৫
আগে-আগে সাদা ঘোড়ার পিঠে চলল কুমার তীক্ষ্ণ, তার পেছনে ছোট্ট একটি দল। সেই দলে রয়েছেন কয়েকজন শিবির বাহক, দাস-দাসী, রান্নার ঠাকুর এবং কারারক্ষী মল্লপাল। ছম্ভী এই মল্লপালকে বলে দিয়েছেন যে, কুমার তীক্ষ্ণ কোনও রাজ্যে গিয়েই রাজাদের আতিথ্য গ্রহণ করবে না। মাঠের মধ্যে শিবির খাটিয়ে থাকবে, নিজের লোকেরা রান্না করে দেবে। এবং মল্লপাল যেন কোনও সময়েই কুমারকে চোখের আড়াল না করে।
মাঠের মধ্যে ধুলো উড়িয়ে চলল ক্ষুদ্র দলটি। আকাশে ঝকঝক করছে শীতকালের রোদ। ফসল কাটা হয়ে গেছে, দু’দিকের প্রান্তর একেবারে ফাঁকা। সামনের দিকে দেখা যাচ্ছে বনের রেখা, তার মাঝখান দিয়ে মাথা তুলেছে একটা পাহাড়। সেই পাহাড়ের ওপাশে ছত্রপুর রাজ্য।
রাজকুমার তীক্ষ্ণ স্বভাব-গম্ভীর। সহজে তার মুখে হাসি ফোটে না। পারতপক্ষে কারও সঙ্গে কথা বলে না। তার ঘোড়া অন্যদের চেয়ে অনেক আগে-আগে ছোটে। তার অঙ্গে গোলাপি রঙের মখমলের পোশাক, তার মাথায় সাদা পালক বসানো পাগড়ি। তার চক্ষু দুটি পদ্মরাগ মণির মতন, তার ভুরু দুটি : উড়ন্ত পাখির ডানার মতন।
আজ রাজকুমার তীক্ষ্ণর মুখমণ্ডল চাপা আনন্দে উজ্জ্বল। তার জীবনে এই প্রথম সে স্বাধীনভাবে পথে বেরিয়েছে। রাজপ্রাসাদ ও উদ্যানের মধ্যেই তাকে কাটাতে হয়েছে বছরের পর বছর। ছম্ভী তাকে বন্দী করে রাখেননি, কিন্তু সব সময় চোখে-চোখে রেখেছেন। তিন-চারজন শিক্ষক ও গুরু ছাড়া আর কারও সঙ্গে তাকে মিলতেই দেওয়া হয়নি। রাজকুমার তীক্ষ্ণ শাস্ত্র পড়েছে, অস্ত্রশিক্ষা করেছে কিন্তু আর কোনও বিষয়ে সে কিছুই জানে না।
ক্রমে এই দলটি প্রান্তর পেরিয়ে অরণ্যে প্রবেশ করল।
এখানে গাছপালাগুলি এমন বিশাল ও পত্রবহুল যে, দিনের আলোতেও ছায়া-ছায়া হয়ে আছে। মাঝে-মাঝে শুকনো পাতায় কোনও জন্তু-জানোয়ার ছুটে যাওয়ার খসখস শব্দ হয়। এক সময় দূরে একটা কোনও প্রাণীর করুণ ডাক শুনে কুমার তীক্ষ্ণ ছুটে গেল সেই শব্দ অনুসরণ করে। একটা জলাশয়ের ধারে এসে সে দেখল একটা অদ্ভুত দৃশ্য। এক বিশাল অজগর সাপ গিলে ফেলতে চাইছে একটা হরিণকে। হরিণের শরীরের অর্ধেকটা ঢুকে গেছে সেই অজগরের মুখে, কিন্তু হরিণটার বড়-বড় শিং সেই অজগরটা গিলতে পারবে না। হরিণটা তখনও মরেনি। সে আর্তনাদ করে চলেছে।
মল্লপাল বিড়বিড় করে বলল, “দেখুন, কুমার। যে যতটা গিলতে পারে না, তার চেয়েও বেশি গ্রাস করতে চায়। একেই বলে লোভ।”
কুমার তীক্ষ্ণ সেই বিশাল অজগরকে মারবার জন্য ধনুকে তীর জুড়ল।
তখন তার সঙ্গের লোকজনেরা চিৎকার করে বলে উঠল, “মারবেন না, কুমার মারবেন না। অজগর সাপ মারা যায় না।”
কুমার তীক্ষ্ণ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন, অজগর মারা যাবে না কেন?”
একজন বলল, “অজগরের চামড়ায় তীর বেঁধে না। এই সাপ কত বড় হয় তার ঠিক নেই। ওর মুখ দেখা যাচ্ছে কিন্তু লেজটা পুরো দেখা যাচ্ছে না। ওকে বিরক্ত করলে সারা বন তোলপাড় করে দেবে। লেজের ঝাপটে আমাদেরও শেষ করে দেবে।”
কুমার তীক্ষ্ণ বলল, “তা হলে তোমরা সবাই দূরে সরে যাও। ওই অতি লোভী সাপটাকে হত্যা না করে আমি এখান থেকে যাব না।”
মল্লপালও নিরস্ত করার চেষ্টা করল কুমারকে। কিন্তু কুমার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সে তীর-ধনুক তুলে রইল, অন্যরা ভয়ে সরে গেল অনেকখানি দূরে। শুধু জয়পাল বাধ্য হয়ে রয়ে গেল। ছম্ভী আদেশ করেছেন, তাকে সব সময় কুমারের কাছাকাছি থাকতে হবে।
কুমার তীক্ষ্ণ একসঙ্গে দশটি বাণ মারল সেই অজগরের মাথার কাছে। কয়েকটি বাণ সত্যিই পিছলে পড়ে গেল, কয়েকটি বাণ বিধল। অজগরটার পেটের কাছটা ফুলে উঠল হঠাৎ। কুমার আরও দশটি বাণ মারতেই অজগর তার মুখ থেকে ফেলে দিল হরিণটা। তারপর সে মাথা ফেরাল এদিকে, তার চোখ দুটি আগুনের ভাটার মতন জ্বলছে।
তারপর মনে হল যেন জঙ্গলের মধ্যে ঝড় উঠেছে। সামনের দিকে অজগরের মুখ, আর পেছনের দিক থেকে অজগরের লেজটা লকলক করে ধেয়ে আসছে অনেক গাছপালা ভেঙে। সেই লেজের অংশটাকেই মনে হয় সাতখানা সাপের মতন। অজগরের নিশ্বাসের ঝাপটায় দাঁড়িয়ে থাকাই শক্ত।
মল্লপাল আর্ত চিৎকার করে বলল, “কুমার, জলে ঝাঁপ দিন, নইলে বাঁচতে পারবেন না।”
কিন্তু রাজকুমার তীক্ষ্ণ ততক্ষণে তীর-ধনুক ছেড়ে তলোয়ার হাতে নিয়েছে।
একগলা জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে মল্লপাল সবিস্ময়ে দেখল, কুমার তীক্ষ্ণ তলোয়ার নিয়ে শূন্যে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে, মুহূর্তে এক দিক থেকে অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে, যেন সে-ও একসঙ্গে সাতজন মানুষ।
তারপর সেই অজগরের টুকরো-টুকরো শরীর ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে।
সেই অজগরকে সম্পূর্ণ বিনাশ করার পর একটা গাছের ডাল ধরে নেমে এল কুমার তীক্ষ্ণ। তারপর সে সরোবরে নেমে চোখে-মুখে জলের ছিটে দিল ভাল করে।
মল্লপাল আগে কখনও কুমার তীক্ষ্ণকে লড়াই করতে দেখেনি। এবার সে হাত জোড় করে বলল, “ধন্য আপনি, কুমার। আপনার মতন এমন অল্প বয়েসীর এমন বিক্রম যে সম্ভব, তা চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস করা যায় না।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ লাজুকভাবে বলল, “আমি কখনও কোনও জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে লড়াই করিনি। অজগরটা ওই হরিণটিকে জ্যান্ত গিলছিল দেখে আমার রাগ হল।”
মল্লপাল বলল, “এবার বুঝলাম, ছম্ভী আপনার সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করেন কেন? আপনি দিগ্বিজয়ী হবেন অবশ্যই।”
এর পর বন পেরিয়ে, পাহাড়ের গা দিয়ে এই দলটি এল ছত্রপুর রাজ্যের প্রান্তে। সেখানেই রাত্তিরের মতন শিবির ফেলা হল। লুকা নামে একজন অনুচরকে পাঠানো হল ওই রাজ্যের খবর আনার জন্য।
সে রাত্রি নির্বিঘ্নে কেটে গেল।
পরদিন দুপুরে লুকা অনেক খবর নিয়ে এল।
এ রাজ্যের রাজা বেশ বৃদ্ধ এবং দুর্বল। দু’জন রাজকুমারও খুব বিলাসী, যুদ্ধবিদ্যা বিশেষ জানে না। রাজ্যটি প্রকৃতপক্ষে শাসন করে রাজার শ্যালক জয়রাম। সে যেমন শক্তিশালী, তেমন অহঙ্কারী। রাজধানীর চৌরাস্তায় সে একটি সোনার কলস রেখে দিয়েছে। আর ঘোষণা করেছে যে দেশ-বিদেশের কোনও যোদ্ধা যদি তাকে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় হারাতে পারে, তা হলে ওই সোনার কলসটি তাকে দেওয়া হবে।
লুকা হাত দিয়ে দেখাল, সেই কলসটি এই অ্যাত্ত বড়! এরকম সোনার কলস যে পাবে তার সাত পুরুষকে আর চিন্তা করতে হবে না। তবে, এর মধ্যে অন্তত চোদ্দজন যোদ্ধা ওই সোনার কলসের লোভে জয়রামের সঙ্গে লড়াই করতে এসে প্রাণ দিয়েছে।
অন্য একজন বলল, “আমাদের রাজকুমার অজগর হত্যা করেছেন। তিনি মহাবীর। তা হলে এবার ওই সোনার কলস আমাদের রাজ্যে যাচ্ছে।”
লুকা একটু থমকে গিয়ে বলল, “সত্যি কথা বলব? আমি জয়রামকে এক ঝলক দেখেছি। তাঁকে দেখে মানুষ বলে মনে হয় না, ঠিক যেন একটা দৈত্য। তিনি নাকি তলোয়ারের এক কোপে একটা তাল গাছ কেটে ফেলতে পারেন। আমাদের রাজকুমারের যতই সাহস হোক, তিনি গায়ের জোরে তো পারবেন না। জয়রামের হাত দুটোও কত লম্বা-লম্বা। এ লড়াইয়ে দরকার নেই, চলুন আমরা দেশে ফিরে যাই।”
মল্লপাল বলল, “অতবড় অজগর সাপটা, সেও তো একটা দৈত্যের মতন। কত বড় তার ল্যাজটা ছিল দ্যাখোনি?”
কুমার তীক্ষ্ণ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে গম্ভীর ভাবে বলল, “জয়রামের সঙ্গে কাল সকালে আমি দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামব। তোমরা খবর দিয়ে এসো।”
পরদিন যথাসময়ে রাজকুমার তীক্ষ্ণ সদলবলে এসে উপস্থিত হল চৌরাস্তায়। দামামাধ্বনি দিয়ে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে রাজপুরীর অনেকেই এসে হাজির হয়েছে লড়াই দেখতে। ফেরিওয়ালারা সেখানে মিঠাই ও মুড়ি-বাতাসা বিক্রি করছে।
জয়রাম এল খানিকটা দেরি করে। সত্যিই তাকে দেখলে ভয় করে। হেলেদুলে এমনভাবে হাঁটছে, যেন একটি চলন্ত পাহাড়! তার গলায় সোনার হার, দু’হাতে সোনার কবচ।
সোনার কলসটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সে এদিক-ওদিক চেয়ে বলল, “কই, কে আমার সঙ্গে লড়বে? তেমন যোদ্ধা তো কাউকে দেখছি না।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ এক পা এগিয়ে এসে বলল, “হে বীর, আপনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি আপনার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাই।”
জয়রাম ঝুঁকে পড়ে কুমার তীক্ষ্ণকে দেখল। তারপর অট্টহাসি করে উঠল। হাসির দমকে দুলে-দুলে উঠতে লাগল তার শরীর।
একটু পরে হাসি থামিয়ে বলল, “তুই কে রে? এইটুকু পুঁচকে ছেলে লড়বে আমার সঙ্গে। তোর সাহস তো কম নয়। মরবার সাধ হয়েছে বুঝি। যা, যা, পালা, পালা।”
মল্লপাল তখন এগিয়ে এসে বলল, “হে মহাশয়, ইনি অহিচ্ছত্রপুরের যুবরাজ তীক্ষ্ণ। এর তুল্য বীর কোনও দেশে নেই। ইনি আপনার সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা করতে চান।”
জয়রাম এবার ধমকের সুরে বলল, “অহিচ্ছত্রপুরের যুবরাজ তো কী হয়েছে! আমি ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করি না। আমার সামনে একবার কেউ তলোয়ার তুললে আর প্রাণ নিয়ে ফেরে না। ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।”
মল্লপাল বলল, “তা হলে তো সোনার কলসটাও আমাদের নিয়ে যেতে হয়। আপনি হার স্বীকার করছেন নিশ্চয়ই।”
জয়রাম ক্রুদ্ধ হুঙ্কারে বলল, “তবে রে। এত বড় কথা!”
জয়রাম তলোয়ার তুলে এক কোপে রাজকুমার তীক্ষ্ণকে শেষ করে দিতে গেল।
কিন্তু রাজকুমার তীক্ষ্ণ যেন অদৃশ্য হয়ে যেতে জানে। চোখের নিমেষে সে ঘুরে গেল অন্য দিকে। লাফিয়ে উঠতে লাগল শূন্যে। এক-একবার তাকে দেখা যায়, এক-একবার যেন সে কোথায় হারিয়ে যায়। শুধু শোনা যায় অস্ত্রের ঝনঝন শব্দ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, জয়রাম ধপাস করে চিত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে, আর ঠিক গলার কাছে তলোয়ারের ডগা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমার তীক্ষ্ণ।
সমবেত জনতা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে রইল কয়েক পলক। তারপর সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ল। অত্যাচারী জয়রামকে এ রাজ্যের মানুষ বিশেষ পছন্দ করে না, সে পরাজিত হওয়ায় সবাই খুশি হয়েছে।
তলোয়ারের অগ্রভাগ জয়রামের গলায় ঠেকিয়ে রেখে রাজকুমার তীক্ষ্ণ জিজ্ঞেস করল, “কী, লড়াইয়ের শখ মিটেছে? আর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা আছে?”
জয়রাম কোনও উত্তর দিল না।
জনতার মধ্য থেকে কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠল, “কুমার, ওকে মেরে ফেলুন। ওর গলা কেটে ফেলুন। আগে যাদের হারিয়েছে, তাদের সকলকেই জয়রাম হত্যা করেছে।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “না, আমি মানুষ মারতে আসিনি। আমি শুধু এর বীরত্বের গর্ব ভাঙতে এসেছিলাম। সকলের সামনে আমি প্রমাণ করেছি, জয়রাম সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা নয়।”
মল্লপালও চোখের ইশারায় জানাল জয়রামের গলাটা কেটে ফেলার জন্য।
কুমার তীক্ষ্ণ তবু বলল, “না, ওকে মারব না। দ্যাখো, ও সম্পূর্ণ পরাজিত হয়েছে, ওর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। এবার কেউ ওর মুখ-চোখে জল ঢেলে দাও।”
জয়রাম নিস্পন্দ হয়ে চোখ বুজে আছে দেখে কুমার তীক্ষ্ণ তলোয়ারটা সরিয়ে এনে খাপে ভরল।
সঙ্গে-সঙ্গে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জয়রাম। কুমারকে আর অস্ত্র তোলার সুযোগ না দিয়েই তার ঘাড়ের ওপর মারল এক কোপ।
রাজকুমার তীক্ষ্ণ মাটিতে ঢলে পড়ে গেল।
জয়রাম আবার হা-হা করে হেসে উঠে বলল, “স্পর্ধিত বালক, এই তোর শেষ। শুধু তলোয়ার চালাতে শিখে আমার সঙ্গে লড়তে এসেছিলি? শত্রুর যে শেষ রাখে, সে কখনও যোদ্ধা হতে পারে? তুই শত্রুকে না মারলে, শত্রু তোর সর্বনাশ করবে, এই তো নিয়ম।”
তলোয়ারের রক্ত মুছতে-মুছতে জয়রাম সগর্বে বলল, “ওরে, কে আছিস, এই মৃতদেহটাকে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আয়।”