আটাশ
আই.এ পরীক্ষাও পাস করলাম। শেখরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ কথাবার্তা হয় খুবই কম। সেও আমাকে এড়িয়ে চলে। আমিও উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে যাই না। কিন্তু চরম অশান্ত সংসারে বাস করেও সে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। বস্তুত আমাদের স্কুলের দলটি বিভিন্ন কলেজ থেকে ভালো-মন্দ যেভাবে হোক সকলেই পাস করলাম। কিছুদিন পর সেলিনা-অনিমাদের পরীক্ষার ফলও বের হলো, তারাও সসম্মানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো।
বি.এ পড়বার জন্য আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলাম। সেলিনাও এম.এ কোর্সের জন্য বীটন কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে এলো। কলেজের পথে ট্রামে-বাসে প্রায়ই সেলিনার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। অনেক সময় পাশাপাশি বসবারও সুযোগ হয়ে যায়। সেলিনার চূর্ণ কুন্তল আমাকে স্পর্শ করে।
খোদার দুনিয়ার এতদিকে এত রকম কাম্য বস্তু থাকা সত্ত্বেও, এই স্পর্শটুকু লাভ করবার সুখ আর আনন্দের মধ্যেই যেন আমি বাঁচবার সার্থকতা খুঁজে পেতাম। আমাদের উভয়ের সম্পর্ক অল্প কিছুদিনের ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে অতি সত্ত্বর অতি নিবিড় হয়ে আসছিল। মাঝে উভয়েরই পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। কেবল পরীক্ষার দুশ্চিন্তা আর কেবল পড়া। পরীক্ষার পর আবার যখন মুখোমুখি হলাম তখন দেখলাম, যত দ্রুত কাছে এসেছিলাম ঠিক ততটাই দ্রুতভাবে আমরা আবার বহু দূরে সরে গেছি। সেলিনাকে আবারও সেই আগেকার আত্মস্থ গম্ভীররূপে যেন অতি দূর ব্যবধান থেকে দেখলাম। আশ্চর্য এই পরীক্ষার মাঝখানকার দিনগুলো। দু’জনের মাঝখানে যেন বিরাট সমুদ্রের ব্যবধান সৃষ্টি করেছে।
অথচ এই কিছুদিন আগেও কতই না কাছাকাছি ছিলাম। সেলিনা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে প্রসাধন করত। তার কণ্ঠে গুঞ্জরিত হতে থাকত কোনো একটি প্রিয় গানের কলি। স্খলিত আঁচলটি কোলের ওপর পড়ে থাকত। প্রসাধনের এই সময়টা আমি মনে মনে চিহ্নিত করে রেখেছিলাম। বেছে বেছে এই সময়টিতেই আমি সেলিনার কক্ষে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে প্রবেশ করতাম। এই কক্ষটিতে আমি যেন আরব্য উপন্যাসের পরিবেশ দেখতে পেতাম। তা কেবল এই কারণে নয় যে সেলিনাও অপরূপ সুন্দরী। তার এই কামরাটিতে এই সময়টায় অপরাহের রাগে ঝিলিমিলি রোদ আর ছায়া পশ্চিম দিকের জানালা দিয়ে লুটিয়ে পড়ত। মাথার তেল, দুর্লভ সেন্ট এবং সেলিনার শরীরের এক মিশ্র মদির গন্ধও এক অপার্থিব আবহাওয়া সৃষ্টি করত। প্রথম প্রথম চুপে চুপে ভয়ে ভয়ে, পরে অপেক্ষাকৃত নিশ্চিত নির্ভয় পদক্ষেপে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়াতাম। আমার দুটি হাত দিয়ে তার দুটি চোখ টিপে ধরতাম। আয়নায় সে আমাকে দেখতে পেত, এবং সে যে দেখতে পেয়েছে, আমিও তো আয়নাতেই দেখতে পেতাম; তবু যেন আমার আগমন অনাবিষ্কৃতই আছে, সেইভাবে পিছনে গিয়ে দাঁড়াতাম আর চোখ টিপে ধরতাম। এই স্পর্শটুকুর প্রতিই লোভ। বাকিটা অছিলা মাত্র।
সেলিনা একটু একটু করে আমার হাত টিপে টিপে অনুভব করত, যেন চিনবার চেষ্টা করছে, যেন চিনতে কষ্ট হচ্ছে, যেন কিছুতেই চিনতে পারছে না। তারপর এক একটা করে দুনিয়ায় যত নাম আছে সব আউড়ে যেত, কেবল আমারটিই ছাড়া। আমি শুধু উঁহু উঁহু করে মুখ দিয়ে এক রকম আওয়াজ করে জানিয়ে দিতাম, সেলিনার সব কটি অনুমানই ভুল।
সেলিনা শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয়ার অভিনয় করত।
কেবল তখুনি আমি বলতাম : আমি।
—তু–মি!
সেলিনা যেন অবাক হয়ে গেছে, একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে।
—ওমা, তাই বলো, তুমি! আমি ভাবলাম কে বুঝি
তারপর সে তার ঘাড় বাঁকিয়ে আমাকে একবার দেখে নিয়ে যেন তার সন্দেহ দূর করত, আমি সত্যিই আমি কি না। আবার স্থির হয়ে আগের মতোই চেয়ারে বসে থেকে, তার দুই কাঁধের দুই পাশ দিয়ে আমার দুটি হাত টেনে এনে তার মুঠির মধ্যে ধরে রাখত।
এই খেলা কত মিথ্যা, এর মধ্যে কত ছলনা, কত অভিনয় সবই আমি জানতাম। মাঝে মাঝে মনটাও বিরূপ হয়ে উঠত, এই বুনিয়াদহীন ইমারতটিকে ভেঙে ফেলে দিতে চাইত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সঙ্কল্প স্থির থাকত না। একটি স্ত্রীলোককে সেই প্রথম নারীরূপে দেখলাম, সেই প্রথম নারীরূপে তার পরিচয় লাভ করলাম। তাকে ত্যাগ করব আমার মন এতটা নির্লোভ নিষ্কাম ছিল না।
আরো একটি কারণে আমার মন গ্লানিতে ভরে যেত। সেটা হচ্ছে আমাদের বয়সের ব্যবধান। খুব বেশি না হলেও সেলিনা আমার চাইতে বয়সে বড়। তাছাড়া সে নানান দিক দিয়ে এত অভিজ্ঞ, তার বুদ্ধি এতই পরিণত, তার শরীর এতই পরিপূর্ণ, তার দৃষ্টি এতই নির্ভীক আর নিঃসঙ্কোচ যে তাকে তার বয়সের চাইতেও বড় মনে হতো। আমাদের এই সম্পর্ক কেবল যে আমার কাছে অবাস্তবই মনে হতো তাই নয়, মাঝে মাঝে অত্যন্ত অসুন্দরও মনে হতো। তাই কতবার মনে হতো, দূর ছাই, সব চুকিয়ে দি।
অথচ পরীক্ষার পর যখন দেখলাম, আপনা থেকেই সব চুকতে বসেছে, তখন কিন্তু সব হারাবার বিষণ্নতা আর ব্যর্থতায় সমস্ত মনটাই মুষড়ে গেল।
সেলিনার কামরায় আগের মতো যখন। তখন প্রবেশ করবার কথা চিন্তা করতেই পারি না। তার সঙ্গে যেন আবার নতুন করে পরিচয় হচ্ছে। তার হাবভাব মতিগতি ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবকিছুই যেন অপরিচিত। তাই তার কক্ষে প্রবেশ করব অতটা স্বাধীনতার কথা ভাবতেও পারতাম না।
বেশ বুঝতে পারছিলাম, সেলিনাও আমার সমস্যার কথা বুঝতে পেরেছে কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধানই তার দিক দিয়ে এলো না। বরঞ্চ সে তার আচরণের দ্বারা এই ব্যবধানটিকে সযত্নে সুরক্ষিত করে রাখল।
ট্রামে-বাসে দেখা হয়, কিন্তু কথা বড় একটা হয় না। প্রায়ই ট্রামে বসতাম পাশাপাশি, ট্ৰাম থেকে নাবতামও একই স্টপেজে, তবু বাক্য-বিনিময় বলতে গেলে হতোই না। চূর্ণ কুন্তলের স্পর্শ-লাভের কম্প্র-মুহূর্তগুলো ছাড়া, আমার জীবনের অবশিষ্ট সমস্ত সময়ই নিথর নিষ্প্রাণই থাকবে, এই রকম একটা অবস্থা মনে মনে মেনে নিয়েছিলাম।
বসন্ত-কেবিনে কখনো-বা আমি এক পেয়ালা চা আর এক টুকরা পুডিং দিয়ে সেলিনার আতিথেয়তা করতাম, কখনো সে আমার। কখনো সে আমার ট্রামের টিকিট করে দিত, কখনো আমি তার। সেই পর্যন্ত। হয়তো-বা কোনোদিন আমি তার দিকে দুটি প্রশ্নভরা চোখ তুলে ধরতাম; কিন্তু সে প্রশ্ন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসত।
এই অসম প্রেম সম্বন্ধে মনে মনে একটা অপরাধবোধ ছিলই। তার ওপর আমাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টাটা সেলিনার দিক দিয়ে এতই সযত্ন-পরিকল্পিত যে আমিও মনে মনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাকে বাদ দিয়েই একটা পরিপূর্ণ জীবনের চিত্র কল্পনা করবার চেষ্টা করছিলাম— এবং ধীরে ধীরে সে চেষ্টা সার্থক হতে চলছিল।
কিন্তু তা আর হতে পারল কৈ!
ইউনিভার্সিটি-ইনস্টিটিউটে এক সাহিত্য-সভা ছিল। দুটি পিরিয়ডের পরই সেদিন আমার ছুটি। বেশ কিছুটা আগেই আমি সভাস্থলে এসে একাকী একটি আসনে বই খুলে বসে পড়লাম।
—পড়বার জন্য জায়গাটা ভালোই বেছেছ!
—ওঃ তুমি! কি মনে করে?
—ওঃ তুমি! এ ছাড়া বলবার আর কিছুই নেই না কি!
আমি সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে পাশের আসনটি দেখিয়ে বললাম :
—বোসো! আমি যে এখানে আছি তুমি জানলে কেমন করে?
—তোমার পিছু পিছু আসছি ছায়ার মতো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
—কি কথা?
—এখানে বলা যায় না।
—আবার খিদিরপুরে যাবার জন্য সঙ্গী চাও না কি?
সেলিনা কিন্তু তেমনি সপ্রতিভভাবেই উত্তর দিল :
–না। তেমন কিছু নয়। আমার বিয়ের কথা হচ্ছে।
—বিয়ে? তোমার?
—অবাক হলে যে? কেন, আমার কি বিয়ে হতে পারে না।
—সত্যই অবাক হয়েছি।
—শুধু কি অবাক? আর কিছুই নয়? একটু দুঃখিত কি ব্যথিত?
সেলিনা পরিহাস করছে কিনা ঠিক বুঝলাম না। এরপর সে যে প্রস্তাব করল তা শুনে আরো হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম।
—চলো আমরা পালিয়ে চলে যাই কোথাও।
মুহূর্তের জন্য আমারও মতিভ্রম হলো। বললাম : যাবে? সত্যি যাবে? এরপর সন্দেহ দূর হয়ে গেল। সেলিনা খিলখিল করে হেসে উঠল। পরক্ষণেই কিন্তু আবার গম্ভীর হয়ে বললো : যাব। সেই কথা বলতে এসেছি। কিন্তু এভাবে চলে গেলেই তো হলো না। ব্যবস্থা করতে হবে। তার জন্য তোমার সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন। তাছাড়া এক্ষুণি পালিয়ে যাওয়া হবে না। খাবে কি? আমার বিয়ের জন্য গহনা তৈরি হচ্ছে। তাই নিয়ে পালাব আমরা। কিছুদিন তো চলবে। তারপর না হয় আমি ‘দিল খুস-সভায়’ কাজ নেব; কিন্তু সবার আগে তোমার সঙ্গে কথা হওয়া দরকার।
—কথা যদি কিছু থাকে তো এখানেই বলতে হবে। আর তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
—অপেক্ষা করতে হবে কেন?
—কলকাতায় না কি বোমা পড়বে। আমরা সকলেই তাই আব্বার কাছে মাদারীপুর চলে যাচ্ছি। কবে ফিরব কে জানে। কাল সকালেই যাচ্ছি।
—কাল সকালেই? তাহলে তো আজই তোমার সঙ্গে খোলাখুলি কথা হওয়া দরকার; কিন্তু এখন তো আর তা হতে পারে না। সন্ধ্যাবেলাও আমি ফ্রি নই। বন্ধুদের সঙ্গে ছ’টার শোতে সিনেমায় যাচ্ছি। কথা দিয়ে ফেলেছি। ফিরতে সেই রাত ন’টা। আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না? রাত দশটায় তুমি আমার বাসায় এসো। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে; কিন্তু আমার ঘরের দরজা খোলা থাকবে। ঘর অন্ধকার দেখলে ফিরে যেও না। আমি জেগেই থাকব। তুমি সোজা ঘরের ভিতর চলে এসো।
কেউ দেখলে কি বলব?
—কি আর বলবে? সময়-অসময়ে তুমি তো কতই এসেছ।
—আমার কিন্তু ভয় করছে। ও আমি পারব না।
—পারবে না? এই সাহস নিয়ে তুমি পালাবার ফন্দি করছ? খুব তো দেখি বীরপুরুষ। এখন চলো আমাকে ভবানীপুর পৌঁছে দেবে। সাহিত্যের কচকচি শুনে কি হবে!
—চলো।
আমরা বেরিয়ে এলাম। এইভাবেই সেলিনার প্রবল ইচ্ছা-অনিচ্ছা আমাকে সমুদ্রের ঢেউয়ে মোচার খোলের মতো আছড়াতে লাগল। পথে নেবে সেলিনা বললো : চলো, আমরা একটা ফিটিন ভাড়া করি। বহু দিন ফিটিন চড়ি নি।
ফিটিন এগিয়ে চলল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দু’জনেই যেন নিঃশব্দ একাগ্রতায় ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনছিলাম। এক সময় সেলিনা এক বিচিত্র হাসি হেসে বললো : দু’পাশের লোকগুলো কি রকম অভদ্রের মতো তাকিয়ে থাকে। বল না কোচোয়ানকে ফিটিনের দু’পাশে পর্দা নাবিয়ে দেবে।
আমাকে কিছু বলতে হলো না। কোচোয়ান সেলিনার কথা শুনতে পেয়েছিল। সেই বললো : এই দিচ্ছি মেম সাহেব!
দু’পাশ দিয়ে পর্দা ঝপ করে নেবে এলো।
সেলিনা আরো কাছে সরে এলো। এতক্ষণ আমি দৃষ্টি নত করেই বসেছিলাম। এইবার চোখ তুলে সেলিনাকে দেখলাম। তার ডাগর দুটি চোখের পরিপূর্ণ দৃষ্টি স্থির হয়ে আমারই ওপর নিবদ্ধ। তার তপ্ত নিশ্বাস আমার বুকের মাঝখানটাই যেন দগ্ধ শলাকার মতো বিদ্ধ করছে। সেলিনা তার কোলের ওপর আমার হাত টেনে আনল।
.
সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে এলাম।
হাতমুখ ধুয়ে, কাপড় ছেড়ে, মুখে একটা কিছু দিয়ে,–পড়তে বসলাম। দ্বিপ্রহর এবং বৈকালের মানসিক উত্তেজনা ততক্ষণে স্তিমিত হয়ে এসেছে। সভাকক্ষে বসে যে দুঃসাহসিক প্রস্তাব অনেকটা অবলীলায় কণ্ঠাগ্রে এসে পড়েছিল, এবং যা তখনকার সেই চঞ্চল মুহূর্তে অস্বাভাবিক বা অসঙ্গত মনে হয় নি, সন্ধ্যার ঈষৎ শীতল হাওয়ার স্পর্শে এবং গৃহের সাংসারিক পরিবেশে, এখন তাই তার সত্যকার পরিপ্রেক্ষিতে মনের সামনে এসে দাঁড়ালো। “যাবে, সত্যি যাবে” সেলিনার ঘর ছাড়ার প্রস্তাবে আমি ব্যাকুল-আকুল অধীর আগ্রহে এই যে কথাগুলো বলেছিলাম, এখন তারই প্রতিধ্বনি ব্যঙ্গোক্তির মতোই কানে বাজতে লাগল। নিজের অসম সাহসিকতায় নিজেই হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম।
চৌবাচ্চার সামনেই আমার অকালবৃদ্ধ জননী পর্বতপ্রমাণ নোংরা কাপড় নিয়ে বসেছেন। এইগুলো ধোয়া হবে, সারারাত ধরে শুকোবে, তবে না কাল ছেলেরা ভদ্র সাজে মাদারীপুর যাত্রা করবে। কাপড় আছাড় দেয়ার শব্দ ছাড়া চারদিক নীরব। এই শব্দটুকু বারবার কানের ভিতর পর্যন্ত পৌঁছে আমার চিন্তার স্রোতকে সম্পূর্ণ ভিন্নপথে প্রবাহিত করে দিল। সেলিনা, তার জীবন, তার প্রস্তাব, সবকিছু যেন বহু দিন আগে স্বপ্নে দেখা ঘটনার মতোই অবাস্তব মনে হচ্ছিল। আমরা বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াই, বিশ্ব-সমস্যায় বিচলিত হই, নানা প্রকার ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলগ্রন্থির মধ্যে শতপাকে জড়িয়ে পড়ি, এদিকে আম্মা বহির্জীবনের প্রতি আমাদের আকর্ষণকে েেখাদার অমোঘ বিধানের মতোই অনিবার্যরূপে স্বীকার করে নিয়ে নীরবে একহাতে সংসারের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। আম্মা এক সময় বললেন : স্টেশনে শুনছি বড্ড ভিড় হয়। সবাই কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছে। কি করে যে ভালোয় ভালোয় ট্রেনে গিয়ে উঠব এখন থেকে সে ভাবনাই হচ্ছে। তুই ছেলেমানুষ, সব দিক সামলাতে পারবি? সঙ্গে আবার আধ পাগলা ভাই থাকবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে আম্মা তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। এই সময় অর্থ, বুদ্ধি ও সাহস নিয়ে পাশে এসে দাঁড়াতে পারতেন বড় ভাই। কিন্তু চাকরি পাবার পর থেকেই বাড়িতে তিনি বেশি থাকেন না। নার্গিস আপা আই. এ পরীক্ষা দেবেন। তাঁরই পড়া দেখে দেন। এই কিছুদিন হলো বড় ভাই ছুটি নিয়ে নার্গিস আপনাদের সঙ্গে দিল্লি বেড়াতে গেছেন। বেড়ানো হবে, বোমা থেকেও দূরে থাকা যাবে।
যাই হোক, আম্মার কথার জবাবে আমি বললাম : খুব পারব। তুমি চিন্তা করো না।
—চিন্তা করে আর কি করব বাবা। আমার নিজের শরীরটাও যদি একটু ভালো থাকত। তোর আব্বা যে কত চিন্তা করবেন। আমরা যতক্ষণ না পৌঁছাই, তিনি ভাবনা করবেন।
—কিছু ভেব না তুমি। ভিড় একটু হবেই। তবে তোমাকে জেনানাদের কামরায় তুলে দিতে পারব ঠিকই। এবার তুমি উঠে পড়তো। আর কাপড় ধুতে হবে না। উঠলে? না উঠলে আমিও কাপড় ধুতে বসব।
—উঠছি বাবা। এই কুর্তাটা দেখছিস, পকেটের কাছে ছিঁড়ে গেছে। তোর বড় ভাইয়ের ছিল। সেতো আর পরবে না! সেলাই করে মজলাটাকে পরতে দেব।
—বড় ভাইয়ের ওপর তোমার খুব রাগ, তাই না।
—রাগ! না রে পাগলা। বাপ আমার যেখানেই থাক, সুখে থাক। চিন্তা হয় কেবল মজলাটার জন্য। খোদা তাকে এমন মাথা দিলেন, অথচ সে মাথাই যাচ্ছে বিগড়ে। লেখাপড়ায় সে তোদের সকলের চাইতে তেজ ছিল। তাছাড়া তার দিলটাও খুব বড়। সে খুব সাধারণ ছেলে ছিল না রে। যেমন নেক তেমনি ঈমানদার। তাছাড়া বাপ-মা-ভাইদের জন্য জান দিতে পারে। আল্লাহ্ কি মর্জি আল্লাহ্ই জানেন। তারই মাথা কেন যে অমন গরম হয়ে গেল। দুঃখ হয়, তারই জন্য। যেদিন মরব, সেদিনও তারই জন্য চিন্তা নিয়ে মরব। কি যে তার গতি হবে। তোরও খুব দুঃখ হয়, আমি সব বুঝি। তুই বড্ড চাপা। মুখ ফুটে কিছু বলতে চাস না। কিন্তু মার মনকে কি করে ফাঁদি দিবি বল! আমি মরে গেলে বদমেজাজ ভাইকে তোরা হয়তো কেউ সঙ্গে রাখতেই চাইবি না। তোরা চাইলেও তোদের বউ চাইবে না। বউদেরই-বা দোষ কি! শান্তি কে না চায়!
আমি সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে বললাম : আমার সবচাইতে দুঃখ হয় তোমার জন্য। জীবনে কোনোদিন যদি সুখের দিন দেখতে পারি, সেদিন তোমার কথা মনে করেই সবচাইতে দুঃখ হবে। সারাটা জীবন কি কষ্টটাই না করে যাচ্ছ।
—দূর পাগল! তুই ভাবিস, আমার বুঝি খুব কষ্ট? কিন্তু বিশ্বাস কর, আমার এতটুকু কষ্ট হয় না। তুই ভাবছিস, আমি বানিয়ে বলছি! একটুও না। যেদিন তোর ছেলেমেয়ে হবে সেদিন বুঝবি আমার কথা সত্য কি না।
—এবার তুমি উঠে পড়তো। ঠাণ্ডা লেগে জ্বর না আসে। এমনিতেই বলছ তোমার শরীর ভালো নেই। আমাকেও উঠতে হবে। তাড়াতাড়ি চারটে ডাল-ভাত যা আছে দাও।
—একটু সবুর কর। কাপড়গুলো নেড়ে দিয়েই আলু চটকাতে বসব। এই এলাম বলে। তুই বস!
ভেবেছিলাম যাব না। কিছুতেই যাব না। কিন্তু রাত দশটা বাজতেই কে যেন জোর করে আমাকে বিছানা থেকে তুলে দিল। আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। একেই যুদ্ধের বাজার, রাস্তায় আলো বড়ই কম। আজ কি কারণে জানি না, রাস্তা একেবারেই অন্ধকার। বোধ করি কোনোখানে ইলেকট্রিক তার বিগড়ে গেছে। এমনই নিকষ কালো অন্ধকার, দেখে মনে হলো, এই বুঝি প্রথম রাত্রির সঙ্গে আমার চাক্ষুষ পরিচয় হচ্ছে। এমন আলকাতরার মতো বীভৎস অন্ধকার আগে কখনো দেখি নি। রাত্রি দশটা কলকাতার নাগরিক জীবনের পক্ষে বেশি রাত নয়, এমনকি সেই যুদ্ধের সময়ও নয়। তবে ইদানীং বোমা পড়ার আতঙ্ক চতুর্দিক ছড়িয়ে পড়েছে। সেই যে রবিবার দিন সকালবেলা খিদিরপুরে বোমা পড়ল, তারপর থেকেই এই আতঙ্কের শুরু। পথে লোকজন নেই বললেই চলে। কেবল ভকত-এর পানের দোকানে লাইটিং-রেশট্রিকশন অনুসারে একটা হারিকেন লণ্ঠন অবগুণ্ঠিত হয়ে বিরল পথিককে পথের সন্ধান দেয়ার চেষ্টা করছে। ভকত হাত পা চোখ কান মাথা একটা সাদা কাঁথায় ঢেকে তার দোকানের খুপরিতে চুপচাপ বসে আছে। কড়ায়া রোডের দু-একজন নিশীথিনী শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণবর্ণের গাউন ঝুলিয়ে অলস পদক্ষেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হয়তো তাদের মন্দির তখনো শূন্য, তাই। তাদের ঠোঁটের জ্বলন্ত সিগারেট অন্ধকারে রক্তচক্ষুর মতো জ্বলছে। এই প্ৰেম- পসারিণীদের পাড়া থেকে তুলে দেয়ার জন্য ভদ্র প্রতিবেশীরা কয়েকবার আন্দোলনও করেছে; কিন্তু এখনো তার কোনো ফল পাওয়া যায় নি। হয়তো যুদ্ধের পর তাদের তুলে দেওয়া হবে।
তাদেরই পাশ কাটিয়ে আমি অভিসার শুরু করলাম। বেনিয়াপুকুর উপস্থিত হতে সময় খুব কম লাগল না। সেলিনাদের বাড়িও বাইরে থেকে অন্ধকার দেখাচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম। এ রকম তো কতবারই এসেছি, কোনোদিন এতটুকু ইতস্তত করি নি। কিন্তু আজ কিছুতেই পা উঠতে চায় না। হাঁটুর কাছে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। আগেই ঠিক করেছি, পালিয়ে-টালিয়ে যাওয়া হবে না। ওসব পাগলামি আমার দ্বারা হবে না। সেই কথাটি বলতেই কি এত রাত্রে সেলিনার শয়নকক্ষে একাকী এগিয়ে যাচ্ছি? যাবই না যদি, তাহলে একেবারে না এলেই-বা ক্ষতি কি ছিল? এগিয়েই গেলাম। ভেজানো কোলাপসিবল গেটটা এক হাত দিয়ে খুলতেই, দরজার মরচে-পড়া চাকাগুলো ক্যাচ করে শব্দ করে উঠল। শব্দ মাত্রই যখন আমাকে চমকিত করে দিচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ই এই অপ্রত্যাশিত শব্দটা বুকের ভিতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। দমকা ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শে শরীরটা শিরশির করে উঠল। সভয়ে চারদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম, কেউ কোথাও দেখছে না তো। নাঃ। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত ক’টা হবে এখন? এতক্ষণে বোধ হয় এগারোটাই হবে। বাড়িটার পিছনেই ঘোড়ার একটা আস্তাবল। সেখান থেকে এক প্রকার অসহনীয় দুর্গন্ধ ভেসে আসছিল, মাঝে মাঝে ঘোড়ার অসন্তুষ্ট হ্রেস্বাধ্বনি রাত্রির শান্তি বিচলিত করছিল। ঘরের ভিতরকার এই খোলা মাঠটিতে অনেকগুলো চৌকি পাতা আছে, যেখানে গাড়ির কোচোয়ানরা চাদর মুড়ি দিয়ে গভীর নিদ্রায় অচেতন। তাদের সম্মিলিত নিশ্বাস এই জায়গাটির বাতাস বেশ কিছুটা তপ্ত করে তুলেছে। এইখানটায় এসে বেশ যেন আরাম বোধ করলাম। তাদের পাশ কাটিয়ে এগুলে সামনেই দরজা। খোলাই আছে। দরজার সামনেই একটা প্রস্তর নারী-মূর্তি। এই মূর্তিটিকেও পিছনে রেখে সেলিনার দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালাম। সবাই কি ঘুমে অচেতন? এই তো সেলিনার কক্ষ? ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম। সেলিনাই কি খাটের ওপর ঐভাবে শুয়ে আছে। অন্ধকারে একটি শায়িত নারীর অস্পষ্ট রেখার তরঙ্গ যেন চোখে পড়ে। সেলিনা ছাড়া আর কে হবে? দরজা দুটি ভিতরের দিকে খোলে। দুই হাত দিয়ে বেশ জোরেই দরজা দুটি ভিতরের দিকে ঠেলে দিলাম। হাত পা বুক সবই থরথর করে কাঁপছিল। তবু সমস্ত শক্তি একত্র করে দরজা দুটি ঠেলে দিলাম।
তারপর এক মুহূর্তের মধ্যে কি যেন ঘটে গেল।
দরজার ও পাশেই একেবারে দরজার সঙ্গে ঘেঁষে পানি খাবার কাচের জগ আর গেলাস রাখা ছিল। অন্ধকারের বুক চিরে ঝনঝন করে শব্দ উঠল। তৎক্ষণাৎ সেলিনা বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে আলো জ্বালিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার “কে কোথায় আছ, তাড়াতাড়ি এসো। দেখ, শাকের এত রাত্রে আমার ঘরে কি করছে।” তখনো সুইচের ওপর তার হাত।
সেলিনার চিৎকারের কোনো প্রয়োজন ছিল না। ঘরের যেখানে যত আলো ছিল সব জ্বলে উঠল। পিছনে ক্ষিপ্ৰ পদক্ষেপের শব্দ! নিমেষের মধ্যেই যেন এই ঘুমন্তপুরী এক বিরাট লক্ষ দিয়ে জেগে উঠেছে। অনেকগুলো চোখের আলো তখন দপদপ করে জ্বলছে। কে কে উঠে এলেন, কার হাতে লাঠি ছিল, কার হাতে আর কি ছিল, কিছুই তখন আমার চোখে পড়ে নি। কতগুলো ভাঙা ভাঙা বিস্ময়াহত উক্তি কেবল থেকে থেকে কানে বাজতে লাগল। শাকের! এখানে! এমন সময়!
তখন কিছুই ভালো করে আমার চোখে পড়ছে না, কানে বাজছে না। আমার দৃষ্টি একবারমাত্র মাতালের মতো টলতে টলতে সেলিনার ওপর এসে পড়ল। সে তখনো সেইভাবেই দাঁড়িয়ে। ঠোঁটের কোণে বিজয়িনীর হাসি, যে-হাসি আমি ছাড়া আর কারো চোখে পড়া অসম্ভব।
ঘণ্টা দেড়েক পর বাড়ি ফিরে এলাম। আম্মা তখনো জেগেই ছিলেন। ঘরে আলোও জ্বলছে। আমাকে দেখেই আম্মা চিৎকার করে উঠলেন : ও কি রে! তোর চোখে রক্ত কেন? কাঁপছিস কেন?
চোখের উপরকার রক্ত আর অশ্রুর আবরণ ভেদ করেও দেখতে পেলাম, আম্মার মুখ ও কাগজের মতো সাদা! তাঁর চোখ দুটিও লাল। নিশ্চয়ই বহুক্ষণ ধরে কাঁদছেন।
—আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছি। তোমার কি হয়েছে! তোমার মুখ মড়ার মতো ফ্যাকাসে কেন?
আম্মা কোনোমতে আমার কাছ পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। হাত দুটি তাঁর তখনো কাঁপছে, থরথর করে কাঁপছে, কোনো শাসন মানছে না। সেই দুটি হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তেমনি কাঁপা গলায় বললেন : এই দ্যাখ টেলিগ্রাম!
সব রকম দুঃসংবাদের জন্যই তৈরি ছিলাম। কোনো রকম দুঃসংবাদই তখন আমাকে দুঃখ দিতে পারত না। তবু টেলিগ্রামটি যখন চোখের সামনে তুলে ধরলাম, চোখ দুটি তখন ভয়ে কাঁপছিল।
বড় ভাইয়ের টেলিগ্রাম। তিনি জানাচ্ছেন, নার্গিস আপার সঙ্গে দিল্লিতেই তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে। আগে জানাতে পারেন নি বলে দুঃখিত। মামু অনেক ধুমধাম করেছিলেন, একমাত্র মেয়ের বিয়ে। আব্বা-আম্মার দোয়া চেয়েছেন।
আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। আম্মার সমস্ত শরীর কাঁপছিল। আমরা একে অপরকে ধরে সেখানেই বসে পড়লাম। ট্রেনে-স্টিমারে আম্মা একটি কথাও বলেন নি। এক মুহূর্ত ঘুমান নি। মুখে কিছু দেন নি।
মাদারীপুরে এক সময় পৌঁছলাম। বাংলোয় যখন উপস্থিত হলাম, দেখলাম আব্বা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। সকলেই নিঃশব্দে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলাম। আব্বাও কেমন ম্রিয়মাণ। একবার শুধু জিগ্যেস করলেন : আব্বাসের মা, পথে কোনো কষ্ট হয় নি তো!
আম্মা কোনো জবাব দিলেন না। একবার শুধু দুটি চোখ তুলে আব্বার দিকে তাকালেন। সে চোখের দৃষ্টি যে দেখে নি সে তার ভাষা বুঝবে না। আম্মা সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলেন : খবর শুনেছেন?
আব্বা হাসলেন। এ হাসিরও একটা ভাষা ছিল। তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন : আব্বাসের বিয়ের কথা? হ্যাঁ। আমি কাল টেলিগ্রাম পেয়েছি। তাছাড়া শামসের কাল দিল্লি থেকেই এলো। সে বলছিল, খুব না কি ধুমধাম হয়েছিল। অনেক বড় বড় লোক সব এসেছিলেন। সেখানে গরিব বাপকে কি মানাত?
এই বলে আব্বা তেমনি করেই হাসলেন।
আম্মা আব্বার পায়ের কাছে বসে পড়লেন।
মেজ ভাই সারাটা পথ কোনো কথা বলেন নি, এখনো বললেন না।