আঠারো
ব্রুহামের চাকা ঘুরতে থাকে। বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়। হাবিবুর রহমান সাহেব চাকরি জীবনে দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় তিনি কলকাতার এডিশনাল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট।
খান বাহাদুর আবদুস সানী আর মাত্র ছ’মাস পরই রিটায়ার করবেন। পুলিশের এ্যাসিসটেন্ট কমিশনার আর এডিশনাল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যে প্রায়ই দেখা- সাক্ষাৎ হয়। আদালতে, কেল্লার ময়দানে, কনফারেন্সে, আরো কত জায়গায়।
কিন্তু দুটি ঘটনা হাবিব সাহেব কোনোদিন ভুলতে পারেন নি। এক, তার সমস্ত উন্নতির মূলে আছেন খান বাহাদুর সাহেব। দুই, সেই সন্ধ্যার কথা—যে দিন খান বাহাদুর সাহেব দরজা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
অথচ তাঁর সমস্ত অন্তঃকরণ এই দুই সত্যই অস্বীকার করতে চায়।
কোনো কোনো মামলায় সানী সাহেবকে হাবিব সাহেবের এজলাসে আসতে হয়। তখন তিনি চেয়ারকে স্যালুট দেন। আদালতসুদ্ধ লোক যে স্যালুট দিল তাকেই দেখতে থাকে, যে পেল তাকে তেমন করে দেখে না। তবু সেই সময় এক অনাস্বাদিত-পূর্ব চরিতার্থতায় হাবিব সাহেবের বুক ভরে যায়।
সানী সাহেব অপরিসীম উদাসীন।
এই জীবনে তিনি বহু দেখেছেন। বহু নাটকের তিনি দর্শক, বহু নাটকের তিনি নায়ক। জীবনে ভালোবেসেছেন, ক্ষমা করেছেন, প্রচণ্ড উষ্মায় উন্মত্ত হয়েছেন; কিন্তু কোনোদিন প্রতিহিংসায় খড়গহস্ত হতে পারেন নি।
চেয়ারে বসা হাবিবকে তাঁর চোখে যাত্রার মঞ্চের রাজার মতোই হাস্যকর মনে হয়। এই লোকটির বিরুদ্ধে তিনি কোনো আক্রোশই বোধ করেন না।
সেদিন অফিস-আদালতে, চায়ের দোকানে, খেলার মাঠে, লোকের মুখে মুখে, সংবাদপত্রের স্তম্ভে, একই কথা।
খান বাহাদুর আবদুস সানী এডিশনাল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটকে ফেলে দিয়েছে।
সে কি?
হ্যাঁ। আদালতসুদ্ধ লোকের চোখের সামনে পাঁজা কোলা করে তুলে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে। তখন যদি খান বাহাদুরকে দেখতে! মনে হচ্ছিল, আরব্য উপন্যাসের পৃষ্ঠা থেকে এক দৈত্য বেরিয়ে এসেছে। এডিশনাল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কি এক অপমানকর মন্তব্য করেছিলেন।
খান বাহাদুর কোনো কথা না বলে দু’হাত দিয়ে তুলে আছাড় দিয়েছে।
‘সন অফ আবদুল গফফার! এন্ড এ গ্রেট অফিসার হিমসেলফ।’ তার ওপর যথেষ্ট প্রভোকেশন ছিল। তাই খান বাহাদুরের বিশেষ কিছু হলো না। সরকার তাঁকে রিটায়ার করতে বাধ্য করলেন!
কিছুদিন পর পুলিশ কমিশনার এলেন।
—আই কান্ট সে আই ক্যান কনগ্রাচুলেট ইউ। এন্ড ইয়েট, ওয়েল…। ইট ইজ ওয়ান অফ দোজ্ প্যারাডকস এজ।
—নাথিং এলস ওয়ারিজ মি। ওনলি মাই সন্স…
—ইওর সন্স! আবদুল গফফার’স গ্র্যান্ড সন্স! দ্য বৃটিশ গভর্নমেন্ট উইল লুক আফটার দেম।
খান বাহাদুর কোনো জবাব দিলেন না। একটু হাসলেন। বাইরের লোকের সঙ্গে তাঁর সেই শেষ সাক্ষাৎ।
আবার ছয় মাস পর সকলে তাঁকে শেষবারের মতো দেখল। কোমেদান বাগান লেনে লোক আর ধরে না।
জানাজা চলল ‘গোরে-গরিবান।’ পিছনে শত শত লোক। সবার মুখে এক কথা :
—পাড়ার রাজা চলে গেল।
পুলিশ কমিশনার—সাহেব মানুষ; কিন্তু তাঁর চোখেও পানি।
—এ প্রিন্স এমং মেন! এ মোস্ট ব্রিলিয়েন্ট অফিসার। দ্য এন্ড অফ এন ইনস্টিটিউশন। টেক মাই স্যালুট খান বাহাদুর।
পুলিশ কমিশনার তাঁর টুপি খুলে হাতে নিলেন।
হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান সবাই চলল।