১
এর পর বারো বছর পার হয়ে গেছে।
এর মধ্যে নদী দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। পৃথিবীতে শুকিয়ে গেছে অনেক গাছ, আবার জন্মেছে অনেক নতুন বৃক্ষ-লতা। যারা শিশু ছিল, তারা কিশোর হয়েছে। কিশোররা পৌঁছেছে যৌবনে। অনেক যুবক-যুবতী প্রৌঢ় হয়েছে, প্রৌঢ়রা হয়েছে বৃদ্ধ, আবার তাদের বংশে এসেছে নতুন শিশু।
রাজকুমার দৃঢ় এখন রীতিমতন যুবক, আর রাজকুমার তীক্ষ্ণ এসে পৌঁছেছে কৈশোরের শেষ দিকে। ছম্ভী ছিলেন রাজপুরোহিত, এখন এ-রাজ্যের পুরোপুরি রাজা, তিনি প্রৌঢ় হয়েছেন বটে কিন্তু তাঁর চেহারা দেখলে বোঝা যায় না। তাঁর শরীর আগের চেয়েও সবল হয়েছে, প্রতিদিন তিনি ব্যায়াম ও অস্ত্রচালনা করেন।
রানি তলতাদেবী আজও অন্ধকার কারাগারে বন্দিনী। এই দশ বছরের মধ্যে তাঁকে বাইরের কেউ দেখেনি। একজন প্রহরী তাঁকে খাবার দিতে যায়, আর ছম্ভী মাঝে-মাঝে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু সেই সময় কারাগারের মধ্যে মশাল জ্বালা হলেও তলতাদেবী দু’ হাতে নিজের মুখ ঢেকে রাখেন, তিনি ছম্ভীর মুখ দেখতে চান না। নিজের মুখও দেখাতে চান না।
রাজকুমার দৃঢ়ও সূর্যের আলো দেখতে পায় না। কালাঘর দুর্গেরই অন্য এক প্রান্তে তাকে রাখা হয়েছে আর-একটা অন্ধকার ঘরে। সে জানে না তার মা কোথায়, তার ছোট ভাই কোথায়। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সে একা ওই ঘরে রয়েছে, তবু সে মনের জোর হারায়নি।
দু’ বছর আগে রাজকুমার দৃঢ় একবার পালাবার চেষ্টা করেছিল।
প্রথম-প্রথম তাকে খাবার দিতে আসত একজন প্রহরী। বয়েস বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রহরীর সংখ্যা বেড়ে হল দু’জন। উন্মুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে তারা আসে, রাজকুমার তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা কোনও উত্তর দেয় না।
একদিন রাজকুমার দৃঢ় জ্বরে পড়ল। বিছানা থেকে আর ওঠে না, খাবারও খায় না। প্রহরীরা খাবার রেখে যায়, আবার সেই খাবার-ভর্তি পাত্র ফেরত নিয়ে যায়। এইরকম চলল তিনদিন।
প্রহরীরা সেদিন এসে দেখল, রাজকুমার দৃঢ় এমনভাবে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে যে বেঁচে আছে কি না বোঝা যায় না। প্রহরী দু’জন চিন্তায় পড়ে গেল। তারপর একজন মুখের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে গায়ে হাত দিয়ে দেখল। গা বেশ গরম। তখন সে একটা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই, তুমি কিছু খাচ্ছ না কেন?”
দু-তিনবার প্রশ্ন করেও কোনও উত্তর পেল না।
তখন তারা ধরে নিল যে, রাজকুমার জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে গেছে। এর পর যদি চিকিৎসা না করা যায়, তা হলে সে মরেই যাবে। এরকমভাবে তাকে মরতে দেওয়া উচিত কি না, বুঝতে পারল না তারা।
একজন রাজকুমার দৃঢ়র পাশে রইল, আর-একজন গেল রাজবাড়িতে খবর পাঠাতে।
দ্বিতীয় প্রহরীটি বেরিয়ে যাবার একটুক্ষণ পরেই রাজকুমার দৃঢ় তড়াক করে লাফিয়ে উঠে চেপে ধরল অন্য প্রহরীটির কণ্ঠ। বাঘ যেমন মোষের টুটি কামড়ে ধরে আর কিছুতেই ছাড়ে না, রাজকুমার দৃঢ়ও কিছুতেই ছাড়ল না তাকে। সে লোকটি হাতের তলোয়ার চালাবারও সুযোগ পেল না, গোঁ-গোঁ আওয়াজ করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল কয়েক মুহূর্ত পরেই।
রাজকুমার দৃঢ় হাতে তুলে নিল তলোয়ার। দরজা খোলা। পালাবার এই তো দারুণ সুযোগ। সামনেই মুক্তি।
তবু সেবার রাজকুমার দৃঢ় পালাতে পারেনি। কারও হাতে সে ধরাও পড়েনি অনেকটা সময়, তা হলেও তাকে ফিরে আসতে হয়েছিল এই অন্ধকার কারাগারে।
সেদিন তলোয়ার হাতে নিয়ে রাজকুমার দৃঢ় বেরিয়ে এসেছিল তার ঘর থেকে। খানিকটা অলিন্দের পর সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নেমেও এসেছিল অনেকটা, আর-একজন প্রহরীর চোখ এড়িয়ে সে চলে এসেছিল এই বন্দিশালার প্রধান দ্বারের কাছে। কিন্তু দুর্গের বাইরে পা দিয়েই সে চিৎকার করে উঠেছিল যন্ত্রণায়!
দশ বছর ধরে রাজকুমার দৃঢ় একটুও সূর্যের আলো দেখেনি। অন্ধকারে থাকতে থাকতে তার চোখে অন্ধকার সয়ে গিয়েছিল। অন্ধকারের মধ্যেও সে একটু-একটু দেখতে পায়। কিন্তু রোদ সে সহ্য করতে পারল না। দারুণ যন্ত্রণায় সে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল। তার চিৎকার শুনে প্রহরীরা এসে তাকে আবার তুলে নিয়ে রেখে এসেছিল কারাগারে।
সে সংবাদ শুনে ছম্ভী খুব হেসেছিলেন।
এমন ব্যবস্থা তিনি করেছেন যে, প্রহরীরা অমনোযোগী হলেও রাজকুমার পালাতে পারবে না। সারাজীবন তাকে অন্ধকারেই কাটাতে হবে!
রাজকুমার তীক্ষ্ণর অবস্থা অবশ্য অন্যরকম। ছম্ভী তাকে খুব ভালবাসেন, তীক্ষ্ণ তাঁর দু’ চোখের মণি। সব সময় তিনি তীক্ষ্ণকে নিজের কাছে কাছে রাখেন। তীক্ষ্ণকে তিনি লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। অস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছেন। ব্রাহ্মণ পূজারী হলেও ছম্ভী অস্ত্রচালনাও ভাল জানেন। প্রত্যেকদিন খানিকক্ষণ অস্ত্রচর্চাও করেন।
রাজসভাতেও ছম্ভী নিয়ে যান তীক্ষ্ণকে। তাকে রাজকার্য শেখাচ্ছেন। ভবিষ্যতে তীক্ষ্ণকেই তিনি সিংহাসনে বসাবেন। ছম্ভী বিয়ে করেননি, তাঁর আর কেউ নেই। তীক্ষ্ণকে তিনি নিজের ছেলের মতনই মনে করেন। রাজবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী রাজকুমার তীক্ষ্ণ রাজ পুরোহিত ছম্ভীকে গুরুদেব বলে ডাকে। ছম্ভী বারবার বলেন, আমাকে গুরুদেব বলিস না, আমাকে বাবা বলে ডাকবি! তোর বাবা বেঁচে নেই, তোর মা তোর স্নেহময় বাবাকে খুন করেছে। ওরকম মায়ের কথা মনে রাখতে নেই।
তীক্ষ্ণ অবশ্য এখনও ছম্ভীকে বাবা বলে না, গুরুদেবই বলে।
এত বছর কেটে গেছে, তীক্ষ্ণর এখন আর বাবা-মায়ের মুখ ভাল করে মনেই পড়ে না। তার মা তার বাবাকে হত্যা করেছে। এই কথাটা শুনলেই তার ঘৃণা হয়! ওই মাকে সে আর কোনওদিন দেখতে চায় না।
তীক্ষ্ণর চেহারা খুব সুন্দর হয়েছে। ছিপছিপে লম্বা, চোখা নাক। কিন্তু তার চোখে সব সময় যেন একটা অন্যমনস্ক ভাব। তার অস্ত্রশিক্ষক মামোজি মাঝে-মাঝে অনুযোগ করে বলেন, “এই রাজকুমার তো ইচ্ছে করলেই মহাবীর হতে পারে, কিন্তু সব সময় যে মন দিয়ে লড়াই করে না! এক-এক সময় হাত থেকে তলোয়ার ফেলে দেয়!”
ছম্ভী রাজকুমার তীক্ষ্ণকে সব জায়গায় নিজের সঙ্গে নিয়ে যান। শুধু এক জায়গায় ছাড়া। মাঝে-মাঝে তিনি কালাঘর দুর্গে রানি তলতাদেবীকে দেখতে আসেন, তখন তিনি তীক্ষ্ণকে রেখে আসেন রাজবাড়িতে।
কালাঘর দুর্গে এসে, একটার পর একটা কক্ষ পেরিয়ে চলে আসেন রানি তলতাদেবীর কক্ষে। একজন প্রহরী মশাল জ্বালিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ায়।
তলতাদেবী ঘরের এক কোণে সরে গিয়ে দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে রইলেন। দেওয়ালের দিকে মুখ করে বললেন, “নমস্কার, গুরুদেব।”
ছম্ভী হেসে উঠে বললেন, “এখনও তুমি আমাকে প্রণাম জানাচ্ছ? আমি তোমাকে এমন শাস্তি দিয়েছি, তবু তোমার রাগ হয় না?”
তলতাদেবী বললেন, “আমি এ-রাজ্যের রানি, আমি রাজপুরোহিতকে প্ৰণাম জানাব না? আপনি আমাকে যে শাস্তি দিয়েছেন, সেটা আপনার ব্যাপার! তা বলে তো আমি আমাদের পরিবারের রীতি অমান্য করতে পারি না!”
ছম্ভী আরও জোরে হেসে উঠে বললেন, “তুমি এখনও নিজেকে এ-রাজ্যের রানি মনে করো? হায় রে! এ-রাজ্যের মানুষ তোমার নামই ভুলে গেছে। এ-রাজ্যের রাজা এখন আমি! তলতাদেবী, তোমার রাজত্ব এখন শুধু এই অন্ধকার ঘরটুকু! ওই ছেঁড়া কম্বলটা তোমার সিংহাসন!”
তলতাদেবী বললেন, “গুরুদেব, আপনি বলছেন, আপনিই এখন এ রাজ্যের রাজা। আপনি মহা শক্তিমান। তবু মাঝে-মাঝে আপনাকে আসতে হয় আমার কাছে। আমি আপনার মুখ দেখি না, তবু আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। তাতেই প্রমাণ হচ্ছে, আমি আপনার চেয়ে বড়!”
ছম্ভী বললেন, “তোমার তেজ দেখছি এখনও একটুও কমেনি! ভাল, তেজ থাকা ভাল! শোনো, তলতাদেবী, তোমাকে আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। তোমার এখনও এ-রাজ্যের রানি থাকার শখ। তুমি রানি হতে পারো, যদি তুমি আমাকে বিয়ে করো!”
তলতাদেবী এতই অবাক হলেন যে, কয়েক মুহূর্ত কথাই বলতে পারলেন না।
তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, “আপনি এখনও এমন একটা অদ্ভুত কথা বলতে পারছেন? কোনও রানি কি কখনও কোনও পুরোহিতকে বিয়ে করতে পারে?”
ছম্ভী বললেন, “কেন বারবার আমাকে পুরোহিত বলছ? আমি এখন রাজা। চারপাশের অন্যান্য রাজ্যও আমাকে শক্তিমান রাজা বলে স্বীকার করে। কেউ এ রাজ্য আক্রমণ করতে সাহস পায় না। অনেক ব্রাহ্মণও রাজা হয়, তাদের সঙ্গে রাজকুমারীদের বিয়ে হয়! এখনও বলো, তুমি রাজি কি না!”
তলতাদেবী বললেন, “আমি সত্যিই আপনার কথার মানে বুঝতে পারছি না। আপনি আমার সর্বনাশ করেছেন। আপনি আমার স্বামীকে হত্যা করেছেন, আমার ছেলেদের কেড়ে নিয়েছেন। আমার জীবনের বারোটি বছর অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছেন। তারপরেও আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান? আমি যদি রাজিও হই, তা হলে প্রথমেই তো প্রতিশোধ নিতে চাইব। প্রথম দিনেই আপনাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলব।”
ছম্ভী অট্টহাস্য করে বললেন, “সে কথা কি আমি জানি না? তুমি প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে, আর আমি প্রত্যেকবারই তোমার ষড়যন্ত্র ধরে ফেলব। বুদ্ধির খেলায় তুমি প্রত্যেকবার আমার কাছে হারবে। সেইটাই তো মজা! তুমি যে এখন কারাগারে রয়েছ, তা প্রজারা জানে না। আমি চাই, প্রজারা সবাই দেখুক, এককালের সেই অহঙ্কারী রানি তলতাদেবী আমার রানি হয়েছে, আমার বুদ্ধির কাছে সে বশ মেনেছে!”
তলতাদেবী বললেন, “আপনাকে সেই মজা পেতে দিতে আমি রাজি নই। তবে, জেনে রাখবেন, প্রতিশোধ আমি নেবই!”
‘ছম্ভী বললেন, “তুমি কোনওক্রমেই এই কারাগার থেকে বেরোতে পারবে না!”
তলতাদেবী বললেন, “আমি না পারি, আমার ছেলেরা প্রতিশোধ নেবে। মায়ের অপমান, পিতৃহত্যা তারা ভুলবে না!”
ছম্ভী বললেন, “তোমার সে আশা দুরাশা। তোমার এক ছেলে তোমায় ঘৃণা করে। সে কোনওদিন তোমার মুখ দর্শন করবে না। আর-এক ছেলে অন্ধকার ছাড়া আলোতেই আসতে পারবে না কোনওদিন! যতদিন বাঁচবে; তুমি এই অন্ধকার নরকেই থাকবে। আমি মাঝে-মাঝে এসে তোমার অবস্থা দেখে যাব!”
এই বলে বেরিয়ে এলেন ছম্ভী। তলতাদেবীর তেজ দেখতে তাঁর ভাল লাগে। তিনি দেখতে চান, এই তেজ কতদিন বজায় থাকে। এই নারী কোনওদিনই তাঁর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।
পরদিনই কিন্তু ছম্ভী একটা দুঃসংবাদ পেলেন।