উত্তম পুরুষ – ২০

বিশ

সবে ভাত খেয়ে উঠেছি; ভকত-এর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে একটা পান পুরে, ধারে একটা সিগারেটও কিনে নিয়েছি।

—তাড়াতাড়ি উসুল করে দেবেন বাবু। আমি গরিব মানুষ—পয়সা পাব, তবে আবার মাল আনব।

—হবে রে হবে। ব্যস্ত হতে হবে না তোকে।

রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে আর ভয় লাগে না। কি আর হবে। শুনেছি বড় ভাই, মেজ ভাই এঁরাও অল্প বয়সেই সিগারেট ধরেছেন। সামনাসামনি পড়ে গেলে লুকিয়ে ফেললেই হবে; কিন্তু সত্যিই যখন সামনাসামনি পড়ে যাই তখন ভয়ে হাত-পা-বুক সব এক সঙ্গে কাঁপতে থাকে। একবার বড় ভাইয়ের সামনে পড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি আর কোনো উপায় না দেখে পকেটের মধ্যেই জ্বলন্ত সিগারেটটা পুরে ফেলেছিলাম।

ভরা পেটে এক মুখ ধোঁয়া ছাড়তে কিন্তু বেশ লাগে।

এমন সময় কোথা থেকে মুশতাক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো।

হাঁফাতে হাঁফাতে বললো : শাকের শোন। তোর সাথে কথা আছে।

—বলেই ফেল।

—তুই তো খেলাধুলা ছেড়েই দিয়েছিস, যদিও খেলতিস তুই কড়া; কিন্তু আজ আমার না গেলেই নয়। নারকেলডাঙ্গায় একটা কাপ ফাইনালে আমাকে খেলতেই হবে। এদিকে বুবু ধরেছে, তার সঙ্গে তার কলেজ যেতে হবে সন্ধ্যাবেলা। তাদের কি একটা ভ্যারাইটি শো আছে। আম্মা কিছুতেই একা যেতে দেবেন না। তুই যা না ভাই। তা না হলে আমার নারকেলডাঙ্গা যাওয়া হবে না।

—আমি যাব?

—লক্ষ্মী ভাইটি আমার!

—তুই যে দেখি মেয়ে মানুষের মতো কথা বলতে শুরু করে দিলি!

তারপর আর কোনো কথার অপেক্ষা না করে মুশতাক এক রকম জোর করেই আমাকে ধরে নিয়ে চলল।

—একটু দাঁড়া রে বাবা। এইভাবে কোথাও যাওয়া যায়! দেখছিস না কাপড়-চোপড়ের ছিরি।

—কিসসু লাগবে না। তুই আয় তো।

বাড়ি পৌঁছেই মুশতাক একটা কিট ব্যাগে খেলবার বুট আর জামা-কাপড় দ্রুত হাতে পুরে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালালো। আমাকে কোনোমতে এখানে উপস্থিত করেই তার কর্তব্য শেষ। মুশতাক যে-ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল, সেলিনার চোখ-মুখে কোথাও তার সমর্থন নেই। মনে হলো মাতা-পুত্রীর মধ্যে একটা বচসাও হয়ে গেল।

—কেন, আম্মা আমি কি একা যেতে পারি না।

—না। একা যাওয়া তোমার হবে না। দিনকাল ভালো নয়। ফিরতে কতো রাত হবে কে জানে! বাড়ির গাড়িও সার্ভিসিংয়ে গেছে। যেতে হলে শাকেরে সঙ্গে যাও।

—এমন জানলে আমি যেতামই না; কিন্তু কথা দিয়ে ফেলেছি। সেলিনা ঘোরতম অনিচ্ছায় সাজতে চলে গেল। একটু পরই তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলো। আমি তখনো সেই একইভাবে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাকে একনজর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সেলিনা আরো বেঁকে বসল।

কন্যার মনের কথা বুঝতে পেরে মাতা বললেন : শাকের নাও নাও, তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নাও। এই যে তোমার কাপড়।

আমি যেন একটা পুতুল। সকলেরই ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম আছে, আর আমার যেন ইচ্ছা- অনিচ্ছা বলে কোনো বস্তুই থাকতে পারে না।

—আমি কোথাও যাব না।

সেলিনা আর চাচি উভয়েই হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

সেলিনাই প্রথমে বললো : যাই আমি কাপড় ছাড়ি গে। কাউকে খোশামোদ করতে পারব না।

—তুই কেমন মেয়েরে সবার যেন মাথা কিনে নিয়েছিস। মুখে যদি একটা মিষ্টি কথা কেউ কখনো শুনেছে।

সেলিনা তেমনি দাঁড়িয়ে থাকল। সরবে বেশ পরিবর্তনের ঘোষণা সত্ত্বেও পরিকল্পনা কার্যকরী করবার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। বেশ বুঝতে পারছিলাম, কলেজের ফাংশনে তাকে যেতেই হবে। সুতরাং আমিই বেশ পরিবর্তন করতে চলে গেলাম।

যাবার আগে চাচি কতগুলো খুচরা আনি-দুয়ানি হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন : তুমি তো আর সেলিনার কাছে পয়সা চাইবে না। এগুলো রেখে দাও। ট্রামের ভাড়া দেবে।

সেলিনা বলে উঠল : আম্মা, আনি-দু’আনিগুলো ভালো করে দেখে দিও, ট্রামে আবার অচল না বেরোয়।

চলতে শুরু করেছিলাম, কি হলো আর যেন পা উঠতে চায় না। তবু এগিয়েই গেলাম। দাঁড়িয়ে থাকলাম না।

ট্রামে আর কোনো কথা হয় না। একেবারে সামনের সিটে দু’জন বসেছি। বিকেলবেলার রোদ সেলিনার চোখে মুখে খোঁপায় আবিরের রঙ ছিটিয়ে দিচ্ছে। পথে লোকজন, গাড়ি-ঘোড়া সবকিছুই আছে; কিন্তু এই সময়টায় কোলাহল কেমন যেন স্তিমিত হয়ে আসে। দিন শেষের লগ্নটিতে অনেকটা অকারণেই সমস্ত মন বিষাদে ভরে যায়।

সামনের খোলা জানালা দিয়ে দমকা বাতাস আসে—উভয়কেই স্পর্শ করে যায়। দামি সেন্টের দুর্লভ সুগন্ধ নাকের চারপাশে ভ্রমণের মতো ঘুরে বেড়াতে থাকে। পার্শ্ববর্তিনীর দু’-একটি চূর্ণ কুন্তল উড়ে এসে বসে কখনো নাকের কখনো চোখের কখনো বুকের ওপর ফড়িংয়ের মতো।

কলেজে পৌঁছে আমি একেবারে দমে গেলাম। বীটন কলেজ, মেয়েদের অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অতিথি-অভ্যাগতরা প্রায় সকলেই বিদ্যায়-আভিজাত্যে সব দিক দিয়ে আমার চাইতে বড়! এত দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের মুখোমুখি হয়ে আমার অন্তরাত্মা শুষ্ক তৃণের মতো নিষ্প্রাণ হয়ে এলো। আমি হয়তো সেলিনাকে পৌঁছে দিয়েই বাড়ি ফিরে আসতাম। কিন্তু কত রাত্রে উৎসব শেষ হবে জানি না। একা এতটা পথ সেলিনার পক্ষে যাওয়া সত্যিই নিরাপদ নয়। তাই থাকতেই হলো।

কিন্তু একটু পরেই সব ভুলে গেলাম। মঞ্চের আলোকসজ্জা, পাত্র-পাত্রীর রূপসজ্জা, নাটকের ঘটনাচক্রের উত্থান-পতন, সঙ্গীতের আবেদন এইসব কিছু মিলে অন্য সবকিছুরই অস্তিত্ব ভুলিয়ে দিল—এমনকি সেলিনার অভিভাবক হিসেবে আমার কর্তব্য পর্যন্ত।

অবশ্য একটু পরই লক্ষ্য করলাম, সেলিনা কেমন উসখুস করছে। শুধু মঞ্চের ওপর তার চোখ নেই, আর সব দিকেই আছে। অভিনয় চলছে বলে মঞ্চের আলোগুলো ছাড়া আর কোনো আলোই জ্বলছে না। তাই দর্শকদের আসনগুলো অন্ধকারে ডুবে আছে। তবু সেই আধো-অন্ধকারেই এক সময় দেখলাম, সাদা প্যান্ট আর হাফ শার্ট পরা এক সুন্দর স্বাস্থ্যবান যুবক সেলিনার পিছনে এসে দাঁড়ালো। একটি আঙুল দিয়ে সেলিনার কাঁধ স্পর্শ করল; দুই ঠোঁটের মাঝখানে একটা জ্বলন্ত সিগারেট, তবু তারই ফাঁক দিয়ে হাসির এক ঈষৎ তরঙ্গ বেরিয়ে এলো।

সেলিনা তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ল। আমাকে বললো : শাকের, তুমি নাটক দেখ। আমি এখুনি আসছি!

সুন্দর যুবকটি প্রশ্ন করল : ছেলেটি কে?

সেলিনা জবাব দিল : কোন্ ছেলেটি? ও : ওর কথা বলছ। ও কেউ না। ও শাকের! তারপর তারা চলে গেল।

আমি আবার অভিনয় দেখতে শুরু করলাম। একটু আগেই যতটা ভালো লাগছিল, এখন তেমন লাগল না। আগাগোড়াই কি অভিনয় সমান ভালো হতে পারে। তাই আর তেমন করে মন বসল না।

অভিনয় শেষ হলো। সব ক’টি আলো জ্বলে উঠল। দর্শকদের ভিতর থেকে কারা যেন স্বর্ণপদক ঘোষণা করলেন। হাততালি পেল। সবাই আসন ছেড়ে দাঁড়ালেন। অনেকেই নাটকের ভালো-মন্দ সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করলেন। কেউ কেউ হারিয়ে যাওয়া সঙ্গীকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন।

আবার আলো নিভল। গান শুরু হলো, তাও শেষ হলো।

তবু সেলিনার দেখা নেই।

একে একে সব ক’টি অনুষ্ঠানই শেষ হলো। গেটের কাছে ভয়ানক ভিড়; সবাই এক সঙ্গে বেরিয়ে যেতে চায়। সামিয়ানার নিচে তেমনি গোলমাল; সবাই একসঙ্গে কথা বলতে চায়।

গেটের সামনে ভিড় কমে এলো। একে একে সবাই বিদায় নিলেন, এমনকি শেষধ্বনির বুদ্বুদও মিলিয়ে গেল।

আমি একা আধ-অন্ধকারে নিঃশব্দে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকলাম। চলে যাব কিনা ভাবছি, এমন সময় যুগলে ফিরে এলেন। সেলিনাই বললো : কিছু মনে করো না ভাই। তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। বড্ড মাথা ধরেছিল, তাই কর্নওয়ালিস স্কোয়ারে গিয়ে বসেছিলাম।

আমি কোনো কথাই বললাম না।

এবার হাফ শার্ট পরা ছেলেটি সেলিনাকে জিগ্যেস করল : আবার কবে কোথায় দেখা হচ্ছে? ইন থান্ডার লাইটনিং এন্ড ইন রেন?

—ইন থান্ডার লাইটনিং এন্ড ইন রেনই বটে। যাই হোক, জানতে পারবেই। আমরা বাড়ি ফিরে এলাম।

ক্রিমেটোরিয়াম রোডের কবরস্থানের পাশ দিয়ে হাঁটছি। এই রাস্তাটি রাত্রে বেশ অন্ধকারই থাকে। আমাদের সম্মুখে হাঁটছে আমাদের লম্বা লম্বা দুটি ছায়া—স্তিমিত গ্যাস-লাইটের অপ্রচুর আলোকে সেই ছায়া দুটির অস্তিত্ব যেন আমাদের অস্তিত্বের চাইতেও সত্য মনে হচ্ছিল। পথে লোকজনও অত্যন্ত বিরল। অন্ধকার রাত্রে কবরস্থানের কবরগুলোর সাদা পাথরগুলো ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। প্রতি পদক্ষেপে আঁধারের বুকে এই শ্বেত পাথরগুলো চোখে পড়ে; আর আমাদের উভয়েরই পদধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দও কানে পৌঁছয় না! দুই ছায়া পাশাপাশি হাঁটছে আর দুই জোড়া চরণের ধ্বনি একই তালে বাজছে; পিছনে অতি দূরে দুই পথিকের কথোপকথনের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া বহির্বিশ্বের অস্তিত্ব যেন বিলুপ্ত প্রায়। এই পরিবেশে কেমন করে যেন সেলিনার সঙ্গে এক নিবিড় অন্তরঙ্গতার আত্মীয়তা অনুভব করতে লাগলাম। সেলিনা মাথাটা নিচু করে হাঁটছিল, নানান ভাবনাচিন্তাতেই যেন তার মাথা নত হয়ে গেছে; অত্যন্ত অন্যমনস্ক, আপনাতে আপনি মগ্ন।

অন্ধকারের সমুদ্রে বুদ্বুদের মতো আমার কণ্ঠে ভেসে উঠল : ছেলেটি কে? হিন্দু না মুসলমান?

সেলিনা একটু হাসল। বিচিত্র সে হাসি।

—বলতে পার, রূপের কোনো ধর্ম আছে

—আছে। কারণ যে-আচরণের পিছনে ধর্মের সমর্থন নেই, তা অন্যায়-অসুন্দর।

আবার তেমনি হাঁটতে লাগলাম। কেউ কোনো কথা বলি না। ঐ সামনেই সেলিনাদের বাড়ি। একেবারে বাড়ির কাছাকাছি এসে সেলিনা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল! তার দুটি হাত দিয়ে শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরল। আমার চোখের ওপর তার দুটি চোখ তুলে ধরে বললো : কাউকে বলো না, তোমার পায়ে ধরি।

ভীরু কম্পিত শঙ্কিত কণ্ঠস্বর, যা তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যহীন।

আমি বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম; কিন্তু অবাক হবার আরো বাকি ছিল

সেলিনার ব্লাউজে তার ফাউন্টেন পেনটা আটকানো ছিল। ক্ষিপ্র হাতে সেটি টেনে বের করে সে আমার হাতে গুঁজে দিল।

—তোমাকে দিলাম!

বলে সে বাকিটা পথ প্রায় দৌগে অতিক্রম করে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল।

আমি বিহ্বল দৃষ্টিতে একবার হাতের কলম একবার অপসৃয়মাণ সেলিনাকে দেখতে লাগলাম।

এক পা এক পা করে কখন দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছি আর কতক্ষণই-বা সেখানে সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছি কিছু জানি না। এমন সময় পিছন থেকে মুশতাক তীরের মতো ছুটে এলো।

—আঁধারে দাঁড়িয়ে করছিস কি?

বলেই সেও সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁফাতে লাগল।

—শুনেছিস্ খবর শুনেছিস্। এই দ্যাখ টেলিগ্রাম

স্টেটসম্যানের বিশেষ সংখ্যা। খবর : জাপানিরা পার্ল হারবারে বোমা ফেলেছে—যুদ্ধ ঘোষণা না করেই।

তখন আশ্চর্য বা আতঙ্কিত হবার মতো মনের অবস্থা আমার ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *