৬
মল্লপাল আর তার সাথীরা রাজকুমার তীক্ষ্ণর নিস্পন্দ শরীরটাকে দ্রুত বয়ে নিয়ে চলে এল নিজেদের শিবিরে। বেশ কিছুক্ষণ সেই শরীরটাকে ঘিরে ঝিম মেরে বসে রইল তারা। মল্লপাল শোকে আর আশঙ্কায় কাঁদতে লাগল কপাল চাপড়ে। এমন অকস্মাৎ যে এরকম একটা সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটে যাবে, তারা ভাবতেই পারেনি।
এখন কী করা যাবে? কুমারের দেহটা ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত অহিচ্ছত্রপুরে, নাকি এখানেই পুড়িয়ে ফেলা হবে? ছম্ভী এই সংবাদ শুনে রাগে-দুঃখে কী যে করবেন তার ঠিক নেই। হয়তো এই দলের সকলকেই মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বসবেন।
রাজকুমার তীক্ষ্ণর ঘাড়ের কাছে একটা বিরাট কোপ পড়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। রক্তের ছিটে এমনভাবে লেগেছে যে, তার মুখখানাও চেনা যাচ্ছে না।
একসময় দলের একজন বলল, “আমার মনে হয়, আমাদের কুমারের এমন বীভৎস, ছিন্নভিন্ন শরীর আর রাজধানীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। প্রজারা কষ্ট পাবে। তার চেয়ে বরং কুমারকে এখানেই পুড়িয়ে ফেলা যাক। আমরাও রাজধানীতে না ফিরে দূরের কোনও গ্রামে পালিয়ে যাব।”
কয়েকজন এই প্রস্তাব শুনে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই করা যাক। তাই করা যাক।”
আর কয়েকজন বলল, “বিদেশের মাটিতে কুমারকে রেখে যাব, তা কি ঠিক হবে ভাই? স্বদেশে জাঁকজমকের সঙ্গে তাঁকে দাহ করা উচিত না!”
খানিকক্ষণ তর্ক-বিতর্ক চলল নিজেদের মধ্যে।
মল্লপাল বলল, “আমি আর দেশেই ফিরব না। আমি যেখানেই লুকোতে চাই, ছম্ভী আমাকে ঠিক খুঁজে বার করবেন। আমাকে চলে যেতে হবে অনেক দূরে।”
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, রাজকুমারের মৃতদেহ নিয়ে কেউই আর দেশে ফিরে যেতে চায় না।
মল্লপাল ভগ্নহৃদয়ে বলল, “তা হলে চলো সবাই শ্মশানে যাই। একজন চণ্ডালকে ধরে চুপিচুপি কাজ সারতে হবে।”
লুকা বলল, “একজন পুরোহিতকেও তো ডেকে আনা দরকার।”
মল্লপাল বলল, “লুকা, তুমিই যাও, একজন পুরোহিতের সন্ধান করে নিয়ে এসো।”
সন্ধে হয়ে এসেছে প্রায়। সূর্যদেব যাচ্ছেন অস্তাচলে। পাখিরা কলকাকলি করতে করতে বাসায় ফিরছে। ঘণ্টা বাজছে সব মন্দিরে। এক-এক করে জ্বলে উঠছে তেলের প্রদীপ। নদীর ঘাট থেকে জল আনতে আনতে গান গাইছে মেয়েরা।
চৌরাস্তার মোড়ে জ্বলজ্বল করছে সোনার কলসটি। সেটাতে হাত দেওয়ার মতন দুঃসাহস কোনও চোরেরও নেই।
মল্লপাল এবং অন্যরা রাজকুমার তীক্ষ্ণর দেহটি নিয়ে এল শ্মশানঘাটে। একজন বিশাল চেহারার চণ্ডাল স্নান করছে নদীতে নেমে। মল্লপালের লোকজনেরা তাকে ডাকাডাকি করতেই সে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, “দাঁড়ান না, এত তাড়াহুড়ো কিসের? দেখছেন না চান করছি? মরা মানুষ এখন পুড়ল, না একটু পরে পুড়ল, তাতে কী আসে যায় “
সবাই চুপ করে রইল।
চণ্ডাল ধীরে-সুস্থে স্নান সেরে উঠে এল নদী থেকে। ভিজে কাপড় গায় দিয়েই সে গুনগুন করতে করতে এদিকে এসে উঁকি মেরে বলল, “দেখি, এ-নগরে আজ আবার কে মরল?”
রাজকুমার তীক্ষ্ণর দিকে এক পলক তাকিয়েই তার ভুরু কুঁচকে গেল। সে আবার ধমকের সুরে বলল, “এ কী? কাকে এনেছেন? আমি মড়া পোড়াই, জ্যান্ত মানুষ পোড়াই না!”
মল্লপালেরা বুঝতে না পেরে বলল, “জ্যান্ত মানুষ পোড়াতে কে বলেছে? মৃতদেহই তো এনেছি!”
চণ্ডাল বলল, “আমি সারা জীবন ধরে হাজার-হাজার মড়া পোড়াচ্ছি। আমি মড়া আর জ্যান্ত চিনি না? আহা রে, এমন ফুটফুটে সুন্দর ছেলেটা, তাকে তোমরা এমনভাবে মারছ?”
মল্লপাল দারুণ চমকে গিয়ে বলল, “বেঁচে আছে? তুমি বলো কী? বহুক্ষণ ধরে এর শরীরে কোনও স্পন্দন নেই!”
চণ্ডাল বলল, “নড়া-চড়া করছে না বলেই কি খাঁচা ছেড়ে পাখি উড়ে গেছে? ছি ছি ছি ছি!”
চণ্ডাল দৌড়ে চলে গিয়ে নদী থেকে আঁজলা করে জল নিয়ে এল। সেই জল ছিটিয়ে দিল রাজকুমারের চোখে-মুখে। এইরকম ভাবে কয়েকবার সে জল নিয়ে এল, কুমারের মুখ থেকে ধুইয়ে দিল সব রক্ত।
এই সময় লুকা ডেকে আনল একজন বৃদ্ধ পুরোহিতকে।
সব শুনে সেই বৃদ্ধ বললেন, “অন্ধকার হয়ে এসেছে, কেউ একটা মশাল জ্বালো তো, দেখি ভাল করে!”
পুরোহিতমশাই কবিরাজি ওষুধও দেন। তিনি কুমারকে ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে বললেন, “নাড়ি অতি দুর্বল। কিন্তু শরীরে প্রাণ আছে। বহুক্ষণ ধরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তোমরা আগে আমাকে ডাকতে পারোনি?”
একটু পরে রাজকুমার তীক্ষ্ণ একবার উঃ শব্দ করে উঠল।
সেই শ্মশানেই একটা চালাঘরে চিকিৎসা চলল রাজকুমারের। পুরোহিতটি বারবার বলতে লাগলেন, “সকালে ওদের যুদ্ধটা আমি দেখেছি। ভারী অন্যায়। ভারী অন্যায়! এই বালকটি জয়রামকে অস্ত্র লড়াইতে হারিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাকে প্রাণে মারেনি। কিন্তু সেই পাষণ্ডটা এমনই অকৃতজ্ঞ যে, নিরস্ত্র অবস্থায় কুমারকে আঘাত হানল? ভারী অন্যায়! ভারী অন্যায়!”
সেই চণ্ডাল ও পুরোহিতের সুবিবেচনায় তিন-চারদিনের মধ্যে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল রাজকুমার তীক্ষ্ণ। এখনও সে হাঁটতে পারে না বটে কিন্তু কথা বলতে পারে।
মল্লপাল বলল, “ভগবানের দয়ায় কুমারকে আমরা ফিরে পেয়েছি। এবার তা হলে আমাদের রাজ্যে ফিরে যাওয়াই ভাল। জয়রাম যদি শুনে ফেলে যে, কুমার বেঁচে উঠেছেন, তা হলে আবার সে কী করবে কে জানে!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকব।”
মল্লপালেরা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেও জেদ ধরে রইল রাজকুমার। তখন তাদের শিবিরটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল জঙ্গলের মধ্যে। কেউ আর নগরের দিকে যায়ই না। আস্তে-আস্তে একদিন উঠে দাঁড়াল রাজকুমার তীক্ষ্ণ, জঙ্গলের মধ্যে এক পা এক পা করে হাঁটতে লাগল।
এক মাস পরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে রাজকুমার তীক্ষ্ণ লুকাকে বলল, “তুমি নগরে যাও। ধৃষ্ট জয়রামকে গিয়ে বলো, অহিচ্ছত্রপুরের যুবরাজ তার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে চায়।”
মল্লপাল ও অন্যদের ভয় এবং আপত্তি গ্রাহ্যই করল না রাজকুমার তীক্ষ্ণ। সে জোর করেই পাঠিয়ে দিল লুকাকে।
পরদিন সকালে আবার ডঙ্কা বাজিয়ে ঘোষণা করা হল লড়াইয়ের। চৌরাস্তায় আবার জমায়েত হল বহু মানুষ। এল সেই চণ্ডাল এবং পুরোহিতও।
জয়রাম প্রথমে চিনতে পারল না রাজকুমার তীক্ষ্ণকে। প্রথমে হাসল এক চোট। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, “কী ব্যাপার হল! ভারতে কি আর বীর নেই? আমার সঙ্গে লড়াই করতে সবাই ভয় পায়। শুধু বাচ্চা-বাচ্চা কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলেরা সোনার কলসিটার লোভে আমার হাতে মরতে আসে। মরার যদি অত ইচ্ছে হয়, তবে মর!”
সে তলোয়ারের এক কোপ বসাতে যেতেই রাজকুমার তীক্ষ্ণ সরে গেল দ্রুত। তারপর এক লাফে সে উঠে বসল পাশের একটা গাছের ডালে। প্রায় পর মুহূর্তেই সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়রামের ঘাড়ে।
জয়রাম কোনওক্রমে রাজকুমার তীক্ষ্ণকে ঝেড়ে ফেলল গা থেকে। কিন্তু ওইরকম লাফ দিতে দেখেই সে কৌশলটা বুঝতে পেরেছে, তার মনে পড়েছে রাজকুমার তীক্ষ্ণর কথা।
সে বিকট চিৎকার করে বলে উঠল, “সেই ছেলেটা আবার ফিরে এল কী করে? তাকে আমি মেরে ফেলেছিলাম! ভূত! ভূত হয়ে আমাকে মারতে এসেছে!”
দারুণ ভয় পেয়ে জয়রাম পেছন ফিরে একটা দৌড় মারল।
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বিদ্যুৎ-গতিতে তার সামনে গিয়ে বলল, “পামর, পালাচ্ছিস কোথায়? এই তোর বীরত্ব?”
জয়রাম এবার হাউহাউ করে কেঁদে, হাত জোড় করে বলল, “দয়া করো, আমায় দয়া করো! আমায় ক্ষমা করো, কুমার! আমি হেরে গেছি!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ এবার আর ভুল করল না। দয়াও দেখাল না। এক কোপে সে জয়রামের ঘাড় থেকে মুণ্ডটা নামিয়ে দিল।
তারপর রাজকুমার সোনার কলসটায় এক লাথি মেরে বলল, “এটা যার ইচ্ছে নিক। আমার চাই না!”
পরদিনই শিবির গুটিয়ে দলবল নিয়ে রাজকুমার তীক্ষ্ণ চলে এল অন্য একটি দেশে।
এদেশের নাম ভোজ রাজ্য। এ রাজ্যের রাজার কোনও পুত্রসন্তান নেই, দুটি কন্যা। সেনাপতির নাম বাহুক। রাজকন্যা দুটির এখনও বিয়ে হয়নি। রাজা একটি অদ্ভূত ঘোষণা করেছেন। তাঁর নিজের কালো রঙের ঘোড়ায় চেপে যদি কেউ রাজবাড়ির পিছনের নদীটা পার হতে পারে, তবে তার সঙ্গেই বড় রাজকন্যার বিয়ে হবে।
রাজার সেই কালো ঘোড়া একমাত্র রাজা ছাড়া অন্য কোনও যাত্রীকে পিঠে নিতে চায় না, ফেলে দেয়। রাজবাড়ির পেছন দিকে যে নদী, তাতে এমন সাঙ্ঘাতিক স্রোত যে, কেউ তাতে নামতেই সাহস পায় না, ঘোড়াসুদ্ধু সে নদী পার হওয়া তো অসম্ভব ব্যাপার। নদীটি আসলে একটা জলপ্রপাত, কিছুটা আগেই সে পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে সমতলে পড়েছে। এ-পর্যন্ত কেউ এই পরীক্ষা দিতে এগিয়ে আসেনি। অনেকে বলে, ভোজরাজ তাঁর মেয়েদের বিয়ে দিতে চান না বলেই এমন কঠিন শর্ত রেখেছেন।
রাজকুমার তীক্ষ্ণর শিবির পাতা হল নগরের সীমানার বাইরে। তারপর রাজকুমার দূত পাঠাল ভোজরাজার কাছে। সৈন্যবাহিনী নিয়ে নয়, রাজকুমার একা বেরিয়েছে দিক্বিজয়ে। এই রাজ্যের সবচেয়ে বড় বীরের সঙ্গে সে শক্তি পরীক্ষা করতে চায়। সে রাজ্য জয় করতে চায় না, শ্রেষ্ঠ বীরের সম্মান পেলেই সে অন্য রাজ্যে চলে যাবে।
বৃদ্ধ ভোজরাজ অহিচ্ছত্রপুরের রাজাকে চিনতেন। তাঁর ছেলে এ-রাজ্যে এসেছে শুনে তিনি বললেন, “সে কী, আমার বন্ধুপুত্র প্রান্তরের মধ্যে সামান্য শিবিরে থাকবে কেন? যাও, যাও, তাকে রাজপ্রাসাদে ডেকে আনো। তাকে আমাদের অতিথি করে রাখব।”
ভোজরাজ তাঁর সেনাপতি বাহুককে পাঠালেন রাজকুমার তীক্ষ্ণকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসার জন্য।
রাজকুমার সেনাপতিকে সম্মান জানিয়ে নিজের শিবিরে বসাল। তারপর বলল, “মহারাজকে আমার প্রণাম জানাবেন। কিন্তু আমি এ-রাজ্যের অতিথি হতে আসিনি। যুদ্ধ করতে এসেছি। রাজপ্রাসাদে নয়, আমি এই শিবিরেই থাকব। আমার সঙ্গে কে লড়াই করবে আপনি ঠিক করুন।”
সেনাপতি বাহুক অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, “তুমি এসে গায়ে পড়ে লড়াই করতে চাইলেই বা অন্য কেউ রাজি হবে কেন? তুমি যদি রাজার অতিথি হতে না চাও, তা হলে এ-রাজ্য ছেড়ে চলে যাও!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “আপনি এ-রাজ্যের সেনাপতি। আপনাকে নিশ্চয়ই সকলে বড় বীর বলে মনে করে। আমি আপনার সঙ্গেই শক্তি পরীক্ষা করতে চাই।”
সেনাপতি বাহুক এবার ক্রদ্ধ হয়ে বলল, “বালক, তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। তুমি আমার ভৃত্যের সঙ্গেও লড়াই করার যোগ্য নও। যাও, দূর হয়ে যাও!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ সামান্য হেসে বলল, “আপনি যদি আমার সঙ্গে লড়তে রাজি না হন, তা হলে বুঝতে হবে যে, আপনি একজন কাপুরুষ। এ-রাজ্যের সেনাপতি এক কাপুরুষ!”
ক্ষত্রিয়দের মধ্যে প্রথা এই যে, কেউ কাউকে কাপুরুষ বললেই দু’জনকে প্রাণপণ করে যুদ্ধ করতে হয়।
ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বাহুক তার কোষ থেকে তরবারি মুক্ত করে বলল, “ওরে দুর্বুদ্ধি, তুই আমাকে এমন কথা বলতে সাহস করলি? আমি এখনই তোর যুদ্ধ-সাধ মিটিয়ে দিচ্ছি!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ একটুও ভয় পেল না। তার ঠোঁট থেকে হাসিটুকুও মুছল না। সে শান্ত গলায় বলল, “এখানে নয়, এখানে নয়। লড়াই হবে কাল সকালে, প্রকাশ্য কোনও জায়গায়। বহু লোকের চোখের সামনে আমি আপনাকে পরাজিত করতে চাই।”
বাহুক বলল, “তবে তাই হোক। এ রাজ্যের প্রজাদের সামনেই আমি তোর স্পর্ধার শাস্তি দেব। তোর ছিন্ন মুণ্ড কাল ধুলোয় গড়াবে!”
সেই দিনই সমস্ত রাজধানীতে রাজকুমার তীক্ষ্ণ এবং সেনাপতি বাহুকের দ্বন্দ্বযুদ্ধের কথা ঘোষণা করে দেওয়া হল।