নয়
তখনো ক্লাস সিক্সেই পড়ি। এনুয়াল পরীক্ষা দরজায় কড়া নাড়ছে। অথচ সেদিন আমি ‘রিডিং- রুমে’ বসে ‘বনে-জঙ্গলে’ পড়ছিলাম। এমন সময় মফিজ এসে বললো :
—দু’মাস বাদে পরীক্ষা। তুই ‘বনে-জঙ্গলে’ পড়ছিস!
–শুরু করেছি। শেষ না করে উঠতে পারছি নে।
মফিজ অনেকক্ষণ কোনো কথা বলে না; কিন্তু চলেও যায় না।
—কি রে। কিছু বলবি?
মফিজ আমার কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে গলা খুব খাটো করে বলে :
তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
—কি কথা?
মফিজ এদিক-ওদিক সাবধানে দেখে নিয়ে বললো :
—ফার্সি পড়াবার জন্য মৌলবী সাহেবকে মাস্টার রাখবি? তিনি বলেছেন, এনুয়াল পরীক্ষায় তোকে পঁচানব্বুই নম্বর দেবেন। তুই তো সব সাবজেক্টেই ভালো, ফার্সিতে একটু বেশি নম্বর পেলে ক্লাসে তোর পজিশন থাকবে। দু’মাস পঁচিশ টাকা করে মাইনে দিলেই হবে।
—সে কি রে! পরীক্ষার আগেই নম্বর কি রে!
—দূর গাধা! তুই জানিস, ঐ শিশিরটা ক্লাসে থার্ড হয় কি করে? পরীক্ষার তিন মাস আগে থেকে সেকেন্ড পণ্ডিত তাকে পড়ায়। ঐ পঁচিশ টাকা মাইনে। বাংলা আর সংস্কৃতে শিশির আশি-পঁচাশি করে নম্বর পায়। অঙ্কের মাস্টার হারান বাবুকেও শিশির হাতে রেখেছে। তুই জানিস না। ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত এ-রকম কত হয়।
—তুই বলছিস কি!
—আরে ভাই তুই জানিস, এই মাস্টারদের কত কষ্ট! ওদের দিকটাও তো দেখতে হবে। মৌলবী সাহেবের কষ্ট দেখলে চোখে পানি আসে।
সত্যকার বেদনাবোধে মফিজের কণ্ঠ ভারাক্রান্ত হয়ে আসে। পরে অবশ্য শুনেছিলাম, এই বেদনাবোধের রহস্য। মৌলবী সাহেবের বারো বছরের একটি কন্যা ছিল। দেখতে সে যেমনই হোক, চৌদ্দ বছরের মফিজের কানে এই মেয়েটির চুড়ির শব্দ বড়ই মিষ্টি শোনাত।
কিন্তু সেদিন আমি এসব কিছুই জানতাম না। তাই অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
—আরো শুনবি? আমাদের ফোর্থ-বয় শেখর। সেই তো ক্লাসের সেরা ছেলে। কিন্তু হলে কি হবে। বেচারা গরিব বলে কাউকে মাস্টার রাখতে পারে না। তাই ফোর্থ হয়। তুই দেখবি, ম্যাট্রিকে তারই রেজাল্ট সবচাইতে ভালো হবে।
বিস্ময়ের পর বিস্ময়। আমি হতবুদ্ধি হয়ে যাই। মাথাটাও কেমন ঘুরতে থাকে। শেখর ছেলেটিকে আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে। হাঁটু পর্যন্ত উঁচু একটি লাল-পেড়ে ধুতি আর একটি ফতুয়া পরে স্কুলে আসে। শান্ত চোখের দৃষ্টি। ফার্স্ট বয় কাঞ্জিলাল, সেকেন্ড বয় বদ্রিনারায়ণ আর থার্ড বয় শিশির, কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলে না। বিদ্যার আভিজাত্যে তারা তিনজন এক স্বতন্ত্র দল। শেখর চুপচাপ তার আসনে বসে পড়া শোনে।
কিন্তু কেমন করে যেন ক্লাসের আশিজন ছেলের মধ্যে শেখরকেই সবার আগে চোখে পড়ে।
আজকে এই সময় একদিনের কথা আমার মনে পড়ল।
এসিটেন্ট হেডমাস্টার শশাঙ্কবাবু আমাদের ইংরেজি কম্পোজিশন শেখাচ্ছিলেন। ছেলেদের বলেছেন : বন্ধুর পিতৃবিয়োগে শোক প্রকাশ করে চিঠি লেখ।
আমার চিঠি সবচাইতে ভালো হয়েছিল। শশাঙ্কবাবু দশের মধ্যে আট দিলেন। তারপর শেখর : সাড়ে সাত।
—তোমার খাতাটা একটু দেখতে পারি ভাই।
এমন শান্ত, ভদ্র, মিষ্ট অনুরোধ জীবনে আর কোনোদিন শুনি নি।
—নিশ্চয়ই।
ক্লাসে আর কোনো কথা হয় নি। শেখর খাতাটি দেখে ফেরত দিল।
টিফিনের সময় ছেলেরা ছোটাছুটি দাপাদাপি খাওয়া-দাওয়া করতে থাকে।
সেদিন দেখি, শেখর একটি মুদির দোকানের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে এক অবর্ণনীয় দৃষ্টি।
—মুড়ি-মুড়কি খাবি?
আমি জিগ্যেস করলাম।
—না ভাই। তুমি খাও।
—তুই অমন “তুমি তুমি” করিস কেন বলতো? আর তো কেউ তুমি বলে না! শেখর অল্পক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর হনহন করে একদিকে চলে গেল।
আসল কথাটা শুনেছিলাম পরে।
কাঞ্জিলাল, বদ্রি আর শিশির একদিন শেখরকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বলেছিল :
—শেখর। তোমাকে বহুদিন থেকে একটা কথা বলব মনে করেছি। তুমি ইতরদের মতো তুই-তোকারি করবে না।
এই সময় মফিজের প্রশ্ন আমাকে আবার বর্তমানে ফিরিয়ে আনল।
—কি রে। কি ঠিক করলি? মৌলবী সাহেবকে কি বলব?
—না রে না। আমি বড় ভাইয়ের কাছে ফার্সি পড়ি। তাছাড়া ও-ভাবে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার তরবিয়ত আমরা পাই নি
মফিজ আর কিছু বলে না।
এবার আমিই জিগ্যেস করি :
—আচ্ছা মফিজ, তুই এত কথা কি করে জানলিরে?
এইবার মফিজ একটুখানি হাসল। দেখবার মতো সে হাসি।
–ক্লাস ওয়ান থেকে এই স্কুলে পড়ছি। আমি জানব না, তো জানবে কে?
তা বটে।
এইভাবে আমার দিন কাটতে থাকে। এক এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এক এক দিনে এক এক বছর করে বয়স বাড়তে থাকে।