্গে আক্রমণ করে এই স্পর্ধিত কুমারকে হত্যা করবে।
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গিয়ে রাজার কালো ঘোড়াটার পিঠে চড়ে বসল। আর কোনও দিকে পালাবার পথ নেই, তাই সে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল রাজবাড়ির দিকেই। সেদিক থেকেও তেড়ে আসছে একদল যোদ্ধা। অন্য কোনও উপায় না দেখে রাজকুমার তীক্ষ্ণ সেই ঘোড়াসুদ্ধু ঝাঁপিয়ে পড়ল জলপ্রপাতের মতন অতি খরস্রোতা নদীতে।
তারপর তাকে দেখা গেল না। হায়-হায় করে উঠল জনতা।
সেই দুরন্ত স্রোতের টানে অনেকখানি ভেসে গেল রাজকুমার তীক্ষ্ণ, তবু তার মৃত্যু হল না। এক সময় সে উঠে পড়ল নদীর অন্য পাড়ে। পাশেই একটি নিবিড় বন। সেই বনের মধ্যে শুয়ে পড়ল সে। জেগে ওঠার পর সে কালো ঘোড়াটিকে আর দেখতে পেল না।
পরদিন বন থেকে বেরিয়ে কিছু দূর যাবার পর সে একটি নগরের সন্ধান পেল। লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝল, এটা ভোজ রাজ্য নয়। এ এক অন্য রাজ্য, এর নাম গালবদেশ। এর রাজধানীর নাম যুধাখেরি।
রাজকুমার তীক্ষ্ণ রাজধানীর উদ্দেশে রওনা দিল। ভোজ রাজ্যের পর তার এখানেই আসার কথা ছিল। ভোজ রাজ্যের অশ্বারোহীরা তাকে এখানে তাড়া করে আসতে পারবে না।
রাজকুমার তীক্ষ্ণর সঙ্গে টাকা-পয়সা কিছু নেই। খিদে পেলেও খেতে পারবে না কিছু। কোনও লোকের বাড়িতে আশ্রয় চাইলেই পেতে পারে। সেইরকমই প্রথা। ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে অন্ন-পানীয় দিয়ে সবাই পুণ্য অর্জন করতে চায়। সেইজন্যই এইসব রাজ্যে কোনও লোক উপবাসী থাকে না। কিন্তু রাজার কুমার তীক্ষ্ণ কারও কাছে হাত পাততে জানে না।
সে রাজধানীতে এসে এক ধর্মশালার বারান্দায় শুয়ে রইল। তলোয়ারটা লুকিয়ে রাখল কাপড়ে মুড়ে। দু’ দিন তার কোনও খাদ্য জোটেনি, শুধু জল খেয়ে পেট ভরাতে হয়।
আরও একজন ভিখিরির মতন চেহারার লোক ওই ধর্মশালার বারান্দায় থাকে। সে রাজকুমার তীক্ষ্ণর সঙ্গে ভাব জমাতে আসে, তার পরিচয় জানতে চায়। কিন্তু রাজকুমার তীক্ষ্ণ এমনিতেই কম কথা বলে, অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতেই চায় না।
রাজকুমারের হাতে একটা আংটি আছে। সেই লোকটি ওই আংটিটির দিকে লোভীর মতন তাকায়। দ্বিতীয় রাতে ঘুমন্ত রাজকুমারের হাত থেকে সে ওই আংটিটা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল!
রাজকুমার জেগে উঠতেই সে কাঁচুমাচু হয়ে নিজেই বলে উঠল, “চুরি করতে চাইনি, চুরি করতে চাইনি, আমি শুধু ওটা একবার দেখতে চেয়েছি। তুমি ওটা বিক্রি করবে?”
আংটি যে বিক্রি করা যাবে, সেটাই জানত না রাজকুমার তীক্ষ্ণ। আংটিটার যে কত মূল্য, তাও সে জানে না। তিনরকম দুর্লভ পাথর বসানো অতি মূল্যবান সেই অঙ্গুরীয় সে বিক্রি করে দিল মাত্র দশটি মুদ্রার বিনিময়ে। পরদিন সেই টাকা দিয়ে সে খাদ্য ফলমূল কিনল।
আরও দু’ দিন পরে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মল্লপালের। অনেক পথ ঘুরে ঘুরে সে তার দলবল নিয়ে উপস্থিত হয়েছে যুধাখেরিতে।
বাহুকের দলবল রাজকুমার তীক্ষ্ণকে তাড়া করতেই মল্লপালরাও ভয়ে পালিয়েছিল। রাজধানীর বাইরে এক জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল দু’ দিন। তারপর রাতের বেলায় হেঁটে-হেঁটে তারা সেই রাজ্য ছেড়ে আসে। পথে তারা শুনেছে, ভোজরাজা নাকি ঘোষণা করেছেন যে, রাজকুমার তীক্ষ্ণ ফিরে এলে তার সঙ্গেই তিনি দুই রাজকন্যার বিয়ে দেবেন। রাজকুমার তীক্ষ্ণ তার কালো ঘোড়ায় চেপেছে, দারুণ তরঙ্গমুখর নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। এর পরেও যদি সে বেঁচে থাকে তবে রাজকন্যারা তার গলাতেই বরমাল্য দেবে।
লুকা বলল, “রাজকুমার, চলুন, আমরা ভোজরাজ্যে ফিরে যাই। সেনাপতি মারা গেছে। রাজাও খুব বৃদ্ধ। রাজকন্যাদের বিয়ে করলে আপনিও সে রাজ্যের রাজা হবেন। আমরাও মহাসুখে থাকব!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “চুপ! ওই রাজকন্যারা যাকে ইচ্ছে বিয়ে করুক। আমি ওদের রাজ্যও চাই না। তোমরা শিবির স্থাপন কর। তারপর খোঁজ নাও এই রাজ্যের শ্রেষ্ঠ বীর কে? আমি তার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করব .
মল্লপাল হতাশভাবে বলল, “আবার যুদ্ধ? আবার আমাদের কী বিপদ হবে কে জানে?”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “আমি উত্তর ভারতের অন্তত তিরিশটি রাজ্য ঘুরতে চাই!”
গালবদেশের রাজা অসুস্থ। তাঁর রানি পল্লবী দেবীই রাজ্য চালান। সেনাপতি অতি বৃদ্ধ, এখন তিনি একটা বর্শাও তুলতে পারেন না, তবু তাঁকে সেনাপতি পদ থেকে ছাড়ানো হয়নি। তবে শহরের দুই কোটালই সৈন্যবাহিনীকে চালায়। কোটাল দু’জনের নাম দ্রব আর প্লব। সাধারণত সব রাজধানীতে একজন করেই কোটাল থাকে, এই রাজধানীতে দু’জন কোটাল। তার কারণ, দ্রব আর প্লব যমজ। তারা দেখতে হুবহু একরকম তো বটেই, তাদের চিন্তারও অদ্ভুত মিল। দ্রব যদি পুকুরঘাটে আছাড় খায়, তা হলে প্লব বিছানায় শুয়েও ব্যথায় উহু-হু করে ওঠে। দ্রব আর প্লব যতদূরেই থাকুক, একজনের খিদে পেলে অন্যজনও খিদেয় কাতরাবে। কিংবা প্লব যদি শুধু ডাবের জল খেয়ে পেট বোঝাই করে ফেলে, তখন দ্রব তার সামনে মণ্ডা-মেঠাই দেখলেও খাবে না।
কে যে দ্রব আর কে যে প্লবতা প্রজারা চিনতেই পারে না। সবসময় ভুল করে। সেইজন্য পল্লবী দেবী ওদের দু’জনকেই কোটালের পদ দিয়েছেন।
দ্রব আর প্লব’র তলোয়ার খেলার খুব সুনাম। তারা গর্ব করে বলে যে একালে তাদের সমকক্ষ যোদ্ধা আর কেউ নেই। তাই তারা দু’জনেই মাঝে-মাঝে দ্বন্দ্বযুদ্ধে মাতে। দু’জনেই সমান, কেউ জেতে না, কেউ হারে না।
লুকার মুখে সব খবর শুনে রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “যাও, ওদের দু’জনকেই আহ্বান জানাও। আমি একসঙ্গে ওদের দু’জনের সঙ্গেই লড়াই করব।”
লড়াইয়ের মাঠে হল এক অদ্ভুত কাণ্ড।
দ্রব আর প্লব দু’জনেই কালো কুচকুচে পোশাক পরে। দু’জনেই বেশ রোগা আর লম্বা। দু’জনেরই ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।
দু’ ভাই পাশাপাশি দাঁড়াল। ভাল করে দেখল রাজকুমার তীক্ষ্ণকে। তারপর দ্রব অস্ত্র হাতে না নিয়ে সোজা হেঁটে এসে এক থাপ্পড় কষাল রাজকুমার তীক্ষ্ণর গালে। দ্রব’র হাতে এত জোর যে সেই থাপ্পড় খেয়ে রাজকুমার তীক্ষ্ণ উলটে পড়ে গেল।
দু’ ভাই একসঙ্গে হেসে উঠে বলল, “এই গায়ের জোর নিয়ে তুই লড়াই করবি? যা, বাড়ি যা!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণর ঠোঁটের পাশ দিয়ে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত গড়াচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে রক্ত মুছে সে দ্রবকে বলল, “তুমি আমাকে অন্যায়ভাবে আঘাত করেছ। আমার অস্ত্রের কোপে তোমারই প্রথম প্রাণ যাবে।”
তারপর সে তলোয়ার হাতে নিতেই দু’ ভাই দু’ দিক থেকে ধেয়ে এল তাকে আঘাত করতে। রাজকুমার তীক্ষ্ণ লাফিয়ে উঠে গেল তাদের মাথার ওপর। একসঙ্গে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর তলোয়ারকেই সে কী করে যে আটকাতে লাগল, তা বোঝাই গেল না।
দ্রব আর প্লব সত্যিই ভাল লড়াই জানে। তবু এই লড়াই চলল না বেশিক্ষণ। রাজকুমার তীক্ষ্ণ প্রথমে দ্রব’র ডান হাত কেটে ফেলল, তারপর তার বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে ধরাশায়ী করল। সঙ্গে-সঙ্গে প্লবও ধড়াম করে শুয়ে পড়ল মাটিতে। তার হাত থেকে খসে গেল তলোয়ার। সে আর কোনও শব্দ করল না।
রাজকুমার তীক্ষ্ণ নিরস্ত্রকে আঘাত করে না। প্লব’র কাছে গিয়ে বলল, “খুব যে হেসেছিলে? এর মধ্যেই লড়াইয়ের সাধ মিটে গেল? উঠে দাঁড়াও!” প্লব কোনও উত্তর দিল না। উত্তর দিতে পারবেই না। দ্রব’র মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই তারও প্রাণ বেরিয়ে গেছে।
এইভাবে রাজকুমার তীক্ষ্ণ একের পর এক রাজ্য ঘুরে-ঘুরে নামকরা বীরদের দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাজিত করতে লাগল। বৈভব রাজ্য, ধরাশূর, উনকোটি, শ্রীপুর, মন্দারগড় রাজ্যে কোনও যোদ্ধাই রাজকুমার তীক্ষ্ণর সামনে আসতে সাহস করল না। চতুর্দিকে রটে গেছে যে এই রাজকুমার যেমন কৌশলী যোদ্ধা তেমনই নিষ্ঠুর। কোনও শত্রুকেই সে দয়া করে না। এই রাজকুমার যেন জাদুকর। লড়াইয়ের মধ্যে যখন-তখন অদৃশ্য হয়ে যায়, হঠাৎ-হঠাৎ শূন্যে লাফিয়ে ওঠে, গাছের ডাল ধরে ঝোলে। লোকের মুখে-মুখে রাজকুমার তীক্ষ্ণর আর-একটা নাম হয়ে গেল উড়ন্ত রাজকুমার।
সদলবলে রাজকুমার তীক্ষ্ণ এক সময় এসে পৌঁছল কাঞ্চী রাজ্যে। অহিচ্ছত্রপুর ছেড়ে আসার পর প্রায় দেড় বছর কেটে গেছে। কাঞ্চীতে এসেই তার জীবন আবার এক অন্যদিকে মোড় নিল।