উত্তম পুরুষ – ৪

চার

সেদিন রাত্রে আমার ঘুম হয় নি। সারারাত কেন ছটফট করেছি, ঘুমই-বা হয় নি কেন, এতদিন বাদে তা ভালো করে মনে নেই।

তার পরদিন ছিল রবিবার, স্কুল ছিল না।

ইজি-চেয়ারে শুয়ে আমি পাঁচকড়ি দে-র ‘মায়াবী’ পড়ছি। বাম পাশের ভাঙা টেবিলটিতে কিছু নুন-মরিচ আর কতগুলো ডাঁসা পেয়ারা রাখা ছিল। এই পেয়ারা জিনিসটা আমাকে কিনতে হতো না, বাড়িতেই গাছ ছিল। মাঝে মাঝে পেয়ারায় কামড় দিচ্ছিলাম, আর ধীরে ধীরে বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই বয়সে পেয়ারা আর গোয়েন্দা কাহিনীর দ্বিবিধ রসের মধ্যে কোনটার প্রতি লোলুপতা ছিল বেশি, তা-ও শপথ করে বলা যায় না। তবে রাস্তার পাশে জানালার ধারে বসে এই কর্মটি করতে আমাকে প্রায়ই দেখা যেত।

কখন মেঘ করে এসেছে, জোরে জোরে হাওয়া দিতে শুরু করেছে, একটু একটু করে বৃষ্টি পড়ছে আমি খেয়াল করি নি। হঠাৎ বাজ পড়ার শব্দে সংবিৎ ফিরে আসে। আর বই পড়তে ভালো লাগে না। এমনকি পেয়ারার মতো জিনিসেও আর স্বাদ পাই না। জানালার ভিতর দিয়ে দেখতে থাকি, ঝড় কিভাবে তাল গাছটির মাথা ঝাঁকানি দিচ্ছে। দেখি, আর অলসভাবে পা দোলাতে থাকি।

এমন সময় কপালের ওপর একটা স্পর্শ অনুভব করলাম।

চির পরিচিত স্পর্শ।

আমি চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকি।

—গল্প শুনবি?

—কি গল্প?

—তোর বাপ-দাদার গল্প।

নিজের বংশকাহিনী, এই আমার সবচাইতে প্রিয় গল্প। কতবার কতোরকম করে শুনেছি, তবু শেষ হয় না, ক্লান্তি আসে না। আগে শুনতাম দাদির মুখে, এখন বলেন আম্মা। সেই পুরাতন জামানার গল্প বলতে বলতে দাদির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। দাদির মুখের ওপর অতীতকালের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার স্মৃতির আলোছায়া আনাগোনা করত।

হাত দুটো মাথার নিচে রেখে মাদুরের ওপর শুয়ে শুনতাম, কতক বুঝতাম, কিন্তু বেশির ভাগই বুঝতাম না। তবু সে গল্প রূপকথার মতোই রোমাঞ্চকর মনে হতো।

তেমনি রোমাঞ্চকর দাদির ইন্তেকাল।

ছেলেবেলার স্মৃতির সঙ্গে আমার কল্পনার রঙ আর লোকমুখের অতিভাষণ মেশালে ঘটনাটা এই রকম দাঁড়ায়।

ঈদের ছুটিতে আব্বা কলকাতা এসেছেন। চাঁদ-রাতে সারারাত জেগে দাদি রান্না করছেন : সেমাই, পোলাউ-কোর্মা কাবাব-পরোটা। বাড়ির কারো চোখে ঘুম নেই। ঈদের আগের রাতে কেই-বা ঘুমায়? ঘুম কি আসতে চায়? বছরের একটি দিন ঈদ, আবার আসবে সেই আসছে বছর। রান্নাঘরে কোর্মার খুসবু, চাটুর শব্দ, কাঠ-কয়লার ধোঁয়া, উনুনের দগদগে আগুন আর বাবুর্চির ময়দা পেশা, অন্যান্য ঘরে পাজামার ইজারবন, মাথার টুপি আর জুতার ফিতা সব ঠিকমতো আছে কি না তারই তদারক, বাড়ির বিভিন্ন লোকের এইসব বিভিন্ন কাজেই তো রাত কাবার হয়ে যায়। সময় কোথায়? বস্তুত উৎসবের দিনের চাইতে তার আগমন-প্রতীক্ষাতেই তো প্রধান আনন্দ।

দাদিও বাবুর্চিখানায় ব্যস্ত, তাঁরও মরবার ফুরসত নেই, দম নেবারও ফুরসত নেই, এমনই এক সঙ্কটাপন্ন অবস্থা।

সেইদিন সন্ধ্যার কথা।

দাদির সঙ্গে আমার বাজি। আমি বলেছি এবার ঊনত্রিশে রোজা। দাদি বলেছেন, তিরিশে।

–ঊনত্রিশে রোজা তো যা না, চাঁদ দেখে আয়।

কোমেদান বাগান লেনে আমাদের বাড়ির চারপাশে উঁচু উঁচু দালান, ভালো করে আকাশ দেখা যায় না।

আমরা পাড়ার সব ছেলেরা জড়ো হয়েছি তেত্রিশ নম্বরের ছাতে, সেখান থেকে আকাশের চারদিক দেখা যায়।

একটি বিশেষ দিকেই চাঁদ উঠবে, এই বৈজ্ঞানিক সত্যটিতে আমাদের অধীর শিশুমন কিছুতেই সায় দেয় না। চাঁদ যদি ফাঁকি দিয়ে অন্য কোন দিকে ওঠে। আমরা অস্থির হয়ে আকাশের চারদিকে চাঁদ হাতড়ে বেড়াই; কিন্তু কোথায় চাঁদ

অধীর উদ্বিগ্ন, অসহ্য প্ৰতীক্ষা।

—ঐ যে চাঁদ!

একজন সোল্লাসে লাফিয়ে ওঠে।

–কৈ কোথায়?

দশজনের অধীর প্রশ্ন।

তারপর একজন দশজনকে দেখিয়ে দেয়, ঐ যে দুটো তালগাছ দেখা যাচ্ছে না, তার ফাঁক দিয়ে, ঐ যে মেঘ দেখা যাচ্ছে, তারই নিচে।

সুতার মতো এক ফালি চাঁদ।

ছেলেরা লাফ দিয়ে নিচে নেবে আসে। যে যার বাড়ির দিকে ছুটে।

আকাশটা একটু আগেই তারা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে দেখেছে; আকাশের বুকে কোথায় কখণ্ড মেঘ জমেছে, আকাশের গায়ে কোথায় কটা বাড়ি হেলান দিয়েছে, তাও তারা একটু আগেই সমস্বরে বলে দিতে পারত। কিন্তু এখন? আকাশের মানচিত্রে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

বুকের মধ্যে শীর্ণ অপূর্ণ চাঁদের টুকরোটিকে পুরে নিয়ে সবাই ছুটতে ছুটতে চললাম, যে যার বাড়ি। কে কতো আগে আনন্দের বার্তা পৌঁছে দিতে পারে তারই পাল্লা।

সবার আগে ছুটছিলাম আমি একেবারে অন্ধ হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে। বাজি জিতবার আনন্দ ততটা নয়; ঈদের জন্য আরো একটি দিন অপেক্ষা করতে হবে না, সেই আনন্দই প্রধান। কিন্তু একেবারে দোরগোড়ায় এসে পাল্লায় পেছিয়ে পড়লাম! চৌকিতে ধাক্কা লেগে দু’গজ দূরে ছিটকে পড়লাম। চোখের ঠিক নিচে একটা পেরেকের অর্ধেকটা ঢুকে গেল। তারপরের কথা আমার কিছু জানা নেই। যা জানি, তা নিজের স্মৃতি মন্থন করা ফ্রেমের ছবি নয়, দশজনের মুখে শোনা রূপকথা।

তার চেহারাটা কতক এই রকম।

আমার চোখ দিয়ে যে পরিমাণ রক্ত ঝরতে লাগল, আব্বা-আম্মার চোখ দিয়ে সেই পরিমাণ অশ্রু। ডাক্তার এলো, মুখ ভার করলো। আব্বার উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি বারবার আম্মার ওপর এসে পড়ে। আম্মা বারবার আব্বার কাছে ভরসা চান। দাদার টুপিটা গেল ঈদে বড় ভাই মাথায় দিয়েছিলেন। এবারও তিনি পরবেন না মেজ ভাই পরবেন এ তর্কের কোনো মীমাংসাই হচ্ছিল না। এই দুর্ঘটনার পর তাঁদের তর্ক কোনো মীমাংসায় উপস্থিত না হয়েই শেষ হয়ে গেল।

কেবল দাদি নিজের মনে কাজ করে যান। ঈদের প্রস্তুতি ছাড়া অন্য কোনো দিকে তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই। এমনকি মুখে তাঁর হাসি, আশ্চর্য, দুর্জ্ঞেয়, অনির্বচনীয় সে হাসি।

এক সময় রান্নাঘর থেকে দাদি ডাক দেন, দুলহীন বিবি, এদিকে এসো, কাজ আছে। কোলের ছেলে নাবিয়ে আম্মা কাজ করতে যান। তাঁর মনের অবস্থা যাই হোক, এই আহ্বান অপ্রতিরোধ্য। মন্থর পদে তিনি রান্নাঘরে এগিয়ে আসেন। নিরুদ্ধ অভিমানের প্রতিমূর্তির মতো একটি কোণে বসে থাকেন।

আঁচল দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে ফেলে, কাজের ফাঁকে দাদি একবার আম্মার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তারপর একটু হাসলেন।

তারপর দুই হাত দিয়ে আম্মাকে ছোট মেয়েটির মতো কোলে টেনে নিলেন। “আমার বয়স যখন সাত তখন থেকে এক বেলার নামাজও আমি কামাই করি নি। একবারও কাজা করি নি। আমার সমস্ত এবাদতের বদলে আমি তোমার ছেলের হায়াত চেয়ে নিয়েছি। দেখবে সে কাল ঈদ করবে।”

দাদি রাত দুটো পর্যন্ত রান্নাঘরেই থাকলেন। তারপর গোসল আর অজু করে এসে জায়নামাজে বসলেন।

পরদিন সকালে জরির টুপি, চুড়িদার পাজামা আর রঙিন শেরওয়ানি পরে আমি ঈদের নামাজ পড়ে এলাম। সঙ্গে আব্বা, চাচাজান আর ভাইজানরা।

লাল জায়নামাজে বসে দাদি তখনো তসবিহ পড়ছিলেন। আমাদের দেখে ইশারা করে কাছে ডাকলেন। আব্বা, চাচাজান আর ভাইভানদের সঙ্গে আমিও দাদিকে কদমবুসি করলাম।

দাদি দোয়া পড়ে আমার কাটা ঘায়ের ওপর ফুঁ দিলেন। জায়নামাজের তিন দিকে সেমাই-ফিরনি, গোস্ত-রুটি সব সাজানো ছিল।

দাদি আমাদের খেতে দিলেন।

শীর্ণ হাতে তসবিহ নড়ছিল; কিন্তু দন্তহীন মুখের হাসি তেমনি অপরিম্লান। ‘বল তো ভাইয়া, সেমাইটা কেমন হয়েছে?’

কিন্তু উত্তর শুনবার জন্য দাদি অপেক্ষা করলেন না। তাঁর হাতের তসবিহ পড়ে গেল। মাথা বুকের ওপর ঝুঁকে পড়ল। সব শেষ!

আম্মা থামলেন। উঠতে যাবেন, আমি আঁচল চেপে ধরলাম।

‘ছাড় ছাড়। তিনটে বাজে। এখুনি কলে পানি আসবে। উনুন ধরাতে হবে।’

গত রাত্রে যে গ্লানি বোধ করছিলাম কেমন করে যেন তা দূর হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *