ছয়
তারও পরের দিন। সোমবার সকালবেলা।
স্কুলে যাব, সবেমাত্র ভাত খেয়ে উঠেছি। ছেঁড়া মাদুরের ওপর রাখা রেকাবিতে তখনো পুঁই শাক, কুমড়ো ভাজি আর চিংড়ি মাছের তরকারি রাখা আছে। ঘরের চারদিকে ময়লা। দরজার কাছে বিড়াল নোংরা করে রেখেছে। ছেঁড়া মাদুরের দু’একটি আলগা বেত, আর জীর্ণ বালিশের খণ্ড খণ্ড তুলা আর বিচি ঘরের চারদিকে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। আম্মার পরনে দু’দিনের ময়লা শাড়ি।
এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই, মুশতাক হাজির। এই পরিবেশে মুশতাকের আগমন দেখে আমার মনে আবার সেই পুরাতন গ্লানিবোধ ফিরে এলো।
বাইরে একটি মোটর গাড়ির হর্ন শব্দ করল। মুশতাক তাড়াতাড়ি বললো :
—চল চল। বুবু এখুনি রেগে উঠবে। তোকে তালতলায় আর আমাকে হেয়ার স্কুলে নাবিয়ে বুবু গাড়ি নিয়ে কলেজ যাবে।
আম্মা নিচু হয়ে এঁটো বাসন তুলছিলেন। তিনি জিগ্যেস করলেন :
ছেলেটি কে?
—আমার বন্ধু মুশতাক।
আমার ভারি ইচ্ছে করতে লাগল, আম্মা মুশতাককে কিছু খেতে দিন-যেভাবে মুশতাকের আম্মা আমাকে খেতে দিয়েছিলেন।
এবার সোজা আম্মাকে উদ্দেশ করে মুশতাক বললো :
—চাচি আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসবেন। আম্মা আপনাকে বলতে বলে দিয়েছেন।
কেমন দিব্যি চাচি বলে ডাকল। একেবারে অবলীলায়। এতটুকু বাধল না। পরে অবশ্য জেনেছিলাম, মুশতাক সত্য বলে নি। অর্থাৎ তার আম্মা আমার আম্মাকে আমন্ত্রণ জানান নি। সে কথা তুললে মুশতাক হেসে জবাব দিয়েছিল :
—তুই বড্ড বোকা। দরকারমতো ওরকম দু’-একটা কথা বানিয়ে বলতে হয়।
পরে অবশ্য ওসব কথা আমিও বানিয়ে বলেছি, আর চাচি ডাকও গলায় বাধে নি; কিন্তু সেদিন ভারি অবাক হয়েছিলাম।
মুশতাক ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এলো। বাইরে এসে দেখি, সেলিনা গাড়ির এক কোণে চুপ করে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। মুশতাককে দেখে বিরক্ত কণ্ঠে বললো :
—যেখানেই যাও, দেরি কর।
মুশতাক সে কথার কোনো জবাবই দিল না। আমি কিছুতেই গাড়ির পিছনে বসতে রাজি হই না। ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসলাম।
গাড়ি ছেড়ে দিল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এক সময় সেলিনাই নীরবতা ভাঙল। প্রশ্ন করল :
এই বুঝি তোমাদের বাড়ি?
আমি কোনো জবাব দিই না।
—আর ঐ যে, বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল—সে কে?
—আমার আম্মা।
—ওঃ সরি! আমি মনে করলাম কোনো ঝি বুঝি।
গাড়ি অলিগলি পার হয়ে এগিয়ে চলল। আমি দু’ হাত শক্ত করে স্থির হয়ে বসে থাকলাম। তারপর আর কেউ কোনো কথা বলে নি। সবচাইতে সঙ্কুচিত হয়ে বসেছিল মুশতাক। সে যেন এক আকস্মিক অপরাধের লজ্জায় শরবিদ্ধ হয়ে এক কোণে মাথা নত করে বসে থাকল।
মুশতাক বলে দিয়েছিল, ফিরবার পথেও সে আমাকে তুলে নেবে। ছুটির ঘণ্টার পর আমি যেন অপেক্ষা করি।
আমি কিন্তু অপেক্ষা করি নি। স্কুল ছুটি হবার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছি। সেই তিন মাইল পথ হাঁটতে হবে। যখন কোমেদান বাগান লেনে থাকতাম, তখন বেশি হাঁটতে হতো না। কিন্তু পার্ক- সার্কাসে উঠে আসার পর থেকে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। পার্ক-সার্কাসও নয়, পার্ক-সার্কাসের শেষ মাথা। বলতে গেলে বালীগঞ্জ। বলতে গেলে কেন, পোস্ট অফিস তো বালীগঞ্জই। বাড়িটাও বিড়লার বাড়ির একেবারে কাছাকাছি।
হাঁটতে অবশ্য আমার মন্দ লাগে না, তা বৃষ্টিই হোক, ঝড়ই হোক, আর রোদই হোক। বরং খুব ভালো লাগে। কিন্তু ছুটির পর আজকাল বড় খিদে পায়। সেই কোন্ সকালে খেয়ে আসি, তারপর পেটে আর কিছু পড়ে না। তাই এতোটা পথ হেঁটে যেতে বড় কষ্ট হয়।
মৌলালির মোড়, তারপর জোড়া-গির্জা, বেনিয়া পুকুরের মোড়, তারপর সাহেবদের গোরস্তান, যেখানে কবি মধুসূদনের সমাধি। তারপর বাঁ দিকে পার্ক শো হাউজ ফেলে পার্ক-সার্কাস ময়দান পেরিয়ে ডান দিকে ঘুরলেই সৈয়দ আমির আলী এভিনিউ। আবার বাঁ দিকে ছাকুমিয়ার হোটেল আর ডান দিকে মডার্ন স্টোরস্ রেখে আরো এগিয়ে যেতে হয়। এবার ডান দিকে মোড় ফিরলেই আমাদের রাস্তা—মোড়ের ওপর একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ।
এতটা পথ হেঁটে আসতে সময় লাগে অনেক। ক্লান্তিতে পা আর উঠতে চায় না। তবু ভালো লাগে।
কলকাতার রাস্তা। ঘড়ঘড় করে ট্রাম চলে যায়, কন্ডাক্টর ঘণ্টা দিতে থাকে। দু’-একটা ভিস্তিও চোখে পড়ে—চামড়ার ব্যাগ পিঠে ফেলে অনেকটা যেন ব্যাঙের মতোই লাফাতে লাফাতে নিজ মনে চলেছে, রিকশা এগোয় ঠুনঠুন করে। পিচের রাস্তা গরমে গলতে থাকে। ফুটপাতের দু’ধারে কাটা শশা, তরমুজ আর রঙ-বেরঙের শরবত বিক্রি হয়। টেলিগ্রাফের তারে বসে কাক ঝুলতে থাকে। রাস্তার দু’পাশে দেয়ালের গায়ে অসংখ্য সিনেমার বিজ্ঞাপন। ‘কমিট নো নুইসেন্স’। হঠাৎ রাস্তার মোড়ের কোনো সস্তা হোটেল থেকে ভেসে আসে শিক-কাবাবের গন্ধ। ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, ঠ্যালা গাড়ি, মোটর গাড়ি, বাস, ট্রাক একটার পর একটা— কোনোটা মন্থর, কোনোটা দ্রুতগতিতে চলতে থাকে।
জোড়া-গির্জার ঘড়িতে পৌনে পাঁচটা বাজে—বিকেলের ছায়া পড়ে। এইসব দেখি, আর ক্লান্ত পদে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাই। কোনো কোনোদিন, পা যখন আর উঠতে চায় না, একটা চলন্ত ফিটনের পিছনের পাদানিতে উঠে বসি। কোচোয়ান ব্যাটারা যেন কেমন করে টের পেয়ে যায়। পিছন দিকে সপাং সপাং করে যা জোরে চাবুক চালাতে থাকে—পিঠে পড়লে আর রক্ষে নেই!
একটি ক্লান্ত ক্ষুৎপিপাসাতুর স্কুল-বালক এইভাবে তার দীর্ঘ পথ হ্রস্ব করে নিতে চায়- অব্যবহৃত একটি আসনে বসে, এতে কার কি ক্ষতি, কিছুতেই বুঝতে পারতাম না! তাই গাড়োয়ান ব্যাটার ওপর আমার ভারি একটা রাগ হতো। কখনো কখনো অসহায় আক্রোশে দু’চোখ পানিতে টলমল করে উঠত।
এসব কোনো দুঃখই থাকতো না— আম্মা যদি রোজ এক আনা করে পয়সা দিতেন। পয়সা চাইলে আম্মা কোনোদিনই না করতেন না। কিন্তু কেমন করে যেন আমার মনে হতো, না চাইলেই বুঝি ভালো হয়।
স্কুলে টিফিনের সময় যা খিদে পায়। তেলে ভাজা, আলুর দম, পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে মাখা মুড়ি কত কি বিক্রি হয়। কত ছেলে কিনে তাই খায়।
আমি সে পাড়াই মাড়াই না।
টিফিনের সময় পানি-খাবার ঘরে গিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিই।
বাড়ি পৌঁছে বই-পত্তর জানালার তাকে রেখে, সোরাই থেকে পানি গড়িয়ে নিয়ে পেট ভরে নিতাম। রোদের মধ্যে অতটা পথ হাঁটার পর পিয়াসাও লাগত কম নয়।
তারপর দোতলায় এসে বারান্দায় শীতল পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়তাম। সামনের তালগাছগুলোর পাতা নড়ত—চেয়ে চেয়ে তাই দেখতাম।
আম্মা হয়তো কোনোদিন নাস্তা এনে দিতেন। কোনোদিন পারতেন না। যেদিন কিছু থাকত না, আম্মা বারান্দা দিয়ে যাবার সময় আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে দেখতেন। আমার চোখে চোখ পড়তেই দ্রুত বেগে এগিয়ে যেতেন।
আমিও এমন ভাব করতাম যেন তাঁকে দেখি নি; আনমনে গাছের পাতা-নড়া দেখছি। মায়ে-পোয়ে এইভাবে ফাঁকি চলত।