উত্তম পুরুষ – ১৯

উনিশ

সানী সাহেবের আখ্যান-বর্ণনায় বিমুগ্ধ চোখের বর্ণচ্ছটার প্রভাব হয়তো আছে। অতীতের দিকে কিছুটা বিমোহিত দৃষ্টিতে ফিরে ফিরে তাকানো মানব চরিত্রের একটা পুরাতন দুর্বলতা। যে- কাল মহাকালের গর্ভে চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে, সেই সময়কার দু’একটি ক্ষুদ্র স্মৃতি যখন চিত্তপটের ওপর ছায়া ফেলে, তখন ছোট্ট একটি অশরীরী দীর্ঘশ্বাস বরঞ্চ অতীতের বন্ধন থেকে মুক্তিই এনে দেয়। যাই হোক, সানী সাহেবের কাহিনীর যে-রেশটুকু এখনো কানে বাজছে সেটুকুও শেষ করে দেয়া যাক।

‘দ্য বৃটিশ গভর্নমেন্ট’ অবশ্য নাসের আর আজিজের একটা কিনার করে দিলেন। প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের কমিশনার স্যার ডানকান ম্যাকডোনাল্ড নাসেরকে ডেকে পাঠালেন তোমার এখুনি চাকরি দরকার? কিছুদিন অপেক্ষা করতে পার না?

নাসের চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন।

—বুঝেছি!

ডিভিশনাল কমিশনারের ললাটে চিন্তার রেখা। লম্বা পাইপে তিনি ধীরে ধীরে টান দিতে থাকেন।

—সাব-ডিপুটি হবে? এখুনি আর কোনো ভেকেনসি নেই। তবে আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, নেকস্ট্ ভেকেনসিতেই আমি তোমাকে ডিপুটি করে দেব। দু’মাস পরেই ভেকেনসি হবে। তোমার ছোট ভাইকে পোর্ট কমিশনারস অফিসে জুনিয়র অফিসার করে দিচ্ছি।

দু’মাস পর ভেকেনসি হলো। কিন্তু নাসের ডিপুটি হলেন না। তার আগেই পোলো খেলবার সময় স্যার ডানকান ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান।

খান বাহাদুর সানীর ইন্তেকালের পর দু’বছর হয়ে গেছে।

সৈয়দ আবু নাসের তখন নওগাঁয়ে আবগারি বিভাগের ছোট সাহেব। সৈয়দ আবদুল আজিজ পোর্ট কমিশনারস অফিসে জুনিয়র অফিসার। উভয়েই অবিবাহিত। খদিজা বিবি থাকেন কলকাতায়, ছোট ছেলের সঙ্গে।

পূজার ছুটিতে নাসের কলকাতা এসেছেন। উদ্দেশ্য : মার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আর বাপের কবর জিয়ারত করা।

সেই ছুটিতেই কলকাতা এলেন মালদহের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর মতিন উদ্দিন চৌধুরী—সপরিবারে এসে উঠলেন কলকাতার এডিশনাল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. হাবিবুর রহমানের বাসায়।

দিন দু’-এক পর তেত্রিশ নম্বর কোমেদান বাগান লেনে একটা ব্রহাম এসে দাঁড়ালো। বহুদিন এই বাড়ির গেটে কেউ ব্রুহাম বা ল্যান্ডো দেখে নি।

গাড়ি থেকে নাবলেন খান বাহাদুর চৌধুরী। বেঁটেখাটো লোক, পরনে হাফ প্যান্ট হাফ শার্ট, চোখে সোনার চশমা, মুখে চুরুট, হাতে সোনার বাঁট লাগানো ছড়ি

দুটি পায়ে ক্ষিপ্র গতি।

–তোমার নাম কি?

–জি, আজিজ।

চৌধুরী সাহেবের চোখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

–তোমার চাচাজান কোথায়?

—জি, কোন্ চাচাজান?

—প্রিন্সিপাল আবদুল গনি।

—তিনি থাকেন ইউরোপিয়ান এসাইলাম লেনে।

–বেশ। আমি সেখানেই যাচ্ছি। তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। চৌধুরী সাহেব যেমন ক্ষিপ্র পদে এসেছিলেন, তেমনি দ্রুতপদে চলে গেলেন।

আজিজ অনেকটা হতবুদ্ধি হয়েই দাঁড়িয়ে থাকলেন।

কিন্তু আবার-দেখা-হবে মানে যে এই তা কি আর তিনি ভেবেছিলেন। দু’কথায় আজিজের সঙ্গে চৌধুরী সাহেবের বড় মেয়ের বিয়ে পাকা হয়ে গেল।

আবু নাসেরের সঙ্গে হাবিবুর রহমানের মেয়ের বিয়ে অবশ্য অত সহজে পাকা হতে পারে নি। চৌধুরী সাহেবেরই মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত তাও সম্ভব হলো।

হাবিবুর রহমান বহুদিন পর আবার তেত্রিশ নম্বর কোমেদান বাগান লেনে এলেন। খজিদা বিবির কাছে মাফ চাইলেন। বললেন : আমাকে আপনি মাফ করতে পারবেন না। কিন্তু আমার মেয়েকে দেখলে আপনি রাগ করে থাকতেও পারবেন না। মেয়েটি বড় নেক।

হাবিবুর রহমানকে এখন দেখলে বজ্রাহত বনস্পতির কথাই মনে পড়ে। হয়তো তাতেও খদিজা বিবি রাজি হতেন না।

কিন্তু হাবিবুর রহমান যখন বললেন, মেয়েটি বড় নেক, তখন বহুদিন আগেকার একটি বিস্মৃত প্রায় কথা তাঁর কানে বাজতে লাগল। একটি ছোট পোস্ট কার্ডে এই মেয়েটিরই জন্মবার্তা পেয়ে খান বাহাদুর সানী বলেছিলেন : মেয়েটি খুশনসিব। এই শুনে রাখো আমার কথা।

সুতরাং এই বিয়েও পাকা হয়ে গেল।

খান বাহাদুর আবদুস সানীর দুই ছেলের বিয়ে। ভীম নাগের দোকান থেকে সন্দেশ এলো : কোলুটোলা থেকে এলো মাওয়ার লাড্ডু, আতর আর গোলাপ-পানি, নতুন বাজারের স্টল থেকে এলো ফুল আর নেশাসতার হালুয়া। হোয়াইটওয়ে লেডল দুই নওশাকে সুট বানিয়ে দিল।

প্রিন্সিপাল আবদুল গনি দাম দেয়ার জন্য হাত বাড়ালেন। দুই হাত দিয়ে সেই হাত ধরে ফেলে তাঁরা বললেন : তওবা তওবা। তাও কি হয়। কার ছেলের বিয়ে তা কি আমরা ভুলতে পারি। তাঁর কাছ থেকে অনেক পয়সা পেয়েছি। এ আমাদের তরফ থেকে সামান্য তোফা।

কোনো আপত্তিই তারা শুনলেন না।

বিয়ে হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *