৪
রাজকুমার দৃঢ়র পলায়নের খবর ছম্ভী পেয়ে গেলেন সেই রাতেই।
প্রথমেই তিনি বেশি উত্তেজিত হলেন না। শুভ আর নিশুম্ভকে ডেকে পাঠালেন রাজপ্রাসাদে।
অমন দুই জোয়ান সৈন্য শুম্ভ আর নিশুম্ভ, তারাও ছম্ভীর সামনে এসে ভয়ে কাঁপে। কাঁপতে-কাঁপতে তারা ছম্ভীর পায়ের কাছে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম জানাল।
ছম্ভী গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা আমার দু’জন অতি বিশ্বাসী প্রহরী। প্রতি রাতে কালাঘর বন্দীশালা পাহারা দেওয়ার ভার তোমাদের ওপর দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। তবু একজন বন্দী পালাল কী করে?”
শুম্ভ বলল, “প্রভু, আমরা তো বন্দীদের পালাতে দিইনি। আমাদের চোখ এড়িয়ে একটি মাছিও কালাঘর থেকে প্রাণ নিয়ে বেরোতে পারে না।”
নিশুম্ভ বলল, “আমরা ঠিক সময়েই এক বিশ্বাসঘাতক রক্ষী ও এক বন্দীর ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছি, তাদের প্রতিরোধ করেছি!”
ছম্ভী বললেন, “তবু তারা পালিয়েছে, এ-কথাও ঠিক!”
শুম্ভ বলল, “না, প্রভু, তারা পালাতে পারেনি। তারা আত্মহত্যা করেছে। দুর্গ-প্রাকারে যেখানে ওদের ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে ওদের ধরা না দিয়ে উপায় ছিল না। তারপর ওরা নদীতে লাফিয়ে পড়ল। ওখান থেকে লাফালে ওদের মৃত্যু নিশ্চিত।”
ছম্ভী বললেন, “মৃত্যু নিশ্চিত? তবে তাদের মৃতদেহ গেল কোথায়? আমি সেই পলাতকদের মৃত মুখ দেখতে চাই!”
নিশুম্ভ বলল, “ওরা লাফাবার পরই আমরা ছুটে নীচে গিয়ে দুর্গের বাইরে, নদীর ধারে খোঁজ করেছি, কিছু দেখতে পাইনি। তবে নদীতে খুব স্রোত ছিল। ওদের মৃতদেহ স্রোতে ভেসে গেছে।
ছম্ভী বললেন, “কত দূর ভেসে যাবে? মৃতদেহ প্রথমেই ভেসে ওঠে না, কোনও পাথরে লেগে জলের মধ্যে ডুবে থাকতেও পারে। তোমরা ধীবরদের ডেকে জাল ফেলে দেখেছ?”
শুম্ভ আর নিশুম্ভ নীরব রইল।
ছম্ভী বললেন, “এক্ষুনি গিয়ে অন্তত দশজন ধীবরকে সংগ্রহ করো। নদীতে জাল ফ্যালো। যে-কোনও উপায়ে মৃতদেহ দুটি এনে আমাকে দেখাবে। আমি তোমাদের এখনও কোনও দোষ ধরছি না। কিন্তু ওই দুই পলাতকের মৃতদেহ যদি আমাকে দেখাতে না পারো, তা হলে তোমাদের কঠিন শাস্তি দেব! এ দেশে তোমাদের স্থান হবে না, মনে রেখো!”
শুম্ভ-নিশুম্ভ বিদায় নেওয়ার পর ছম্ভী কালাঘরের অধ্যক্ষ মল্লপালকে ডেকে বললেন, “তোমার কারাগার থেকে একজন রক্ষী আর এক বন্দী পালিয়েছে, এ দায়িত্ব কার? তোমার নিশ্চয়ই। তোমাকে কী শাস্তি দেব?”
মল্লপাল মাথা নিচু করে বলল, “প্রভু, দায়িত্ব অবশ্যই আমার। আপনি আমাকে যে শাস্তিই দেবেন, তা মাথা পেতে নেব।”
ছম্ভী বললেন, “মৃত্যুদণ্ডই তোমার প্রাপ্য। কাল সকালে তোমাকে শূলে দেওয়া উচিত, তাই না? সে বিষয়ে পরে বিবেচনা করছি। তার আগে বলো, এই বন্দীর পলায়নের সংবাদ কি তলতাদেবী পেয়েছেন?”
মল্লপাল বলল, “না প্রভু! সে বিষয়ে আপনাকে আমি নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দিতে পারি। আমার কারাগারে সবচেয়ে মূল্যবান বন্দী ওই দু’জন। এর মধ্যে একজনের পলায়নের সংবাদ শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই আমি প্রাক্তন রানির কক্ষের দিকে ছুটে যাই। তিনি তখন ঘুমন্ত ছিলেন। আমি নিজে সেখানে পাহারা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
ছম্ভী ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন তুমি এখানে এসেছ, এখন সেখানে কে রয়েছে?”
মল্লপাল বলল, “আমার জ্যেষ্ঠপুত্রকে সেখানে বসিয়ে রেখে এসেছি, প্ৰভু। তাকে কঠোর নির্দেশ দিয়ে এসেছি, বোবা-কালা প্রহরী ছাড়া আর কেউ যেন কিছুতেই না ঢুকতে পারে।”
ছম্ভী দু’বার মাথা নেড়ে একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
তারপর বললেন, “হ্যাঁ, এই কাজটার জন্য তোমার অপরাধ কিছুটা কমে গেছে বটে। মল্লপাল, তোমার মতন বিশ্বস্ত কর্মচারীকে মৃত্যুদণ্ড দিতে আমার মন চায় না। তোমাকে আমি অন্য কাজের ভার দেব। তুমি এই প্রাসাদেই নীচে অপেক্ষা করো। সকাল হলে তোমাকে দেশান্তরে যেতে হবে!”
সারা রাত ছম্ভী ঘুমোতে পারলেন না।
পায়চারি করতে-করতে ছম্ভী বহু কথা চিন্তা করতে লাগলেন। এক-একবার তিনি ঘুমন্ত রাজকুমার তীক্ষ্ণর শিয়রের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। তীক্ষ্ণ এখন সদ্য কৈশোর ছাড়িয়েছে, তার মুখমণ্ডলে ফুটে উঠেছে বুদ্ধির দীপ্তি। এই বয়েসেই সে তলোয়ার খেলায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে প্রায়।
অন্যান্য দিনের মতনই তীক্ষ্ণ ঘুম থেকে ওঠার পর এক বৃদ্ধ পণ্ডিতের কাছে শাস্ত্র-পাঠ নিল। তারপর সে উদ্যানে গেল অন্য এক শিক্ষকের কাছে অস্ত্রচালনার শিক্ষা নিতে।
সেই সময় ছম্ভী এসে দাঁড়ালেন তার পাশে।
স্নেহ-কোমল স্বরে বললেন, “কুমার তীক্ষ্ণ, তোমার হস্ত-ক্ষিপ্রতা ও অস্ত্র-দক্ষতা দেখে আমি খুবই প্রীত হয়েছি। তুমি এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজা হওয়ার পুরোপুরি যোগ্য। কিন্তু সিংহাসনে বসবার আগে আমি তোমাকে একটি দায়িত্ব দিতে চাই।”
কুমার তীক্ষ্ণ বিনীতভাবে বলল, “আদেশ করুন, প্রভু!”
ছম্ভী বললেন, “আমাদের পাশের রাজ্যে জয়রাম নামে এক ব্যক্তির খুব নাম শোনা যাচ্ছে। জয়রাম ওই রাজ্যের রাজার শ্যালক। সে সবাইকে গর্ব করে বলে বেড়াচ্ছে যে, তলোয়ার চালনায় তার তুল্য বীর আর ভূ-ভারতে কেউ নেই। বেশ কিছু যোদ্ধাকে সে পরাজিতও করেছে। তার এই অহঙ্কার আমার সহ্য হচ্ছে না। তোমার মতন একজন বীর থাকতে এমন কথা সে বলে কী করে? তাই আমি তোমাকে ছত্রপুরে পাঠাতে চাই। তুমি জয়রামকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করে পরাজিত করবে, তার অহঙ্কার চূর্ণ করবে! তুমি এই প্রস্তাবে রাজি?”
কুমার তীক্ষ্ণ বলল, “আপনি আদেশ করলে অবশ্যই রাজি আছি!” ছম্ভী বললেন, “এটা আমার আদেশ নয়। আমার অভিপ্রায়। তুমি ভেবে দেখো।”
কুমার তীক্ষ্ণ বলল, “ভেবে দেখার কিছু নেই। আমাকে কবে যেতে হবে বলুন?”
ছম্ভী বললেন, “শুভস্য শীঘ্রম। আজই যাত্রা করো তা হলে!”
রাজপ্রাসাদে ফিরে এসে ছম্ভী কারারক্ষী মল্লপাল আর সেনাপতি বলভদ্রকে একসঙ্গে ডেকে পাঠালেন। দু’জনকে সামনে বসিয়ে তিনি বললেন, “আগেকার দিনের রাজারা যেমন দিগ্বিজয়ের জন্য রাজকুমারদের পাঠাতেন, আমিও সেইরকম কুমার তীক্ষ্ণকে দেশে-দেশে পাঠাতে চাই। রাজ্য জয় করার বদলে সে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলি ঘুরে-ঘুরে খ্যাতনামা বীরদের সঙ্গে অস্ত্র যুদ্ধে নামবে। আমার নিশ্চিত ধারণা, সে সর্বত্র জয়ী হবে। সকলকে পরাজিত করার পর সে দিগ্বিজয়ীর বেশে এই দেশে ফিরবে। তখন তাকে আমি সিংহাসনে বসাব। আজই সে যাবে ছত্রপুরে জয়রামের সঙ্গে লড়াই করতে!”
সব শুনে বলভদ্র বলল, “প্রভু, আপনার প্রস্তাব অতি উত্তম। কিন্তু আর কয়েকটি বছর অপেক্ষা করলে হয় না? কুমার তীক্ষ্ণ এখনও বালক মাত্ৰ!”
ছম্ভী বললেন, “কুমারের ষোলো বছর বয়স হয়েছে। ষোলো বছরের যুবকদের বাবা-মায়েরা বালক মনে করে বলেই তো অধিকাংশ যুবক নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। ষোলো বছরের যুবকরা কী না পারে! ইচ্ছে করলে তারা বিশ্বজয় করতে পারে!”
বলভদ্র বললেন, “প্রভু, আপনি ছত্রপুরের জয়রামকে দেখেছেন? তার দৈত্যের মতন চেহারা। সেই তুলনায় কুমার তীক্ষ্ণর ছোটখাটো শরীর। এ দু’জনের দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ হবে কী করে? এ যেন সিংহের সঙ্গে খরগোশের লড়াই!”
ছম্ভী বললেন, “বিরাট চেহারা হলেই বড় বীর হয় না। সমস্ত যুদ্ধই হয় বুদ্ধি দিয়ে। কুমার তীক্ষ্ণ অসম্ভব বুদ্ধিমান। সে জয়ী হবেই। বলভদ্র, তুমি সব ব্যবস্থা করে দাও! শিবির নিয়ে লোকজন যাবে কুমারের সঙ্গে। আর মল্লপালও থাকবে কুমারের পাশে পাশে। জয়রামকে পরাজিত করার পর তাকে নিয়ে যাবে মল্লারপুরে। সব ক’টি রাজ্যের বীরদের ধরাশায়ী করতে কুমারের যদি চার-পাঁচ বছর লেগে যায় তো লাগুক!”
বলভদ্রের তবু বিস্ময় কাটল না। সকলেই জানে, ছম্ভী কুমার তীক্ষ্ণকে নিজের পুত্রের মতন ভালবাসেন। সব সময় তাকে চোখে-চোখে রাখেন। সেই ছম্ভী এতদিনের জন্য তীক্ষ্ণকে চোখের আড়ালে পাঠাচ্ছেন কেন, তাও বিপদের মধ্যে?
বলভদ্র জিজ্ঞেস করল, “প্রভু, কুমার যদি বাইরের কোনও যোদ্ধার কাছে পরাজিত হয়, তা হলে কী হবে? তখন তার জীবন সংশয় হতে পারে!”
ছম্ভী গম্ভীর ভাবে বললেন, “যদি কুমার তীক্ষ্ণ কারও কাছে পরাজিত হয়, তা হলে বুঝতে হবে, সে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার উপযুক্ত নয়। এ-রাজ্যের প্রজারা কোনও দুর্বল রাজা চায় না। কুমার আমার নয়নের মণি, তবু আমি তাকে বাইরে পাঠাচ্ছি উপযুক্ত হয়ে ওঠার জন্য!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণর যাত্রার ব্যবস্থা করে দিয়ে ছম্ভী বললেন, “কালকের দুই পলাতকের মৃতদেহ পাওয়া গেল? আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।”
কিন্তু জয়পাল ও রাজকুমার দৃঢ়র মৃতদেহ পাওয়া গেল না শেষ পর্যন্ত।
নিশ্চিত মৃত্যুর কথা ভেবেই দু’জনে দুর্গ-প্রাকার থেকে লাফ দিয়েছিল। জলে পড়ার পর দু’জনে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কুমার দৃঢ় প্রবল স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে চলে যায় অনেক দূর। সেই স্রোতস্বিনী নদী দুটি রাজ্য পেরিয়ে লিচ্ছবি দেশে আসবার পর, কুমারের দেহ আটকে গেল একটা দ্বীপে।
সেখানকার নদীর ঘাটে কয়েকজন স্ত্রীলোক কাপড় কাচছিল। প্রথমে একটা মৃতদেহ দেখে তারা ভয় পেয়ে গেল। একটু দূরে পালিয়ে যাওয়ার পরে তাদের একজন বলল, “আহা, কী ফুটফুটে, সুন্দর মানুষটি। সত্যিই মরে গেছে কি না দ্যাখ তো!”
তারা আবার ফিরে এসে দেহটি টেনে তুলল ঘাটে। কুমারের শরীরে আঘাতের চিহ্ন নেই। একটু-একটু যেন উত্তাপ আছে। যেন বেঁচে আছে মনে হয়।
তখন তারা ডেকে আনল গ্রামের মোড়লকে।
কুমারের শরীর ধুয়ে-মুছে, গরম জলের খানিকটা সেঁক দেওয়ার পর এক সময় সে চোখ মেলল।
গ্রামের মোড়ল বলল, “চেহারা দেখে মনে হয় কোনও বড় ঘরের সন্তান। ঠিক যেন রাজপুত্তুর। হে বিদেশী, আপনি কে?”
রাজকুমার দৃঢ় ঘোলাটে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। দিনের আলোয় তার চোখে যন্ত্রণা বোধ হচ্ছে, তবু সে চোখ ঢাকল না। হাত তোলার মতন সামর্থ্যও তার নেই।
মোড়ল বারবার ‘আপনি কে? আপনি কে?’ জিজ্ঞেস করলেও কুমার কোনও উত্তর দিতে পারল না। তার কিছুই মনে পড়ছে না।
অত উঁচু থেকে নদীর জলে পড়ার ফলে কুমারের মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। তার স্মৃতিভ্রংশ হয়ে গেছে। নিজের নামটাও তার মনে নেই।