উত্তম পুরুষ – ২৬

ছাব্বিশ

অনিমাদের বাড়ির গেটের বাইরে অন্নপ্রার্থীর ভিড়ের কথা আগেই বলেছি। জন্মদিনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করে যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম, দেখলাম অদূরেই একটা মিষ্টান্নের দোকানের কাছে বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধ চলছে। পথে আলোকের অভাব। কিন্তু সেই আলোতেই দেখতে পেলাম, মিষ্টির দোকানটির সামনের কাচ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। রাস্তায় টুকরো টুকরো কাচ ইতস্তত পড়ে আছে। একটু আগেই একদল ভিখিরি দোকানটি লুট করেছে। পুলিশ এসে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, দু’-একজনকে ধরেও নিয়ে গেছে।

বেশ রাত হয়ে গেছে। রাস্তা অন্ধকার। তার ওপর আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ। হাঙ্গামার পর এই পথটিতেও লোকজনের যাতায়াত অত্যন্ত বিরল। স্ট্রিট লাইটে অর্ধ-অবগুণ্ঠিত আলোকে ভাঙা কাচগুলোর ফাঁক দিয়ে দোকানটি কেমন শূন্য রিক্ত মনে হচ্ছিল। পথের ওপর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কাচের খণ্ডগুলো চিকমিক করছিল—মাছের আঁশের মতো।

আমি দ্রুত পা চালিয়ে দিলাম। এখুনি শেষ ট্রাম ছেড়ে দেবে। আধ-অন্ধকারে আধ- আলোকে পথ চলতে চলতে এক প্রকার অবর্ণনীয় অনুভূতি সমস্ত মনটিকে আচ্ছন্ন করে রাখল। সেই গভীর রাত্রেও ভিখিরি পথে পথে এদিকওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। নারীদের কোলে শিশু, পরনের জীর্ণ বস্ত্র নগ্নতাকে আরো উন্মোচিত করছে। অনেকেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কি চায়? ভিক্ষা? আমি আরো দ্রুত পা চালিয়ে দি। কেমন যেন প্রেতাত্মার ছায়ার মতো মনে হয় এই দুর্ভিক্ষতাড়িত লোকগুলোকে। অন্ধকার জনবিরল পথে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়।

মাঝে মাঝে ট্রামের শব্দ কানে আসে। এখনো ট্রাম চলছে; তবে দিনের মতো সন্ধ্যার মতো অত ঘন-ঘন নয়। অনেক পরপর। পাশের হোটেল থেকে চায়ের দোকান থেকে তখনো মাঝে মাঝে উত্তেজিত উল্লসিত কণ্ঠস্বর অন্যমনস্ক পথিককে হঠাৎ সচকিত করে দেয়। যুদ্ধের বাজারে নিশাচরের সংখ্যা বেড়েছে। জানালার শার্সির ভিতর দিয়ে হোটেলের আলো আর মদ্যপায়ী মস্তক চোখে পড়ে। বোতল খুলবার শব্দ পর্যন্ত কানে ভেসে আসে। বহুদূরে একদল সৈনিক সমতালে পা ফেলে কোথায় যেন চলেছে। তাদের পায়ের ভারি আওয়াজও দূরত্বের সমুদ্র অতিক্রম করে কিছুটা হালকা হয়ে কানে বাজতে থাকে।

আজ রাত্রির ঘটনাগুলোর কথা চিন্তা করতে করতে এক সময় ট্রামে উঠলাম, তারপর বাড়ি পৌঁছলাম। নিদ্রিত গৃহের শান্তি অব্যাহত রেখে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।

অনিমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথে হাঁটছি, এমন সময় কানে এলো : শোনো। হঠাৎ ঠিক কানের কাছেই এই ডাক শুনে আমি বিদ্যুৎ-গতিতে ঘুরে দাঁড়ালাম। তারপরের আবিষ্কারে অপরিসীম বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। এত রাত্রে এইখানে, একাকী সেলিনাকে দেখতে পাব এমন সম্ভাবনার কথা কখনো মনে আসে নি।

আকাশে মেঘ গর্জন করে উঠল। চকিতে একবার বিদ্যুৎ আকাশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত নৃত্যের ছন্দে এগিয়ে গিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। ক্ষণকালের সেই আলোকেই সম্মুখের বিস্তৃত পথটি একবার চোখের সামনে ভেসে উঠল। কালো পিচের রাস্তা অভ্রভেদী অন্ধকারের মতো চোখের ওপর নিমেষের জন্য ভেসে উঠে আবার তিমিরের গর্ভে মিলিয়ে গেল। মাথার ওপর ঢোলকের গুরুগম্ভীর আওয়াজের মতো আবার মেঘ ডেকে উঠল। সিক্ত- বাতাসের একটা ঢেউ এসে সমস্ত শরীরে কাঁপনও ধরিয়ে দিল। তারপর মাথার ওপর বৃষ্টি ভেঙে পড়ল।

—একটু তাড়াতাড়ি পা চালাও। একেবারে ভিজে যাব।

আমি এমন মোহাবিষ্ট, সমস্ত অনুভূতির অতীত, এমন এক আচ্ছন্ন অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলাম যে প্রতিটি শব্দেই চমকে উঠছিলাম। পিছনে একটা রিকশার ঠুনঠুন শব্দেও ভয়ানক চমকে উঠলাম—চোর যেভাবে অন্ধকার কোণে গৃহস্বামীর পদশব্দ শুনে চমকে ওঠে।

–এই রিকশাতেই উঠে পড়।

কখন যে রিকশায় উঠলাম কতদূর যে এগুলাম, কি কি কথা হলো, আমি কোনো জবাব দিলাম কি না, বহুক্ষণ যেন সে সম্বন্ধে আমার কোনো জ্ঞানই ছিল না। কেবল রিকশা এগিয়ে চলেছে, আর রিকশার হলুদ আলোটি অন্ধকারের বুকে এক অজ্ঞাত অতিকায় সাপের চোখের মতো দপদপ করে জ্বলছে, কেমন করে যেন এই চেতনাটুকুই ছিল।

আশ্চর্য এই আমি।

ফুটবল মাঠে, বিতর্ক-সভায়, স্কুল-কলেজে আমি পরম আত্মনির্ভর, কিন্তু যে-মুহূর্তে আমি সেলিনার সঙ্গে একাকী, তক্ষুণি এক অসহায় নিরুপায় অক্ষমতায় আমার সমস্ত শরীর-মন পঙ্গু হয়ে যায়। প্রথম দর্শন থেকেই সেলিনাই হয় প্রবল পক্ষ। তার কারণ কি কেবল এই, সেলিনার আচরণে আমি পরম্পরার সূত্র দেখতে পাই না। তার কারণ কি এই, সেলিনার আচরণে আমার প্রতি এক নিদারুণ ধিক্কার দেখতে পাই; তার কারণ কি এই, তার গতিবিধি মতামত আমি অনুমোদন করি না?

কোনো একটি কারণে আমি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ি না, তা ঠিক। তবে আমার ভয় হতো, সেলিনার পদক্ষেপ এত দ্রুত যে আমি তার সমতালে অগ্রসর হতে পারব না। হতে চাইও না। তাই সেলিনার সংস্পর্শে এলে এক অজ্ঞাত আতঙ্ক আমাকে নিবিড়ভাবে বেষ্টন করে ফেলে।

আজ রাত্রে সেলিনাও যেন আতঙ্কিত, চিন্তিত, এবং এমনকি আমার কাছে পৌঁছে যেন কিছুটা আশ্রিতও বোধ করছিল।

রিকশায় উঠে সেলিনা অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে আমার হাত ধরল। এক সময় আমিই প্রশ্ন করলাম : আমরা যাচ্ছি কোথায়?

—চলোই না। আমাকে বিশ্বাস করতে পার না?

লঘুভাবে জবাব দিয়ে সেলিনা এক রহস্যময় হাসি হাসল। তার পরই আবার ভয়ানক গম্ভীর।

—আমরা এক ডাক্তার বাড়ি যাব। এক্ষুণি আমার অপারেশন করানো দরকার।

—অপারেশন?

আমার কণ্ঠে যারপরনাই বিস্ময়।

সেলিনা জবাব দিল : হ্যাঁ। আজ রাত্রেই।

সেই মুহূর্তে একটি ট্রাক দুরন্ত বেগে ছুটে চলে গেল। রিকশা এগিয়ে চলেছে। তাকে কোথায় যেতে হবে সেলিনা হয়তো বলে দিয়েছে কিন্তু কখন বলেছে আমি শুনতে পাই নি কিন্তু সে একটি অন্ধকার গলি পেরিয়ে এগিয়েই চলেছে। নিস্তব্ধ নিশীথে রিকশাঅলার ঘণ্টার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। মাঝে মাঝে হঠাৎ এক-আধটা বাড়ির এক-আধটা কামরায় বাতি জ্বলছে দেখা যায়।

রিকশার মধ্যে আমরা দুটি প্রাণী পরস্পরের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।

–কিসের অপারেশন?

সেলিনার কথার জবাবে তৎক্ষণাৎ এই প্রশ্ন করলাম; কিন্তু মনে হলো মাঝখানে যেন একটা গোটা যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে।

সেলিনা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। অনেকক্ষণ নীরব থাকল। তারপর বললো : সেই রাত্রের কথা মনে আছে? সেই যে খিদিরপুর থেকে ফিরে এলাম?

মনে মনে বললাম : সে রাত্রের কথা জীবনে কোনোদিন কি ভুলতে পারব!

সেলিনাই বলে চলল: আমার সর্বনাশ হয়েছে। অপারেশন করে ফেলে দিতে হবে।

এই বলে সেলিনা আরো জোরে আমার হস্ত-পীড়ন করল।

আমার সমস্ত শরীর পাথর হয়ে গেল। মেয়েটা বলে কি! নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এই কি সেই সেলিনা, যে মুশতাকের বোন, যে আমাদের সঙ্গে উঠেছে- বসেছে, এক সঙ্গে বসে ক্যারাম খেলেছে! এ কি সর্বনেশে কথা তার মুখে।

আমার হৃৎপিণ্ড কাটা ছাগলের মতো লাফাতে শুরু করল, এক্ষুণি যেন গলা থেকে বেরিয়ে আসবে।

রিকশার চাকার ঘড়ঘড় ছড়ছড় শব্দ ছাড়া চতুর্দিক নীরব। কেমন করে সেই শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল, জল্লাদ তার অস্ত্র শাণিত করছে।

এক দুঃসহ আতঙ্কে সমস্ত পৃথিবীটাই আমার চোখের সামনে দুলতে আরম্ভ করে দিল। অপারেশন করতে গিয়ে সেলিনা যদি মারা যায়? এই গভীর রাত্রে অজানা-অচেনা জায়গায় আমি তখন কি করব? তার মৃত্যুর কি কৈফিয়ত দেব? এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর সময় তার শয্যাপার্শ্বে আমার উপস্থিতির ব্যাখ্যাটাই-বা কি হবে? সেলিনা তো মরেই খালাস! তারপর আমার অবস্থাটা কি হবে? আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, আইন-আদালত সবার চোখে এই আমিই অপরাধী হয়ে থাকব।

সহসা এক নিদারুণ ঘৃণায় আমার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। আচ্ছা স্বার্থপর এই মেয়েটি! এমন এক চরম অন্যায় প্রস্তাব সে করে কি করে—কাদা ঘাঁটবার সময় আমাকে আহ্বান কেন করে! আমি তার কে যে তার জন্য এত বড় ঝুঁকি নিতে যাব?

কিন্তু ততক্ষণে রিকশা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রিকশা থেকে নাবতে নাবতে সেলিনা বললো : মুশতাক বাড়ি চলে যাবার পর আমি তোমার পিছু পিছু চলে আসি। সে কিছুই জানে না। আশা করি কোনোদিনই জানবে না। কি বলো? বাড়িতে বলে এসেছি অনিমার সঙ্গে দিন সাতেক থাকব।

—অনিমা জানে?

সেলিনা কোনো জবাব দিল না।

রিকশা থেকে রাস্তায় নেবে একবার সভয়ে চারদিক চোখ বুলিয়ে নিলাম—কোথাও

আমাদের এই অভিযানের সাক্ষী আছে কি না।

দরজার কাছে এগিয়ে এসে সেলিনা কড়া নাড়ল। মনে হলো বড় বেশি শব্দ হচ্ছে।

—আস্তে কড়া নাড়। পাড়ার লোক উঠে পড়বে।

—আরো আস্তে নাড়লে ডাক্তার আবার শুনতে পাবে না।

—এই ডাক্তারের সঙ্গে তোমার পরিচয় হলো কোথায়?

সেলিনা এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিল না।

দরজা খুলে গেল। ঘরের ভিতরের আলো খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে অন্ধকার রাস্তার ওপর টর্চের আলোর মতো এসে পড়ল।

ডাক্তার ইশারা করলেন, আমরা অন্দরে প্রবেশ করলাম।

শিখ ডাক্তার। অল্প বয়স। অত্যন্ত সুপুরুষ। হাত দিয়ে চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে আমাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। তারপর অল্প একটু হেসে মন্তব্য করলেন : So, this is the young man. But…well, he is younger than I thought.

আমার সমস্ত চোখ-মুখ রাঙা হয়ে গেল।

আমাদের বসতে বলে ডাক্তার ভিতরে চলে গেলেন। বলে গেলেন এক্ষুণি ফিরে আসছেন।

সেলিনা বললো : আমাদের বোধ হয় ঘণ্টা দু’-এক লাগবে। তুমি ততক্ষণ এখানেই বসে থাক।

আমি প্রশ্ন করলাম : এখান থেকে আমরা যাব কোথায়?

—অনিমাদের বাড়ি।

—তার বাবা-মা বলবেন কি!

—ব্যবস্থা করে এসেছি, কেউ জানবে না।

সেলিনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে একবার তাকালাম। এমনকি তার স্থির শান্ত আত্ম-প্রত্যয় লক্ষ্য করে এক প্রকার ভক্তিও হলো। কিন্তু আমার দৃষ্টির মোকাবিলাতেও তার মুখের কোনো ভাবান্তর দেখলাম না।

এক সময় ডাক্তার ফিরে এলেন।

সেলিনা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আশ্চর্য, মাথার ওপর ঘোমটা টেনে দিল। আমার কাঁধের ওপর অল্প একটু চাপ দিয়ে শুধু বললো : চললাম!

ডাক্তার একটা ছোট্ট গ্লাসে কি এক প্রকার পানীয় নিয়ে এসে আমার সামনে টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। বললেন, Have some gin, It will steady your nerves.

তারপর উভয়েই ভিতরে চলে গেলেন।

সেলিনার আঁচল পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হবার পর মুহূর্তেই আমার সমস্ত শরীর অসহ্য ভয়ে কাঁপতে শুরু করে দিল। মনে হলো, এক্ষুণি বুঝি ফিট হয়ে যাব।

সেলিনা তো বললো : চললাম। কিন্তু এই চললামটা কোথায় ভালো করে উপলব্ধি করবার পরই আমার গোটা শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করল : চোখের সামনে সবকিছুই নাগরদোলার মতো ঘুরতে শুরু করে দিল। মাথা গরম হয়ে এলো, গলা কাঠ। বুকের কাছে আবার সেই অনুভূতি, একটা গোটা সুপারি সেখানে আটকে গেলে যেমন করে। এইভাবে কতক্ষণ কাটল সঠিক বলা কঠিন। কিন্তু আরো কিছুক্ষণ সেইভাবে বসে থাকতে হলে আমি সত্যি সত্যিই অজ্ঞান হয়ে যেতাম।

কিন্তু দু’ঘণ্টার আগেই—অনেক আগেই ডাক্তার-রোগী উভয়েই ফিরে এলো। উভয়ের চোখে-মুখেই স্বস্তির প্রশান্তি।

ডাক্তার বললেন : False alarm, young lady. But be careful in future. The same to you young man.

ডাক্তারের কথা শুনে এত দুঃখেও আমার হাসি এলো—বড়ই তিক্ত সে হাসি।

সেলিনা আর আমি উভয়েই আবার রাত্রির অন্ধকারে বেরিয়ে এলাম। রিকশায় উঠবার পর ডাক্তার যখন দরজা বন্ধ করে দিলেন, তখন সেলিনা বললো : দেখতো, কি কাণ্ডটা করলাম। মিছিমিছি।

তারপর প্রসঙ্গটা সামান্য একটু বদলে সে আবার বললো : তুমিই দ্বিতীয় প্রাণী জানলে। আর কেউ জানবে না তো।

আমি কোনো জবাবই দিলাম না। বস্তুত আমার পার্শ্বের এই মেয়েটির স্পর্শ আমার কাছে তখন অসহ্য মনে হচ্ছিল।

এমন সময় সেলিনা এক কাণ্ড করল।

হঠাৎ দু’হাত দিয়ে আমাকে সজোরে জড়িয়ে ধরে আমার দুই ঠোঁটের ওপর একটা দীর্ঘ চুম্বন দিল—আমার মনে হতে লাগল, এ চুম্বন যেন শেষ হবে না।

আমি সজোরে নিজেকে মুক্ত করে নিলাম। রিকশা ভয়ানকভাবে নড়ে উঠল! রিকশাঅলা প্রতিবাদ করে বললো : এ রকম করলে রিকশা চালাব কি করে।

রিকশাঅলা হয়তো এ ধরনের বহু দৃশ্যেরই সাক্ষী, তাই আর কিছু বললো না

সেলিনা এবার স্থির হয়ে বসল। আমিও বহুক্ষণ ধরে কোনো কথা বললাম না, বলবার প্রবৃত্তি হলো না। তারপর প্রশ্ন করলাম :

–কি তোমার পেশা?

—পেশা।

–হ্যাঁ পেশা। তাই তো মনে হয়। হয় তুমি দানবী, নয় তুমি উন্মাদ। আজকের পরিবেশে তোমাকে দেখে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, তুমি স্বচ্ছন্দে শীতল মস্তিষ্কে মানুষ খুন করতে পার।

এরপর আর একটি কথাও হয় নি। একেবারে অনিমাদের বাড়ির গেটের সামনে এসে আবার যখন রিকশা দাঁড়ালো, তখন আর একবার পার্শ্বে সেলিনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। এও কি সম্ভব? সেলিনার চোখে অশ্রু। রিকশার কোণে মাথা কাত করে অঝোরে কাঁদছে।

একটি কথাও না বলে সে নেবে পড়ল, তারপর সোজা এগিয়ে গেল গেটের দিকে। খোলা দুটি গেটের মাঝখানে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সে বললো : হয়তো তোমার কথাই ঠিক

তারপর অত্যন্ত দর্পিত ভঙ্গিতে ভিতরে অদৃশ্য হলো।

ঘুম ভাঙলে দেখলাম আমার গোটা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। অদ্ভুত স্বপ্ন! এমন স্বপ্নও লোকে দেখে! যাই হোক, একটা স্বস্তির নিশ্বাস বুকটাকে হালকা করে দিল।

আশ্চর্য, এর কিছুদিন পরই কলেজের ঠিকানায় একটা চিঠি পেলাম। সেলিনার চিঠি। সে লিখেছে : “তোমার সাথে কথা আছে। অনেক কথা। তুমি আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানো আবার অনেক কিছুই জানো না। সবটাই তোমাকে শোনাতে চাই—সবটুকু শুনলে তোমার ধারণা হয়তো একটু অন্যরকম হবে। মুখোমুখি না বলে, চিঠিতেই সব খুলে বলতে পারতাম; কিন্তু চিঠি তোমার হাতে যদি না পৌঁছয়? তাই সাক্ষাতেই বলতে চাই।

তুমি ভাবছ, বলবার প্রয়োজন কি? হয়তো প্রয়োজন কিছুই নেই। তবু তুমি আমার জীবনের অমাবস্যাটাই কেবল দেখলে, আর কিছুই জানলে না, এই চিন্তাটুকু আমাকে পীড়িত করে। আমার কথা বুঝি বিশ্বাস হতে চায় না? দোষ তোমার নয়। কেনই-বা বিশ্বাস হবে।

আমার জীবনের এক গোপন গলিতে অপ্রত্যাশিতভাবে তোমার সঙ্গে দেখা। দেখা না হলেই ভালো হতো। অথবা হয়তো এ-ই ভালো হয়েছে। সকলের চোখে আমি অপরূপ সুন্দরী, অন্তত একজন থাক যে আমাকে স্বরূপে দেখেছে।

তোমার সঙ্গে আমার গোপন কথা ভাগাভাগি করে নেব। মনের বোঝাও হালকা হবে। নেবে সেই দুঃসহ ভারের কিছুটা?

জানি তুমি আসবেই। তেইশ তারিখে, ছটার সময়, মেট্রো সিনেমায়। আসবে তো? আমি অপেক্ষা করে থাকব। টিকিট কাটা থাকবে।

তোমার পরীক্ষা সামনে। ভালো করে পড়াশোনা করো। তোমার সুন্দর জীবনটা নষ্ট হতে দিও না। কিছুতেই না।

বয়সে আমি কিছু বড়। মেধায় তুমি। তবু আমি নারী। তোমার চাইতে বেশি বুঝি। আর আমার অভিজ্ঞতা? তার কিছুটা পরিচয় তো পেয়েছ? তুমি বড় হবে, অনেক বড় হবে। চিঠিটা ছিঁড়ে ফেল। কিছুতেই যেন ভুল না হয়।”

এইখানেই সেলিনার চিঠি শেষ হয়েছে। এই দ্বিতীয়বার শুনলাম, আমি না কি বড় হবো।

চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললাম, কুচিকুচি করে। এইভাবেই এত সহজেই যদি সেলিনার জীবনের গোপন গলিটার অস্তিত্বও শেষ করা যেত! তারও মনে আছে! সেও দুঃখ পায় কষ্ট পায়, বিপদের সময় সঙ্গ চায়?

সেও বিরূপ ধারণার সম্ভাবনা চিন্তা করে বিচলিত হয়? তারও বন্ধু প্রয়োজন—বিশেষ করে আমার মতো বন্ধু!

কিন্তু সেলিনাকে চিনবার তখনো অনেক বাকি ছিল।

যাই হোক সেলিনার এই নিমন্ত্রণ আমি রক্ষা করি নি। বস্তুত সেই রাত্রের বিভীষিকা আমি ভুলতে পারি নি। জীবনে আর কোনোদিন কোনো প্রলোভনইবা কোনো প্রয়োজনই আমাকে সেলিনার কাছে নিয়ে আসতে পারবে না, মনে মনে এমনই এক ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলাম; কিন্তু মানুষের প্রতিজ্ঞা।

কয়েকদিন পর আবার সেলিনার চিঠি পেলাম। এবার সে লিখেছে : “তুমি শেষ পর্যন্ত এলে না। তোমার পথের দিকে চেয়ে চেয়ে আমার চোখ ক্ষয়ে গেল, তবু তুমি এলে না! আমি একা মেয়েমানুষ রাজ্যের পুরুষের মাঝখানে কতক্ষণ যে বসেছিলাম, তা যদি জানতে। কত লোক এলো-গেল, কতজন আমার চারপাশে ঘুরে বেড়ালো, লেমনেড-বিয়ার সেবন করল, এক একটা করে ঘণ্টা পড়ল, সকলেই এক এক হলের ভিতর প্রবেশ করল, আমি তবু টিকিট হাতে করে তোমার আশায় বসেই থাকলাম। বারের বেয়ারারাও আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তারা হয়তো মনে করল : সবাই আসে-যায়, ছবি শুরু হবার সময় হলো, সবাই অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে, অথচ এই মেয়েটি সেই যে ঠায় বসে আছে, সে আর উঠবার নাম করে না কেন। আমার পিছনেই দু’জন হুনোমুখো সাহেব ট্রালালা করে গান জুড়ে দিল। তবু আমার চোখ বারবার সিঁড়ি দিয়ে নাবতে থাকে, বারবার আমার মন বলতে থাকে, তুমি আসবে, তুমি নিশ্চয়ই আসবে, তুমি না এসে থাকতে পারবে না। সিঁড়িতে পদধ্বনি হয়, আমার দুটি কান খাড়া হয়ে ওঠে এই বুঝি তুমি এলে!

কিন্তু তুমি তো এলে না! সত্যিই এলে না?

কেনই-বা আসবে!

তবু আমি আবার অপেক্ষা করব। কাল রবিবার। তুমি চাইনিজ ফুড খেতে ভালোবাস। কাল দুপুর সাড়ে বারোটায় আমি চীনে পাড়ার নানকিং হোটেলে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। চীনে পাড়া আমার বাসা থেকে অনেক দূর। তাছাড়া আজকালকার দিনে একাকী একটি মেয়েমানুষের জন্য নিরাপদও নয়। তবু আমি একাই অপেক্ষা করব।

এরপরও কি তুমি আসবে না?

পুনশ্চ—পড়া হলেই এই চিঠিটিও ছিঁড়ে ফেল। আশা করি কিছুতেই ভুলবে না।

চীনে পাড়া এক নতুন দুনিয়া। সরু সরু আঁকাবাঁকা গলি, খাটোখাটো ছোট-ছোট বাড়িঘর, যেমন অন্ধকার তেমনি নোংরা। চামড়ার আর গাঁজার আর কোকেনের গন্ধ, অধিবাসী চীনাদের বিচিত্র আর সন্দিগ্ধ চোখ-মুখ, পথের ওপরই রকম-বেরকমের পণ্যের সম্ভার—দেখেশুনে মনে হয়, এই অঞ্চলটি কলকাতার জনসমুদ্রে এক অচেনা দ্বীপ। রাত্রে তো বটেই, এমনকি দিনেও এই পাড়ার পথঘাটে চলাফেরা করতে গা-টা কেমন ছমছম করে। গুমখুন করবার জন্যই যেন এই পাড়াটি তৈরি করা হয়েছে—এমনই রহস্যময় পরিবেশ। কিন্তু ঠিক সেই কারণেই এই অঞ্চলটির একান্ত নিজস্ব এক আকর্ষণ আর ব্যক্তিত্ব আছে। মুখ বদলাবার জন্য অনাস্বাদিত খাদ্যের মতো, চোখ বদলাবার জন্য এমন আর একটি পাড়া গোটা কলকাতায় আর কোথাও নেই। মনে হয় এক নতুন দুনিয়ায় চলে এসেছি এবং মুখ বদলাবার জন্যও এখানে যেমন ব্যবস্থা আছে, তার ওপর আর কথা নেই। ভোজনবিলাসী মাত্রেই বলবেন : চীনে খাবার যদি খেতে চাও তো নানকিং যাও। খাস নানকিং-এও না কি কলকাতার নানকিং-এর মতো খাস চীনে খাবার পাবে না।

আমার আগেই সেলিনা পৌঁছে গিয়েছিল। একটা কেবিনে একটা কোণে চুপচাপ বসেছিল। সেদিন আমার মেজাজ ছিল হালকা এমনকি পাতলা! একটু হেসেই জিগ্যেস করলাম : কতক্ষণ এসেছ? বহুক্ষণ বসে থাকতে হয় নি তো। খাওয়াবে কিন্তু তুমি। আমার পকেট শূন্য!

সেলিনা জবাব দিল : এইমাত্র এলাম। তোমার অন্তত পকেট আছে আমার যে তাও নেই। —না, তা নেই বটে। কিন্তু তোমাদের সম্পদ তো আর পকেটে লুকানো থাকে না।

—তার মানে?

—মানে কিছু নেই!

সেলিনার পরনে পাতলা ফিনফিনে শাড়ি। অবগুণ্ঠনের অছিলায় উন্মোচনের কৌশল সে জানে।

সেলিনা বলে : এরা কিন্তু সার্ভ করতে অনেক সময় নেয়। তাড়াতাড়ি বলতে হবে কি খেতে চাও।

—কি খেতে চাই? প্রথমে বিয়ার, তারপর ছাউছাউ, নুডুলস আর সুইট এন্ড সাওয়ার পোর্ক।

–বিয়ার পোর্ক! তুমি খাবে বিয়ার আর শূয়ার।

—চমকে উঠলে যে। তুমি তো এত সহজেই চমকাবার পাত্রী নও।

–সে যাই বল, তোমাকে বিয়ার আর পোর্ক আমি খাওয়াতে পারব না। তোমার মুখে ওসব কথা মানায় না।

এ কথার পর কিছুতেই আমি হাসি রোধ করতে পারলাম না।

—হা হা হা। তোমার মুখে এ কথাটি কিন্তু সুন্দর মানিয়েছে তোমারই যোগ্য কথা।

সেলিনার মুখ মলিন হয়ে গেল। হবার জন্যই কথাগুলো বলা। তার মুখভাব একবার দেখে নিয়ে আমি আবার হাসতে শুরু করলাম। ইচ্ছাকৃত হাসি নয়, অপ্রতিরোধ্য হাসি।

লজ্জায় সেলিনার চিবুক তার বুকের ওপর নেবে এলো। পাশের কেবিনে ছুরি-কাঁটার শব্দ, মদের বোতল খুলবার শব্দ, আর অস্ফুট প্রেমালাপের শব্দ।

সেলিনা নিজের সঙ্গে লড়াই করছিল। এক সময় সে মনস্থির করে মাথা উঁচু করে বসল। বেল টিপে ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার দিল : প্রথমে এক বোতল বিয়ার নিয়ে এসো। তারপর ছাউছাউ নুডুলস সুইট এন্ড সাওয়ার পোর্ক আর সুইট এন্ড সাওয়ার প্রন

ওয়েটার তার নোট বইয়ে ফরমায়েশ টুকে নিয়ে বিদায় নিল। আমি তখনো একটু একটু হাসছি। বললাম : সুইট এন্ড সাওয়ার প্রন বুঝি তোমার জন্য।

সেলিনা নিরুত্তর থাকল। তার চোখ যেন একটু সিক্ত!

–কৈ জবাব দিলে না।

–হ্যাঁ আমার জন্য।

ওয়েটার বিয়ারের বোতল হাতে নিয়ে উপস্থিত হলো। আমি তাকে বললাম : ওয়েটার, পোর্ক লাগবে না শুধু প্রন নিয়ে এসো।

খোলা বিয়ারের বোতল থেকে গ্লাসের মধ্যে বিয়ার ঢেলে নিলাম। গ্লাসে একটা চুমুক দিলাম। সামনে টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকল অর্ধশূন্য অর্ধপূর্ণ বোতলটি।

এক ঢোকে অনেকটা খেয়ে নিয়ে গ্লাসটা টেবিলের ওপর নাবিয়ে রাখলাম। তারপর একটা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলাম। আমার চঞ্চল উত্তেজিত স্নায়ুগুলো শান্ত হয়ে এলো। একটা আরামের নিশ্বাস মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, আঃ।

সেলিনা আমার হাবভাব লক্ষ্য করছিল। সে প্রশ্ন করল : তুমি কি নিয়মিত বিয়ার খাও।

—না। আজই প্রথম।

—তবে আজই-বা কেন খেলে?

—সব কিছুরই একটা শুরু আছে, আগে খাই নি বলে এখন খাব না, এটা কোনো যুক্তি নয়।

এই বলে গেলাসটা আবার মুখের সামনে টেনে নিলাম। ঠোঁট মুছে এক গাল হাসি হেসে আবার বললাম : তুমিই কি খিদিরপুরে আবার গেছ।

তারপর হো-হো করে হেসে উঠলাম : সেলিনা দুই হাত দিয়ে বুক চেপে বসে থাকল। হাসতে হাসতে আবার বললাম : তুমি পোর্ক খেতে চাও না কেন? জাহান্নামে যাবার ভয়? সেলিনা দৃপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল : হ্যাঁ তাই।

ঠাস করে গেলাসটা টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়লাম। হাসি থামলে বললাম : সত্যিই, তোমার ধর্মপরায়ণতায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। তোমার মতোটি আর কোনোদিন দেখব না।

—তুমি আমাকে ভয়ানক ঘৃণা কর, তাই না? কি ভাব তুমি আমার সম্বন্ধে?

—কি ভাবি? শুনবে কি ভাবি?

—হ্যাঁ

—তুমি King Lear পড়েছ?

—পড়েছি।

বিয়ারে লোক সহজে মাতাল হয় না। কিন্তু যে-পানরসিক প্রথম বিয়ার সেবন করছে তার মাথা সুস্থ-স্বাভাবিক থাকে না। আমারও মুখ দিয়ে হল্কার মতো তপ্ত শব্দগুলো বেরিয়ে এলো-

Down from the waist they are Centaurs,
Though women all above.
But to the girdle do the Gods inherit,
Beneath is all the fiend’s.
There’s hell, there’s darkness, there is the sulphurous pit, burning, scalding, stench, consumption.

সেলিনা অত্যন্ত অন্যমনস্ক ছিল। সে আমার কথা শুনল না, কি বুঝল জানি না; কিন্তু তার কোনো ভাবান্তর দেখলাম না।

এতক্ষণে ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গে খাবারের ওপর ঝুঁকে পড়লাম। সেলিনা একটু যেন বিদ্রূপের ভঙ্গিতেই প্রশ্ন করল :

—আরো এক বোতল বিয়ার চলবে না কি!

ভোজ্যবস্তুগুলোর ওপর থেকে একবার চোখ তুলে নিয়ে আমিও ঠিক ততটাই বিদ্রূপের ভঙ্গিতে জবাব দিলাম : আলবাত চলবে!

ওয়েটার আরো এক বোতল বিয়ার নিয়ে এলো। পানির বদলে বিয়ার পান করতে লাগলাম।

খাচ্ছি, ছুরি-কাঁটা নাড়ছি, এবং তারই ফাঁকে ফাঁকে এক-আধটা কথা হচ্ছে।

হঠাৎ সেলিনার মুখে হাসি দেখে জিগ্যেস করলাম : হাসছ কেন?

—এমনি। কোনো কারণ নেই।

—তা হতেই পারে না। বলতে হবে কেন।

—না, ভাবছিলাম, তুমি এখনো বাম হাতে ছুরি ধর কিনা? রাগ করলে?

আমি সজোরে হেসে উঠলাম।

এইভাবেই এক সময় সেলিনা আবার প্রশ্ন করল : আচ্ছা তোমার বয়স কত?

—কেন বলতো?

—এমনিই জিগ্যেস করছি। মানা আছে?

—বয়স? তা প্রায় উনিশ। তোমার কত?

—ছিঃ! মেয়েদের বয়স জানতে নেই। তুমি এখনো আমাকে ঘৃণা কর না তো!

—ঘৃণা! তুমি এত সুন্দর, তোমাকে ঘৃণা করতে পারি না!

—ভিতরটা তো আর সুন্দর নয়!

সে কথার জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলাম : তুমি আজকে আমাকে এখানে ডাকলে কেন তাতো এখনো বললে না!

—তা বলছি। তার আগে একটা জবাব দাও। চিঠি দুটো ছিঁড়ে ফেলেছ তো?

–হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে। আমাকে ডাকলে কেন তাই বল।

—বলছি বাবা বলছি। যদি বলি এমনিতেই ডেকেছি, তোমার সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলব বলে।

—যদি তা বলো আমি একেবারেই অবাক হব না।

—হবে না! বিশ্বাস করবে তো?

—বিশ্বাস করব? তোমার কথা?

—কিন্তু সত্যিই আমি তোমাকে ভালোবাসি।

—তামাসা করবার আর সময় পেলে না।

—তামাসা কেন হবে। কেন? আমি কি তোমাকে ভালোবাসতে পারি না?

আমার আর কথা কাটাকাটি করবার প্রবৃত্তি থাকল না। সেলিনার সঙ্গে প্রেমালাপ করবার চাইতে এক গেলাস বিয়ার খাওয়া ভালো। তাই গেলাসের ওপর আবার বোতল উপুড় করলাম। আমিই এক সময় জিগ্যেস করলাম : খিদিরপুরের লোকটি কোথায়?

—একটা অনুরোধ রাখবে? ঐ লোকটির নাম কোনোদিন আমার কাছে উচ্চারণ করবে না।

-–নাম জানলে তো উচ্চারণ করব। সে যাই হোক, যে লোকটির সঙ্গে তোমার এত অন্তরঙ্গতা হঠাৎ তার প্রতি এত বিরূপ কেন?

সেলিনা আঙুলে আঁচল জড়াতে লাগল। জানালার বাইরে পথ দেখা যায়, সেলিনা সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। এক সময় সে বললো : খিদিরপুরের ঘটনার জন্য তুমি আমাকেই দায়ী করেছ–তাই না?

—তুমি কি অন্য কাউকে দায়ী করতে চাও?

তারপর কঠিন হয়ে বললাম : দুশ্চরিত্রতা অত্যন্ত নিন্দনীয় সন্দেহ নেই। তবু মানুষের শরীর যখন ভুল করে বা পাপ করে তাও সহ্য হয়। সহ্য হয় না মনের ভীরুতা, মনের শঠতা। সহ্য হয় না কোদালকে কোদাল বলে ডাকতে তুমি যখন ভয় পাও। তোমার অধঃপতনকে কোনো প্রকার সাফাইয়ের পোশাক পরাতে চেষ্টা করো না। করলে তোমার চরিত্র আরো বিকৃত হবে।

সেলিনা আমার দিকে এগিয়ে এলো। পর্দার বাইরে কাছাকাছি কেউ আছে কিনা তাও দেখে নিল। তারপর আমার পাশের চেয়ারে বসে আমার মুখের ওপর সাপের মতো নিশ্বাস ফেলতে শুরু করল। তার চোখে মরুভূমির শুষ্কতা, মরুভূমির পিপাসা। সে আমার মাথা তার দুই হাতের মধ্যে টেনে আনল।

খানিক বাদে স্থির হয়ে দু’জন দু’দিকে যেমন বসেছিলাম, তেমনি বসে পড়লাম।

সেলিনা বললো : এখনকার এই ঘটনার জন্য আমি দায়ী। খিদিরপুরের ঘটনার জন্য দায়ী ছিল সে।

—কার কোথায় দায়িত্ব, এ কি তারই একটা মহড়া হয়ে গেল না কি।

–মনে কর তাই।

তুমি এক আশ্চর্য জীব।

—কি বললে?

আমি সে কথার আর কোনো জবাব দিলাম না। সে-ই আবার বললো : ওঠ এবার চলি। ফারপোতে গিয়ে আইস-ক্রিম খাব, কফি হাউসে কফি।

আমি সেলিনাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করলাম।

আইস-ক্রিম আর কফির পালা শেষ হলে আমরা লেকে এলাম। দু’বোতল বিয়ারের পর আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল, আর বাঘের মতো ঘুম পাচ্ছিল। কফি খাবার পরও ঘুম-ভাব গেল না। লেকে সবুজ ঘাসের ওপর আমি শুয়ে পড়লাম। মাথার ওপর আর চারপাশে গাছপালা আমাদের আড়াল করে রাখল। সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমে অচেতন। যখন ঘুম ভাঙল তখন চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। সেলিনার কোলের ওপর আমার মাথা। বেশ লাগছিল। ঠোঁটের ওপর সেলিনার হাত টেনে আনলাম। হাতের ওপর একটা চুমুও দিলাম—যেভাবে খোকার কপালে মা চুমু দেয়। কেমন করে যে মনে হলো, সেলিনার অপরাধ যতই হোক, তাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না। তার দায়িত্ব কিছুটা আমারও। তার আঙুলে হাত বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করলাম : সেদিন রাত্রে খিদিরপুরে কি হয়েছিল?

সেলিনা একটু নীরব থেকে তারপর জবাব দিল : তুমি বড় বেশি কল্পনা করছ। ইতরটা শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তাইতেই আমি নিঃস্বের মতো উদ্ভ্রান্ত বোধ করছিলাম। ভুলে যেও না, আমি মুসলমানের মেয়ে, আমার অধঃপতনের একটা সীমা আছে।

আমি একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেলিনার দিকে তাকালাম। সেলিনা তার দৃষ্টি নত করে নিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *