১০
পাশাপাশি দুটি ঘোড়ায় বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে পথ চললেন মহারাজ মহাচূড়ামণি এবং রাজপুরোহিত ছম্ভী।
মধ্যরাত্রি পার হয়ে গেছে, রাজধানীর সমস্ত মানুষই এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। কেউ জানেই না রাজ্যের এখন কতখানি বিপদ। বিদ্রোহ করেছে সেনাপতি চম্পক, এই রাজ্যের মহারানি সেই চম্পকের কাছে বন্দিনী। মহারাজ গোপনে চলেছেন রাজধানী ছেড়ে, সঙ্গে একজনও সৈন্য নেননি, শুধু রাজপুরোহিত তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
কোনও বাড়িতেই এখন বাতি জ্বলছে না। কিন্তু পথের মোড়ে মোড়ে দাউদাউ করে জ্বলছে মশাল।
এই রাজ্যে চোর-ডাকাতের উপদ্রব নেই। রাত্রে পথে পথে পাহারাদারও থাকে না। তবে নগরীর দু’ দিকে দুটি প্রবেশ দ্বারে প্রহরী থাকে সর্বক্ষণ। মহারাজ ও রাজপুরোহিত সেই দ্বার এড়িয়ে একটা জলাভূমি দিয়ে চলে গেলেন রাজধানী ছাড়িয়ে।
মহাচূড়ামণি যখন অন্য সময়ে যুদ্ধযাত্রায় বেরোন কিংবা শিকার করতে যান, তখন সঙ্গে শুধু সৈন্যবাহিনী ছাড়াও বহু জিনিসপত্র, দাস-দাসী, রান্নার লোক, ধোপা-নাপিত সবই থাকে। আজ সঙ্গে কিছুই নেই।
আজ মহারাজের মনখারাপ তো বটেই, একটু পরে খিদেও পেয়ে গেল। তাঁর কখন যে ঘুম পাবে আর কখন খিদে পাবে, তার কোনও ঠিক নেই। এখন তাঁর মনে রাগ আর দুঃখ একসঙ্গে জ্বালা ধরিয়ে রেখেছে, তাই ঘুম পাবে না। কিন্তু এই অবস্থাতেও খিদে পেতে বাধা নেই।
মহারাজ একটু পরে বললেন, “গুরুদেব, আপনি খেয়ে এসেছেন? আপনার খিদে পায়নি তো?”
রাজপুরোহিত বললেন, “না, মহারাজ, আমার খিদে পায়নি। আমি একদিন-দু’দিন না খেয়েও থাকতে পারি। কিন্তু আপনার খিদে পেয়েছে বুঝি?”
মহারাজ বললেন, “হ্যাঁ, হঠাৎ বেশ খিদে পেয়ে গেল! এখান থেকে চম্পকের শিবির কত দূর?”
ছম্ভী বললেন, “খুব বেশি দূর নয়। রাত্রি ভোর হবার আগেই আমরা পৌঁছে যাব।”
মহারাজ বললেন, “এখন রাত্রির তৃতীয় প্রহর। ভোরবেলা চম্পকের শিবিরে পৌঁছে তাকে হত্যা করব। তারপর তার সৈন্যদের দমন করব। তারপর কিছু খেতে পাব! এতক্ষণ কি আমার সহ্য হবে?”
ছম্ভী বললেন, “খুব বেশি সময় তো নয়, মহারাজ। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবেন না?”
মহারাজ বললেন, “মনে হয় না। পেটে খিদে থাকলে আমি অন্য কোনও কাজে মন দিতে পারি না।”
ছম্ভী বললেন, “তবে তো মুশকিল হল, মহারাজ। এখন খাবার কোথায় পাওয়া যাবে? তা হলে এদিকের কোনও গৃহস্থের বাড়ি খুঁজব? সে-বাড়ির লোকদের ডেকে বলব, আপনাকে খাবার দিতে! কিন্তু এদিককার যে-কোনও প্রজাই যে আপনাকে দেখে চিনে ফেলবে! তা হলেই আমাদের উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যাবে। আমি চাই, আমাদের অভিযানের কথা কেউ জানতে না পারে!”
মহারাজ বললেন, “তা হলে কোনও প্রজার বাড়িতে যেতে হবে না। গুরুদেব, এদিকে কোনও ফলের গাছ নেই?”
ছম্ভী বললেন, “এদিকে সবই তো দেখছি খেজুর গাছ। আপনি কি শুধু খেজুর খেয়ে খিদে মেটাতে পারবেন?”
মহারাজ বললেন, “পাকা খেজুর অতি উত্তম জিনিস। দেখুন দেখি, কোন গাছটিতে বেশ ভাল খেজুর ফলেছে!”
আকাশে অল্প-অল্প জ্যোৎস্না। গাছের মাথাগুলো ভাল দেখা যায় না। ছম্ভী সঙ্গে কোনও মশালও আনেননি।
তবু একটা গাছের কাছে থেমে তিনি বললেন, “মহারাজ, এই খেজুর গাছটিতে যথেষ্ট খেজুর আছে মনে হচ্ছে। কিন্তু লম্বা গাছ। খেজুর পাড়া যাবে কী করে? আমি তো গাছে উঠতে শিখিনি।”
মহারাজ বললেন, “আপনি গাছে উঠতে পারেন না? আমিও কখনও গাছে উঠিনি। তা হলেও একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে!”
মহারাজ ঘোড়া থেকে নেমে খাপ থেকে তলোয়ার বার করলেন।
ছম্ভী বললেন, “এ কী করছেন মহারাজ? তলোয়ার দিয়ে খেজুর গাছ কাটবেন নাকি? আপনার অমন মহার্ঘ তলোয়ারটি নষ্ট হয়ে যাবে।”
মহারাজ বললেন, “এবার দেখুন আমার শক্তি। মনে করুন, এই গাছটাই চম্পকের গলা। আমি কী করে এক কোপে তার গলা কাটব, সেটা দেখুন!”
মহারাজ তলোয়ার তুলে প্রচণ্ড জোরে এক কোপ বসালেন। অত বড় খেজুর গাছটা দু’ খণ্ড হয়ে গেল। ধপাস করে সেটা পড়ল একদিকে।
ছম্ভী বললেন, “আশ্চর্য! আশ্চর্য! মানুষের গায়ে যে এত শক্তি থাকতে পারে, তা চোখে দেখলেও যেন বিশ্বাস করা যায় না!”
মহারাজ এক ছড়া পাকা খেজুর ছিঁড়ে নিয়ে টপাটপ মুখে দিতে লাগলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তা শেষ হয়ে গেল। তিনি আর-এক ছড়া নিলেন। তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, “বাঃ, বেশ মিষ্টি!”
ছম্ভী অস্থিরভাবে তাকাচ্ছেন আকাশের দিকে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ভোর হয়ে গেলে চম্পকের শিবিরে গোপনে প্রবেশ করার অসুবিধে হবে।
মহারাজ আরও দু’ ছড়া খেজুর শেষ করলেন। তারপর আবার যাত্রা শুরু হল।
সমতল ছেড়ে এবার পাহাড়ে উঠতে হবে। অন্ধকার পথ ভাল বোঝা যায় না। জঙ্গলের মধ্যে একটা সরু পায়ে-চলা পথ আছে বটে। ছম্ভী এ-পথে আগে কয়েকবার এসেছেন, তিনি অতিকষ্টে পথ খুঁজে খুঁজে চলেছেন আগে-আগে। ঘোড়ার পায়ের কপাকপ শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। বাতাস থেমে আছে। অরণ্যের একটি পাতাও নড়ছে না।
.
হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেলেন ছম্ভী। উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শোনার চেষ্টা করলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন,”মহারাজ, কিছু শুনতে পাচ্ছেন কি?”
মহারাজ বললেন, “মনে হচ্ছে পায়ের আওয়াজ। কেউ আমাদের পিছু-পিছু- আসছে গোপনে?”
ছম্ভী বললেন, “মানুষ নাও হতে পারে। মহারাজ, এই জঙ্গলে ভাল্লুকের উপদ্রব আছে। মনে হচ্ছে, দু-একটা ভাল্লুকই চলাফেরা করছে। হঠাৎ সামনে কোনও ভাল্লুক এসে পড়লে বিপদে পড়ে যাব।”
মহারাজ অবাক হয়ে বললেন, “ভাল্লুক এলে আবার বিপদ কিসের? ভাল্লুক আমাদের কী করবে? এবার আমি সামনে যাচ্ছি, আপনি আসুন আমার পেছনে।”
তলোয়ার উঁচিয়ে ঝড়ের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন মহারাজ। সোজা উঠে এলেন পাহাড়ের একেবারে চূড়ার কাছে। তার সামনে একেবারে খাড়া পাথর। আর কোনও পথ নেই।
ছম্ভী এসে পৌঁছলেন একটু পরে।
ঘোড়া থেকে নেমে তিনি বললেন, “মহারাজ, আমরা সুড়ঙ্গটার প্রায় কাছাকাছি এসে গেছি। এবার খানিকটা পায়ে হেঁটে যেতে হবে।”
মহারাজও ঘোড়া থেকে নামলেন। ঘোড়া দুটিকে বেঁধে রাখা হল সেখানে একটি গাছের সঙ্গে।
আস্তে-আস্তে পাহাড়ের পূর্ব দিগন্ত লাল হয়ে আসছে। পাহাড়ের এক কোণ থেকে মাথা তুলছেন সূর্য। একটু আলো ফোটার সঙ্গে-সঙ্গে ডাকাডাকি করতে শুরু করেছে নানারকমের পাখি
পাহাড়ের ফাটল ধরে খানিকটা এগোতে এগোতেও আবার থামতে হল। এবারে একেবারে নিরেট দেওয়ালের মতন পাথর, কোনও ফাঁকফোকর নেই।
ছম্ভী সেই পাথরের গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, “মহারাজ, আমরা এসে গেছি। এই পাথরটার ওপারেই সেই সুড়ঙ্গ শুরু হয়েছে। চম্পকের শিবিরে পৌঁছতে আর বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। আকাশে আলো ফুটে গেল অবশ্য! তা হোক, চম্পক এত ভোরে জেগে উঠবে না নিশ্চয়ই।”
মহারাজ বললেন, “এই পাথরের দেওয়ালটা যে অনেকখানি উঁচু। এর ওপাশে যাব কী করে?”
ছম্ভী বললেন, “মহারাজ, আপনি আমাকে একটু উঁচু করে তুলে ধরুন। আমি আগে এর ওপরে উঠে দেখি, রাস্তা পরিষ্কার আছে কি না। দৈবাৎ এদিকেও যদি কোনও প্রহরী থাকে, তাকে আগে শেষ করতে হবে।”
মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, “গুরুদেব, আপনি আগে ওপরে উঠবেন? যদি কোনও প্রহরী থাকে, আপনাকে দেখে ফেলে? আমিই আগে উঠি বরং!”
ছম্ভী বললেন, “না, মহারাজ। যদি প্রহরীর সংখ্যা বেশি হয়? আমার প্রাণ গেলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু আপনি রাজা, আপনাকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য। তবে, এত কম আলোয় আমাকে দেখতে পাবে না মনে হয়। যদি বেশি প্রহরী থাকে, তা হলে আমাদের অন্য পথের কথা চিন্তা করতে হবে। এই সুড়ঙ্গের আর-একটা মুখও আছে। নিন, আমাকে একটু তুলে ধরুন, মহারাজ।”
ছম্ভীর পাতলা ছিপছিপে চেহারা, মহারাজ তাঁকে অনায়াসেই দু’ হাতে উঁচু করলেন, ছম্ভী উঠে গেলেন সেই পাথরের দেওয়ালের ওপর। সেখানে বসে পড়েই খুব উৎফুল্ল ভাবে বললেন, “দারুণ সুযোগ, মহারাজ! একজনও প্রহরী নেই। পথ একেবারে পরিষ্কার।”
তলা থেকে মহারাজ বললেন, “বাঃ! তবে তো কোনও কথাই নেই!”
ছম্ভী বললেন, “সুড়ঙ্গের ওপাশে চম্পকের শিবিরের খানিকটা অংশও দেখা যাচ্ছে। কেউ জেগে ওঠেনি। কাউকে নড়াচড়া করতেও দেখা যাচ্ছে না।”
মহারাজ বললেন, “আপনি এবার নেমে আসুন, গুরুদেব। এবার আমি যাব। আর আমি ধৈর্য ধরতে পারছি না।”
ছম্ভী একলাফ দিয়ে নেমে পড়লেন। তারপর বললেন, “মহারাজ, কোনও শব্দ করবেন না। খুব সাবধানে যেতে হবে।”
কিন্তু মহারাজ মহাচূড়ামণিকে ওপরে তুলে দেওয়া অত সহজ হল না। তাঁর বিশাল চেহারা। ছম্ভী অত ভারী একজন মানুষকে তুলতে পারবেন কী করে?
অনেক ঠেলাঠেলি করেও বিশেষ কোনও ফল হল না।
মহারাজের মাথা থেকে মুকুটটা খসে পড়ে ঝনঝন শব্দ হল।
মহারাজ বললেন, “থাক, মুকুটটা থাক। আমি ওপরে ওঠার পর ছুঁড়ে দেবেন!”
মহারাজের কোমরের তলোয়ারটা নিয়েও অসুবিধে হল বেশ। অত বড় খাপসুদ্ধু তলোয়ার, বারবার ঠেকে যাচ্ছে পাথরে। মহারাজ কোমর থেকে সেটাও খুলে ফেলে বললেন, “এটাও আপনার কাছে রাখুন। পরে আমার হাতে দিয়ে দেবেন!”
ছম্ভী এবার মহারাজের কোমরে দু হাত দিয়ে খুব জোরে চাপ দিলেন ওপরের দিকে। মহারাজও সেইসঙ্গে লাফ দিয়ে ধরে ফেললেন পাথরের ওপরের দিকটা। .
তারপর তিনি হাতের জোর দিয়ে ওপরে উঠে বসলেন। সঙ্গে-সঙ্গে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, “এ কী?”
ছম্ভী জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল, মহারাজ?”
মহাচূড়ামণি বললেন, “কী ব্যাপার বুঝতে পারছি না। সুড়ঙ্গ কোথায়? এ যে দেখছি একটা অন্ধকার খাদ? আপনি কোথায় দেখতে পেলেন চম্পকের শিবির? সেরকম কিছুই তো নেই!”
ছম্ভী হা-হা করে হেসে উঠে বললেন, “দেখতে পাচ্ছেন না? সে কী? ভাল করে নীচের দিকে উঁকি মেরে দেখুন!”
মহারাজ বললেন, “কই, কোথায় সুড়ঙ্গ?”
ছম্ভী বললেন, “উঠে দাঁড়ান, ভাল করে দেখুন। একটু নীচেই তো সুড়ঙ্গটা রয়েছে, আমি স্পষ্ট দেখলাম!”
মহারাজ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “গুরুদেব, আমি এখনও দেখতে পাচ্ছি না!”
ছম্ভী আবার হেসে বললেন, “এইবার ঠিক দেখতে পাবেন!”
সঙ্গে-সঙ্গে তিনি এক ধাক্কা দিলেন মহারাজের পিঠে। মহারাজ নিজের শরীরের ভার সামলাতে পারলেন না। আঁ-আঁ-আঁ শব্দ করে তিনি পড়ে যেতে লাগলেন খাদের মধ্যে।
সেই খাদটা অনেক গভীর। তলা পর্যন্ত দেখাই যায় না।
মহারাজ কিন্তু শেষ পর্যন্ত পড়বার আগেই আটকে গেলেন এক জায়গায়। চিৎকার করতে লাগলেন, “বাঁচাও, বাঁচাও!”
ছম্ভী এবার মহারাজের তলোয়ারটা নিয়ে একাই নিপুণভাবে লাফ মেরে উঠে পড়লেন পাথরের দেওয়ালের ওপর। ঝুঁকে দেখলেন, একটু নীচে মহারাজ একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলছেন।
কোনওক্রমে মুখ তুলে ছম্ভীকে দেখতে পেয়ে মহারাজ ব্যাকুলভাবে বললেন, “গুরুদেব, গুরুদেব, কী করলেন আপনি? আপনার হাতের ধাক্কা লেগে আমি পড়ে গেলাম। শিগগির আমাকে টেনে তুলুন!”
ছম্ভী গাছটাকে কেটে ফেলবার জন্য একটা কোপ মারলেন।
মহারাজ বললেন, “এ কী করছেন, গুরুদেব? গাছটা কাটছেন কেন?”
ছম্ভী বললেন, “বুঝতে পারছেন না? আপনার কষ্ট ঘুচিয়ে দিচ্ছি। কতক্ষণ আর ঝুলে থাকতে পারবেন ওভাবে? অতবড় ভারী শরীর নিয়ে আপনি ওপরে উঠতে পারবেন না কখনও!”
মহারাজ বললেন, “গুরুদেব, আপনি আমাকে মেরে ফেলতে চান? আমি চলে গেলে এই রাজ্য কে চালাবে!”
ছম্ভী বললেন, “তোমার মতন একটা মাথা মোটা, গোঁয়ার গর্দভ এ দেশের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে! তোমার থেকে চম্পক অনেক ভাল রাজা হবে।”
মহারাজ বললেন, “গুরুদেব, আমি প্রাণভিক্ষা চাইছি। আমি কোনওদিন আপনার কোনও ক্ষতি করিনি। আমাকে একবার বাঁচার সুযোগ দিন। আমাকে ওপরে টেনে তুলুন! আমি না বাঁচলে মহারানিকে কে উদ্ধার করবে?”
ছম্ভী বললেন, “তোমাকে আর কোনও সুযোগ দেব না, শয়তান!”
তারপর তিনি গাছটা কাটার জন্য আবার তলোয়ারটা তুলতেই শুনতে পেলেন একটা ভেড়ার ডাক। ছম্ভী চমকে উঠলেন দারুণভাবে।
মুখ তুলে তিনি দেখলেন, একটু দূরে একটা ভেড়ার পালের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে একজন মাঝবয়সী লোক, তার সঙ্গে সাত-আট বছর বয়েসী একটি বাচ্চা ছেলে। তারা হাঁ করে এই ব্যাপার দেখছে।
মহারাজ আর্ত চিৎকার করলেন, “বাঁচাও! বাঁচাও! যে বাঁচাবে, তাকে লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দেব! যা চাইবে তাই দেব! গুরুদেব, আপনাকে আমি সোনার সিংহাসন গড়িয়ে দেব!”
ছম্ভী দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “তুমি যমালয়ে যাও, মহাচূড়ামণি!”
খুব জোরে একটা কোপ দিয়ে তিনি কেটে ফেললেন গাছটা। মহারাজ মহাচূড়ামণি ঘুরতে-ঘুরতে পড়তে লাগলেন নীচের দিকে। একটু পরেই তাঁকে আর দেখাই গেল না। একেবারে নীচে পড়ে তাঁর হাড়গোড় গুঁড়ো হয়ে যাবে।
ছম্ভী এবার ক্রুদ্ধ চোখ তুলে বয়স্ক রাখালটিকে বললেন, “এদিকে আয়!”
রাখালটি কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এ কী করলেন প্রভু? আমাদের রাজাকে আপনি মেরে ফেললেন?”
ছম্ভী বললেন, “রাজাকে তার যোগ্য শাস্তি দিয়েছি। অনেক আগেই ওকে সরিয়ে ফেলা উচিত ছিল। তুই এদিকে আয়! কাছে আয়!”
লোকটি বলল, “আমি একজন সামান্য মেষপালক। আমাকে কেন ডাকছেন, প্ৰভু?”
ছম্ভী ডান হাত তুলে বললেন, “যা দেখেছিস, তা যদি কারও কাছে কখনও বলিস, তা হলে আমার অভিশাপে তুই পুড়ে ছাই হয়ে যাবি। আর যদি না বলিস, তা হলে পুরস্কার পাবি। এদিকে আয়, তোকে বুঝিয়ে দিচ্ছি, রাজাকে কেন শাস্তি দিতে হল। তোর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আয়।”
এখানে চম্পকের শিবির-টিবির কিচ্ছু নেই। সুড়ঙ্গও নেই। রয়েছে শুধু এই ভয়ঙ্কর খাদ। তার ওপাশে সাধারণ একটি গ্রাম। সেই গ্রামের মেষপালকটি এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ফেলে ভয়ে কাঁপছে এখনও। রাজপুরোহিতের আদেশ সে অমান্য করতে পারল না।
সে এক-পা এক-পা করে এগিয়ে এল ছম্ভীর কাছে। ছেলেটির হাত ধরে রইল।
সে কাছে আসবার পর ছম্ভী বাচ্চাটাকে নিজের কাছে টেনে আনলেন। বয়স্ক লোকটিকে ধমক দিয়ে বললেন, “প্রণাম কর আগে। তারপর পুরস্কার পাবি।”
লোকটি প্রণাম করার জন্য মাথা নিচু করল।
ছম্ভী তক্ষুনি তলোয়ারের এক কোপে তার মুণ্ডুটা কেটে ফেললেন।
তারপর তিনি বাচ্চাটিকে হত্যা করার জন্য পাশ ফিরলেন বটে, কিন্তু সে সুযোগ পেলেন না। বাচ্চাটি তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এক লাফ মারল উঁচু পাথর থেকে। নীচে পড়েই সে দৌড় লাগাল।
ছম্ভী সেই বাচ্চাটিকে খানিকটা তাড়া করেও আর ধরতে পারলেন না। সে তীরের মতন ছুটে মিলিয়ে গেল অরণ্যের মধ্যে।