3 of 3

উদারতার চেয়ে মহান কিছু নেই

সেদিন বলেছিলাম, হিন্দুরা হিন্দুদের পক্ষে কথা বলছে, মুসলমানরা মুসলমানদের পক্ষে কথা বলছে। কত ভালোই না হতো যদি হিন্দুরা মুসলমানদের পক্ষে কথা বলতো, আর মুসলমান হিন্দুদের পক্ষে কথা বলতো।

নুরিত পেলেড-এলহানান একজন ইহুদি।   জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা-শিক্ষার শিক্ষক। আমার মতোই তিনি ইউরোপীয় সংসদ থেকে মুক্তচিন্তার জন্য সাখারভ পুরস্কার পেয়েছেন। নুরিত পেলেডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে। তিনি তাঁর সংগ্রামের কথা যখন বলেছেন, আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় বসেছিলাম। নুরিতের মেয়ে স্মাদার ১৩ বছর বয়সে ১৯৯৭ সালে ফিলিস্তিনি আত্মঘাতী বোমায় জেরুজালেমের রাস্তায় নিহত হয়। নুরিত ইজরাইলি হয়েও, ইহুদি হয়েও, ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের জন্য লড়ছেন। তিনি এক জিওনিস্ট পরিবারের মেয়ে। তাঁর ঠাকুরদা ইজরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা মাটিনিয়াহু পেলেড ছিলেন ইজরাইলের মেজর জেনারেল। নুরিতের মতো নুরিতের ভাই মিকো পেলেডও ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের জন্য লড়ছেন।

নুরিত তাঁর ‘Palestine in Israeli Books : Ideology and Propaganda in Education’ বইটিতে লিখেছেন ইজরাইলের ইস্কুল-বইয়ে আরবদের সম্পর্কে লেখা হয় তারা বর্ণবাদী। লেখা হয়, ‘আরবরা মূলত শরণার্থী, সন্ত্রাসী আর আদ্দিকালের কৃষক’। অনেকে অবশ্য নুরিতের এই দাবি মানেন না। ইজরাইলি লেখক এবি ইয়েহোশুয়া বলেছিলেন আরব আর ইহুদিদের মধ্যে সাংস্কৃতিক দূরত্ব এত বেশি যে ওরা কখনও একসঙ্গে বাস করতে পারবে না। নুরিত এ কথা মানেননি। ইউরোপীয় সংসদে দেওয়া নুরিতের বক্তৃতা আমি শুনেছি, ইজরাইলের মাটিতে ফিলিস্তিনি শরণার্থী আর ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর যে কী পরিমাণ নির্যাতন হয়— তা বর্ণনা করেছেন। প্রতিকার চেয়েছেন। ইজরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে সকলকে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন। নুরিতকে আমি বলেছি, ‘ফিলিস্তিনি আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয়েছে তোমার মেয়ে, তারপরও তুমি ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের জন্য দিনরাত খেটে চলেছ, ইজরাইলি শাসকের বর্বরতার বিরুদ্ধে তুমি। তোমাকে নমস্কার’। নুরিত সস্নেহে বলেছিলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও সংখ্যালঘুদের পাশে তুমিও তো দাঁড়িয়েছো। তুমিও তো লিখেছো ‘লজ্জা’ নামের বই। আমরা আসলে একই কাজ করছি, যে কাজ পৃথিবীকে আমাদের সবার বাসযোগ্য করার জন্য খুব জরুরি।

কিছু দিন আগে ভারতের গুরমেহার কাউর নামে ২০ বছর বয়সী এক মেয়ে তার এক ভিডিও প্রকাশ করেছে সোশাল মিডিয়ায়। এটি নিয়ে ভারত এখন উত্তাল। মেয়েটির বাবা মানদীপ সিং ১৯৯৯ সালে কাশ্মীরের মিলিটারি ক্যাম্পে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। গুরমেহারের তখন ২ বছর বয়স। গুরমেহার বলছে, তার বাবাকে পাকিস্তান মারেনি, মেরেছে যুদ্ধ। বলেছে যদি ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে কোনও যুদ্ধ না থাকতো, তাহলে তার বাবাকে মরতে হতো না। গুরমেহার যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়। চায়, পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে যত কলহ কোন্দল আছে, সব ঘুচে যাক, প্রতিষ্ঠা হোক শান্তি। গুরমেহার এরপর তার কলেজের উগ্র জাতীয়তাবাদী ছাত্রদের কাছ থেকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি তো আছেই, ধর্ষণের হুমকিও পেয়েছে। গুরমেহারকে সবাই আশা করেছিল ভীষণ পাকিস্তান-বিরোধী এক মেয়ে হবে সে। পাকিস্তানকে ঘৃণা করবে। উল্টে মেয়ে হয়ে উঠেছে উদার এবং সহিষ্ণু। যে পাকিস্তান সন্ত্রাসী পাঠিয়ে তার বাবাকে হত্যা করেছে, সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার কোনও ক্ষোভ নেই। হত্যার প্রতিশোধ সকলে নিতে চায়। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য চারদিক থেকে প্রেরণা আসে। সমাজে হিংসে, ঘৃণা এসব খুব সহজ এবং স্বাভাবিক। প্রতিশোধ না নিয়ে, ঘৃণা না ছড়িয়ে, হিংসেয় উন্মত্ত না হয়ে আমি যদি সভ্য উপায়ে সমস্যা সমাধানের জন্য বলি, আমি যদি শান্তির কথা বলি, আমি যদি সহনশীলতা আর সহমর্মিতার কথা বলি— তাহলে আমি কোনও না কোনওভাবে জাতীয়তাবাদবিরোধী, দেশদ্রোহী! এমনিতো হচ্ছে। গুরমেহারকেও ভারতবিরোধী বলা হয়েছে, নুরিতকেও বলা হয় দেশদ্রোহী, আমাকে তো বলাই হয়। দেশের ভালো যারাই করতে যায়, তাদেরই দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেওয়া হয়। আখ্যা দেয় তারাই, যারা ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করে, যারা রক্তপাতে আর মৃত্যুতে বিশ্বাস করে।

কত যে অমসৃণ পথে হাঁটতে হয় আমাদের। কত কিছু থেকে যে বঞ্চিত হতে হয়।   কিন্তু তারপরও আমরা যেখানে আছি, সেখানে থাকবো বলে ঠিক করেছি। ঘৃণা কখনও কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। ভালোবাসাই দিতে পারে মুক্তি, উদারতাই আনতে পারে শান্তি।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০২ মার্চ, ২০১৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *