১৭
চম্পককে শূলে চড়ানো হল দ্বিপ্রহরের আগেই। তার মুখ বাঁধা রইল, শেষ মুহূর্তেও সে একটা কথাও বলতে পারল না। ছম্ভীর কাছ থেকে ভরসা পেয়ে সে রাজা হবার আশা নিয়ে ছুটে এসেছিল রাজধানীতে, সেই ছম্ভীর আদেশেই প্রাণ দিতে হল তাকে।
মহারানি তলতাদেবী ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে যেতে গিয়ে এক সময় বাধা পেলেন। তিনি ঠিক করেছিলেন যে, কোনওক্রমে সীমান্ত পেরিয়ে গিয়ে তিনি তাঁর পৈতৃক রাজ্যে আশ্রয় নেবেন। কিন্তু সীমান্তের দিকে আগে থেকেই সৈন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। তলতাদেবী এক জায়গায় এসে দেখলেন, তাঁর সামনেও সৈন্য, পেছন দিকেও সৈন্য, সবাই তাঁকে ধরতে আসছে।
তখন তলতাদেবী ঠিক করলেন, তিনি আত্মহত্যা করবেন। ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে ধরা দিয়ে তিনি কিছুতেই অপমানের জীবন বরণ করে নেবেন না। তলোয়ারটা তুলে গলায় কোপ মারতে গিয়েও তিনি থমকে গেলেন। তিনি আত্মহত্যা করলে তাঁর ছেলে দুটির কী হবে? দৃঢ় আর তীক্ষ্ণ দু’জনেই ছোট। মাকে ছাড়া ওরা কী করে বাঁচবে?
তলতাদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তলোয়ারটা ফেলে দিলেন।
প্রহরীরা তাঁকে ঘিরে ধরল। ঘোড়ার ওপর বসিয়ে রেখেই তাঁকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল আষ্টেপৃষ্ঠে।
এদিকে রাজবাড়ির যে অংশটাতে মহারাজ আর মহারানি থাকতেন, সেই অংশটা নতুন করে সাজিয়ে নিলেন ছম্ভী। একেবারে শেষ ঘরটা তিনি রাখলেন নিজের জন্য। তার সামনের ঘরটিতে থাকবে তীক্ষ্ণ। এর পরে একটি সুদৃঢ় লোহার দ্বার, সেই দ্বারের সামনে বসে থাকবে অতি বিশ্বাসী চারজন প্রহরী। ছন্তা আদেশ দিয়ে রাখলেন, “কোনও মানুষ তো দূরের কথা, কোনও পক্ষী-পিঁপড়েও যেন এ লোহার দ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকতে না পারে।”
সব ব্যবস্থা পাকা করার পর ছম্ভী কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন মহাচূড়ামণির মণি-মাণিক্যখচিত পালঙ্কে।
একসময় প্রহরীদের ডাকে তাঁর ঘুম ভাঙল। লৌহদ্বারের বাইরে এসে তিনি দেখলেন সেনানায়ক ভামহ দাঁড়িয়ে আছে। ছম্ভীকে দেখে হাত জোড় করে সে প্রণাম জানাল।
ছম্ভী জিজ্ঞেস করল, “কী বার্তা, সেনানায়ক?”
ভামহ বলল, “গুরুদেব, আপনার সব আদেশ পালিত হয়েছে। রাজ্যের সর্বত্র সৈন্যদের ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে কোথাও সামান্য কোনও বিদ্রোহের চিহ্ন দেখা গেলেই তারা দমন করতে পারে। সেরকম কোনও চিহ্ন এখনও কোথাও দেখা যায়নি। মহারানি তলতাদেবীও ধরা পড়েছেন।
ছম্ভী ধমক দিয়ে বললেন, “মহারানি মানে? কে মহারানি? এ-রাজ্যের তো কোনও মহারানি নেই এখন? বলো, তলতাদেবী!”
এ-রাজ্যের সাধারণ মানুষ ও সৈন্যরা কখনও রাজা বা রানির নাম উচ্চারণ করে না। ভামহ আড়ষ্ট গলায় বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ। উনিই ধরা পড়েছেন। ওঁকে কি এখানে নিয়ে আসব?”
ছম্ভী আরও জোর গলায় বললেন, “খবরদার, না! তলতাদেবী আর কোনওদিন এই রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে পারবেন না, একথা মনে রেখো। তিনি এখন কোথায়?”
ভামহ বলল, “তাঁকে রাজউদ্যানের মাঝখানে ধরে রাখা হয়েছে। তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে কি না, সে বিষয়ে আমরা আপনার আদেশের অপেক্ষায় রয়েছি।”
ছট্টী বললেন, “এখানকার কারাগারে নয়, পাহাড়ের ওপরে কালাঘরে নিয়ে যাও। সেখানে কড়া পাহারায় ওঁকে রাখবে। আমি সন্ধের সময় কালাঘরে যাব। সাবধান, এই বন্দিনী যেন কোনওক্রমে আর না পালায়!”
ভামহ বলল, “না গুরুদেব, সে ব্যবস্থা আমরা করব। ওঁকে কি কিছু খেতে দেওয়া হবে?”
ছম্ভী বললেন, “তা দিও। যা খেতে চান উনি সব দিও। আমি তো ওঁকে মৃত্যুদণ্ড দিইনি, কারাদণ্ড দিয়েছি মাত্র। ওঁকে না খাইয়ে রাখবার দরকার নেই।”
ভামহ এবং অন্য প্রহরীরা দূরে সরে গেলে ছম্ভীর মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। এ-রাজ্যের আর কোনও প্রজা এখনও বিদ্রোহ করেনি। তলতাদেবীও ধরা পড়েছেন। এখন ছম্ভীর আর কোনও প্রতিপক্ষ রইল না।
বিকেলবেলা ছম্ভী রাজসভায় গিয়ে কিছুক্ষণ রাজকার্য পরিচালনা করলেন। তিনি বসলেন ভূতপূর্ব মহারাজ মহাচূড়ামণির সিংহাসনে। কিন্তু তিনি মুকুটটা মাথায় দেননি। তাঁর অঙ্গে পুরোহিতের পট্টবস্ত্র। রাজ্যের কোথায় কী ঘটছে, তার সবই খুঁটিনাটি তিনি জানেন, কর্মচারিদের প্রয়োজন মতো নির্দেশ দিলেন।
একটু পরে তিনি একটি রথে চেপে চালককে বললেন, “কালাঘর চলো।”
রাজধানী থেকে কিছুটা দূরে একটা ছোট পাহাড়ের ওপর কালাঘর একটি কুখ্যাত জেলখানা। অন্যান্য জেলখানার সঙ্গে এর তফাত এই যে, এখানে কয়েদিদের সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসতে পারে না। কয়েদিরাও চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কখনও আলো দেখতে পায় না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তাদের কাটাতে হয় অন্ধকার ঘরে। তারা নিজেদের মুখ দেখতে পায় না, হাত-পা দেখতে পায় না, কখন যে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, তাও টের পায় না। এই রকম অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখন অন্ধ হয়ে যায় তাবা।
ছম্ভী সেই কালাঘরের প্রধান দ্বারে এসে রথ থেকে নামলেন। চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে বুঝে নিলেন, এই কারাগার থেকে কোনও জীবন্ত মানুষের পালাবার উপায় নেই। একেবারে নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা।
লম্বা সিঁড়ি বেয়ে তিনি উঠে এলেন ওপরে।
একজন প্রহরী একটা মশাল জ্বেলে নিল, তারপর সেই মশালের আলোয় পথ দেখে ছম্ভী প্রহরীটির সঙ্গে একটার পর একটা কক্ষ পার হয়ে এলেন।
একেবারে শেষ কক্ষটির সামনেটা বড়-বড় লোহার শিক দিয়ে ঘেরা। সেখানে এসে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পেলেন তলতাদেবীকে। কালো মেঘের মধ্যে প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া চাঁদের মতন সেই অন্ধকার ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছেন তলতাদেবী।
ছম্ভী বিদ্রূপের স্বরে বললেন, “ওহে প্রাক্তন রানি, তা হলে তুমি শেষ পর্যন্ত পালাতে পারলে না?”
তলতাদেবী উঠে বসে ছম্ভীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর দু’হাত জোড় করে বললেন, “প্রণাম, গুরুদেব।”
ছম্ভী হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বললেন, “বেঁচে থাকো! তুমি আয়ুষ্মতী হও!”
তলতাদেবী বললেন, “গুরুদেব, আপনাকে সবাই বিশ্বাস করি, শ্রদ্ধা করি। তবু আপনি মিথ্যে কথা বলে আমাকে চম্পকের কাছে পাঠালেন!”
ছম্ভী হা-হা করে হেসে উঠলেন খুব জোরে। তারপর বললেন, “তুমি নিজের বুদ্ধির খুব গর্ব করতে, তাই না? তুমি মনে করতে, এ রাজ্যে তোমার মতন বুদ্ধি আর কারও নেই। তুমি সামান্য একটা কৌশলে দাবানল নিভিয়ে দিয়েছিলে, তাই তোমার স্বামী রাজা মহাচূড়ামণি আমাদের সকলকে বোকা বলে অপমান করেছিল। এবার বুঝলে, কে আসল বুদ্ধিমান? যে শেষ পর্যন্ত জেতে, তার বুদ্ধিই সবচেয়ে বেশি।”
তলতাদেবী বললেন, “মহারাজ আপনাকে সব সময় মান্য করতেন। তিনি সরল মানুষ ছিলেন। তবু আপনি তাঁকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করলেন?”
ছম্ভী বললেন, “আমি তাকে হত্যা করেছি? তুমি এখন এ-কথা চিৎকার করে বললেও কেউ শুনতে পাবে না। মহাচূড়ামণি মারা গেছেন নিজের বোকামির জন্য। অত কম বুদ্ধি নিয়ে কি কোনও রাজা রাজ্য চালাতে পারেন? কোনও রাজা কি কখনও অন্য কাউকে বিশ্বাস করে একা অত উঁচু খাড়া পাঁচিলে ওঠেন? তার তো মরাই উচিত!”
তলতাদেবী বললেন, “আপনি কিসের লোভে এত সব খারাপ কাজ করলেন গুরুদেব? আপনার কিসের অভাব ছিল?”
ছম্ভী বললেন, “তোমার বুদ্ধির অহঙ্কারই আমার অসহ্য ছিল। তুমি নারী হয়েও সকলের ওপরে উঠে গিয়েছিলে। তাই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বুদ্ধির খেলায় তুমি জিতবে, না আমি জিতব, তা শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে। তুমি এত সহজে হেরে গেলে, তলতাদেবী! ছি ছি ছি. তুমি এখন অন্ধকার কারাগারে ধূলায় গড়াচ্ছ!”
তলতাদেবী বললেন, “আমি তো আপনার সঙ্গে বুদ্ধির খেলা খেলতে যাইনি। আমি আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম!”
ছম্ভী বললেন, “রাজ্য যাঁরা চালান, তাঁরা কাউকেই পুরো বিশ্বাস করেন না। তুমি ভুল করেছ, তাই তোমার এই দশা।”
“আপনি পুরোহিত হয়েও সিংহাসনের ওপর লোভ করেছিলেন?”
“কেন, পুরোহিত বুঝি রাজা হতে পারে না? আমি ইচ্ছে করলেই মাথায় রাজমুকুট পরতে পারতাম। তা আমি পরিনি। কিন্তু এই রাজ্য এখন আমার হাতের মুঠোয়। আমি যেমনভাবে খুশি এই রাজ্য চালাব!”
“আপনি অন্যায়ভাবে সিংহাসন দখল করেছেন। এ-সিংহাসন আপনি বেশিদিন রাখতে পারবেন না।”
“তুমি বুঝি মনে-মনে ভেবে রেখেছ, এখান থেকে কোনওক্রমে পালিয়ে গিয়ে প্রজাদের আমার বিরুদ্ধে খ্যাপাবে! সে গুড়ে বালি! তোমার জন্য কী ব্যবস্থা করেছি শুনে রাখো। তুমি সারা জীবন এই অন্ধকার ঘরে কাটাবে। এখান থেকে কেঁদে-কেঁদে চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না। একজন বোবা-কালা সৈন্য শুধু দু’ বেলা তোমার খাবার দিয়ে যাবে। এখান থেকে তোমার পালাবার কোনও উপায় নেই। তবু যদি কোনওক্রমে বাইরে বেরোতে পারো, তা হলে কী হবে, সেটাও শুনে রাখো। তোমার এক ছেলে তীক্ষ্ণ থাকবে আমার কাছে। অন্য ছেলে দৃঢ় থাকবে এই কারাগারেরই অন্য একটা ঘরে। তুমি তাকে কখনও দেখতে পাবে না। তুমি যদি কোনওক্রমে পালাও, তাহলে প্রথমেই তোমার দুটি ছেলেকে খুন করা হবে। সুতরাং মনে রেখো, তুমি এ-ঘরের বাইরে কোনও দিন পা দিলেই তোমার দুই ছেলেরই মৃত্যু হবে, আর তুমিই হবে তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী।”
“গুরুদেব, তবু আপনি আমাকে বেশিদিন বেঁচে থাকার জন্য আশীর্বাদ করলেন কেন?”
“তুমি যত বেশিদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন কষ্ট পাবে, সেটাই তো আমি চাই।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তলতাদেবী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “তবে আপনিও শুনে রাখুন, গুরুদেব! যদি আমি বেঁচে থাকি, তা হলে নিশ্চয়ই আমি দেখে যাব, একদিন কেউ এই রাজ্যের সিংহাসন থেকে পদাঘাত করে আপনাকে ফেলে দিয়েছে। আপনার ছিন্ন মুণ্ড ধূলায় গড়াচ্ছে!”
ছম্ভী অট্টহাস্য করে বললেন, “সে সাধ তোমার কোনওদিন পূর্ণ হবে না!” আর কোনও কথা না বলে ছম্ভী পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলেন। সব ক’টি কক্ষ পেরিয়ে, বাইরের মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে তিনি পরম তৃপ্তির সঙ্গে মনে-মনে বললেন, “আঃ! এখন এই রাজ্য সম্পূর্ণ আমার!”