৯
নিস্তব্ধ রাত। যজ্ঞশালায় কেউ নেই, শুধু মহারাজ মহাচূড়ামণি আর রাজপুরোহিত ছম্ভী বসে আছেন মুখোমুখি।
মহারাজ এক-একবার ক্রোধে হুঙ্কার দিয়ে উঠছেন, কেঁপে উঠছে তাঁর সর্বাঙ্গ। আবার তিনি দু’ হাতে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদছেন হুহু করে। এমন গভীর সংকটে তিনি জীবনে পড়েননি!
চম্পক বিদ্রোহ করেছে। মহাচূড়ামণি এক ফুৎকারে সেই বিদ্রোহ দমন করে দিতে পারেন। কিন্তু চম্পককে মারতে গেলে মহারানি তলতাদেবীকে বাঁচানো যাবে না। সেই পাষণ্ডটা দূর থেকে মহারাজের সৈন্যবাহিনী দেখতে পেলেই তলতাদেবীকে হত্যা করবে বলেছে। মহারানিকে হারালে এ-রাজ্য ফিরে পেয়েও লাভ কী?
রাজাদের অনেক রানিও থাকে। এক রানি গেলে তার বদলে অন্য রানি পাওয়া যায়। কিন্তু রাজ্য চলে গেলে আর কিছুই থাকে না। কিন্তু তলতাদেবীর সঙ্গে অন্য কোনও রানিরই তুলনা চলে না। তাঁর বুদ্ধিতেই এতদিন এই রাজ্য চলেছে। মহারানিকে হারিয়ে মহারাজ আর কিছুই পেতে চান না।
একসময় চোখের জল মুছে রাজপুরোহিতকে মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, “তা হলে এখন কী উপায়?”
ছম্ভীও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মহারাজ, আমি তো কোনও উপায় দেখতে পাচ্ছি না!”
মহাচূড়ামণি বললেন, “তবে কি এই রাজ্য, আমার এই প্রিয় রাজ্য আমি ওই উল্লুকটার হাতে তুলে দেব? যে সিংহাসনে আমার ঠাকুদা বসেছেন, আমার বাবা বসেছেন, আমি বসেছি, সেখানে এসে বসবে ওই নরকের কীট?”
ছম্ভী আঁতকে উঠে বললেন, “চম্পক এসে বসবে এই সিংহাসনে! তার আগে আমি এই রাজ্য ছেড়ে বিবাগী হয়ে চলে যাব।”
মহাচূড়ামণি বললেন, “তবে কি আপনি বলতে চান, মহারানির জীবনের বিনিময়ে আমি বিদ্রোহ দমন করব?”
ছম্ভী এবারও একইরকম ভাবে বললেন, “না, না, মহারাজ, তিনি এই রাজ্যের সৌভাগ্যলক্ষ্মী। যেদিন থেকে তিনি এই রাজ্যের রানি হয়ে এসেছেন, সেইদিন থেকেই এখানকার কত উন্নতি হয়েছে। এই তো সেদিন তাঁর বুদ্ধিতেই দাবানল থেকে রক্ষা পেল রাজধানী। মহারানিকে বিসর্জন দিলে এই রাজ্যের সাঙ্ঘাতিক অকল্যাণ হবে।”
“তা হলে আমি এখন কী করব, বলে দিন!”
“অপেক্ষা করা ছাড়া তো আর কোনও উপায় দেখছি না, মহারাজ!”
“অপেক্ষা করব? কতদিন অপেক্ষা করব? আমার মহারানি ওই মর্কট চম্পকের হাতে বন্দিনী, এটা আমি এক মুহূর্তও সহ্য করতে পারছি না! মহারানিকে মুক্ত করতে না পারলে আমার আর ঘুম হবে না! ওঃ, ওঃ, আমার আর ঘুম হবে না! আমি এখন কী করব?”
“মহারাজ, শান্ত হোন! শান্ত হোন!”
“কী করে শান্ত হব, গুরুদেব? আমার সর্বাঙ্গে আগুন জ্বলছে। আমার মাথা ঘুরছে।”
রাজপুরোহিত ছম্ভী চক্ষু বুজে একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “একটাই মাত্র উপায় আছে!”
মহাচূড়ামণি লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, “আছে? আছে? উপায় আছে? কী করতে হবে, এক্ষুনি বলুন!”
ছম্ভী বললেন, “ভাল করে শুনুন, মহারাজ। চম্পক জানিয়েছে যে, আপনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাকে আক্রমণ করতে গেলেই সে আগে মহারানি তলতাদেবীকে হত্যা করবে। তার এ-কথা মিথ্যে হবে না। মহারানির মৃত্যুর ঝুঁকি আমরা নিতে পারি না!”
মহাচূড়ামণি বললেন, “তা তো কিছুতেই নিতে পারি না।”
ছম্ভী বললেন, “মহারানির বিনিময়ে চম্পক আপনাকে বিনা যুদ্ধে সিংহাসন ছেড়ে দিতে বলেছে। সেটাও সম্ভব নয়।”
মহাচূড়ামণি হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “বিনা যুদ্ধে ওকে আমি সিংহাসন ছেড়ে দেব? মামার বাড়ির আবদার? তার আগে, আমি এই সিংহাসন ভেঙে টুকরো টুকরো করব, সারা রাজ্যে আগুন জ্বালিয়ে সবকিছু ধ্বংস করে দেব! ওই শকুনির ডিম চম্পকটা কিছু পাবে না!”
ছম্ভী বললেন, “এত প্রজাসমেত গোটা রাজ্যটা ধ্বংস করাও তো কাজের কথা নয়! আমি অন্য একটা উপায় চিন্তা করেছি। চম্পকের চিঠির কথা আমরা কাউকে জানাব না। সেনাবাহিনীকে আমরা যুদ্ধের সাজে সাজাব না। এই রাত্রে সবাই যেমন ঘুমিয়ে আছে, তেমন থাক। চম্পকের চর আছে নিশ্চয়। সে জানবে, তাকে আমরা আক্রমণ করতে যাচ্ছি না।”
মহাচূড়ামণি অস্থিরভাবে বললেন, “তাতে কী লাভ হল? তাতে তো আর মহারানি উদ্ধার পাচ্ছেন না!”
ছম্ভী বললেন, “আমার পরিকল্পনা পুরোটা শুনুন, মহারাজ। আমরা সৈন্য সাজিয়ে আক্রমণ করতে যাচ্ছি না জেনে চম্পক নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোবে। সেই সুযোগে আমরা যাব।”
মহাচূড়ামণি বুঝতে না পেরে বললেন, “আমরা যাব মানে? আমরা কোথায় যাব?”
“চম্পকের শিবিরে।”
“চম্পকের শিবিরে! আপনি কী বলছেন, গুরুদেব? চম্পকটা একটা উল্লুক হতে পারে, কিন্তু সে কি এতই গর্দভ যে, শিবিরের সামনে পাহারা রাখবে না? সেখানে নিশ্চয় অষ্টপ্রহর প্রহরীরা থাকবে। আমরা যত গোপনেই যাবার চেষ্টা করি, সেই প্রহরীরা আমাদের দেখেই শিঙা বাজিয়ে দেবে। সবাই জেগে উঠবে। আর তক্ষুনি যদি চম্পক হত্যা করে মহারানিকে?”
“আমাদের কেউ দেখতে পাবে না। চম্পক কোথায় শিবির খাটিয়েছে জানেন? রাজ্যের উত্তর প্রান্তের জঙ্গলে। এই জঙ্গলটা কোথায় আপনার মনে আছে? জঙ্গলের পেছনেই একেবারে খাড়া পাহাড়। মহারানির সঙ্গে যে গুপ্তচরটি গিয়েছিল, সে পালিয়ে এসেছে কোনওক্রমে। তার কাছে আমি শুনেছি, চম্পকের নিজের শিবির একেবারে জঙ্গলের শেষ প্রান্তে, পাহাড়ের গায়ে। যাতে পেছন থেকে কোনও শত্রু তাকে আক্রমণ করতে না পারে। কিন্তু মহারাজ, এই পাহাড়ের একটা সুড়ঙ্গপথের কথা আমি জানি। সেই সুড়ঙ্গপথে গিয়ে আমরা চম্পককে অতর্কিতে আক্রমণ করতে পারি।”
মহাচূড়ামণি কয়েক পলক ছম্ভীর দিকে তাকিয়ে কথাটা ঠিক মতন বুঝে নিলেন। তারপর উল্লাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, “পাহাড়ে সুড়ঙ্গপথ আছে? এ-কথা এতক্ষণ বলেননি কেন? চলুন, চলুন, আর দেরি নয়।”
ছম্ভী তবু চিন্তিতভাবে বললেন, “মহারাজ, যেতে হবে খুব সঙ্গোপনে। কাক-পক্ষীটিও যেন টের না পায়। কোথায় কোন্ বিশ্বাসঘাতক লুকিয়ে আছে, তার ঠিক কী?”
মহাচূড়ামণি বললেন, “শুধু আপনি আর আমি যাব। কেউ টের পাবে না।”
ছম্ভী বললেন, “আরও একটা কথা আছে। সুড়ঙ্গপথ ধরে নেমে গিয়ে প্রথমেই চম্পককে হত্যা করতে হবে, তার সৈন্যরা কেউ কিছু বুঝবার আগেই। না হলে কিন্তু আমাদের কার্যসিদ্ধি হবে না।”
মহাচূড়ামণি বললেন, “সে ব্যাপারে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। চম্পককে দেখামাত্রই আমি তার ধড় থেকে মুণ্ডটা নামিয়ে দেব। মৃত্যুর সময় সে যদি বিকট চিৎকার করে, তাতেও কিছু আসে যায় না। তার পঞ্চাশ-একশোজন সৈন্য তা শুনে ছুটে এলেও আমি একাই কচু-কাটা করব তাদের।
ছম্ভী বললেন, “তার আর প্রয়োজন হবে না। চম্পক নিহত হলেই অন্য সৈন্যরা আপনাকে দেখে ভয় পাবে। চম্পক ছাড়া মহারানির শরীরে হাত ছোঁওয়াবার সাধ্যও হবে না অন্য কারও। চম্পককে শেষ করতে পারলেই বিদ্রোহ শেষ হয়ে যাবে।”
মহাচূড়ামণি বললেন, “এই শাখামৃগটাকে শেষ করার জন্য আমার হাত নিশপিশ করছে। আপনি আমাকে গোপন সুড়ঙ্গপথটা দেখিয়ে দিন শুধু। আমি আর দেরি করতে পারছি না।”
ছম্ভী এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমাদের দু’জনকেই শুধু যেতে হবে। অন্য লোক নেওয়া যাবে না। অনেকটা দূরের পথ। দুটো ঘোড়া লাগবে। মহারাজ, আপনি নিজে অশ্বশালায় গেলে সব প্রহরী কৌতূহলী হবে। এত রাত্রে ঘোড়া সাজাতে বললে কেউ-না-কেউ সন্দেহ করবেই। আমি অন্য জায়গা থেকে দুটি ঘোড়া নিয়ে আসছি। আপনি নিজস্ব ঘোড়া ছাড়া অন্য ঘোড়ায় যেতে পারবেন তো?”
মহারাজ বললেন, “অবশ্যই পারব। এখন কি আর বাছাবাছির সময় আছে?”
ছম্ভী বললেন, “তা হলে আমি দুটি ঘোড়া নিয়ে আসছি। একটু সময় লাগবে। মহারাজ, আপনি যদি পোশাক পরিবর্তন করে নিতে চান তাও করে নিন। তবে আপনার রাজমুকুটখানি অবশ্যই সঙ্গে নেবেন। আপনি এ-দেশের রাজা, সব সময় রাজবেশই আপনাকে মানায়। চম্পককে শেষ করার পর তার সৈন্যরা যাতে আপনাকে চিনতে পারে, সেজন্যও মুকুট থাকা দরকার। ওইসব পাহাড়ি সৈন্য অনেকেই আপনাকে পূর্বে দ্যাখেনি, কিন্তু আপনার মুকুট দেখে চিনতে পারবে।”
মহারাজ বললেন, “মুকুট আমার মাথায় থাকবে। আপনি ঘোড়া আনুন, আমি চুপিচুপি রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে সামনের পথে অপেক্ষা করব!” ছম্ভী চলে গেলেন ঘোড়া আনতে, মহাচূড়ামণি ফিরে এলেন প্রাসাদে।
মুকুটটা নেবার পর হঠাৎ তাঁর ইচ্ছে হল রাজকুমার দু’জনকে একবার দেখে যেতে। মহারানির কথা মনে পড়তেই তাঁর বুকখানা হুহু করে উঠল। রাজকুমার দু’জন এখনও বেশ ছোট, তাদের মাকে চম্পক হত্যা করতে চায়। ওঃ, লোকটা এত পাষণ্ড! অথচ, মহারানি চম্পককে বিশেষ স্নেহ করতেন। মহারানির অনুরোধে চম্পককে আগে বেশ কয়েকবার ক্ষমা করেছেন মহারাজ।
মহারানি তলতাদেবীর শয্যাটা খালি। আর-একটি সোনার পালঙ্কে দুই রাজকুমার শুয়ে আছে পাশাপাশি। দু’জনেই গভীর ঘুমে মগ্ন।
মহাচূড়ামণি সেই পালঙ্কের পাশে এসে একটুক্ষণ সস্নেহে তাকিয়ে রইলেন দুই পুত্রের দিকে।
তারপর নিঃশব্দে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রথমে বড়কুমার দৃঢ়র কপালে একটি চুম্বন দিলেন। দৃঢ়র ঘুম ভাঙল না, সে পাশ ফিরে শুল।
মহাচূড়ামণি একটু সরে এসে চুম্বন করলেন ছোটকুমার তীক্ষ্ণর কপালে। তীক্ষ্ণ সঙ্গে-সঙ্গে চোখ মেলে তাকাল।
এত রাত্রে পিতাকে সে কোনওদিন দ্যাখেনি। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
মহাচূড়ামণি তার দিকে চেয়ে হাসলেন। তার গালে হাত বুলিয়ে দিলেন।
তীক্ষ্ণ এবার বললে, “কী হয়েছে, বাবা, কী হয়েছে?”
মহাচূড়ামণি দু’ দিকে মাথা নেড়ে বললেন, “কিছু হয়নি। এমনি তোদের দু’জনকে একবার দেখতে এলাম।”
তীক্ষ্ণ উঠে বসে বলল, “মা কোথায়? মা কোথায়?”
মহাচূড়ামণি সে প্রশ্নের তক্ষুনি উত্তর দিতে পারলেন না। তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তিনি তীক্ষ্ণকে কোলে নিয়ে সারা ঘর ঘুরতে লাগলেন।
তারপর তাঁর মনে পড়ল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। তিনি তীক্ষ্ণকে আবার পালঙ্কের ওপর নামিয়ে দিয়ে বললেন, “ঘুমোও কুমার। মা আসবেন, সকালেই ফিরে আসবেন।”
দু’জন প্রহরীকে ডেকে সেই কক্ষের সামনে সর্বক্ষণ পাহারা দিতে বললেন তিনি। তারপর মাথায় মুকুট পরে, কোমরে হিরণ্যক তলোয়ার ঝুলিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন রাজপ্রাসাদ থেকে।