১৮
কালাঘর থেকে নেমে এসে ছম্ভী চলে এলেন রাজপ্রাসাদে। ওপরে উঠে দেখলেন, লম্বা টানা বারান্দার মাঝখানে একটা মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমার তীক্ষ্ণ।
ছম্ভী থমকে দাঁড়িয়ে ভুরু কোঁচকালেন। লোহার দ্বারের ওপাশে রাজকুমারের থাকার কথা। সে এ পাশে এল কী করে?
তা ছাড়া ওই মূর্তিটাই বা কার?
প্রথমে তিনি ভাবলেন, হাঁকডাক করে প্রহরীদের ধমকাবেন। তারপর তিনি নিজেই আস্তে আস্তে এগোলেন রাজকুমারের দিকে।
একটা পাথরের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তীক্ষ্ণ, তার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।
ছম্ভী দেখলেন, সেই মূর্তিটা তলতাদেবীর। তিনি দারুণ চমকে উঠলেন। রাজকুমারকে না ডেকে তিনি এগিয়ে গেলেন প্রহরীদের দিকে। যাকে সামনে পেলেন, তার চুলের মুঠি ধরে দাঁতে দাঁত পিষে তিনি বললেন, “পামর, ওই মূর্তিটা এখানে কে এনেছে? কে এনেছে? শীঘ্র বল, নইলে এই মুহূর্তে তোর প্রাণ যাবে!”
ছম্ভীর এরকম উগ্রমূর্তি দেখে প্রহরীটির প্রাণ কণ্ঠাগত হয়ে গেল, ভয়ে তার মুখ দিয়ে কথাই বেরোল না।
ছম্ভী আর-একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “এখনও চুপ করে আছিস?”
প্রহরীটি এবার কাঁপতে কাঁপতে বলল, “প্রভু, রাজবাড়ির বাগানে একজন শিল্পী এই মূর্তিটা গড়েছিল। আমাদের মহারানির মূর্তি। তারপর কে সেটা ওপরে নিয়ে এসেছে আমি জানি না।”
প্রহরীটির বুকে পদাঘাত করে ছম্ভী হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “মহারানির মূর্তি মানে কী রে, হতভাগা? কে মহারানি? জানিস না, এ-রাজ্যে এখন কোনও মহারানি নেই?”
অন্য একজন প্রহরী বলল, “সেই শিল্পীই মূর্তিটা ওপরে এনে বসিয়ে দিয়ে গেছেন। আমি দেখেছি!”
ছম্ভী বললেন, “সেই শিল্পীকে এক্ষুনি ধরে নিয়ে গিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করো। যাও, ছুটে যাও, তাকে ধরার পর আমাকে খবর দেবে। আর এই মূর্তিটাকেও সরিয়ে ফেলবে এই দণ্ডেই!”
তারপর ছম্ভী ধীরে-ধীরে তীক্ষ্ণর কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে কোমল গলায় বললেন, “এখানে কী করছ, কুমার?”
তীক্ষ্ণ বলল, “কিছু না।”
ছম্ভী বললেন, “এই মূর্তিটা দেখতে বিশ্রী হয়েছে। তাই এটা এখানে রাখা হবে না। আমি ভেঙে ফেলতে বলেছি!”
তীক্ষ্ণ জিজ্ঞেস করল, “আমার মা কোথায়?”
ছম্ভী বললেন, “তোমার মাকে তুমি আর দেখতে পাবে না। মাকে তুমি ভুলে যাও, কুমার। তুমি তো আজ নিজের চোখেই দেখলে, সকালবেলা তোমার মা তোমাকে দেখেও পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। উনিই তোমার বাবাকে হত্যা করেছেন। তোমার মা পাপীয়সী। অমন মাকে মনে রাখতে নেই।”
তীক্ষ্ণ চুপ করে গেল।
ছম্ভী বললেন, “এবার শুয়ে পড়বে চলো। তোমার বাবা নেই, মা নেই, এখন থেকে আমিই তোমার বাবা ও মা।”
ছম্ভী আদর করে তীক্ষ্ণকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলেন। তীক্ষ্ণ কোনও আপত্তি করল না। ছম্ভী চলে যাবার পর সে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
ছম্ভীও একটু পরে শুয়ে পড়লেন নিজের শয্যায়। চক্ষু বুজে তিনি কালকের রাত থেকে আজকের রাত পর্যন্ত সব ঘটনা ভাবতে লাগলেন। একদিনের মধ্যে কত কী হয়ে গেল। মহাশক্তিশালী রাজা মহাচূড়ামণি, যাঁকে অন্য কোনও রাজা হারাতে পারেননি, তিনি এখন নিহত। মহারানি তলতাদেবীর বুদ্ধির প্রশংসা করত সবাই, সেই মহারানি এখন অন্ধকার কারাগারে চিরজীবনের মতন বন্দিনী। চম্পক নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখন এই রাজ্য নিষ্কণ্টক। সিংহাসন ছম্ভীর করায়ত্ত।
পরম নিশ্চিন্তভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন ছম্ভী।
খানিকবাদেই তাঁর আবার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি একটা দারুণ দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছেন, ঘামে ভিজে গেছে তাঁর সারা শরীর!
ঘুমের মধ্যে ছম্ভী দেখেছেন একটা বাচ্চা ছেলের মুখ!
রাজা মহাচূড়ামণিকে খাদের মধ্যে ঠেলে দেবার সময় দু’জন সাক্ষী ছিল। একজন মেষপালক আর তার সঙ্গে একটি ছেলে। ছম্ভী সেই মেষপালকটিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কাছে ডেকে এনে তার মুণ্ডু কেটে দিয়েছিলেন, কিন্তু ওই ছেলেটা যে পালিয়ে গেল! পৃথিবীতে ওই ছেলেটিই একমাত্র জানে যে, ছম্ভীই রাজা মহাচূড়ামণির হত্যাকারী।
এই ছেলেটিকে তো বাঁচতে দেওয়া যায় না।
ধড়মড় করে উঠে পড়ে ছম্ভী দ্রুত পোশাক পরতে লাগলেন। উত্তেজনায় তাঁর শরীর কাঁপছে।
ঘর থেকে বেরোতেই প্রহরীরা উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম জানাল তাঁকে। ছম্ভী বললেন, “সেনানায়ক ভামহ কোথায়? শিগগির তাঁকে ডাকো!”
ছম্ভী নিজেই দৌড়ে চলে এলেন রাজপ্রাসাদের বাইরে।
সেনানায়ক ভামহ তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। জরুরি ডাক পেয়ে তিনি ছুটে এলেন।
ছম্ভী তাঁকে একপাশে ডেকে বললেন, “তুমি শিগগির দশজন অতি বিশ্বাসী সৈন্যকে প্রস্তুত হতে বলো। আমার সঙ্গে যেতে হবে!”
ভামহ হাত জোড় করে বললেন, “এত রাতে কোথায় যেতে হবে, প্ৰভু?”
ছম্ভী বললেন, “প্রশ্ন কোরো না। মনে রাখবে, আমার প্রত্যেকটি কথাই আদেশ। আমি অবিলম্বে রওনা হতে চাই। তুমিও যাবে আমার সঙ্গে।”
একটু পরেই দশজন অশ্বারোহী সৈন্য ও ভামহকে সঙ্গে নিয়ে ছম্ভী বেরিয়ে পড়লেন।
ভামহের পাশ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যেতে-যেতে ছম্ভী বললেন, “আমি একটু আগে একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমি দেখলাম, কুরালা নামে একটি গ্রামে একটি বালক আছে। এই বালকটির কপালে একটা তিল আছে। বড় অশুভ লক্ষণ। যার কপালে এইরকম তিল থাকে, সে বড় হয়ে রাজ-হত্যাকারী হয়। এই বালক নিশ্চিত বড় হয়ে আমাদের রাজকুমার তীক্ষ্ণকে হত্যা করবে! সুতরাং এখনই সেই বালকটিকে বন্দী করা দরকার। নইলে রাজ্যের সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
শিউরে উঠে ভামহ কপালে হাত চাপা দিলেন। তাঁর কপালেও তো তিল আছে একটা।
ভামহের এই ভাবান্তর ছম্ভীর চোখ এড়াল না। তিনি বললেন, “তোমার কপালে যেটা আছে, ওটা তিল নয়, আঁচিল। ওতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যাদের কপালে লাল তিল থাকে, তারা অতি সাঙ্ঘাতিক হয়! সুতরাং যে-কোনও উপায়ে এই বালকটিকে খুঁজে বার করতেই হবে। আজ রাত্রের মধ্যেই। যদি কখনও কোনও দিকের প্রজারা বিদ্রোহ করে, তখন তারা এই বালকটিকে কাজে লাগাতে পারে।”
অন্ধকার রাস্তায় ঘোড়ার খুরের খটাখট শব্দ হতে লাগল। অশ্বারোহীরা এগিয়ে চলল পাহাড়ের দিকে।
কুরালা গ্রামটি পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায়। তারপর আর কোনও জনবসতি নেই।
সেই গ্রামের প্রান্তে এসে ছম্ভী ঘোড়া থেকে নেমে একটা পাথরের ওপর বসলেন। একজন সৈন্য একটি মশাল জ্বেলে তাঁর পাশে রাখল।
ছম্ভী বললেন, “এবার তোমরা যাও, গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়ি তল্লাশ করো। এ-গ্রামের ছয় থেকে বারো বছর পর্যন্ত সব ছেলেদের আমার সামনে এনে হাজির করাও।”
গ্রামটি একেবারে ঘুমন্ত। ঘুটঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে ঝিঝি ডাকছে। এরই মধ্যে সৈন্যরা এক-একটা বাড়িতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। ঘুম ভেঙে লোকেরা উঠে এলে সৈন্যরা তাদের ঠেলে ঢুকে পড়ছে ঘরের মধ্যে। বিছানা থেকে টেনে-টেনে তুলতে লাগল বাচ্চাদের। মেয়েদের ছেড়ে দিয়ে শুধু ছেলেদের টেনে টেনে আনতে লাগল বাইরে। ছম্ভীর সামনে।
ছম্ভী এক-এক করে তাদের পরীক্ষা করতে লাগলেন। মশালটা মুখের সামনে এনে দেখলেন ভাল করে। সকালবেলার ছেলেটিকে তিনি সামান্য একটুক্ষণের জন্য দেখেছিলেন, তবু ভোলেননি। ছেলেটির মুখ লম্বা মতন, টানা-টানা চোখ, টিকলো নাক, মাথা ভর্তি চুল, তার ডান দিকের ভুরুর ওপর বোধহয় একটা কাটা দাগ ছিল।
এক-একটি ছেলেকে সামনে দাঁড় করিয়ে ছম্ভী তার মুখখানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। কারও মুখ গোল, কারও নাক থ্যাবড়া। ছম্ভী তাদের বাতিল করে দিতে লাগলেন।
একজনের মুখ লম্বাটে কিন্তু চোখ দুটো ছোট-ছোট। তবু ছম্ভী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর নাম কী?”
ছেলেটি জানাল যে তার নাম ভল্ল।
ছম্ভী জিজ্ঞেস করলেন, “তুই আজ সকালে কোথায় গিয়েছিলি?”
ছেলেটি বলল, “কোথাও তো যাইনি, বাড়িতে ছিলাম।”
ছম্ভী বললেন, “তোর বাবা কোথায়?”
ছেলেটি বলল, “বাবা ওই তো দাঁড়িয়ে!”
ছেলেটির বাবাকে ডেকে আনানো হল। ছম্ভী তাকেও দেখলেন। সে একটি নিরীহ, রোগা মতন লোক। ছম্ভী বললেন, “এরা অন্য। সেই ছেলেটির বাবা বেঁচে থাকতে পারে না।”
আর-একটি ছেলেকে দেখা গেল, তার মুখ লম্বাটে, নাকও টিকলো। তার ডান দিকের ভুরুর ওপর অবশ্য কাটা দাগ নেই। কপালে তিল অবশ্য এ-পর্যন্ত একজনেরও দেখা যায়নি।
ছম্ভী এই ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই, তোর নাম কী রে?”
ছেলেটি চুপ করে রইল।
ছম্ভী ধমক দিয়ে বললেন, “উত্তর দিচ্ছিস না কেন? তোর নাম জানিস না?”
ছেলেটি তবু কোনও কথাই বলল না।
ছম্ভী এবার ঠাস করে একটা চড় কষালেন ছেলেটির গালে।
একজন প্রৌঢ় লোক হাউ হাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে এসে বলল, “প্রভু, ওকে মারবেন না, মারবেন না। ও কথা বলতে পারে না। আমার এই নাতিটা বোবা!”
এই কথাটা শুনে ছম্ভীর আরও সন্দেহ হল। ভুরু কুঁচকে তিনি বললেন, “বোবা? আমার সামনে মিথ্যে কথা বলছিস? ছেলেটা বোবা কি না পরীক্ষা করে দেখছি। এর বাবা কোথায়!”
প্রৌঢ়টি বলল, “প্রভু এর বাবা মারা গেছে। আমি ওকে মানুষ করেছি।”
ছম্ভী আরও সন্দেহের সঙ্গে বললেন, “ওর বাবা মারা গেছে? কবে?”
প্রৌঢ়টি বলল, “ওর বাবা মারা গেছে এক বছর আগে। জঙ্গলে গিয়ে ভাল্লুকের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে সে প্রাণ দিয়েছে।”
ছম্ভী বললেন, “একবছর আগে, না আজই সকালে সে মরেছে?”
প্রৌঢ় বলল, “আজ নয় হুজুর, বছর পার হয়ে গেছে!”
ছম্ভী হঠাৎ তাঁর মশালটা নিয়ে ছেলেটির হাতে ছ্যাঁকা দিয়ে দিলেন। ছেলেটি যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না।
ছম্ভী বললেন, “হুঁ।”
তারপর একজন সৈন্যকে ডেকে বললেন, “ওর পা দুটো ধরে উলটো করে ঝুলিয়ে ধরো তো!”
সৈন্যটি সঙ্গে-সঙ্গে ছম্ভীর আদেশ পালন করল।
ছেলেটির মুখ নীচে, পা দুটো ওপরে। সে ছটফট করছে, তবু চিৎকার করে উঠল না একবারও।
ছম্ভী একটুক্ষণ সে-দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “সত্যিই দেখছি ছেলেটি বোবা! এইটুকু ছেলের এতখানি সহ্য শক্তি থাকতে পারে না। ওকে ছেড়ে দাও!”
একে-একে সব বালককেই পরীক্ষা করে দেখলেন ছম্ভী। কারও সঙ্গেই সকালের সেই ছেলেটির মিল পাওয়া গেল না।
একসময় ক্লান্ত হয়ে ছম্ভী উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘোড়ার পিঠে চড়ে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, “ভামহ, গোটা গ্রামটাতেই আগুন লাগিয়ে দাও। দেখো, যেন কেউ পালাতে না পারে। সেই ছেলেটাকে এরা নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে, সেজন্য এদের সবাইকেই শাস্তি পেতে হবে।