উত্তম পুরুষ – ২২

বাইশ

টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে। আজ ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফি দেয়ার শেষ তারিখ। বিকেলবেলা প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীদের জন্য স্কুলের ছেলেরা এক বিদায় সভার আয়োজন করেছে। স্কুলের পিছনে খোলা মাঠটিতে একটি মঞ্চ তৈরি করা হচ্ছে—চেয়ার এনে বসানো হচ্ছে। ছেলেরা ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে।

বেশ দুঃখই হচ্ছিল। একটি অখ্যাত স্কুলের ছেলে আমরা। দু’-একজন ছাড়া ফাইনাল পরীক্ষায় কারোই ফলাফল তেমন উল্লেখযোগ্য হবে না, তাও জানতাম। তবু এই কটি বছর ধরে আমরা প্রতিদিন এই স্কুলের চারটি দেয়ালের মধ্যে যে-বিচিত্র প্রণালিতে জীবনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম—সেই জগৎটিকে চিরকালের মতো পিছনে ফেলে রেখে আসতে কষ্টই হচ্ছিল।

টেস্ট পরীক্ষায় শেখর হয়েছে ফার্স্ট, আমি সেকেন্ড। অফিস রুমের সামনে বড্ড ভিড়— ছেলেরা ফি দিচ্ছে। আমিও কিউতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই এক নতুন নিয়ম হয়েছে—সব কিছুতেই ‘কিউ’ করা। ‘র‍্যাশন শপ’ থেকে শুরু করে ‘বাসস্ট্যান্ড’ পর্যন্ত সবকিছুতেই ‘কিউ’। যুদ্ধ বাধবার পর থেকেই এই নিয়মটা চালু হয়েছে। নিয়মটা অবশ্য ভালোই—–সকলেরই সুবিধা।

হঠাৎ এক সময় চোখে পড়ল, শেখর এক পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, মুখ অন্ধকার। কিউ ছেড়ে আমি তার কাছে এগিয়ে এলাম।

—কি রে! কি হলো তোর? চুপচাপ দাঁড়িয়ে কেন? ফি দিবি না?

—না। আমার আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না।

—সে কি! কেন?

—পরশুদিন আমার এক ভাই হয়েছে। বাড়িতে যা টাকা ছিল খরচ হয়ে গেছে। ফি দেয়ার টাকা নেই।

ফি দেয়ার টাকা নেই। শেখরের মতো ছেলে পরীক্ষা দিতে পারবে না।

শেখর আবার বললো : মার শরীর এমনিতেই ভেঙে পড়েছে। আমি পরীক্ষা দিতে পারব না বলে কান্নাকাটি করে শরীর আরো নষ্ট করছেন। ছোট ভাইটির গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইছিলেন। যত রাগ তারই ওপর।

—থাকগে সে সব কথা। তোর কাছে টাকা আছে কত?

—সাড়ে সাত টাকা আছে।

—লাগবে তো সবসুদ্ধ পঁয়ত্রিশ। তুই এখানেই দাঁড়িয়ে থাক। আমি দেখি কি করতে পারি। খবরদার, কোথাও যাস নে! আমি যতক্ষণ না আসি, দাঁড়িয়ে থাকবি। যতই দেরি হোক…

কাঞ্জিলাল, শিশির প্রমুখের অবস্থা ভালো। তাদের কাছে গিয়ে সবকিছু খুলে বললাম : শেখর পরীক্ষা দিতে পারবে না, যদি না আজকেই কিছু টাকা সংগ্রহ করতে পারি।

কাঞ্জিলাল আর শিশির একটু গম্ভীর হলো, মুখ অন্ধকার করলো, তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।

টাকা কোথায় পাব! দুঃখিত।

কাঞ্জিলালের কাছে টাকা ছিল। সবসময়ই থাকে। স্কুলের ছাত্র হলে কি হবে, টাকা সবসময়ই থাকে। বড় বাজারে কাঞ্জিলালের বাবার বড় দোকান আছে। বাপের এক ছেলে। ওদের বংশে আর কেউ লেখাপড়া করে নি। সে যখন যা চাইত, তাই পেত। দোকানে গিয়ে ক্যাশ খুলে যখন-তখন টাকা নিয়ে আসত।

শেখরকে উদ্ধার করবার জন্য যে সে টাকা দেবে না, আমি জানতাম। বস্তুত নিজের ক্ষতি করে কাউকে উদ্ধার করবার কথা সে ভাবতে পারে না, তবু তারই কাছে ছুটে গিয়েছিলাম- ছুটে যাবার মতো জায়গা বেশি ছিল না, তাই।

কাঞ্জিলাল বহুক্ষণ ধরে আমার পকেটে গোঁজা কলমটির দিকে ফিরে ফিরে দেখছিল। এক সময় বললো : কলমটি কোথায় পেলিরে! বেশ সুন্দর তো! বিক্রি করবি?

কাঞ্জিলালের ব্যবহারে আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। জবাব দিলাম : ওসব বিক্রি- টিক্রির পেশা আমাদের আসে না। ওসব বড় বাজারেই শোভা পায়।

সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে কাঞ্জিলাল বললো : পরের কাছ থেকে ভিক্ষে করে সাহায্য করার মধ্যে বাহাদুরি কিছুই নেই, ও সবাই পারে। নিজের ট্যাকের পয়সা খরচ করে সাহায্য করলে তবে বুঝি, হ্যাঁ মরদ বটে।

—আমার কাছে টাকা থাকলে তোর মতো ছুঁচোর কাছে আসতাম না। তাছাড়া বাহাদুরি করবার কোনো উদ্দেশ্যই আমার নেই।

—টাকার পথ তো বাতলে দিলাম। কলমটা বিক্রি করলেই টাকা আসে।

—কত দিবি?

—পনের টাকা দিতে পারি।

মাত্র পনের টাকা! এরকম একটা কলমের দাম কত জানিস?

—অত কথা শুনতে চাই না। দিবি তো বল।

তখন যুদ্ধের বাজার। একে তো কলম পাওয়াই যায় না—তার ওপর লাইফ-টাইম শেফার্স। আশি নব্বুই টাকা দিয়েও কলম মিলবে না। একটু ঘোরাঘুরি করলেই বেশি দাম পাওয়া যায়। কিন্তু সময় কোথায়? আজকেই ফি দেয়ার শেষ দিন।

—আচ্ছা, তাই দে।

কলমটা বিক্রিই করে ফেললাম। সেলিনার কলম সেলিনাকেই ফেরত দেব একেবারে স্থির করে ফেলেছিলাম; কিন্তু ঘটনাচক্রে কিসে যে কি হয়ে গেল বুঝবার আগেই কলমটা হাতছাড়া হয়ে গেল।

—তাহলে বিক্রি-টিক্রির পেশা যে একেবারেই আসে না তা নয়। ঠ্যাকা পড়লে আসে— পকেটে কলমটা গুঁজতে গুঁজতে কাঞ্জিলাল বললো।

—কোথায় আর আসে! তোদের দোকানে কলমটা কি আর নব্বুই একশ’ টাকায় বিক্রি হতো না। একে তো বড় বাজার তার ওপর কালো বাজার।

এই বলে আমিও পনেরটি টাকা পকেটে গুঁজলাম। তারপর দু’জন দু’দিকে চলে গেলাম। শেখরকে আমি অপেক্ষা করতে বলে এসেছিলাম। ফিরে এসে দেখলাম সে সেই একইভাবে একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটি তার অফিস-রুমের দিকে নিবদ্ধ যেখানে ছেলেরা ফি দিচ্ছে; কিন্তু তার চোখ দুটি যে কিছু দেখছে মনে হয় না। শেখর এমনই স্থির উদাসীন, সমস্ত সুখ-দুঃখানুভূতির অতীত যে রক্তে মাংসে গড়া মানুষ বলেই তাকে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, একটা পাষাণ মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তারই পায়ের কাছে একটু ছায়া দেখে একটি বিড়াল নিরুপদ্রব শান্তিতে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝিমুচ্ছে। শেখরের কাছ থেকে যে কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই, বিড়ালটিও টের পেয়েছে।

—রোদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

—তুই যে বললি দাঁড়িয়ে থাকতে।

—গাধা কোথাকার। রোদ থেকে সরে ছায়া দেখে দাঁড়াতে পারিস না! তারপর, শোন! সুখবর আছে। পনেরটি টাকা যোগাড় হয়েছে।

—আমিও আরো আড়াইটি টাকা যোগাড় করেছি।

—তুইতো দেখি মুনি ঋষি হয়ে গেছিস। আমি ছুটোছুটি করে হয়রান হয়ে গেলাম, আর তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আকাশ থেকে টাকা পেড়ে আনলি?

—আকাশ থেকে না রে। দেউকী দিয়ে গেল।

—দেউকী? স্কুলের দারোয়ান তোকে টাকা দিয়ে গেল। সে জানল কি করে তোর টাকার দরকার?

—আমাকে এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে জিগ্যেস করল, সবার মতো আমিও ফি দিচ্ছি না কেন? তুই তো জানিস, ও কত দিনের পুরোনো লোক, ও সব জানে। আমাকে ছেলেবেলা থেকে দেখেছে, আমিও তাকে সব খুলে বললাম।

—সব? তোর ভাই হবার কথা, তোর মার কথা, সব বললি? তোর লজ্জা করল না?

শেখর কিছু বললো না। মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকল। রাগে আমার সমস্ত গা জ্বালা করছিল।

—তোর লজ্জা-শরম কিছু বাকি নেই। একটা দারোয়ানের কাছ থেকে তুই টাকা নিস! সে ব্যাটা গেছে কোথায়?

—সে তার বাড়ি গেছে! তার কাছে আরো পাঁচটি টাকা আছে, তাই আনতে গেছে। তোর মতো সেও আমাকে এখানে অপেক্ষা করতে বলে গেছে।

শেখর অপরাধীর মতো ম্লান সঙ্কোচে কোনোমতে কথাগুলো উচ্চারণ করল। শেষের দিকে তার গলা ভেঙে এলো। তবু বললো : লজ্জা করা কি আর আমার সাজে। আমি পরীক্ষা দিতে না পারলে মা মরেই যাবে। ছোট ভাইটিকেও গলা টিপে মেরে ফেলবে। তুই জানিস, আজকাল আমাদের ভালো করে খাওয়া জোটে না! যুদ্ধ যবে থেকে শুরু হয়েছে, চাল-ডালের দাম এত বেড়ে গেছে, আমরা দু’বেলা পেট পুরে খেতে পাই না। দেশে একটু বা জমিজমা আছে তার থেকেও কিছু পাই না। দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। মা-ও একবেলা খায়। মার কষ্ট দেখলে বুক ফেটে যায়। মনে হয় ছুটে যাই, ভিক্ষে করে কিছু চাল-ডাল নিয়ে আসি। শেষ পর্যন্ত পারি না। লজ্জায় মাথা কাটা যায়।

অবাক হয়ে যাই। শেখরের চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়ল না। দুপুরবেলার রোদের মতো চোখ দুটি জ্বলতে লাগল।

—চুপ চুপ। আশেপাশে অনেক লোক আছে। তুই এখানেই দাঁড়িয়ে থাক। আমি একটা ব্যবস্থা করবই।

—আমার আর পরীক্ষা দেওয়া হলো না ভাই।

–হবে রে হবে। তুই এখানেই থাক, আমি এলাম বলে।

এই বলে আমি হনহন করে বেরিয়ে এলাম।

এলাম তো বটে, কিন্তু যাব কোথায়? গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে খানিকক্ষণ ভাববার চেষ্টা করলাম।

বেলা তখন প্রায় দ্বিপ্রহর। সেলিনা এইমাত্র বই ছেড়ে উঠল। তারও আই.এ পরীক্ষা এসে গেল প্রায়। ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে তেলের শিশিটা তুলে নিল, ছিপি খুলল, তালুর ওপর একটুখানি তেল ঢালল। তারপর একহাতে খোঁপা খুলে, দুই হাত দিয়ে মাথায় তেল ঘষতে যাবে, এমন সময় আমাকে দেখতে পেল।

—হঠাৎ এ সময়?

—আমার কিছু টাকা দরকার।

এক মুহূর্ত সেলিনা বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর তার ওষ্ঠাধরে এক বিচিত্র হাসির তরঙ্গ দেখা গেল—তাও এক মুহূর্তের জন্যই।

অবিচলিত হাত দিয়ে সে বোতলের ছিপি বন্ধ করল। বোতলটি টেবিলের ওপর যথাস্থানে রেখে দিল, তারপর আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সে অল্পকাল কি যেন চিন্তা করল। দেয়াল ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া কামরা নিস্তব্ধ।

এক সময় সেলিনা ফিরে দাঁড়ালো। এগিয়ে এসে জিগ্যেস করল : টাকা? কি করবে টাকা?

—দরকার আছে।

—শুনিই না কি দরকার।

—আছে একটা দরকার।

—আচ্ছা বাবা আচ্ছা। আমি আর প্রশ্ন করব না।

তারপর আবার কোনো কথা নেই।

এক সময় আমার কানের ওপর মুখ নাবিয়ে এনে সেলিনা বললো, ফিসফিস করে :

—দেব। কিন্তু তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। সব কথা। শুনবে তো?

সেলিনার কণ্ঠস্বর সাপের নিশ্বাসের মতোই হিসহিস করে উঠল।

—শুনব। বলেই টাকা নিয়ে আমি সেখান থেকে পালালাম।

ফি দেয়ার দিন শেখর কিছুতেই ছাড়ল না। তাদের বাড়ি ধরে নিয়ে এলো। বেড়া দেওয়া দুটি ঘর। সামনে একটুখানি উঠান, তাও বেড়া দিয়ে ঘেরা। লাউ আর তরি-তরকারির কিছু কিছু গাছ, অনেকগুলো হাতের যত্নের পরিচয় দিচ্ছে

শেখর বাইরের ঘরে আমাকে বসিয়ে রেখে অন্দরে চলে গেল। একটু পরই ফিরে এসে বললো : চল, ভিতরে চল। মা ডাকছেন।

এবার আমরা বেড়ার দ্বিতীয় ঘরটির সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটা মাদুরের ওপর ছেঁড়া বালিশে মাথা রেখে শেখরের মা শুয়েছিলেন। তাঁর কোলের কাছে শেখরের “ছোট ভাই”।

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম।

শেখর আমার সমবয়সী। তার মার একটা ছবি আমি মনে মনে কল্পনা করে নিয়েছিলাম— আমার আত্মার ছবির সঙ্গে কোথায় যেন তার মিল ছিল।

কিন্তু দৃষ্টির অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার কল্পিত ছবির কোনোই মিল নেই।

শেখরের মার বয়স কম, অবিশ্বাস্যরকম কম, অন্তত দেখে তাই মনে হয়। গায়ে একটা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি; কিন্তু সেই দীন বেশেই তাকে রানীর মতো সুন্দর লাগছিল।

আমি ঘরের ভিতরে প্রবেশ করছিলাম। তিনি ইশারা করে নিষেধ করলেন। বললেন : না বাবা, তোমাকে ভিতরে আসতে বলব না। এক বাটি চা পর্যন্ত দিতে বলব না—বলতে পারি না। কিন্তু তোমার মাথার ওপর মার আশীর্বাদ রইল। দেখবে তুমি বড় হবে, অনেক বড় হবে। অবাক হবার আরো বাকি ছিল। একটি চৌদ্দ পনের বছরের মেয়ে, অবিকল শেখরের মায়ের মতো দেখতে, একটা পেয়ালায় গরম দুধে ফুঁ দিতে দিতে ঘরে প্রবেশ করল। পেয়ালাটি মার শয্যাপার্শ্বে রাখল। দুটি চোখ তুলে একবার আমাকে দেখল।

আমি বেরিয়ে এলাম। শেখর আমার পিছনে পিছনে বেরিয়ে এলো। বললো : ঐ মেয়েটি আমার বোন। আমার পিঠাপিঠি।

সারাটা দিন বড়ই উত্তেজনায় কেটেছে। সারাটা পথ আমার মাথার মধ্যে নানান চিন্তা আনাগোনা করছে—কানের মধ্যে নানা কথা বাজতে থেকেছে। সেলিনার কথা “আমার সব কথা শুনতে হবে। শুনবে তো?” বারবার ভাবতে চেষ্টা করলাম, কি সে কথা, কি তার রহস্য, আবার শুনতে পাই শেখরের মার কণ্ঠস্বর : “এক বাটি চা-ও দিতে বলব না—বলতে পারি না!”

কেন এক পেয়ালা চা-ও দিতে বলতে পারেন না? তাঁরা গরিব বলে? আমি মুসলমান বলে? নিশ্চয়ই আমি মুসলমান বলেই। এই সময় আর একদিনের কথা মনে পড়ল। সেদিন কি কারণে স্কুল হঠাৎ ছুটি হয়ে গিয়েছিল। আমি, শিশির আর মহেন্দ্র নামে একটি ছেলে গল্প করতে করতে শিশিরদেরই বাড়ি পৌঁছে গেলাম। রৌদ্রে হাঁটবার পর আমাদের সকলেরই ভয়ানক তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল। মহেন্দ্ৰ শিশিরকে বললো : “এক গ্লাস জল খাওয়া তো রে!” তৎক্ষণাৎ ভিতর থেকে কাঁসার গ্লাসে এক গ্লাস পানি এলো। এবার আমি বললাম : “আমিও খাব।” হঠাৎ শিশিরের মুখ শুকিয়ে গেল—আমার কণ্ঠের চাইতেও শিশিরের মুখ অধিক শুষ্ক মনে হচ্ছিল। সে অত্যন্ত বিব্রত হয়ে আমতা আমতা করে কোনোমতে বললো : “জল কি খাবি! চল, তোকে ভালো জিনিস খাওয়াব। পাশের পানের দোকানে চল, বোতল থেকে লেমনেড খাবি।”

অকস্মাৎ আমারও দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি বললাম : “থাক। লেমনেড খেতে আর ভালো লাগবে না।” বলেই সেদিন বিদায় নিয়েছিলাম।

তেমনই কোনো বাধা নিশ্চয়ই শেখরের মায়েরও স্বতঃস্ফূর্ত স্নেহশীলতার অথবা কৃতজ্ঞতাবোধের—উৎস মুখ রুদ্ধ করে দিয়েছিল।

যখন বাড়ি ফিরলাম তখন ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় আমি কাতর।

আম্মা বারান্দার একপাশে চুপচাপ বসেছিলেন। এমনিতেই তিনি গম্ভীর, আজ আরো গম্ভীর।

—ফি দিলি?

—দিলাম। বড্ড খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দাও।

আঁচল থেকে আম্মা এক আনা পয়সা বের করে দিলেন।

—যা বাবা। আজকের মতো কিছু মুড়ি-মুড়কি কিনে খেয়ে নে।

—মুড়ি-মুড়কি? মুড়ি-মুড়কি দিয়ে দুপুরের খাবার?

—হ্যাঁ বাবা। আজকে আর চুলো ধরে নি I

—চুলো ধরে নি? কেন ধরে নি শুনি?

—বাজারে কয়লা পাওয়া যাচ্ছে না। যবে থেকে লড়াই শুরু হয়েছে একটা না একটা হাঙ্গামা লেগেই আছে।

—তুমি কিছু খেয়েছ?

—হ্যাঁ খেয়েছি। বকাস নে যা।

–উঁহু। তুমি খাও নি। তোমার মুখ দেখেই টের পাচ্ছি।

—ভারি লায়েক হয়েছ তুমি, তাই না! মুখ দেখেই টের পাচ্ছ?

আম্মার প্রশ্নের কোনো জবাব দিলাম না। দেয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আম্মার পায়ের কাছে বসে পড়লাম। কেউ কোনো কথা বলি না। এইভাবেই অনেকটা সময় কেটে যায়। আমিই এক সময় বললাম : আমি আর পড়ব না। চাকরি করব।

এত দুঃখেও আম্মার মুখে হাসি এলো। চেয়ে চেয়ে তাঁর এই হাসিই দেখতে লাগলাম। তাঁকে যেন কিছু স্পর্শ করে না—কোনো দৈন্যই যেন তাঁকে ম্লান করতে পারে না।

—তোকে চাকরি দেবে কে শুনি?

আমি এবারও কোনো জবাব দিলাম না। কিন্তু আমার দুটি ওষ্ঠের এক বিবিক্ত ভঙ্গিমা এই বলতে চাইল, চাকরি সংগ্রহের মতো অনায়াসসাধ্য কাজ আর কিছুই নেই।

—কি রে, কথা বলছিস না যে।

—চাকরির অভাব। যুদ্ধের সময় কত জায়গায় সেধে লোক নিচ্ছে। ইচ্ছে করলে কালকেই ‘এ-আর-পি’তে জয়েন করতে পারি।

এতক্ষণ আম্মার আচরণের মধ্যে কিছুটা প্রচ্ছন্ন কৌতুক ছিল। মুখে যতই লম্ফঝম্প করি, চাকরির বাজার বড়ই কঠিন তিনি তা জানতেন। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে চাকরি যে বাস্তবিকই সস্তা হয়ে গেছে আমার কাছ থেকে তারই ইঙ্গিত পেয়ে তিনি শঙ্কিত হয়ে উঠলেন।

—ছিঃ বাবা। ও-সব কথা মনে আনতে নেই। যুদ্ধ আজ আছে কাল নেই। যুদ্ধের চাকরিও আজ আছে কাল নেই। তখন করবি কি? লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে এক্ষুণি কাজে ঢুকলে তখন পথে বসবি। এখন মন দিয়ে পড়াশোনা কর। যতই কষ্ট হোক, আর কোনো কথাই ভাববি না। লেখাপড়া কর, তারপর যদি তোকে মোটও বইতে হয়, তার মধ্যেও ইজ্জত আছে।

—আচ্ছা আচ্ছা, সে হবেখন।

এই বলে উঠে পড়ি।

বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পেট খালি থাকলে পোড়া চোখে ঘুমও আসতে চায় না। একটু পরেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। গোসলখানায় গিয়ে ঢুকলাম। কাপড় ছেড়ে ভালো করে মাথায় পানি ঢালতে লাগলাম।

—তুই করছিস কি! অত পানি খরচ করিস নে। অত পানি পাবি কোথায়?

কি জ্বালা। একটু আয়েস করে গোসল করব সে উপায়ও নেই।

যুদ্ধের পর থেকে পানি সরবরাহ পর্যন্ত কমে গেছে। তাড়াতাড়ি গা মুছে কাপড় পরে গোসলখানা থেকে বেরিয়ে আসি।

—এই এলি, আবার যাচ্ছিস কোথায়? একটু সবুর কর, দেখি রান্নার ব্যবস্থা করতে পারি কি না।

—আমি এই এলাম বলে।

এই বলে বেরিয়ে পড়লাম। আধঘণ্টা পর একটা ঠোঙায় করে কিছু খাবার কিনে বাড়ি ফিরলাম। ঠোঙাটা আম্মার সামনে তুলে ধরলাম।

—হালুয়া-কচুরি কোথায় পেলি?

—কোথায় আবার পাব! কিনে আনলাম।

আম্মাকে আর কোনো প্রশ্ন করবার অবসর না দিয়েই তাঁর হাত ধরে দু’জনেই মাটিতে বসে পড়লাম।

—–এই নাও, খাও।

—তুই খা, আমি খেয়েছি।

—ওসব চালাকি চলবে না। তুমি খাও নি আমি জানি।

—আচ্ছা বেশ। আগে তুই খেয়ে নে। আমার জন্য একটু রেখে দিস। আমি হাতমুখ ধুয়ে এলাম বলে।

কলম-বিক্রি এবং “সব করব” এই প্রতিশ্রুতি-লব্ধ উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে কেনা কচুরি খেতে বসে গেলাম।

আম্মা একটু পরই আঁচলে হাতমুখ মুছতে মুছতে ফিরে এলেন। সারাদিনের অনাহারে ক্ষুৎপিপাসাতুর মুখ এখন অনেকটা প্রসন্ন-উৎফুল্ল। ঠোঙাটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিই।

—তুই খেয়েছিস?

—না খেয়েই তোমাকে দেব, আমাকে অমন মহাপুরুষ পেয়েছ!

—আচ্ছা বীর পুরুষ, দে!

আম্মা ঠোঙাটা হাতে নিলেন।

এমন সময় কোথা থেকে হঠাৎ মেজ ভাই উপস্থিত হলেন। এক নিমেষে আম্মার হাত থেকে ঠোঙাটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করে দিলেন। আমি বা আম্মা কেউ বাধা দিলাম না।

এই মেজ ভাই কিছুদিন থেকে আজব বেয়াড়া হয়ে গেছেন। কারো কথা শুনবেন না, কারো মানা মানবেন না। মাথাটা বেজায় গরম। একটা ঝড়ো হাওয়ার মতো সবসময় ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়াবেন—হাতের কাছে যখন যা পাবেন তাই তছনছ করে দেবেন। লেখাপড়া সব ছেড়ে দিয়েছেন। হয় সারাটি ঘর দাবড়ে বেড়াবেন নয় বিছানায় গুম হয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবেন, দিনের পর দিন কোনো কথাই বলবেন না। মুখে একটি কথা নেই, চোখে পলক নেই, সারাটি দিন উন্নেত্র হয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। বহুদিন পর যখন মৌনভঙ্গ হবে, তখন তাঁর প্রথম বাণী: ‘আমি ভীম ভাসমান মাইন’ সবাই বলাবলি করেন : মেজ ভাইয়ের মাথাটাই না কি গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

মেজ ভাই বিনা রণেই জয় করলেন—এটা তাঁর মনঃপূত হলো না। আম্মার ভাগের হালুয়া- কচুরি কিছুটা খেয়ে নিয়ে তাঁর কি মনে হলো—ঠোঙাটা আম্মাকে ফেরত দিলেন।

আম্মা বললেন : তুই খা না।

বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে উত্তর এলো : না তুমি খাও। আমি খেয়েছি। তুমি পয়সা দিয়েছিলে।

—তাতে কি বাবা। তুই খা। তোর পেট ভরে নি।

–না। তুমি খাও বলছি।

এমন সময় হঠাৎ মেজ ভাই আম্মাকে দুই হাত দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে নাচতে শুরু করে দিলেন।

—আরে থাম থাম। করছিস কি। পড়ে যাব যে।

যেমন হঠাৎ কোলে তুলে নিয়েছিলেন তেমনি অকস্মাৎ কোল থেকে নাবিয়ে দিয়ে কঠোর কণ্ঠে তিনি আম্মাকে প্রশ্ন করলেন : তোমাকে তো লোক ভালোই মনে হয়। কিন্তু তোমার ভাইটি অমন চামার কেন?

—ছিঃ বাবা ছিঃ। তোর মুরুব্বি না! লোকে বলবে কি?

মেজ ভাই অনেকক্ষণ আম্মার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর গালে একটা চুমু দিয়ে যেদিক দিয়ে এসেছিলেন সেদিকেই চলে গেলেন। কেবল সিগারেটের ধোঁয়ার মতো মুখ থেকে একটু পরপর বেরুতে লাগল : ভীম ভাসমান মাইন।

হালুয়ার ঠোঙাটা যে কখন মাটিতে পড়ে গেছে কেউ খেয়াল করে নি। কয়েকটি কাক তারই ভাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি মারামারি করছিল।

আম্মা একটা ছোট্ট নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

আমরা ম্যাট্রিক পাস করলাম। পরীক্ষার ফলাফল মোটের ওপর ভালোই হলো। মুশতাক আর কাঞ্জিলাল প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলো, আমি আর শেখর রিপন কলেজে। আমি আর মুশতাক আর্টস। শেখর আর কাঞ্জিলাল সায়েন্স। শিশির আর বদ্রি গেল সেন্ট জেভিয়ার্সে, উভয়েই আর্টস। মফিজ গেল ইসলামিয়া কলেজে, সেও আর্টস।

সেলিনা আর অনিমাও আই.এ পাস করল। সেলিনা নিল ইংরেজিতে অনার্স, অনিমা ইকনমিকসে—উভয়েই বীটন কলেজেই থেকে গেল।

দ্রুত সময় কেটে যেতে লাগল। যুদ্ধ ঘরের কাছাকাছি চলে এলো, আর দুর্ভিক্ষ দ্বারে দ্বারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *