১২
জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসীদের একটা গ্রাম আছে। এই গ্রামের মানুষরা চাষবাসের কাজ জানে না। জন্তু-জানোয়ার শিকার করাই এদের জীবিকা। এরা বনে-পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে হরিণ- মোষ শুয়োর খরগোশ আর নানারকম পাখি শিকার করে। সেইসব মাংস নিজেদের খাওয়ার জন্য কিছুটা রেখে বাকিটা বিক্রি করে দিয়ে আসে বাজারে। মাংস বিক্রি করে যা টাকা পায়, তা দিয়ে চাল-ডাল-তেল কেনে। এদের নুন কিনতে হয় না। জঙ্গলের মধ্যেই একটা জায়গায় নুন-পাথর আছে, এরা সেই পাথর এনে গুঁড়ো করে নেয়। জন্তু-জানোয়াররাও সেই নুন-পাথর চাটতে আসে।
এই জঙ্গলে চম্পকের সৈন্যবাহিনীর তাঁর পড়ায় ওই আদিবাসী গ্রামটির বেশ অসুবিধে হয়েছে। এত লোকজন, ঘোড়া আর রথের আনাগোনায় এই জঙ্গলের সব প্রাণী ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে অন্য বনে। গ্রামের লোকদের শিকার জুটছে না। তাদের না খেয়ে থাকার মতন অবস্থা।
দিনের বেলায় শিকার করা খুব মুশকিল, তাই রাত্তিরবেলা সেই গ্রামবাসীরা দল বেঁধে দূর-দূর বনে যায় শিকারের খোঁজে, আবার সকাল হওয়ার আগেই ফিরে আসে। সৈন্য-সামন্তদের সামনেও তারা পড়তে চায় না, কারণ তাদের হাতে শিকার করা জন্তু-জানোয়ার দেখলে সৈন্যরা কেড়ে নেয়।
তিনজন ওই গ্রামের আদিবাসী একটি হরিণ শিকার করে ফিরছে ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে। হরিণটি বেশ বড়, দু’জনে মিলে কাঁধে করে বয়ে আনছে সেটাকে, আর-একজন চলেছে সামনে সামনে।
সামনের লোকটির নাম হিংকা। সে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
একটা ঝোপের আড়ালে শুকনো পাতায় কার যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে! সৈন্য-সামন্তরা এত ভোরেই জেগে উঠেছে না কি?
সাবধানে উঁকিঝুঁকি মেরেও সে কাউকে দেখতে পেল না। অন্য লোক দু’জন জিজ্ঞেস করল, “কী রে, হিংকা, কী হল?”
হিংকা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “চুপ!”
আর একটুক্ষণ কান খাড়া করে থেকেও সে কোনও শব্দ শুনতে পেল না। তখন সে ভাবল, “তা হলে নিশ্চয়ই মনের ভুল। সৈন্যরা এলে আর চুপিচুপি হাঁটবে কেন, তারা লুকিয়ে থাকবে না। গ্রামের লোক দেখলে তারা হইচই করে তেড়ে এসে শিকার কেড়ে নেয়।”
আবার চলতে শুরু করল গ্রামবাসীরা।
খানিক বাদে আবার সেই শব্দ। কেউ যেন খুব সাবধানে, আস্তে-আস্তে পা ফেলছে। এবার হিংকার সঙ্গে অন্য দু’জন লোকও শুনতে পেয়েছে সেই শব্দ।
তিনজনেই নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। হ্যাঁ, কোনও সন্দেহ নেই। একজন কেউ লুকিয়ে-লুকিয়ে তাদের অনুসরণ করছে। তারা থেমে যাবার একটু পরেই থেমে যাচ্ছে সেই পায়ের শব্দ। জন্তু-জানোয়ার নয়, মানুষেরই পায়ের আওয়াজ। নিশ্চয়ই কোনও গুপ্তচর। যে-মতলবই থাক, গুপ্তচরকে ফিরে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না।
হরিণটাকে সাবধানে মাটিতে নামিয়ে রেখে তিনজনে তীর-ধনুক বাগিয়ে এগিয়ে গেল তিন দিকে।
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠতে শুরু করেছে বটে, কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে এখনও আবছা-আবছা ভাব। বড়-বড় গাছগুলোর ডগার ওপর সোনালি আলো পড়েছে। কিন্তু তলার দিকে অন্ধকার। রাত এখনও কাটেনি ভেবে এখনও ডেকে চলেছে কয়েকটা ঝিঝি পোকা।
হঠাৎ ওদের মধ্যে একজন চমকে উঠল। সে দেখতে পেয়েছে, একটু দূরে একটা গাছের ডালে এক ঝলক রং। গোলাপি আর নীল রঙের একটা কাপড়।
আর একটু এগিয়ে গিয়ে সে একটা গাছের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে কোনওরকমে মুখ বাড়িয়ে দেখল, একটা গাছের ডালে আটকে গেছে একটি রঙিন রেশমি ওড়না, আর একজন খুব সুন্দর চেহারার মহিলা সেটি টানাটানি করে খোলার চেষ্টা করছেন। মহিলার মাথার চুল সমস্ত খোলা, তাঁর গায়ের রং গলানো সোনার মতন। এখানকার জঙ্গলে-পাহাড়ে এরকম কোনও মহিলাকে আগে কোনওদিন দেখা যায়নি।
লোকটি বড়-বড় চোখ মেলে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। সে যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। সকালবেলা একা একা এই নিবিড় অরণ্যে এক সুন্দরী মহিলা!
লোকটি কোনও সাড়াশব্দ করেনি, তবু তার নিশ্বাসের শব্দও যেন শুনে ফেললেন সেই মহিলা। ঝট করে মুখ ফিরিয়েই তিনি দেখতে পেলেন লোকটিকে। তার হাতে তীর-ধনুক।
মহিলাটি আদেশের সুরে বললেন, “আমি এ রাজ্যের রানি, তলতাদেবী। আমার দিকে অস্ত্র তুলছ কেন? নামাও! হাত নামাও!”
লোকটি সেই আদেশ অগ্রাহ্য করতে পারল না। তীর-ধনুক ফেলে দিল মাটিতে। কিন্তু সে খুব ভয়ও পেয়ে গেল।
সে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল, “ভূত! ভূত! ওরে হিংকা, ওরে মংক, শিগগির এদিকে আয়! মরে গেলাম! ভূত!”
লোকটি অমন সুন্দর একজন মহিলাকে দেখেও ভূত ভাবল কেন কে জানে! এরা যখনই খুব ভয় পায়, তখনই ভূতের কথা ভাবে!
হিংকা আর মংরু নামে অন্য দু’জন লোক হুড়মুড় করে ছুটে এল এদিকে। মহারানি তলতাদেবীকে দেখে একটু দূরে তারা থমকে গেল। কোনও অপদেবতা মনে করে তারাও ধরল তীর উঁচিয়ে।
চম্পকের শিবির থেকে গোপনে বেরিয়ে এসে মহারানি তলতাদেবী বিপদে পড়ে গেছেন। তিনি রাজধানীতে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁর রাজধানীতে ফিরে যাওয়া দরকার, কিন্তু তিনি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছেন।
এই লোক তিনটিকে হরিণ শিকার করে নিয়ে যেতে তিনি আগেই দেখেছেন। তিনি একবার ভেবেছিলেন, ওদের কাছ থেকে শহরে যাওয়ার পথটা জেনে নেবেন। তার পরেই তাঁর মনে হয়েছিল, এই লোকগুলো যদি চ্যাঁচামেচি করে চম্পকের সৈন্যদের জানিয়ে দেয়!
এখন এরা তাঁর দিকে তীর তুলেছে দেখে সেই সন্দেহটা আরও বেড়ে গেল। এখন তিনি আবার কিছুতেই চম্পকের হাতে ধরা দেবেন না।
তিনি হাতের তলোয়ারটা তুলে ধীর, গম্ভীর গলায় বললেন, “আমি এই দেশের মহারানি। তোমরা আমার প্রজা। আমার দিকে তোমরা অস্ত্র তুলো না। বরং আমাকে যদি তোমরা সাহায্য করো, তা হলে তোমাদের আমি অনেক পুরস্কার দেব!”
হিংকা হা-হা-হা-হা করে হেসে উঠে বলল, “মহারানি! এঃ! বললেই হল! মহারানি একা-একা জঙ্গলে ঘুরবেন? তাঁর সঙ্গে কত লোক-লশকর, দাস-দাসি, ঘোড়া-উট থাকে!”
মংরু বলল, “আমরা কোনওদিন মহারাজাকেও দেখিনি, মহারানিকেও দেখিনি। আমরা এই জঙ্গলের বাইরে কোথাও যাই না। রাজা-রানিরাও কোনওদিন এদিকে আসেন না!”
তলতাদেবী বললেন, “আমি পথ হারিয়ে চলে এসেছি। তোমাদের সাহায্য চাই!”
হিংকা বলল, “আপনি আমাদের দিকে তলোয়ার উঁচিয়েছেন যে বড়! তীর-ধনুকের সঙ্গে তলোয়ার দিয়ে লড়াই করতে পারবেন?”
মংরু বলল, “ওরে হিংকা, তলোয়ারের হলদে রঙের বাঁটটা অত চকচক করছে কেন? সোনার তৈরি নাকি রে?”
দু’ দিক থেকে দু’জন ধনুকের ছিলা টান করে রেখেছে। তলতাদেবী বুঝলেন, এদের সঙ্গে লড়াই করার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। কিন্তু অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে।
তিনি তলোয়ারটা নামিয়ে রেখে বললেন, “না, আমি প্রজাদের সঙ্গে লড়াই করতে চাই না। তোমরা বিশ্বাস করছ না যে, আমি এ-দেশের মহারানি? ঠিক আছে, তোমরা আমাকে রাজধানীতে নিয়ে চলো! সেখানে গেলেই তোমাদের সন্দেহ মিটে যাবে। ভয় নেই। রাজধানীতে গেলে তোমাদের কেউ ক্ষতি করবে না। মহারাজ খুশি হয়ে তোমাদের অনেক পুরস্কার দেবেন!”
হিংকা বলল, “যাঃ বাবা! রাজধানীটা আবার কোথায়? আমরা কি কখনও সেখানে গেছি নাকি? আমরা সৈন্য-সামন্তদের ভয়ে সব সময় লুকিয়ে থাকি! আমরা রাজধানীর কিছু জানি না!”
তলতাদেবী ভুরু কুঁচকে দু-এক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, “তোমরা সৈন্যদের দেখলে ভয় পাও? কেন? তোমরা বুঝি সৈন্য নও!”
মংরু বলল, “আমরা সৈন্য হতে যাব কেন? আমরা এই জঙ্গলের মধ্যে গ্রামে থাকি। শিকার করে খাই। সৈন্যরা আমাদের জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। আমাদের দিয়ে জোর করে অনেক কাজ করায়, তার বদলে কিছু দেয় না!”
তলতাদেবী এবার খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন। এরা তা হলে চম্পকের বিদ্রোহী সৈন্য নয়। নিরীহ গ্রামবাসী!
তিনি এবার বললেন, “তোমরা এই রাজ্যের বিশ্বাসী প্রজা! তোমরা রাজধানী চেনো না। তা হলে তোমরা আমাকে এই জঙ্গলের বাইরে কোনও রাস্তায় পৌঁছে দিতে পারবে? তা হলেই হবে। আমার খুব বিপদ!”
লোক তিনটি পরস্পরের মুখের দিকে চাইল। কী করবে বুঝতে পারছে না। তাদেরও দেরি হয়ে যাচ্ছে, রোদ উঠে যাচ্ছে চড়া হয়ে।
প্রথম যে-লোকটি ভয় পেয়ে তীর-ধনুক ফেলে দিয়েছিল, সে বলল, “ওরে, অত কথায় কাজ কী? ইনি ভূত না মানুষ, তা কে জানে! ইনি যেখানে ইচ্ছে যান, আমরা চল পালাই।”
হিংকা বলল, “তলোয়ারখানা দেখে বড্ড লোভ হচ্ছে। আমাদের গ্রামে কারও এরকম অস্ত্র নেই! কখনও চোখেও দেখিনি!”
মংরু বলল, “হাতে কীরকম আংটি রয়েছে দ্যাখ! নির্ঘাত মনে হচ্ছে সোনার। তাতে হিরে-মুক্তো বসানো। ওরে, ওরকম একটা আংটি বিক্রি করে দিলে কত চাল আর ডাল পাওয়া যাবে বল তো? সারা বছর আমাদের খাওয়ার চিন্তা থাকবে না।”
তলতাদেবী বললেন, “ঠিক আছে, তোমরা আমাকে জঙ্গলের বাইরে কোনও বড় রাস্তায় নিয়ে চলো। তা হলে আমি তোমাদের এই তলোয়ার আর আমার হাতের আংটি উপহার দেব! চলো, চলো, শিগগির চলো।”
মংরু বলল, “এটা মন্দ কথা নয়। ওনাকে জঙ্গলের বাইরে পৌঁছে দিলেই যদি অমন ভাল জিনিস দুটো পাওয়া যায়, তা হলে তো বহুত মজা! চল তা হলে যাই!”
হিংকা বলল, “দূর গাধা! এখন আমরা জঙ্গলের বাইরে রাস্তা পর্যন্ত যাব, আবার ফিরে আসতে হবে, এর মধ্যে যদি সৈন্যদের কাছে ধরা পড়ে যাই? তখন কী হবে? সৈন্যরা আমাদের এইসব জিনিস কেড়ে নেবে না? মেরেও ফেলতে পারে। তার চেয়ে আর-একটা কাজ করা তো অনেক সহজ!”
হিংকা মংরুর দিকে তাকিয়ে চোখের ইঙ্গিত করল। মংরু তাকাল অন্য লোকটির দিকে। সে-ও ভুরু নাচিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস!”
তারা তখন তিন দিক থেকে এক-পা এক-পা করে এগোতে লাগল মহারানির দিকে।
মহারানি আবার তলোয়ার তুলে নিয়ে বললেন, “খবরদার, আমার কাছে আসবে না। আমাকে ধরার চেষ্টা করবে না।”
লোক তিনটি লোভীর মতন হি-হি করে হেসে উঠল একসঙ্গে।
ঠিক সময় আরও তিনটি লোক ঝোপ সরিয়ে উপস্থিত হল সেখানে। তাদের মধ্যে একজন তলতাদেবীর দিকে তাকিয়েই দারুণ চমকে গিয়ে বলল, “কে? কে? ইনি কে?”