১০
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। আকাশে ভাল্লুকের গায়ের মতন মেঘ। ছায়া পড়েছে চতুর্দিকে। মাঝে-মাঝে গুরু-গুরু গর্জন হচ্ছে আর চড়াৎ-চড়াৎ করে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে সারা আকাশ জুড়ে। জোরালো বাতাসে দুলে উঠছে গাছগুলোর মাথা। ঝড়-বাদল শুরু হতে আর দেরি নেই।
একটা ঝাঁকড়া গাছের নীচে শুয়ে আছে রাজকুমার তীক্ষ্ণ।
তাকে ঘিরে বসে আছে মল্লপাল আর অন্য সঙ্গীরা। সবাই খুব চিন্তিত। রাজকুমার অনেকক্ষণ ধরে ঘুমিয়ে আছে। দুপুরে কিছু খায়নি। ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না। এরকম আগে কখনও হয়নি। একটা দেশে দ্বন্দ্বযুদ্ধে জয়ী হওয়ার পরেই রাজকুমার বলেছে, চলো অন্য রাজ্যে। মহাবীর রাজকুমার তীক্ষ্ণ দুপুরবেলা এরকম ভাবে খোলা মাঠে শুয়ে ঘুমোবে, এ যেন কল্পনাই করা যায় না।
ঘুমন্ত রাজকুমারের মুখখানি দেখলে মনে হয়, সে খুব ক্লান্ত। অনেকদিন তার ভাল করে ঘুম হয়নি। আজ সে সব ঘুম পুষিয়ে নিচ্ছে।
আর-একবার খুব জোরে মেঘের গর্জন হল। বাতাসের বেগ বেড়েছে। আর এভাবে মাঠের মধ্যে থাকা নিরাপদ নয়।
মল্লপাল এবার ব্যাকুলভাবে ডাকল, “কুমার! কুমার!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ তাতেও সাড়া দিল না। তার ঘুম এতই গভীর যে, সে মেঘের গর্জনও শুনতে পাচ্ছে না।
রাজা আর রাজকুমারদের গায়ে হাত দিয়ে ঠ্যালা মেরে ডাকার নিয়ম নেই। মল্লপালেরা কেউ রাজকুমার তীক্ষ্ণর গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনায় তারা চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ জোর হাওয়ায় গাছের একটা শুকনো পাতা খসে পড়ল রাজকুমার তীক্ষ্ণর বুকের ওপর। ওইটুকু ছোঁয়াতেই সে চোখ মেলল এবং ধড়মড় করে উঠে বসল।
মল্লপাল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “রাজকুমার, চলুন, চলুন, শিবিরে চলুন। এক্ষুনি মহা দুর্যোগ শুরু হবে।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ একবার আকাশের দিকে তাকাল। তারপর মল্লপালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সেই সন্ন্যাসী? তিনি কে? কোথায় গেলেন?”
রাজকুমার এর আগেও এই প্রশ্ন অনেকবার করেছে। কিন্তু মল্লপালরা কেউ ওই সন্ন্যাসীকে আগে দেখেনি। রাজকুমার তীক্ষ্ণ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার পর তিনি তাকে কোলে তুলে এনে গাছতলায় শুইয়ে দিলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন খানিকক্ষণ। তারপর চলে গেলেন। কারও সঙ্গেই আর কোনও কথা বলেননি। ওঁর সঙ্গে আরও দশ-বারোজন লোক ছিল, সবাই মিলে একটা নৌকোয় চড়ে চলে গেছে নদীর অন্য পারে।
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “ওই সন্ন্যাসী কে, ওঁর নাম কী, আমাকে জানতেই হবে।”
মল্লপাল এক ভাণ্ড দুধ সামনে তুলে বলল, “এই দুধটুকু খেয়ে নিন, কুমার! সারাদিন আপনি কিছু খাননি।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ তাতে আপত্তি জানাল না। এক চুমুকেই সবটা দুধ খেয়ে ফেলল, তারপর ভাণ্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “জয়পাল, ওই সন্ন্যাসীর মতন এমন সাহসী মানুষ তুমি আর কখনও দেখেছ? পাগলটার সঙ্গে লড়াই করতে করতে আমার সাঙ্ঘাতিক মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। রাগে আমার শরীর কাঁপছিল, সেই অবস্থায় সন্ন্যাসী এসে আমায় বাধা দিলেন। আমার হাতে তলোয়ার, আমি রাগের চোটে ওঁকেই আঘাত করতে পারতাম। উনি তবু ভয় পেলেন না। আমার দিকে এগিয়ে এলেন!”
জয়পাল বলল, “সন্ন্যাসীদের প্রাণের ভয় থাকে না। ভগবান তাঁদের রক্ষা করেন!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “কিন্তু উনি তো আসল সাধু নন! নকল! উনি নিজেই বলেছেন যে উনি ব্রাহ্মণ নন! ব্রাহ্মণ না হলে কি কেউ সাধু-সন্ন্যাসী হতে পারে?”
জয়পাল বলল, “আজকাল তো অনেকেই দেখি গেরুয়া কাপড় পরে সাধু সেজে ঘুরে বেড়ায়!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “তারা সব নকল। ব্রাহ্মণ ছাড়া কি কেউ বেদ পাঠ করতে পারে? কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই, সেই নকল সাধু যখন আমার মাথায় হাত রাখলেন, আমার সমস্ত শরীর যেন কীরকম হয়ে গেল। কী নরম আর ঠাণ্ডা তাঁর হাত। আমার মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছিল, আমি যেন কত রকম ফুলের গন্ধ পেলাম। চতুর্দিকে সুন্দর বাজনা বাজতে লাগল। আর কেউ আমাকে ছুঁয়ে দিলে তো এরকম কখনও হয়নি?”
মল্লপাল বলল, “তা হলে বোধ হয় ওই সাধুটি জাদু জানে!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “সেইজন্যই তো আমি ওই সন্ন্যাসীকে আবার দেখতে চাই। তাঁকে পরীক্ষা করে দেখতে চাই।”
মল্লপাল বলল, “এতদিন ধরে লড়াই করতে-করতে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। হয়তো ওই সন্ন্যাসীর কোনও কৃতিত্ব নেই। অজ্ঞান হয়ে গেলে মানুষ অনেক কিছু শুনতে পায়।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “লড়াই করে করে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু বিশ্বাস করো, ওই সন্ন্যাসী ছুঁয়ে দেওয়ার পর আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। শরীর খুব সতেজ লাগছে। সন্ন্যাসী কোন্ দিকে চলে গেলেন?”
মল্লপাল বলল, “ওই নদীর অন্য পারে।”
বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামতেই মল্লপাল আবার ব্যস্ত হয়ে বলল, “চলুন, চলুন, কুমার, শিবিরে চলুন। গাছতলায় বসে থাকলে মাথায় বাজ পড়তে পারে!”
উঠে দাঁড়িয়ে রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “শিবিরে যাবো না, আমিও এখন নদী পার হব।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণর তলোয়ারটা মাটিতে পড়ে আছে। অন্য সময়ে সেটা রাজকুমার তীক্ষ্ণর কোমরের খাপে ঝোলে। এখন সে তলোয়ারটার দিকে তাকিয়ে একটুক্ষণ কী যেন ভাবল। তলোয়ারটা তুলল না। হনহন করে এগিয়ে গেল নদীর দিকে।
মল্লপাল তলোয়ারটা তুলে অন্য একজন অনুচরের হাতে দিয়ে ছুটে গেল রাজকুমারের পেছনে। হাত জোড় করে কাতরভাবে বলল, “এ কী করছেন, কুমার? এখন নদীর দিকে গিয়ে কোনও লাভ নেই!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “লাভ মানে কী? আমি নদী পার হতে চাই!” মল্লপাল বলল, “কী করে পার হবেন? এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কে নৌকো চালাবে? মাঝিরা নিশ্চয়ই পালিয়েছে!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “তুমি নৌকো চালাতে পারো না?”
মল্লপাল বলল, “না, আমি জানি না। এই ঝড়-বৃষ্টিতে নদী পার হওয়া অসম্ভব। চলুন, আমরা শিবিরে ফিরি। তারপর আমি গুপ্তচর পাঠাচ্ছি। সে ওই সন্ন্যাসী সম্পর্কে সব খবর সংগ্রহ করে আনবে।”
বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে রাজকুমারের সারা দেহ। ঘোর বৃষ্টিতে চারদিক প্ৰায় অন্ধকার হয়ে গেছে। নদীর দিকে তাকিয়ে রাজকুমার বুঝল, এ-সময় ওপারে যাওয়া সত্যি সম্ভব নয়। সে নিজেও নৌকো চালাতে জানে না।
সবাই মিলে দৌড়ে ফিরে এলো শিবিরে।
ভিজে পোশাকে সবাই শীতে কাঁপছে ঠকঠক করে। আগুন জ্বালানো হল। একজন শুরু করে দিল রাত্তিরের রান্না। বৃষ্টি একটু কমতেই লুকাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল সেই সন্ন্যাসীর সন্ধান আনার জন্য।
রাজকুমার তীক্ষ্ণ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। চুপ করে বসে আছে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে।
একটু পরে মল্লপাল এসে বসল তার সামনে। মাথা চুলকে কাঁচুমাচুভাবে বলল, “কুমার, আমি অন্যদের মুখপাত্র হয়ে এসেছি। যদি অভয় দেন তো একটা নিবেদন জানাতে চাই।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
মল্লপাল বলল, “মহারাজ মহাচূড়ামণির পুত্র আপনি, আপনি ধন্য। আপনার মতন বীর ভূ-ভারতে নেই।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ ভুরু তুলে বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, “কী ব্যাপার? আমার নিজের লোকদের মুখ থেকে এরকম প্রশংসা তো আমি শুনতে চাই না! তুমি আসল কথাটা কি বলতে চাও, সেটাই তাড়াতাড়ি বলো!”
মল্লপাল বলল, “আজ আপনি যেভাবে উম্মাদ অলম্বুষকে জব্দ করলেন, তা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেছি। এক সময় ভয় হয়েছিল, এবার বুঝি আপনার সুনামে একটা কলঙ্কের দাগ পড়বে। একটা মুগুর দিয়ে লড়াই করতে এসেছে একটা দৈত্যের মতন চেহারার পাগল। তার সঙ্গে কি কোনও বীরপুরুষ একলা লড়াই করতে পারে? কিন্তু আপনি গাছের ওপর থেকে ঠিক তার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়লেন। সেই পাগলটা ভয়েই মারা যাচ্ছিল আর একটু হলে।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “সে লোকটা শেষ পর্যন্ত পালিয়ে গেল।”
মল্লপাল বলল, “সে ভয়ে আর আসবে না। আপনি যখন ঘুমিয়েছিলেন, তখন রাজার দূত এসে জানিয়ে গেছে যে এই রাজ্য আপনাকে বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে মেনে নিয়েছে। এখানে আর কেউ আপনার সঙ্গে লড়বে না।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “এর পর আমাদের আর কোন্ রাজ্যে যাওয়ার কথা?”
মল্লপাল বলল, “এদিকে আর তো কোনও রাজ্য নেই। পাহাড়ের পর পাহাড়। এবার আমাদের ফেরার পালা।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “কোন্ দিকে ফিরব?”
মল্লপাল বলল, “সেই কথাটাই বলতে এসেছি, কুমার! আমাদের দলের সকলেরই ইচ্ছে, এবার দেশে ফিরলে হয় না? তিন বছরেরও বেশি আমরা ঘুরছি বাইরে বাইরে। অহিচ্ছত্রপুরে স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা কে কেমন আছে কিছুই জানি না!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তিন বছর কেটে গেছে?”
মল্লপাল বলল, “ঠিক তিন বৎসর পাঁচ মাস। কতদিন আমরা আত্মীয়স্বজনদের দেখিনি। সকলেরই মন উতলা হয়ে আছে। তাই বলছিলাম, কুমার, এবার দেশে ফিরে চলুন।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “গুরুদেব ছম্ভী আমাকে পাঁচ বৎসর ঘুরতে বলেছিলেন, এখনও তো ফেরার সময় হয়নি!”
মল্লপাল বলল, “এত কম সময়ের মধ্যে আপনি এতগুলি রাজ্যের বীরদের যে পরাজিত করতে পারবেন, তা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? প্রায় পঞ্চাশটি রাজ্য আমরা ঘুরেছি। পাহাড় ডিঙিয়ে, অরণ্য ভেদ করে, মরুভূমি পার হয়ে আমরা গেছি এক-একটা রাজ্যে। এত দূরের পথ পাড়ি দিতে অন্যদের আরও বেশি সময় লাগত। তারপর এক-একটা রাজ্যে আপনি তিন-চারজনের সঙ্গেও আলাদা ভাবে লড়াই করেছেন। অন্য যে-কোনও যোদ্ধার পক্ষে এতগুলি যুদ্ধ করতে বছরের পর বছর লেগে যেত, কিন্তু আপনি বিদ্যুৎগতিতে সব কিছু সম্পন্ন করেছেন। এবার দেশে ফিরে চলুন, কুমার!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ একটুক্ষণ চুপ করে রইল। সে এর মধ্যে কখনও সময়ের হিসেব করেনি, কত বছর কেটে গেছে তা জানত না। এখন সে যৌবনে পৌঁছে গেছে। মুখে কোমল ঘাসের মতন দাড়ি, মাথার চুল নেমেছে ঘাড় পর্যন্ত।
দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে সে গম্ভীরভাবে বলল, “দেশে ফেরার জন্য আপনাদের মন উতলা হয়েছে। সেখানে আপনাদের আত্মীয়-স্বজন আছে। কিন্তু মল্লপাল, আমার পিতা নেই, মাতা নেই। ভাই নেই, বোন নেই। কেউ নেই। শুধু আছেন গুরুদেব ছম্ভী। তিনিই আমার বাবার মতন, মায়ের মতন। তাঁর আদেশ আমি অমান্য করতে পারি না। তিনি আমাকে পাঁচ বৎসর পরিভ্রমণ করতে বলেছেন, তার আগে আমি ফিরতে পারি না।”
মল্লপাল ব্যাকুলভাবে বলল, “কুমার, আপনি যদি আরও দিগ্বিজয়ে যেতে চান, তা হলে রাজধানী অহিচ্ছত্রপুরে একবার ফিরে তারপর আবার অন্যদিকে যেতে পারেন। এদিকে তো আর জয় করার মতন কোনও রাজ্য নেই। তা ছাড়া, অনেকদিন আমরা দেশের কোনও খবর পাইনি। মহারাজ ছম্ভী যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তা হলে তিনি নিশ্চয়ই আপনাকে দেখলে খুশি হবেন। আপনি যুবরাজ। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ রাজা! রাজসিংহাসন খালি পড়ে থাকলে অন্য কেউ দখল করে নেবে। আপনি একবার অন্তত ফিরে গিয়ে অবস্থাটা দেখে নিন।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “আমাকে যদি প্রয়োজন হত, তা হলে গুরুদেব ছম্ভী নিশ্চিত খবর পাঠাতেন। আমাকে খুঁজে পাওয়া তো শক্ত নয়। আমরা যে-সব রাজ্য পার হয়ে এসেছি, তারা সবাই আমার কথা জানে।”
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে শিবিরের দ্বারের কাছে গিয়ে রাজকুমার তীক্ষ্ণ আবার বলল, “তোমরা ফিরে যাও! তোমাদের ছুটি।”
মল্লপাল ভয় পেয়ে বলল, “এ কী বলছেন, কুমার। আপনাকে ফেলে রেখে আমরা ফিরে যাব? মহামান্য ছম্ভী তা হলে আমাদের কারুর ঘাড়ের ওপর কি মুণ্ডু রাখবেন?”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “আমি পত্র লিখে দেব। আমি জানিয়ে দেব যে আমি নিজেই তোমাদের ফিরে যেতে বলেছি! ও কে দৌড়ে আসছে।”
মল্লপাল দ্বারের কাছে এসে অন্ধকারের মধ্যে ছুটন্ত একটা মূর্তিকে একটুখানি দেখেই বলল, “ওই তো লুকা। নিশ্চয়ই কোনও খবর পেয়েছে।”
হাঁপাতে হাঁপাতে লুকা এসে পৌঁছে গেল শিবিরের কাছে।
রাজকুমার তীক্ষ্ণ ধৈর্য ধরতে পারছিল না। তবু সে লুকাকে দম নেওয়ার সময় দিল।
রাজকুমার তীক্ষ্ণকে প্রণাম জানিয়ে, সামনে হাঁটু গেড়ে বসে লুকা বলল, “খবর এনেছি, যুবরাজ। খেয়া নৌকোর মাঝিদের দেখা পেলাম। তারাই জানালো। তারাই ওই সন্ন্যাসীর দলকে নদী পার করে দিয়েছে। সন্ন্যাসী তাঁর দল নিয়ে বৈশালীর দিকে গেছে।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ জিজ্ঞেস করল, “ওই সন্ন্যাসী কে? কী তাঁর পরিচয়?” লুকা বলল, “ওই সন্ন্যাসী নাকি আপনারই মতন বিভিন্ন রাজ্যে-রাজ্যে ঘুরে বেড়ান। মানুষকে জয় করেন। তবে কী অস্ত্র দিয়ে তিনি লড়াই করেন তা কেউ বলতে পারল না। তবে বহু লোকই তাঁর কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছে।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বলল, “সন্ন্যাসী আবার লড়াই করবে কী? ওঁর কাছে কোনও অস্ত্রও ছিল না। তা ছাড়া উনি যে ব্রাহ্মণ নন, তা কি লোকে জানে না? ব্রাহ্মণ না হয়েও সন্ন্যাসী হলেন কী করে?”
লুকা বললেন, “আপনি ঠিকই শুনেছেন, যুবরাজ। উনি ব্রাহ্মণ নন। উনি ক্ষত্রিয়। আপনারই মতন একটি রাজ্যের রাজকুমার।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বিস্ময়ে চিৎকার করে বলল, “অ্যাঁ? রাজকুমার? সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ ধরে আছে? তা হলে তো ওঁকে জয় করতেই হবে! হ্যাঁ, জয় না করে আমি কিছুতেই ফিরবো না। লুকা, উনি কোন্ রাজ্যের রাজকুমার তা জেনে এসেছ?”
লুকা বলল, “উনি কোন্ রাজ্যের রাজকুমার তা কেউ ঠিক বলতে পারল না। বোধ করি অনেক দূরের কোনও দেশের। তবে ওঁর নামটা জেনেছি। ওঁর নাম শাক্য সিংহ। এখন সবাই বলে শাক্যমুনি!”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল।
তারপর আস্তে-আস্তে বলল, “আমি আজই বৈশালী যাব। বৃষ্টি থেমে গেছে। এখন নদী পার হতে কোনও বাধা নেই। তোমরা ফিরে যাও।”
রাজকুমার তীক্ষ্ণ বেরিয়ে এল শিবিরের বাইরে। তারপর ছুটতে লাগল নদীর দিকে।