উত্তাপ
ট্রেনখানা বৃষ্টিতে নেয়ে এসে দাঁড়াল। আর ঠিক সেই সময়ে মেয়েটা আবার খিল খিল করে হেসে উঠল। আবার ধ্বক ধ্বক করে উঠল হরেনের বুকের মধ্যে। তার লিকলিকে শরীরের রক্তে রক্তে অসহ্য জ্বালা ধরে গেল। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে তার বুকের মধ্যে আরও তোলপাড় করে উঠল। দেখল, মেয়েটাও ওর লোকজনের সঙ্গে সেখানেই নামছে। কোথায় যাবে এরা?
ছোট স্টেশন। যাত্রীও খুব অল্প কয়েকজন। কিছু খেতমজুর মেয়ে-পুরুষ। ভিজতে ভিজতে এসেছে। যাবেও ভিজতে ভিজতেই। টোকা, হুঁকো, বোঁচকা, টুকিটাকি সামান্য জিনিস হাতে কাঁধে ঝুলছে। কেমন ছন্নছাড়া ভেজা ভেজা একটা ভাব।
এখানেও বৃষ্টি হয়ে গেছে। হয়ে গেছে নয়, এখনও হচ্ছে। তেমন জোরে নয়। যেন হওয়ার ঝাপটায় নেমে আসছে ইলশাগুড়ি ছাট। এর আগের রাস্তায় জল আরও তোড়ে নেমেছে। ট্রেনের ছাদ দিয়ে জল পড়ে কামরাগুলি পর্যন্ত ভেসে গেছে। মনে হচ্ছিল, গাড়িটাই বুঝি লাইন থেকে হড়কে পড়ে যাবে।
আষাঢ় মাস। কিন্তু যেন শ্রাবণের ধারা লেগেছে। মাঝে মাঝে থমকায়। একটা আশা দেয়। আকাশ দাঁত খিঁচোয় দূরে দূরে। ভাবখানা, যাবি যা, নইলে এলুম বলে।
এসেই আছে। গড়িয়ে গড়িয়ে আকাশটা অষ্টপ্রহর নামছে। মেঘ দলা পাকাচ্ছে উঁচু চড়াইয়ের মাথায়। মনে হয়, চড়াই পেরিয়ে উৎরাইয়ের ঢালু প্রান্তর দলা দলা মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে। কাছাকাছি কোথাও চাষ-আবাদের লক্ষণ বিশেষ দেখা যায় না। যা আছে, খুব সামান্য। সবটাই লাল কাঁকর পাথরে ভরা। মাঝে মাঝে কাজল চোখের চকিত চাউনির মতো সবুজের ছিটে লেগেছে। কোথাও হঠাৎ এক সার ভূতের মতো মাথা তুলেছে সোজা বাঁকা তালগাছ। তার ঘন বেষ্টনীতে খোঁচা খোঁচা হয়ে আছে মেঘ অন্ধকার। তারপর দম আটকে চড়াই উঠেছে ঠেলে ঠেলে, হামাগুঁড়ি দিয়ে। এমন সময় আচমকা কয়েকটা শালগাছ। অন্যদিকে চোখ ফেরাতেই হয়তো দেখা যাবে ঝাঁকড়া মহুয়া গাছটা টলছে বাতাসে। কয়েকটা বিক্ষিপ্ত পলাশগাছ জলের ফোঁটা পড়া পাতায় পাতায় চেয়ে আছে বিষণ্ণ চোখে। তারপর কিছু নেই, যতদূর চোখ যায়। কেবল কালো কিম্ভূত আকাশটার তলায় এই উঁচু-নিচু বিশাল প্রান্তর যেন গেরুয়া আলখাল্লা-পরা রুদ্র সন্ন্যাসী, পড়ে পড়ে প্রতি লোমকূল দিয়ে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে আষাঢ়ের ঢলে।
স্টেশনটা উত্তর বীরভূমের পশ্চিম ঘেঁষে। ক্রোশ দেড়েক পশ্চিমে গেলে সাঁওতাল পরগনার সীমানা। পশ্চিমে, দূরে, মেঘের কোলে মেঘের মতো জেগে রয়েছে রাজমহল পাহাড়ের ইশারা। ইশারাটা দূর দিয়ে বেঁকে, অনেকখানি দক্ষিণে এসে হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে পুবে।
ট্রেন চলে গেল। হরেন সব ভুলে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল মেয়েটাকে। নিজের যাওয়ার কথা ভুলে, লক্ষ করছে ওদের গতিবিধি। যাদের সঙ্গে মেয়েটা আছে, একটা বুড়ো একটা বুড়ি, একটি মাঝবয়সী মেয়েমানুষ। আর ওই মেয়েটা। টোকা, হুঁকো, বোঁচকা, এমনি সামান্য কিছু জিনিস ওদের হাতে কাঁধে ঝুলছে। চাষের কাজে মজুরি খাটতে যাচ্ছে কোথাও। প্রথমে মনে হয়েছিল সাঁওতাল। কথা শুনে বুঝল, সাঁওতাল নয়। বাউরী কিংবা বাগদী হবে। গাড়িতে উঠেছে ওরা নলহাটি থেকে।
মরদ নেই সঙ্গে। মনে হচ্ছে, মেয়েটাই ওদের নিয়ে চলেছে। কালো রং মেয়ে। যেন ঝুঁটিওয়ালী একটি কালো মেয়ে পায়রা। মদ্দা এসে ঠুকরে খুনসুটি করবে। সেই আশায়, বুক উঁচিয়ে, মাথা হেলিয়ে দুলে দুলে চলেছে। চোখে দীপ্তি, গলায় বকম বকম। কিন্তু যাচ্ছে তো খাটতে, বোঝাই যাচ্ছে। আর সঙ্গেও কয়েকটা বুড়োবুড়ি। তবে এত হাসির ঢুলুনি ঢলানি কীসের।
গাড়িতে কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে। হরেন তার জীবনে অনেক মদ খাওয়া মেয়েমানুষের চোখ দেখেছে, সঙ্গও করেছে। ওই মেয়েটার টানা টানা চোখ দুটিও যেন মদ খাওয়া চোখ। একদিকে যেমন শান দেওয়া, আর একদিকে তেমনি ঢুলুঢুলু। নেশা ধরিয়ে দেয়। নেশা ধরেও গেছে হরেনের। হেসে হেসে গাড়ির অনেকের প্রাণেই নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। বোধ হয় বিধবা। আসল বয়সে রং ফুটে বেরুচ্ছে হাতে-পায়ে, কথায়, হাসিতে। রং করার ইচ্ছে আছে প্রাণে। কিন্তু যাবে কোথায় এরা?
সে ওই দলটার পেছনে পেছনে এসে দাঁড়াল স্টেশনের বাইরে। পরনে তার ফিনফিনে মিলের ধুতি, পপলিনের চকচকে শার্ট। পায়ে কালো রঙের বুট জুতো। রংটা ফরসা, কিন্তু যতখানি বেঁটে, ততখানি রোগা। বয়স তিরিশ না হলেও মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে চল্লিশেরও বেশি। শরীরের ক্ষয়টা জামার ভাঁজেও ফুটে উঠেছে। যেন বাঁশ ব্যাকারির কাঠামোর উপরে ঝুলছে জামাটি। শালিকের মতো সরু বুক। তার উপরে আবার বোতাম খুলে দিয়েছে বুকের। গায়ে এসেন্সের গন্ধ।
বাপের আছে ভাল জমিজমা, ঘর পুকুর। ছেলে মাত্র হরেন। কুলকুনুটি বংশ কুলিন রায়ের ছেলে। আট বছর ধরে শহর সিউড়িতে ছেলে পড়ছে কলেজের এক ক্লাশে। বাপ টাকা পাঠায় নিয়মিত। হরেন টাকাটা সরস্বতীর পায়েই দেয়। তিনি হলেন দুষ্টু সরস্বতী। বিদ্যের প্রকৃতিটা একটু অন্য রসের। আজকে যে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে মেয়েটা, এ নেশা আট বছর ধরে রপ্ত করেছে সে। এখন দর্শনেই নেশা হয়, আর নেশার মতো বস্তুও বটে।
সামনে এসে মেয়েটিকে ভাল করে দেখল সে। গায়ে জামা নেই। নিভাঁজ গ্রীবার নীচে দিয়ে রূপোর বিছে হার বুকের টান টান কাপড়ের ঢাকায় হারিয়ে গেছে। কানের ফুটোয় গোঁজা দুটি পেতলের মাকড়ি। সিঁথেয় সিঁদুরের আভাস দেখা গেল এবার। জলে ধুয়ে অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
মেয়েটা তাকাল হরেনের দিকে। তাকিয়ে হঠাৎ একটু ঠোঁট টিপে হেসে সরে গেল মাঝবয়সী মেয়েমানুষটির কাছে। ঠোঁট বেঁকিয়ে কী যেন বলল ফিসফিস করে। মাঝবয়সী মেয়েমানুষটি ফিরে তাকাল। তারপর তাকাল বুড়োবুড়ি। কেমন যেন ছেলেমানুষের মতো চাউনি বুড়োবুড়ির।
বুড়ো বলল হরেনকে, কুথাকে যাবেন গ বাবু?
যাক, মুখ খোলা গেল। এবারে জানা যাবে গতিবিধি। হরেন বলল, কে আমি? যাব তো রলাটি, কিন্তু
রলাটি? ওরা সবাই একসঙ্গে ফিরে তাকাল তার দিকে। বলল, অলাটি যাবেন। আপুনি। আরে বাপ! গাড়ি নাই, গরু নাই, দুস্তর রাস্তা, ম্যাঘ-বিষ্টি। কী করে যাবেন গ?
সেইটেই এতক্ষণে হুঁশ হল হরেনের। তাই তো চিঠি দিয়েছিল বাড়িতে গরুর গাড়ি পাঠাবার জন্যে। কিন্তু কাকপক্ষীও তো নেই। সে ফিরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কোথায় যাবে?
অলাটি।
রলাটি?
হুঁ। ফি বছরে যাই। মজুরি খাটতে যাই গ। ইবারে এট্টুস আগে আগে বেরলম। দেখেন ক্যানে আকাশের ভাব। সব ভাসায়ে লিবে মনে হচ্ছে।
হরেনের প্রাণে রস নামল আরও। রলাটি যাবে তা হলে? একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে চাইল সে। বলল, কার ঘরে কাজ করতে যাচ্ছিস? কথা বলে এদিকে। নজর থাকে মেয়েটির দিকে। জবাব বুড়োই দিল, ইন্দির চাটুজ্যে মশায়ের ঘরে। অলাটির কুন্ ঘর আপনাকাদের?
গদাই রায়, মনে গদাধর—
হঁ হঁ, বুঝলাম গ। তা আপুনি
কথার মাঝেই সেই মেয়েটি কপট রোষে ফুঁসে উঠল, আ কী যন্তনা গ গপ্প করছ, ইদিকে যে দিন যায়।
সবাই নড়েচড়ে উঠল। বুড়ো বলল হরেনকে, চলি গ বাবু। সাত কোশ রাস্তা যেতে যেতে বাতি জ্বলবে ঘরে।
হরেনকে এই সময়ে হঠাৎ কেমন বোকা বোকা মনে হতে লাগল। সে কিছু স্থির করতে পারছে। এতটা রাস্তা হাঁটবার সাহস নেই তার। তার উপরে জল। ফিস ফিস করে পড়ছেই। একটা ছাতাও নেই সঙ্গে। সে অসহায়ের মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে।
চোখাচোখি হতে মেয়েটা আবার হেসে উঠল খিলখিল করে। সারা শরীরের সঙ্গে রূপোর বিছেহারটিও কালো মেঘের বুকে বিদ্যুতের মতো চমকে উঠল। হাসির মধ্যে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ ছুড়ে দিয়ে গেল পেছনে। খোঁপার উপর দিয়ে ঘোমটা তুলে, মাথায় বসিয়ে দিল টোকা। বুকে কেটে কেটে বসা হাসিটা নিয়ে হৃৎপিণ্ডহীনের মতো দাঁড়িয়ে রইল হরেন। ভাবল, হুঁ! রং চায় মেয়েটা।
সামনের চড়াইয়ের গা বেয়ে বেয়ে মেঘ নামছে। লাল মাটির বুকে জল যেন ঢল নামিয়ে দিয়েছে রক্তের। বিদ্যুৎ-ঝিলিকে টাটকা রক্ত ক্ষতের মতো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে লাল পাঁক। ক্রুদ্ধ খ্যাপা কুকুরের মতো দূর আকাশ গরগর করছে থেকে থেকে। থেকে থেকে দূরের রাজমহলের ইশারাটুকু হারিয়ে যাচ্ছে একেবারে। আবার যেন কেউ পেন্সিল টেনে বসিয়ে দিচ্ছে।
ওদের চারজনকে ছাড়া লোক দেখা যায় না একটিও। সামনের রাস্তাটা গরু আর মানুষের পায়ের দাগে এবড়ো খেবড়ো কর্দমাক্ত হয়ে উঠেছে। ক্রোশ দেড়েক পশ্চিমে গেলে বীরভূমের সীমানা পার হয়ে সাঁওতাল পরগনা পড়বে। তারপর একটু দক্ষিণে এসে আবার খাড়া পশ্চিমে, সাঁওতাল পরগনার মধ্যে পাঁচ ক্রোশ রলাটি। দূরে দূরে কিছু সাঁওতাল গ্রাম, মাঝখানে হঠাৎ একটি বাঙালি গ্রাম। কয়েক ঘর ব্রাহ্মণের বাস। সেই পাঠান যুগ থেকে এমনি আছে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থমকে রইল হরেন। আবার ফিরে তাকাল দলটির দিকে। সেই মেয়েটা সবচেয়ে পেছনে। তাকিয়েও বুকটা রন্রন করে উঠল। মেয়েটার বলিষ্ঠ ঋজু পেছনটা যেন সমস্ত দলটিকে সাপটে হস্তিনীর মতো দুলে দুলে চলেছে। দেখতে দেখতে আবার কানে এসে পৌঁছল হাসির অস্ফুট নিক্কণ।
আর দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পা বাড়াল হরেন। সঙ্গে সঙ্গে পুবে পশ্চিমে আকাশটা চির খেয়ে গেল বিদ্যুৎকষায়। মাটি যেন রক্তাক্ত মুখ হা করে হেসে উঠল। বাজ হানল আকাশে। হঠাৎ বাতাসে মরকুটে বাবলা ঝাড় নুয়ে নুয়ে পড়ল। সামনের ন্যাড়া তালগাছে সভয়ে কা কা করে উঠল একটা কাক। হরেন চিৎকার করে ডাক দিল, ওহে, ও বুড়া শুন ক্যানে।
ওরা দাঁড়াল চারজন। মাটিতে পা দিয়েই বুঝল হরেন, বুট জুতো কামড়ে কামড়ে ধরছে কাদা। ওইটুকুনি যেতে হাঁফ ধরে গেল। কাছে গিয়েই আগে মেয়েটির দিকে তাকাল সে।
মেয়েটি তার দিকেই নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রয়েছে। চোখে তার সেই মাতাল হাসি, একটু যেন ধারালো। ঠোঁটের কোণ তেমনি বেঁকে। বিদ্রূপ না মশকরা, সহসা বোঝা যায় না। কালো-পাথর-চড়াই বুকের বাস কিছু শিথিল হয়েছে।
বুড়োর দিকে ফিরে বলল হরেন, গাড়ি আসেনি, আসবে কিনা কে জানে। চ তোদের সঙ্গেই হাঁটা দি।
বুড়ো বলল, আরে বাপ্। ই হয় না। আমরা জনমজুর মানুস, তাতেই আলামরা হয়ে যাই। আপুন ক্যানে পারবে।
বুড়ি সস্নেহ গলায় বলল, হঁ। না না, ই হয় না।
মেয়েটি হঠাৎ ধারালো ছুরির মতো চকিত হেসে বলল, প্রাণ চেয়েছে হাঁটতে। বলেই আবার চড়াইয়ে প্রতিধ্বনি তুলে হেসে উঠল।
বুড়ি বলল, আঃ, ই কি হাসি। বড় বেহায়া তু বউ।
মাঝবয়সী মেয়েমানুষটি মুখে আঁচল চেপে একেবারে চুপচাপ। বুড়ো আবার বলল, আকাশের গতিক ভাল না। আপুনি থাকেন গ! অলাটি কি এখনে? আমরা যেছি গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বুলব।
হরেন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, না, যাব। এই তোরা কজনা রইছিস। দুটো সুখ দুঃখের কথা বলতে বলতে চলে যাব।
আবার চিকচিক বিদ্যুৎ হানল। মেয়েটাও হাসল বিদ্যুতের মতো। আবার এক ঝলক বাতাস নামল হুস করে। মেয়েটা দ্রুতগতি মেঘের মতো চকিত বাঁকে চড়াইয়ে পা বাড়াল।
বুড়োবুড়ি খানিকটা অসহায়ের মতো চুপচাপ রইল। তারপর হাঁটা ধরল। এবার মেয়েটা সকলের আগে। চড়াইয়ের পরে মেঘ। যেন মেঘে মেঘে হারিয়ে যাবে, সেইদিকে নিশানা।
বাতাস এলে ছাট বেশি আসে। নইলে মন্থর ফিসফিসে। আর এই জলে পিছল মাটি পায়ে ধরে হ্যাঁচকা দেয়। দশ পা হাঁটলে পাঁচ পা এগুনো যায়। পা নেমে আসে হড়কে।
হরেন একদিক ঘেঁষে চলল। যেখান থেকে মেয়েটাকে পুরো দেখা যায়। দেখতে গান মনে পড়ল। মনে পড়তেই গুন গুন করে গেয়ে উঠল, সখী আমা পানে চাও ফিরিয়া দাঁড়াও..ওদিকে চোখাচোখি হল মাঝবয়সীর সঙ্গে মেয়েটির। আবার হাসি। বুড়োবুড়ি নির্বিকারভাবে উঠছে ঠেলে ঠেলে।
ওরা যত ওঠে, আকাশ তত ওঠে। উপরে বাতাসের জোর বেশি। বড় চড়াই। সময় নিচ্ছে উঠতে। তারপরে উৎরাই। সেখানে দশ পা নামতে, বিশ পা টেনে নিয়ে যায়। নিয়ে মুখ গুঁজড়ে ফেলতে। উৎরাইয়ে এসে, ঘাসের উপর দিয়ে চলল সবাই। ঘাসে পেছলায় কম। কিন্তু ঘাসের তলে তলে পাঁক। টেনে টেনে ধরে। যত না ধরে খালি পা, তার চেয়ে বেশি জুতো। উৎরাইয়ের ধাপে ধাপে হঠাৎ মাথা তুলেছে কয়েকটা তালগাছ। কোথাও কিছু নয়, যেন হঠাৎ কতকগুলি দত্যি মাথা নেড়ে নেড়ে কানাকানি করছে। খসখস শব্দে হাসছে মানুষ দেখে। আর কিছু নেই। শুধু উঁচু নিচু উঁচু। মেঘে বসছে চেপে চেপে।
মেয়েটাকে শুনিয়ে হরেন জিজ্ঞেস করল বুড়োকে, ওই বউ দুটো কে হয় বটে?
বুড়ো টোকায় তলা থেকে বলল, বিটার বউ। দুটে বিটার বউ। বিটারা গেলছে সক্কালবেলা আগে আগে। ইয়াদের লিয়ে এখন আমি চলছি।
সাবধানে সাবধানে নামছে হরেন। নজর আছে আগে আগে। যেখানে জলের মতো তরতর করে গড়িয়ে চলেছে মেয়েটা। ওর কালো পায়ের শক্ত গোছা দেখে মনে হয়, মাটিতে বসলে আর উঠবে না। কিন্তু অমন পা দুখানি যেন পাঁকে বসছে কি না বসছে। ছিটকে যাচ্ছে রক্ত পঙ্ক। লালে লাল হয়ে গেছে সকলের পা। হরেনের কালো জুতো লাল হয়ে এসেছে। কাপড়ে লেগেছে চাপ চাপ রক্তের মতো।
হরেন ভাবছে, বুড়োর সঙ্গে ভাব করা যাক আগে। রলাটির ছোকরা বাবুদের মন চেনে ওরা। কথার ভাবে বোঝে, কী চায় বাবুরা। বলল, তবে ই বয়সে তুমার, দুটা বুড়াবুড়ির তো বড় কষ্ট হে?
বুড়ো হাসল টোকার তলায়। বৈরাগীর আত্মভোলা হাসির মতো। বলল, কস্ট? কষ্ট কী গ বাবু। ই কী রোগ ব্যামো যে কষ্ট হচ্চে? সমসারে যাবৎ মানুষ খাটে, খাটতে হয়। সি কুন কষ্ট লয়। ইটা খাটুনি। যখন লারবে, তখন মনে কষ্ট হবেক।
হরেনের মন বিগড়ে উঠল বুড়োর কথা শুনে। এর মধ্যেই তার বুকে হাঁফ লাগছে, গলায় উঠছে সাঁই সাঁই শব্দ। কোমরের গাঁটে গাঁটে কনকনানি। আর ওর বুড়ো হাড়ে কোনও কষ্ট নেই। ব্যাটা বজ্জাত, বেশিদূর হরেনকে এগুতে দিতে চায় না।
হরেন আবার বলল, তা বউ বেটা সব চলেছে, লাতিলাতকুর নাই?
বুড়ো খালি বলল, নাঃ!
বলতে গিয়ে বুড়োর বুকে যেন একটি দীর্ঘশ্বাস আটকে রইল। আটকে রইল যেন সকলের বুকেই। বুড়োবুড়ি, মাঝবয়সী আর… না, মেয়েটার ভাব দেখে কিছু বোঝা যায় না। ঝুঁটি পায়রার মতো বুক এগিয়ে নেমেই চলেছে। তবু কেমন একটা স্তব্ধতা।
কেবল পাঁকে পাঁকে থপ থপ্ চল্ চল্। কালো কালো কতগুলি থ্যাবড়া পা, আর লাল কাদা। আকাশের ডাক বাড়ছে। ডাকছে ওই সামনের চড়াইটার মাথায়। চড়াইয়ের গা দিয়ে নামছে হিলিবিলি বিদ্যুৎ। চিকচিক করছে তালবনের মাথায়। দগদগিয়ে উঠছে লাল পাঁক। তরল পাঁক গরুর গাড়ির লিক বেয়ে বেয়ে গড়াচ্ছে আঁকাবাঁকা সাপের মতো। তরল কিন্তু আঁটালো। অন্ধকার আরও নামছে। কে বলবে, এখন ভর দুপুর। যেন সাঁঝের শাঁখ বাজানোর সময় হল।
আস্তে আস্তে ওদের চারজনের গতি কমছে না। বাড়ছে বাড়াতে হচ্ছে হরেনকেও।
তারপর অনেক্ষণ বাদে হঠাৎ বুড়ো হুস করে একটা নিশ্বাস ফেলল। যেন এতক্ষণ ধরে চেপেছিল দম। আর সেই মুহূর্তেই আকাশটা জলের তোড় নিয়ে গলে গলে পড়তে লাগল। পট পট ফুটতে লাগল ওদের তালপাতার টোকাগুলিতে।
তার মধ্যে গোঙানির সুরে বুড়ো বলল, হঁ, ছোট বিটার এট্টা ছেল্যা হয়েছিল। তা পরে মরে গেল গ বাবু। এই সিদিনে, ছ মাসের ছেল্যা!…
বুড়ির গলা দিয়ে শব্দ বেরুল, হঁ-হ-হ।
ও! ওই মেয়েটারই ছ মাসের ছেলে মরে গেছে। কিন্তু
দূর। বিরক্ত হয়ে উঠল হরেন। বৃষ্টিটা বেড়েছে। জুতো ভিজে ঢোল। কাপড়ের কোঁচা দিয়েছে মাথায়। কিন্তু সব সপসপে হয়ে উঠেছে। বুড়োও যেন বৃষ্টির মতো ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করল।
সে লাফিয়ে লাফিয়ে আগে গেল। আগে, মাঝবয়সীটিকে পার হয়ে, তার আসলটির কাছে। হুঁ। গালের পাশে এখনও সেই হাসিটি লেগে রয়েছে। আড়চোখে দেখছে হরেনকে। দেখছে, আর কেঁপে কেঁপে উঠছে ভ্রূদুটি। মদ্দার খুনসুটি চায়।
পাশাপাশি দু হাত ফারাকে এসে পড়ল হরেন। হাঁপিয়ে পড়ছে আসতে। বলল, কির্যা বউ, তু যে ঘোড়ায় জিন দিইছিস।
মেয়েটি চকিত চোখে একবার তাকিয়ে দেখল হরেনের আপাদমস্তক। দেখে আরও হাসি পেল। পাওয়ার মতো চেহারাই দেখাচ্ছে হরেনের। ভেজা জামা লেপটে, একটুখানি শরীরটি দুমড়ে গেছে যেন। কিন্তু চোখ জ্বলছে দপদপ।
জ্বলছে রক্তের মধ্যে। পথচলা আর দুর্যোগটা কাবু করে দিচ্ছে। তবু নিজের রক্তে রক্তে মেয়েটার হাসির কাঁপুনিটা অনুভব করছে। পশ্চিমে ছাট জলের। টোকার তলা দিয়ে জলের ছাট এক বুকের। কাপড় ভিজিয়ে দিয়েছে। ভিজে ভিজে যেন আরও তীব্রভাবে সব খুলে দিয়েছে রেখায় রেখায়। রেখার বাঁকে বাঁকে অস্পষ্ট বিদ্যুতের মতো রূপোর বিছেহারটির শেষ দেখা যাচ্ছে। খেয়াল নেই, টানাগোছের সময়ও নেই। শুধু টেপা ঠোঁটের কোণে কোণে, টানা চোখের আঙিনায় কী যেন খেলে বেড়াচ্ছে। রং খেলছে। রং চায়। কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া শক্ত। দু হাত ফারাক, দেড়হাত ফারাক করল হরেন। ওই আকাশের মেঘের মতো মেয়েটার নিটোল পেশি দুলে দুলে যেন নেমে আসছে হরেনের চোখের সামনে। চোখের সামনে, বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে শরীরের উঁচুনিচু বাঁকে।
দারুণ বাতাস এল পলাশবনের মাথা দুলিয়ে। আকাশে আচমকা বিদ্যুতের কাটাকাটি ধাঁধিয়ে দিল চোখ। যেন অনেকগুলি খ্যাপা কুকুর তীব্র চিৎকারে মাতামাতি শুরু করল। চোখের নজর হারিয়ে গেল হরেনের। সামনে শুধু জলের ধারা। সেই সঙ্গে অস্ফুট হাসির শব্দ।
বুড়োর গলা শোনা গেল, সামলে গ। সামলে চল। আবার জোর লেমেছে। সামনে কিন্তুক লদী।
নদী আছে। হরেন দেখল, সে সকলের পেছনে। ছায়ার মতো চারজনের দলটা তার আগে আগে। সে মনে মনে বলল, এঃ শালা, মরতে হবে নাকি? বৃষ্টির ঝাপটা তাকে যেন বুকে চেপে ঠেলে দিচ্ছে পিছনে।
পরনের কাপড়টি সে হাঁটুর চেয়েও এক বিঘত ওপরে তুলে ফেলল। তার সরু পায়ে জুতো জোড়া যেমন বড়, তেমনি ভারী দেখাচ্ছে।
রাস্তা বদলে গেছে। পাথর ছড়ানো রাস্তা। বড় বড় চাংড়া, খোঁচা খোঁচা হয়ে ছড়িয়ে আছে। তারই আশপাশ দিয়ে যেতে হবে। হরেনের চেয়েও বড় বড় পাথর। যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়ে থমকে আছে। মাথা ঠুকলে রক্তপাত নিশ্চিত। আর এরই তলে তলে পাঁক।
সামনে নদী। ছ হাত চওড়া নদী। এখন কোমর জল। অন্য সময় পায়ের পাতা ডোবে না। কিন্তু কোমর জলেই যা টান। ব্যাং ছানার মত টেনে নিয়ে যেতে চায়। তোড়ের মুখে হাসছে খলখল করে।
মেয়েটাও হাসছে। জলের নীচে পাথরে হোঁচট খেয়ে একেবারে ডুব দিয়ে উঠেছে, তাই হাসছে। সে হাসিতে নদীর হাসিও চাপা পড়ে যায়।
হরেন পার হল। বুড়ি তখন ছোবড়া পাকাচ্ছে। বুড়ো টোকার তলায় কলকে সাজাচ্ছে।
হরেনের চোখ তখন আধ খোলা। দেখল মেয়েটার গায়ে কাপড় নেই। রক্তের জ্বালায় না জলের ঝাপ্টায়, কে জানে, তার কাঁপন ধরল। কাপড় নেই নয়, আছে। না থেকে আছে। জলে ড়ুবে উঠেছে। কালো শরীর ছাপিয়ে উঠে ঝিলিক হানছে। কাপড় উঠেছে হাঁটু অবধি, পিঠ গেছে খুলে। কাছে যাবার জন্যে ব্যাঙের মতো লাফাতে লাগল হরেন। মাঝবয়সীকে কী যেন বলছে মেয়েটি। ফিরে ফিরে দেখছে হরেনকে আর বৃষ্টিধারার মতো মরছে হেসে।
আবার, আবার আসছে মুষলধারে। হরেন তবু কাছে গেল। মাঝবয়সীকে জিজ্ঞেস করল, তোরা হাসছিস যে?
মাঝবয়সী এতক্ষণে বলল, ক্যানে? তুমাকে দেখে। ক্ষ্যামতা নাই, আসতে ক্যানে গেলে।
হরেন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে জবাব দিল, ক্যানে, এই তো চলছি।
তার হাঁপ ধরা দেখে ওরা দুজনেই হেসে উঠল। মেয়েটা আবার কাছাকাছি। চোখে বিদ্যুৎ হেসে হেসে বলল, সামনে লিদেন আসছে যে।
নিদেন। বুকের মধ্যে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল হরেনের। মরণ আসছে তার সামনে। তার পিঠের শিরদাঁড়ার কাছে কী যেন নামছে হিলহিল করে।
মেয়েটা আরও কাছে। ওর বৃষ্টি-ধোয়া গায়ের গন্ধ লাগছে তার নাকে। ওর নীচে ওপরে, বিশাল শরীরের প্রতিটি পেশির পেষণশব্দও যেন কানে আসছে হরেনের। যেন রং চায় ওর প্রতি অঙ্গ।
কিন্তু রংটা ঘোলা হয়ে উঠছে হরেনের চোখে। পাঁক বাড়ছে। নিশিরাইয়ের কাছে আসা গেল। বুড়ো চেঁচিয়ে বলল, নিশি আই আসল গ। আর একটু পা চালাও।
নিশিরাই। হরেনের দাঁতে দাঁত লাগছে ঠকঠক করে। শীত ধরেছে হৃৎপিণ্ডে। বিদ্যুৎকষায় লাল তেপান্তর দগদগে ঘায়ের মতো লাগছে চোখে। তালের পাতায় চাপা তীব্র সুরে গোঙাচ্ছে বাতাস। যেন পেতনী কাঁদছে।
ওরা মুখ বুজে চলেছে এবার। ওদেরও নিশ্বাস হয়েছে ঘন ঘন। থ্যাবড়া পায়ে মাটি থ্যাঁতলাচ্ছে।
মেয়েটা কোথায় উধাও হয়ে গেল। ওই, ওই যাচ্ছে। পায়রা নয়, নাগিনীর মতো লকলক করে চলেছে। আর মনে হচ্ছে, তার হৃৎপিণ্ড উঠে আসছে গলা দিয়ে। উঠে আসছে আর নীচের থেকে অবশ হয়ে যাচ্ছে শরীর। অবশ, অবশ একেবারে।
আবার বাজ হানল কক্কড় শব্দে। একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল হরেনের চোখ। শালিকের প্রাণ খাবি খাচ্ছে। পাঁকে মুখ থুবড়ে পড়ল সে।
আ হা হা
বুড়োটা সস্নেহে সভয়ে চিৎকার করে উঠল। বুড়ো বুড়ি ছুটে এল। তারপরে মাঝবয়সী। তার পেছনে সংশয়ান্বিত পায়ে পায়ে এল মেয়েটা।
বুড়ো বসে ডাক দিল, আ-হা-হা! উঠ, উঠ গ বাবু। বলছিলাম তখন
ওঠে না হরেন। জলে ভিজে ভিজে, হাড় কেঁপে অচৈতন্য হয়েছে। বুড়ো বলে উঠল, হে ভগবান। ইয়ার জ্ঞান লাই যে গ।
জ্ঞান নাই। কে টেনে তোলে? বুড়ো বুড়ি কাহিল। মাঝবয়সী রুগ্ন। মেয়েটাই টেনে তুলল। তুলে নিয়ে গেল একটা মহুয়ার তলায়। বুড়ো অসহায়ের মতো তাকাল পশ্চিমে। এখনও দেড় ক্রোশ! উই দূরে, পাহাড়টা গেছে আরও সরে। তার নীচে একটি কালচে রেখা। ওইটে অলাটি। অর্থাৎ রলাটি।
হরেন কাঁপছে থরথর করে। কাঁপছে আর লালা গড়াচ্ছে ঠোঁটের কষ দিয়ে।
বুড়ি বলল, বউ, নোকটার কাঁপন লেগেছে যে? বাঁচবে তো? মেয়েটির চোখেও অসহায়তা। তার টানা চোখে ভয় ও ব্যথা। বলল, তা–ই তো! আগে শুখনা কাপড় একখান দেও এখন।
বুড়ি তাই দিল বোঁচকা খুলে। মেয়েটি তার কোলে টেনে নিয়ে বসেছে হরেনকে। ভেজা জামা ছাড়িয়ে, মাথা মুছিয়ে শুকনো কাপড় জড়াল তাকে। নিজের টোকাটি দিল হরেনের মাথায় ঢেকে। মাঝবয়সী তার টোকাটি দিল হরেনের পায়ে। বৃষ্টি তো বন্ধ নেই।
তারপর কোলের ছেলেকে যেমন করে বলে তেমনি সস্নেহে গলায় বলল, ইয়ার বড় বাড়াবাড়ি। আমরা যেছি অলাটি তো খবর দিতুমনি? তা-ই নোকের বড় বাড়াবাড়ি। বলতে বলতে হেসে ফেলল মেয়েটি। স্নেহকরুণ হয়ে উঠল চোখ। সেই চোখে সে দেখল হরেনের আপাদমস্তক। চোখাচোখি করল মাঝবয়সীর সঙ্গে।
বুড়ো বলে উঠল, হুঁ। নোকটাকে তু বাঁচা গ বউ। ই বুড় হাড়ে তো ক্ষ্যামতা লাই।
মেয়েটা বলল, অ মা! তবে কি মেরে ফেলছি নাকি গ। বাপ মায়ের ছেল্যা তো এট্টা।
হুঁ! বাপ মায়ের ছেল্যা!
হঠাৎ এই বর্ষণ মুখরিত রক্ত তেপান্তর খাড়াই উৎরাই কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। তালপাতার বাতাসে গুমরে গুমরে উঠল কান্না। বাবলা ঝাড় বাতাসে মাটির বুক ভরে নুয়ে নুয়ে পড়তে লাগল।
ছোট বিটার ছ মাসের ছেল্যাটার শোক চারটে বুকে পাথর হয়ে জমে আছে। সে তো বাপ মায়ের ছেলে ছিল!
মেয়েটা দু হাত দিয়ে সাপটে ধরল হরেনের অচৈতন্য মুখ। ই কী বাড়াবাড়ি বাপু তোমার, অ্যাঁ? মানুষের জীবন, সে কি ছেলেখেলার জিনিস! ছেলেখেলা করতে এসে মানুষ এমনি করে মরণ ডাকে।
হঠাৎ আবার কেঁপে উঠল হরেন। হাত পা খিঁচিয়ে থরথরিয়ে উঠল সর্বাঙ্গ।
এই, অ্যাই দ্যাখো ক্যানে কাণ্ডো।
সভয়ে বলতে বলতে মেয়েটি বুকের কাছে আরও আঁকড়ে নিল হরেনকে।
বুড়োও কাঁপছে। যত না জলে, তার চেয়ে বেশি ভয়ে। বলল, তোরা থাক ইখেনে। আমি যেছি। যেয়ে গাড়ি পাঠায়ে দিই।
মেয়েটি বলে উঠল, হুঁ, তুমি যাও গ বাবা, ই তো ভাল বুঝি না।
বুড়ো চলে গেল। মাঝবয়সী বলল মেয়েটিকে, গরম করতে হবে। শরীলে কিছু নাই।
মেয়েটি আরও বুকে চেপে ধরল। মাঝবয়সী বলল, আ দূর মরণ। বুকের ভিজা কাপড়টা ক্যানে চাপছিস। আরও জল নাগছে যে মুখে। কাপড় সরা। লজ্জা কীসের? বাপ মায়ের ছেল্যাটা। বুকের ওম্ পেলে গরম হবে।
মেয়েটি কাপড় সরিয়ে দিল। কক্কড় করে বাজ হানল। সাপিনীর মতো বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে নেমে এল মাটিতে। কিন্তু আকাশের সব ভয় সমারোহ এখানে কেমন শান্ত ও দৃঢ় হয়ে উঠেছে। তাকে আড়াল করে মানুষ মানুষের মৃত্যুশীতকে তপ্ত করছে। মেয়েটার বুকে ওর ছেলেটার দাগ রয়েছে এখনও। হরেনকে ওর উত্তাপের চাপে চাপে গরম করতে লাগল। একটু একটু করে, অনেকক্ষণ ধরে।
যেন একটুখানি ছেলে, সবটুকু কোলে ধরা যায়।
এবার সত্যিকারের অন্ধকার নামছে। মেঘ তাকে গাঢ় করছে। এখনও গরাইয়ের সেই মানুষ ডোবা রক্ত পাঁক হতে হবে।
হঠাৎ মেয়েটা চমকে উঠল। বিছের মতো সুড়সুড় করে কী যেন উঠে এসেছে তার বুকে, কোমরের আশেপাশে। দেখল চোখ চেয়েছে হরেন। যেন স্বপ্ন দেখছে, এমনি বিস্ময়ে। যেন সেই বিস্ময়ের ঝোঁকেই আর একবার কেঁপে উঠল সে। বিস্ফারিত চোখে আর একবার দেখে হিংস্র চোখে হেসে উঠল সে। মুহূর্তে সরু সরু দুটো হাত দিয়ে মুঠো করে আঁকড়ে ধরল মেয়েটাকে।
মেয়েটা প্রথমে হরেনের জ্ঞান দেখে হেসে উঠল। হাত দুটো সরিয়ে দিল গায়ের থেকে। পরমুহূর্তেই হরেনের সেই রুগ্ন ছোট্ট মুখটার হিংস্রতা দেখে থমকে গেল। রক্তের মধ্যে সেই আগের দর্প পেয়ে হরেন প্রাণপণে হাত প্রবেশ করিয়ে দিল মেয়েটার দু হাতের তলা দিয়ে। মুখ তুলে আনতে চেষ্টা করল ওপরে।
দপদপ করে জ্বলে উঠল মেয়েটার টানা চোখ। তার বলিষ্ঠ নিটোল হাতের এক ঝটকায় ছিটকে ফেলে দিল হরেনকে। বলল, আ মরণ! কেন্নোর মরণ গ! বলে, সেই ক্রুদ্ধ মুখেও হেসে উঠল মেয়েটি, ই আর বাঁচবেনি দেখছি গ।
বিদ্যুৎ চমকে, দিকে দিকে, উঁচুনিচু তেপান্তর যেন হাসছে রক্তাক্ত মুখে। আর তালের সারি যেন অশরীর ছায়ার মতো পায়ে পায়ে আসছে এখানে এগিয়ে।
হরেনের গায়ে এমনিতেই কাদা মাখামাখি। আবার কাদা লাগল। পাঁক থেকে মুখ তুলে কিছু একটা বলার উদ্যোগ করল। চোখ তার তখনও মেয়ে বুকের উত্তাপে চকচক করছে।
এমন সময় ওপরের চড়াই থেকে হাঁক শোনা গেল বুডোর। বলদের ঘন্টা শোনা গেল। গাড়ি আসছে।
গাড়ি এল, গদাই রায়ের ছেলেটাকে তুলল। তুলে চলল।
এতক্ষণে শরীরের যন্ত্রণায় হরেনের চোখে একটি নোনাধরা চোঁয়াচ্ছে।
বৃষ্টি তখনও তেমনি। ওরা চারজন গাড়ির আগে আগে চলল। মেয়েটির চোখে যেন হঠাৎ রুদ্ধ অভিমানে দুরন্ত হয়ে উঠল। বুকের কাপড়টি কষে টেনে দিল সে। ওদের পেছনে বৃষ্টির শব্দের মধ্যে গাড়ির চাকা দুটো ককাচ্ছে। ককিয়ে কাঁদছে।