পঁচিশ
আজ সোমবার। অনিমার জন্মদিনের নিমন্ত্রণ আজকেই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ইতস্তত করছিলাম, যাব কি না। কত রকমেরর লোক থাকবে—তাদের মধ্যে নিঃসঙ্কোচ হতে পারব কি না, সে চিন্তাও ছিল। তাছাড়া একটা কিছু উপহারও দিতে হয়। এইসব চিন্তা করছি, এমন সময় মুশতাক উপস্থিত। আমাকে তখনো শায়িত অবস্থায় দেখে সে প্রায় চিৎকার করে উঠল।
—তুই এখনো তৈরি হস নি! নাঃ তোকে দিয়ে কিছু হবে না।
—তোর কথা একশ’বার মানি। বিশেষ করে এই নিমন্ত্রণ-রক্ষা কিছুতেই হবে না। আমায় মাপ কর ভাই। অনিমাকে ছাড়া তাদের বাড়ির আর কাউকেই চিনি না।
মুশতাকের পক্ষে যতটা গাম্ভীর্য আয়ত্ত করা সম্ভব—খুব বেশি কোনোদিনই সম্ভব হয় নি তার সমস্তটাই একত্র করে সে আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল। তার ভাবটা এই; আমার মতো অদ্ভুত অশোভন আর অচিন্তনীয় কথা সে কোনোদিনই শোনে নি, এমনকি আমার কাছ থেকেও নয়। মুশতাকের গাম্ভীর্যময় মুহূর্তগুলো, সেগুলো খুব বিরল বলেই, আমি বরাবরই বড্ড উপভোগ করতাম। বস্তুত তার চরিত্রের অনেকটা মাধুর্যই তার এই ধরনের সারল্যের মধ্যে নিহিত ছিল।
আমি বললাম : রাগ করিস কেন বাছা। তুই কেমন বেয়াড়া রকম মোটা হয়ে যাচ্ছিস, তার খবর রাখিস?
—সত্যিই বড় মোটা হয়ে গেছি, তাই না? কি করি বলতো? মুশতাক এবার হেসে ফেলল। তার গাম্ভীর্যের পর্বত বরফ হয়ে গলে গেল।
—কি আর করবি। খাওয়া কমিয়ে দে।
মুশতাকের মুখ আবার গম্ভীর হয়ে গেল—এইবারের গাম্ভীর্যটুকু একেবারেই অকৃত্রিম। তার বুক ভেঙে গেছে, এমনই করুণ সুরে বললো : খাওয়াই যদি কমিয়ে দিলাম, তাহলে বেঁচে আর সুখ কি। তার চাইতে বল, গলায় দড়ি বেঁধে গাছ থেকে ঝুলে পড়ি।
—বৎস, তুমি খাও, যত খুশি খাও, আর মোটা হও; কিন্তু দোহাই তোমার দড়ি-টড়ির কথা চিন্তা করো না। তোমার মতো ছেলে গাছ থেকে ঝুলছে, এমন অবিশ্বাস্য দৃশ্য চোখে পড়লে আমার হাসিই পাবে; মনে হবে বুঝি এ কোনো প্রহসনের দৃশ্য।
—হাসি পাবে! আমার মৃত্যুতে তোর হাসি পাবে। তুই তো দেখি খু-উ-ব হাস্যরসিক হয়েছিস!
—শোন শোন। রাগ করিস নে। জরা, মৃত্যু, শোক, তাপ এই ধরনের কতগুলো অবস্থার সঙ্গে তোর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে তা আমি ভাবতেই পারি না। তুই হচ্ছিস যাকে বলে চির বসন্ত।
—চির বসন্ত? চির কচু! তুই আমাকে যতটা বোকা ভাবিস আসলে আমি কিন্তু ততটা বোকা নই। না হয় একটু বেশি খাই। আসলে তুই আমাকে একটা ক্লাউন মনে করিস!
সত্যকার দুঃখ আর ক্রোধে মুশতাকের মুখভাব এক বিচিত্র রূপ ধারণ করল।
—অমনি রাগ হলো? তোর সঙ্গে একটু তামাসাও করতে পারব না?
—ওসব কথা এখন থাক। যাবি কিনা তাই বল। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এরপরও যদি ‘না’ বলি তাহলে মুশতাক যে আমাকে চিরকালের মতো ত্যাগ করবে তা একেবারে অবধারিত। কিন্তু মুশতাককে ত্যাগ করবার কোনো অভিপ্রায়ই আমার ছিল না। তাই আর কোনো প্রতিবাদ না করে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম।
উভয়েই এসপ্লানেডের ট্রামে উঠলাম। তখনো আমির আলী এভিনিউ,০ গড়িয়াহাট রোডে ট্রাম লাইন বসে নি। তাই পার্ক সার্কাস থেকে এসপ্লানেড ঘুরে বালীগঞ্জ যেতে হতো। অবশ্য দশ নম্বর বাস ধরতে পারতাম; কিন্তু বাসে এত ভিড় যে সে প্রস্তাব মনেও আসে না। এসপ্লানেড পৌঁছলে মুশতাক বললো : আগে একবার নিউ মার্কেট যেতে হবে।
—কেন? আবার নিউ মার্কেট কেন?
–কেন? একটা কিছু উপহার দিতে হবে না!
—তুই কি দিবি রে!
—ফুল। তুই কি দিবি!
—আমিও তো ভেবেছিলাম ফুল দেব। সস্তাও বটে, আর ফুল জিনিসটা ভালো নয় এমন কথাও কেউ বলতে পারবে না।
—বেশ। তুই-ই ফুল দে। আমি না হয় অন্য কিছু কিনে নি।
আমি ফুলের একটা তোড়া কিনলাম। মুশতাক কিনল ভ্যানিটি ব্যাগ। তারপর দু’জনেই গিয়ে উঠলাম বালীগঞ্জের ট্রামে।
আমরা উভয়েই নীরব। মুশতাক অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর। এক সময় মুশতাকই বললো : আমাকে মোটা বলা হয়। নিজের চেহারাটা একবার দেখেছিস! ম্যাট্রিক পাস করার পর থেকেই তুই কি রকম মোটাতে শুরু করেছিস, কখনো খেয়াল করে দেখেছিস।
আমি বললাম : আমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। তুই হয়েছিস যাকে বলে মোটা তাই।
কিন্তু মনে মনে।
গেটের সামনেই অনিমা দাঁড়িয়েছিল। তার পশ্চাতে সেলিনা, সুনীল এবং আরো গোটা কয়েক ছেলেমেয়ে। গেটের ভিতরে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গেই অনিমা আমাদের দু’বন্ধুর হাতে দুটি বেলফুলের মালা পরিয়ে দিল। বিনা আড়ম্বরে এবং স্বল্প প্রসাধনে অনিমা অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়েছে। এই মিষ্টি মেয়েটিকে চারদিক দিয়ে যেন এক প্রকার প্রসন্ন অনুচ্চারিত সৌন্দর্য বেষ্টন করে আছে।
বাড়ির লোহার গেটের দুই পাশে দু’জন দারোয়ান মোটা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। নিমন্ত্রিতদের সালাম জানাতে অবশ্য তারা কসুর করছিল না; কিন্তু তাদের সত্যকার ভূমিকা কিছুটা ভিন্ন রকম ছিল। গেটের ঠিক বাইরেই অসংখ্য দুর্ভিক্ষতাড়িত বুভুক্ষু লোলুপ-দৃষ্টিতে উন্মুখ হয়ে এই বাড়িটির অন্দরের দিকে তাকিয়ে ছিল। অলোক-সজ্জা, সুসজ্জিত নর-নারী, কল-হাস্য প্রভৃতির বাহুল্য দেখে আর শুনে তারা সহজেই অনুমান করেছে, এ-বাড়িতে আজ ভোজের আয়োজন আছে। তাদের সম্মিলিত চাপে গেট যখন ভাঙবার উপক্রম হলো, তখনই দারোয়ান দুটিকে লাঠিসহ মোতায়েন করা হলো।
মুশতাক অনিমাকে উদ্দেশ করে বললো : শাকের আর তোমার উৎসবে অংশ নেবে না।
–কেন? অনিমার প্রশ্ন।
–দেশে দুর্ভিক্ষ, আর তুমি এমন উৎসব করছ।
–দেশের লোক খেতে পাচ্ছে না এমন দৃশ্য দেখে আমি আনন্দ পাই, শাকের আশা করি সে রকম কিছু বিশ্বাস করে না!
—আনন্দ পাও না, সেটাই যথেষ্ট নয়!
—তবে?
—রীতিমতো ব্যথা পেতে হবে। দুঃখে কাতর হতে হবে। অনাহারে থাকতে হবে।
—আমি অনাহারে থাকলেই যদি দেশসুদ্ধ লোকের খাদ্য জুটত তাহলে আমি অন্ন স্পর্শ করতাম না।
এতক্ষণ মুশতাক আর অনিমার মধ্যেই কথা হচ্ছিল। এবার অনিমা সোজা আমাকেই প্রশ্ন করল : শাকের সত্যিই তোমার এই মত? দেশে দুর্দিন, তাই কোনো উৎসব করা চলবে না।
—এ সম্বন্ধে আমার সুবিবেচিত কোন মতই নেই। একটু অসহিষ্ণু কণ্ঠেই আমি জবাব দিলাম।
—তাহলে?
—তাহলে কি?
—তুমি উৎসবে অংশ নেবে না কেন?
—অংশ নেবই না যদি, তো এলাম কেন?
—তাহলে মুশতাক এমন কথা বলছে কেন?
—এ প্রশ্নের উত্তর মুশতাকই ভালো দিতে পারবে।
মুশতাকের এই একটা অভ্যাস ছিল। কোনো কোনো সময় আমার উপস্থিতি সত্ত্বেও সে আমারই মুখপাত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সে অনায়াস অবলীলায় ও দুর্মর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে আমার বক্তব্য কি হতে পারে বলে যেতে থাকত। তার এই অভ্যাসের জন্য আমি প্রায়ই বিপদগ্রস্ত হতাম। এ অভ্যাসটিও তার চরিত্রের এক প্রকার সরলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। মনে মনে তা স্বীকার করলেও, ঠিক সেই মুহূর্তে আমার এত রাগ হতো যে তার কথার প্রতিবাদ পর্যন্ত করতাম না। ফলে তার বক্তব্যই যে আমারই বক্তব্য শ্রোতাও সেইটেই বিশ্বাস করত।
তাকে এ সম্বন্ধে কিছু বললে সে পরম ঔদাস্যভরে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলত : সরি।
বলতে ভুলে গেছি, মুশতাক হালে সিগারেট ধরেছে, ডি লুক্স টেনর!
—তাই বলো! মুশতাক পরিহাস করছিল।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অনিমা বললো। আমি জবাব দিলাম :
—হ্যাঁ। তাই।
লনের ওপর কার্পেট, কার্পেটের ওপর কুশন দেয়া চেয়ার, এবং চেয়ারের ওপর বিভিন্ন বয়সের নারী ও পুরুষ বসেছিলেন।
—এদিকে নয়, ওপরে চল। আমাদের আড্ডা সেখানেই। সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়ের আসবার কথা আছে। যদি আসে, গান জমবে।
ওপরে একটি মাঝ-সাইজের কামরায় উপস্থিত হলাম। সেখানে সাত-আটজন ছেলমেয়ে বসে গল্প করছিল। অর্থাৎ একজন আর একজনের রুমাল কেড়ে নিচ্ছিল; তৃতীয়জন চতুর্থজনের চোখ টিপে ধরছিল; পঞ্চমজন ষষ্ঠের সঙ্গে সাহিত্য আলোচনা করছিল : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চতুষ্কোণ’। কামরার বাইরে একটি বড় বারান্দা, সেখানে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে টেবিল-টেনিস খেলছিল। এক কোণে দেখলাম আমাদের স্কুলের বন্ধু কাঞ্জিলালও উপস্থিত আছে। একবার আমাকে দেখে নিয়ে সে যেমন তাসের ম্যাজিক দেখাচ্ছিল তেমনি ম্যাজিকই দেখাতে লাগল। আমার দিকে দ্বিতীয়বার ভ্রূক্ষেপ করল না।
পরিচয় বিনিময় হয়ে গেলে আসন গ্রহণ করলাম। আমার পাশেই বসেছিল দিলীপ কুমার, প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসে অনার্স পড়ছে—সে না কি বন্ধুমহলে ডি-কে নামেই পরিচিত। এতদিন পরও সবচাইতে আগে তার চোখের রিমলেস চশমাটার কথাই মনে পড়ে। এক কথায় যাকে বলে ‘লাটুবাবু’ ডি-কে-কে দেখেই তাই মনে হলো।
অনিমা বললো : তোমরা আলাপ কর। আমি এই এলাম বলে। একটু কাজ আছে। আর হ্যাঁ, ভালো কথা, আমাদের শাকের একজন উৎসাহী মুসলিম লীগার।
অনিমা নিতান্তই রহস্যচ্ছলে এই পরিচয়টুকু দিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য আলোচনা গেল বন্ধ হয়ে; রুমাল কাড়াকাড়ি স্থগিত থাকল; চোখ টেপাটেপি ক্রীড়ার উৎসাহও এক নিমেষে নিঃশেষ হলো; পিং-পং টেবিলে বল আছাড় খেয়ে পড়বার শব্দও আর শোনা গেল না। এতগুলো ছেলেমেয়ের চোখ এক সঙ্গে একই মুহূর্তে আমার ওপর এসে পড়ল।
একমাত্র মুশতাক অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বোধ করি কাঞ্জিলালের ম্যাজিকও ভুল হয়ে গেল।
অনিবার্যভাবেই পাকিস্তান-প্রসঙ্গ এসে পড়ল।
ডি-কে তার চশমাটি রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করতে শুরু করল। কিন্তু তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হতে লাগল, চশমা তো নয়, যুদ্ধের আগে অস্ত্র শানিয়ে রাখছে। তার সমস্ত মুখ এক অব্যক্ত প্রতিজ্ঞায় কঠিন আকার ধারণ করল। তারপর সে তার চেয়ারটি আমার আরো কাছাকাছি টেনে আনল।
—আপনারা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চান, তাই না?
চিকিৎসক অন্তিম মুহূর্তে একটা ইঞ্জেকশন দেয়ার পর যেভাবে রোগীর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেন, প্রথম প্রশ্ন-বাণটি নিক্ষেপ করবার পর, ডি-কে অনেকটা সেইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। যখন দেখলো রোগী বেশ শক্তই, তখন আর একটি অস্ত্র নিক্ষেপ করবার ভঙ্গিতে দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছুঁড়ে মারল :
—জানতে পারি কি, এই আত্ম বলতে আপনারা কি বোঝেন?
কেবল বক্তব্য নয়, বাচনভঙ্গি পর্যন্ত মারমুখ।
আমি জবাব দিলাম : আপনার প্রশ্নে “আপনারা” বলে যে সম্প্রদায়ের উল্লেখ করলেন, তাদেরকেই বুঝি।
—অর্থাৎ?
ডি-কের ললাটের ওপর একটা প্রশ্ন চিহ্ন অঙ্কিত হয়ে গেল।
—অর্থাৎ ভারতবর্ষে মুসলমান বলে যে জাতি আছে তাদেরকেই বুঝি। একটা বিখ্যাত নটের বাচনভঙ্গি অনুকরণ করে ডি-কে আবার বললো :
–তেমন কোনো জাতি আছে না কি। ভারতবর্ষীয় বলে একটা জাতির উল্লেখ ইতিহাসে আছে বটে।
–যে ইতিহাস ইংরেজ আর হিন্দু লিখিত সেই ইতিহাসে!
এবার ডি-কে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর একটু হেসে, একটু কেশে, চেয়ার একটু নড়েচড়ে, চশমাটা আর একবার মুছে নিয়ে, সে আবার এক প্রশ্ন করল :
—জিগ্যেস করি, এই আমাদের সঙ্গে বোধকরি, ‘কাফের’ নামেই আপনি আমাদের ভালো চিনবেন— সে যাই হোক, এই অধমদের সঙ্গে আপনাদের পার্থক্যটা কোথায় যে পৃথক জাতিত্বের দাবি করছেন।
তারপর একটু থেমে, এবং একটা অভ্রভেদী হাসি হেসে ডি-কে পুনশ্চ যোগ করল : আর যদি কিছু মনে না করেন, আপনার বৃদ্ধ-প্রপিতামহের নামটা কি ছিল একবার স্মরণ করলেই, পার্থক্য সম্পর্কে আপনার যেটুকু চৈতন্য আছে, তাও লোপ পাবে। আপনি বোধ করি জানেন, পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও এখনকার বহু মুসলমানই আর যাই থাকুক না কেন, ঠিক মুসলমান ছিলেন না।
একটা সমবেত হাসি ডি-কের বক্তব্যকে সংবর্ধিত করল।
—আগে আপনার প্রথম প্রশ্নের জবাব দিয়ে নি। আমরা সৈয়দ—এবং আপনারা আমাদের এতই আপন যে সৈয়দ শব্দটির তাৎপর্য কি বোধ করি তাও জানেন না। আর যদি জানেনই, তাহলে আমার বৃদ্ধ-প্রপিতামহের নামটা নাইবা শুনলেন, উচ্চারণ করতে পারবেন না, আপনার কণ্ঠই আড়ষ্ট হয়ে যাবে। আপনার দ্বিতীয় ইঙ্গিত : বাঙালি মুসলমানেরা কয়েক পুরুষ আগেও অমুসলমান ছিলেন। হয়তো ছিলেন; কিন্তু তাঁরা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এ কারণে নয় যে হিন্দু-মুসলমান এক। পৃথক বলেই এক ধর্ম ত্যাগ করে, অন্য ধর্ম গ্রহণ করবার প্রশ্ন ওঠে। অবশ্য হিন্দুরা দলে দলে ধর্ম-ত্যাগ করেছে এই ঐতিহাসিক সত্যটি স্মরণ করে আপনি দুঃখিত আর বিচলিত হবেন, এটা স্বাভাবিক!
ডি-কে একটু আগেই একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। তার হাত কাঁপতে লাগল। সে তার জ্বলন্ত গোটা সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পরক্ষণেই আর একটা সিগারেট ধরাল। তারপর বক্র-হাসি হেসে বললো : আপনি কি বলতে চান, ধর্ম আলাদা হলেই জাতি আলাদা হয়।
—হ্যাঁ। অনেক সময় তাই হয়।
—দ্বিজাতিত্বের একটা ভিত্তি থাকতে হবে তো। আপনাদের ভিত্তিটা কি? আবার জিগ্যেস করি : আমাদের সঙ্গে আপনাদের পার্থক্যটা কোথায়?
—পার্থক্য সর্বত্র। একটা প্রমাণ দিতে পারি। এত বড় বাংলা সাহিত্য – অথচ মুসলিম জীবনের চিত্র কোথাও দেখতে পান।
—সে চিত্র তুলে ধরবার দায়িত্ব মুসলমান সাহিত্যিকদের, আমাদের নয়। আপনাদের জীবন সম্বন্ধে আমরা ভালো জানি না।
—আমাদের জীবন সম্বন্ধে আপনারা ভালো জানেন না সে কথা খুবই সত্য। কিন্তু এ কথার আর একটি অর্থ এই যে আমাদের জীবন আপনাদের জীবন থেকে পৃথক, তাই জানেন না। তাই নয় কি? সুতরাং পার্থক্যটা যে-কোথায় আমাকে আর সে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। তাছাড়া পার্থক্য বিশ্লেষণ আর ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক, কারণ জাতিত্বের সর্বাধুনিক আর সর্বাপেক্ষা বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা অনুসারে কোনো এক দল লোক যদি নিজেদের এক বলে অনুভব করে তাহলেই তাদের এক পৃথক জাতি বলে স্বীকার করতে হবে। ভারতীয় মুসলমানরা তাই অনুভব করে।
—না! তারা তা করে না।
এবার আমি হেসে ফেললাম। আমি সাধারণত সিগারেট খাই না; কিন্তু এই সময় এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে মুশতাকের কাছ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালাম। মুশতাক সোৎসাহে সিগারেট ধরিয়ে দিল—যেন যুদ্ধের জন্য নতুন রসদ হাতের কাছে এগিয়ে দিল। তারপর অলক্ষ্যে তার বাম হাত দিয়ে আমার হাতের ওপর একটু চাপ দিল।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে, ডি-কে-কে উদ্দেশ করে বললাম :
—আমরা নিজেরা শতবার শতরূপে বলছি আমরা আলাদা, আমরা স্বতন্ত্র, তবু আপনি বলবেন, আলাদা নই। আপনাদের এই হাস্যকর জেদের জন্যই আমাদের রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো মীমাংসা হচ্ছে না। নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আপনারা খুব সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলেন। অথচ একটু পূর্বেই যে-সাহিত্যিকদের উল্লেখ করলেন তাঁদের উক্তি কি ভুলে গেছেন। আপনারা যাঁকে মহর্ষি বলেন সেই বঙ্কিমচন্দ্রের কথা না হয় নাই তুললাম; এমনকি অমন যে দরদী শরত্চন্দ্র আর মনীষী রবীন্দ্রনাথ তাঁদের মতটাও মনে রাখবেন।
—আপনি রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রকেও এই বিতর্কের ঊর্ধ্বে মনে করেন না।
—না, করি না। মনে আছে, এই শরৎচন্দ্রই বলেছিলেন; “বস্তুত মুসলমান যদিও কখনও বলে—হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কি হইতে পারে, ভাবিয়া পাওয়া কঠিন। একদিন মুসলমান লুণ্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, রাজ্য-প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসে নাই। সেদিন কেবল লুঠ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চূর্ণ করিয়াছে, নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে, বস্তুত অপরের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের পরে যতখানি আঘাত ও অপমান করা যায়, কোথাও কোন সঙ্কোচ মানে নাই।”
এই যে কথাগুলো উদ্ধৃত করলাম সেগুলো দরদী শরৎচন্দ্রের। মুসলমান সম্বন্ধে তাঁর মত তিনি আরো পরিষ্কার করে বলেছেন। তা এই : “হিন্দু নারী হরণ ব্যাপারে সংবাদপত্রওয়ালারা প্রায়ই দেখি প্রশ্ন করেন, মুসলমান নেতারা নীরব কেন? তাঁদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যে পুনঃ পুনঃ এতবড় অপরাধ করিতেছে, তথাপি প্রতিবাদ করিতেছেন না কিসের জন্য? মুখ বুজিয়া নিঃশব্দে থাকিবার অর্থ কি? কিন্তু আমার ত মনে হয় অর্থ অতিশয় প্রাঞ্জল। তাঁরা শুধু অতি বিনয়বশতই মুখ ফুটিয়া বলিতে পারেন না, বাপু, আপত্তি করব কি, সময় ও সুযোগ পেলে ওকাজে আমরাও লেগে যেতে পারি এই যে কথাগুলো শুনলেন এগুলোও বলেছেন সাহিত্য-সম্রাট শরৎচন্দ্র,—যাঁকে আপনারা মুসলিম হিতৈষী বলেন। বাকি থাকলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বক্তব্য স্মরণ করতে পারেন? মনে আছে—”মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস” নিবন্ধে তিনি কি বলেছেন।
—আপনি কি রবীন্দ্রনাথকেও মুসলিম-বিদ্বেষী বলতে চান না কি। তাঁর সম্বন্ধেও আপনার মনে কোনো শ্রদ্ধা নেই।
—রবীন্দ্রনাথের কাব্য-প্রতিভাক আমি শ্রদ্ধা করি, বোধ করি আপনার চাইতে বেশিই করি; কিন্তু সে কেবল তিনি অতুল কাব্য-প্রতিভার অধিকারী বলে। মুসলমানকে তিনি কোনোদিন আপন মনে করেন নি। তিনি মুসলমানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন।
অনিমা কখন যে ফিরে এসেছে আমরা কেউই লক্ষ্য করি নি; সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের বাদানুবাদ শুনছিল গভীর মনোযোগ দিয়ে। এবার সে বললো : গত দু’শ বছর আমরা এক বিদেশী প্রভুর দাসত্ব করেছি, একইভাবে সমানে লাঞ্ছিত হয়েছি, একই সাথে পাশাপাশি শত শত বৎসর বাস করেছি, পরস্পরের সুখ-দুঃখে অংশ নিয়েছি, তবু আমরা এক নই, এত বড় আশ্চর্য।
অনিমার বক্তব্যে যুক্তির চাইতে আবেগ বেশি, তাই তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারলাম না। তবু এক সময় বললাম : না, আমরা পরস্পরের সুখ-দুঃখে অংশ নেই নি। আমাদের মধ্যে সত্যকার সম্প্রীতিও কোনোদিনই ছিল না। আমরা কেউ কাউকে বিশ্বাসও করতে পারি নি। হিন্দুরা মুসলমান রাজত্বের তুলনায় বরঞ্চ বৃটিশ রাজত্বকেই কাম্য বলে মেনে নিয়েছে; স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র অকপটে সে-কথা স্বীকার করেছেন; এবং হিন্দুরা বৃটিশদের স্বাগতম করেছে বলেই এ দেশে বৃটিশ-রাজ সম্ভব হয়েছে। এরপর কোনো উন্মাদও সুস্থ বুদ্ধিতে বলতে পারবে না যে হিন্দু-মুসলমান এক জাতি।
অনিমা আবার বললো : তুমি আমার ভাই নও, এ কথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না।
—দেখ, ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রশ্ন তুলে কোনো বৃহৎ সমস্যার সমাধান হয় না। ফরাসি, জার্মান, ইংরেজ, মার্কিন এদের পরস্পরের বন্ধু সংখ্যা নিতান্ত কম হবে না, হয়তো প্রয়োজন হলে এক বন্ধু আর এক বন্ধুর জন্য প্রাণও দেবে; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তারা এক জাতিত্বের কথা চিন্তা করবে না। তাছাড়া পৃথক হলেই আমাদের শত্রুভাবাপন্ন হতে হবে, এমন কথা মনে করবার কোনো কারণই নেই। কায়েদে আযম বহুবার বলেছেন : Live and let live পাকিস্তান হবার পর দুই রাষ্ট্রের মধ্যে পরম মিত্র ভাব গড়ে তোলা হবে, কায়েদে আযম সে আশাই করেছেন।
—তোমাদের পাকিস্তানে হিন্দুদের কি দশা হবে?
—কি আবার হবে। তারা থাকবে। পাকিস্তানে সকলেরই স্থান হবে—হবে না কেবল রাষ্ট্রদোহীর, সে যেই হোক।
—দেখ শাকের, তুমি হয়তো তর্কে জিতছ, কিন্তু আমার মন বলছে তুমি ভুল করছ, ভুল বলছ। এ কখনো হয়েছে? একটা দেশকে দু’ভাগ করে দু’ রাষ্ট্র করবার কথা আগে কেউ ভেবেছে?
—বিশ্ব ইতিহাস আমার নখ-দর্পণে নয়, সুতরাং কখন কি হয়েছে না হয়েছে বলতে পারব না। তবে একটা কথা বলতে পারি; আগে যা হয়েছে চিরকাল তাই হতে থাকবে। আগে লোকে যা ভেবেছে চিরকাল তাই ভাবতে থাকবে, এ যদি হতো, তাহলে প্রগতি শব্দটির কোনো অৰ্থ থাকত না।
অনিমা তবু বললো :
—মুশতাক আর সেলিনাকে দেখ। তারাও তো মুসলমান। কোথায় পার্থক্য আমাকে বুঝিয়ে দাও।
চোখ তুলে এই ভাই-বোনকে দেখলাম। মুশতাকের পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। সেলিনার পরনে অবশ্যই শাড়ি; মাথার খোঁপায় বেলফুলের মালা জড়ানো; কপালে লাল টিপ। বহিরাবরণটাই যদি মিল আর গরমিলের মাপকাঠি হয়, তাহলে পার্থক্য নেই। তবু আমার দৃষ্টির সামনে মুশতাক কেমন সঙ্কুচিত হয়ে গেল। সেলিনাও তার চেয়ারে একটু নড়ে বসল।
ডি-কে এতক্ষণ নীরব ছিল,—এক প্রকার হিংস্র নীরবতা। এবার সে বললো : জবাব দিন। অমিল কোথায়? অবশ্য আপনার সঙ্গে কোনো প্রকার সামঞ্জস্য বা মিল আমরা দাবি করছি না। কিন্তু মুসলমান সমাজেও এখনো কোনো কোনো সুস্থ লোক আছেন যাঁদের সঙ্গে ওঠা-বসা করতে আমরা বিন্দুমাত্র অসুবিধা বোধ করি না।
এই বলে ডি-কে সেলিনার কাছে উঠে গেল। সেলিনা তাকে সহাস্যে সংবর্ধনা জানিয়ে পাশের চেয়ারটিতে বসতে অনুরোধ করল।
আমি জবাবে বললাম : আপনারা যাতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা বোধ না করেন সেই উদ্দেশ্যে এই সুস্থ মুসলমানগণ তাঁদের স্বকীয়তার সব চিহ্ন সচেষ্ট হয়ে বর্জন করে আসেন। মুশতাক আমার বন্ধু, তার সম্বন্ধে এর বেশি আমি কিছু বলতে চাই না।
এইবার মুশতাক আমার দিকে তাকালো। তার মুখ কালো হয়ে গেছে।
আমি তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আবার অনিমাকে বললাম :
—তাছাড়া কেবল বাইরের মিলটুকু দেখে সবসময় বিচার করা ঠিক নয়। চার্চিল আর রুজভেল্টের মধ্যেও কোনো অমিল আছে, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় না। অথচ একজন ইংরেজ এবং অপরজন আমেরিকান।
ডি-কে প্রস্তাব করল : মুশতাককেই প্রশ্ন করা হোক, কোনো পার্থক্য আছে বলে সে মনে করে কি না।
এবার মুশতাকের অন্ধকার মুখ আরো অন্ধকার হয়ে গেল। অনিমা একবার তার দিকে তাকিয়ে দেখল। সে কি মনে করল সেই জানে কিন্তু মুশতাককে প্রশ্নের জবাব দিতে পীড়াপীড়ি করল না। সে বরং বললো : এবার শেষ করতো তর্ক। মাথা ধরে গেছে। চলো কিছু খাওয়া- দাওয়া করা যাক।
সকলেই উঠে পড়লাম। মুশতাক কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে অনিমাকে ধন্যবাদ জানালো
খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে আমরা সকলেই বাইরে এসে চেয়ারে বসলাম। লোকের ভিড় আর তিক্ত তর্কের মধ্যে থেকে আমিও হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। এক সময় উঠে পড়লাম এবং নির্জন কোণে একটি গাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম। গাছের বিপরীত পার্শ্ব থেকে দু’জনের কথা বলার শব্দ ভেসে এলো। সেলিনা মুশতাককে বলছে : আজ তোমার বন্ধুর কীর্তি দেখে লজ্জায় মাথা তুলতে পারছি না।
মুশতাক জবাব দিলো : কেন? শাকের অন্যায় কিছুই বলে নি। যা বলেছে হক কথা বলেছে। ওর সৎ সাহস আছে, আমাদের নেই। আমরা সবকিছুই করি আমাদের স্কুল-কলেজের বন্ধুদের খুশি করবার জন্য।
সেলিনা আর কিছু বললো না। রাগে সেখান থেকে দ্রুত চলে গেল।
প্রায় ঠিক সেই মুহূর্তেই অনিমা আর সুনীল বিপরীত পার্শ্ব দিয়ে সেইখানেই উপস্থিত হলো। অনিমা বললো : শোনো শাকের! তোমার মতের সাথে আমার মতের মিল নেই। কিন্তু এ কথা আমি বলব তুমি তোমার বক্তব্য অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে নিবেদন করেছ। তোমাদের পাকিস্তান দাবির পিছনে যে কেবল নেতিবাচক বিতর্ক আর মনোমালিন্যই নেই, বরং তার চাইতে অনেক গভীর আর মৌলিক জীবনাদর্শের প্রশ্ন জড়িত আছে, সে কথা আগে আমার কোনোদিনই মনে হয় নি।
আমি আর কোনো মন্তব্য করলাম না। একে একে সকলেই আবার সেই কামরাটিতেই ফিরে এলাম।
আবার সেই একই তর্কের সূত্র ধরে সুনীল বললো : আমরা অতীতে ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই বাস করেছি, কখনো পৃথক হবার তো কথাও ওঠে নি
—পৃথক আমরা চিরকালই ছিলাম। রেল স্টেশনেও বহু নর-বারী একত্র হয়, এক সঙ্গে ওঠা-বসা করে, বাক্য বিনিময়ও হয় কিন্তু যে যার গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হবার পর কি কেউ কারো কথা মনে রাখে?
—উপমা তো আর যুক্তি নয়।
দেখুন, কতগুলো সত্য আছে, যা প্রমাণ করবার জন্য যুক্তি আবশ্যক হয় না। তাছাড়া এক বছর ধরে আমরা আর আমাদের নেতারা যুক্তি কি কম সরবরাহ করেছি।
সুনীল এবার অনিমারই কথার পুনরুক্তি করে বললো : আমি কিছুতেই মানব না যে আপনি আমার ভাই নন।
এ কথার আর কি জবাব সম্ভব? আবেগ যখন আলোচনার বুনিয়াদ হয় তখন তর্ক করা বৃথা। বরং জবাব দিতে গেলে অনেক সময় অসৌজন্যই প্রকাশ পায়। তাই আমিও বললাম : পিতৃ সম্পত্তি দুই ভাই ভাগ করেই নেয়। সৌভ্রাত্র আর সম্প্রীতি আছে বলেই কেউ কারো দাবি ছেড়ে দেয় না।
হঠাৎ ডি-কে হো-হো করে হেসে উঠল। সে কি দুর্নিবার দুর্বিনীত হাসি। তার হাবভাব দেখে আমরা সকলেই অনুমান করলাম, একবার তার হাসি থামলে সে একটা চিরস্মরণীয় মন্তব্য করবে। তাই কামরাসুদ্ধ লোক তার হাসি থামবার অপেক্ষায় বসে থাকলাম।
—ভারতবর্ষটাকে—হো হো হা হা হি হি—আপনি হি হি পৈতৃক সম্পত্তি হা হা হা—মনে করেন না কি—হো হো হো!
আমি সম্পূর্ণ শান্ত থাকলাম। আমার অধরের কোণে একটুখানি হাসির আভাস হয়তো দেখা গিয়ে থাকবে। মুশতাককে সম্বোধন করে বললাম : মুশতাক একটা সিগারেট দেতো রে।
মুশতাক দ্রুত একটা সিগারেট এগিয়ে দিল, দ্রুততর হস্তে সেটা ধরিয়ে দিল। ঘরসুদ্ধ লোক আমার উত্তর শুনবার জন্য নীরব, ডি-কে পর্যন্ত উৎসুক দৃষ্টিতে অপেক্ষা করছিল। ফাঁসির হুকুম দেবার পর বোধ করি জুরি এইভাবেই আসামির মুখভাব লক্ষ্য করতে থাকে।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে জবাব দিলাম। কবি যখন প্রিয়ার মুখের সঙ্গে চাঁদের তুলনা করেন, তখন চাঁদকেই প্রিয়া মনে করেন না কি!
ডি-কে অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে এক অপ্রত্যাশিত মন্তব্য করল : মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ না বলে আপনাদের বলা উচিত মুসলিম লীগ জিন্নাবাদ।
—আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠার আর সর্বজনমান্য নেতা সম্পর্কে আপনার উক্তি অমার্জনীয় রকম অশোভন আর অযৌক্তিক এইটুকু বলবার পর আপনার সঙ্গে আলাপ করবার আর কোনো স্পৃহা অবশিষ্ট নেই। শুধু একটি কথা বলব! ইতিহাস এক সময় এই রায়ই দেবে যে কায়েদে আযম এশিয়ার সর্বাপেক্ষা দূরদর্শী আর বিচক্ষণ নেতা। আমরা বেশ বুঝি, কায়েদে আযম আমাদের যে পরিমাণ উপকার করেছেন ঠিক সেই পরিমাপেই আপনাদের উষ্মার কারণ হয়েছেন।
ডি-কে আর একটি অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন করল : মুসলমানদের সম্বন্ধে হিন্দু লেখকরা কোথায় কি বিরূপ মন্তব্য করেছেন সব কি আপনার কণ্ঠাগ্রে?
—কণ্ঠাগ্রে থাকবার মতো কথা যে।
এবার সুনীল ডি-কে-কে এক সুপরামর্শ দিল : চলো হেঃ চলো ডি-কে সাহেব, নিচে চলো। গান-টান শোনা যাক।
বোমার মতো ফেটে পড়ে ডি-কে অপরিসীম রূঢ় কণ্ঠে ঝড়ের বেগে বলে গেল : যাও যাও। একজন নেড়েকে ডেকে এনে বাড়ির মেয়েদের মধ্যে ভিড়িয়ে দিতে তোমাদের লজ্জা করে না। যখন কাউকে নিয়ে ইলোপ করবে তখনই তোমাদের শিক্ষা হবে।
অনিমা ত্রস্ত হরিণীর মতো ভীত চকিত দৃষ্টিতে তৎক্ষণাৎ আমার দিকে একবার তাকালো! আমিও একবার তার দিকে তাকালাম। একটুখানি হাসতেও ভুলে যাই নি।
অনিমা তার মাথা আর দৃষ্টি দুই নত করে নিল।