৫
মহারাজ মহাচূড়ামণি রানির ঘরে চুপ করে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। তাঁর খুব মন খারাপ। কিন্তু কেন যে তাঁর মন খারাপ হয়েছে, সেটাই তাঁর মনে পড়ছে না।
রানি তলতাদেবী নানারকম প্রশ্ন করেও কিছু জানতে পারেননি। রাজার মন ভাল করার অনেক চেষ্টা করলেন তিনি, তবু রাজার মুখে হাসি ফুটল না। তিনি রানির মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন শুধু।
এক সময় রানিকে চলে যেতে হল রাজকুমারদের খাবারের ঘরে। খাওয়ার পর মায়ের কাছে দু’-একটা গল্প না শুনলে ওরা শুতে যেতেই চায় না।
মহারাজ তবু একা বসে রইলেন পালঙ্কের ওপর। তাঁর ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না, খেতে ইচ্ছে করছে না, কারও সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম করে। ঘন-ঘন বিদ্যুৎ চমকে ঘর একবার ঝলসে যাচ্ছে আলোয়, পরের মুহূর্তেই আবার অন্ধকার।
ঝড়ের ধাক্কায় উদ্যানের কটি বড় গাছ ভেঙে পড়েছে। সেই গাছে অনেক পাখির বাসা ছিল। সেই পাখিগুলি ভয় পেয়ে অসহায়ভাবে ডাকতে শুরু করেছে। মহারাজ একটুক্ষণ কান পেতে সেই পাখির ডাক শুনলেন, তারপর উঠে এলেন দরজার কাছে।
সঙ্গে-সঙ্গে দু’জন প্রতিহারী এসে দাঁড়াল দু’পাশে। মহারাজ যখন যেদিকে যান, এরা আগে-আগে ছুটে চলে আর মহারাজের নাম ঘোষণা করে।
এখন মহারাজ মহাচূড়ামণি বিরক্তভাবে হাত নেড়ে তাদের সরে যেতে বললেন। অমনি তারা অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। মহারাজ একাই ঘুরতে ঘুরতে এক সময় এসে হাজির হলেন রাজকুমারদের শয়নকক্ষে।
এই ঘরটিতে মহারাজ আগে কখনও আসেননি। এই রাজপ্রাসাদে যে কতগুলো ঘর আছে, তা তিনি নিজেই জানেন না।
মস্ত বড় পালঙ্কের ওপর দুই রাজকুমার শুয়েছে দু’দিকে, মাঝখানে পা ছড়িয়ে বসে আছেন রানি তলতাদেবী। তিনি দু’হাতে দু’জনের মাথায় চাপড় দিতে দিতে তাদের দধীচি মুনির গল্প শোনাচ্ছেন।
মহাচূড়ামণি নিজেও এই গল্পটা জানেন না। তিনি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলেন। দেবরাজ ইন্দ্র এসেছেন দধীচি মুনির কাছে তাঁর শরীরের হাড় চাইতে, এইটুকু বলা হতেই ঘুমিয়ে পড়ল দুই রাজকুমার, তলতাদেবীও থামিয়ে দিলেন গল্প।
মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, “তারপর?”
তলতাদেবী ফিসফিস করে বললেন, “এখন থাক। পরে আমি আপনাকে বাকিটা শোনাব। রাজকুমাররা জেগে উঠলে অনেক দুষ্টুমি করবে, তখন তাদের ঘুম পাড়ানো আরও কঠিন হবে।”
ছেলেদের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে তলতাদেবী নেমে এলেন পালঙ্ক থেকে। পা টিপে মহারাজের কাছে এসে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার কী হয়েছে বলুন তো! আজ সব কিছুই অন্যরকম দেখছি। রাজকুমারদের ঘরে তো আপনাকে কখনও আসতে দেখিনি!”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহারাজ বললেন, “হ্যাঁ, আমার আজ কী যেন হয়েছে! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”
রানি বললেন, “তা হলে আমি এক্ষুনি রাজবৈদ্যকে ডাকছি। তিনি এসে আপনাকে ওষুধ দেবেন।”
মহারাজ বললেন, “না, না, ওষুধ খাবার দরকার নেই। ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা রানি, আজ আমি এই রাজকুমারদের ঘরে শুতে পারি না?”
রানি তলতাদেবী দারুণ অবাক হয়ে বললেন, “আপনি এই ঘরে শোবেন? তাতে আপনার ঘুম হবে? আপনার একার জন্যই এর চেয়ে বড় পালঙ্ক লাগে!”
“আজ এখানেই শুতে ইচ্ছে করছে।”
“তা হলে রাজকুমারদের জাগিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি আমার ঘরে।”
“ওদের জাগাবে কেন? আমি রাজকুমারদের পাশেই শোবো ঠিক করেছি।”
“মহারাজ, আপনার কষ্ট হবে। এই পালঙ্কে সকলের জায়গা হবে না।”
“হোক একটু কষ্ট। রানি, আমি শুনেছি, সাধারণ প্রজারা স্ত্রী আর পুত্র-কন্যাদের নিয়ে এক ঘরে এক বিছানায় শোয়। আমি কোনওদিন আমার ছেলেদের সঙ্গে শুইনি। একদিন দেখিই না কেমন লাগে!”
“মহারাজের যেমন ইচ্ছে! আমি তা হলে নিজের ঘরে যাই?” মহাচূড়ামণি রানিকে বাধা দিয়ে বললেন, “না, না, তুমি যাবে কেন? তোমাকেও এখানেই থাকতে হবে আজ।”
মহারাজের যখন একটা খেয়াল চেপেছে, তখন তা মেনে নিতেই হবে। ঘুমন্ত রাজকুমারদের এক পাশে শুলেন মহাচূড়ামণি, অন্য পাশে তলতাদেবী। জায়গা এতই কম যে মহারাজকে কাত হয়ে শুতে হল। তবু তিনি বললেন, “আঃ! বেশ ভাল লাগছে।”
রাজকুমারদের ঘুমের ব্যাঘাত হবে বলে তলতাদেবী কোনও কথা বললেন না, তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন একটু পরেই।
কিছুক্ষণ পরেই তাঁর শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগল। মহাচূড়ামণি তাঁকে ঠেলে ঠেলে ডাকছেন।
মহাচূড়ামণি বললেন, “রানি, ওঠো, ওঠো, আমার মনে পড়েছে। মনে পড়ে গেছে! তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে!”
রানি তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন পালঙ্ক থেকে। অনুনয় করে বললেন, “মহারাজ, যদি কিছু বলতে চান, ঘরের বাইরে চলুন। রাজকুমারদের জাগাবেন না।”
দু’জনেই একটু দূরে অন্য একটা কক্ষে চলে এলেন। এটা মহারাজের নিজস্ব অস্ত্র-কক্ষ। মহারাজ ছেলেবেলা থেকে যতরকম অস্ত্র ব্যবহার করেছেন, সেইসব ঢাল-তলোয়ার-গদা-তীর-ধনুক দেওয়ালে সাজানো রয়েছে।
বৃষ্টি এখনও থামেনি। বহুদিন অনাবৃষ্টির পর আজ আকাশ একেবারে দরাজ ভাবে বৃষ্টি ঢেলে দিচ্ছে। বাতাস এখন বেশ ঠাণ্ডা।
জানলার ধারে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন মহাচূড়ামণি।
তলতাদেবী কাছে এসে মৃদু গলায় বললেন, “মহারাজ, আমাকে ডেকে তুললেন, কই কিছু বলছেন না তো!”
মহাচূড়ামণি মুখ ফেরালেন। তাঁর দু’চোখে জল। শিশুর মতন অভিমান আর কান্না-ভরা গলায় বললেন, “রানি, আমি তোমাকে এত ভালবাসি; তুমি আমার পুত্রদের জননী। তবু তুমি আমাকে খুন করতে চাও?”
রানি তলতাদেবী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্ময়ে তাঁর সুন্দর পাখির ডানার মতন ভুরু দুটি যেন কপাল ছাড়িয়ে যেতে চাইল। হাহাকারের সুরে তিনি বললেন, “এ কী কথা বলছেন মহারাজ? এ কী সাঙ্ঘাতিক অলুক্ষণে কথা!”
মহাচূড়ামণি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “আমাকে খুন করলে কি তুমি সুখী হবে? একটা বড় গাছ পড়ে গেলে কি পাখিরা সুখী হয়?”
রানি তলতাদেবী এবার মহারাজের পায়ের কাছে বসে পড়ে আকুলভাবে বললেন, “মহারাজ, এমন পাপ-কথা আর একবারও উচ্চারণ করবেন না। আপনি শুধু বড় গাছ কেন, আপনি পর্বত। আপনি এ রাজ্যের সকলকে আশ্রয় দিয়েছেন। পর্বতকে কি কেউ কখনও সরাবার কথা চিন্তা করতে পারে? এমন অদ্ভুত চিন্তা আপনার মাথায় এল কী করে, মহারাজ?”
মহাচূড়ামণি দু’হাত দিয়ে তলতাদেবীকে তুলে ধরে বললেন, “আমি বোকা, আমার তেমন বুদ্ধি নেই, আর তোমার খুব বুদ্ধি! আমাকে সরিয়ে দিয়ে তুমি এই রাজ্যের ভার নিতে চাও?”
তলতাদেবী বললেন, “মহারাজ, আমি এমন কথা কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি!” মহাচূড়ামণি বললেন, “তোমার বিয়ের আগে তুমি পুরুষের মতন পোশাক পরতে। তুমি তলোয়ার চালনা শিখেছিলে। তোমার পিতা ভল্লদেব তোমাকে তাঁর সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন, তাই না? তুমি সেইভাবে তৈরি হচ্ছিলে।”
তলতাদেবী বললেন, “আমার তখন কোনও ভাই ছিল না। সেইজন্যই আমার পিতা আমাকে তাঁর উত্তরাধিকারিণী হিসেবে তৈরি করছিলেন। তাতে আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনও প্রশ্ন ছিল না। সে রাজ্য তো এখন আমাদেরই রাজ্যের অধীন। আমরাই সেই সিংহাসন পেয়েছি। সেজন্য তো আর কোনও ক্ষোভ থাকার কথা নয়!”
মহাচূড়ামণি বললেন, “সিংহাসনে বসেছি আমি, তুমি তো বসোনি! তোমার সিংহাসনের ওপরে এখনও লোভ আছে।”
হঠাৎ দেওয়াল থেকে দুটি তলোয়ার খুলে নিয়ে মহাচূড়ামণি তার একটি ছুঁড়ে দিলেন তলতাদেবীর দিকে। তাঁর চোখে এখন কান্না নেই। কঠোর স্বরে তিনি বললেন, “তুমি কেমন অস্ত্র চালনা শিখেছিলে, পরীক্ষা করে দেখি তো! আমার সঙ্গে পারবে?”
তলতাদেবী দারুণ করুণস্বরে বললেন, “আমি তেমন কিছুই শিখিনি, মহারাজ! আপনার সঙ্গে আমি প্রতিযোগিতায় নামতে পারি? আপনি সিংহের মতন শক্তিশালী ও তেজস্বী আর আমি এক শশক!”
“কথা শুনতে চাই না, অস্ত্র ধরো!”
“মহারাজ, শান্ত হয়ে, দয়া করে আমার কথা শুনুন। আমি আপনার সঙ্গে লড়াই করব, এও কি সম্ভব?”
“আমি তোমার ওপর আঘাত হানব। যদি প্রাণে বাঁচতে চাও তো…” মহাচূড়ামণি তরবারি চালিয়ে দিলেন রানি তলতাদেবীর মাথা লক্ষ্য করে। রানি নিতান্ত আত্মরক্ষার জন্যই অস্ত্র তুললেন। দুই তরবারির সংঘর্ষে ঝনাৎ করে শব্দ হল!
মহাচূড়ামণি একটু পিছিয়ে এসে অস্ত্র টেনে নিয়ে আবার আঘাত করতে গেলেন, রানি তলতাদেবী বিদ্যুৎগতিতে এক পাশে সরে গিয়ে মহারাজের অস্ত্র নিজের অস্ত্রে চেপে ধরলেন।
মহাচূড়ামণি বিস্ফারিত চক্ষে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন রানির দিকে। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “হুঁ, ভালই অস্ত্র শিক্ষা করেছ দেখছি। বড়-বড় বীরপুরুষরাও আমার আঘাত একবারের বেশি সহ্য করতে পারে না। ঠিক আছে, এবার হোক তবে জীবন-মরণ খেলা। দেখি কে হারে আর কে জেতে। তোমার যদি ক্ষমতা থাকে, এখনই আমাকে মেরে সিংহাসন দখল করে নাও!
রানি তলতাদেবী তাঁর হাতের তলোয়ারটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। মহাচূড়ামণি বললেন, “এ কী?”
রানি বললেন, “আপনি আমাকে মারুন, মহারাজ। আমি আর অস্ত্র ছোঁব না কখনও।”
মহাচূড়ামণি তলোয়ার তুলে বললেন, “আমি তোমায় সত্যি মারব কিন্তু!”
তলতাদেবী এক পা এগিয়ে এসে বললেন, “আমি মরতেই চাই। আপনি আমাকে মিথ্যে সন্দেহ করেছেন, এর পর আর আমার বাঁচার একটুও ইচ্ছে নেই। শুধু এইটুকু শুনে রাখুন, মহারাজ, আপনি আমার স্বামী, আমার প্রভু, আপনাকে সরিয়ে দেবার মতন পাপ চিন্তা কোনওদিন আমার মাথায় আসেনি। সিংহাসনের প্রতি কখনও আমি লোভ করিনি।”
মহাচূড়ামণি বললেন, “কেউ অস্ত্র ত্যাগ করলে তাকে আমি মারতে পারি না। তাকে আমি বন্দী করি।”
তলতাদেবী বললেন, “আপনি আমাকে বন্দী করুন, কিংবা শূলে দিন, যা খুশি করুন। আমি আর এক মুহূর্তও বেঁচে থাকতে চাই না!”
মহাচূড়ামণি বললেন, “তুমি সত্যিই সিংহাসন চাওনি?”
তলতাদেবী বললেন, “এই কথা বারবার শুনতেও আমার শরীর ঘৃণায় জর্জরিত হচ্ছে। আপনি আমাকে মারতে দ্বিধা করছেন, আমি নিজেই তবে আত্মঘাতিনী হব!”
তলতাদেবী মাটিতে বসে পড়ে তরবারিটি তুলে নিজের গলায় কোপ মারতে গেলেন।
এমন সময় দরজার কাছ থেকে রাজকুমার দৃঢ় ডেকে উঠল, “মা!” হঠাৎ ঘুম ভেঙে কিছু শব্দ শুনে রাজকুমার দৃঢ় উঠে এসেছে। রানি তলতাদেবীকে ওই অবস্থায় দেখে সে আর্তনাদ করে উঠল। তাতেই হাত কেঁপে উঠল তলতাদেবীর।
রাজা মহাচূড়ামণি হা-হা করে অট্টহাস্য করে উঠলেন।
তারপর নিজের তরবারিটি মাটিতে ফেলে দিয়ে এক লাফে এগিয়ে এসে তলতাদেবীর হাত থেকে তরবারিটি কেড়ে নিলেন।
পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরে, বড়কুমারের ঘুম ভেঙে গেল! আমরা খুব চ্যাঁচামেচি করছিলাম বুঝি! আমরা আসলে খেলা করছিলাম। জানিস দৃঢ়, তোর মা তলোয়ার খেলায় আমার কাছে হেরে গেছে। তাই ওরকমভাবে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল! ওঠো, রানি, ওঠো!”
দৃঢ় ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। তলতাদেবী কান্না সামলাতে পারছেন না। কান্নায় তাঁর শরীর কেঁপে-কেঁপে উঠছে।
মহাচূড়ামণি হাঁক দিয়ে বললেন, “ওরে কে আছিস?”
সঙ্গে-সঙ্গে একজন দাসী এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। মহাচূড়ামণি তাকে আদেশ দিলেন, “যাও, বড়কুমারকে আবার বিছানায় নিয়ে যাও!”
দাসী বড়কুমার দৃঢ়কে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই মহাচূড়ামণি এগিয়ে এসে রানি তলতাদেবীর এক হাত চেপে ধরে আবেগের সঙ্গে বললেন, “রানি, রানি, সত্যিই আমি মূর্খ! আমার মাথায় কিছুই নেই : না হলে, তোমার মতন পুণ্যবতী, গুণবতীকে আমি সন্দেহ করি! ছি ছি ছি। আত্মহত্যা করা উচিত তো আমারই।”
মহাচূড়ামণির মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে তলতাদেবী কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, “মহারাজ, একবার যখন সন্দেহের কাঁটা আপনার মনে বিঁধেছে, তখন তা আর কিছুতেই যাবে না। আমাকে বিদায় দিন, মহারাজ। আমি এ-রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে চাই। আপনি আমার পুত্র দুটিকে দেখবেন।”
মহাচূড়ামণি বললেন, “আমাকে ক্ষমা করো, রানি! বিশ্বাস করো, আমি অন্তর থেকে তোমাকে সত্যিই সন্দেহ করিনি। তুমি চলে গেলে আমার এই রাজ্য চলবে কী করে? তোমার বুদ্ধিতেই তো আমি চলি! শুধু বাহুবল দিয়ে কি আর রাজ্য শাসন করা যায়!”
তারপর তিনি মহাক্রোধে চিৎকার করে উঠলেন, “প্রতিহারী! প্রতিহারী!”
এত রাত্রেও চোখের নিমেষে কয়েকজন প্রতিহারী এসে উপস্থিত হল। তারা আড়াল থেকে সব শুনছিল নিশ্চয়ই। মহারাজ দু’বার ডেকেছেন বলে ওদের মধ্য থেকে ঠিক দু’জন এগিয়ে এল সামনে।
মহারাজ বললেন, ‘এক্ষুনি মহামন্ত্রী জীবককে এখানে ধরে আন। সে যে অবস্থাতেই থাকুক, তাকে তোরা সেই অবস্থায় বহন করে আনবি। একটুও বিলম্ব যেন না হয়!”
প্রতিহারীরা ছুটে বেরিয়ে যাবার পর রানি তলতাদেবী চোখ মুছে পরিচ্ছন্ন হলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “এত রাতে মহামন্ত্রীকে ধরে আনতে বললেন কেন, মহারাজ? তাও এই অন্তঃপুরে?”
মহাচূড়ামণি বললেন, “ওই শয়তান জীবকটাই আমার কানে বিষ ঢেলেছে। সে-ই আমাকে বুঝিয়েছে যে সিংহাসনের প্রতি তুমি লোভী। আসল লোভটা যে কার, এবার আমি বুঝেছি!”
তলতাদেবী বললেন, “মহামন্ত্রী এরকম একটা কথা বলতেই আপনি বিশ্বাস করে ফেললেন? আমাকে কি আপনি চেনেন না? আমার স্বভাব-চরিত্র আপনি বোঝেন না?”
মহাচূড়ামণি বললেন, “ওই তো আমার দোষ। কোনও কিছুই বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বোঝার ধৈর্য রাখতে পারি না! ওই জীবকটা আমাকে বলল কিনা, আমি যাদের শাস্তি দিই, তুমি আবার তাদের ক্ষমা করে দাও। তার মানে, তুমি আমার ক্ষমতা মানো না! তুমি নিজের ক্ষমতা বাড়াতে চাও!”
তলতাদেবী বললেন, “অল্প দোষে আপনি অনেককে বেশি শাস্তি দেন, তাই আমি তাদের ক্ষমা করতে বলি। মানুষকে ক্ষমা করা কি দোষের?”
মহাচূড়ামণি বললেন, “ও আরও বলল, রাজার থেকে রানির বেশি বুদ্ধি থাকা ভাল নয়। রানির একে তো বুদ্ধি বেশি, তার ওপর সিংহাসনের প্রতি তাঁর ছোটবেলা থেকেই লোভ!”
তলতাদেবী বললেন, “বুদ্ধি থাকলেই বুঝি লোভ থাকতে হবে? বড়-বড় মুনি-ঋষিরা কি বুদ্ধিমান নন? আর আপনি এত বড় যোদ্ধা, আপনার বুদ্ধি কম কে বলল? বুদ্ধি না থাকলে কেউ বীর হতে পারে?”
একটু পরেই প্রতিহারীরা মহামন্ত্রী জীবককে টানতে টানতে নিয়ে এল সেখানে। মহাচূড়ামণি প্রথমেই তাঁকে একটি পেল্লায় লাথি কষালেন।
সেই লাথি খেয়ে চিত হয়ে পড়ে গেলেন মহামন্ত্রী।
মহাচূড়ামণি তাঁর বুকের ওপর একটা পা রেখে বললেন, “পাষণ্ড, শয়তান! তুই মহারানির বিরুদ্ধে আমাকে লাগাবার চেষ্টা করেছিলি!”
জীবক বলল, “রক্ষা করুন, মহারাজ। আমি তো সেরকম কথা আপনাকে কখনও বলিনি! মহারানি কত গুণবতী, কত তাঁর দয়া!”
মহাচূড়ামণি গর্জন করে বললেন, “দুরাচার, পামর, নরকের কীট! আবার মিথ্যা কথা বলছিস! আমি অনেক কথা ভুলে যাই বলে ভেবেছিস, তোর এই শয়তানি ভুলব? কাল সকালেই তোকে প্রজাদের চোখের সামনে শূলে চড়াব! লোকে দেখবে বিশ্বাসঘাতকের কী শাস্তি দিই আমি!”
তারপর তিনি পেছন ফিরে রানির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কিছুতেই একে দয়া করার জন্য অনুরোধ করতে পারবে না! তুমি অনুরোধ করলেও এই পাষণ্ডটাকে আমি ক্ষমা করব না!”