একত্রিশ
সারাটা সকাল দুপুর ও সন্ধ্যা কেটে গেল আমাদের কলকাতার বাড়ি যথাসাধ্য ঝাড় পৌঁছ গোছগাছ করতে। রাত্রিবেলা আমার ট্রেন—ঢাকা মেল। ব্রড গেজের গাড়ি। ফার্স্ট আর সেকেন্ড ক্লাসের কামরাগুলো খাসা। চওড়া গদি লাগানো। রাত্রিবেলা পুরা আসনটাই একজন যাত্রীর দখলে। আশ্চর্য, ফার্স্ট সেকেন্ড ক্লাসের এত প্রকার স্বচ্ছন্দের আয়োজন তুচ্ছ করে, আমার কল্পনায় আগুন ধরিয়ে দেয় গদি আটা বেঞ্চির মাঝামাঝি জায়গাটি, যেখানে হাতের কাছে কাঠের দেয়ালের গায়ে সামান্য খোপের মতো করা হয়েছে— যেখানে সিগারেটের কৌটা, দিয়াশলাই, এমনকি শোবার আগে একটা বই পর্যন্ত রেখে দেয়া যায়। স্বাচ্ছন্দ্যের এই আয়োজনটিই আমার কাছে সবচাইতে লোভনীয় মনে হয়। বেশ দুলতে দুলতে, ঝাঁকানি দিতে দিতে, গর্জন করতে করতে, ফোঁস-ফোঁস করতে করতে, ধমক দিতে দিতে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ট্রেন ছুটতে থাকে। মাথার ওপরের বার্থের লোকটি বাতি নিবিয়ে এতক্ষণে হয়তো শুয়েই পড়েছে। আমি হয়তো শিয়রের কাছের আলোটি জ্বালিয়ে একটি উপন্যাস পড়ছি আর থেকে থেকে আরাম করে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিচ্ছি। মাথার কাছে খোলা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসে। এক একটি স্টেশনের আলোয় ছুটন্ত ট্রেনের ভিতর থেকে দেখি, সামনের অন্ধকার- মণ্ডিত গ্রামগুলো অবিচলিত শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। ঝোপের মাঝখানে ঘন আঁধারে ঝিঁঝি ডাকছে, আর মাথার পাশের রগের মতো দপদপ করছে। হয়তো ফ্লাস্ক থেকে একটু গরম চা ঢেলে নিয়ে গলাটা একটু ভিজিয়ে নিলাম, ফস্ করে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালাম, বইটা মুড়ে রেখে দিলাম, খোলা জানালার ধারে বসে বাইরের অন্ধকার দেখতে লাগলাম, এইভাবে হুড়মুড় করে এগিয়ে যাওয়া ট্রেনের গতিবেগ আস্বাদন করতে করতে এগিয়ে চললাম।
কিন্তু এসবই স্বপ্ন।
যেতে হবে সেই যাকে বলে থার্ড ক্লাসে।
ট্রেন স্টেশনে ভিড়বার আগেই সেখানে উপস্থিত হলাম। আগে থেকে এসে একটুখানি জায়গা করে নেব, এই মতলব। কিন্তু দেখলাম, আমার মতো হুঁশিয়ার লোকের অভাব নেই। ট্রেন ধীরে ধীরে প্লাটফর্মে প্রবেশ করল; কিন্তু ট্রেন স্থির হয়ে দাঁড়াবার আগেই দেখলাম হুড়মুড় করে এগিয়ে গিয়ে যে পারল সেই খোলা দরজা দিয়ে, জানালার ভিতর দিয়ে মাথা গলিয়ে, আর একজনের পায়ের ফাঁক দিয়ে, বগলের নিচে দিয়ে, নানান বিচিত্র অভিনব অন্যায় কৌশলে যে যেভাবে পারল ট্রেনে উঠে পড়ল। কে নারী কে শিশু েেক বৃদ্ধ কে অথর্ব সে ভাবনা ভাববার মতো সময় কারো নেই। অশক্ত বৃদ্ধকে টেনে ফেলে দিয়ে, হাত-ধরা শিশুকে মাতৃ-সঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী তাঁর আসনটি দখল করবার জন্য দ্রুত এগিয়ে গেলেন, ঊর্ধ্বশ্বাসে, অনেকে মুক্তকচ্ছ হয়ে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এই বিরাট দৈত্যের মতো ট্রেনের প্রতিটি তৃতীয় শ্রেণীর কক্ষই যাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। বাঙাল চরিত্রে এতটা তৎপরতা আছে, থার্ড ক্লাসের যাত্রীদের এই সময় না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আশ্চর্য এই যে, মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমিও একটি থার্ড ক্লাস কক্ষে উঠে পড়লাম। কোনো মতে পা দুটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকবার জায়গাটুকু ছাড়া তিল ধারণের স্থান নেই। চোখের সামনেই দেখলাম দেয়ালের গায়ে বড় বড় হরফে লেখা আছে : বাইশজন বসিবেক। বসিবেক তো বুঝলাম, কিন্তু বাইশজন কেন, অন্তত দেড়শত যাত্রী বাইশজনের জন্য বরাদ্দ স্থানে কোনোমতে ঠাঁই করে নিয়েছে। নারীর পক্ষে স্পর্শ বাঁচাবার উপায় নেই, আব্রু রক্ষার এতটা সুযোগ নেই। একজন জোয়ান মদ্দের ঠিক চোখের সামনেই শিশুকে স্তন দিতে হচ্ছে। সারা রাত্রির সফর। পার্শ্বের অনাত্মীয় অপরিচিত পুরুষের ঠিক বুকের ওপর অনূঢ়া তরুণীর তন্দ্রা ভারাক্রান্ত মাথা বারবার নুয়ে নুয়ে পড়ছে; সামনের পুরুষটির কোলের পাশে তার পা জোড়া কোনোমতে একটুখানি জায়গা করে নিয়েছে। দুটি বেঞ্চির মাঝখানকার যে স্থানটুকু ট্রেন কর্তৃপক্ষ চলাফেরার জন্য খালি রেখেছেন, সেই জায়গাটুকু বাক্স প্যাটরা পুটলি বিছানা প্রভৃতি রাজ্যের জিনিসপত্র দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে—যাত্রীদের আসনের ব্যবস্থা করবার জন্য।
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। এ-ওর গায়ে ছিটকে পড়ে, কিন্তু কারো মুখে নালিশ নেই। এরই মধ্যে কেউ হয়তো সঙ্গীত-চর্চা শুরু করে দেয়; কেউবা বংশের ব্যাখ্যান; কেউ করে স্বামীর পদমর্যাদা কীর্তন, কেউ-বা প্রেম আলাপন। শিশু কাঁদে, মা বকে, স্বামী ফরমায়েশ করে, স্ত্রী ক্ষিপ্তের মতো প্রতিবাদ করে— ট্রেন কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে চলে। কেউ বিড়ি ফোঁকে, কেউ মোড়ক থেকে খাবার বের করে খায়, কেউ পাশের লোকটিকে একটু সরে বসতে অনুরোধ করে, কেউ সম্মুখের রমণীটিকে দেখতে থাকে। কেউ-বা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে পান কেনে, চা খায়।
বিড়ির ধোঁয়ায় আমার মাথা ধরে গিয়েছিল। তার ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আমার পা দুটি অবশ হয়ে আসছিল। রানাঘাটে ট্রেন থামতেই প্লাটফর্মের ওপর নেবে পড়লাম। ফিরে গিয়ে আবার জায়গা পাই ভালো, না পাই ঝুলতে ঝুলতেই বাকিটা পথ যাব। মরি আর বাঁচি। এখন একটুখানি খোলা হাওয়ায় না দাঁড়ালে দমটাই বন্ধ হয়ে যাবে।
রাত তখন কটা জানি না। রানাঘাটে বেশ কিছুক্ষণ ট্রেন দাঁড়ায়। প্লাটফর্মের ওপর নেবে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। চারদিকের ব্যস্ততা দেখতে লাগলাম। উজ্জ্বল আলোর নিচে ব্যস্ত যাত্রীদের আনাগোনা। রসগোল্লা আর মিহিদানা মাথায় ছোট ছোট ছেলেদের চিৎকার : টাটকা মিষ্টি বাবু, খেলে পরে ভুলবেন না। চাই বাবু পান বিড়ি চাই। চা—গরম চা! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই বিচিত্র শব্দ সমষ্টির সঙ্গীত শুনছিলাম। এমন সময় বইয়ের স্টলটির দিকে চোখ পড়ল।
কালো শাড়ি আর লাল ব্লাউজ পরা সেলিনা! একটা বই নাড়াচাড়া করে দেখছে। এক সময় সেও আমাকে দেখতে পেল। একটুখানি হাসলও। হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো যন্ত্রচালিতের মতো এগিয়ে গেলাম।
আমরা নিরিবিলি দেখে একটি কোণে এসে দাঁড়ালাম—সেলিনাই আমাকে সেখানে নিয়ে এলো। ট্রেন ছাড়বার আর বেশি দেরি নেই। সেলিনা কোনোরকম ভূমিকা না করে বললো : সেদিন রাত্রের ব্যবহারে তুমি নিশ্চয়ই খু-উব অবাক হয়েছ, তাই না। সেই যেদিন তোমাকে ডেকে এনে ধরিয়ে দিলাম। খুবই অবাক হয়েছ, তাই না? কিন্তু তুমি আমার সম্বন্ধে বড় বেশি জান। তাই তোমার কথা কেউ যাতে কোনোদিন বিশ্বাস করতে না পারে সেই জন্য আমাকে এই কৌশল করতে হয়েছিল। পারলে আমাকে মাফ করো। আবার দেখা হবে।
তারপরই দ্রুত পদে সে সম্মুখের একটি প্রথম শ্রেণীর কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল।
ঢং ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়ল। এখুনি ট্রেন ছাড়বে!
ভিড় ঠেলে আমার কামরার দিকে এগিয়ে এলাম। দরজার হাতল ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম।
পান বিড়ি সিগারেট তখনো ফিরি হচ্ছে, তখনো গরম চা-অলা হেঁকে যাচ্ছে, রাস্তার ও- পাশের চায়ের দোকানে বিকট শব্দে রেকর্ডে গান বাজছে, তখনো যাত্রীরা ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে, গার্ড হুইসিল দিচ্ছে, সবুজ আলো দেখাচ্ছে—আর আমি তখনো ট্রেনের হাতল ধরে প্লাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।