উদভ্রান্ত শিকারি (ছোট গল্প)
কর্মোপলক্ষ্যে নিউজিল্যান্ড থেকে ভারতবর্ষের বিহার অঞ্চলে জেমস ইংলিস নামে এক সাহেবের রোমাঞ্চকর একটি শিকারের অভিজ্ঞতা তোমরা কিছুদিন আগে সন্দেশ-এ পড়েছ। এবার তার আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা তোমাদের বলব।
বিশেষ কোনো কারণে কিছুদিনের জন্য মাতৃভূমি নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলেন জেমস ইংলিস। ফিরে এসে তিনি দেখেন তার কাজের জায়গা বদলে গেছে। এবার তাঁকে যেতে হবে অযোধ্যা প্রদেশের উত্তর-অঞ্চলে অবস্থিত বিশাল তৃণভূমিতে। সেখানে তাঁর বাসস্থানটিও নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে।
এলাকাটি ইংলিস সাহেবের সম্পূর্ণ অপরিচিত। ওখানকার মানুষের রীতিনীতিও তার অজানা। তা ছাড়া বাঙালি সংলাপে অভ্যস্ত থাকলেও অযোধ্যার বাসিন্দাদের ভাষা বুঝতে প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হচ্ছিল। আরো এই যে, তার প্রথম বারের জায়গা কুশীনদের তীরে বনভূমির সঙ্গে অযোধ্যার বন্য প্রকৃতির কোনো সাদৃশ্য ছিল না। এখানে শস্যের চেহারা অন্যরকম, চাষবাসের ব্যবস্থা আগের তুলনায় আদিম। বালুকাময় প্রান্তরের মধ্যে সুদীর্ঘ ঘাসজঙ্গলের পরিবর্তে অযোধ্যায় দেখা যায় ছায়া নিবিড় অরণ্যের জটিল সমাবেশ, আর সেই অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে তৃণগুল্মে আবৃত অসংখ্য প্রান্তর বহু দূর প্রশস্ত বিস্তার। কৃষ্ণসার নামে হরিণজাতীয় পশুরা দলে দলে ঘুরে বেড়ায় ওইসব প্রান্তরের বুকে।
বনভূমির সবচেয়ে কাছাকাছি শহর সাজাহানপুর অঞ্চলের দক্ষিণে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে ওই শহরটির অবস্থান। উত্তরদিকে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট, নাম সীতাপুর। সীতাপুরের মাঝখানে একটি গ্রাম আর পুলিশ স্টেশন।
ইংলিসের সঙ্গে ছিল একটি হস্তিনী, নাম মতি। সর্দানদীর ধারে জঙ্গল আছে শুনে ঘোড়ায় চড়ে জায়গাটা দেখতে গেলেন জেমস ইংলিস। তার আদেশে ঘোড়ার পিছু পিছু হাতিটাকে চালিয়ে নিয়ে এল সাহেবের ভৃত্যবর্গ। ওই জঙ্গলে শিকারের সম্ভাবনা আছে কিনা দেখার উদ্দেশ্য ছিল ইংলিসের।
জঙ্গলের ভিতর বহু হরিণ আর শুয়োরের পায়ের ছাপ দেখা গেল। শিকারের উপযোগী অন্যান্য জীবেরও অভাব ছিল না সেখানে। তবে বাঘ ভাল্লুকের মতো বড়ো জানোয়ারের কোনো চিহই চোখে পড়ল না। নিতান্ত নিরাশ হয়ে ফিরে আসছিলেন, হঠাৎ বাধা পড়ল। জগরু নামে যে সহিসটি তার সঙ্গ নিয়েছিল, সে জানাল একটু এগিয়ে গেলে বড় শিকারের সন্ধান পাওয়া যাবে বলে তার ধারণা, এমন কি বাঘের খোঁজ পাওয়াও অসম্ভব নয়।
জাগরু শিকারে অভিজ্ঞ। তার কথা উড়িয়ে দিতে পারলেন না ইংলিস সাহেব।
নির্দিষ্ট দিকে জগরুর সঙ্গে এগিয়ে চললেন তিনি। উঁচু বালিজমির উপর অজস্র তিল ও শিমূল গাছের শুকনো ঝোঁপ ভেদ করে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ শিকারিরা এসে পড়লেন সবুজ পত্রপল্লব ও উদ্ভিদে পরিপূর্ণ ঘন অরণ্যের সামনে।
কোনো কারণে উঁচু জমির কিছু অংশ ধসে যাওয়ার ফলে একটা বিরাট গহ্বরের আকার নিয়ে নীচু জমির উপর হঠাৎ জেগে উঠেছে শ্যামল বনভুমি। গাছপালার ফাঁকে নদীর দিকে আকৃষ্ট হল শিকারিদের দৃষ্টি। সূর্যের আলোতে ঝক ঝক করে জ্বলছিল বালুকারাশির উপর প্রবাহিত নদীর জলধারা। বালিতে ভরা শুকনো জমি থেকে অনেক নীচে ওই বনভূমি। সাহেব বুঝলেন ওইখানেই বড়ো শিকারের খোঁজ পাওয়া যাবে। জায়গাটা বাঘের বসবাসের পক্ষে প্রশস্ত।
জগরুর দিকে তাকিয়ে ইংলিস দেখলেন তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে হাসির রেখা। সেই নীরব হাসির মর্ম সাহেবের কাছে স্পষ্ট কি সাহেব! বলেছিলাম কিনা জগরু কেমন দরের লোক এখন বুঝেছ তো?
হাতির সাহায্য ছাড়া ওই বনে শিকারের খোঁজ করা সম্ভব নয়। অতএব ইংলিস সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁর নির্দেশ অনুসারে সহিস জগরু তার ঘোড়ায় চড়ে তিরবেগে ছুটল হাতি আনার জন্য।
পাইপে আগুন ধরিয়ে ইংলিস সাহেব ধূমপানে মনোনিবেশ করলেন। তারই ফাঁকে গ্রামবাসীদের সঙ্গে গল্প-গুজবও চলল। একটি অল্পবয়সী ছোকরা মাটির ঢেলা নিয়ে নীচের জঙ্গলে ছুঁড়ে মারছিল অলস খেয়ালের বশে।
সামান্য ঘটনা থেকে অনেক সময় চমকপ্রদ ঘটনার উদ্ভব হয়। ছেলেটির হাতের তৃতীয় বা চতুর্থ ঢিলটি জঙ্গলের ভিতর পড়তেই হঠাৎ গর্জিত কণ্ঠে প্রবল প্রতিবাদ ভেসে এসে জানিয়ে দিল নীচের জঙ্গলটি বর্তমানে ব্যাঘ্রের বাসভূমি এবং ঢিল ছোঁড়ার ব্যাপারটা বাঘ মশাই মোটেই পছন্দ করছেন না।
যে লোকগুলো সেখানে দাঁড়িয়েছিল তাদের মুখ শুকিয়ে ছাই-এর মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ইংলিস সাহেব একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়েছিলেন কোনোদিকে না তাকিয়ে সেই গাছটা বেয়ে তিনি উপরে উঠে গেলেন বিদ্যুৎ বেগে। তাঁর বন্দুকটা পড়ে রইল গাছের তলায়!
পরক্ষণেই জঙ্গলের আবরণ ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করল ক্রুদ্ধ শার্দুল!
বাঘটি অল্প বয়সের জানোয়ার, তবে তাকে একবারে নাবালক বাচ্চা বলা যায় না। বয়স কম হলেও বিক্রম বড়ো কম ছিল না। তার গোঁফ খাড়া হয়ে উঠেছিল, ঘাড়ের লোম শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছিল সজারুর কাঁটার মতো, লেজ লোহার ডাণ্ডার মতো কঠিন ও আড়ষ্ট এবং চোখ হিংস্র আক্রোশে জ্বলন্ত!
সেখানে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষই চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা, এই নীতি অবলম্বন করে দৌড় মারল। যে ছোকরাটি ঢিল ছুঁড়েছিল সেও দ্রুতবেগে পা চালিয়েছিল, কিন্তু ব্যাঘ্রের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারল না। দু বার কি তিন বার লাফ মেরে বাঘ একেবারে তার পিঠে এসে পড়ে সজোরে চপেটাঘাত করল। সে কি ধাক্কা, এক থাপ্পড়ে ছেলেটির দেহ শূন্যপথে উড়ে গিয়ে ধরাশায়ী গ্রহণ করল সশব্দে!
বিড়াল যেমন ইঁদুরের পিছনে তাড়া করে ছুটে তেমনি করেই বাঘ ছুটে গেল ধরাশায়ী ছেলেটির দিকে। ভাগ্যক্রমে সে ছেলেটির গায়ে দাঁত কিংবা নখ বসাবার চেষ্টা করল না। ভূপতিত শত্রুর পাশে দাঁড়িয়ে সে তার কাধ আর ঘাড়ের মৃদু সঞ্চালনে রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করল, তার লাঙ্গল পাঁজরের উপর আছড়ে পড়তে লাগল। আক্রোশে তার কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে লাগল অবরুদ্ধ ক্রোধের চাপা গর্জনধ্বনি।
তরুণ বাঘ তার রাজত্বে অনধিকার প্রবেশকারীর উপর তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছে সদর্পে ও সগর্জনে!
ততক্ষণে ভয়ের ধাক্কা সামলে নিয়েছেন ইংলিস সাহেব। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে তিনি বন্দুকটাকে হস্তগত করলেন, তারপর চটপট বন্দুকে গুলি ভরে নিয়ে গুলি চালালেন। একটা গুলি লাগল বাঘের পিছনে, আর একটি গুলি তার বুক ভেদ করে চলে গেল। তৎক্ষণাৎ ধরাশয়ী ছেলেটির শরীরের উপর পড়ে গেল গুলিবিদ্ধ ব্যাঘ্রের মৃতদেহ। তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে বাঘের তলা থেকে টেনে আনা হল। পরীক্ষা করে দেখা গেল তার পাঁজরের উপর বাঘের নখ লেগে একটি গভীর ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে বটে, তবে আঘাত মারা যাবার মতো নয়।
আচম্বিতে নীচের ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে এল আর একটি গম্ভীর গর্জনধ্বনি। ইংলিস সাহেব আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন গাছটির দিকে। তবে এবার আর গাছে ওঠার চেষ্টা না করে আগে যেটায় চড়েছিলেন, সেটার আড়ালে আশ্রয় নিলেন। ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে আরও কয়েকটা গর্জন শোনা গেল, তবে সৌভাগ্যবশত কণ্ঠস্বরের মালিক জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করতে চাইল না।
সহেব এবং তাঁর সঙ্গীদল রীতিমত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। বারবার গর্জন শুনে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় করা মুশকিল। জঙ্গলের আড়ালে একাধিক ব্যাঘ্রের অবস্থানের সাংঘাতিক সম্ভাবনা যখন সকলকেই উদবিগ্ন করে তুলেছে, তখন হঠাৎ মুশকিল আসানের মতো দেখা দিল অশ্বারোহী জগরু এবং তার পিছনে হাতির সঙ্গে একদল গ্রামবাসী ও জেমস ইংলিসের ভৃত্যবর্গ।
ওই অঞ্চলের বাঘের মেজাজ-মরজি সম্পর্কে ইংলিস সাহেবের যে অভিজ্ঞতা হল, তাতে তিনি বুঝেছিলেন যথেষ্ট সাবধান না হলে বাঘের কবলে এক বা একাধিক মানুষের হতাহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অতএব নীচের জঙ্গলে বাঘ যেখানে আত্মগোপন করেছে, সেই জায়গাটা থেকে যথাসম্ভব দূরে দাঁড়িয়ে তিনি লোকজনদের চেঁচামেচি করে বাঘকে ভয় দেখাতে বললেন। তিনি নিজে জগরুর সঙ্গে মতির পিঠে বসলেন। তাঁর আদেশে মতির মাহুত তাকে জঙ্গলের দিকে নিয়ে চলল। হাতি অবশ্য ব্যাপারটা আদৌ পছন্দ করছিল না।
এবার প্রায় দুই মানুষ উঁচু ঘন উদ্ভিদের মধ্যে প্রবেশ করল হাতি, আর পরমুহূর্তেই গর্জে উঠল বাঘ। তৎক্ষণাৎ জঙ্গল থেকে এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল হাতি। তাকে অনেক মারধর, অনেক তোয়াজ করেও কোনো ফল হল না। হাতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ঘন জঙ্গলের মধ্যে বাঘের সান্নিধ্যে আসতে সে নিতান্তই নারাজ।
বাধ্য হয়ে হাতির পিঠ থেকে মাটিতে নামলেন ইংলিস সাহেব। জগরুকে সঙ্গে নিয়ে অনেক ঘুরে তিনি নদীর ধার দিয়ে একটা খাড়া পাড় বেয়ে সমতল ভূমিতে হাজির হলেন। ওই জায়গাটা থেকে নীচের জঙ্গলের দিকে দৃষ্টি রাখা অনেক সহজ।
গহ্বরের মতো অরণ্য-সঙ্কুল নিম্নভূমি ছিল চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ একরের মতো চওড়া। জায়গাটা অতিশয় দুর্গম। অসমান মাটির উপর হাঁ করে রয়েছে অসংখ্য ফাটল, আর সেই ফেটে যাওয়া মাটির চারপাশে লতাগুল্ম ও শুষ্ক ঝোপের সমাবেশে গড়ে উঠেছে এক দুর্ভেদ্য ন্যূহ। অভিজ্ঞ শিকারি জেমস ইংলিস বুঝলেন একটি মাত্র হাতির সাহয্যে সেই উদ্ভিদের ব্যুহ ভেদ করে বাঘের সম্মুখীন হওয়া অসম্ভব।
সুতরাং তখনকার মতো বাঘের অনুসরণকার্যে ইস্তফা দিলেন জেমস ইংলিস। আশেপাশে একদল লোক মোতায়েন করে তিনি নির্দেশ দিলেন বাঘের গতিবিধির কোনো লক্ষণ দেখলে তারা যেন অবিলম্বে সেই খবর সাহেবকে পাঠিয়ে দেয়। নির্দেশ অনুসারে কাজ করলে প্রচুর পুরস্কারের আশা দিয়ে মৃত বাঘের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে সাহেব অ্যালেনগঞ্জে চলে গেলেন, আর সেখান থেকে তার ঘোড়ার সাহায্যে অশ্বারোহী দূত পাঠিয়ে দিলেন হাতি সংগ্রহের চেষ্টায়।
পরের দিন সকাল এগারোটার মধ্যে চারটি হাতি এসে হাজির। সঙ্গে এল একদল বলিষ্ঠ গ্রামবাসী তাদের হাতে বর্শা, মুগুর, তলোয়ার প্রভৃতি অস্ত্র। পাঁচটি হাতি সঙ্গে সশস্ত্র সেনাবাহিনী নিয়ে বাঘ শিকারে যাত্রা করলেন জেমস ইংলিস।
ইংলিস সাহেব ছিলেন মতির পিঠে। তাঁর একখানা বন্দুক নিয়ে আর একটি হাতির পিঠে বসেছিল জগরু, অন্যপাশে তিন নম্বর হাতির পিঠে ছিল বন্দুক হাতে জমিদার পুত্র। চতুর্থ ও পঞ্চম হাতির সঙ্গে সমবেত দল নিয়ে এবার জঙ্গল ভেঙে বাঘের অনুসন্ধান শুরু হল।
খোঁজাখুঁজিতে বেশি সময় নষ্ট করার দরকার হয়নি কারণ বাঘ নিজেই এগিয়ে এসে শিকারিদের অভ্যর্থনা জানাল।
অভিযান শুরু হতে না হতেই প্রকাণ্ড বাঘিনী সগর্জনে লাফিয়ে পড়ল একটি হাতির মাথার উপর!
হাতির মাহুত ছিটকে কাঁটাগাছের উপর পড়ে আর্তনাদ করতে লাগল তারস্বরে– আর হাতি তীব্র বৃহন-ধ্বনি চারদিক কাঁপয়ে সোজা ঝাঁপ দিল নদীর জলে। সেখানে চোরাবালির মধ্যে পড়ে তলিয়ে যেতে যেতে কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে চলৎশক্তিরহিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কুঁটো জগন্নাথের মতো! ওদিকে জঙ্গল-বাহিনীর দল অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ছত্রভঙ্গ!
মতি আগের দিন ভয় পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আজ সে যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিল। শুড় আর কান গুটিয়ে আক্রমণকারী বাঘিনীর দিকে অগ্রসর হল। বাহনের আকস্মিক গতিবেগে ভারসাম্য হারিয়ে ইংলিস পড়ে গেলেন, কোনমতে নিজেকে সামলে বন্দুকের নিশানা ঠিক করার আগেই ধূর্ত বাঘিনী আক্রান্ত হাতির মাথার কাছে নখের আঁচড় বসিয়ে আবার জঙ্গলের ভিতর ঢুকে লুকিয়ে পড়ল।
ওই ঘটনার ফলে লোকজন এমন ঘাবড়ে গেল যে, আর জঙ্গলে গিয়ে বাঘিনীকে তাড়া দিতে রাজি হল না। পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি, তিরস্কার এবং সাহেবের প্রচণ্ড ক্রোধ অগ্রাহ্য করে তারা গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নদীর পাড়ে জমির উপর। অগত্যা সাহেব একাই বাঘিনীর মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হলেন। তাঁর আদেশে মাহুত হাতিকে চালিয়ে দিল জঙ্গলের মধ্যে।
বেশি দূর যেতে হল না– ভীষণ গর্জনে চারদিক কাঁপিয়ে বাঘিনী ধেয়ে এল হাতির দিকে। সাহেব গুলি করলেন। গুলি সম্ভবত বাঘিনীর পিছনের দিকে লেগেছিল, একবার আর্তনাদ করে উঠল, পরক্ষণেই যুদ্ধের উদ্যম ভঙ্গি করে ঘন উদ্ভিদ আর আগাছার মধ্যে তিরবেগে সরে পড়ে আত্মগোপন করল।
মাথার উপর উচ্চভূমিতে দণ্ডায়মান জনতা মহা সমারোহে চিৎকার করে সাহেবকে জানাল বাঘিনী নদী পার করে পালিয়ে যাচ্ছে। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে নির্বোধের মতো বাঘিনীকে অনুসরণ করলেন! পরবর্তী ঘটনা থেকে বোঝা যায় অজানা জায়গায় ওই হঠকারিতার ফল সাহেবের পক্ষে মোটেই ভালো হয়নি। হাতির মাহুত ছিল এক অনভিজ্ঞ ছোকরা, সে হাতি অঙ্কুশের আঘাত করে আর কানের পিছনে পা দিয়ে মোচড় মেরে জোরে ছুটিয়ে দিল। জল তোলপাড় করে নদী পার হয়ে ছুটল হাতি। বাঘিনীকে দূরে এক জায়গায় দেখতে পেল, তারপরই একটা উঁচু বালির ঢিপি পেরিয়ে সে অগ্রসর হল। সাহেবের মনে হল জন্তুটা দস্তুরমতো ক্লান্ত।
আবার ছুটল হাতি। বালির ঢিপিটা পার হয়ে একবারের জন্য মহারানির দর্শন পেলেন ইংলিস, পরক্ষণেই নদীর পাশে অন্তর্ধান কলেন। বাঘিনীর ক্ষিপ্র গতিবেগ দেখে এবার কিন্তু সাহেবের মনে হল দূর থেকে গুলি করে তাকে বিশেষ কাবু করতে পারে নি।
মাহুত হাতিকে প্রাণপণে ছুটিয়ে দিল। বৃথা চেষ্টা বাঘিনী যেন জীবন্ত বিদ্যুৎশিখা, সাহেবের হাতি কিছুতেই বাঘিনীর কাছে পৌঁছাতে পারল না।
প্রায় দু-তিন মাইল পথ পেরিয়ে এসে ইংলিস বুঝলেন শিকার খুব সহজলভ্য হবে না। হয়তো তিনি সেখানে থেকেই ফিরে যেতেন, কিন্তু হতভাগা মাহুত সোৎসাহে জানাল এখন ফিরে যাওয়া অনুচিত। বিভ্রান্ত সাহেব মাহুতের কথায় সায় দিলেন।
অনেকক্ষণ ছুটোছুটি পর দেখা গেল হাতি অত্যন্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। বাঘিনীর পাত্তা নেই! সে যেন হাওয়ায় মিশে গেছে। দারুণ পিপাসায় ইংলিস সাহেবের প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। জলের জন্য খোঁজাখুঁজি শুরু হল। কোথায় জল? জায়গাটাকে মরুভূমি বললেও অত্যুক্তি হয় না। কোনো জীবিত প্রাণীর চিহ্ন সেখানে নেই।
দেখতে দেখতে সূর্য অস্ত গেল। এল রাত্রি। আকাশে দেখা গেল পূর্ণচন্দ্র। জ্যোৎস্নার ম্লান আলোতে বালির ঢিপিগুলো দেখে সাহেবের মনে হল প্রেতলোকের কয়েকটা অপচ্ছায়া যেন চাঁদের আলোর সঙ্গে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। ভুতুড়ে দৃশ্যটার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই যেন তীব্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল একদল শেয়াল। একতান সঙ্গীতের সেই বীভৎস ধ্বনি যেন অপার্থিব আতঙ্কের শিহরণ ছড়িয়ে দিল সাহেব ও তার সঙ্গীর বুকের মধ্যে।
স্বভাবসুলভ বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সাহায্যে হাতি নিশ্চয় জলের সন্ধান পেতে পারত, কিন্তু মুখ মাহুত হাতিটাকে এদিক-ওদিক চালিয়ে ক্লান্ত করে ফেলল।
অবশেষে হাতিও বিরক্ত হয়ে উঠল। সজোরে ঝাঁকনি মেরে আরোহীদের সে পিঠ থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল বার বার।
একে তৃষ্ণা, তার উপর দারুণ রোদে সারাদিন ছুটোছুটি করার ফলে সাহেবের শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে উঠেছিল। শ্রান্তদেহে তিনি হাতির পিঠ থেকে পড়ে গেলেন মাটিতে, আর পড়ামাত্র অজ্ঞান।
কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ইংলিস দেখলেন তিনি সম্পূর্ণ একা, আর তাকে ঘিরে বসে আছে পনেরোকুড়িটা শেয়াল তাদের লুব্ধ চক্ষু ক্ষুধিত আগ্রহে জ্বলছে জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ডের মতো!
দুটি শেয়াল হঠাৎ দাঁত খিঁচিয়ে পরস্পরের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করতে শুরু করল। সঙ্গেসঙ্গে সমস্ত দলটা চিৎকার করে উঠল তীব্র কণ্ঠে। বালুকাময় নির্জন প্রান্তরে সেই চিৎকার যেন চাবুক মেরে সাহেবের আচ্ছন্ন চেতনাকে জাগিয়ে দিল। মনের জোরে কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বন্দুকটা তুলে ধরলেন। তৎক্ষণাৎ তীরবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল শেয়ালের দল।
ইংলিস সাহেবের শুকনো জিভ তখন মুখের মধ্যে খর খর করছে, হাঁটু কাঁপছে, শরীর শিউরে উঠছে থেকে থেকে। বন্দুক আঁকড়ে ধরে তিনি এগিয়ে চললেন অন্ধের মতো। কিন্তু বেশি দূর যেতে হল না, কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বিতীয়বার তাকে সংজ্ঞা হারাতে হল। আবার যখন জ্ঞান হল তখন ভোর হয়ে গেছে, সর্যের আলো ঘন কুয়াশা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, তবু আচ্ছন্ন দৃষ্টিকে প্রাণপণে চালিত করে ইংলিস দেখলেন একটু দূরে অগভীর গর্তের ভিতর থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মিমোসা ঝোপের সারি। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা চিন্তা তার মস্তিষ্কে সাড়া দিল- ওখানে জল নেই তো?
শিকারের নিত্যসঙ্গী হান্টিং নাইফ সঙ্গেই ছিল সেই ধারাল ছোরা দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় মাটি খুঁড়ে ফেললেন জেমস ইংলিস। ধারণা নির্ভুল! জল রয়েছে বটে! ~-ময়লা ঘোলাটে জলে রুমাল ভিজিয়ে রুমাল বার বার নিংড়ে জলপান করে জেমস কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন।
সাহেব সেখানেই পড়ে রইলেন। মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য তার দেহের উপর অগ্নিবর্ষণ করল সারা দুপুর ধরে। বিকালের দিকে তার সঙ্গীরা যখন তাকে সেই ময়লা জল পরিপূর্ণ গর্তের পাশ থেকে উদ্ধার করল, তখন দারুণ জ্বরের ঝেকে প্রলাপ বকছেন জেমস ইংলিস।
আরোগ্যলাভের পর ইংলিস সাহেব বলেছেন, আমি যে কোথা দিয়ে কেমন করে আমার ফ্যাক্টরিতে ফিরে এসেছিলাম, সে কথা আজও বলতে পারি না।